‘মুহম্মদ কুতুব‘
অধ্যাপক আব্দুল গফুর অনূদিত
ইসলাম ও কমিউনিজম
আমরা ইতিমধ্যেই দেখিয়েছি–ইসলাম জীবনে যা কিছু মহৎ, সুস্থ ও বাঞ্ছিত তাকেই সমর্থন করে। এটা সর্বকালের, সব মানুষের ও সব সমাজের ধর্ম। তবে যেহেতু গত চারশ’ বছর ধরে মুসলিম বিশ্ব বিপর্যয়ের মধ্যে ছিল তাই ইসলামী বিধানের যে অংশ অর্থনৈতিক সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত তার কোন রূপায়ণ হয়নি। এমতাবস্থায় আমরা ইসলামকে আমাদের আত্মিক উন্নয়ন ও চিন্তার পরিশুদ্ধির আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য কমিউনিজমকে আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসাবে গ্রহণ করি না কেন? এতে তো আর আমাদের সমাজ ব্যবস্থার ক্ষতি হচ্ছে না। এতে করে আমরা আমাদের নৈতিকতা, সামাজিক ঐতিহ্য ও প্রথাই যে শুধু রক্ষা করতে পারব, তা নয়-আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য বর্তমান যুগের একটি অতি আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও কায়েম করতে পারব।”
উপরে উল্লিখিত ধারায় যুক্তির মারপ্যাঁচ দিয়ে এক নতুন শুভঙ্করীর খেলা বেশ কিছুদিন ধরে কমিউনিস্টরা খেলতে শুরু করেছে। প্রাচ্য ভূখণ্ডে প্রথম প্রথম তারা ইসলামের বিরুদ্ধে উগ্র মনোভাব গ্রহণ করে এবং এ সম্পর্কে নানারূপ সন্দেহ প্রকাশ শুরু করে। কিন্তু যখন তারা বুঝতে পারল যে, তাতে ইসলামের প্রতি মুসলমানদের আকর্ষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন তারা যুদ্ধ-কৌশল পরিবর্তন করে প্রতারণা ও চাতুর্যের আশ্রয় গ্রহণ করল। তাই তারা যুক্তি দেওয়া শুরু করল: “কমিউনিজমের সাথে ইসলামের সংঘাতের কোন অবকাশ নেই; কারণ এর অন্য নাম সামাজিক ইনসাফ এবং নাগরিকদের জীবনের মৌলিক প্রয়োজনসমূহ পূরণের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক দায়িত্ব গ্রহণই এর কাজ। আপনারা ইসলামকে যে কমিউনিজমের বিরোধী বলেন, আপনারা কি একে সামাজিক ইনসাফের বিরোধী মনে করেন? ইসলাম নিশ্চয়ই সামাজিক ইনসাফের ভিত্তিতে গঠিত ব্যবস্থার বিরোধিতা করতে পারে না।”
এই সব ‘শুভঙ্করী’ যুক্তির সাথে অতীতের সাম্রাজ্যবাদীদের প্রদত্ত যুক্তির বেশ মিল রয়েছে। তারাও ইসলামকে প্রকাশ্যে আক্রমণের মাধ্যমে তাদের যাত্রা শুরু করেছিল, ফিন্তু যখন তারা দেখতে পেল, এর ফলে মুসলমানরা সাবধান ও
সতর্ক হয়ে উঠছে, তারা ভিন্ন পথ অবলম্বন করল। তারা বলতে শুরু করল:”প্রাচ্যদেশে সভ্যতার বিস্তার সাধনই পাশ্চাত্যের একমাত্র লক্ষ্য। ইসলাম কি করে সভ্যতার বিরোধী হতে পারে-ইসলাম যখন নিজেই সভ্যতার জন্ম- দাতা?” তারা মুসলমানদের ভরসা দিল যে তারা সালাত-সিয়াদ যিকর-আযকার বাদ না দিয়েও এই পাশ্চাত্য গ্রহণ করতে পারে। অবশ্য তারা এ ব্যাপারে সুনিশ্চিত ছিল যে, একবার যদি মুসলমানরা তাদের মতবাদের কাছে নতি স্বীকার করে তারা আর কিছুতেই নিজেদের ইসলামী চরিত্র বজায় রাখতে পারবে না। ফলে কয়েক পুরুষের মধ্যেই এই সভ্যতাকে তারা চিরকালের জন্য পর্যুদস্ত করে ফেলবে। তাদের ধারণা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। পরিণতিতে মুসলমানদের মধ্যে কিছুদিনের মধ্যেই এমন একদল লোক সৃষ্টি হয়ে পড়ল, যারা ইসলাম সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল এবং যারা বরং ইসলাম সম্পর্কে কোনরূপ জ্ঞান বা যুক্তি ব্যতিরেকেই বিরূপ মনোভাব পোষণ শুরু করল।
জালিয়াতি ও প্রতারণার সেই সাম্রাজ্যবাদী খেলাই কমিউনিস্টরা বর্তমানে খেলে চলেছে। তারা বলে বে, মুসলমানরা সালাত, সিয়াম ও ধর্মীয় পর্বাদি পালন করে যেয়েও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসাবে কমিউনিজমকে গ্রহণ করতে পারে, কারণ এটা তাদের ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে না। একে সাদরে বরণ করে নিতে তাই তাদের দ্বিধা থাকবে কেন? কিন্তু এই যুক্তিদান কালেও এটা তারা বিলক্ষণ জানে যে, একবার তারা এই সভ্যতার প্রলোভনের কাছে মাথা নত করলে আর তারা মুসলমান থাকতে পারবে না। এরূপ ঘটলে তারা কয়েক বৎসরের মধ্যেই মুসলমানদেরকে তাদের নিজেদের জীবন-দর্শনের আলোকে পুনর্গঠিত করে ইসলাম ও তার বিধানকে ইতি করে দেবে, কারণ আমরা যে যুগে বাস করছি তা দ্রুতগতি ও পরিবর্তনশীলতার যুগ। আর এ যুগে অল্প সময়ের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন আনয়ন করা সম্ভব। কিন্তু এসব সত্ত্বেও বেশ কিছু সংখ্যক মুসলমান আছেন, যারা স্বেচ্ছায় নিজেদেরকে এরূপ কু-যুক্তির শিকার হবার সুযোগ দেন। এর কারণ-এতে করে অন্ততঃ তারা মুসলমান হিসাবে তাদের কঠোর কর্তব্য পালনের সংগ্রাম থেকে বাঁচবার একটা অজুহাত পান এবং মুসলমান হিসাবে নিজের পথ অনুসন্ধান, নিজস্ব যুক্তি প্রয়োগ এবং গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগের জটিল কর্তব্য থেকে মুক্তি পান। এর চাইতে বসে বসে অলস স্বপ্ন দেখা এবং অন্যদের দ্বারা পরিচালিত হওয়া তারা বেশি পছন্দ করেন।
এ পর্যায়ে আমরা বলতে চাই যে, সে-ব্যবস্থা মূলগতভাবে ইসলামী নীতির বিরোধী নয় এবং যা পরিবর্তিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত মুসলিম সমাজের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে সাহায্য করে থাকে, ইসলাম নীতিগতভাবে তার বিরোধী নয়। আর আসল কথা এই যে, ইসলাম আর কমিউনিজমের দৃষ্টভঙ্গী মোটেই একরূপ নয়, যদিও বাহ্য দৃষ্টিতে কোন কোন বিষয়ে এ দুয়ের মধ্যে মিল দেখা যায়। মুসলিম সমাজের সামনে যখন সর্বোত্তম ব্যবস্থা আছে তখন এর পক্ষে ইসলাম অবহেলা করে কমিউনিজম, ধনতন্ত্র বা জড়বাদী সমাজতন্ত্রের আদর্শ গ্রহণ করা সম্ভব নয়-যদিও কোন কোন বিষয়ে এগুলোর সাথে ইসলামের মিল দেখা যায়। কারণ আল্লাহ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নির্দেশ দিয়েছেনঃ “যারা আল্লার অবতীর্ণ বিধান অনুসারে সমাজ পরিচালনা করে না তারা কাফির।” (কুরআন- ৫:৪৭)
আমরা কি বাস্তবে কমিউনিজমকে গ্রহণ করেও মুসলিম হিসাবে জীবন যাপন করতে পারি? এর জবাব একটি বৃহৎ না, কারণ যদি আমরা (তুলক্রমে বা অসাধুভাবে নেহায়েত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসাবে বর্ণিত) কমিউনিজম বাস্তবে প্রয়োগ করি, আমরা দেখব যে তত্ত্বগত বা বাস্তব উভয় দিক দিয়ে এটা ইসলামের বিরোধী। এ দুইয়ের সংঘাত অনিবার্য, কারণ দুটি পরস্পর ঘিরোধী মতবাদ হিসাবে এই সংঘাত এড়াবার কোন উপায় নেই।
এ দুটি যে বহু বিষয়ে তত্ত্বগতভাবে পরস্পর-বিরোধী, নিম্নোক্ত আলোচনা হতে তা পরিষ্কার বোঝা যাবে:
প্রথমত, কমিউনিজম সম্পূর্ণভাবে জড়বাদী ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে: ইন্দ্রিয়শক্তির মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায় না-এমন কিছুতে এটা বিশ্বাস করে না। যা ইন্দ্রিয়শক্তির মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায় না তাই অসত্য, অর্থহীন এবং অস্তিত্বহীন, অথবা যদি বা তার অস্তিত্ব থেকেও থাকে তবুও তা এত তুচ্ছ যে, তা নিয়ে কারো মাথা ঘামাবার দরকার নেই। এঙ্গেলস বলেছেন, “পৃথিবীতে বস্তুই একমাত্র বাস্তব সত্য।” বস্তুবাদীরা যুক্তি দেখায়:”মানব যুক্তি বস্তুর বহিঃ প্রকাশ মাত্র আর এটা বাহ্যিক বস্তুগত পরিবেশকেই প্রতিফলিত করে।” তারা আরও বলে, এটা যাকে আত্মা বলা হয় তার কোনই নিজস্ব স্বাধীন সত্তা নেই, এটা বরং বস্তুরই পরিণতি। সুতরাং আমরা দেখতে পাই কমিউনিজম সম্পূর্ণরূপে একটি জড়বাদী আদর্শ যা আধ্যাত্মিকতা বা আত্না সম্পর্কিত সব কিছুতেই অবৈজ্ঞানিক বলে আখ্যায়িত করে। অপরপক্ষে ইসলামী আদর্শ নানুষের কর্ম-জগতকে এতখানি সংকীর্ণ করতে এবং মানুষের জীবনকে এত নিম্নস্তরে নিয়ে যেতে অস্বীকার করে। এটা মানুষকে এমন এক সত্তা হিসাবে কল্পনা করে যা আত্মা ও মন-জগতে বহু উর্ধ্বে আরোহণ করতে অভিলাষী-যদিও সে মাটির উপরই বিচরণ করে এবং
যদিও তার রক্তমাংসের দেহ রয়েছে। আর কার্ল মার্কস যেমনটি বলতে চেয়েছেন মানবীয় প্রয়োজন খাদ্য, আশ্রয় ও যৌন সঙ্গমের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কোন কোন পাঠকের মনে এই পর্যায়ে একটি প্রশ্ন জাগতে পারে। এই জড়বাদী দর্শনের সাথে যদি আমাদের কোন সম্পর্ক না থাকে, তবে আমাদের এটা ক্ষতি করবে?-আমরা তো শুধু কমিউনিজমের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করব এবং আমাদের মৌলিক বিশ্বাস, আমাদের আল্লাহ্, আমাদের রসুল এবং আমাদের আধ্যাত্মিক ব্যবস্থা অক্ষুন্নই রাখব। অর্থনৈতিক কর্মসূচী দ্বারা এ সবের কি ক্ষতি হবে, কারণ এটা উপরোল্লিখিত বিষয় থেকে স্বতন্ত্র এবং এর একটি স্বাধীন সত্তা আছে। এ বিষয়ে কিন্তু কারো কোন বিভ্রান্তির মধ্যে থাকবার অবকাশ নেই। কেননা, কমিউনিস্টরা নিজেরাই বিশ্বাস করে যে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও মৌলিক বিশ্বাস, আদর্শ জীবন দৃষ্টির মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে,, এগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা যায় না; এগুলো পরস্পর নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। কারণ, কমিউনিস্ট দর্শনের পুরোধা কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলস তাদের লেখার মাধ্যমে একথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন যে, কমিউনিজমের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নির্ভেজাল বস্তুবাদী জীবন-দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত।
দৃষ্টান্তস্বরূপ আরও বলা যেতে পারে যে কমিউনিস্টরা দ্বান্দ্বিক জড়বাদে বিশ্বাস করে। তারা বিশ্বাস করে যে, প্রাথমিক কমিউনিস্ট যুগ থেকে শুরু করে দাসপ্রথা, সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ হয়ে চূড়ান্ত কমিউনিস্ট পর্যায় পর্যন্ত মানব সমাজ যত সব অর্থনৈতিক ও মানবিক প্রগতি অর্জন করেছে তার মূলে রয়েছে বিপরীতধর্মী দুই সত্তার (ধনী ও দরিদ্র তথা মালিক ও শ্রমিকের) মধ্যে সংঘর্ষ। এই দ্বান্দ্বিক জড়বাদের ভিত্তিতেই তারা তাদের নীতির যথার্থতা প্রমাণ করে এবং দাবী করে যে, বর্তমানের আদর্শিক দ্বন্দ্বের পরিণতিতে কমিউনিজমের চূড়ান্ত বিজয় আসবে। তারাই দাবী করে যে, কমিউনিজম ও দ্বান্দ্বিক জড়বাদের তত্ত্বের মধ্যে নিবিড় বৈজ্ঞানিক সম্পর্ক রয়েছে। এই দ্বান্দ্বিক জড়বাদের মধ্যে আল্লাহ রসূল বা ধর্মের ধারণার কোন স্থান নেই। স্পর্ধাভরে তারা বলে বেড়ায় যে আল্লাহ, রসূল, ধর্ম প্রভৃতি ধারণা অর্থনৈতিক শক্তির প্রভাবে সৃষ্ট; যেসব অর্থনৈতিক পরিবেশ এই সব ধারণার সৃষ্টি করেছে তার বাইরে এগুলোর কোন মূল্য বা তাৎপর্য নেই। এ কারণেই মানবজীবনে এসব ধারণার গুরুত্ব ফুরিয়ে যায় এবং জীবন ও তার প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যাখ্যায় এগুলোর কানাকড়ি মূল্যও থাকে না। একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে উৎপাদন ব্যবস্থা, তার পরিবর্তন আনলেই সমগ্র মানব জীবনে পরিবর্তন আনা ও তাকে বিপ্লবায়িত করা সম্ভব। মানব ইতিহাস
সম্পর্কে কমিউনিস্টদের মতবাদের অসারতা ও দুর্বলতা প্রমাণের জন্য আরবের ইসলামী বিপ্লবের দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। তারা এই মহান বিপ্লবের কোন উপযুক্ত ব্যাখ্যা দিতে পারে নি। তারা এটা দেখাতে পারবে না যে, তৎকালীন আরব উপদ্বীপ বা সমসাময়িক মুসলিম জগতে উৎপাদন ব্যবস্থায় এমন কোন পরিবর্তন এসেছিল যার ফলে বিশ্বের সেই অংশে রসূলে করীমের আবির্ভাব ঘটে আর তার সঙ্গে সঙ্গে একটি সম্পূর্ণ নতুন জীবন ব্যবস্থা গড়ে উঠে।
এর থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, ইসলাম ও কমিউনিজম মূলতই পরম্পর বিরোধী। সুতরাং উভয়কে কি করে এক বলা যায়? মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ রহমানুর রহীম এবং সর্বজীবে দয়াশীল। তারা আরও বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ মানুষের সুপথ প্রদর্শনের জন্য রসূল প্রেরণ করেন। মুসলমানরা বিশ্বাস করে, ইসলাম অর্থনৈতিক ঘটনাবলীর পরিণতিতে সৃষ্টি হয়নি। এসব যারা বিশ্বাস করে সেই মুসলমানরা কি করে কমিউনিজমকে গ্রহণ করবে, যা বলে বেড়ায় যে মানব প্রগতির সব কিছুই শুধুমাত্র পরস্পর বিরোধী সংঘাতের ফলে অর্জিত হয়েছে। সেখানে অর্থনৈতিক পরিবেশ বা তাগিদের বাইরে আল্লাহর ইচ্ছা বা অন্য কোন কারণ বা উদ্যোগের কোন স্থান নেই।
দ্বিতীয়ত, কমিউনিজমের দৃষ্টিতে মানুষ একটি অসহায় জীব মাত্র–বৈষয়িক ও অর্থনৈতিক শক্তির মুকাবিলায় যার ইচ্ছার কোন গুরুত্ব নেই। কার্ল মার্কস বলেন: “জীবনের বৈষয়িক উপাদানের উৎপাদন ব্যবস্থাই সামাজিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের সমগ্র প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। মানুষের চেতনা তার জীবন-পদ্ধতি নির্ধারণ করে না, বরং তার সামাজিক অস্তিত্বই তার চেতনা নির্ধারণ করে।
অপর পক্ষে ইসলামী মানুষকে দেখা হয় একটি সক্রিয় সত্তারূপে-যার নিজস্ব ইচ্ছা রয়েছে যা শুধুমাত্র আল্লাহর উচ্চতর ইচ্ছা দ্বারাই প্রভাবিত হয়। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে: “আসমান ও যমীনের মধ্যে যা কিছু রয়েছে তার সব কিছুকে তিনি তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন।” (পবিত্র কুরআন- ৪৫: ১৩)
এভাবে ইসলাম এটা সুস্পষ্ট করে দেয় যে, এই পৃথিবীতে মানুষকে পরম উচ্চ ক্ষমতা ও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে এবং যাবতীয় বৈষয়িক ও অর্থনৈতিক শক্তির উপর তাকে কর্তৃত্ব করতে দেওয়া হয়েছে। আর ইসলাম স্বয়ং এর অন্যতম দৃষ্টান্ত; দ্বান্দ্বিক জড়বাদের কোন প্রক্রিয়ার দ্বারা ইসলামের অগ্রগতি নিয়ন্ত্রিত বা পরিচালিত হয়নি। প্রাথমিক যুগের মুসলিমগণ কখনো এক মুহূর্তের জন্যও মনে করেনি যে শুধুমাত্র মানুষের অর্থনৈতিক জীবনই তার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। মার্কসের ন্যায় একথাও তারা বিশ্বাস করতেন না যে, এটা তার সচেতন নিয়ন্ত্রণের বাইরে, বরং ইসলামের শিক্ষার আলোকে তাদের যাবতীয় সামাজিক সম্পর্কাদি পুনর্বিন্যস্ত করে সচেতনভাবে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিধানের ভিত্তিতে তাদের অর্থনীতি গড়ে তোলেন: অর্থনৈতিক লাভালাভের বা প্রেরণার তোয়াক্কা না করে তারা দাসদের মুক্তি দিয়েছেন; এবং তৎকালীন ও তৎপরবর্তী ইউরোপ ও বৃহত্তর বিশ্বে কয়েক শতাব্দী যাবত সামন্ত-তন্ত্রের অবাধ রাজত্ব থাকা সত্ত্বেও তারা বাস্তব ক্ষেত্রে তাদের দেশে সামন্তবাদ গড়ে উঠতে দেন নি।
কমিউনিস্ট অর্থনীতি অনিবার্যরূপে কমিউনিস্ট দর্শনের দিকে ঠেলে দেবে।আর এ এমন এক দর্শন যা তার ইচ্ছাশক্তির সমস্ত স্বাধীনতা হরণ করে তাকে অর্থনৈতিক শক্তির হাতের পুতুলে পর্যবসিত করে; এই দর্শনের বক্তব্যানুসারে মানুষ তার জীবনের গতি পরিবর্তন করতে পারে না, কোন রূপে তাকে প্রভাবিতও করতে পারে না; এই পরিবর্তনটা অসম্ভব, সুতরাং অচিন্তনীয়।
তৃতীয়ত, ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি’ অধ্যায়ে আমরা উল্লেখ করেছি যে, একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে তার পশ্চাতের সামাজিক দর্শন থেকে পৃথক করে দেখা অসম্ভব। সুতরাং আমরা যদি কমিউনিজমকে একটি অর্থনৈতিক কর্মসূচীরূপে গ্রহণ করি, আমাদের অবশ্যই এর সামাজিক দর্শনও গ্রহণ করতে হবে। আর এই দর্শন বলে যে, সমাজই একমাত্র বাস্তব সত্য এবং সমাজের সদস্যরূপে ছাড়া ব্যক্তির আলাদা কোন সত্তা নেই। এটা ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গীর সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ ইসলাম ব্যক্তিকে প্রচুর গুরুত্ব দেয় এবং তার আদর্শ রূপায়ণে ব্যক্তির উপর অধিক নির্ভর করে। ইসলাম মানুষকে ভেতর থেকে সভ্য করে তোলে, যাতে সে স্বেচ্ছায় সমাজের সদস্য হিসাবে তার দায়িত্ব যথাযথ পালন করে। এমনি করে এটা ব্যক্তিকে সমাজের সচেতন সভ্য হিসাবে উচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত করে। এ এমন এক মর্যাদা, যেখানে তার নিজস্ব ইচ্ছা থাকে, অধিকার থাকে তার পেশা এবং কর্মক্ষেত্র নির্বাচনের। শাসকের আদেশ মেনে চলবার স্বাধীনতা তার থাকে, আবার শাসক আল্লাহ-প্রদত্ত ইসলামের বিধান লংঘন করলে তাকে অমান্য করবার স্বাধীনতাও তার থাকে। এমনি করে ইসলাম একই সাথে প্রতিটি ব্যক্তিকে সমাজের নৈতিকতার অভিভাবক করে তোলে এবং যাবতীয় দুর্নীতি উচ্ছেদের দায়িত্ব দান করে। স্বাভাবিক, বাস্তব ও মনস্তাত্ত্বিক কারণের দরুন ও রকমটি সেই সমাজে ঘটতে পারে না, যেখানে ব্যক্তিকে তুচ্ছ পোকা-মাকড় বা মরদেহধারী বামনে পরিণত করা হয়, যেখানে তার ভাগ্য সম্পূর্ণত গঠন ও নিয়ন্ত্রণ করে সরকার-কারণ সেখানে সরকারই অর্থনৈতিক উৎপাদনের যাবতীয় মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে।
সবশেষে, আমরা একথাও স্মরণ রাখব যে কমিউনিস্ট মতবাদ এই ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত যে, শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারণই কোন সামাজিক জনমণ্ডলীর অভ্যন্তরীণ সম্পর্কাদি প্রভাবিত করে। ইসলাম মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক দিকের গুরুত্ব অস্বীকার বা খর্ব করে না বা নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধকে প্রাণবন্ত করে তুলতে কোন জাতির সামাজিক জীবনের সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ভিত্তির গুরুত্ব অস্বীকার করে না। কিন্তু জীবন মানেই অর্থনীতি-এ ধরনের কোন ধারণা ইসলাম মূলতই স্বীকার করে না। ইসলাম একথাও বিশ্বাস করে না যে, অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে অন্যান্য সমস্যা এমনিতেই সমাধান হয়ে যাবে। কথাটা পরিষ্কার করতে বাস্তব জীবন থেকে আমরা দৃষ্টান্ত নিতে পারি। মনে করা যাক-একই রূপ অর্থনৈতিক অবস্থার দু’জন যুবক রয়েছে। তাদের একজন উৎকৃষ্ট ইন্দ্রিয়পরায়ণ এবং পাশবিক লালসা ও প্রবৃত্তির গোলামীতে মত্ত। অপরজন তার সম্পদের একটা যুক্তিসঙ্গত অংশ নিজে উপভোগ করে এবং তার বাড়তি শক্তিকে মানসিক ও আত্মিক বিকাশের কাজে ব্যয় করে। এই দুইজন যুবককে কি সমান ও একইরূপে মনে করা যায়? এই দুই ব্যক্তি কি তাদের জীবনে সমপরিমাণ গুণ, মহত্ত্ব ও সাফল্যের অধিকারী?
আর একটি দৃষ্টান্ত নেয়া যাক। মনে করা যাক-একজন লোক, যার দৃঢ় ব্যক্তিত্ব রয়েছে, যার কথা লোকে শ্রদ্ধা সহকারে শোনে এবং যার উপদেশ লোকে মেনে চলতে রাযী। অন্য একটি অকর্মা লোক, যার কোন ব্যক্তিত্ব নেই এবং নিজের পরিচিত মহলে শুধু হাসির খোরাকই যোগায়। এখন প্রশ্ন হল, এই লোকের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান দ্বিতীয় ব্যক্তির কোন কাজে আসে কি? প্রথমোক্ত ব্যক্তি যেরূপ মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করবেন তা কি দ্বিতীয় ব্যক্তির কাছ থেকে আশা করা যায়?
আরেকটি দৃষ্টান্ত নেয়া যাক। সুষমা ও সৌন্দর্যের অধিকারিণী একটি মেয়েকে কি সুষমা ও সৌন্দর্যবিহীন অপর একটি মেয়ের সাথে তুলনা করা চলে? অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা দূর করলেই কি কুৎসিৎ মেয়েটির সব অসুবিধার অবসান হবে?
এই কারণেই ইসলামী চিন্তাধারার অর্থনৈতিক মূল্যের, বুনিয়াদী গুরুত্ব দেয় না-দেয় অন্যান্য মূল্যের বিশেষত নৈতিক মূল্যমানের। কারণ অর্থনীতির বাইরের অন্যান্য মূল্যই মানব জীবনের বুনিয়াদ রচনা করে। আর সেগুলোর যথাযথ সংগঠনের জন্য অর্থনীতির মতই কঠোর সাধনার প্রয়োজন। এজন্যেই এটা আল্লাহ ও মানুষের মধ্যে নিরন্তর নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার উপর জোর দেয়। আল্লাহ ও মানুষের মধ্যকার এই আধ্যাত্মিক সম্পর্কই বাস্তব জীবনে নৈতিক মুল্যমান লালনের উত্তম পন্থা। পার্থিব জীবনে মানুষ প্রায়শই বস্তুগত প্রযোজনের গোলামী করে এবং পারস্পারিক কলহ, হিংসা-বিদ্বেষে মত্ত থাকে। নীচতার গ্লানিমায় পরিপূর্ণ এই জীবনকে ইসলাম এমন এক উচ্চ স্তরে উন্নীত করতে প্রয়াস পায়, যেখানে মানুষ জাগতিক নীচ প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে যুক্ত কয়ে প্রেম, প্রীতি ও পুণ্যের এক স্বর্গীয় জগতে বিচরণ করতে পারে।
আরেক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেখা যাবে-ইসলাম মানব জীবনে আধ্যাত্মিক শক্তিকে মৌলিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। মানুষ হিসাবে তার ভাগ্যের উপর শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার ছাড়াও এ জগতে এটা মানুষের জন্য এক অমূল্য সম্পদ। যথাযথ মনোযোগ দেওয়া হলে এবং উপযুক্তভাবে সংগঠিত করা হলে মানব সমাজ গঠনে এটা অর্থনীতি প্রভৃতি অপরাপর উপাদান অপেক্ষা কম শক্তিশালী প্রমাণিত হবে না; বরং সামাজিক পরিবর্তনের অন্যান্য সমস্ত উপাদান অপেক্ষা অনেক বেশি কার্যকরী ও শক্তিশালী প্রমাণিত হবে। মুসলমানরা একথার সত্যতা প্রমাণের জন্য তাদের নিজেদের ইতিহাস থেকে প্রচুর প্রমাণ দিতে পারবে। এজন্যেই আমরা দেখি-প্রথম খলীফা আবুবকর তাঁর খিলাফতের প্রথম দিকে ভণ্ড নবী সমস্যার মুকাবিলায় কঠোর মনোভাব গ্রহণ করেন-যদিও উমর বিন্ খাত্তাবসহ অনেক মুসলমানই প্রথম দিকে এ প্রশ্নে তাঁর সাথে একমত ছিলেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্বীয় মতে তিনি পর্বতের ন্যায় অটল থাকেন এবং এক বিন্দুও তা থেকে বিচ্যুত হন নি। তাঁর এই প্রেরণা তিনি কোথেকে লাভ করেছিলেন? এটা কি জাগতিক শক্তি ছিল? অথবা অর্থনৈতিক কল্যাণের ধারণা? অথবা কোন মানব শক্তি তাঁকে এই সংকল্পে প্রেরণা যুগিয়েছিল? তার জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে তাঁর প্রেরণা ও সাহস এ ধরনের কিছুতেই যোগায়নি। এসবের কোন একটিতে যদি তাঁর বিশ্বাস থাকত তাহলে ইসলামের ইতিহাস সেই সংকট-মুহূর্তে তিনি কিছুতেই প্রতিকূল শক্তির সঙ্গে সংগ্রাম করতে সাহস পেতেন না। শুধুমাত্র আত্মিক শক্তির বলে বলিয়ান ছিলেন বলেই হযরত আবুবকর বিদ্রোহীদের সাথে সংগ্রামে নামবার ইচ্ছা, সংকল্প ও সাহস অর্জন করেছিলেন। শুধু এই কারণেই তারা শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়েছিল এবং ইসলাম ও মুসলমানদের সাথে দুশমনী পরিত্যাগ করে পুনরায় সৎ মুসলমান হিসাবে পরিগণিত হয়েছিল। মানব ইতিহাসের এটা এমন এক তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়, যা প্রমাণ করে জীবন্ত আত্মিক প্রেরণা কিভাবে নজীরবিহীন বৈষয়িক ও অর্থনৈতিক শক্তি সৃষ্টি করতে পারে। উমর বিন আবদুল আযীযের ঘটনাও অনুরূপ। তিনি শুধুমাত্র আত্মিক শক্তির বলে বলিয়ান হয়েই প্রথম যুগের উমাইয়া শাসকদের সৃষ্ট রাজনৈতিক ও সামাজিক বে-ইনসাফীর আমূল পরিবর্তন সাধন করেন। তিনি অন্যায়ের মূলোৎপাটন করে ইসলামের অন্তর্নিহিত সামাজিক নীতিসমূহের ভিত্তিতে সাফল্যের সাথে সমাজের পুনর্গঠন করেন। ইসলামের ইতিহাসের সেই মুহূর্তেই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটতে দেখা যায়, যখন সমগ্র মুসলিম সমাজে একটিও দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সুতরাং ইসলাম আত্মিক শক্তিকে পরম গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কারণ এটা এর বিরাট অলৌকিক কল্যাণ থেকে মানব সমাজকে বঞ্চিত করতে চায় ন। যদিও ইসলাম অলসভাবে বসে থাকা পছন্দ করে না এবং এর লক্ষ্য হাসিলে জাগতিক মাধ্যম ব্যবহারও বাদ দেয় না। ইসলাম আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস করে, তবে অলৌকিক কারামতের জন্য অলস প্রতীক্ষা পছন্দ করে না। এর চিরন্তন মূলনীতি হচ্ছে: “কুরআনে যার নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি আল্লাহ্ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করেন।”
অন্যদিকে কমিউনিজমের নির্দেশিত পথে অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা সাধনা করে নৈতিক মূল্যবোধের দিকে বা আত্মিক উন্নয়নের দিকে নজর দেওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কারণ কমিউনিজমে মানব জীবনের জন্য মাত্রাতিরিক্ত অর্থনৈতিক দিকে গুরুত্ব দেওয়ার ফলে একদেশদর্শী উন্নয়নই সম্ভবপর হয় যাত্র। এটা এরূপ এক চিকিৎসা, যার দ্বারা শরীরের কোন একটি অঙ্গ-যেমন হৃদপিণ্ড বা যকৃত-এমন ভাবে স্ফীত করে যে তার ফলে দেহের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সুষম বিকাশ ও কার্যকারিতা ব্যাহত হয়।
আমরা জানি, এমন কিছু লোক আছেন যারা উপরোল্লিখিত ধারায় ইসলাম ও কমিউনিজমের মধ্যে এরূপ দার্শনিক তুলনা পছন্দ করেন না। কারণ, তারা মনে করেন যে, এসব তাত্ত্বিক আলোচনার কোন মূল্য নেই, এগুলোর গুরুত্ব বা তাৎপর্য কিছুই নেই। তাদের কাছে শুধু বাস্তব সমস্যারই দাম রয়েছে এবং সব রকমের তত্ত্বগত আলোচনার পরিবর্তে সেগুলোকেই যথাসম্ভব গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের মতে সব কিছুই শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়ে যাবে এবং কোন জীবন পদ্ধতি গ্রহণের বেলায় তাত্ত্বিক প্রশ্ন বাদ দিয়ে শুধুমাত্র তার বাস্তবতাকেই বিবেচনা করতে হবে। তাই তারা বাস্তব জীবনে ইসলাম ও কমিউনিজমের মধ্যে কি করে সংঘাত আসতে পারে তা ভেবে উঠতে পারেন না। তারা এ দুয়ের মধ্যে এরূপ কোন সংঘাতের সম্ভাবনা অস্বীকার করেন।
সমস্যার তত্ত্বগত ধা দার্শনিক দিক সম্বন্ধে তাদের অনীহার সাথে আমরা একমত নই। কারণ, তত্ত্বের দিক থেকে বাস্তবকে কোন দিনই বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না। যাই হোক, এদের বিবেচনার জন্য ইসলাম ও কমিউনিজমের মধ্যে কতকগুলো বাস্তব পার্থক্য আমরা এখানে তুলে ধরছি:
১. ইসলাম বিশ্বাস করে যে, মানব জাতির বংশ বিস্তারই মেয়েদের প্রধান কাজ। তাই এটা নেহায়েত জরুরী তাগিদ ব্যতিরেকে (যেমন পিতা, ভাই বা স্বামী না থাকলে) তার নিজ রাজ্য ত্যাগ করে কারখানা ও ময়দানে কাজ করাটা সমর্থন করে না। কিন্তু কমিউনিজম মেয়েদের কারখানা এবং ময়দানে পুরুষের সমান পরিশ্রম করতে বাধ্য করে কমিউনিজমের অন্তনিহিত দর্শনে স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে কর্মক্ষেত্র ও মনস্তাত্ত্বিক গঠনের ক্ষেত্রে পার্থক্য স্বীকার করে না। একথাটি আপাতত ভুলে গেলে কমিউনিস্ট অর্থনীতি মূলতই সর্বপ্রকার উৎপাদন বৃদ্ধির নীতির উপর নির্ভরশীল। এই বৃদ্ধি তখনই সম্ভব হয়, যখন সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিই কারখানা, লেবরেটরী ও ময়দানে পরিশ্রম করে। সমাজের অন্যান্য সদস্যদের সাথে মেয়েদেরও এ ব্যাপারে সমান দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে এবং তারা শুধু প্রসবকালীন সময়েই এ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাবে। এর ফলে বৃহদাকারের উৎপাদনের মত সন্তান-সন্ততি পালন ও ছেড়ে দেওয়া হবে রাষ্ট্রের হাতে।
সুতরাং আমরা যদি কমিউনিস্ট অর্থনীতি গ্রহণ করি তার অন্যতম ফল দাঁড়াবে এই যে, মেয়েদেরকে তাদের ঘর ছেড়ে কাজের জন্য বাইরে যেতে হবে। এর অর্থই হচ্ছেঃ ইসলামের অন্যতম মৌলিক সংস্থা পরিবার ব্যবস্থার উপর নির্মমভাবে আঘাত হানা হবে। অথচ এই পরিবার ব্যবস্থার উপরই ইসলামের নৈতিকতা ও অর্থনীতির সমস্ত কাঠামোটি দণ্ডায়মান এবং এটার মাধ্যমেই ইসলাম দেখাতে চায় যে, মেয়েদের প্রকৃত কাজ গৃহাভ্যন্তরে এবং পুরুষের কাজ বাইরে। যদি বলা হয় যে, মেয়েদের কাজের জন্যে যে বাইরে কারখানায় পাঠানোই হবে তা ঠিক নয়। তবে বলতে হবে এটা এমন এক ব্যাপার হবে,
যার সাথে কমউনিজমের কোন সম্পর্ক নেই। কারণ কমিউনিস্টরা এ সম্পর্কে তাদের নীতি মোটেই অস্পষ্ট রাখেনি। উৎপাদন বৃদ্ধির প্রশ্নে একথা বলা যায় যে, এটা বেশ ভাল কথা এবং মানবীয় অস্তিত্বের জন্য এর প্রয়োজনও রয়েছে কিন্তু এর জন্য কমিউনিস্ট অর্থনীতি গ্রহণের কোন প্রয়োজন নেই। কারণ কমিউনিস্টরা নিজেরাও ইউরোপীয় ধনতন্ত্র থেকে উৎপাদন বৃদ্ধির উপায় হাওলাত করেছে। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির তাগিদে কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধির যাবতীয় আধুনিক পন্থা গ্রহণে কোন বাধা থাকবে না।
২. কমিউনিস্ট অর্থনীতি প্রলেতারিয়েতদের পূর্ণাঙ্গ একনায়কত্বের উপর নির্ভরশীল। তার মানে হচ্ছে বিভিন্ন নাগরিক কি কাজ করবে তা স্থির করার অধিকার একমাত্র রাষ্ট্রের এবং সেখানে তাদের শক্তি বা রুচির কোন প্রশ্নই থাকবে না। যাবতীয় চিন্তা, কর্ম ও সম্পর্কের বিষয়াদি এবং তাদের লক্ষ্য সবই নিয়ন্ত্রণ করবে শুধুমাত্র রাষ্ট্র। এই পর্যায়ে আমরা একজন ব্যক্তির একনায়কত্ব এবং রাষ্ট্রের (তথা প্রলেতারিয়েতের) একনায়কত্বের মধ্যকার পার্থক্য বুঝাতে চেষ্টা করব। কারণ একজন শাসকের পক্ষে এমনটি হতে পারে যে, তিনি কল্যাণব্রতী, বিনয়ী চরিত্রের অধিকারী হবেন এবং দেশের কল্যাণ তাঁর প্রির হতে পারে এবং কোন বিষয় নির্ধারণ বা আইন প্রণয়নের সময় সৎ বা অসৎ জনপ্রতিনিধিদের সাথে পরামর্শও করতে পারেন। কিন্তু প্রলেতারিয়েতের বা রাষ্ট্রের ডিক্টেটরশীপের পক্ষে এটা প্রায় অসম্ভবের শামিল। কারণ, এটা প্রধানত অর্থনীতির ব্যাপারে আগ্রহী এবং সে কারণেই কঠোর হস্তে সেই লক্ষ্য হাসিল করতে চাইবে। প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব দ্বারা একথাই বোঝা যায়।
কমিউনিজমের উপরোল্লিখিত দোষত্রুটির তালিকায় আমরা আরও একটি বিষয় সংযোজন করতে পারিঃ এর কোন সুষ্ঠু ভিত্তি নেই, যার ফলে তত্ত্ব ও বাস্তবে প্রায়শই সংঘাত ঘটতে দেখা যায়। যেমন গোড়ার দিকে সেটা সব রকমের ব্যক্তিগত সম্পত্তি আমূল উচ্ছেদের ওকালতি করেছিল এবং সব রকমের কর্মচারীর মজুরী সমান করে দেয়ার দাবী জানিয়েছিল। কিন্তু বাস্তব ও অবস্থার চাপে এই নীতি বর্জন করতে বাধ্য হয়েছিল। কারণ, অন্ল্পদিনের মধ্যেই দেখা গেলো যে, কিছু পরিমাণ ব্যক্তিগত সম্পত্তির অনুমতি দেওয়া এবং উৎসাহ ও শ্রমের ভিত্তিতে শ্রমিকদের মজুরীতে কিছুটা পার্থক্য রাখাই সুবিধাজনক। এমনি করে কমিউনিজম কার্ল মার্কসের দর্শনের দু’টি মৌলিক নীতি পরিত্যাগ করে
এবং ইসলামের নীতির দিকে বেশ খানিকটা অগ্রসর হতে বাধ্য হয়। এই পরিস্থিতিতে আমরা মুসলমানরা কি করে একমাত্র বাস্তব জীবন ব্যবস্থা ইসলাম পরিত্যাগ করতে পারি-অথচ মানবতা যখনই অন্য কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গেছে বাস্তবের কষাঘাতে বারবার এদিকেই তাকে ফিরে আসতে হয়েছে?
ইসলাম ও ভাববাদ [Idealism ]
আমাদের প্রায়ই জিজ্ঞাসা করা হয়ঃ “তোমরা মুসলমানরা যে ইসলামের কথা বলে বেড়াও, তা কোথায়? প্রকৃত প্রস্তাবে তা কি জীবনে কখনও বাস্তবায়িত হরেছিল? একথা তোমরা হরদম বলে বেড়াও যে, এটা একটা অত্যন্ত আদর্শ ব্যবস্থা, কিন্তু বাস্তব জীবনে এর কি কখনও অস্তিত্ব ছিল? এর বাস্তব রূপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে রসূলে করীম (সা.) খুলাফায়ে রাশেদীন অথবা তার মধ্যেও প্রথম দুই খলিফার ক্ষুদ্র শাসনকাল ছাড়া কিছু দেখতে পাই না। বিশেষভাবে উমর বিন খাত্তাবের কথা বলতে, তিনি যে ইসলামের জীবন্ত প্রতীক ছিলেন তা বলতে তোমরা কখনো ক্লান্তি বোধ কর না। তোমরা তাকে উজ্জ্বল রঙে চিত্রিত করে থাক কিন্তু তার শাসনামলের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নিলে আমরা তো শুধু “স্তূপের পর স্তূপ অন্ধকার” সামন্তবাদ, অসাম্য, নির্যাতন, প্রতিক্রিয়াশীলতা ও পশ্চাদপদতা দেখতে পাই। তোমরা দাবী কর যে, শাসকগণ তাদের দায়িত্ব পালনে বার্থ হলে ইসলাম জাতিকে তাদের শাস্তিদানের অধিকার দেয়, কিন্তু, খুলাফায়ে রাশেদীনের পর শাসকদের শাস্তি দেওয়া তো দূরের কথা, জনগণকে শাসক মনোনয়নের অধিকারটুক কবে দেওয়া হয়েছিল? তোমরা আরও বল যে, ইসলাম সম্পদের সুষম বণ্টনসহ একটি ইনসাফসম্মত অর্থনীতি দিয়েছে। কিন্তু মানুষে মানুষে পার্থক্য দূর করে, এমন কি খলিফায়ে রাশেদীনের সময় কবে পূর্ণ সাম্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল? তোমরা বলে থাক যে, ইসলাম সমস্ত নাগরিককে কাজ দেওয়া রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক করে, কিন্তু ‘যে সব লক্ষ লক্ষ বেকার লোক সেদিন ভিক্ষা করে জীবন কাটাত অথবা আজীবন বঞ্চনা ও দারিদ্রোর মধ্যে জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছিল তাদের সম্পর্কে কি বলতে চাও? তোমরা নারীর অধিকারের কথাও বলে থাক, কিন্তু তারা কি প্রকৃত প্রস্তাবে কোনদিন এইসব অধিকার উপভোগ করেছে? এটা কি সত্য নয় যে, প্রতিকূল সামাজিক- অর্থনৈতিক পরিবেশের কারণে তারা কখনো তাদের অধিকার ভোগ করতে পারেনি? তোমরা বল যে, আল্লাহ্-ভীতির ফলশ্রুতি হিসাবে মানুষের আত্মিক বিকাশ সাধিত হয় এবং তার ফলে শাসক ও শাসিতের মধ্যে এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে ইনসাফ ও ন্যায়পরায়ণতার আলোকে পারস্পরিক সহ-যোগিতার ভিত্তিতে একটি সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে, কিন্তু একটি সীমিত কালের কথা বাদ দিলে, কবে কোথায় এই আত্মিক উন্নয়ন সাধিত হয়েছিল? দরিদ্রের অধিকার হরণ করে তাদেরকে বে-ইনসাফী ও নিষ্ঠুরতার শিকারে পরিণত করার পথে ইসলাম কি কোন দিন প্রতিবন্ধক হয়েছিল? জনগণের অধিকার পদদলিত করে তাদেরকে জিল্লতী ও অবমাননার মুখে ঠেলে দেওয়ার পথে এটা কি কখনও বাদ সেধেছিল? মোটকথা, তোমরা এমন এক স্বপ্নরাজ্যের কথা বলে বেড়াও, বাস্তবে যার কোন অস্তিত্ব নেই। যে সীমিত যুগের তোমরা এত ভক্ত তাও শুধু একথাই প্রমাণ করে যে, কতিপয় অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন লোক এমন কিছু পরিমাণ অসম সাহসিক কাজ সম্পন্ন করেছিল, যা আর কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়। এটা একটা ব্যতিক্রম, কারণ পরবর্তীকালে এর পুনরাবৃত্তি আর কখনো ঘটেনি এবং সেরূপ আর ঘটারও কোন সম্ভাবনা নেই।”
কমিউনিস্ট ও তাদের সাঙ্গোপাঙ্গোরা এসব কথাই বলতে চায়। দুর্ভাগ্যক্রমে অনেক মুসলমানও এ ধরনের প্রচারণার শিকার হন। কারণ তাদের সাম্রাজ্যবাদী মনিবেরা তাদের যতটুকু শিক্ষা দিয়েছেন, তার বাইরে ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে আর কিছুই জানেন না বা পড়েন নাই।
পরবর্তী পর্যায়ে প্রবেশের আগে আমরা দু’ধরনের ভাববাদের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করতে চাই। বিশুদ্ধ ভাববাদ বলতে যা বোঝা যায়, বাস্তব জীবন-পরিবেশে তাকে কোনদিন প্রয়োগ বা রূপায়িত করার নজীর নেই। অপর পক্ষে আর এক ধরনের ভাববাদ (বা আদর্শবাদ) আছে না সাফল্যের সাথে যে বাস্তবায়িত হতে পারে, তার ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে। এটা এমন এক ধরনের আদর্শবাদ যা শুধু যে বাস্তবে রূপায়িত হতে পারে তা-ই নয়, এর নিজস্ব গতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও এটা রাখে। সুতরাং যে প্রশ্নটি আমাদের সামনে উপস্থিত হয় তা হচ্ছে: ইসলাম কি মূলতই এমন একটি স্বাপ্নিক আদর্শ যার বাস্তব অস্তিত্ব নেই, জগতে কোথাও বাস্তবে রূপায়িত হওয়ার শক্তি যার নেই এবং যার গোটা মতবাদটাই কতকগুলো কাল্পনিক ও মনগড়া অলীক উপাদানে গঠিত? অথবা এটা একটি বাস্তব জীবন-ব্যবস্থা; তবে মানব ইতিহাসের সর্ব যুগে সমান সাফল্যের সাথে ও সম্পূর্ণ একই ধারায় একে রূপায়িত করা চলে না? এটা সুস্পষ্ট যে, এই দুই ধরনের আদর্শবাদের মধ্যে একটা বড় রকমের পার্থক্য রয়েছে। ইসলাম যদি মূলতই একটি কল্পনামূলক আদর্শ হয়, তবে ভবিষ্যতে সামাজিক পরিস্থিতি ও জীবন পরিবেশের যতই পরিবর্তন হোক, এর রূপায়ণের আর কোনই আশা নেই। কিন্তু এটা যদি একটি বাস্তব জীবন-ব্যবস্থা হয় এবং শুধুমাত্র বাহ্যিক জীবন-পরিবেশের কারণেই যদি এর বাস্তব রূপায়ণ হয়ে থাকে, তবে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কথা। সে অবস্থায় জীবনের প্রতিকূল পরিবেশ পরিবর্তিত হয়ে অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি হলে এর রূপায়ণের খুবই আশা রয়েছে। এখন, ইসলামের ব্যাপারে এ’দুয়ের কোনটি সত্য আগেরটি না পরেরটি?
এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে আমাদের বেশী দূর যেতে হবে না, কারণ বিষয়টি এত স্পষ্ট যে এতে কোনরূপ দ্বিমতের অবকাশ নেই। মানব ইতিহাসের এক পর্যায়ে ইসলামের পূর্ণাংগ রূপায়ণ সম্ভব হয়েছিল, এতেই নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, এটার বাস্তব জীবন-ব্যবস্থা এবং মানুষের দ্বারা এর পূর্ণাংগ বাস্তবায়ন সম্ভবপর। এর থেকে আরও প্রমাণ হয় যে, এর ভিত্তি কাল্পনিক বা অলীক কিছু নয়। মানুষ মূলত অতীতেও যা ছিল বর্তমানেও তাই রয়েছে মানুষের প্রকৃতিতেও কোন পরিবর্তন হয়নি। সুতরাং যা একবার ঘটেছে তা বারবার ঘটতে পারে। আধুনিক প্রগতিবাদিগণ বলেন যে, এরূপটি আর ঘটবে না, সুতরাং ইসলামী পুনর্জাগরণ একটি অসম্ভব ব্যাপার। আমরা সবিনয়ে তাদের প্রশ্ন করতে চাই, তবে কি তারা বিশ্বাস করেন যে, ইসলামের প্রথম যুগে মানুষ নৈতিক উন্নতির এমন উচ্চ শীর্ষে আরোহণ করেছিলেন, যা হাসিল করা মানুষের পক্ষে আর কখনো সম্ভব নয়? এরূপ বক্তব্য তারা কি করে সমর্থন করতে পারেন, তারা নিজেরা যখন দাবী করে থাকেন যে, মানবতা প্রতিনিয়ত প্রগতির পথে সামনে এগিয়ে চলেছে?
খুলাফায়ে রাশেদীনের অনুরূপ শাসন-ব্যবস্থা প্রথম দিকে একবার এবং পরে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়ের পরিধিতে, যেমন উমর বিন আবদুল আযীযের খিলাফতকালে, এমনি ছিটেফোটা দু’একটা পুনরাবৃত্তি ছাড়া আর মুসলিম ইতিহাসে দেখা যায় না। এমনটি কেন ঘটলো তার উত্তর পেতে হলে আমাদের প্রশ্নটি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিবেচনা করতে হবে। ইতিহাসের পাতায় এর উত্তর অবশ্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় লিপিবদ্ধ হয়েছে। কখনো এর জবাব মেলে মুসলিন বিশ্বের কোন স্থানীয় ঘটনার আকারে, আবার কখনো মানবতার জীবন-ইতিহাসে উদ্ভাসিত কোন শাশ্বত সত্যের আকারে।
এ ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই নীচের দু’টি তথ্য বিবেচনা করতে হবে। প্রথমত ইসলামের সাহায্যে মানবতার যে বিপুল অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলে ইসলাম একে বর্বরতার যে অতল গহ্বর থেকে নৈতিক উৎকর্ষের উচ্চ শিখরে উন্নীত করেছিল তা ছিল এমন এক ঘটনা, জীবনের সাধারণ সূত্র দ্বারা যার কোন ব্যাখ্যা চলে না। ইসলাম এই পৃথিবীতে যেসব অসাধ্য সাধন করেছে, এটি ছিল তারই অন্যতম। কিন্তু এটা সম্ভব হয়েছিল ইসলামের প্রাথমিক যুগের নায়কদের বহু বৎসরের প্রস্তুতি ও সামগ্রিক নৈতিক সাধনার ফলে। তাদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনে তাঁরা এই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিলেন যে, তাঁরা সেই মহান আদর্শের জীবন্ত প্রতিমূ্র্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
কিন্তু ইসলাম এমন তড়িৎ গতিতে পৃথিবীতে বিস্তার লাভ করে যে, এর পূর্বের বা পরের কোন যুগে বিভিন্ন ঐতিহাসিক আন্দোলনের ইতিহাসে তার কোন নজীর নেই। কমিউনিস্ট ও জড়বাদীরা মানব ইতিহাসের জড়বাদী বা অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিতে অত্যন্ত পটু, কিন্তু তারাও তাদের তত্ত্ব দিয়ে ইসলামের এই অলৌকিক বিস্তৃতির কোন ব্যাখ্যা দিতে পারবে না। ইসলামের এই দ্রুত প্রসারের ফলে এমন অনেক জাতি এর আওতাভুক্ত হয়, যারা ইসলামের প্রকৃত মর্মবাণীর সাথে ভালভাবে পরিচিত হয়নি এবং এর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রকৃত তাৎপর্যও অনুধাবন করতে পারেনি। দুর্ভাগ্যবশত প্রথম যুগের আরবীয় মুসলমানদের মত এই সব মুসলমান সরকারের পক্ষে নও-মুসলিমদের মধ্যে আদর্শগত তালিম বা নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করাও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ফলে মুসলিম জাহানের সীমা বেড়ে যায়, বিশ্বাসীদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়; কিন্তু নব দীক্ষিতদের অধিকাংশের অন্তরে ইসলামের আদর্শ ও শিক্ষা প্রবেশ লাভ করতে পারেনি। ইসলামের অনুশাসন পদদলিত করতে শাসকদেরও তাই আর জনমতের তোয়াক্কা করতে হয়নি। তারা জনসাধারণের অধিকার হরণ করে সর্বপ্রকার জুলুম-নির্যাতনের মুখে তাদের নিক্ষেপ করে। উমাইয়া, আব্বাসীয়, তুর্কী ও মামলুকদের ইতিহাসে এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। সুগঠিত ও জ্ঞানদীপ্ত জনমতের অনুপস্থিতিতে তারা সহজেই ইসলামকে খেলার পুতুলে পরিণত করে জনগণের অধিকার হরণ করতে সক্ষম হয়।
দ্বিতীয়ত মানব জীবনে ইসলাম যে বিরাট অগ্রগতি সাধন করে, তাকে কিছুতেই একটি সাধারণ বা স্বাভাবিক ঘটনা বলে বর্ণনা করা যায় না। কারণ এটা মানবতাকে ক্রীতদাস ও ভূমিদাস প্রথার নিম্নতম পঙ্ক থেকে টেনে তুলে। এ যাবত পৃথিবীতে মানুষ যত রকমের সমাজ ব্যবস্থা পরখ করেছিল তার তুলনায় শ্রেষ্ঠতম ইনসাফ-সম্মত সমাজ ও রাষ্ট্র উপহার দিয়েছে। বেপরোয়া প্রবৃত্তি-তাড়না থেকে মানবতাকে মুক্তি দিয়ে ইসলাম মানব ইতিহাসে নৈতিক উন্নয়নের উচ্চতম শিখরে একে উন্নীত করে।
ইসলামই মানুষকে প্রথম যুগে এই অত্যাশ্চর্য সু-উন্নত নৈতিক উৎকর্ষ হাসিল করতে সাহায্য করেছিল। রসূলে করীম (সা) এবং তাঁর সাহাবাগণের জীবনে যে আত্মিক শক্তির উন্মেষ ঘটেছিল, ইতিহাসে তার অন্য কোন দৃষ্টান্ত মেলে না। এই শক্তি মানুষকে এত উচ্চমানে উন্নীত করেছিল, যা সাধারণভাবে হাসিল করা সম্ভব ছিল না। এর ফলে তারা এমন সব অসাধারণ কাজ করতে সক্ষম হয়েছিল যা রীতিমত অলৌকিক বলে মনে হবে। যখন এই জীবন্ত অনুভূতিতে ভাটা পড়ল, জনগণ তাদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক অস্তিত্বের সুউচ্চ আসন থেকে বিচ্যুত হয়ে তাদের পূর্বতন অবস্থায় অধঃপতিত হল। যদিও এর পরও তারা আল্লাহর রওশনিতে রওশনির একটা স্ফুলিঙ্গ অক্ষুণ্ণ রাখল। এই আল্লাহর রওশনিতে উদ্ভাসিত ইতিহাসের পাতাগুলির দিকেই আমরা আমাদের বন্ধু সহযাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। কিন্তু এর জন্য ইসলাম প্রবর্তিত পরিবর্তনের ন্যায় মানব জীবনে সামান্যতম পরিবর্তন আনতে হলেও স্বয়ং রসূল (সা) ও তাঁর সাহাবাদের উপস্থিতি অপরিহার্য বলে যারা মনে করেন তারা ভুল করেন। কারণ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেরশ’ বছর পূর্বে যা ছিল অলৌকিক ঘটনা, সাধারণভাবে মানবতা অথবা বিশেষভাবে মুসলিম জাতি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, তার কল্যাণে এখন এটা এমন এক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে, যা সমাধা করতে মানুষ সম্পূর্ণ সক্ষম। সুতরাং প্রথম যুগের মুসলমানদের জীবনে সুউচ্চ নৈতিক আদর্শের কথা স্মরণ রেখে আমরা যদি ইসলামকে আধুনিক জীবনে প্রয়োগ করতে চাই, তাহলে আমাদেরও যে সে যুগের মত অলৌকিক তড়িৎ-গতিতেই অগ্রসর হতে হবে তার কোন মানে নেই। কারণ বিভিন্ন দিকে মানুষের লব্ধ বিপুল অভিজ্ঞতা ও অগ্রগতি আমাদেরকে ইসলামী আদর্শের সুউচ্চ শিখরের অনেকটা নিকটবর্তী করে তুলেছে। ফলে এর বাস্তবায়ন এখন অনেক সহজতর হয়ে উঠেছে এবং এ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমও সহজসাধ্য হয়ে উঠেছে। আধুনিক জীবনধারা থেকে কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিলেই আমাদের কথার সত্যতা প্রমাণিত হবে।
আধুনিক যুগের অধিকাংশ জাতি সাধারণ নির্বাচনের মারফত তাদের শাসক নির্বাচিত করে থাকে। জনসাধারণের প্রতি তাদের কর্তব্য পালনে তারা ব্যর্থ হলে জনগণ তাদের সাস্পেন্ড বা ডিস্মিসও
করতে পারে। কিন্তু তেরশ’ বছর পূর্বে ইসলাম যে রাষ্ট্র-ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল, এটা তারই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধানের আধুনিক প্রয়োগবিধি মাত্র। খলীফা আবু বকর (রা.) ও উমর (রা.)-এর যুগে এটা অবশ্যই অলৌকিক ব্যাপার ছিল, কিন্তু আমাদের আধুনিক বিশ্বে এটা তা নয়। আমরা যদি আমাদের জীবনে এটা সততার সাথে কার্যকর করতে চাই তবে এর বাস্তবায়ন আমাদের জন্য অতি সহজ। আমরা যদি এটা ইংল্যান্ড বা আমেরিকা থেকে নিতে পারি তবে ইসলামের নামে কেন গ্রহণ করতে পারব না-বিশেষত এটা যখন ইসলামের মধ্যে এমনিতেই রয়ে গেছে?
তারপর রাষ্ট্র কর্তৃক তার কর্মচারীদের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের প্রশ্ন। এ ব্যাপারেও রসূলে করীম (সা)-এর সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে যে, রাষ্ট্রের সমস্ত নাগরিকের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। বিংশ শতাব্দীতে কমিউনিজম এই বিধানটি কার্যকরী করেছে; কিন্তু এটা ইসলাম পূর্বেই কার্যকরী করতে সক্ষম হয়েছিল-অথচ কমিউনিজম প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব কায়েম না করে উক্ত বিধান কার্যকর করতে পারেনি। রাষ্ট্রের কর্মচারীদের জন্য মৌলিক প্রয়োজন পূরণের নিশ্চয়তা বিধান যদি আমরা করতে চাই তার জন্য আমরা ইসলামের নেতৃত্ব অনুসরণ না করে কমিউনিজমকে অনুসরণ করতে যাব কেন?
সুতরাং চূড়ান্ত বিশ্লেষণে আমরা যে সমস্যাটির সম্মুখীন হচ্ছি তার মধ্যে রয়েছে একটি মৌলিক প্রশ্ন। কোন বিশেষ সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার বাস্তবায়ন সম্ভব কি না? এটাই একমাত্র মাপকাঠি, যার ভিত্তিতে কোন ব্যবস্থার বাস্তবতা বা অবাস্তবতার বিচার হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গীতে বিচার করলে আমরা দেখতে পাব যে, ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা প্রকৃত প্রস্তাবে একটি বাস্তব জীবন-ব্যবস্থা। কারণ, পৃথিবীর বুকে এটাই সর্বপ্রথম ব্যবস্থা, যা মানব-জীবনে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছিল।
কমিউনিস্ট ও তাদের স্বগোত্রীয়রা বলে বেড়ায় যে, আধুনিক জীবন বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত আর ইসলাম ভাবাবেগ ও সদিচ্ছার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা-একথার মূলেও কোন সত্য নেই। এটা যে নির্জলা মিথ্যা তা একটা বিষয় থেকেই বোঝা যায়-ইসলামী আইন মোটেই মানুষের অনুভূতি বা ভাবাবেগের উপর নির্ভর করে না। অনুরূপভাবে প্রথম যুগের খলীফাগণ তাঁদের পরিষদের সঙ্গে পরামর্শ কালে অথবা আইনের ব্যাখ্যা ও ইসলামী আইনের প্রয়োগ ক্ষেত্রে কল্পনাবিলাস বা মানুষের মর্জির উপর তাঁদের সিদ্ধান্ত ছেড়ে দিতেন না।
প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, ইসলাম শুধু আইনের উপর নির্ভর করে না। তা অবশ্যই নানারূপ আইন রচনা করে, কিন্তু সর্বপ্রথমে এটা চায় মানুষকে ভেতর থেকে সভ্য করে তুলতে। কারণ তার দ্বারাই আইন প্রয়োগ করা হলে তারা তাকে স্বেচ্ছায় মেনে চলবে-শুধুমাত্র সরকারের বাহ্যিক ভয়ে নয়, নিজের মধ্যকার নৈতিক তাগিদেও। রাজনীতির জগতে মানুষ এ পর্যন্ত যা কিছু হাসিল করেছে এটা নিঃসন্দেহে তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব। কিন্তু আইন সর্বক্ষণ মওজুদ রয়েছে এবং যখনই সাধারণ কল্যাণের জন্য প্রয়োজন হয় তা ব্যবহার করা হয়। এরূপ ক্ষেত্রে এটা ব্যক্তি ও দল-নির্বিশেষে কিভাবে প্রয়োগ করা হয়, সে সম্পর্কে খলীফা উসমান (রা) বলেছেনঃ “কুরআন যা নিয়ন্ত্রণ করে নাই আল্লাহ্ তার নিয়ন্ত্রণ করেন সরকারের মাধ্যমে।”
কতক লেখক ইসলামের পুনরুজ্জীবন যে সম্ভব নয় তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যুক্তি দেন যে, উমরের মত লোক সব সময় জন্মগ্রহণ করেন না; আর অনুরূপ ব্যক্তিত্ব ব্যতিক্রম এবং ইতিহাসে যখন-তখন এরূপ ব্যক্তিত্ব দেখা যায় না। কিন্তু যুক্তির এই ধারা তাদের মস্তিষ্কের শূন্যতাই প্রমাণ করে। কারণ, ইসলামী আইন প্রয়োগের জন্য আজ আমাদের প্রয়োজন ইসলামের প্রতিনিধি- স্থানীয় চরিত্র–ব্যক্তিগত উমর নন, বরং তাঁর রচিত আইন ও আইনের নজীর। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, উমর হুকুম দিয়েছিলেন যে, কেউ যদি কোন বাহ্যিক অর্থনৈতিক বা সামাজিক চাপের ফলে চুরি করে থাকে বলে প্রমাণ হয় তবে তার হাত কাটা যাবে না। এই আইন বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগের জন্য নিশ্চয়ই উমরের মত লোকেরই যে একেবারে প্রয়োজন তা নয়। ইসলামের একটি বিধান রয়েছে যে, সন্দেহের ক্ষেত্রে শাস্তি দান পরিহার করতে হবে, আর উপরোক্ত বিধানে উমর ইসলামী ব্যবহার-শাস্ত্রের উক্ত মূলনীতিরই ব্যাখ্যা দিয়েছেন মাত্র। উমর আমাদের মধ্যে নেই বলেই যে আমাদের বাস্তব জীবনে আমরা এই নীতি রূপায়িত করতে পারব না, এমন তো কোন বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ বাধা নেই।
অনুরূপভাবে উমর আরও আইন করেছিলেন যে, ধনী লোকদের উদ্বৃত্ত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে তা দরিদ্রদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়ার অধিকার শাসকের আছে। এ নিয়মটা বর্তমানে ইংলণ্ডেও চালু করা হয়েছে। এটা চালু করতে ইংলণ্ডে একজন উমরের দরকার হয়নি-তাতেই বোঝা যায় আধুনিক বিশ্বে এটা বাস্তবায়নযোগ্য। তাঁর এই আইন ছিল কুরআনেরই একটা আয়াতের ভিত্তিতে রচিত- “সম্পদ যেন কিছুতেই শুধুমাত্র ধনীদের হাতে আবর্তিত না হয়।” (৫৯:৭)। উমর আরও বিধান দিয়েছিলেন যে, গভর্নরদের সম্পদ কিভাবে অর্জিত হয়েছে, তা তদন্ত করে দেখার অধিকার রাষ্ট্রের আছে; রাষ্ট্র খুঁজে খুঁজে দেখবে-সম্পদ কি তাদের নিজেদের, না সরকারী তহবিল হতে তসরুপ করা অথবা অবৈধভাবে অর্জিত। এটা আজকের বিশ্বে প্রায় সার্বজনীন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, যদিও এই বিশ্বে উমর উপস্থিত নেই। তিনি আরও নিয়ম করেছিলেন যে, পরিত্যক্ত শিশুর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেবে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করা হবে। কারণ, তার পিতা-মাতার পাপের জন্য তাকে দায়ী করা চলে না অথবা তাকে কষ্ট দেওয়া চলে না। ইউরোপ এবং আমেরিকাও এই সত্যকে স্বীকার করে নিয়ে বিংশ শতাব্দীতে এ বিষয়ে আইন তৈরী করেছে। এতে করে আরেকবার প্রমাণিত হল যে, এই আইন প্রয়োগের জন্য উমরের উপস্থিতি অপরিহার্য নয়। উমরকে তো আমাদের এজন্যে প্রয়োজন নয় যে তিনি একজন ব্যক্তিত্বশালী লোক ছিলেন বরং এজন্যে যে, তিনি ইসলামের প্রথম যুগের একজন নেতৃস্থানীয় আইনজ্ঞ ছিলেন এবং ইসলামের মর্ম ও শিক্ষার দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে এতটুকু বলা যায় যে, তা আমরা অনুসরণ করলে উপকৃত হব। কারণ এতে করে আমরা জীবনের উচ্চতর সোপানে আরোহণ করতে অনুপ্রেরণা পাব এবং সর্ব যুগের মুসলমান এ থেকে অনুসরণের জন্য এক মহৎ শিক্ষা লাভ করবে। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে আমরা যদি ব্যর্থও হই, তাঁর রচিত আইন পালন করলেও বাস্তব জীবনে আমাদের জন্য যথেষ্ট হবে। কারণ আমরা এর ফলে অন্যান্য জাতির নিকট থেকে ধার করা আইন ও শাসনতন্ত্রের অন্ধ অনুকরণের বদলে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারব।
এ ছাড়াও ইসলাম সম্পর্কে আর একটি মস্ত ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে। কেউ কেউ বলেন যে, খুলাফায়ে রাশেদীনের সময় ছাড়া আর কোন দিন ইসলাম পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। একথা সত্য যে, খুলাফায়ে রাশেদীনের পর উমর বিন আবদুল আযীযের সংক্ষিপ্ত খিলাফতকাল ব্যতীত আর কখনো ইসলাম প্রকৃত চেহারায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে একথাও ঠিক নয় যে, খিলাফতে রাশেদার পর একটি ধর্ম ও জীবন-পদ্ধতি হিসাবে ইসলামের অস্তিত্ব নেই। পরবর্তী বছরগুলিতে শুধুমাত্র সরকারের মধ্যেই ইসলামের দৃষ্টিতে আংশিক বা পূর্ণ অধঃপতন ঘটেছে। সমাজের অবশিষ্ট অংশ পূর্বের ন্যায় ইসলামী থেকেছে। এ সমাজ কোন দিন মানুষকে ধনী, নির্ধন অথবা মালিক, গোলাম পর্যায়ে বিভক্ত হতে দেয়নি। তারা বরং একটা সার্বজনীন ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থেকেছে এবং একে অন্যের সাথে মিলে মিশে কাজ করেছে এবং তার ফল ভোগ করেছে।
মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র মুসলিম ভূ-খণ্ডের আইনই প্রাধান্য লাভ করেছে; ইউরোপের মত সামন্ত প্রভুদের দয়ার উপর জনসাধারণকে ছেড়ে দেওয়া হয়নি। ইসলামের ঐতিহ্য বজায় থেকেছে এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনাকালেও এ ঐতিহ্য মুসলমানরা পালন করেছে। ক্রুসেডের ইতিহাস, বিশেষ করে সালাহ্ উদ্দীন আইউবীর আমলের ঘটনাবলী পর্যালোচনা করলেই এ কথার সত্যতা প্রমাণিত হবে। পরবর্তীকালে ও আন্তর্জাতিক চুক্তি পালনের ক্ষেত্রে মুসলমানদের আচরণ মহান ও গৌরবজনক ছিল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি তাদের আগ্রহ এবং সভ্যতা সম্পর্কে তাদের অকুন্ঠ শ্রদ্ধার কারণে মুসলিম বিশ্ব জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ও শিশুকলা চর্চার প্রধান কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। ইসলামের প্রজ্বলিত জ্ঞানের দীপ্ত মশালই সমগ্র ইউরোপকে আলোকিত করে তাকে প্রগতি ও উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।
পাশ্চাত্যে যেরূপ খারাপ অর্থে ভাববাদ বোঝানো হয়, ইসলাম সেরূপ কোন মতবাদ নয়। এটা বরং একটা নিখুঁত বাস্তব ব্যবস্থা, যা একবার মানুষ পরখ করে দেখেছে। সুতরাং তেরশ’ বছর পূর্বে যে ভাবে একে একবার রূপায়িত করা হয়েছিল, পরবর্তীকালে লব্ধ অভিজ্ঞতার সাহায্যে সহজেই সেরূপ সাফল্যের সাথে আজও একে রূপায়িত করা সম্ভব। নবলব্ধ অভিজ্ঞতা বরং এর উপলব্ধির পথ মানুষের জন্য আরও সহজ ও নিকটতর করে দিয়েছে। অপর পক্ষে কমিউনিজম সম্পর্কেই বলা চলে যে, এটা একটা কল্পনা-প্রধান আদর্শবাদ,যার সফল প্রয়োগ এ পর্যন্ত কখনও হয়নি। আমাদের বলা হয়, প্রকৃত কমিউনিজমের স্তর এখন আসেনি, দুনিয়াই নাকি কেবল ধীরে ধীরে সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যখন সমগ্র বিশ্বকে একটিমাত্র বিশ্ব কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের আওতাধীনে আনয়ন করে এর সমস্ত নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সম-বন্টন করা হবে, তখনই নাকি কমিউনিজমের আসল স্তর-হাসিল করা হবে। তখন বড় ও ছোটর মধ্যকার শ্রেণী-সংগ্রাম চিরতরে দূরীভূত হবে। কারণ, সম্পদের অসম বন্টনই শ্রেণী- সংগ্রামের একমাত্র কারণ।
কমিউনিস্ট স্বপ্নরাজ্য একটি কল্পনা-রাজ্য, যা এই মাটির পৃথিবীতে কোনদিনই বাস্তবায়িত হয়নি এবং হবে না। এই মতবাদ যে মনে করে,একইরূপ উৎ- পাদন-যন্ত্র দিয়ে মানুষকে কখনো কৃত্রিমভাবে সমান করা যাবে না এবং মানুষের মধ্যে সম্পদের সমবন্টন হলেই সব শ্রেণী-সংঘাত খতম হয়ে যাবে এবং মানবতা শ্রেণী-সংগ্রাম ছাড়া প্রগতির পথে অগ্রসর হতে পারে না-এর সবকটি ধারণাই ভিত্তিহীন ও অসত্য। এ এমন এক ভাববাদের প্রতিনিধিত্ব করে, যা শুধুমাত্র আহম্মকদেরই চিত্ত জয় করতে পারে, জড়বাদের নামে কল্পনার জগতে এর সৃষ্টি হয়েছে এবং পরিহাসের বিষয় এই যে, বৈজ্ঞানিক নীতি ও জীবনের সত্যের উপর একে প্রতিষ্ঠিত বলে দাবী করা হয়।