ইসলামের চারটি মূল উৎস থেকে শুরু করে জ্ঞানের সকল শাখার মূল হলো উসূল। প্রত্যেক জ্ঞানের ৩টি মূল বিষয় থাকে, তন্মধ্যে অন্যতম হলো সেই জ্ঞানের মেথোডলজি। জ্ঞান শুধু তথ্য উপাত্তের নাম নয়; বরং হাকিকত অন্বেষণের দিকে উন্মুক্তকারী একটি পথ। এই পথ হলো সামগ্রিকতার পথ, কোনো সংকীর্ণতা এই পথে চলতে গেলে বাধাগ্রস্ত বা বিপথগামী করে তুলবেই। আর এ জ্ঞানের প্রতিটি শাখাকে বুঝতে এবং জানতে হলে ৩টি শর্ত আবশ্যক। বিষয়বস্তু, প্রিন্সিপলস বা মেথডোলজি এবং সেই জ্ঞানের সাথে উদ্ভাবিত সমস্যার সমাধান দেয়া।
মেথডোলজিকে যে নামে চিনি সেটাকে বলি পন্থা বা পদ্ধতি। আরবিতে বলা হয়, ‘ইলমুল মানহাজ’।
আবার এটাকে ‘ফালসাফাতুল উলুম’ বা জ্ঞানের ফিলোসফি ও বলা হয়। সকল জ্ঞানে যদি উসূল ও মেথডোলজিকে ভালোভাবে রপ্ত করা যায় তাহলে সে জ্ঞানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে সেখান থেকে চিন্তা উৎপাদন ও সুনিশ্চিত তথ্য বের করে সেটা কাজে পরিণত করার সম্ভব। আমরা দেখতে পাই, জ্ঞান এখন পণ্যে রূপান্তরিত হয়েছে। ইসলামের মৌলিক জ্ঞান এবং আমলের উৎসসমূহ সুস্পষ্ট হওয়ার পরেও একটি অক্ষর এমনকি একটি হরকতও পরিবর্তন হয়নি এমন অবিকৃত জ্ঞানসমূহ থাকার পরও পনেরো শতাব্দী পরে এসে দ্বীনকে স্থিতিশীলতা ও ধারাবাহিকতা দানকারী উৎসসমূহের সামগ্রিকতা, মূলনীতি ও দলীলসমূহের পদ্ধতি এবং মূল্যবোধের হারিয়ে ফেলা কীসের আলামত সেটা আমাদের জানতে হবে।
ব্রিটিশ একাডেমিয়া তাদের চিন্তা জ্ঞান আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের যে জ্ঞান সেটার মূলে প্রবেশ করে জানতে হবে। বর্তমান সভ্যতা ও জ্ঞানের কাছে মানবতা শুধু একটা ইনফরমেশন। কিন্তু ইসলামী সভ্যতায় মানবতা হলো, ইলাহী নাফখা অর্থাৎ ইলাহী রুহকে আমরা ধারণ করি। তাই শুধু ডেটা দিয়ে কোনোকিছু বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। মানুষকে উপাদান হিসেবে নয় নির্দেশন হিসেবে নিতে হবে।
সে হিসেবে কুরআনের পর দ্বিতীয় জ্ঞানের উৎস হলো সুন্নত। আমরা জানি যে, সুন্নত হলো রাসূল তাঁর কাজের মাধ্যমে আমাদের যে পথ দেখিয়ে গেছেন সেই সঠিক মাধ্যমই হলো সুন্নত। আর হাদিস হলো, সুন্নতকে বহনকারী মৌখিক বাণীসমূহ, গ্রন্থসমূহ এবং রেওয়াতসমূহ। অর্থাৎ, সুন্নত ও হাদিসের মধ্যেকার পার্থক্য হলো, সুন্নত হলো কুরআনকে বাস্তব জীবনধারায় রূপদানকারী উদাহরণ এবং সভ্যতা প্রতিষ্ঠাকারী মানুষের এক অনুপম উপমা। আর হাদিস হলো, দ্বীনের সাথে সম্পৃক্তকারী রাসূলের হিকমতপূর্ণ কথামালা, যা দ্বীনের দলিল হিসেবে সাব্যস্ত।
সুন্নত হচ্ছে এমন একটি পন্থা যেটা আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের বয়ান ও তার বাস্তব কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়েছে এমন একটি পন্থা হচ্ছে সুন্নত। কুরআনের জীবন্ত রূপ হচ্ছে সুন্নত। ইসলামের প্রথম যুগে হাদিসসমূহ লিখিত ছিল না। এর অর্থ এই নয় যে, সুন্নতের উসূল ছিল না। কেননা, সুন্নত হচ্ছে এমন একটি বিষয় যে ঘরে কুরআন নাজিল হয় সেই ঘরটাই সুন্নত।
অন্য দৃষ্টিকোণে সুন্নত হলো, কুরআন নাজিলের যে ধারাবাহিকতা, সে ওহীকে বাস্তবায়ন করে জীবন্ত রূপদানকারী, সেটাকে জীবনব্যবস্থায় প্রবর্তনকারী একটি উৎস হচ্ছে সুন্নত। ইসলামে কুরআনের পর ২য় দলীল সুন্নত। এক্ষেত্রে সুন্নত শুধু দলীলই না, এটি একটি জ্ঞানের উৎস। শুধু জ্ঞানের উৎসই না, একিসাথে একটি উসূল বা মেথডও দিয়ে থাকে।
নবী শুধু তাবলীগের দায়িত্বেই ছিলেন না, একি সাথে তিনি বয়ান, দাওয়াত, তাসকী এর দায়িত্বেও ছিলেন, যা মূলত উসূলের দায়িত্ব দিয়ে থাকে। কেননা অনেকেই ভাবে, নবীর সুন্নত হলো, ওহীকে গ্রহণ করে অন্যের কাছে পৌঁছে দেয়া।এটা আহলে কুরআনদের ধারণা। হযরত মুহাম্মদ (সা. আল্লাহর পক্ষ থেকে যে ওহী সেটা শুধু প্রচারই করেননি একিসাথে ব্যাখ্যা করেছেন। সমাজকে, মানবজাতিকে হিকমতের মাধ্যমে ইসলামের দিকে আহবান করেছেন। একটি পরিচ্ছন্ন বা মুঝাক্কি সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য তাদেরকে তাসকিয়া করেছেন।
যেমন: কোনো বিষয়কে বুঝা ও অনুধাবনের আগে যে বিষয়টা কোন উদ্দেশ্যে আগত, কাকে বা কোন জিনিসকে উদ্দেশ্যে রেখে আসা সেটা জানা জরুরী। যদি একটা কথা বা লাইনের ব্যাপারকেই ধরে নেই, সেক্ষেত্রে আমাদের আগে জানতে হবে সে লাইনটা কী উদ্দেশ্যে বলা বা কাকে কিংবা কোন জিনিসকে উদ্দেশ্যে করে বলা। হতে পারে সেটা নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর ক্ষেত্রে, নির্দিষ্ট কোন স্থান বা অঞ্চলের ক্ষেত্রে, নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে অথবা সার্বজনীন সকল দিক বিবেচনায় স্থান, কাল, সময়ভেদে অনির্দিষ্টকালের জন্য। অথবা সে কথা সীমাবদ্ধ বা স্থায়ীত্বতা দানকারী উন্মুক্ত বিষয়াবলির জন্য। অর্থাৎ, বুঝা গেলো কোনো বিষয় বা জ্ঞানের রন্ধ্রে ঢুকার প্রবেশপথই হলো, উসূল বা মূলনীতি (মেথডোলজি)
আজ আমরা অধিকাংশ সুন্নত ও হাদিসকে এক অর্থে বুঝে থাকি বা ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে আসা বিষয়সমূহকে এককেন্দ্রিক করে স্থায়ীভাবে বিবেচনায় নিয়ে থাকি অথচ ইসলামের দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত সুন্নত ও হাদিস দুটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয় বলে গণ্য করা হতো। কিন্তু উভয়টিকে একত্রীকরণ করে বুঝার প্রভাব বিস্তার করে শাফেয়ি ধারা ও আহলে হাদিসগণ যা পরবর্তীতে প্রভাবশালী চিন্তায় পরিণত হয়। এক্ষেত্রে মতপার্থক্য থাকাটা স্বাভাবিক বিষয় হলেও সুন্নত ও হাদিসকে তার মূল ও মৌলিক দৃষ্টিকোণ থেকে অধ্যায়ন ও বুঝতে না পারাটাই শত সমস্যা ও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। অথচ রাসূল সা এর ওফাতের চৌদ্দশত বছর পরে এসে এরূপ বিতর্ক মুসলমানদের জন্য কখনোই কাম্য ছিল না। কারণ, মুসলমানগণ কুরআনের পরে সুন্নতের উপর ভিত্তি করেই ঈমান, ইবাদত, আখলাক, সভ্যতা ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করেছে।
কিন্তু যখন প্রত্যেক বিশ্লেষক দ্বীনের এমন মূল উৎসসমূহকে নিজেদের দৃষ্টিকোণের আলোকে ব্যাখ্যা করা শুরু করে, তখন সেটা জ্ঞানগত, উসূলগত ও মেথডোলজিক্যাল দিক থেকে অনেক সমস্যার জন্ম দেয় যা শুধু বয়ান ও তথ্য হিসেবে খন্ডিত বিষয়ে রূপান্তরিত করে ফেলে। যা পরবর্তীতে আইডিওলজিক্যাল বিতর্কের প্রতিফলন ঘটিয়ে ওরিয়েন্টালিস্টদের দুষ্টচক্রের দাঁড় উন্মুক্ত করে দেয়। অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দীতে এ বিতর্ক চরম মাত্রায় পৌঁছালে ওরিয়েন্টালিস্টরা ও সুন্নত হাদিস গবেষণা করে তাদের লেখা ও চিন্তা সুন্নত ও হাদিসের নামে মুসলমানদের মাঝে ছড়িয়ে দেয় যা মুসলিম উম্মাহকে বিগত একশত বছর ধরে পরিগ্রহ করে রেখেছে।
এখান থেকেই বড় বড় সমস্যা সৃষ্টিকারী তিনটি ধারা অস্তিত্ব লাভ করে।
১- আহলে কুরআন
২- হিস্টোরিসিজম
৩- সালাফী ধারা
প্রথম ধারা, দ্বীন বলতে শুধু কুরআনকে বুঝে থাকে, যেখানে সুন্নত বা হাদীসকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে তারা। দ্বিতীয় ধারা কুরআন নাজিলের উদ্দেশ্য কে সে সমাজ ও সংস্কৃতির সৃষ্টি বা ইতিহাস বলে গণ্য করে থাকে, যেখানে কুরআন নাজিল হয়। আর তৃতীয় ধারা কুরআন ও হাদীসকে শুরু টেক্সট নির্ভর শাব্দিক ও আক্ষরিক অর্থে প্রয়োগ করে থাকে, যা শুধু নবীজীর সময়কাল প্রথম তিন প্রজন্মের কর্মকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাদের মতে, সেই তিন প্রজন্মের মাধ্যমে শুরু হওয়া ও তাদের মাধ্যমেই শেষ হয় সুন্নত ও হাদিসের ইতিহাস, এখানে আর কোনো অর্থ খুঁজে বের করা যাবে না।
ফলশ্রুতিতে, আমরা এ তিনটি ধারাকেই সমগ্র দুনিয়াব্যাপী দেখতে পাই, যা মর্ডানিজম ও ট্রেডিশনালিজম নিয়ে করা মতপার্থক্য থেকে সৃষ্টি হয়ে সুন্নত ও হাদিসের মূল উদ্দেশ্য থেকে শত যোজন দূরে অবস্থান করে অভিন্ন ও বিপরীতমুখী দৃষ্টিভঙ্গি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অথচ এ দ্বীন ইসলাম যে ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সভ্যতা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত এক বিশ্বজনীন ব্যবস্থার কেন্দ্রস্থল সেখানে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি কখনোই দ্বীনের মূল উৎসসমূহের শিক্ষা হতে পারে না। যারা সুন্নত ও হাদিসের মতো মূল্যবান রত্নভাণ্ডার কে অশুভ ও সংকীর্ণ করে তুলে মানবতার মধ্যে ক্লেশের উদ্ভব করে, তারা মূলত দ্বীনের শিক্ষাকেই অস্বীকার করে।
সুন্নত ও হাদিসের মতো এ বিশাল ভখন্ডারকে বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সামগ্রিক একটা দৃষ্টিকোণের উপর ভিত্তি করে পাঠ করতে না পারলে এ দুষ্টু চক্র যুগ যুগ ধরেই চলতে থাকবে, যা মানবতার জন্য বিধ্বংসী অনুঘটকের ভূমিকা পালনে সক্ষম। আর সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ সে ভান্ডারের উসূলের সাথে নিসবত করা ছাড়া অসম্ভব। কেননা, সুন্নত বা হাদীস নির্দিষ্ট কোনো যুগ, সময়, সংস্কৃতি, সমাজ, অঞ্চল, মানুষের জন্য আসেনি। সুন্নত ও হাদিস বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী, বিভিন্ন সংস্কৃতির অধিকারী মানুষদেরকে সমজাতীয় দ্বীন ইসলামের সভ্যতা সংস্কৃতির ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ করেছে। কুরআনের শানে নুজুলের মতো শানে উরুদকে সামনে রেখে সুন্নত ও হাদিস সকল যুগের, সকল সময়ের, সকল অঞ্চলের, সকল মানুষের জন্য বিশ্বজনীন রূপরেখা স্থাপন করেছে। যদি এটাকে তার মূল মাকসাদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়, সেটা হবে ক্লাসিক ওরিয়েন্টালিজমের দাবি, ‘এ সুন্নত ও হাদিসই উম্মাহর মধ্যেকার ঐক্য বিনষ্ট করে দিবে’ মোতাবেক আমরা আজ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেখতে পাচ্ছি।
এক আল্লাহ, এক দ্বীন, এক দরুদ, এক ঐতিহ্য, এক উৎসব আনুষ্ঠিকতা যদি তার মূলনীতির আলোকে স্থান পায়, সেটা কখনো কোনো হুমকির মুখে নিপতিত হতে পারবে না। আজ আমাদের দ্বীন ও দ্বীনের উত্তরসূরীরা যে হুমকির মুখে, সেখান থেকে উত্তরণের জন্য সুন্নত ও হাদিসের মর্যাদা ও কতৃত্বকে রক্ষা করা জরুরি। আর এর কতৃত্ব যথাযথভাবে ধরে রাখতে ও অনুসরণ করতে এ মহা রত্নভাণ্ডারের প্রতিটি বিষয়কে সঠিকভাবে বুঝা, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা ও শ্রেণিবিন্যাস করে ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে উসূলের প্রায়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আমাদের পূর্ববর্তী ফকিহগণ যেভাবে তাদের সময়কে সুন্নত ও হাদিসকে উসূলের আলোকে পথপ্রদর্শন করেছিলেন, তেমনি আমাদেরও উচিত আমাদের সময়ের আলোকে শক্তিশালী উসূলী দৃষ্টিকোণের ভিত্তিতে এ জ্ঞানভাণ্ডার থেকে উপকৃত হয়ে দ্বীন, উম্মাহ ও বিশ্ব ব্যবস্থাপনাকে পথপ্রদর্শন করা।