ফাগুনের এক পড়ন্ত বিকেল। এই ব্যস্ত শহরের মূল রাস্তা ছেড়ে আমার রিকশা প্রবেশ করলো নাজিমুদ্দিন রোডে। গন্তব্য করতলব খান মসজিদ। কে বলবে একপাশে নিউমার্কেট-নিলক্ষেত আর অন্য পাশে চকবাজারের মতো ব্যস্ত এলাকার মাঝে এত নিরিবিলি, একটা রাস্তা! অবশ্য সারা ঢাকা শহরের এই একই অবস্থা। রাস্তার অবস্থা বেশ খারাপ। উঁচুনিচু- এবড়ো থেবড়ো তার উপর বিভিন্ন জায়গায়া গর্ত করে সিটি কর্পোরেশনের কাজ চলছে।
রিকশার ক্রমাগত ঝাঁকুনি আর ধূলাকে অগ্রাহ্য করে একইসাথে বেশ কয়েকটা মসজিদ থেকে আজানের সুর ভেসে আসলো। এর মধ্যে কোন একটা আজান হয়তো করতলব খান মসজিদ থেকে এসেছে। আজানের সুর ইথারে ইথারে ধ্বণিত-প্রতিধ্বণিত হবার সাথে সাথে আমার মন ছুটে গেলো সাড়ে তিনশ বছর আগে। মনে হলো তিনশ বছর আগেও এই মিনার থেকে একই আজান ভেসে আসতো। সেই একই আহবান। হাইয়া আলাস সালাহ। হাইয়া আলাল ফালাহ। কী ভীষণ সংবেদী দুটো বাক্য। শত শত বছর ধরে সারা দুনিয়ার মানুষকে একই আহবান করে যাচ্ছে। আর মানুষ সেই এক মহান রবের দিকে ছুটে যাচ্ছে। সুদূর আফ্রিকার একটা মানুষ, আরবের এক মরুযাত্রী অথবা এইযে আমি, বাংলাদেশের একটা মেয়ে। একই প্রভুর দিকে, একই আহবানে। এ যেন দুনিয়ার সেরা মিলনের সুর।
আজানের সুর মেলাতে মেলাতেই আমরা গিয়ে পৌঁছলাম বেগমবাজারে। করতলব খান মসজিদের সামনে। ততক্ষণে মুসল্লিরা ভীড় করেছে মসজিদে। স্থানীয়রা অবশ্য মসজিদটিকে বেগমবাজার শাহী মসজিদ বা বেগমবাজার বড় মসজিদ নামেই চেনে। জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলা পিডিয়ার তথ্য মতে, মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব তরুণ মুর্শিদকুলী খাঁনকে ১৭০০ সালে সম্মানসূচক করতলব খাঁ উপাধি দিয়ে দেওয়ান হিসেবে বাংলায় পাঠান। তিনিই বাংলায় নবাবি শাসনের প্রতিষ্ঠাতা। ১৭০১ থেকে ১৭০৪ সালের মধ্যে তিনি এই মসজিদ নির্মাণ করেন। ১৭৭৭ সালে তৎকালীন নায়েব-ই-নাজিম শরফরাজ খানের কন্যা বেগম বাজারের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। স্থানীয় এলাকা ‘বেগমবাজার’ এবং মসজিদের নামটি তার নাম থেকেই সৃষ্টি হয়। ধারণা করা হয় একসময় মসজিদটির কোল ঘেঁষে বুড়িগঙ্গা নদী প্রবাহিত ছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়। এখনো ওয়াইজ ঘাট থেকে মসজিদটির দূরত্ব খুব বেশি নয়।
একসময় মসজিদটি ছিলো চারপাশে সবুজ গাছগাছালিতে ঘেরা। এখন সেই সবুজের সমারোহ আর নেই। কিন্তু চারপাশে অসংখ্য দোকানপাট, ছোট-বড় ভবনের মাঝে কালের স্বাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি একই রকমের পাঁচটি আকর্ষণীয় গম্বুজ। এই গম্বুজ শুধু গম্বুজ নয়। এগুলো যেমনি বাঙলায় মোঘল এবং নবাবী আমলের সুনিপুন স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন, তেমনি আমাদের গৌরমময় অতীতের সাথে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের যোগসেতু।
সংযোজিত দোচালা অংশসহ মসজিদটি একটি উচু ভল্টেড প্লাটফর্মের পশ্চিমের অর্ধেক অংশ দখল করে আছে। প্লাটফর্মের পূর্বে রয়েছে একটি বাব বা বাউলি (ধাপকৃত কুয়া)।
উত্তর-দক্ষিণে ৩৯.৬২ মি. এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৩.৪১ মি. প্লাটফর্মের উত্তর প্রান্ত খিলানাকৃতির। প্লাটফর্মের খিলানাকৃতির অংশটির মাঝ বরাবর কেটে একটি সমাধির জন্য জায়গা করা হয়েছে। সারকোফেগাসে মসজিদের প্রথম ইমামের নাম উৎকীর্ণ। প্লাটফর্মটির নিচে সারিবদ্ধভাবে একাধিক বর্গাকার ও আয়তাকার কক্ষ বিদ্যমান, যা এখন দোকানঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্লাটফর্মের পূর্ব দিকে নতুন করে নির্মিত সিড়ি সম্বলিত একটি খিলানপথ রয়েছে। এ পথেই প্লাটফর্মের উপর নির্মিত মসজিদে প্রবেশ করা যায়। তুলনামূলকভাবে বড় একটি বাউলি নির্মিত হয়েছিল সম্ভবত উজু করার জন্য।
একটি কক্ষের মধ্য দিয়ে সিড়ির কয়েকটি ধাপ বেয়ে নিচে নেমে এর পানি স্তরের নিকট পৌঁছা যায়। বাইরে থেকেও পানি উত্তোলণের ব্যবস্থা আছে। কোণার বুরুজসহ মূল মসজিদের পরিমাপ ২৮.৬৫ মি./ ৮.২৩ মি. এবং প্রবেশের জন্য পূর্ব দিকে পাঁচটি খিলানপথ রয়েছে। প্রতিটি খিলানই অর্ধ-গম্বুজ ছাদ দ্বারা আচ্ছাদিত এবং পাশে রয়েছে সরু অষ্টভুজাকৃতির ছোট মিনার, যা প্যারাপেট ছাড়িয়ে উপরে উঠে গেছে। উত্তর ও দক্ষিণ উভয় পার্শ্বের দেওয়ালের মাঝ বরাবর একটি করে দরজা আছে। সম্প্রসারিত অংশটিতে (৬.১০ মি. দ্ধ ২.১৩ মি.) দুটি দরজা রয়েছে; একটি পূর্ব দেওয়ালের মাঝ বরাবর, বর্তমানে নতুন করে নির্মিত এবং অন্যটি দক্ষিণ দেওয়ালের মাঝে। শেষোক্ত এ দরজা দিয়েই সম্প্রসারিত অংশের সাথে মূল মসজিদ সংযোজিত।
সম্প্রতি সম্প্রসারিত অংশের উত্তর দেওয়ালে একটি জানালা স্থাপন করা হয়েছে। এ কক্ষটির অভ্যন্তর ভাগের চারদিকের দেওয়ালে বেশ কিছু আয়তাকার ও বর্গাকার কুলুঙ্গি রয়েছে, সম্ভবত সেলফ হিসেবে ব্যবহারের জন্য এগুলি নির্মিত। বাঁকানো ছাদটি বাইরের দিকে নিয়মিত বিরতিতে পশ্চিম দেওয়ালের অভ্যন্তরভাগে রয়েছে অর্ধ-অষ্টভুজাকার পাাঁচটি মিহরাব কুলঙ্গি। পার্শ্বে ছোট বুরুজসহ সবগুলিই সম্মুখভাগে অভিক্ষিপ্ত। কেন্দ্রীয় মিহরাবের পাশে একটি তিন ধাপ বিশিষ্ট পাকা মিম্বার রয়েছে। মসজিদটির অভ্যন্তর ভাগে আড়াআড়িভাবে স্থাপিত চারটি চতুর্কেন্দ্রিক খিলান দ্বারা পাঁচটি ‘বে’তে বিভক্ত। কেন্দ্রীয় বে’টি বর্গাকার এবং পার্শ্ববর্তী অন্যান্য ছোট ছোট আয়তাকার বে’গুলি থেকে অপেক্ষাকৃত বড়। প্রত্যেকটি
বে গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত। গম্বুজগুলি অষ্টভুজাকার ড্রামের উপর স্থাপিত এবং পদ্ম ও কলস চূড়ায় সুশোভিত। গম্বুজের ভার বহনে যে পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে তা ঢাকার লালবাগ দুর্গ মসজিদ ও সাত গম্বুজ মসজিদে ব্যবহৃত কৌশলের অনুরূপ। চার কোণের চারটি অষ্টভুজাকার কলস ভিত্তি শোভিত কর্ণার টাওয়ার অনুভূমিক প্যারাপেটকে ছাড়িয়ে উপরে উঠে গেছে। কর্ণার টাওয়ারগুলি নতুন করে নির্মিত ছোট গম্বুজসহ বদ্ধ ছত্রী এবং পদ্ম ও কলস শোভিত শীর্ষচূড়া দ্বারা আচ্ছাদিত। সবগুলি টাওয়ারেরই ডান ও বাম উভয় পার্শ্বে সংযোজিত হয়েছে সরু মিনার যা প্যারাপেট থেকে উঁচু এবং ছোট গম্বুজ ও কলস ফিনিয়াল দ্বারা আচ্ছাদিত। মসজিদের বাওলি, যা একটি স্বতন্ত্র্য সৌধ হিসেবেই প্রতীয়মান, আলাদাভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। এটি বাংলায় একমাত্র ও স্বতন্ত্র্য নিদর্শন। এ ধরনের স্থাপত্য খুঁজে পাওয়া যায় দাক্ষিণাত্যে, যেখানে এ মসজিদের নির্মাতা করতলব খান বাংলায় আসার পূর্বে দীর্ঘ দিন অতিবাহিত করেছিলেন।
ঢাকা শহর তার কন্দরে কন্দরে এরূপ অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শনকে আজও ধরে রেখেছে। যদিও আধুনিক অপরিকল্পিত বাড়িঘর আর যানবাহনের চাপে এর অধিকাংশই পড়ে আছে অনাদরে অবহেলায় এবং অনেকক্ষেত্রে দৃষ্টির আড়ালে। তবু তারা হারিয়ে যায়নি। আমাদের ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে বছরের পর বছর ধরে ধারণ করেছে। পৌঁছে দিয়েছে আমাদের কাছে। পুরনো ভবনগুলোর ভগ্ন দেয়ালগুলো যেন আর্তনাদ করে বলতে চায়, “দেখ তবু আমি হারিয়ে যাইনি। টিকে আছে এই শহরের সকল যান্ত্রিকতার সাথে সংগ্রাম করে। তবে তোমরা কেন হারিয়ে যাবে?”
লেখা: নাজিয়া তাসনিম



