শিউলিমালা একাডেমি

ইসলামী সংস্কৃতির মর্মকথা

জনাব মোহাম্মদ মার্মেডিউক পিকথলের জন্য ১৮৭৫ খৃষ্টাব্দে, ইংল্যান্ডের এক সম্ভ্রান্ত খৃষ্টান পরিবারে। বাল্যে ছ্যারো’তে এবং পরে ইউরোপের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ সমাপ্ত করে জনাব পিকথল ৩ বৎসর কাল নিকট-প্রাচ্যের কতিপয় দেশে অবস্থান করেন। এ সময়েই তিনি ইসলামী জীবন-বিধানের মাহাত্মো আকৃষ্ট হন। লেবানন পর্বতের দ্রুজ অঞ্চলেও তিনি এক বৎসরকাল অতিবাহিত করেন। ১৯২০ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত তিনি বোম্বাই হতে প্রকাশিত Bombay Chronicle পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন। অতঃপর হায়দারাবাদের নিজাম তাঁকে স্বীয় সরকারের শিক্ষা দফতরে নিয়োগ করেন। এ সময়ে তিনি Hyderabad Quarterly Islamic Culture পত্রিকাদ্বয় সম্পাদনা করেন। ইংরেজিতে আল-কুরআনের পূর্ণাঙ্গ তরজমা ছাড়াও জনাব পিথকল কয়েকখানি উপন্যাসসহ ২০ খানিরও অধিক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের প্রণেতা। জনাব পিকথল ১৯৩৬ সালের ১৯শে মে তারিখে ইন্তেকাল করেন। ১৯২৭ সালে হায়দারাবাদে এক সুধী সম্মেলনে জনাব পিকথল ইসলামের বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করে কতিপয় বক্তৃতা দান করেন। Islamic Culture নামে গ্রন্থরূপে প্রকাশিত সে বক্তৃতামালা থেকে Islamic Culture শীর্ষক প্রবন্ধটির বাংলা অনুবাদ এখানে প্রকাশ করা হল।

সংস্কৃতির অর্থ উৎকর্ষ বা অনুশীলন। আধুনাতন ও সাধারণভাবে একক ব্যবহারের ক্ষেত্রে সংস্কৃতির বিশেষ অর্থ হচ্ছে মানব-মনের উৎকর্ষ। অন্যান্য সংস্কৃতি হতে ইসলামী সংস্কৃতির সুস্পষ্ট স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। কেননা ইসলামী সংস্কৃতি কখনো কেবলমাত্র কোনো সংস্কৃতিবান ব্যক্তি-বিশেষ মাত্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পরিপূরক হতে পারে না। আরো পরিষ্কার ভাষায় বলতে গেলে, ইসলামী সংস্কৃতি শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে অগ্রসর ব্যক্তি- বিশেষ মাত্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিপূরণের বাহন হতে পারে না; এবং এখানেই বিভিন্ন সংস্কৃতির সংগে তার পার্থক্য। এটা সুস্পষ্ট ও সর্বজনবিদিত সত্য যে, ইসলামী সংস্কৃতির লক্ষ্য সীমিত পর্যায়ে কোনো ব্যক্তি বিশেষ কিংবা ব্যক্তি- সমষ্টির বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধন নয়-বস্তুতঃ সামগ্রিকভাবে গোটা মানবজাতির অগ্রগতি ও উৎকর্ষ সাধন। অন্যায়, অবিচার ও অসহিষ্ণুতা বিদ্যমান থাকা পর্যন্ত কোনো দেশে শিল্প ও সাহিত্য-সাধনার কোনো পরিসরের কাজই ইসলামের দৃষ্টিতে ন্যায়ানুগত হতে পারে না। যত বিরাট ও কীর্তিময় হোক না কেন, কোনো যুদ্ধ কিংবা সন্ধি-চুক্তির সাফল্যকে ইসলামের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত সাফল্যের ফল-শ্রুতি বলে অভিহিত করা যেতে পারে না। ইসলামের লক্ষ্য আরো প্রশস্ততর এবং এর দৃষ্টি-দিগন্ত আরো দূর-বিসারী। প্রকৃতপক্ষে, সার্বজনীন মানবিক ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠাই ইসলামের চূড়ান্ত লক্ষ্য- ইসলামে বিরামহীন অভিযাত্রা এই আদর্শের লক্ষ্যভূমির পথে অগ্রসরমান। ধর্ম হিসেবে ইসলাম নিজস্ব পরিসরেও নিজের শ্রেণীগত অগ্রগতির পর অন্য যে কোনো ধর্মের চেয়ে অধিকতর ও ব্যাপক পর্যায়ে মানবীয় প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করে থাকে। শক্তি হিসেবে বিশ্বে আত্ম-প্রতিষ্ঠা লাভের পর ইসলাম যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্ম দিয়েছে, অন্য সব ধর্ম, সভ্যতা ও দর্শনের সম্মিলিত সাফলের সংগে তার তুলনা করা যেতে পারে। মানে, ইসলামের সাংস্কৃতিক অবদানকে বিশ্বের সমস্ত ধর্ম, সভ্যতা ও কৃষ্টির সামগ্রিক অবদানের সংগে এক পাল্লায় ওজন করা যেতে পারে।

প্রতীচ্যে শিল্প ও সাহিত্য চর্চাকে-যাকে সংস্কৃতির একটা প্রাসংগিক বা গৌন দিক বলা যেতে পারে-প্রায় উপাসনার অনুরূপ যে অপরিসীম গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে, একজন মুসলমান তাতে অবাক না হয়ে পারে না। কেননা, মনে করা হয়, এ-ই যেন ঠিক এ-ই যেন বিরাট এক সত্য এবং এর সৃষ্টিই মানবজাতির সর্বোচ্চ লক্ষ্য। মুসলমানরা সাহিত্যিক, শৈল্পিক ও বৈজ্ঞানিক সাফল্যকে উপেক্ষা করে না- কখনো অবজ্ঞার চোখে দেখে না। কিন্তু এটা সত্য যে, তারা এগুলোকে অনেকখানি চলার পথে পাওয়া আশীর্বাদের আলোকে বিচার করে- তাদের চোখে এ হচ্ছে লক্ষ্যপথের একটা সহায়ক উপকরণ কিংবা পথযাত্রীর শ্রান্তি অপনোদনের মতো। তারা এই সহায়ক বস্তু এবং শ্রান্তি অপনোদনের মাধ্যমকে পূজা বা প্রতীক আশ্রয়িতার পর্যায়ভুক্ত করে না।

বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্যে ইসলামের সামগ্রিক অবদান এই সহায়ক উপকরণ ও শ্রান্তি অপনোদনের ভিত্তিতেই সম্প্রসারিত হয়েছে। সূক্ষ্মতম কাব্য-সাহিত্য ও ভাস্কর্য এগুলোর অন্যতম এবং এ দুই পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত এর সবকিছুই এক নেতাকে স্বীকৃতি দান করে, এক পথ নির্দেশের অনুসরণ করে, এক কেবলা বা লক্ষ্যাভিমুখে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। নেতা হচ্ছেন মহানবী (সঃ)। পথ নির্দেশ হচ্ছে আল-কুরআন, আর মঞ্জিল-মোকসাদ বা অভীষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহ।

ইসলামী সংস্কৃতি বলতে-তা যে কোনো সূত্র হতেই উদ্‌গত হোক না কেন-আমি ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের লব্ধ সংস্কৃতি বোঝাতে চাইনি। আর যে কোনো উৎস থেকেই এর বিকাশ হোক না কেন, তা-ও বড় কথা নয়। বস্তুতঃ ইসলামী সংস্কৃতি বলতে আমি এমনি একটি ধর্মমত কর্তৃক স্বীকৃত সংস্কৃতির কথা বোঝাতে চাইছি, যাতে মানবিক অগ্রগতিই একটা নিশ্চিত ও সুস্পষ্ট লক্ষ্য।

যে-সব মানুষ আল-কুরআনের পথ-নির্দেশ অনুসরণ করে এবং তার বিধানসমূহ মেনে চলে, তাদের প্রতি মহাগ্রন্থ এ জগতে ও পরলোক সাফল্যের যে প্রতিশ্রুিতি দান করেছে-আল কুরআনের শিক্ষা সম্পর্কে অবহিত কোনো ব্যক্তিই তা অস্বীকার করতে পারেন না। এর চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে সামগ্রিকভাবে গোটা মানব জাতির জন্য সাফল্য অর্জন। আর মানুষের সৃজনধর্মী অবদান ও মৌলিক গুণগুলোর বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনের উপরই এ সাফল্য নির্ভরশীল।

উন্মেষশীল মুসলিম সমাজের কোনো প্রসারণ-ব্যবস্থা আল-কুরআন কিংবা মহানবীর কোনো নির্দেশ বা আল হাদীসে অনুমোদিত না হলে বুঝতে হবে, তা ইসলাম বহির্ভূত এবং ইসলামী বিধি-ব্যবস্থার বাইরেই তার অনৈসলামিক মূলানুসন্ধান করতে হবে। সাফল্যের পরিপন্থী হওয়ার কোনো কারণ না ঘটলেও মুসলমানরা তাদের সমাজ জীবনে এগুলোর সংযোজন বা ফল গ্রহণ দ্বারা কোনোরূপ সুফল আশা করতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে, কোনো কর্মপন্থা আল-কুরআনের সুস্পষ্ট কোনো বিধির পরিপন্থী হলে বুঝতে হবে তা ইসলাম বিরোধী, আর এটা নিশ্চিতভাবে সাফল্য ও অগ্রগতিরও পরিপন্থী এবং একে গ্রহণ করলে মুসলমানরা নিঃসন্দেহে এক অনিবার্য ধ্বংসের শিকার হবে।

গোড়ার দিকে পৌত্তলিক আরবদের প্রতীক-পূজা এবং এর পংকিলতা ও মত্ততাময় রূপ- বৈচিত্র্যের সংগে সম্পৃক্ত ছিল বলে কতিপয় শিল্পকলাকে ইসলাম নিরুৎসাহিত করে। কারণ, সমাজের এই প্রতীকবাদিতা ও এর পাপসর্বস্ব বৈশিষ্ট্যের মূলোৎপাটনের প্রয়োজন অনিবার্য ছিল। তবে সুকুমার বৃত্তিজাত কাজগুলোর অনুরূপ এক জাতীয় শিল্প-পদ্ধতির অভিব্যক্তির ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত ও অন্যবিধ শিল্প-পদ্ধতির পৃষ্ঠপোষকতা-উভয়েরই গুরুত্ব অধস্তন বা গৌনধর্মী ছিল। কেননা, ইসলামী সংস্কৃতির লক্ষ্য মানবজীবনের বাড়তি উপকরণগুলোর সৌন্দর্য বর্ধন, পরিমার্জন ও পরিশীলন নয়- বস্তুত সামগ্রিক মানব- জীবনকে সুন্দরতম, মহত্তর, মহিমাময় করে তোলাই ইসলামী সংস্কৃতির লক্ষ্য। অধুনা পাশ্চাত্য বিশ্বে এক বিরাট বুদ্ধিজীবীমহল এই অভিমত পোষণ করেন যে, কোনো সমাজ শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের একটি মুষ্টিমেয় অংশের শিল্প-সংস্কৃতির অনুশীলন সেই সমাজ ও সম্প্রদায়ের কৃষ্টি সংস্কৃতির দাবীর পক্ষে বিরাট কারণ হয়ে দাঁড়ায়; যদিও প্রচলিত সমাজ- আওতায় বাধ্য হয়েই এই সমাজের বেশির ভাগ মানুষকে কুৎসিত ও অধঃপতিত জীবন যাপন করতে হয়। শুধু তাই নয়- সেখানকার অপর একটি বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর অভিমত হচ্ছে, কোনো জাতির সংখ্যালঘু অংশের সাহিত্য ও শিল্প-সাধনার প্রয়াসই সে জাতির বৃহত্তম অংশের কদর্য জীবন ও দাসবৃত্তির চরম গ্লানির যৌক্তিক প্রমাণ করে।

কয়েক বছর আগে ইংল্যান্ডের সংবাদপত্র মহলের একটি আলোচনার কথা আপনাদের কারো কারো নিশ্চয়ই স্মরণ আছে। প্রশ্নটি ছিল এই- মনে করুন, একটি কক্ষে একটি জীবন্ত শিশুর সংগে একটি সুবিখ্যাত ও অনুপম সুন্দর গ্রীক ভাস্কর মূর্তি রয়েছে; সম পর্যায়ের মূর্তির মধ্যে এ মূর্তিটি অসাধারণ ও অতুলনীয়; সুতরাং এর স্থান পূরণ অসম্ভব। এখন ধরুন, কক্ষটিতে আগুন লেগেছে, আর মূর্তি ও শিশুটির মধ্যে কেবল একটিকেই বাঁচানো সম্ভব; এ অবস্থায় কাকে বাঁচাতে হবে? আমার মনে আছে, প্রায় অধিকাংশ সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও পদস্থ ব্যক্তি হতভ্যাগ্য শিশুটির সামনে মৃত্যুর দ্বার উন্মুক্ত করে সেই অনুপম গ্রীক ভাস্কর্য মূর্তিটি রক্ষার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করেছেন। তাঁদের যুক্তি ছিল, প্রতিদিন লাখ লাখ শিশুর জন্ম হয়; পক্ষান্তরে প্রাচীন গ্রীক ভাস্কর্য শিল্পের সেই শ্রেষ্ঠতম নিদর্শনটির স্থান পূরণ কখনো সম্ভব হবে না। কোনো মুসলমান কখনো এই অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসূত অভিমত গ্রহণ করতে পারে না, কিংবা এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিপোষক হতে পারে না। এই দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে প্রতীকবাদিতা তথা প্রতিমাপূজার সর্বশেষ মার্জিত রূপ।

দূরদৃষ্টি ও পরিণামদর্শিতা ইসলামের বৈশিষ্ট্য। আরো পরিষ্কার করে বলতে গেলে, পূর্বাহ্নেই ফলাফলের কল্পরূপ সামনে রেখেই ইসলাম কর্মব্রতী হয় এবং গোটা মানবজাতির জন্য একটা উজ্জ্বলতম ভবিষ্যত গড়ে তোলার উদ্দেশ্য সামনে রেখে কাজ করে যায়। অবশ্যি, প্রতিটি মুসলিম আল্লাহর কাজে তার নিজস্ব জীবনকে উৎসর্গীকৃত মনে করে- আর আল্লাহর কাজকে সে মানবতার কাজ বলেই মনে করে। কিন্তু যত নগণ্য বলে মনে হোক না কেন, কোনো মানুষের জীবনকেই সে কখনো মানুষের হাতে তৈরি কোনো জিনিসেরা জেনে। উৎসর্গ করার কথা কল্পনাও করতে পারে না। আল্লাহর পথ-নির্দেশ এবং মানবজাতি সম্পর্কে তাঁর উদ্দেশ্যের প্রতি বিশ্বাসহীনতাই শিল্প-কীর্তিকে উপানির্দেশম এবং মানবজাতি বেদীতে অধিষ্ঠিত করার পেছনে কারণ যুগিয়েছে। বিতর্কের বিষয় হচ্ছে। বহু শতাব্দী ব্যাপী মানুষের সৃষ্টি-সাধনার শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন হচ্ছে এই জিনসগুলো; সৌন্দর্য ক্রমে লোপ পেয়ে যাচ্ছে-আর মানুষেরও দিন দিন অবনতি হচ্ছে; সুতরাং আমাদের সামনে একটি আদর্শ হিসাবে অতীতের এই সুন্দরতম সৃষ্টিগুলোর প্রতি অবশ্যই আমাদের মর্যাদা আরোপ করতে হবে। এ যুক্তি হচ্ছে নৈরাশ্যবাদিতার নামান্তর মাত্র। আর ইসলাম হচ্ছে আশাবাদী। তবে ইসলামের এই আশাবাদীরূপ ভলটেয়ারের ব্যঙ্গাত্মক চরিত্র সেই অদ্ভুত দার্শনিক ডাক্তার প্যাংলোস-এর আশাবাদিতার অনুরূপ নয়। ডাঃ প্যাংলোস প্রায়ই অভিভূত কণ্ঠে বলতেন: “সম্ভাব্য বিশ্বসমূহের মধ্যে উৎকৃষ্টতম এই বিশ্বে সবকিছুই উৎকৃষ্টতম কোনো কিছুর জন্যে।” এ হচ্ছে এমন একটি মন্তব্য, যা চিন্তাহীনের কাছে আশাবাদিতার স্বর্গকল্পনা বয়ে বেড়ায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ হচ্ছে অদৃষ্টবাদিতা, যা নৈরাশ্যবাদেরই আর একটি রূপ। ইসলাম অদৃষ্টবাদী নয়। হ্যাঁ, আমি সে কথারই পুনরাবৃত্তি করছি। মুসলমানের অদৃষ্টবাদিতা সম্পর্কে যত কথা বলা হয়েছে এবং যত কিছু লেখা হয়েছে, তা সত্ত্বেও এই শব্দটির সাধারণ স্বীকৃত অর্থের দিক থেকে ইসলাম অদৃষ্টবাদী নয়। ইসলাম প্রচলিত অবস্থাকে অপরিহার্য অশুভ অবস্থা কিংবা মন্দভাগ্য হিসাবে গ্রহণ করতে মানুষকে নির্দেশ দেয় না, বস্তুতঃ ইসলাম অগ্রগতির তাগিদে বিরামহীন কর্মসাধনায় ব্রতী হতে মানুষকে নির্দেশ দেয়।

ইসলামের ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে মানবিক প্রগতিমুখী। নানাবিধ অবজ্ঞা ও নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়ে একদিকে মানুষের দৈনন্দিন, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে- অন্যদিকে সে-সংগে তার প্রতিটি মনোভঙ্গি তথা তার মন ও আত্মার প্রতিটি আবেগ অনুভূতির ক্ষেত্রে ইসলাম এই মানবিক প্রগতির সঠিক পথ প্রদর্শন করেছে। এই অনুজ্ঞা নিষেধাজ্ঞাগুলো একটি পূর্ণাংগ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন-ব্যবস্থার বিধিভুক্ত হয়েছে। এ হচ্ছে একটি কার্যকরী বা বাস্তবানুগ ব্যবস্থা। কেননা, এমন এক সাফল্যের সংগে এ ব্যবস্থার প্রয়োগ হয়ে এসেছে, যা ইতিহাসের এক পরম বিস্ময়। অনেক লেখক ইসলামের এই বিস্ময়কর সাফল্যের পেছনে বাইরের কতগুলো কারণ নির্দেশের চেষ্টা করেছেন। তাঁদের এ স্বকপোলকল্পিত কারণগুলোর মধ্যে আশপাশের জাতিগুলোর দুর্বলতা, বেপরোয়াভাবে তরবারি ব্যবহার আর সময়ের সুযোগ গ্রহণ প্রভৃতি অন্যতম।

কিন্তু তাঁরা কি করে এর ব্যাখ্যা করবেন যে, মুসলমানরা যে পর্যন্ত পবিত্র বিধানের বিশেষ একটি অনুজ্ঞাকে নিষ্ঠার সংগে পালন করেছেন, সে পর্যন্ত তাঁরা সেই অনুজ্ঞার পরিসীমায় সফলকাম হয়েছেন এবং যখনি তারা এর অনুসরণে উপেক্ষা প্রদর্শন করেছে, তখনি তাদের নিশ্চিত ব্যর্থতাকে বরণ করতে হয়েছে; আর কিভাবেই বা এর ব্যাখ্যা করবেন যে, আল- কুরআন ও ইসলামের মহিমান্বিত নবীর নির্দেশিত বিধান যে সমগ্র মানবজাতির জন্য কিংবা সমগ্র মানবজাতির অনুকরণীয় স্বাভাবিক বিধান- এ ধারণা ব্যতিরেকেও মুসলমানদের ওপর বিধিবদ্ধ কর্মপন্থা অনুসরণ করে কোনো অমুসলমানও সব সময়েই সেই কর্মের পরিসরে সফলতা অর্জন করেছেন?

প্রকৃতপক্ষে এই বিধানগুলো হচ্ছে প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক আইন। মানুষ তার চরম দুর্ভোগের দিনে-অথবা বলা যায়, জাতি তার দুর্দিনেই এই বিধান লংঘন করে থাকে। কোনো ব্যক্তি বিশেষের গবেষণা বা নিরীক্ষায় এই বিধানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে ইতিহাসের সুদীর্ঘ র্থ কাল-পরিক্রমায় কোনো জ্ঞানব্রতী ছাত্র ও চিন্তাবিদ শুধু বিক্ষিপ্তভাবে এর অংশ বিশেষের সন্ধান পেতে পারেন। নবী বা প্রেরিত পুরুষগণই এই সার্বজনীন বিধানের উদগাতা। অর্থাৎ কোনো নবীর মাধ্যমেই এই বিধান প্রকাশিত হতে হবে। শুধু এইটুকু ছাড়া এই বিধানগুলো আমাদের অস্তিত্বের প্রত্যক্ষ নিয়ামক প্রাকৃতিক আইনের মতই স্বাভাবিক যার বিরুদ্ধবাদিতার কথা কেউ ভাবতেও পারে না।

অন্যান্য ধর্মমত তার সে সব অনুগামীদের সাফল্য লাভের প্রতিশ্রুতি দান করে, যারা এই পৃথিবীতে দুঃখ, দৈন্য ও কৃচ্ছতা বরণ করে এর যোগ্যতা অর্জন করে। ইসলাম সকল মানুষকে যথাক্রমে ইহলোক ও পরলোকে সাফল্য ও ফলভোগের প্রতিশ্রুতি দান করে। এ সাফল্যের জন্য তাদের কেবলমাত্র কয়েকটি সাধারণ আইন ও সহজ সরল জীবন-বিধান মেনে চলতে হবে। খাঁটি মুসলমানের এ জীবন ও পরজীবনের মধ্যে কোনো পার্থক্য চিহ্নিত হয়নি; কেননা, আল্লাহ পৃথিবী ও আকাশমন্ডলীর তথা স্বর্গ ও মর্তের প্রড় এবং ইহজীবন ও পরজীবনের সর্বময় ক্ষমতার অধিপতি। যারা আল-কুরআনের জীবন বিধান অনুসরণ করে আল্লাহর ইচ্ছার ওপর আত্মসমর্পণ করে, তাদের-মৃত্যুতে নয়-বস্তুতঃ এ পার্থিব জীবনেই পরজীবনের যাত্রা শুরু হয়। আমাদের প্রতি নির্দেশে মহানবী (সঃ) ঠিক এ কথাই ঘোষণা করেছেন: মৃত্যুর আগে মৃত্যুবরণ করো।

ইসলাম এই পৃথিবীতে যে সফলকামিতার প্রতিশ্রুতি দান করেছে, তা অন্য অনেকের মূল্যের বিনিময়ে কোনো একজন মানুষ বা ব্যক্তি বিশেষের সাফল্য নয়; কিংবা অন্য জাতির অধঃপতন, ক্ষতি ও নৈরাশ্যের বিনিময়ে কোনো এক জাতির সাফল্য নয়; প্রকৃতপক্ষে, ইসলামের সাফল্য সামগ্রিকভাবে মানবজাতির সাফল্য। বিশ্বের সর্বত্র প্রতিটি মসজিদ থেকে দিনে পাঁচবার এই আহ্বানই ঘোষিত হয়: এসো, ফালাহতে শরীক হও! এসো, ফালাহতে শরীক হও। অথবা কল্যাণ-অভিসারের পথে এসো।

আরবী শব্দ ফালাহ্ কথাটির অর্থ কল্যাণ-অভিসার বা অনুশীলনের মাধ্যমে সাফল্য লাভ। মুসলমানদের মধ্যে সাধারণভাবে ব্যবহৃত ঠিক অনুরূপ আর একটি আরবী শব্দ রয়েছে, পারিভাষিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে এর মৌলিক বা অন্তর্নিহিত অর্থটি আমরা প্রায়ই বিস্মৃত হই। সে শব্দটি হচ্ছে: যাকাত বা “অতিরিক্ত ভাগ যা অনুশীলন কিংবা সরাসরি ছাঁটাই বা বণ্টনের মাধ্যমে ফলন বা বৃদ্ধির কারণ ঘটায়।” এই নামেই ইসলামী দরিদ্র-করের নামকরণ করা হয়েছে। আল-কুরআনে ‘সালাত’ বা উপাসনার সমপর্যারে কর্তব্য হিসেবে বারবার যাকাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং যাকাত আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বস্তুতঃ যাকাত সমাজের উৎকর্ষ-লব্ধ ক্রম-উন্নয়নশীল অগ্রগতির একটি প্রধান কারণ। মহানবী (তাঁর ওপর আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক) বলেছেন: ধনীদের কাছ থেকে যাকাত আদায় করতে হবে এবং গরীবদের মধ্যে তা বন্টন করতে হবে। এ দরিদ্র-কর নিয়মিত ও সঠিকভাবে সংগ্রহ করার সময় মুসলিম সমাজের অবস্থা অগ্রগতির এমন এক উচ্চতম পর্যায়ে এসে পৌঁছেছিল যে, বহু দূর দূরান্ত পর্যন্ত বন্টনকারীদের ব্যাপক অনুসন্ধানের পরও যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত কোনো দুঃস্থ ও বঞ্চিত মুসলমানকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হতো না। সুতরাং যাকাতের সংগৃহীত অর্থ সাধারণ জনকল্যাণের কাজে ব্যয় করা হতো। আল কুরআনের ভাষায়:

সে সত্যি সফলকাম, যে মানবতার বিবর্তন ও বিকাশ সাধনে সহায়ক হয়েছে। আর সে সত্যি ব্যর্থকাম, যে এর বিকাশ রোধ করেছে এবং একে অনশনে রেখেছে।।

আল-কুরআনের আর এক জায়গায় বলা হয়েছে।

সে সফলকাম হয়েছে, যে আত্মবিকাশ সাধন করেছে (এবং পবিত্রতা লাভ করেছে); আর যে তার স্রষ্টা প্রভুর নাম স্মরণ করে এবং সালাত কায়েম করে।

অনেকে ভাবতে পারেন যে, এগুলো হচ্ছে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন কতকগুলো ভাবময় ধর্মীয় অভিব্যক্তি মাত্র। কিন্তু আসলে, বাস্তবভিত্তিক না হলে ইসলাম সম্পূর্ণ অর্থহীন। আরো সুস্পষ্ট ভাষায় বলতে গেলে, বাস্তব মূলবোধ না থাকলে ইসলামের কোনো মানেই হতো না এবং এই সব অভিব্যক্তি ইসলামে কেবলমাত্র নিষ্প্রাণ হরফ সমষ্টির অন্তরালে আবদ্ধ হয়ে থাকেনি। কেননা, এগুলোকে বৃহত্তর পর্যায়ে সাহায্য, সেবা ও দানশীলতার একটি সুসংবদ্ধ ব্যবস্থা হিসেবে বাস্তবরূপ দান করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, ইসলাম ভিন্ন এ ধরনের বাস্তবভিত্তিক, এমন ব্যাপক ও মহত্তর প্রচেষ্টা আর কোথাও হয়নি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ ব্যবস্থা মুসলিম বিশ্বের যাবতীয় সামাজিক সমস্যার সমাধান করেছে। আল-কুরআন আমাদের বলে, খাঁটি ধর্ম বাস্তববাদী- তত্ত্ব-নির্ভর ও অনুষ্ঠান সর্বস্ব নয়।

পূর্ব ও পশ্চিম অভিমুখে তোমাদের মুখ ফেরানোর মধ্যে কোনো সাধুতা বা ধর্মনিষ্ঠা নেই, প্রকৃতপক্ষে সেই সদাচারী ও ধর্মনিষ্ঠ, যে আল্লাহ ও শেষ বিচার দিন, ফেরেশতাগণ ও ঐশী গ্রন্থ এবং নবীদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে, আর আল্লাহর প্রতি ভালোবাসায় তার সম্পদ আত্মীয়-স্বজন, অনাথ-এতিম অভাবগ্রস্ত, গৃহহীন ও সায়েলদের সাহায্যে এবং দাসদের মুক্তি সাধনে দান করে; আর তারা, যারা নিয়মিতভাবে আল্লাহর উপাসনা করে, দরিদ্রদেরকে (তাদের) ন্যায়ানুগ হিস্যা (অংশ) দান করে এবং যারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলে তা পালন করে-আর যারা আপদে ও দুর্দশায় ধৈর্য ধারণ করে। এরাই হচ্ছে তারা যারা অকপট ও সত্যনিষ্ঠ। এরাই হচ্ছে তারা, যারা প্রকৃত শুদ্ধাচারী যারা আত্মাকে দুষ্কৃতিমুক্ত রাখে। (সূরা বাকারা)

আল-কুরআনে অনেক জায়গা এ কথাটি আছে:

যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকাজ করে; অর্থাৎ যারা আস্থাবাদী ও সৎকর্মশীল।

পবিত্র কুরআনে কতবার এ উক্তি উচ্চারিত হয়েছে!

যারা বিশ্বাস করে এবং আর কোনো কিছুই করে না।

মানে যারা বিশ্বাসী, কিন্তু কর্মবিমুখ, ইসলামে তাদের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। “যারা বিশ্বাসী, কিন্তু দুষ্কৃতিকারী” তাদের কথা ধারণাই করা যায় না- তারা সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত। কেননা, ইসলামের অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর ইচ্ছার ওপর মানুষের আত্মসমর্পণ। সুতরাং, আল্লাহর বিধান বা আইনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনও এর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর আইন হচ্ছে নিরন্তর উদ্যমময় ও গতিশীল-অলসতা বা কর্মবিমুখতার স্থান এতে নেই। ইসলামের স্বর্ণযুগে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যে কোনো পার্থক্য চিহ্নিত হয়নি। সব রকমের শিক্ষাকেই ধর্মীয় অঙ্গনে স্থান দেয়া হয়। এ সম্পর্কে সাম্প্রতিক কালে জনৈক ইউরোপীয় লেখকের একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরছি। এতে বলা হয়েছে: ইসলামের গৌরবময় কীর্তি হচ্ছে, ইসলাম কুরআন, হাদীস ও মুসলিম বিধান-শাস্ত্র ফিকাহর অধ্যয়ন ও অনুশীলনের অনুরূপ অন্য সব জ্ঞান বিজ্ঞানের সাধনাকেও সমান আসন মর্যাদা দান করেছে এবং মসজিদে তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

মসজিদে কুরআন, হাদীস ও ফিকাহর ওপর আলোচনার সংগে একই ভাবে রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, ভেষজ বিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপরও আলোচনা করা হতো। কেননা, স্বর্ণযুগে মসজিদই ছিল ইসলামের বিশ্ববিদ্যালয়। দেশ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বের প্রতি ক্ষেত্র প্রতি প্রান্ত থেকে লব্ধ যুগের সমস্ত জ্ঞানধারাকে সেদিন মসজিদের অঙ্গনে সাদরে বরণ করা হতো। এই আশ্চর্য বৈচিত্র্যময় সম্মিলন আর সর্বজ্ঞানের চরম উৎকর্ষই প্রাচীন মুসলিম মনীষীদের চিন্তাধারায় এক অনুপম বৈশিষ্ট্য দান করেছে- যা তাদের প্রতিটি পাঠকের মনেই রেখাপাত করে; এ হচ্ছে বিদগ্ধ মনের এক শান্ত স্থিত মহিমাময় রূপ। ইসলামে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ এবং ধর্মবাদের মতো কোনো মতবাদের অস্তিত্ব নেই। কেননা, খাঁটি ধর্ম মানুষের উদ্যম ও কর্মধারার সমগ্র পরিসরকেই তার আওতাভুক্ত করে। পবিত্র কুরআনে ভালো ও মন্দ তথা সুকৃতি ও দুষ্কৃতির মধ্যে পার্থক্য চিহ্নিত করা হয়েছে। সুকৃতি মানুষের বিকাশ ও উন্নয়নের সহায়ক, আর দুষ্কৃতি এর পক্ষে চরম হানিকর। ইসলাম মুক্তবুদ্ধিবাদী ধর্ম । এ ধর্মে সে মানুষের স্থান নেই, যে সেন্ট অগাস্টিনের সংগে স্বর মিলিয়ে বলে : Credo quia absurdum est “আমি বিশ্বাস করি, যেহেতু এটা অলৌকিক ও অবিশ্বাস্য” । আল-কুরআন বারবার অযৌক্তিক বা মুক্তবুদ্ধিবর্জিত ধর্মকে বাতিল ঘোষণা করেছে। কেননা, কুরআনের দৃষ্টিতে যুক্তিহীন ধর্মমত ধর্ম হিসেবে সম্পূর্ণ বাতিল ও অন্তঃসারশূন্য । বারবার কুরআন ধর্মীয় ক্ষেত্রে যুক্তি ও সাধারণ বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগের জন্যে মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সমস্ত ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা এটা প্রমাণ করে যে, মানবিক অগ্রগতির জন্যে অপরিহার্যভাবে ব্যাপক মুক্তবুদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে। এবং সে সংগে ইতিহাস একথাও প্রমাণ করে, যে-সব জাতি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস হারায়, তাদের অধঃপতন অনিবার্য। আল্লাহর প্রতি জাগ্রত বিশ্বাস এবং প্রশস্ত মুক্তবুদ্ধি- এ দুটো কি সংগতিহীন? পাশ্চাত্যের এক শ্রেণীর বেশ কিছুসংখ্যক চিন্তাবিদ মনে করেন, এ দু’য়ের মধ্যে কোনো সংগতি থাকতে পারে না। কিন্তু ইসলাম প্রমাণ করেছে, এ দুটো বিষয় সম্পূর্ণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সমন্বয়শীল ।

সাফল্যের ফলশ্রুতিবাহী ইসলামের প্রাথমিক শতাব্দীগুলোতে প্রতিটি বৈষয়িক ক্ষেত্রে আল্লাহর প্রতি অবিমিশ্র বিশ্বাসের সংগে মুক্তবুদ্ধির সমন্বয় সাধন করা হয়েছিল। কারণ, ইসলাম পৃথিবীর ওপরে এমন কোনো কিছুকেই এত পবিত্র মনে করে না, যা সমালোচনামুক্ত বা সমালোচনার নাগালের বাইরে। কেবল অসীম অলৌকিক শক্তিময় একজন মাত্র আছেন অকল্পনীয় অদ্বিতীয় সত্তাময় এমন একজন, যাঁর একত্বে একবার বিশ্বাস স্থাপনের পর আর কোনো আলোচনার অবকাশ থাকে না। তিনি সকলের জন্যে সার্বজনীনভাবে মঙ্গলময় ও দয়ালু। তিনি মানুষকে যুক্তি, প্রজ্ঞা ও কার্যকারণ নিরূপণের প্রতিভা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। মুসলিম মনীষী লেখকরা মানুষের প্রতি আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম দান হিসেবে এ কার্যকারণ জ্ঞানকে উচ্চ মর্যাদা দিয়েছেন এবং উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। যা শুভ ও কল্যাণকর তার অনুরসণ এবং যা মন্দ ও অকল্যাণকর তার পথ বর্জনের উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষ যাতে সম্পূর্ণ অবাধে আল্লাহর নামে তার এই বিচারবুদ্ধি ও কার্যকারণজ্ঞান প্রয়োগ করতে পারে, সে জন্যেই আল্লাহ তাকে এ ক্ষমতা দান করেছেন। আর এ উদ্দেশ্যের অনুগমনের ক্ষেত্রে পবিত্র সংবিধানে পথ নির্দেশ ও রক্ষা কবচের ব্যবস্থা রয়েছে। ইসলামে কোনো পৌরোহিত্যবাদ নেই। অন্যান্য ধর্মে সব রকম অধিকার ও কার্যক্রম অস্বাভাবিকভাবে পুরোহিত সম্প্রদায়ের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। কিন্তু ইসলামের সমাজ- ব্যবস্থায় এসব অধিকার ও দায়িত্ব প্রত্যেক ব্যক্তি-মানুষের ওপর আরোপ করা হয়েছে সুতরাং এ প্রশস্ত দৃষ্টিভঙ্গির ফলে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তিগণ স্বাভাবিকভাবেই নেতৃত্বপদ লাভ করেন।

কোনো নর-নারীর জীবনের চলার পথে আলোক-সঞ্চারের পক্ষে একজন জ্ঞানী ব্যক্তি হচ্ছে। তৈলবিহীন একটি প্রদীপের মতো। তাই এই যুক্তি-জ্ঞানের চরম উৎকর্ষ সাধনের সংগে সার্বজনীন শিক্ষার নির্দেশ বিধৃত হয়েছে। মহানবী বলেছেন : জ্ঞানানুশীলন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্যে অবশ্য কর্তব্য বা ফরজ।

এভাবে তেরশ’ বছর আগে নর ও নারী উভয়ের জন্যেই সার্বজনীন শিক্ষা ইসলামের পবিত্র সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়। পরে পাশ্চাত্য সভ্যতা একে সাদরে বরণ করে নেয়। মহানবী একথাও বলেছেন বলে বর্ণিত হয়েছে : জ্ঞানার্জনের সন্ধান কর, যদি সে জ্ঞান চীনেও

থেকে থাকে।

নিম্নোক্ত নির্ভরযোগ্য হাদীসটি থেকে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়, জ্ঞানানুশীলনের ওপরই কেবলমাত্র গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি-জনসাধারণের মধ্যে জ্ঞান বিস্তারের ওপরও সমান গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে : নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর বান্দাদের কাছে থেকে জ্ঞানকে ছিনিয়ে নেবেন না, প্রকৃতপক্ষে, তিনি জ্ঞানসাধকদের পৃথিবী থেকে উঠিয়ে নিয়ে জ্ঞানের ক্ষেত্রে (রাজ্য) শূন্যতা সৃষ্টি করবেন। এর ফলে এমন অবস্থার উদ্ভব হবে যে, কোথাও কোনো খাঁটি জ্ঞানী ব্যক্তি বা আলেম অবশিষ্ট থাকবে না । তখন মানুষ মূর্খদেরকে তাদের নেতা বা পথপ্রদর্শক হিসেবে বরণ করবে এবং তাদের নানা বিষয়ে প্রশ্ন করবে (নানা বিষয় সম্পর্কে তাদের মতামত জানতে চাইবে)। এবং তারা (সেই মূর্খ নেতাগণ) কোনোরূপ জ্ঞান ব্যাতিরিকেই ফতোয়া দান করবে। (এরফলে) তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হবে এবং অপরকেও পথভ্রষ্ট করবে।

এ উক্তিতে ইসলামের বর্তমান অবস্থা সুস্পষ্টভাবে চিত্রিত হয়েছে। আমাদের মধ্যে এখন এমন বহু সংকীর্ণচিত্ত গোঁড়া আলেম দেখা যায়, যাঁদের জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে আমাদের যথেষ্ট সন্দেহের কারণ রয়েছে। তবে এখানে জ্ঞান শব্দটি যে অর্থে প্রয়োগ করা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে যে জ্ঞান রয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রশস্ততর এবং অধিকতর মানবীয়।

এছাড়াও মহানবী বলেছে : জ্ঞান-সাধকের কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও পবিত্রতর । তিনি আরো বলেন, আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে এক ঘন্টার নীরব চিন্তা ও গবেষণা এক বছরের উপাসনার চেয়েও উত্তম।

তাঁর আর সব উক্তিতে আছে : “যে জ্ঞান সাধনা করে, তার মৃত্যু নেই- সে অমর।” “যে জ্ঞান-সাধকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে, সে আমার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। “প্রথম যে জিনিস সৃষ্টি করা হয়েছিল তা হলো-বিচার বুদ্ধি বা কার্যকারণজ্ঞান।” “আল্লাহ বিচার বুদ্ধির চেয়ে উৎকৃষ্ট কোনো কিছুই সৃষ্টি করেননি। এর দ্বারাই আল্লাহ আমাদের কল্যাণবিধি করেছেন, এবং এর সাহায্যেই আমরা সবকিছু বুঝি ও অনুধাবন করি, আর এর জন্যেই আল্লাহর সন্তুষ্টির কারণ ঘটে থাকে, এবং এর মধ্যেই পুরস্কার ও শাস্তির কারণ নিহিত রয়েছে।” তিনি বলেন: “জ্ঞানসাধকের কথা শোনা এবং অন্যদের মধ্যে বিজ্ঞান-শিক্ষার প্রেরণা সৃষ্টি ধর্মীয় উপাসনা-অনুশীলনের চেয়েও মহত্তর।” “যে জ্ঞান-সাধনার উদ্দেশ্যে গৃহ ত্যাগ করে, সে আল্লাহর রাস্তায় পদচারণা করে।” “জ্ঞান তার অধিকারীকে মন্দ থেকে ভালো কিংবা দুষ্কৃতি থেকে সুকৃতির পার্থক্য নিরূপণে সাহায্য করে; জ্ঞান বেহেশতগামী পথকে আলোকিত করে। ঊষর মরুতে এ আমাদের বন্ধু, নিভৃতবাসে আমাদের সমাজ, আর বন্ধুহীন অবস্থায় আমাদের সহচর। এ সুখের পথের সন্ধান দেয় এবং দুঃখের গুরুভার বহনের শক্তি দান করে । বন্ধুদের মধ্যে এ হচ্ছে একটি ভূষণ, এবং দুশমনদের বিরুদ্ধে এ হচ্ছে এক দুর্ভেদ্য বর্ম। “দেখ! ফেরেশতাগণ জ্ঞান-সাধকের ওপর তাদের আলোর পাখা বিস্তার করেছে।” “যাদের জ্ঞান আছে, আর যাদের নেই তারা কি সমপর্যায়ভুক্ত?” “জ্ঞানী ব্যক্তির স্থান ধর্মব্রতীর ওপরে; আর আমার স্থান তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে অধস্তন ব্যক্তির ওপরে।”

তিনি বলেন, একজন মানুষ নামাজ, রোজা, যাকাত, দান-খয়রাত ও হজব্রত অনুষ্ঠান এবং অন্যসব ধর্মীয় কর্তব্য পালন করতে পারে। কিন্তু জীবনে যে পরিমাণ সাধারণ বিচার-বুদ্ধি দিয়ে সে পরিচালিত হয়েছে, ঠিক সে অনুপাতেই তাকে পুরস্কৃত করা হবে। তিনি আরো বলেন, জ্ঞান আছে-অথচ যে তা জীবনে চলার পথে প্রয়োগ করতে জানে না, সে বইয়ের বোঝাবাহী একটি গাধার মত’।

ইসলামে কোনো অজ্ঞ মুসলমানের অস্তিত্বের কথা পবিত্র কুরআনে কখনো ধারণা করাও হয়নি এবং মহানবী হযরত মোহাম্মদও (সঃ) তা কখনো কল্পনা করতে পারেননি প্রকৃতপক্ষে, ‘অজ্ঞ মুসলমান’ কথাটি ‘মুসলমান’ পদবাচক সংজ্ঞার পরিপন্থী বা বিপরীতার্থক । ইসলামের গৌরবময় দিনে একজন ‘দরিদ্র মুসলমানের’ মতো একজন অজ্ঞ মুসলমানকেও খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত দুষ্কর হতো ।

ইসলাম ধর্মকে তার যথার্থ কর্মাংগন দৈনন্দিন জীবনে ঠাঁই দিয়েছে। কুরআনে আল্লাহর যে ‘নূর’ বা আলোর কথা বলা হয়েছে, আল্লাহর পথ-নির্দেশ অনুসরণকারীদের প্রত্যেকের কাছে তার অর্থ সুস্পষ্ট। কেননা, এ হচ্ছে এমনি এক নিত্যদিনকার আলো, যা আল্লাহর স্বতঃনিসৃত শুদ্ধ পুত জ্ঞান দ্বারা রূপান্তরিত, উদ্ভাসিত এবং মহিমান্বিত হয়। ধর্মের লক্ষ্য ভবিষ্যতের গর্ভে নিহিত কোনো দীর্ঘ-বিলম্বিত সুদূর আশ্রয়ী বস্তু নয়; তা এখানে- এই প্রবাহমান বর্তমানের মধ্যেই রয়েছে; রয়েছে আমাদের সহগামীদের সুকৃতি ও নিত্যদিনকার কর্মাংগনের মাঝে। মহানবী যে সত্যের কথা বলেন, আরবের প্রতীকবাদীরা তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ হিসেবে তাঁকে কিছু অলৌকিক ঘটনা প্রদর্শনের জন্যে পীড়াপীড়ি করতে থাকে । এই প্রতীকবাদীদের সম্পর্কে আল-কুরআনে বলা হয় :

এবং তারা বলে ঃ একি স্বভাব-বৈশিষ্ট্য আল্লাহর প্রেরিত একজন নবীর-যিনি (সাধারণ) খাদ্য গ্রহণ করেন এবং নগর ও বাজারের পথে পদচারণ করেন? কেন তাঁর সংগে সতর্ককারী হিসেবে একজন স্বর্গীয় দূত (ফেরেস্তা) পাঠানো হয় না? অথবা (কেন) তাঁকে ঐশ্বর্যপূর্ণ একটা ধনাগার দান করা হয় না? অথবা (কেন) তাঁর এমন একটা বেহেশত নেই যা থেকে তিনি খাদ্যসামগ্রী পেতে পারেন? দুষ্কৃতিকারীরা তাই বলে ঃ তারা (বিশ্বাসীরা) যার অনুসরণ করছে সে একজন সম্মোহনকারী (যাদুকর) ছাড়া আর কিছুই নয়।

আর আল্লাহ যে-ভাষায় দুষ্কৃতিকারীদের এই মনোভাবের জওয়াব দিয়েছেন তা থেকে স্বীকৃতির প্রমাণ বা নিদর্শন নয়। কেননা মানুষের বিচার-বুদ্ধি ও যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অত্যন্ত সহজ ও সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় অলৌকিক ঘটনা আল্লাহর প্রেরিত নবীর প্রতি কাছেই নবীদের আবেদন জানাতে হবে তাদের দুর্বল চেতনা বা কৌতূহল প্রবণতার কাছে নয়। আল-কুরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেন :

“আমরা তোমার পূর্বে এমন কোনো নবী পাঠাইনি যারা খাদ্যগ্রহণ ব্যতিরেকে ছিল এবং নগর-বাজারের পথে পদচারণা করেনি।”

এর অর্থ হচ্ছে, প্রাচীন কালের যেসব নবীকে লোকে অতিমানবিক সত্তা বলে মনে করতো, তাঁরাও সাধারণ মানুষ ছিলেন এবং তাঁরা আল্লাহর নামে অন্যদের কাছে আবেদন জানাতেন ।

ইসলামের শিক্ষার দৃষ্টিতে অলৌকিকতা ঐশী শক্তির এবং ধর্মের প্রাণবস্তুর প্রমাণ-নির্দেশন বা বৈশিষ্ট্য নয়। প্রকৃতপক্ষে, অলৌকিক শক্তি প্রাকৃতিক আইনের বিধানকে খুব কমই লংঘন করে থাকে। কেননা প্রাকৃতিক আইন মৌলিকভাবে ঐশী শক্তিসঞ্জাত এবং স্বয়ং আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন। অলৌকিকতা বা অলৌকিক শক্তি বৈচিত্র্য হচ্ছে, লক্ষ্যের পথে চলাকালে কোনো বিশেষ স্তরে মানবিক অগ্রগতি-কিংবা বলা যায় মানুষের আত্মিক অগ্রগতির এক বিশেষ প্রকাশ-বৈশিষ্ট্যের নিদর্শন। আত্মিক অগ্রগতির এই স্তরে সাধারণ মানুষের কাছে অপ্রকাশিত নিয়মাধারা বা বিধানসমূহ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। হজরত মুহম্মদ (দঃ)-এর জীবনের সংগেও বহু অলৌকিক ঘটনা জড়িয়ে আছে। কিন্তু কোনো মুসলমান এগুলোকে তাঁর নবুয়ত কিংবা তাঁর নবীসুলভ কর্মব্রতের প্রমাণ বা নিদর্শন বলে মনে করে না। আল্লাহর প্রত্যাদিষ্ট বাণী ও কর্মের লব্ধ সাফল্য-আল কুরআন এবং মহানবীর প্রচার, আর এ দুয়ের সামগ্রিক ফলাফল-এদের নিজস্ব সাক্ষ্য বহন করছে। আর এগুলো সমস্ত অলৌকিকতার উর্ধ্বে ।

তবে এটা সত্য যে, প্রত্যাদেশবাদী মুসলমানদের বেশির ভাগই আজ অজ্ঞ, গোঁড়া ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। তারা জনশ্রুতি, প্রবাদ, আজগুবী কাহিনী ও অসম্ভব বিশ্বাসকে ধর্ম- বিশ্বাসের সংগে যুক্ত করেছে। কিন্তু যেখানে মানুষের মন কঠোর বাস্তবধর্মিতা এবং সমাজের প্রচলিত অবস্থা ও প্রবাহমান বর্তমানের আলোকে উদ্ভাসিত, সেখানে সব সময়ই এ ধরনের ভ্রান্ত বিশ্বাস সংশয়বাদিতা ও নাস্তিকতার অস্ত্রের হুমকীর সম্মুখীন । তবে এটাও ঠিক যে, এসব কুসংস্কার ও প্রবাদের এক বিরাট অংশই প্রাচীন কালের এক বিলুপ্ত বিজ্ঞানের প্রতিনিধিত্ব বহন করছে। ইসলামের অন্তর্বাণী ও যুগধর্মী মুল্যবোধ এই স্থবির অচলায়তনের বুকে আধুনিক বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা কামনা করে। কেননা, মুসলমানের মন পৃথিবীর সর্ব ক্ষেত্রে- সর্ব পরিস্থিতিতেই স্বাধীন ও সংস্কারমুক্ত; অবশ্য এই মুক্তিচিত্ততা তখনি সম্ভব, যখন সে তার দৈহিক, মানসিক ও আত্মিক বিকাশ ও অগ্রগতির উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত কতগুলো বিধি বিধান যথার্থভাবে পালন করে। তার যুগের বিজ্ঞান-সাধনা ও বৈজ্ঞানিক সৃষ্টির উদ্ভাবন এবং তার মন যা কিছুকে শ্রেয়তর মনে করে, সে সবকিছু গ্রহণ ও বাস্তবায়ন তার কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত-এমন কি, যদিও তা মুসলমানদের মধ্যে বহু পূর্ব থেকে প্রচলিত কোনো বিশ্বাস কিংবা তাদের বিশেষ কোনো প্রবণতার পরিপন্থী হয় । কিন্তু এ তার ধর্ম-বিশ্বাসকে কখনো স্পর্শ করতে পারে না, যার প্রাণ-বাণী হচ্ছে : “আল্লাহ ছাড়া আর কোনো নিয়ন্তা বা প্রভু নেই এবং মুহাম্মদ (সঃ) আল্লাহর প্রত্যাদিষ্ট নবী।” এ হচ্ছে সেই জীবনবাদী ধর্ম-প্রখ্যাত জড়বাদী চিন্তানায়ক গীবন যাকে একটি শাশ্বত সত্য ও একটি প্রয়োজনীয় উপাখ্যানের সমন্বয় বলে অভিহিত করেছেন। তবে ঐতিহাসিক পরিণতির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি উপাখ্যান বা কাহিনীসুলভতার যৌক্তিকতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন।

ইসলামের বাস্তব ও কার্যকরী শিক্ষা এবং প্রবাদ ও জনশ্রুতির মধ্যে পার্থক্য নিরূপণের জন্য মুসলমানদের মধ্যে অধুনা এক ব্যাপক ও ক্রমবর্ধমান প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এ সব জনশ্রুতি ও প্রবাদকে পুরানো জীর্ণ পোশাকের মতোই আজ ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। মুসলমানদের ধর্ম বিশ্বাসে জুব্বার প্রভাবের অপ্রাধান্য দেখে খৃষ্টানদের ধর্মীয় সংস্কারের বিভ্রান্ত সমালোচকগণই কেবল বিস্মিত হবেন। কেননা, তারা ধর্ম বিশ্বাসের সাথে তার বাইরের আবরণকে এক করে দেখেন- যা মুসলমানরা কখনো করেনি।

আল-কুরআনে মানুষকে প্রাকৃতিক ঘটনা-বৈচিত্র্য, দিন-রাতের পর্যায়ক্রম, মাটি, বাতাস, আগুন ও পানির উপাদান, জন্ম-মৃত্যু, বিকাশ ও বিলুপ্ত (কিংবা উত্থান ও পতন) আর প্রাকৃতিক নিয়ম ও শৃঙ্খলার ধারা পর্যবেক্ষণ ও অনুধাবনের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রাকৃতিক নিয়মশৃঙ্খলা হচ্ছে এমন এক স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবস্থা, যা মানুষের হাতে প্রণীত হয়নি এবং মানুষ যাকে এক পরিমাণও অবনত, স্থানচ্যুত কিংবা পরিবর্তন করতে পারে না। মানুষ যে এই জাগতিক বিশ্বের সার্বভৌম নিয়ন্তা নয়, এর প্রমাণ হিসেবেই তাকে এই প্রাকৃতিক রহস্যসমূহ পর্যবেক্ষণ ও অনুধাবনের জন্যে বলা হয়েছে। মানুষের মুক্তচিন্তা, গবেষণা ও সাফল্যজনক প্রচেষ্টার পরিসীমা একটি সার্বভৌম ও স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তার অধীন একটি ‘আরোপিত শক্তি’ ছাড়া আর কিছুই নয়। এই স্বয়ংসম্পূর্ণ সার্বভৌম সত্তা মহাবিশ্বের স্রষ্টা ও প্রতিপালক এবং জগতসমূহের নিয়ন্তা মহিমান্বিত আল্লাহ ৷ নিয়মগত ভাবেই মানুষ তার প্রাকৃতিক অবস্থার বিস্ময়কর রহস্য এবং তার চারপাশে যে শাশ্বত বিধান নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে, তা উপলব্ধি করতে পারে না। কেননা, এগুলো কখনো তাকে নিরাশ করে না । এক অসাধারণ সৃজনশীল শক্তির রহস্য চারপাশ থেকে তাকে ঘিরে রেখেছে- যে শক্তি নিষ্ফল কিংবা ব্যর্থ হয় না; আর অলংঘনীয় একটি আইন ও নিয়ম ধারার অধীন করে একটি বিশ্বে তাকে অভিষিক্ত করা হয়েছে। এবং এমন প্রত্যক্ষভাবে সে এ নিয়মের অধীন যে এর বিধানসমূহ (যা সে প্রণয়ন করেনি) মান্য না করে সে একটি নিশ্বাস ফেলতে পারে না, একটি আঙ্গুল হেলাতে পারে না, একটি শব্দ উচ্চারণ করতে পারে না এবং এতটুকু কল্পনা বা চিন্তা পর্যন্ত করতে পারে না। সাধারণভাবে মানুষ এই বিষয়গুলো নিয়ে খুব সামান্যই চিন্তা করে। কেননা, নিজকে নিয়েই সে অনুক্ষণ ব্যস্ত থাকে এবং নিজের কর্মশক্তির সীমিত জগতে যে কোনো পোকা মাকড়ের মতই স্বার্থের দ্বন্দ্বে সে নিজেকে আবদ্ধ রাখে। তার এই গণ্ডিবদ্ধ পরিসীমাকেই সে সবচেয়ে বড় মনে করে এবং শুধু তার বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে সাহায্যের জন্যেই সে একজন ভাগ্যবিধাতার প্রয়োজন অনুভব করে। এই আত্মকেন্দ্রিকতার উপাসনা করতে যেয়ে সে সমগ্র সৃষ্টির প্রয়োজন এবং স্রষ্টার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয় ।

একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, একজন স্রষ্টা আর একটা উদ্দেশ্যের কথা স্বীকার করে নিলেই আমরা বিশেষ বা বিরাট কিছু আশা করতে পারি না। আমাদের অবশ্যই আল্লাহর এবং সৃষ্টির মূলে যে উদ্দেশ্য কাজ করছে, তার মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে; এবং একমাত্র তখনি আমরা সাফল্য আশা করতে পারি।

সত্য সত্যই মানুষ বিদ্রোহাচরণ করে (অর্থাৎ সে তার সীমার বাইরে চলে যায়) এবং এজন্যই সে নিজকে স্বাধীন বা অমুখাপেক্ষী মনে করে। (হে শ্রোতৃবৃন্দ) তোমাদের অবশ্যই তোমাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তন করতে হবে।

কয়েক বছর আগে স্কটল্যান্ডের জনৈক ধর্মযাজকের একখানা বইয়ের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। বইটা তেমন আকর্ষণীয় কিছু নয় এবং ইংরেজি ভাষাভাষী মানুষের কাছে তেমন কোনো সাড়া জাগাতে পারেনি। বইটার নামকরণ করা হয় : ‘আধ্যাত্মিক জগতের প্রাকৃতিক প্রত্যাদেশবাণীকে আইন।’ কেবলমাত্র নামের জন্যেই আমি বইটার উল্লেখ করছি। কেননা, ইসলামের আরো ব্যাপকভাবে প্রয়োগ ও বিশ্লেষণ করা যেতে পারে এবং এই প্রশস্ত দৃষ্টিকোণ থেকে এভাবে অভিহিত করা যায় : ‘আধ্যাত্মিক জগত, সামাজিক জগত এবং রাজনৈতিক জগতের প্রাকৃতিক আইন।’ যে প্রাকৃতিক আইন মানুষের দৈহিক অস্তিত্ব নিয়ন্ত্রণ করে, ইসলাম তার কাছেই আল্লাহর প্রকৃত প্রভুত্ব ও সার্বভৌমত্বের সাক্ষ্যদানের জন্যে তথা প্রামাণ্য নির্দেশের আবেদন জানায়; এবং তারপরই প্রমাণ করে কিভাবে ঠিক একই আইন মানুষের আধ্যাত্মিক, সমবায়িক বা সামগ্রিক জীবনও নিয়ন্ত্রিত করে। সকল নবী ও সূফি- সাধকদের জীবনের সংগে সংশ্লিষ্ট সমস্ত অলৌকিক ঘটনাকে এত কম গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে যে, এগুলোর উপর বিশ্বাস স্থাপন বাধ্যতামূলক বা অপরিহার্য নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে যা কিছু বাধ্যতামূলক, তা হচ্ছে আল্লাহর সার্বজনীন সার্বভৌমত্ব এবং হজরত মুহাম্মদ (আল্লাহ তাঁর ওপর শান্তি বর্ষণ করুন) এর নবুয়ত এবং আল্লাহর মানবিক দূত হিসেবে অন্যান্য নবীর উপর বিশ্বাস স্থাপন। আল-কুরআনের একটি অনুবাদ পড়ার পর ইসলামের এই স্বাভাবিক ও বাস্তবধর্মী বৈশিষ্ট্য দেখেই সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম জার্মান কবি গ্যোটে বিস্ময়-বিহ্বল কণ্ঠে বলেছিলেন : “এ যদি ইসলাম হয় তবে আমাদের মধ্যে প্রতিটি চিন্তাশীল ব্যক্তিই একজন মুসলমান।”

গণতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র কিংবা ধনতন্ত্র-অথবা আধুনিক যুগে পরীক্ষিত অন্য কোনো মতবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত না হয়ে সম্পূর্ণভাবে নীতি ও আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ইসলামী সংস্কৃতি আধুনিক চিন্তার ক্ষেত্রে অপাঙক্তেয়-এই অজুহাত তুলে আধুনিক বিশ্বের এক শ্রেণীর লোক-বিশেষ করে করে সবেচেয়ে সচেতন একটি শ্রেণী ইসলামী সংস্কৃতি সম্পর্কে আপত্তি উত্থাপন করবে। এবং কেউ একথাও যোগ করতে পারে যে, তাদের সকলেই একযোগে ইসলামী সংস্কৃতিকে ধর্মীয় আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত না হয়ে ওপরের যে-কোনো মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাইবে। আরো স্পষ্ট করে বলা যায় : তারা ধর্মীয় বা নৈতিক আদর্শ ছাড়া অন্য যে-কোনো মতবাদের ওপর ইসলামী সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাইবে এবং সমস্বরে এর প্রতি সমর্থন করতে দেখা যাবে।   

ধর্মের পরোক্ষ আদর্শকে ইসলাম গ্রহণ করেনি এবং মূল্যবোধের গণ্ডিতে সীমিত করে দেয়নি। তাই কেবল উপাসনার সময়ে ধর্মকে স্মরণ করা হয় এবং অন্য সময়ে ভুলে যাওয়া হয়- ধর্ম সম্পর্কে এই ধরনের নিরাসক্তি এবং জীবন থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রাখার মনোভাব ইসলামে ঠাই পায়নি । প্রকৃতপক্ষে, খাঁটি, কার্যকরী ও পূর্ণাংগ ধর্মীয় আদর্শবাদকেই ইসলাম স্বীকৃতি দেয় এবং সব সময়ে এই আদর্শের অনুসরণ করে। জনৈক প্রখ্যাত ইউরোপীয় রাজনীতিবিদ ধর্মীয় আদর্শবাদ সম্পর্কে এই কটাক্ষ করে বাহ্বা লাভ করেন যে, প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে সর্বশক্তিমানের কোনো ভূমিকা নেই। সাম্প্রতিক ইতিহাসের পাঠকদের চোখে ইউরোপীয় রাজনীতির প্রধান যে ত্রুটিগুলো সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়বে, তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে : তারা আল্লাহর কার্যক্রম তথা কোনো অদৃষ্টপূর্ব ঘটনা, যা বাস্তব পরিকল্পনাসমূহে ওলোট-পালট করে দেয়- তার প্রতি কোনোরূপ গুরুত্ব আরোপ করেনা। আল্লাহর পরিণামসূচক আইন এখনো কার্যকরী রয়েছে। ভালোর পরিণাম এখনো ভালো এবং মন্দের পরিণাম পরবর্তী যে কোনো অবস্থায়ই মন্দ। এ স্বাভাবিক পরিণাম সম্পর্কে যত লোকই চোখ বুজে থাক না কেন, এ ঘটবেই। আমাদের সময়ে যত অদৃষ্টপূর্ব ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে দৃষ্টান্ত হিসেবে রুশ বিপ্লব ও তুরস্কের ওপর গ্রীক হামলার ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এ নিঃসন্দেহে আল্লাহর পরিণামসূচক কাজ, যা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে নিশ্চিত সাফল্যের সম্ভাবনাবাহী লোলুপ আকাঙ্ক্ষা প্রবণ পরিকল্পনাসমূহ এবং রাষ্ট্রনীতিবিদদের সুপরিকল্পিত চক্রান্তকে নস্যাত করে দিয়েছে।

আল্লাহর শাসন-ব্যবস্থা বা খেলাফত সম্পর্কে যা বলা হয়েছে এবং যার কিছুটা বাস্তবায়িত করতে ইসলাম সক্ষম হয়েছে, তার আলোকে বিচার করলে আমার কাছে মনে হয়, মধ্যযুগের সংগে আধুনিক বিশ্বের মোটেই কোনো পার্থক্য নেই। এ মতের বিরুদ্ধবাদীগণ শুধুমাত্র ভুয়া প্রমাণপঞ্জিকে মূলধন করে তর্ক তুলবেন। কেননা, মধ্যযুগে ইউরোপে ধর্মতন্ত্রের যে আদর্শবাদ বিদ্যমান ছিল, তা আজগুবী প্রবাদ-কাহিনী, গীর্জার স্তোত্র ও আচার-অনুষ্ঠানের সংগে একীভূত হয়ে পড়েছিল এবং ধর্মকে তখন পঙ্কিল পৃথিবী থেকে আত্মরক্ষার আশ্রয়স্থল বলে মনে করা হতো। ইউরোপীয় ধর্মীয় আদর্শের এইসব ভুয়া ও বিভ্রান্তিকর প্রমাণপঞ্জি তুলে ধরে এসব তর্কবাগীশগণ স্বতঃসিদ্ধভাবে ধরে নেয় যে, সমস্ত ধর্মীয় আদর্শই অবাস্তব এবং কেবল সংসার- বিমুখ সন্ন্যাসী বা ধর্মান্ধদের স্বপ্ন মাত্র। আধুনিক বিজ্ঞান অলৌকিকতাকে কক্ষচ্যুত করেছে এবং মানুষ তাদের এক মহান কর্তব্য হিসেবে এই পৃথিবীর সম্পদ ও ঐশ্বর্যের পূর্ণাংগ সদ্ব্যবহার এবং এর আওতায় তাদের অবস্থার উন্নয়ন সাধনের কথা চিন্তা করছে। এদের মধ্যে যারা মহৎ, তারা তাদের প্রতিবেশী ও দেশবাসীর অবস্থার উন্নয়নকে বড়ো করে দেখছে এবং এর তুলনায় নিজেদের অবস্থার উন্নয়নের কথা কম ভাবছে।”

এভাবে বাস্তব জীবন ও মানবিক প্রয়োজন থেকে বহু দূরে নির্বাসিত অলৌকিকতা-আশ্রয়ী এবং প্রাকৃতিকভাবে নৈরাশ্যবাদী একটি ধর্মবাদী আদর্শ আধুনিক জীবন-ব্যবস্থার সংগে সংগতিবিহীন আর আধুনিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই অপাঙক্তেয় হয়ে পড়েছে। আর সত্যিই এ পরিবর্তিত যুগপ্রেক্ষণায় এ জীবনবিমুখ আদর্শকে অচল এবং নব জীবন বিধানের পক্ষে সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত বলে মনে করা যেতে পারে। কেননা, এ আদর্শবাদ এই পৃথিবীকে শয়তানের রাজ্য বলে মনে করে এবং মুক্তিসন্ধানী মানুষকে এ পৃথিবীর পরিসীমা হতে পলায়নের নির্দেশ দেয়। এ ধরনের ধর্মীয় আদর্শবাদ কখনো স্বাভাবিক ও বাস্তব-নির্ভর হতে পারে না; এবং প্রকৃতপক্ষে এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আধুনিক জীবনের আত্মঘাতি স্বার্থসর্বস্বতার প্রতিরোধের জন্যে একটি বাস্তবধর্মী জীবন-আদর্শের আজ অনিবার্য প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এ হচ্ছে এমন একটি আদর্শ, যার ভিত্তি বৈজ্ঞানিক আবিষ্ক্রিয়া কিংবা মানুষের চিন্তার ব্যাপ্তির ফলে বসে যেতে পারে না। কেননা, বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনা ও মানুষের চিন্তার ফলাফল প্রকৃতির মধ্যে অন্তর্নিহিত রয়েছে; আর এ আদর্শও প্রকৃতিধর্মী। বিজ্ঞানের প্রগতিমুখী প্রচেষ্টা যত বেশি এবং ব্যাপকভাবে প্রাকৃতিক জগতের রহস্য উদ্ঘাটন করবে, ততই আরো অধিকতর কীর্তিত হয়ে খাঁটি মুসলমানদের কাছে আল্লাহর মহিমা, তাঁর বিধান ও সার্বভৌম শক্তির নিদর্শন আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।

যে পর্যন্ত প্রাকৃতিক আইনসমূহ দৃঢ়সংঘবদ্ধ থাকবে এবং ভালো কিংবা মন্দের পরিণতি কোনো বিশেষ মানুষ ও জাতির কার্যাবলীর অনুগম করবে, সে-পর্যন্ত মানুষের জীবনে তার নিজস্ব ইচ্ছা ও উদ্দেশ্যের চাইতে বৃহত্তর একটি ইচ্ছা ও উদ্দেশ্যের প্রয়োজন অবশ্যই অনূভূত হবে এবং মানুষ তার নিজের রায় ও বিচার বুদ্ধির চাইতেও উচ্চতর বিচার-বুদ্ধির প্রত্যাশা করবে। আর

যে পযন্ত বৃহত্তর ইচ্ছার ও উদ্দেশ্যের নিকট মানুষের আত্মসমর্পণের প্রয়োজন অনুভূত হবে, সে পর্যন্ত মানুষ সাফল্য লাভ করবে। অর্থাৎ মানুষকে সাফল্য লাভ করতে হলে বৃহত্তর ইচ্ছা ও  উদ্দেশ্যের নিকট তাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। আর আল-কুরআনের শিক্ষার দৃষ্টিতে এই বৃহত্তর ইচ্ছা-উদ্দেশ্যের নিকট আত্মসমর্পণ হচ্ছে ইসলাম।

সমাজতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ, শ্রমিকতন্ত্র ও বলশেভিকবাদের বিকল্প হিসেবে ইসলাম একটি পূর্ণাংগ রাজনৈতিক ও সমাজনৈতিক জীবন-ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দান করে। পক্ষান্তরে, অন্য সব মতবাদ বিকল্প হিসেবে এমন একটি ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দান করে যা নিশ্চিতভাবে অনিবার্য ধ্বংসের হুমকীর সম্মুখীন-অর্থাৎ অনিবার্য ধ্বংসই যার স্বাভাবিক পরিণতি। এসব অন্তঃসারশূন্য ঠুনকো মতবাদগুলোর ওপর ইসলামী জীবন-ব্যবস্থার এক বিরাট প্রাধান্য রয়েছে এবং অপরিসীম সাফল্যের সংগেই এই জীবন-ব্যবস্থার অনুশীলন হয়েছে। আর সাফল্য যত বিরাট হবে, তার অনুশীলন এবং বাস্তবায়নও তত পূর্ণাংগ হবে। প্রতিটি মুসলমান বিশ্বাস করে যে পৃথিবীর সকল জাতি পারিভাষিক অর্থে মুসলমান বা অমুসলমান যে কোনো নামেই হোক না কেন, ইসলামের নির্যাস বা মর্মবাণীকে গ্রহণ করবে। কেননা, ইসলামের আইন হচ্ছে প্রাকৃতিক (কিংবা) ঐশী বা স্বাভাবিক আইন, যা মানুষের অগ্রগতিকে পরিচালিত করে। মানুষ অন্য সব পথের সন্ধান করে শেষ পর্যন্ত বেদনাদায়ক ব্যর্থতা বরণ করতে করতে অবশ্যই একদিন এই প্রাকৃতিক জীবন- বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ করবে এবং তার আকাঙ্ক্ষিত পথের সন্ধান খুঁজে পাবে। আমরা আজ যেখানে শ্রেণীতে শ্রেণীতে এবং জাতিতে জাতিতে বিভেদ দেখছি, আর যেখানে কোনো স্থিতিশীলতা লক্ষ্য করছি না, ইসলাম সেখানে শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতিশ্রুতি দান করে। শুধুমাত্র আল্লাহর অস্তিত্বের স্বীকৃতি এবং আল্লাহর প্রেরিত একজন বাণীবাহকের প্রত্যাদেশ- নির্ভর মতবাদের দাবীর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বলে এমন একটি জীবন-ব্যবস্থার ভালো-মন্দ এবং গুণাগুণ বিচার করতেও যদি কেউ অস্বীকার করে, তবে তার পক্ষে এটাকে নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই বলা যেতে পারে না। এবং এটা হবে নাস্তিকতাসুলভ গোঁড়ামির এক চরম নামান্তর মাত্র । একথাও সত্য যে, একমাত্র ধর্মীয় আদর্শভিত্তিক বলেই মানব-সংস্কৃতির ইসলামী ব্যবস্থাকে অবজ্ঞার চোখে দেখা হচ্ছে না; প্রকৃতপক্ষে, আজকের পৃথিবীতে এবং পেছনে ফেলে আসা দিনে- বহু পেছনে ফেলে আসা দিনে-মুসলমানদের অবস্থা, কার্যকলাপ ও আচার-আচরণই এ অবজ্ঞার পেছনে কারণ যুগিয়েছে। মধ্যযুগে খৃষ্টান জগত যাজক-অনুশাসনের দাসত্বের নিগড়ে বন্দী ছিল বলে ইসলাম সম্পর্কে কোনোরূপ ধারণায় আসার সুযোগ পায়নি। আজকের মত সে সময়েও এই ধর্মান্ধ যাজক-শ্ৰেণী মহানবী হজরত মুহাম্মদকে (আল্লাহ তার ওপর শান্তি বর্ষণ করুন) “ভুয়া নবী” বলে প্রচার করতো এবং তাঁর অনুসৃত ধর্মে যে মানব জাতির জন্যে কোনো কিছু ভালো ও কল্যাণকর থাকতে পারে; সে কথা চিন্তা করার সুযোগ পর্যন্ত কাউকে (খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী) দিতো না। তারপর উভয় ধর্মানুসারীদের মধ্যে সুদীর্ঘ যুদ্ধের ঐতিহ্য এক স্থায়ী বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতার মধ্য দিয়ে বর্তমানকাল পর্যন্ত এ-ক্ষেত্রে এক বিরাট বাঁধার প্রাচীর সৃষ্টি করে। আজকে এ প্রাচীর কার্যতঃ অপসৃত হলেও বিশ্বে মুসলমানদের অবস্থা এমন নয় যে, তারা বাইরের লোকদের মনে এ ধারণার সৃষ্টি করতে পারে যে, ঠিক এমনি মানুষরাই মানবিক অগ্রগতির পথের রহস্য জানে। আজ মুসলমানদের আচার-আচরণ ও অবস্থা ইসলামের পক্ষে অত্যন্ত খারাপ দৃষ্টান্ত। এ অবস্থা দেখে যদি কেউ তাদের থেকে মুখ ফেরায় এবং মুসলমানদের অধোগামীতার জন্যে ইসলামের ওপর দোষারোপ করার কথা চিন্তা করে, তবে তাতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। কথা হচ্ছে এই যে, এ জন্য ইসলামকে দায়ী করা যায়না। এ প্রসংগে এ কথা বলা যেতে পারে যে, খৃষ্টান জগতের বর্তমান বস্তুগত অগ্রগতির জন্যে খৃষ্টান যাজক সমাজের প্রচেষ্টা অনেকখানি প্রশংসার্হ। খৃষ্টান ধর্মে একটি যাজকতন্ত্র রয়েছে এবং এতে চিন্তার স্বাধীনতার কোনো স্বীকৃতি নেই। যে-সব শতাব্দীতে খৃষ্টান গীর্জা বা যাজকতন্ত্র সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিল, আজ সে সব শতাব্দীকে অন্ধকার যুগ বলে অভিহিত করা হয়। ইসলামে কোনো পৌরহিত্যবাদ বা মোল্লাতন্ত্রের অস্তিত্ব ছিল না এবং এতে আগাগোড়া চিন্তার স্বাধীনতার স্বীকৃতি ছিল। যে যুগগুলোতে ইসলাম এর পূর্ণাংগ ও বিশুদ্ধ রূপ-বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিদ্যমান ছিল, সে যুগগুলো বিশেষভাবে সুস্পষ্ট এবং ভাস্বর আলোকে বিদ্যমান। খাঁটি ইসলাম থেকে বিচ্যুতিষ্ঠ মুসলমানদের পতন ডেকে আনে। যাজকতন্ত্রের অনুরূপ এক রকমের পৌরোহিত্যবাদ বা মোল্লাতন্ত্রের প্রতি তাদের স্বীকৃতি কিংবা আল-কুরআনের ভাষায় বলা যায়, “আল্লাহ ব্যতিত অন্যদেরকে তাদের প্রভু হিসেবে গ্রহণ।” পাণ্ডিত্যসুলভ বাক-বিতণ্ডার প্রতি তাদের আসক্তি ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে যে-কোনো স্থান থেকে জ্ঞান আহরণের উপদেশের প্রতি তাদের উপেক্ষাদর্শন, মুক্ত-চিন্তার প্রতি তাদের অস্বীকৃতি এবং বিচার-বুদ্ধি ও যুক্তিবাদিতার প্রতি অনাস্থাও তাদের পতনের প্রধান কারণসমূহের অন্যতম। তাদের ইতিহাসের কোনো এক পর্যায়ে তারা তাদের নির্দেশিত জীবন-ব্যবস্থার একটি অংশের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন শুরু করে এবং শরীয়তের অধিকাংশকে বাতিল করে দেয়, যাতে আল্লাহর সৃষ্টি কৌশল অনুধাবন ও উপলব্ধির উদ্দেশ্যে তাদের জ্ঞান ও শিক্ষার অনুশীলনের জন্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এবং ঠিক সে সময়েই পাশ্চাত্যের খৃষ্টানগণ মুসলমানদের পরিত্যক্ত শরীয়তের এই অংশটির মর্মবাণীর অনুগমন শুরু করে- আর তাদের যাজকশ্রেণীর সব রকমের অভিসম্পাত সত্বেও তারা অসাধারণ সাফল্য লাভ করে। পৌরোহিত্যবাদ মানবিক অগ্রগতির দুশমন বলেই ইসলামে এর অস্তিত্ব স্বীকৃত হয়নি। আর মানবিক অগ্রগতির দুশমন হিসেবে এ খাঁটি ধর্মেরও পরিপন্থী। মানবতার অগ্রগতি ও মুক্তিসাধনাকেই আল-কুরআনে খাঁটি ধর্মের লক্ষ্য হিসেবে বিধৃত করা হয়েছে- মানবতার বন্ধ্যাত্ব বা দাসত্ব নয়। বিশ্বের সর্বত্র মুসলমানেরা আজ এ সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠেছে। তারা বুঝতে পারছে, তাদের অবমাননা ও হীনমন্যতার জন্যে তারা নিজেরাই দায়ী-কেননা এ তাদেরই কৃতকর্মের ফল। তারা আরো বুঝতে পারছে, একমাত্র ইসলামে প্রত্যাবর্তন করে তারা তাদের গৌরবময় হৃত মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে পারে।

আপনারা ভাবতে পারেন যে, আমি আমার নির্ধারিত বক্তব্য বিষয় সংস্কৃতি থেকে সরে এসে ধর্মীয় আলোচনায় ব্যাপৃত হয়েছি। প্রকৃতপক্ষে ইসলামী সংস্কৃতি ধর্মের সংগে এত নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত আর আল্লাহর বিশ্বজনীন সার্বভৌমত্বের ধারণার সংগে এমনভাবে সংমিশ্রিত যে, (আমার এ প্রথম ভাষণে) প্রথমেই কার্য-কারণ ও প্রসংগ নির্দেশ ছাড়া বিষয়টিকে যথার্থভাবে তুলে ধরা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। উত্থানে হোক কি পতনে হোক-বিজ্ঞান, শিল্প কিংবা সমাজ- কল্যাণের যে কোনো পরিসর এবং অংগনেই হোক না কেন, সর্বত্র সবখানে আর সব সময়ে ইসলামী সংস্কৃতির এই ধর্মীয় অনুপ্রাণতা এবং এই বিশ্বজনীন ও পূর্ণাংগ ধর্মীয় জীবন-ব্যবস্থার এক ব্যপ্তিশীল আদর্শ রয়েছে। একথা সত্য যে, এর বিভিন্ন রূপ, সৃষ্টি ও প্রকাশের মধ্যে এমন কিছু আছে, যা সাধারণ ধর্মীয় অংগন থেকে অনেক দূরে । এই দৃষ্টিভঙ্গিই আন্তর্জাতিকতার ভাব- রসে সম্পৃক্ত ইসলামী জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়েছে। কেননা, আল্লাহর বিশ্বজনীন সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি তার উদ্দেশ্যের পরিপূরক বিশ্বজনীন মানবিক ভ্রাতৃত্বের স্বীকৃতিই ঘোষণা করে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *