শিউলিমালা একাডেমি

ইসলামী সভ্যতায় ইনফাকের সংস্কৃতি

ইনফাক বলতে কী বুঝায়? সহজ ভাষায় বললে, ইনফাক বলতে বুঝায় আল্লাহর পথে ব্যয়৷ ইনফাক রমজানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং একইসাথে সামাজিক সংহতিরও গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান৷ আজকের দুনিয়ায় প্রতিনিয়ত আমরা আমাদের সমাজে বিভিন্ন ধরনের যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকি, এইসব সমস্যার মূলে অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে আমাদের মধ্য থেকে ইনফাকের সংস্কৃতি উঠে যাওয়া৷ এজন্য আজকে আমি এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করবো।

শাব্দিক অর্থে বলতে গেলে, অন্যকে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য যেই দান বা খরচ করা হয় সেটিই হচ্ছে ইনফাক৷ এই সহযোগিতা কেবলমাত্র আর্থিক বিষয় নয়৷ অপর একজন ভাই/ বোনকে সাহায্য করার জন্য একজন মানুষ তার ধন, সম্পদ, জ্ঞান, সময় এমনকি তার জীবন পর্যন্ত দান করতে পারে৷ কাজেই, ইনফাক একটি সামাজিক পরিভাষা৷ যদিও বর্তমানে ইনফাকের কথা এলে শুরুতেই আমাদের মাথায় আসে আর্থিক সাহায্যের বিষয়টি৷ প্রকৃতপক্ষে ইনফাকের বিষয়টি শুধুমাত্র আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়৷ এটি একইসাথে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক৷ এর দ্বিমাত্রিক অর্থ আছে৷ ইনফাকের বিষয়টি একজন ব্যাক্তিকে যেমন বিকশিত করে থাকে অনুরূপভাবে তা সামাজিক সংহতি ও বিকাশের জন্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ এই ইনফাকের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা, নিজের সময়-সম্পদ অন্যের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়া ও ত্যাগের মানসিকতা তৈরি হয়৷ ফলশ্রুতিতে মানুষ বস্তুগত ধন-সম্পদের প্রতি অতিরিক্ত লোভ লালসা থেকে মুক্ত হতে পারে৷ ইনফাকের ক্ষেত্রে আর্থিক দিক যেমন গুরুত্বপূর্ণ একইসাথে আধ্যাত্মিক দিকটাও গুরুত্বপূর্ণ৷ এই কারণে আমি ইনফাকের বিষয়টিকে ৫টি ভাগে ভাগ করে থাকি :

১. কথার মাধ্যমে দান৷

২. ইলম ও মারেফাতের মাধ্যমে দান৷

৩. সময়ের মাধ্যমে দান৷

৪. জীবনের মাধ্যমে দান৷

৫. সম্পদের মাধ্যমে দান৷

১. কথার মাধ্যমে ইনফাক হচ্ছে কাউকে জ্ঞান শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে, কাউকে ভালো উপদেশ দেয়ার মাধ্যমে, কাউকে সঠিক পথ প্রদর্শন করে তার উপকার করা। এগুলো ইনফাকের গুরুত্বপূর্ণ দিক৷

২. ইলম বা মারেফাতের মাধ্যমে ইনফাক হচ্ছে কোনো উপকারী জ্ঞানকে শিক্ষা করে সে জ্ঞানকে সবার সামনে তুলে ধরা, অন্যকে শিক্ষা দেয়া, বিশেষ করে যুবকদের কাছে তুলে ধরা৷ একই সাথে সে জ্ঞানটি আমাদের বাস্তব জীবনে কিভাবে কাজে লাগতে পারব সেটিকেও সবার সামনে উপস্থাপন করা।

৩. সময়ের মাধ্যমে ইনফাক—এটি হচ্ছে, কেউ যদি আপনার কাছে আসে, এসে সাহায্য-সহযোগিতা চায়; সেটি যেকোন বিষয়ে হতে পারে, যেমন : আর্থিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক। এই ব্যাপারে তাকে সময় দেয়া, তার সাথে গিয়ে তার সমস্যার সমাধান করা৷ এছাড়া সমাজে কোনো বিষয়ে সমস্যা থাকলে সে সমস্যার সমাধানের জন্য সময় বের করা এবং সেগুলোর প্রতি মনোযোগ দেয়া হল সময়ের মাধ্যমে ইনফাক৷

৪. জীবনের মাধ্যমে ইনফাক হচ্ছে প্রয়োজন হলে জীবনের মায়াকে ত্যাগ করে হলেও অন্যের কল্যাণের জন্য চেষ্টা প্রচেষ্টা করা; এমনকি এতে যদি নিজের জীবনও বিপদাপন্ন হয়, তবুও চেষ্টা করা৷

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোভিড-১৯ এর সময় অনেক ডাক্তার, নার্স এবং হাসপাতালে কর্মরত মানুষজন রোগীদের সেবা দেয়া ও সুস্থ করার জন্য নিজেরা করোনায় আক্রান্ত হন৷ শত শত নার্স, ডাক্তার ও চিকিৎসার সাথে সম্পৃক্ত ব্যাক্তিরা অন্যের জীবন বাঁচাতে গিয়ে নিজেই মৃত্যুবরণ করেন৷ এটি হচ্ছে জীবন দিয়ে ইনফাকের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আর দ্বিতীয় উদাহরণ হচ্ছে আমাদের মায়েরা৷ তারা তাদের সন্তানকে লালন পালন করার জন্য, তাদের বড় করার জন্য নিজের স্বাস্থ্য, ঘুম থেকে শুরু করে সবধরণের ত্যাগ স্বীকার করেন৷ বাবারা সন্তানদের হয়তো আর্থিকভাবে লালন পালন করার জন্য, ঘর পরিচালনার জন্য ত্যাগ স্বীকার করেন৷ কিন্তু একজন মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য মায়েরা সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন৷ এককথায় বলতে গেলে, তারা তাদের জীবন দিয়ে একটি প্রজন্ম গড়ে তোলেন৷

সর্বশেষ আমরা যে উদাহরণ দিতে পারি, তা হলো আমাদের গাজার ভাইবোনদের। উম্মতের ইজ্জতকে রক্ষা করার জন্য, আমাদের প্রথম ক্বিবলা বায়তুল মাকসিদকে রক্ষা করার জন্য, তাদের জন্মভূমিকে রক্ষা করার জন্য, এককথায় বলতে গেলে উম্মতের স্বতীত্বকে রক্ষা করার জন্য তারা তাদের জীবন দিয়ে লড়ে যাচ্ছেন৷ গাযার নারী, শিশু থেকে শুরু করে প্রতিটি মানুষ এর মধ্যে শামিল৷ তাই আমি মনে করি এটি জীবন দিয়ে ইনফাকের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ৷

৫. ধন-সম্পদ বা মালের মাধ্যমে ইনফাক৷ এটি হচ্ছে কারো যদি আর্থিক সামর্থ্য থাকে, সে ক্ষেত্রে যারা দরিদ্র, নিপীড়িত; তাদের সাথে নিজের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেয়া৷ এটিকে আবার ৫ ভাগে ভাগ করা হয়েছে :

ক) এর প্রথমটি হচ্ছে তাসাদ্দুক বা সাদাকাহ বা সদকা৷ এটি ইনফাকের সামগ্রিক একটি পরিভাষা৷ এক অর্থে বলতে গেলে এটি ইনফাকের সকল বিষয়কে পরিগ্রহ করে থাকে৷ এই সদকা সম্পর্কে রাসুল (সা.) এর একটি হাদীস রয়েছে৷ এ হাদীসে তিনি সদকাকে সামগ্রিক ভাবে তুলে ধরেছেন৷ তিনি বলেছেন,

“প্রতিটি ভালো কাজই সদকা”

বর্তমানে আমরা সদকা বলতে বুঝি, কেউ যদি এসে সাহায্য চায় তাকে সাহায্য করা, গরীব লোকদের খাবার দেয়া ইত্যাদি৷ অর্থাৎ, আমরা এটিকে খুবই সংকীর্ণ অর্থে ব্যাবহার করি৷ কিন্তু রাসূল (স.) এটিকে সামগ্রিক অর্থে ব্যবহার করেছেন৷ কারো সাথে দেখা হলে মুচকি হাসি দেয়া সদকা, কাউকে পথ প্রদর্শন করা সদকা, পশুপাখিকে খাবার দেয়া, অনুবাদ করা, কোনো একটি ভালো কিছু তৈরি করে মানুষের সামনে উপস্থাপন করা, শিশু বা বাচ্চাদের মাথায় হাত বুলানোসহ সকল ভালো কাজই সদকা৷ এগুলো সবই হাদিসের মাধ্যমে আমাদের কাছে এসেছে৷

খ) সদকার আরেকটি রূপ হচ্ছে সদকায়ে ফিতর বা সদকাতুল ফিতর৷ এটি শুধু রমজান মাসের জন্য নির্দিষ্ট৷ অন্য কোনো সময়ের জন্য নয়৷ সদকাতুল ফিতর খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়৷ সদকাতুল ফিতর হচ্ছে এই রমজানে যারা বেঁচে আছে তাদের পক্ষ থেকে আল্লাহকে দেয়া একটি কৃতজ্ঞতার প্রকাশ৷ আল্লাহকে খুশি করার জন্য দরিদ্র ব্যাক্তিকে ফিতরা সদকা দেয়া৷ সদকায় ফিতর এমন একটি জিনিস যার জন্য ধনী হওয়ার প্রয়োজন নেই৷ যাকাতের মতো নিসাব পরিমাণ মাল বা সম্পদের অধিকারী হতে হবে এমন নয়৷ এটি যে কেউ দিতে পারে৷ যাকাতের ক্ষেত্রে বাড়ির কর্তা বা যে সম্পদের অধিকারী সে-ই মূলত যাকাত দিয়ে থাকে৷ অন্যদের পক্ষ থেকে আদায় করা হয় না৷ কিন্তু সাদাকাতুল ফিতর জন্মগ্রহণকারী প্রতিটি শিশুর জন্য তার পিতা-মাতা দিয়ে থাকে৷ এটি একটি অসাধারণ বিষয়৷

গ) সদকার চতুর্থ রূপ হচ্ছে যাকাত। যাকাত হচ্ছে নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণকারী ব্যাক্তির সম্পদের একটি অংশকে দান করা৷ এটি ইসলামের ৫টি স্তম্ভের একটি৷ সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য যাকাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়৷ আল্লাহ বলেন :

“خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ إِنَّ صَلَاتَكَ سَكَنٌ لَهُمْ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ”

অর্থঃ (হে নবী!) তুমি তাদের ধন-সম্পদ হতে সাদাকাহ গ্রহণ কর, যদ্বারা তুমি তাদেরকে পবিত্র করে দিবে, আর তাদের জন্য দু‘আ কর। নিঃসন্দেহে তোমার দু‘আ হচ্ছে তাদের জন্য শান্তির কারণ, আর আল্লাহ খুব শোনেন, খুব জানেন।

এখানে রাসূলকে (স.) নির্দেশ করা হয়েছে, সমাজের নেতৃত্বের পর্যায়ে যারা থাকবে তাদের নির্দেশ করা হয়েছে৷ যাকাত দেয়ার মাধ্যমে ধনীদের ধন-সম্পদকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করা এর প্রধান উদ্দেশ্য৷ এখানে ‘তুতাহহির’ শব্দটির মাধ্যমে সম্পদ কমানো বা নেয়ার জন্য বলা হচ্ছেনা বরং তাদের পরিশুদ্ধ করো বা পবিত্র করো এটি বলা হয়েছে৷ যাকাতের ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ যাকাতের মাধ্যমে ব্যাক্তির সম্পদ পরিশুদ্ধ হয়, ব্যাক্তি পরিশুদ্ধ হয়৷ এখানে যাকাত ও ‘তুযাক্কি’ একই শব্দমূল থেকে এসেছে৷

ঘ) সদকার আরেকটি দিক হচ্ছে কর্জে হাসানা৷ এটি হলো কোন ধরনের বিনিময় প্রত্যাশা না করে কাউকে ঋণ দেয়া৷ কোন কষ্টে বা সমস্যায় নিপতিত ব্যাক্তিকে কোন সুদ বা দুনিয়াবী কোনো স্বার্থ ছাড়া ঋণ দেয়াকে ইসলামের অনেক বড় ফজিলত হিসেবে আখ্যায়িত করেছে৷ এটি এমন একটি বিষয়, যেমন কোনো ব্যাক্তি কোনো সমস্যার কারণে ঋণ চাচ্ছে, এমতাবস্থায় আপনি জানেন যে, এটি তার পক্ষে ফেরত দেয়াটা খুবই কঠিন৷ এমনকি তিনি ফেরত নাও দিতে পারেন—এটি জেনেও তাকে ঋণ দেয়া এবং মনে করা যে আপনি আল্লাহকে ঋণ দিচ্ছেন, এভাবে তাকে ঋণ দেয়া৷ অর্থাৎ, কোনো ধরণের বিনিময়ের প্রত্যাশা ছাড়াই দিয়ে দেয়া৷ সে যদি তা ফেরত দেয় তো ভালো, আর যদি দিতে না পারে তাহলে আল্লাহ স্বয়ং নিজে এর বিনিময় দিবেন৷ কর্জে হাসানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে যে ঋণ নিবে সে যেনো এর অপব্যবহার না করে সেটিও গুরুত্বপূর্ণ৷ যে ব্যাক্তি নিবে তাকেও অবশ্যই আন্তরিক হতে হবে, সে যেনো এই নিয়তে না আসে যে, তার কাছে সম্পদ আছে, সেতো দিবেই আমি আর ফেরত দিবোনা, তাহলে এটি আল্লাহর সাথেই প্রতারণা করা হলো৷ এর হিসাব আল্লাহর কাছে দিতে হবে৷ এজন্য সম্ভব হলে অবশ্যই পরিশোধ করার নিয়্যত থাকতে হবে৷

مَنۡ ذَا الَّذِیۡ یُقۡرِضُ اللّٰهَ قَرۡضًا حَسَنًا فَیُضٰعِفَهٗ لَهٗۤ اَضۡعَافًا كَثِیۡرَۃً ؕ وَ اللّٰهُ یَقۡبِضُ وَ یَبۡصُۜطُ ۪ وَ اِلَیۡهِ تُرۡجَعُوۡنَ

অর্থঃ এমন ব্যক্তি কে আছে যে আল্লাহকে উত্তম কর্জ প্রদান করবে? তাহলে তার সেই কর্জকে তার জন্য আল্লাহ বহু গুণ বর্ধিত করে দেবেন এবং আল্লাহই সীমিত ও প্রসারিত ক’রে থাকেন এবং তাঁর দিকেই তোমরা ফিরে যাবে।

কর্জে হাসানার বিষয়টি আমাদের সমাজে ব্যাপকভাবে বিস্তার ঘটানো উচিত এবং কর্জে হাসানার অপব্যবহার যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত৷ কোরআন আমাদের এই শিক্ষা দিয়ে থাকে যে, ইনফাক হচ্ছে বরকতের একটি উৎস, একইসাথে এটি আমাদের ধন-সম্পদ হ্রাস করেনা, বরং বৃদ্ধি, পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে৷

কর্জে হাসানা বা বিনিময়ের প্রত্যাশা ছাড়া দান করলে, আল্লাহ রব্বুল আলামীন কখনো সাতগুণ কখনো একশতগুণ আবার চাইলে সাতশতগুণ বা অফুরন্ত নিয়ামতে একজন ব্যাক্তিকে পরিপূর্ণ করতে পারেন৷ তাই আমরা বলে থাকি দান, সদকা, যাকাত সম্পদকে হ্রাস করেনা, বরং বৃদ্ধি করে৷ সম্পদের বরকতের বড় একটি উৎস এই দান-সদকা৷

مَثَلُ الَّذِیۡنَ یُنۡفِقُوۡنَ اَمۡوَالَهُمۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ كَمَثَلِ حَبَّۃٍ اَنۡۢبَتَتۡ سَبۡعَ سَنَابِلَ فِیۡ كُلِّ سُنۡۢبُلَۃٍ مِّائَۃُ حَبَّۃٍ ؕ وَ اللّٰهُ یُضٰعِفُ لِمَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ اللّٰهُ وَاسِعٌ عَلِیۡمٌ

অর্থঃ যারা আল্লাহর পথে তাদের সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি বীজের মত, যা উৎপন্ন করল সাতটি শীষ, প্রতিটি শীষে রয়েছে একশ’ দানা। আর আল্লাহ যাকে চান তার জন্য বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।

ঙ) ইনফাকের পঞ্চম যে শ্রেণী, তা হচ্ছে ফিদিয়া বা কাফফারা৷ কেউ রোযা রাখতে অক্ষম হলে তার পরিবর্তে যে দান, বা ওয়াদা রাখতে না পারলে কিংবা এরকম বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে দান হলো ফিদিয়া বা কাফফারা। যদি কেউ অসুস্থতার কারণে বা অন্য কোন কারণে রোজা রাখতে না পারে তাহলে সে পরের মাসে কাযা করবে৷ কিন্তু তার অসুস্থতা যদি এমন হয় যে, তার পক্ষে পরেও কাজা করা সম্ভব না, স্বাস্থ্যগত সমস্যার সম্ভাবনা বা মৃত্যু ঝুঁকি থাকে তাহলে সে ফিদিয়া দিবে৷ কিন্তু অনেকে এটির অপব্যবহার করে থাকে; ক্লাস, কাজ এসব অজুহাতে রোযা রাখেনা। মনে করে, আমার সামর্থ্য আছে আমি ফিদয়া দিয়ে দিবো। এভাবে এই বিধানের অপব্যবহার করে থাকে৷ এটি এক অর্থে আল্লাহর সাথে প্রতারণা৷ আর আল্লাহর সাথে যে প্রতারণা করে সে নিজেই প্রতারিত হয়৷

দান-সদকা এগুলোর জন্য আন্তরিক নিয়্যত থাকা গুরুত্বপূর্ণ৷ বরকত হওয়ার জন্য সবচেয়ে ভালো, পবিত্র ও হালাল জিনিস দান করতে হবে৷ নাহলে এটি বরকতের উৎস হবে না৷

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنفِقُوا مِن طَيِّبَاتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّا أَخْرَجْنَا لَكُم مِّنَ الْأَرْضِ ۖ وَلَا تَيَمَّمُوا الْخَبِيثَ مِنْهُ تُنفِقُونَ وَلَسْتُم بِآخِذِيهِ إِلَّا أَن تُغْمِضُوا فِيهِ ۚ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ

অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! তোমরা স্বীয় উপার্জন থেকে এবং যা আমি তোমাদের জন্যে ভূমি থেকে উৎপন্ন করেছি, তা থেকে উৎকৃষ্ট বস্তু ব্যয় কর এবং তা থেকে নিকৃষ্ট জিনিস ব্যয় করতে মনস্থ করোনা। কেননা, তা তোমরা কখনও গ্রহণ করবে না; তবে যদি তোমরা চোখ বন্ধ করে নিয়ে নাও। জেনে রেখো, আল্লাহ অভাবমুক্ত, প্রশংসিত। (সূরা বাকারা, ২৬৭)

কোনো একটি পোশাক পুরনো হয়ে গেলে সেটি ফেলে দেয়ার আগে কাউকে দিয়ে দেওয়া বা খাবার খেয়ে কিছু রয়ে গেছে; তা ফেলে দেয়ার আগে দিয়ে দেয়াকে দান বুঝায় না৷ নতুন কোনো কিছু বা সবচেয়ে সুন্দর কোনো কিছু দান করা হলো উত্তম দান৷

ইনফাক হচ্ছে বান্দাহর পক্ষ থেকে আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া ও অপর ভাইয়ের প্রতি ধন্যবাদ৷

বান্দার প্রতি ধন্যবাদ তিনভাবে হয়ে থাকে :

১. আমাদের উপর তাদের যে অধিকার সেটি আমরা পূরণ করে দিচ্ছি

২. তাদের দেয়ার কারণে আমাদের সম্পদ পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হচ্ছে

৩. যখন সমাজে ক্ষুধার্ত ও দরিদ্র মানুষ থাকবেনা, তখন সমাজে বিশৃংখলা ও অপরাধ কমে যাবে এবং শান্তি বিরাজ করবে। কাজেই, সামাজিক শৃঙ্খলার জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ইনফাকের অন্যতম উদ্দেশ্য সমাজের মধ্যকার ব্যাক্তিদের সংহতি ও সামাজিক আদালত নিশ্চিত করা৷ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এটি একটি পন্থা৷ যে ব্যাক্তি দান করে, সে আধ্যাত্মিকভাবে প্রশান্তি লাভ করে; একই সাথে সে কৃপণতা থেকে নিজেকে মুক্ত করে সামাজিকভাবে শ্রদ্ধা অর্জন করে এবং দানের যে সংস্কৃতি সেটিকে বিকশিত করে৷

আল্লামা ত্বহা আবদুর রহমান এর ভাষায়, ইনফাক আমাদের আমানতের যে চেতনা সেটিকে জাগ্রত করে থাকে৷ অর্থাৎ এই পৃথিবীর যা কিছু আছে সবই আমাদের নিকট আমানত এই চেতনা জাগ্রত করে আর আমাদের নিজদের এর মালিক ভাবার চেতনা হ্রাস করে৷

অনেক গবেষণায় আমরা দেখতে পাই যে, যদি পৃথিবীর সব ধনী মুসলমানেরা সঠিকভাবে যাকাত আদায় করতো তাহলে পৃথিবীর কোথাও দারিদ্র‍্য ও সামাজিক বৈষম্য থাকতোনা৷

ফরাসি দার্শনিক ও চিন্তাবিদ রজার গারাউডির ভাষায়;

যাকাত এমন কোনো বিষয় নয় যা মানুষের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ, এটা আমাদের ইচ্ছাধীন কোনো বিষয় নয়৷ যাকাত হচ্ছে এমন একটা বিষয় যা মানুষের মধ্যে স্বার্থপরতা বা কৃপণতার যে প্রবণতা আছে তাকে পরাভূত বা পরাজিত করতে সাহায্য করে৷ মানুষের পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার প্রাতিষ্ঠানিক একটি রূপ হচ্ছে যাকাত৷ এটিকে বাধ্যতামূলক ও আধ্যাত্মিক একটি কর্তব্য হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে৷ যাকাত একইসাথে এটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সকল সম্পদের মালিক হচ্ছেন আল্লাহ৷ ব্যাক্তি চাইলে তার ইচ্ছামত এর ব্যবহার করতে পারবেনা৷ আল্লাহ যেভাবে বলেছেন সেভাবেই ব্যয় করতে হবে৷ এটি একটি আমানত৷ শুধু তাই নয়। সে যে এই সমাজের সদস্য, অন্য মানুষের সাথে তার একটি সম্পর্ক আছে, সেই সম্পর্কের প্রতি তার একটি দায়বদ্ধতা আছে; এটি তাকে বার বার স্মরণ করিয়ে দেয় যাকাত৷

আমরা যদি কোরআনের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, কোরআনে নামাজ এবং যাকাতের কথা একই সাথে উল্লেখিত হয়েছে৷

“وَأَقِيمُوا۟ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُوا۟ ٱلزَّكَوٰةَ وَٱرْكَعُوا۟ مَعَ ٱلرَّٰكِعِينَ”

১। আর তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং রুকূকারীদের সাথে রুকূ কর। (বাকারা, ৪৩)

اَلَّذٖينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقٖيمُونَ الصَّلٰوةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَۙ

২। যারা গায়েবের প্রতি ঈমান আনে, নামায কায়িম করে এবং আমি যে জীবনোপকরণ তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে তারা ব্যয় করে। (বাকারা, ৩)

وَاَقٖيمُوا الصَّلٰوةَ وَاٰتُوا الزَّكٰوةَؕ وَمَا تُقَدِّمُوا لِاَنْفُسِكُمْ مِنْ خَيْرٍ تَجِدُوهُ عِنْدَ اللّٰهِؕ اِنَّ اللّٰهَ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصٖيرٌ

৩। এবং তোমরা নামায আদায় কর এবং যাকাত দাও এবং যা কিছু সৎ কার্যাবলী তোমরা স্বীয় আত্মার জন্যে আগে পাঠাবে, তোমরা তা আল্লাহর নিকট পাবে, তোমরা যা কিছু করছো নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’ দেখছেন। (বাকারা, ১১০)

لَيْسَ الْبِرَّ اَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلٰكِنَّ الْبِرَّ مَنْ اٰمَنَ بِاللّٰهِ وَالْيَوْمِ الْاٰخِرِ وَالْمَلٰٓئِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيّٖنَۚ وَاٰتَى الْمَالَ عَلٰى حُبِّهٖ ذَوِي الْقُرْبٰى وَالْيَتَامٰى وَالْمَسَاكٖينَ وَابْنَ السَّبٖيلِ وَالسَّٓائِلٖينَ وَفِي الرِّقَابِۚ وَاَقَامَ الصَّلٰوةَ وَاٰتَى الزَّكٰوةَۚ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ اِذَا عَاهَدُواۚ وَالصَّابِرٖينَ فِي الْبَأْسَٓاءِ وَالضَّرَّٓاءِ وَحٖينَ الْبَأْسِؕ اُو۬لٰٓئِكَ الَّذٖينَ صَدَقُواؕ وَاُو۬لٰٓئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ

৪। তোমরা নিজেদের মুখ পূর্ব দিকে কর কিংবা পশ্চিম দিকে এতে কোন কল্যাণ নেই বরং কল্যাণ আছে এতে যে, কোন ব্যক্তি ঈমান আনবে আল্লাহ, শেষ দিবস, ফেরেশতাগণ, কিতাবসমূহ ও নাবীগণের প্রতি এবং আল্লাহর ভালবাসার্থে ধন-সম্পদ আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম-মিসকীন, মুসাফির ও যাচ্ঞাকারীদের এবং দাসত্বজীবন হতে নিস্কৃতি দিতে দান করবে এবং নামায কায়িম করবে ও যাকাত দিতে থাকবে, ওয়া‘দা করার পর স্বীয় ওয়া‘দা পূর্ণ করবে এবং অভাবে, দুঃখ-ক্লেশে ও সংকটে ধৈর্য ধারণ করবে, এ লোকেরাই সত্যপরায়ণ আর এ লোকেরাই মুত্তাকী। (বাকারা, ১৭৭ )

الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِى ٱلْأَرْضِ أَقَامُوا۟ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتَوُا۟ ٱلزَّكَوٰةَ وَأَمَرُوا۟ بِٱلْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا۟ عَنِ ٱلْمُنكَرِ وَلِلَّهِ عَٰقِبَةُ ٱلْأُمُورِ

৫। তারা এমন যাদেরকে আমি যমীনে ক্ষমতা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজের আদেশ দেবে ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে; আর সব কাজের পরিণাম আল্লাহরই অধিকারে। (হজ্জ, ৪১)

رِجَالٌۙ لَا تُلْهٖيهِمْ تِجَارَةٌ وَلَا بَيْعٌ عَنْ ذِكْرِ اللّٰهِ وَاِقَامِ الصَّلٰوةِ وَاٖيتَٓاءِ الزَّكٰوةِۙ يَخَافُونَ يَوْماً تَتَقَلَّبُ فٖيهِ الْقُلُوبُ وَالْاَبْصَارُ

৬। সেই সব লোক, যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ক্রয় বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ হতে এবং সালাত কায়েম ও যাকাত প্রদান হতে বিরত রাখেনা, তারা ভয় করে সেই দিনকে যেদিন তাদের অন্তর ও দৃষ্টি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। (নূর, ৪৯)

হাদীসে ইনফাক

ইনফাক মানুষকে একই সাথে কিভাবে রূহগত ও সামাজিকভাবে উচ্চ মর্যাদায় আসীন করে সেই ব্যাপারে হযরত পয়গাম্বর (সঃ) বলেন,

اَلْيَدُ الْعُلْيَا خَيْرٌ مِنَ الْيَدِ السُّفْلَى

” দানকারীত হাত গ্রহণকারীর হাতের চেয়ে উত্তম” (বুখারী, যাকাত, ১৮)

“مَنْ نَفَّسَ عَنْ مُؤْمِنٍ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ الدُّنْيَا نَفَّسَ اللَّهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ”

যদি কেন কোন মু’মিনের কোন একটি দুনিয়াবী সমস্যাকে দূর করার ক্ষেত্রে সাহায্য করে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কিয়ামতের দিন তার একটি সমস্যাকে দূর করে দিবেন। (মুসলিম, বিরর, ৩)

“أَفْضَلُ الصَّدَقَةِ مَا كَانَ عَنْ ظَهْرِ غِنًى”

সর্বোত্তম সাদাকা হল, প্রয়োজনের অতিরিক্তকে দান করে দেওয়া। (বুখারী, যাকাত, ১৮)

ইনফাক বা দানের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য রাখা জরুরি :

১. দান আমরা কেন করবো? আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। দান শুধুমাত্র আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য করতে হবে৷

২. সময়মতো সাহায্য করা৷ দেখা গেছে যে, কোনো অসুস্থতা বা প্রয়োজনের সময় দান না করে যদি পরে দান করা হয় তাহলে তার খুব বেশি উপকার হবে না। এজন্য সময়মত দান করার চেষ্টা করতে হবে৷

৩. গোপনে দান করা ও প্রদর্শনের ইচ্ছা থেকে দূরে থাকা৷ তবে এটি ব্যাক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য৷ কোন ফাউন্ডেশন বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এধরণের কাজকে উৎসাহ দেয়ার জন্য এটিকে দৃশ্যমান করা বা প্রচার করার মধ্যে সমস্যা নেই৷

৪. সম্পদের সবচেয়ে সুন্দর জিনিস দান করা৷ অব্যবহৃত বা মূল্যহীন কিছু দেয়ার চেয়ে ব্যাক্তি যা পছন্দ করে সেখান থেকে দেয়া সবচেয়ে উত্তম৷

৫. দেয়ার সময় কোনো ধরনের অপচয় না করা, আবার কৃপণতা থেকেও মুক্ত থাকা৷ এখানে ব্যাক্তি একটি মধ্যমপন্থা অবলম্বন করবে৷

৬. যাদের সত্যিকার অর্থে প্রয়োজন তাদের ক্রমাগত সাহায্য করা৷

৭. ব্যক্তির উপার্জিত সকল অর্থ দান করা যাবে না৷ তার পরিবার-পরিজনসহ যাদের প্রতি তার দায়িত্ব আছে তাদের প্রতিপালনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ রেখে বাকীটা দান করতে হবে৷

তাকওয়ায় উপনীত হওয়ার দুটি উপায় আছে :

১. ইনফাক

২. কল্যাণকর কাজ

ইনফাকও এক ধরণের কল্যাণকর কাজের অংশ৷

ইসলামী আখলাকের দৃষ্টিকোণ থেকে ইনফাক করার সময় আমাদের দুটি বিষয় থেকে দূরে থাকতে হবে৷

১. ইসরাফ

২. তাবজির

রাসূল (স.) বলেন, “তোমরা ইসরাফ অর্থাৎ অপচয়ের দিকে ধাবিত না হয়ে, অহংকার বা নিজেকে গৌরবান্বিত করার রোগে আক্রান্ত না হয়ে খাও, পান করো ও পরিধান করো এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করো৷ আল্লাহ তোমাকে যে নিয়ামত দিয়েছেন তা যেনো দৃশ্যমান হয়৷” (বুখারী)

কারো যদি সামর্থ্য থাকে সে ভালো খাবে, ভালো পরিধান করবে, সুন্দর থাকবে এটি আল্লাহ বান্দার কাছ থেকে দেখতে চান৷

এ ইনফাক বা ব্যয় করার ক্ষেত্রে আরেক ধাপ এগিয়ে একটি পরিভাষা হচ্ছে তাবজির৷

তাবজির হচ্ছে অযথা খরচ বা আল্লাহ যা পছন্দ করেননা, সেখানে খরচ করা৷

“তাবজিরকারী শয়তানের ভাই।”

এটি ইসরাফের চেয়ে আরেকধাপ এগিয়ে৷ এই তাবজিরের ব্যাপারে আল্লাহ কঠিনভাবে সতর্ক করেছেন৷

وَ اٰتِ ذَاالۡقُرۡبٰی حَقَّهٗ وَ الۡمِسۡكِیۡنَ وَ ابۡنَ السَّبِیۡلِ وَ لَا تُبَذِّرۡ تَبۡذِیۡرًا

অর্থঃ আত্মীয় স্বজনকে দিবে তার প্রাপ্য এবং অভাবগ্রস্ত ও পর্যটককেও (মুসাফিরকেও), এবং কিছুতেই অপব্যয় করনা।

আমরা যদি সম্পদকে আখলাকের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, তাহলে এটি আমাদের জন্য একটি নিয়ামত, আবার একইসাথে এটি আমাদের জন্য একটি পরীক্ষাও৷ পবিত্র কোরআনের কিছু কিছু আয়াতে আমরা দেখতে পাই ধন-সম্পদকে মুমিনদের জন্য ফিতনা ও পরীক্ষা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে৷ আবার সম্পদকে যেখানে ইচ্ছা সেখানে, যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে ব্যয় করাকে একটি গুনাহের কাজ, একটি দায়িত্বহীন কাজ বলে অভিহিত করা হয়েছে৷ এ দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলমানদের অজুতে পানি অপচয় না করা, একেবারে উদরপূর্তি করে না খাওয়া, খাবারের টেবিলকে সাদামাটা রাখা এসব বিষয়ে রাসূলে কারীম (স.) উৎসাহিত করেছেন। আমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার, পোশাক ও দামি আসবাবপত্র থেকে বের হয়ে আসতে হবে৷ মুমিনের জীবন হতে হবে সাধারণ ও অনাড়ম্বর৷

ইসরাফ ও তাবজিরের পার্থক্যের ক্ষেত্রে আলেমেরদের অনেকের বক্তব্য রয়েছে৷ এখানে আমি আল-মাওয়ার্দির বক্তব্যটি উল্লেখ করছি,

তার মতে, “ইসরাফ হচ্ছে সঠিক জায়গায় প্রয়োজনের অধিক ব্যয় করা; তাবজির হচ্ছে আল্লাহ পছন্দ করেননা এমন জায়গায় ব্যয় করা, আল্লাহর অবাধ্যতা যেখানে আছে সেখানে ব্যয় করা।”

ইনফাক এর প্রভাব কেবল ব্যক্তিজীবনে সীমাবদ্ধ নয়। এটি আমাদের সমাজের ভারসাম্যকে নিশ্চিত করে থাকে। এটি একটি পবিত্র কাজ, এটি আমাদের পারস্পরিক ভাগাভাগি (শেয়ারিং) এর বিষয়টিকে বৃদ্ধি করে থাকে, একই সাথে যে দান করে ও যে দান গ্রহণ করে উভয়কে আত্মিকভাবে প্রশান্তি দিয়ে থাকে৷ এজন্য ইনফাককে একটি জীবনধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দান করা আমাদের ব্যাক্তিগত ও সামাজিক জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ আমাদের এ বিষয়টি সবসময় জানা থাকতে হবে যে, ধনী হওয়া কিংবা দরিদ্র‍তা—এটি পরিবর্তনশীল৷ সময়ের পরিক্রমায় একজন ধনী ব্যক্তিও দরিদ্র হয়ে যেতে পারে, আবার একজন দরিদ্র ব্যক্তিও ধনী হতে পারে৷ এজন্য ধন-সম্পদ আল্লাহর দরবারে শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড নয়৷ আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড হচ্ছে তাকওয়া৷ একজন ব্যক্তি গরীব হলে গরীব থাকা অবস্থায় যে কাজ/ দায়িত্বগুলো পালন করা সম্ভব, সেগুলো পালন করবে; ধনী হলে ধনী থাকা অবস্থায় যে দায়িত্বগুলো পালন করা প্রয়োজন সেগুলো পালন করবে৷ তাহলেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে প্রিয় হওয়া যাবে।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সবাইকে এই বিষয়ের আলোকে আমল করার তৌফিক দান করুক। আমাদের সামাজিক সংহতি তৈরি করার তৌফিক দান করুক৷ ইনফাককে আমাদের জীবনধারার অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার তাওফিক দান করুক।

লেখা : ড. খাদিজা গরমেজ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *