একদিন এক লোক স্বপ্নে দেখলেন, একটা অসম্ভব সুন্দর আকাশচারী কবুতর তার কোলে এসে পড়লো। পরে তিনি স্বপ্ন বিশারদদের কাছে গিয়ে জানতে পারেন, অদূর ভবিষ্যতে তিনি একজন ভাগ্যবান পুত্রের বাবা হতে যাচ্ছেন। লোকটি খুব বেশি শিক্ষিত মানুষ ছিলেন না, কিন্তু তার পান্ডিত্যের কারণে শামসুল উলামা সৈয়দ মীর হাসান তাঁকে “অশিক্ষিত দার্শনিক” উপাধি দিয়েছিলেন।
পুত্রের জন্মের পরপরই তিনি সদ্যজাত শিশু পুত্রকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, বড় হয়ে দ্বীনের খেদমত করলে বেঁচে থাকো, না হলে এখনই মরে যাও। ছোটোকাল থেকেই পিতামাতার দ্বীনী চেতনায় শিশুটিও ঋদ্ধ হতে থাকে এবং সত্যিই সারা বিশ্বের কাছে এক আলোচিত নাম হয়ে উঠেন।
কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশেই কেবল তিনি আস্তে আস্তে আড়ালে চলে যান। পল্লীকবি জসীমউদ্দিন তাঁর ‘পথ ভোলা কবি’ কবিতায় দেশের অসহায় মানুষের হয়ে মানবতার কথা বলতে কবি ইকবালকে আহ্বান করেন এবং কবিতার পরের অংশেই আক্ষেপ নিয়ে বলেন-
“মিথ্যা তোমারে আহ্বান করি করিলাম অপমান
আমরা আজিও প্রস্তুত নহি লইতে তোমার দান।
মানুষেরে মোরা দিতে পারিনাই মানুষের অধিকার
মানুষেরে লয়ে শিখিয়াছি কেবল বিকি কিনি কারবার
অহমিকা ভরে একের কথারে পুরিতে অপরের মুখে
ব্যর্থ প্রয়াস করিয়া ফিরিছি আমরা নকল সুখে।”
ইকবালের কাব্যের মূল বিষয় ছিলো তার দার্শনিকতা। তাঁর কাব্যদর্শনের মূল কথা ছিল মানবতাবাদ, উম্মাহর প্রতি মমত্ববোধ, ইসলামের আদর্শে তাওহীদভিত্তিক বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, বৈষম্য ও কলহ নিরসনসহ বিভিন্ন বিষয়। ঘুমিয়ে পড়া যুব সমাজকে জাগিয়ে তোলাই ছিলো তাঁর মূল উদ্দেশ্য। মুসলিমদের বর্তমান ঘুমন্ত অবস্থা দেখে তিনি তাঁর শিকওয়া (অভিযোগ) গ্রন্থে লিখেছেন-
“কোথায় আজি সেই সে হৃদয়? কোথায় আজি সেই সে উন্মিদ?
ঘর আমাদের উজাড় আজি! ঘিরেছে আজ মরণ-নিদ!”
আমাদের হারিয়ে যাওয়া শৌর্য বীর্যের আবেগী বর্ণনার চিত্রায়নে তিনি আমাদের করেন অনুপ্রাণিত। একই গ্রন্থে তিনি বলেছেন-
বস রাহে থে এহী সেলজুক ভী তুরানী ভী/ আহলে চীন চীন মে, ইরান মে সাসানী ভি
ইসী মামূরে মে আবাদ থে ইউনান ভী/ ইসী দুনিয়া মে ইয়াহুদী ভী থে নাছরানি ভী
পার তেরে নাম পে তলওয়ার উঠায়ী কিসনে?/ বাত জো বিগড়ী হোই থী, ওহ বানায়ী কিসনে?
অর্থাৎ,
“সেলজুক আর তুরানিরা বাস করিত হেথায় বেশ/ চীন দেশেতে ছিলো ছিল চীনা, সাসানিরা ইরান-দেশ
এই ধরাতেই ছিল প্রাচীন সভ্যজাতি ইউনানি/ ইহুদি আর নাসারারা-জানি মোরা-তাও জানি।
কিন্তু, বল, তোমার তরে তলোয়ার ধরল কে?/ বিগড়ে যাওয়া তোমার বিধান কায়েম আবার করলো কে?”
কিংবা ,
থে হামে এক তেরে মারেকাহ আরাউঁ মে!/ খুশকিউঁ মে কভী দরইয়াউ মে;
দীঁ আজানে কভী ইউরোপ কে কলিসাউঁ মে/ কভী আফ্রিকা কে তাপতে হুয়ে সহরাউঁ মে।
অর্থাৎ,
“মোরাই ছিলাম যোদ্ধা তোমার-বীর মুজাহিদ-সে নির্ভিক/ স্থলে জলে তোমার তরে যুদ্ধে গেছি দিগ্বিদিক।
কখনো বা আযান দিয়েছি ইউরোপের ওই গির্জাতে/কখনো বা তপ্ত-বালু আফ্রিকার ওই সাহারাতে।”
• শৈশব, শিক্ষা ও কর্মজীবন :
পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের শিয়ালকোটে ১৮৭৭ সালের ৯ নভেম্বর মোহাম্মদ ইকবালের জন্ম। বাবা নূর মোহাম্মদ ও মা ইমাম বিবি দুজনেই ছিলেন অত্যন্ত দ্বীনদার মানুষ। কবির পূর্বপুরুষ কাশ্মীরবাসী সাপ্রু গোত্রীয় ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাঁরা সুলতান জয়নুল আবেদীন ওরফে বুদ শাহ-এর রাজত্বকালে ইসলাম গ্রহণ করেন।
তাঁর বাবা তাকে মাদ্রাসায় পড়াতে চাইলেও উস্তাদ শামসুল উলামা মীর হাসানের পরামর্শে তাকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করা হয়। ১৮৯৩ সালে স্কচ মিশন স্কুল ও কলেজ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন ও ১৮৯৫ সালে এফ. এ পরীক্ষাতেও প্রথম বিভাগে পাশ করেন। স্কচ স্কুলে থাকাকালীন একদিন ইকবাল দেরীতে ক্লাসে আসেন, শিক্ষক দেরীর কারণ জিজ্ঞেস করায় তিনি বলেছিলেন, ‘ইকবাল (সৌভাগ্য) দেরীতে আসে স্যার!’ তাঁর উত্তরে শিক্ষক হতভম্ব হয়ে যান।
১৮৯৭ সালে তিনি আরবী ও ইংরেজীতে সমগ্র পাঞ্জাবে প্রথম স্থান নিয়ে বি.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং দুটি স্বর্ণপদক লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি দর্শনশাস্ত্রে এম.এ পাশ করেন এবং কলকাতা ওরিয়েন্ট কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯০৫ সালে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডন যান এবং কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে এম.এ ডিগ্রী লাভ করেন। পরবর্তীতে জার্মানীর মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে Development of Metaphysics in Persia নামে পারস্য-দর্শন বিষয়ক থিসিস লিখে পিএইচডি অর্জন করেন। এই থিসিসটি বই আকারে প্রকাশিত হলে বিজ্ঞসমাজে তার বেশ নামডাক পড়ে যায়। এরপর তিনি Lincon’s Inn থেকে ব্যারিস্টারী পাশ করেন।
দেশে ফিরে তিনি বিপুলভাবে সম্বর্ধিত হন এবং আইন ব্যবসায় নিয়মিত হন। কিন্তু তিনি কখনো মাসিক খরচের টাকা আয় হয়ে যাওয়ার পর আর কোনো মোকাদ্দমা হাতে নিতেন না। এমনকি যদি কোনো মোকদ্দমায় মক্কেলের তেমন উপকার করতে পারবেন না বলে মনে হতো, তিনি সেটিও নিতেন না।
১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৯৩৭ সালে ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে ডি.লিট ডিগ্রী প্রদান করা হয়।
• ইকবালের রাজনৈতিক দর্শন
ইকবাল মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের শোচনীয় অবস্থা ও গোলামী, এবং পরাধীনতা ও তাদের উপর নানা নির্যাতন দেখে কষ্ট পান এবং আল্লাহর কাছে অভিযোগ করে ১৯০৯ সালে শিকওয়া গ্রন্থটি রচনা করেন। কিন্তু গোটা মুসলিম বিশ্বে এর চর্চা হওয়ার পর অসংখ্য উলামা বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাঁকে দোষারোপ করা শুরু করেন, এমনকি কেউ কেউ তাঁকে ফাসেক, মুরতাদও ঘোষণা করে বসেন। তা দেখে ইকবাল শিকওয়া-এর উদ্দেশ্য পরিষ্কার করার জন্য ১৯১৩ সালে জাওয়াবে শিকওয়া বা “শিকওয়ার জবাব” লিখেন। তখন বিষয়টি সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়, এবং তাঁরা তাদের পূর্বের ফতোয়া তুলে নিয়ে তাঁকে ‘আল্লামা’ উপাধীতে ভূষিত করেন। তিনি “জওয়াবে শিকওয়া” বলকান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লাহোরের মুচিদরওয়াজায় এক কবিতা পাঠের আসরে পড়ে শোনান এবং আবৃত্তির পরপরই বইটির এক লক্ষ কপি বিক্রয় হয়ে যায়, যার বিক্রয় লব্ধ অর্থ তিনি বলকান যুদ্ধের মুজাহিদদের জন্য দান করে দেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম’ এর কথা হয়তো সবার জানা, তার কাছে স্বদেশ ছিলো বাংলা আর তার ভাষ্যে স্বজাতি ছিলো কেবল বাঙালি হিন্দু। অন্যদিকে ইকবাল লিখেছেন তারানায়ে হিন্দ, তাঁর দেশ সমস্ত বিশ্ব এবং তাঁর স্বজাতি সমগ্র বিশ্বের মুসলমান। কিন্তু তাঁর লেখায় বঙ্কিমের মতো সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ কখনো উঠে আসেনি।
“চীন অউর আরব হামারা, হিন্দুস্তাঁ হামারা/
মুসলিম হ্যায় হাম, উতনি সারা জাহাঁ হামারা”
অর্থাৎ,
“আরব ও চীন আমাদের, হিন্দুস্তান আমাদের,
আমরা মুসলিম, সারা বিশ্বজগত আমাদের।”
ইকবাল বিশ্বাস করতেন ধনী, গরিব, দেশ ,জাতি, বর্ণ – সবরকম ভেদাভেদ ভুলে ইসলাম এক বিশ্বভ্রাতৃসমাজ গঠন করতে পারে। ইসলামি বিশ্ব ও মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কার ও দর্শন নিয়ে তিনি লিখেছেন “Reconstruction of Religious Thoughts in Islam” বা “ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন”, যা বিশ্বে অসংখ্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
এটি তাঁর মোট সাতটি ভাষণের সংকলন গ্রন্থ। জার্মানিতে জার্মান ভাষায় বইটি প্রকাশিত হলে এর বিষয়বস্তু নিয়ে সেখানে আলোচনার ঝড় বয়ে যায়। সে দেশের বুদ্ধিজীবীরা তাঁকে ‘ইসলামী নবজাগরণের চিন্তাবিদ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন।
ইকবাল নিজে যেমন ছিলেন বুদ্ধিজীবী, তেমনি তিনি মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্মেষেরও প্রবল আকাঙ্ক্ষী ছিলেন। মুসলমানদের আলস্য, দূর্বলতা আর চিন্তাহীনতা নিয়ে তাঁর আফসোস দেখতে পাওয়া যায় এক বক্তব্যে-
“সিংহের মাথার উপর আজ বিড়াল খেলা করছে, বড়ই দূর্ভাগ্য মুসলমানদের, তারা শাহাদাতের আকাংক্ষা ভুলে গিয়ে তাসবিহর দানার মধ্যে জান্নাত খুঁজছে।…”
• পাশ্চাত্য দর্শন বনাম প্রাচ্যের উপলব্ধি
পাশ্চাত্যে অবস্থানকালে সেখানকার বস্তুবাদী চিন্তাধারার অসাড়তায় তিনি আস্থা হারান এবং তা তাঁর মনে যে চেতনার সৃষ্টি করে তা নিয়ে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন,
“ইউরোপ প্রবাসকালে তাঁহার ভাবরাজ্যে এক যুগান্তর উপস্থিত হয়। এশিয়ার ভাবুকতার সহিত ইউরোপের কর্মপ্রিয়তার যোগ সাধিত হয়। কিন্তু তিনি লোক-উক্তির রাজহংসের ন্যায় ইউরোপের মন্দ নীর ছাড়িয়া উত্তম ক্ষীরই গ্রহণ করিয়াছিলেন। তাই তিনি ইউরোপের অন্ধ অনুকরণ ছাড়িয়া তাহার যা কিছু উত্তম, তাহাই গ্রহণ করেন। এখন হইতে তাঁহার কবিতায় স্থিতির নিন্দা এবং গতির উচ্চ প্রশংসা শুনিতে পাই। ইউরোপের আত্মগ্রাসী জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে তিনি বিশ্বাশ্লেষী আন্তর্জাতীয়তার মহিমা কীর্তন করিতে থাকেন। তিনি নিটশের শয়তানিক Superman (অতিমানুষের) এর স্থলে ইসলামের ঐশ্বরিক ‘মুমিনের’ জয় ঘোষণা করিতে থাকেন।… তাঁহার দিব্যদৃষ্টি ইউরোপের বাহিরের অসার তুষের মধ্যে তাহার ভিতরের সারশস্যকে লক্ষ্য করিয়াছিল।”
ইউরোপের জীবনযাত্রা তাঁকে উপলব্ধি করায় মুসলিম হিসেবে তাঁর কী করণীয়। এক চিঠিতে তিনি বলেন, “ইউরোপের আবহাওয়া আমাকে মুসলমান বানিয়েছে।” ইউরোপের অভিজ্ঞতা ও তাঁর নিজস্ব চেতনার সংমিশ্রণে ১৯১৫ সালে তিনি উপহার দেন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “আসরার–ই–খুদি” বা “ব্যক্তিত্বের গূঢ় রহস্য”। এ. আর. নিকোলসন এটির অনুবাদ ‘Secrets of the self’ বের করলে সমগ্র পশ্চিমা বিশ্বে আল্লামা ইকবালের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ইকবালের বিশ্বাস ছিলো, প্রাচ্যদেশ থেকে প্রচারিত ইসলামের আদর্শ পৃথিবীতে আবার মৈত্রী ও মুক্তির মন্ত্র ফিরিয়ে আনবে।
রাজনৈতিক ও সামাজিক দর্শন হিসেবে ইকবাল জাতীয়তাবাদকে অসম্পূর্ণ বলে মনে করতেন। কারণ জাতীয়তাবাদ শুধু যুদ্ধ ও দ্বন্দ্বেরই জন্ম দেয় না, আধ্যাত্মিকতার বিচারেও এটির কোন সন্তোষজনক চরিত্র দৃশ্যমান নয়। এটা পুরাতন গোত্রীয় মানসিকতার আধুনিক প্রকাশ মাত্র। জন্মস্থান অনুযায়ী মানুষকে বিচার করার অর্থ মানুষের ব্যক্তিত্বকে হানি করা। এটা মানুষের গায়ের রং বা নাকের গঠন অনুযায়ী মানুষকে বিচার করার বর্বর পদ্ধতির আধুনিক সংস্করণ মাত্র। জাতীয়তাবাদ নিয়ে এই ধরনের সমস্যা মৌলিক। আর এর সমাধানের পথও মৌলিক হওয়া চাই। জাতীয়তাবাদ যদি রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে ভ্রান্ত হয় তবে এর পরিবর্তে কী আসবে? কারণ প্রকৃতির মতোই মানবীয় মনও শূন্যতাকে ধরে রাখে না। জাতীয়তাবাদকে প্রতিস্থাপিত করবার জন্য পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীদের বহুজাতিকতাবাদ (Cosmopolitanism) বা সমাজবাদীদের আন্তর্জাতিকতাবাদ একটা বিকল্প হতে পারে। কিন্তু ইকবালের কাছে দুটোকেই অপর্যাপ্ত বলে প্রতীয়মান হয়েছে। কারণ বহুজাতিকতাবাদ একটা হালকা ধারণা যা সামাজিক দায়িত্বগুলোকে অবহেলা করার পথ করে দেয়। অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিকতাবাদ পশ্চিমা বস্তুবাদী দর্শনের একটি প্রান্তিক রূপ, যা ইকবালের কাছে মোটেই গ্রহণীয় মনে হয়নি।
ইকবাল তাই নতুন করে ইসলামের দিকে ফিরে তাকালেন। কারণ এই ইসলাম সব রকমের রক্ত, বর্ণ, গোত্রের পার্থক্য ছুঁড়ে ফেলে প্রথমে আরব, তারপরে মধ্যপ্রাচ্য, শেষে এশিয়া, আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে এক ইসলামী ভ্রাতৃত্বে আবদ্ধ করেছিল। অষ্টম শতাব্দীর এই ইসলামের প্রসারকে তিনি এক ধরনের আধ্যাত্মিকতার বিকাশ বলে মনে করতেন, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ক্ষমতার সম্প্রসারণ হিসেবে নয়। তিনি প্রায়ই আরব সেনাপতি তারিকের কথা বলতেন, যিনি জিবরালটার প্রণালী অতিক্রম করে আন্দালুসিয়ায় পৌঁছে নিজের সৈন্যদের বলেছিলেন, “জাহাজগুলি পুড়িয়ে দাও। আমাদের আর ফিরে যাবার প্রয়োজন নেই। কারণ প্রতিটি দেশই আমাদের দেশ। কারণ প্রতিটি দেশই আল্লাহর।” এভাবে মানুষ ও তার ভাগ্যকে এক আধ্যাত্মিক আনুগত্যের ভিত্তিতে তিনি বিবেচনা করলেন। তিনি ইসলামী দুনিয়াকে বিশেষ করে ভারতীয় মুসলমানদের ভাগ্যবাদের শিকল থেকে বের করে এনে এক কর্মচঞ্চলতার দিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করলেন। ইসলামী আদর্শের সুপ্ত তেজবহ্নিকে ফিরিয়ে এনে তিনি তাদের প্রতিশ্রুত ভূমির স্বপ্ন দেখালেন। ইকবালের এই বিকল্প চিন্তার গুণাগুণ নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু ইউরোপীয় আধুনিকতার মৌলিক ত্রুটি চিহ্নিত করে যে বিকল্প স্বপ্ন তিনি দেখালেন তার মধ্যে কোন খাদ ছিল না। এই ভাবে ইকবাল ওয়াতানিয়াত থেকে এক মিল্লাতের ধারণায় এসে পৌঁছলেন।
ইকবাল বলেন, “শুধুমাত্র সংগঠন-শৃঙ্খল দিয়েই একটি জাতির ভাগ্যকে বিনির্মাণ করা যায় না। বরং তার চেয়ে বেশী প্রয়োজন হল সমাজের মানুষের ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও শক্তি। সংগঠনের বাড়াবাড়ির ফলে ব্যক্তিত্বের বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। এমন অতি সংগঠিত সমাজে ব্যক্তি একদিক দিয়ে শক্তিলাভ করলেও অন্যদিকে তার আপন আত্মারই ঘটে অবলুপ্তি। সমাজের অধঃপতন রোধে একমাত্র কার্যকরী পথ হচ্ছে সেই সমাজে আত্মশক্তি প্রবুদ্ধ মানুষ গড়ে তোলা। একমাত্র তারাই পারেন জীবনের গভীরতার উদ্দেশ্য দিতে। তাদের জীবনে যে নতুন আদর্শ প্রতিষ্ঠা লাভ করবে, তার আলোকে আমাদের বোধগম্য হবে যে, আমাদের বিদ্যমান পারিপার্শ্বিকতা এমন অখণ্ডনীয় কিছু নয়, এবং অবস্থা ভেদে তাঁর সংশোধন আবশ্যক”।
আল্লামা ড. মুহাম্মাদ ইকবালের মানবতার বাণী ধ্বনিত হয় শুধু প্রাচ্যে নয়, বরং পাশ্চাত্যের আঙিনায়ও। আর তাঁর মানবতাবোধ সমৃদ্ধ ছিলো আধ্যাত্মবাদের বুনিয়াদে। ইকবালের মত হচ্ছে, আজকের দুনিয়ায় মানবতার দাবি তিনটি-
১. এ দুনিয়াকে এক আধ্যাত্মিক সত্তা হিসেবে ব্যাখা করতে হবে।
২. ব্যক্তির আধ্যাত্মিক সত্তাকে মুক্তি দিতে হবে।
৩. এমন এক বিশ্বজনীন নীতি গ্রহণ করতে হবে যার কল্যাণে মানবসমাজের বিবর্তন একটা আধ্যাত্মিক ভিত্তিতে হবে।
ইনসান-ই-কামিল:
ইকবাল দর্শনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ‘ইনসান-ই-কামিল’। কারণ তার চিন্তার মৌলিক বা মূল বিন্দু এটি। ইকবালের পরিপূর্ণ মানবের ধারণা কোরআন থেকেই তৈরি হয়েছে। আর এটির মূল ভিত্তিও কোরআন। ইনসান-ই-কামিলের ধারণা মুসলিম চিন্তা জগতে অনেক কাল ধরেই চর্চা হয়ে আসছে। আবদুল করিম আল জিল্লী ও মহিউদ্দিন ইবনুল আরাবীর মতো সুফী তাত্ত্বিকরা এসব বিষয়ে নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। ইকবাল মুমিনের জীবনকে বিবেচনা করেছেন গতিশীল ও কর্মশীল হিসেবে। কর্মবিমুখ নিশ্চল ও সংগ্রামবিহীন জীবন তার কাছে অর্থহীন। এই কর্মশীলতার প্রকৃতি হবে সৃষ্টিশীল ও মৌলিক। কারণ মানুষের সৃষ্টিশীল চেতনা তাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং অসম্পূর্ণ বিশ্বকে সমৃদ্ধশালী করে তোলে।
ইকবালের ইনসান-ই-কামিলের সাথে শক্তিমানতার একটি দিক আছে। অনেকেই আবার ইকবালের এই চিন্তার সাথে নীটশের Superman ধারণার সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা করেন। নীটশের কিছুটা প্রভাব ইকবালের উপর পড়েছিলো এবং তিনি নীটশের কিছুটা প্রশংসা ও করেছিলেন। কিন্তু তারা দুজন দুটি ভিন্ন অবস্থান থেকে এটিকে গ্রহন করেছিলেন। নীটশে করেছেন নাস্তিকতার চাদরে। আর ইকবাল করেছেন বিশ্বাসী হিসেবে। ক্ষমতার পক্ষে নীটশের ওকালতি এবং মানব সমাজে ইসলামের ইতিবাচক অবদানকে নিয়ে নীটশের প্রশস্তি ইকবালকে তার দিকে আকর্ষণ করেছিল। কিন্তু নীটশের নাস্তিকতা তাকে টানেনি।
ইকবালের ইনসান-ই-কামিল হচ্ছে একটি নৈতিক সৃষ্টি যার আছে আধ্যাত্নিক আলো, ঐশী আইনের মধ্যে যার কর্ম সীমিত এবং নিজেই নিজের সৃজন কর্তা। তবে এই দুই জন দার্শনিকের কিছু কিছু জায়গায় মিল থাকলেও তাদের মধ্যে বিরাট পার্থ্যক্য রয়েছে। ইকবালের পরিপূর্ণ মানব আল্লাহর নবীকে অনুসরণ করে স্বার্থকতায় পৌঁছায়। ইকবাল নীটশের অতিমানবের গতিশীলতায় মুগ্ধ হলেও তিনি এর অসামাজিক, অধার্মিক, অনৈতিক গুণরাজিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাই অতিমানব ইকবালের ইনসান-ই-কামিলের সম্পূর্ণ বিপরীত। আবার ইকবালের ইনসান-ই-কামিল সুফিদের ইনসান-ই-কামিলের ধারণার মতোও নয়। কারণ ইকবালের ইনসান-ই- কামিলের মধ্যে যেমন জীবন বিমুখতাও নেই তেমন তকদির নির্ভরতাও নেই। এমন মানব যে নিজের অস্তিত্বকে খোদার অস্তিত্বে বিলিন করে দিতে চায় না। বরং সংগ্রামের ভিতরে দিয়ে বিশ্বকে জয় করে এবং পরিণতিতে খোদা ও পৃথিবীকে নিজের মধ্যে আত্নস্থ করে।
জীবনে পরিপূর্ণতা অর্জনের জন্য ইকবাল নিজের সাথে যুদ্ধ ঘোষনার পরামর্শ দিয়েছেন। কেননা বিশ্বাসী(মুমিন) মানুষ হলেন জীবন্ত এবং তাকে এগিয়ে যেতে হবে নিজের সাথে যুদ্ধ করে। এই জাগ্রত ও গতিধর্মী মানবের পরিপূর্ণতার পথে ৩ টি আলোকবর্তিকা রয়েছে:
১. নিজের আলোকে নিজেকে দেখা।
২. অন্যদের আলোকে নিজেকে দেখা।
৩. ঐশী আলোকে নিজেকে দেখা।
ইকবাল দর্শনে মানুষের এই স্তরকেই বলা হয় পূর্ণতার স্তর। ইকবাল এই মানুষকেই অভিনন্দন জানিয়েছেন ইনসান-ই- কামিল হিসাবে। যুগ যুগ ধরে মানুষ যাদের দেখে পথের দিশা পায় আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল ছিলেন তাদেরই একজন। আল্লাহর সমীপে ইকবালের প্রার্থনা ফুটে উঠেছে তার কাব্যের মধ্য দিয়ে:
“ইয়া রব! দিলে মুসলিম কো ওহ জিন্দা তামান্না দে,
জো কলব কো গড়মা দে, জো রুহ কো তড়পা দে।”
অর্থাৎ,
“হে রব, মুসলমানদের অন্তরে তুমি জীবন্ত উদ্দীপনা জাগিয়ে দাও, যা কলবকে উত্তপ্ত করে উজ্জীবিত করে নির্জীব আত্নাকে।….”
• দেশভাগ ও আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার কায়েম
কাব্যপ্রতিভার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন কূট রাজনীতিবিদ। ১৯১৯ সালে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের এক যৌথ সভায় যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতির সাথে তার সম্পির্ক গড়ে উঠে।
১৯৩৭ সালে কায়দে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে লেখা এক চিঠিতে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তাঁর ইনসাফপূর্ণ মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি চিঠিতে আলী জিন্নাহকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, উত্তর-পশ্চিম ভারত এবং বাংলার মুসলিমদের একটি স্বতন্ত্র জাতিরূপে স্বীকৃতি দেয়া হবে না কেন, যাতে তারা ভারতের এবং ভারতের বাইরের অন্যান্য জাতিসমূহের মত আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার পেতে পারে?
উসমানী খেলাফত পতন পরবর্তী সময়ে বিশ্ব রাজনীতির মোড় ঘুরে যায়। সারা পৃথিবীতে মুসলমানদের সালতানাত সমূহ একে একে ধ্বসে পড়তে থাকে। মুসলিম বিশ্ব অভিভাবকহারা হয়ে পড়ে। কেউই বুঝে উঠতে পারছিলোনা, এই নতুন বিশ্বব্যবিস্থায় টিকে থাকার জন্য মুসলমানদের কী করা উচিৎ। এসময়ে আল্লামা ইকবালই রাজনীতির নতুন রূপরেখা তুলে ধরেন। “ইসলামের ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন’ গ্রন্থে তিনি তৎিকালীন বিশ্ব-রাজনীতিকে বিস্তৃত পর্যালোচনা করে নতুন প্রস্তাবনা হাজির করেন। পরবর্তীতে সারা দুনিয়াব্যপী যেসব ইসলামী আন্দোলনগুলো শুরু হয়েছিলো- সেগুলো ইকিবালের চিন্তার বাস্তবিক রূপায়নই বলা চলে। যদিও দেশভেদে, সমাজভেদে এর প্রয়োগ হয়তো ভিন্ন ভিন্ন হয়েছে।
• সাহিত্য চর্চা
ইউরোপ প্রবাস যেমন ইকবালের চিন্তায় ভাবান্তর এনেছিল তেমনি কাব্য চর্চায়ও এক যুগান্তরের সূচনা করেছিল। ইউরোপে বসেই তার ফারসি কবিতা রচনার সূত্রপাত। এর আগে তিনি ফারসিতে দু’এক পংক্তি লিখেছিলেন ঠিক, কিন্তু পুরো একটি ফারসি কবিতা তার কলম থেকে কখনো বের হয়নি। ইউরোপে আসার আগ পর্যন্ত তিনি উর্দু ভাষার কবি ছিলেন এবং এই ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করে এই ভাষার বিকাশ সাধনের বাসনা তখন পর্যন্ত তার মনে গুঞ্জরিত হতো। একটি কবিতায় তিনি লিখেছিলেন : প্রদীপ চায় কিছু উৎসাহী পতঙ্গের হৃদয় উৎসর্গ। এই প্রদীপ বলতে তিনি উর্দু ভাষাকেই বুঝিয়েছিলেন। কিন্তু লন্ডনে বসে তার ভবিষ্যৎ কবিতার বাহন হিসেবে তিনি বেছে নেন ফারসি ভাষাকে। ঘটনার শুরু এভাবে, যার বর্ণনা বন্ধু আবদুল কাদির দিয়েছেন। ইকবাল লন্ডনের এক কবিসভায় আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সেখানে একজন ভদ্রলোক তাকে জিজ্ঞেস করেন তিনি কখনো ফারসি কবিতা লিখেছেন কিনা। ইকবাল উত্তর দেন, কখনও কখনও দু’একটি পংক্তি লিখেছি বটে, তবে পুরো কবিতা কখনো লেখা হয়ে ওঠেনি। সেইদিন এই প্রশ্নে আবেগাপ্লুত হয়ে ইকবাল বাসায় ফিরে আসেন এবং রাতের বেলায় বিছানায় শুয়ে তিনি দুটো ফারসি গজল লিখে ফেলেন। ভোরে আবদুল কাদিরের সাথে দেখা হলে তিনি এ দুটো গজল তাকে আবৃত্তি করে শোনান। এর পর থেকে ফারসি ভাষাই হয়ে ওঠে তার কাব্য কৃতির প্রধান প্রকাশ মাধ্যম। যদিও তিনি বিভিন্ন সময় উর্দু কবিতাও লিখেছিলেন। ইকবাল কেন ফারসিকে কাব্য ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন তা বুঝা শক্ত নয়। ফারসি ভাষা সমৃদ্ধ, মিষ্ট ও সাবলীল। সে কারণে ফারসিকে প্রাচ্যের ফরাসি ভাষা বলা হয়। প্রচুর শব্দভাণ্ডার থাকার কারণে বিমূর্ত ও জটিল চিন্তা, হৃদয়াবেগের বিচিত্র প্রকাশে ফারসি ভাষা একেবারেই তুলনাহীন। ইকবালের চিত্তবৃত্তির গভীর ও মরমীয়া প্রকাশ, তার দার্শনিক মেজাজ ফারসি ভাষাই যথাযথভাবে প্রকাশ করতে পারতো। উর্দুর লাবন্য আছে, প্রকাশভঙ্গির মধুরতাও আছে। কিন্তু ভাষার জগতে এটি ফারসি ভাষার চেয়ে তুলনামূলকভাবে নবীন এবং এর শব্দ ভারী ও সীমিত। তাছাড়া ফারসি ভাষা ইরানের ভাষা হলেও উপমহাদেশে এটা বহুচর্চিত ভাষাও। এ ভাষার ভিতর দিয়ে বৃহত্তর পাঠকের কাছে পৌঁছানোও সহজতর। ইকবাল এ সম্পর্কে নিজেই একটি কবিতা লিখেছেন:
“আমি হিন্দুস্তানী মানুষ, ফার্সি ভাষার সাথে অপরিচিত। আমি নবোদিত চাঁদ, কিন্তু আমার পাত্র শূন্য। যদিও হিন্দী ভাষা স্বাদে-গন্ধে চিনির সমতুল্য, তবুও দরি (ফার্সি)-র বর্ণনারীতি সুস্বাদু ও সুমধুর। আমার ধ্যান-ধারণা তার কিরণে মন্ত্রমুগ্ধ। আমার কলম পরিণত হয়েছে তুর পর্বতের খেজুর শাখায়। ফার্সি হলো আমার উচ্চাঙ্গ চিন্তার স্বভাববন্ধু।”
তাঁর দেশপ্রেমমূলক কাব্যগ্রন্থগুলোর মাঝে রয়েছে তারানায়ে হিন্দ, হিন্দুস্তানী বাচ্চো কা ক্বওমী গীত, ছদায়ে দরদ, হিমালয়। এছাড়াও বাঙ্গে দারা (যুদ্ধ ঘন্টা, প্রথম উর্দূ কাব্যগ্রন্থ), শিকওয়া ও জাওয়াবে শিকওয়া, পায়ামে মাশরিক (প্রাচ্যের বাণী), রামূযে খুদী (আত্মবিলোপের গূঢ়তত্ব, যা মূলত আসরারে খুদির দ্বিতীয়াংশ), বালে জিব্রীল (জিব্রাঈলের ডানা), দরবারে কালীম (মূসার লাঠির আঘাত), যাবুরে আযম, জাবীদ নামা (তাঁর ছেলেকে নিয়ে লেখা) প্রমুখ কাব্যগ্রন্থ উল্লেখযোগ্য যার মাঝে আধ্যাত্মিকতা এবং খোদায়ী ইশকের সুরও উঠে এসছে অসংখ্য কবিতায়। তাঁর শিশুতোষ কবিতার মাঝে রয়েছে নালা ইয়াতিম , মাকড়সা ও মাছি, মায়ের স্বপ্ন, শিশুর প্রার্থনা প্রভৃতি। শুরুর দিকে উর্দূতে সাহিত্য চর্চা করলেও, বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা সময় ধরে তাঁর ফারসি প্রীতি চোখে পড়ে। শেষ দিকে অবশ্য তিনি আবারো উর্দূতে বেশ কিছু লেখা লিখেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলো আরবি, ইংরেজি, তুর্কি, জার্মানি, রুশ, বাংলাসহ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত ও অসংখ্য সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে।
• এক অনন্য খেদমতগার
ইকবাল ছিলেন একজন আশেকে রাসূল এবং ইবাদতগুজার বান্দা। তিনি বি.এ পড়ার জন্য ভর্তি হওয়ার প্রাক্কালে বাবার কাছে এই ওয়াদা করেন যে ছাত্র জীবন শেষ করার পর বাকি জীবন ইসলামের খেদমতে ওয়াকফ করে দিবেন। তাসাউফের চেতনায় তিনি ছিলেন ভাস্বর। তাঁর বাবা তাঁকে একদিন বলেছিলেন তিনি যেন কোনো স্থাবর সম্পত্তির মালিক না হন, আর তিনি তাই-ই করেছিলেন। এমনকি বাড়ি নির্মাণ করে তা তাঁর ছেলেকে উইল করে দিয়ে সেখানে তিনি ভাড়া থাকতেন। ইকবাল লিখে গিয়েছেন-
“পাখির রাজ্যে দরবেশ ভ্রাম্যমান তাই, শাহীন বাঁধে না নীড়, নীড়ে তাঁর প্রয়োজন নাই।“
তিনি পাশ্চাত্য জীবনদর্শনের বিরোধী ছিলেন এবং বারে বারে মুসলমানদের হুঁশিয়ার করে গেছেন। ১৯৩৬ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং অসুস্থতা বাড়তে থাকে। ১৯৩৮ সালের ২১শে এপ্রিল ভোর পাঁচটায় এই মানবদরদী কবি, উম্মাহর আকাশের অবিসংবাদিত শাহীন ডানা মেলে দিয়েছিলেন তাঁর রবের দিকে।
• পরিশেষে
মোহাম্মদ ইকবাল ছিলেন প্রচন্ড মেধাবী একজন মানুষ। তাঁর দক্ষ পদচারণা ছিলো শুধু কবি হিসেবে নয়, বরং দার্শনিক, আইনজীবী, প্রতিভাধর বাগ্মী, অধ্যাপক, সমাজসেবক, রাজনীতিবিদ নানা পরিচয়ে তিনি ছিলেন সমাদৃত। এই দেশ হয়তো তাঁকে চিনতে পারেনি কিংবা পারলেও তাঁর বিস্তৃতি হয়েছে অনেক পরে, কিন্তু সারা বিশ্বে তাঁর সম্মান যথার্থই ছিল। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তিনি অর্জন করেছিলেন আকুণ্ঠ সম্মান। মহীশুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের এক হিন্দু অধ্যাপক বলেন, “মুসলমানগণ ইকবালকে লক্ষবার তাদের সম্পদ বলে দাবি করতে পারেন। কিন্তু তিনি কোন ধর্ম বা শ্রেণীবিশেষের সম্পদ নন- তিনি একান্তভাবে আমাদেরও।”
এত যশস্বী ব্যক্তিত্ব হওয়ার পরেও যে ইকবাল পাঠকে ইচ্ছাকৃতভাবেই আমাদের দেশে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, তার প্রমাণ হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের নাম পরিবর্তন করে জহুরুল হক হল নামকরণ করা, পাঠ্য তালিকা থেকে তাঁর রচনা ও জীবনী বাদ দেয়া। কিন্তু কেন ইকবাল চর্চাকে দূরে সরিয়ে দেয়া হলো? কেন তাঁকে মুছে ফেলতে চাওয়া হলো বাঙালী মুসলমানের মানসপট থেকে?
সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার দায়িত্ব পাঠকের উপরই ছেড়ে দিলাম…
রেফারেন্স:
১. সেরা মুসলিম মনীষীদের জীবনকথা-নাসির হেলাল
২. শিকওয়া ও জওয়াবে শিকওয়া-আল্লামা ইকবাল(র)
৩. ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন-আল্লামা ডক্টর মুহাম্মদ ইকবাল
৪. ইকবাল মননে অন্বেষণ
আল্লামা ইকবাল: চিরস্মরণীয় এক শাহীনের আখ্যান
লেখা: রাফিয়া জান্নাত
শিক্ষার্থী ও সদস্য
গবেষণা বিভাগ,