শিউলিমালা একাডেমি

খনিতে অপার সম্ভাবনা; প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

প্রাকৃতিক সম্পদ ও নান্দনিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ আমাদের এই বাংলাদেশ। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, ঐতিহাসিক মসজিদ-মিনার, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র-সৈকতসহ বন-বনানী ও পাহাড়-পর্বতের নান্দনিক সব সৌন্দর্য পর্যটকদের মুগ্ধ করেছে প্রতিনিয়ত। শুধু নৈসর্গিক সৌন্দর্যেই নয়, বরং খনিজ সম্পদের বিশাল এক প্রাচুর্যের আধার আমাদের এই দেশটি। এসবের কারণেই এদেশকে ‘সোনার বাংলা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা একেবারেই যুক্তিযুক্ত।

বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকাই স্বতন্ত্র বৈশিষ্টমন্ডিত; ভূমির উপরিভাগ যেমন অপরূপ ও নান্দনিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি, ভূমির অভ্যন্তর বা তলদেশও তেমনি প্রাকৃতিক সম্পদের আধার। স্বর্ণের চেয়েও মূল্যবান সব খনিজ সম্পদের সন্ধান মেলে এই বাংলাদেশে। অতএব, এদেশের অন্যতম একটি অর্থনৈতিক ভিত্তি যে আমাদের এই প্রাকৃতিক সম্পদসমূহ, এটা অনস্বীকার্য।

নিকট অতীতে বাংলাদেশে বিদ্যমান খনিজ সম্পদের বাজারমূল্য নিরূপণ করেছে বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি)। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রাকৃতিকভাবে মজুদ খনিজ সম্পদের মূল্য ২ দশমিক ২৬ ট্রিলিয়ন (২ লাখ ২৬ হাজার কোটি) ডলারের বেশি। বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ ২৪১ দশমিক ৯৭ ট্রিলিয়ন (২ কোটি ৪১ লাখ ৯৭ হাজার ৩০০ কোটি)।

নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ঘেরা দেশটিতে নুড়ি পাথরের দামও অনেক। ৬ জেলায় মজুদ আছে প্রায় ২২০ টন নুড়ি পাথর। মাধবপুর, বিজয়পুর, মধুপুর-সহ দেশটার বহু জায়গায় জমা রয়েছে মূল্যবান সাদামাটি। শুধুমাত্র নওগাঁতেই রয়েছে আড়াই হাজার কোটি টনের বেশি চুনাপাথর। কয়লা রয়েছে প্রায় ৭২৫ কোটি টন। পিট কয়লা রয়েছে প্রায় ৬০ কোটি টন। নদী ঘেরা এই দেশের বেশিরভাগ বড় নদীতেই রয়েছে খনিজ বালি। এতদসত্ত্বেও, দেশটি বর্তমানে ডলার সংকটে ভুগছে। যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩৬ শতাংশ বেশি।

কয়েক ধরনের খনিজ পদার্থ যথেষ্ট পরিমাণে মজুদ থাকা সত্ত্বেও তা আহরণ করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণ-এর বিষয়টি অজানা কোনো এক কারণে প্রতিনিয়তই অবহেলিত অবস্থায় পড়ে থাকে। অথচ, ব্যাপক চাহিদার বুলি আওড়িয়ে উচ্চমূল্যে আমদানি করা হচ্ছে বিদেশ থেকে।

বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক প্রধান হলেন ভূতত্ত্ববিদ ইউনূস আকন। তিনি বলেন, “দেশের সমুদ্র-সৈকত ও তার সন্নিহিত এলাকায় অন্তত ৪৩ লাখ মেট্রিক টন বিভিন্ন ধরনের ভারী মণিক বা মূল্যবান রত্ন রয়েছে। কিন্তু পরমাণুশক্তি কমিশন কয়েক দশক ধরে পরীক্ষামূলক (পাইলট) প্রকল্পের অধীনে মাত্র দুই হাজার টনের মতো আহরণ করেছে। অথচ, দেশের স্বার্থে বাণিজ্যের জন্য সরকারিভাবে এগুলো উত্তোলনের কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করা হয়নি।”

ইউনূস আকন বলেন, “এসব ভারী মণিকের মধ্যে রয়েছে জিরকন, মোনাজাইট, রুটাল, ইলমেনাইট, গার্নেট প্রভৃতি। এসব কাঁচামাল প্লাস্টিক, কাগজ, রং, সিরামিক, টাইলস প্রভৃতি শিল্পের অপরিহার্য উপাদান।”

তিনি আরও বলেন, “ভারতের উড়িষ্যা, অন্ধ্র ও তামিলনাড়ু রাজ্যের সৈকত থেকে প্রায় ৮০ বছর ধরে প্রতিবছর কয়েক লাখ টন এসব মনিক আহরণ করা হচ্ছে। দেশের প্রয়োজন মিটিয়ে ভারত এগুলো রপ্তানিও করে। কিন্তু বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত আহরণের উদ্যোগই নিতে পারেনি।”

পত্রিকার পাতায় একটি শিরোনাম প্রতিনিয়তই আমাদের চোখে পড়ে, বাংলাদেশের এখানে-সেখানে প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। অর্থাৎ, সারাংশ এটাই যে, বাংলাদেশে মজুদ প্রাকৃতিক সব খনিজ সম্পদের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার গ্যাসোত্তলনকেই তুলনামূলক বেশি গুরুত্ব দেয়। অথচ, ক্ষেত্রবিশেষে অন্যান্য খনিজ সম্পদ গ্যাসের সমপর্যায়ের বা তারচেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। কিন্তু, উদ্যোগগুলো নেওয়া হচ্ছে না কেন, এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। পাশাপাশি, নির্দিষ্ট অঞ্চলের কৃষি সম্ভাবনা, বসতবাড়ি এগুলোর ক্ষয়ক্ষতিকে ও বিবেচনায় রাখতে হবে। সরাসরি খননের পরিবর্তে আজকাল অনেক আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষিজমি ও বসতবাড়ির ক্ষতি ছাড়াই খনিজ উত্তোলন সম্ভব হয়। অপরিকল্পিত উত্তোলনের মাধ্যমে এক খাতে অর্জন করতে গিয়ে আরেকটি সম্ভাবনাকে খুইয়ে দেয়া যাবেনা। এজন্য সরকারীভাবে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নেয়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, প্রকৌশল এসব বিভাগে খুব শক্তিশালী উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। আমাদের ইঞ্জিনিয়ারদের দেশের কাজে লাগানো প্রয়োজন। বৈদেশিক আগ্রাসন ও হুমকির সামনে বুক টান করে দাঁড়াতে পারার মতো দৃঢ়চেতা নেতৃত্ব প্রয়োজন। আর জনগনের উচিৎ দেশ নিয়ে ভাবা, কথা বলা, প্রস্তাবনা হাজির করা এবং এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহি চাওয়া। মূলকথা, এসব বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ আর বিনিয়োগ যেমন প্রয়োজন, ক্ষেত্রবিশেষে এরচেয়ে বেশি প্রয়োজন আমাদের দেশপ্রেম এবং খনিজ সম্পদ সংরক্ষণে পর্যাপ্ত সচেতনতা।

চট্টগ্রামে গ্যাস আর জ্বালানি তেল মজুদের প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে, অথচ জ্বালানি বিভাগ প্রায়ই প্রচুর কূপ খননের পরিকল্পনা নিলেও অজ্ঞাত কারণবশত চট্টগ্রামকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। এটা অস্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, মাটির অত্যন্ত গভীর থেকে কয়লা উত্তোলনের সহজলভ্য প্রযুক্তি এখনো বাংলাদেশের কাছে নেই। এক্ষেত্রে এখন অন্য দেশের উপর নির্ভরশীলতার বিষয়টি অপরিহার্য হয়ে পড়ে। যেহেতু অন্য দেশের উপর নির্ভরশীল হতেই হচ্ছে এখন আমাদেরকে, অতএব খনিজ সম্পদ উত্তোলনে সহায়তার দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হওয়াটা প্রয়োজন খুবই সাবধান ও সচেতনতার সাথে। অর্থাৎ, মেট্রোরেল, ট্রানজিট বা রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের মতো কোনো ক্রমেই অন্যদেশকে একপাক্ষিক উপকৃত হতে দেওয়া যাবে না।

১৯৭৫ সালে সর্বপ্রথম মৌলভীবাজারে ইউরেনিয়ামের সন্ধান মেলে। পরবর্তীতে কয়েক দফা অনুসন্ধানে আরও বেশ কয়েকটি এলাকায়ও পাওয়া গেছে দুষ্প্রাপ্য এই খনিজ পদার্থটি। সিলেটে মিলেছে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ইউরেনিয়াম খনির সন্ধান। পৃথিবীর বিভিন্ন বড় বড় গবেষণাগারে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, বাংলাদেশে প্রাপ্ত ইউরেনিয়াম খুবই উন্নতমানের। বিশ্ববাজারে যেখানে ইউরেনিয়াম বিক্রি হয় চড়ামূল্যে, সেখানে এটিকে আমরা ফেলে রেখেছি অবহেলায়; নেয়া হয়নি উত্তোলনের কোন ব্যবস্থা। অথচ শুধু এক ইউরেনিয়ামই বদলে দিতে পারতো বাংলাদেশের অর্থনীতির ভাগ্যকে।

অতএব, রাষ্ট্রীয়ভাবেই যদি খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান আর উত্তোলনের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রার একটা বড় উৎস হতে পারে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ। তাহলে এক্ষেত্রে বৈদেশিক বিনিয়োগ অপরিহার্য। কিন্তু, তারও পূর্বে প্রয়োজন, বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য একটি নিরাপদ ও দুর্নীতি মুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে প্রথমত নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করা। পাশাপাশি, বিদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক হার কমাতে হবে। একই সঙ্গে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধনে সচেষ্ট থাকতে হবে।

বিভিন্ন জায়গায় কয়লা, চুনাপাথরসহ বিভিন্ন খনিজ সম্পদ আহরণের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও সেরকম কোন কাজ হয়নি। অথচ প্রকল্পের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বছরের পর বছর বেতন দেয়া হচ্ছে। এতেও যেন যথেষ্ট ছিলোনা, দেশের জন্য উত্তোলনের পরিবর্তে কেউ কেউ আবার এগুলো চুরি করে বিদেশে পাচার করছে। বড় পুকুরিয়ার কয়লা খনিতে চুরির কথাতো কারও অজানা নয়। আমাদের চোখের আড়ালে এরকম আরও কত চুরিই না জানি প্রতিনিয়ত হচ্ছে। কেন এসবের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়না, তার কোন সুস্পষ্ট জবাব আজ পর্যন্ত জাতির সামনে কেউ দিতে পারেনি।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিজস্ব এত এত সম্পদ থাকার পরেও এটাকে রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে না। তাই প্রতিনিয়তই আমাদেরকে আমদানি-নির্ভর হয়ে থাকতে হচ্ছে। মাটির নিচে সম্পদের বিপুল সমাহার থেকেও আজ আমরা ভারতের থেকে পিছিয়ে। অথচ, বাংলাদেশ চাইলেই হাজার হাজার কোটি টাকার বাজার তৈরি করতে পারে, রিজার্ভে জমা করতে পারে মোটা অঙ্কের রাজস্ব। আমাদের বৈদেশিক আয়ের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হতে পারতো খনিজ রপ্তানি। জ্বালানি সংকট আর ডলার সংকটের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে এতটা নাকাল আর হতে হতো না। এমনকি, এটা বললেও অত্যুক্তি হবে না যে, তৃতীয় বিশ্বের অসংখ্য দেশ সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল হয়ে পড়তো বাংলাদেশের উপর।

অতএব, চাইলেই আমরা নিজেদেরকে গোটা পৃথিবীর নিকট সম্ভাবনাময় একটা দেশ হিসেবে তুলে ধরতে পারি। আগের থেকে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে বটে, তবে আমদানি বেড়েছে তার থেকেও অনেক গুণ বেশি। খনিজ সম্পদ থাকলেও উৎপাদন কম। চড়া দামে আমদানিকৃত মালামাল কিনতে হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে। তাহলে বাংলাদেশে এতোসব খনিজ সম্পদ থেকেও উপকারটা কী হলো আমাদের?

বাংলাদেশ কিন্তু চাইলেই প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভর করে যথাযথ বিনিয়োগ করতে পারে। যদি করে, এই আমদানি নির্ভর দুর্দশা থেকে বেরিয়ে আসতে খুব বেশি সময় লাগবে না। এশিয়ার অন্যতম একটি শক্তিশালী দেশে রূপান্তরিত হতেও সময় নেবে না আমাদের এই মাতৃভূমি। রপ্তানিই হবে তখন দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। যদি সিঙ্গাপুর এত কম সময়ে নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে পারে, মাত্র কয়েক বছরের মাথায় বাংলাদেশ থেকে নেওয়া ঋণের একটা অংশ যদি শ্রীলঙ্কা পরিশোধ করতে পারে, তবে আমরা কেন আমাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারবো না?

তবে একটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, রঙ্গপ্রিয় বঙ্গবাসী হরহামেশাই পথে-ঘাটে, চায়ের আড্ডায় যেসব বুলি আওড়ায়, তার বেশির ভাগই মূলত বাস্তবতা বিবর্জিত আষাঢ়ে গল্প। অন্যদিকে, বাংলাদেশের বর্তমান দুর্নীতিকে পুকুরচুরি বলাটা দুর্নীতিকেই অপমান করার নামান্তর। মর্ত্যলোকের দুর্নীতিবাজ আমলা ও কর্মকর্তাদের দেখে মহাকাশ-মহাসাগর সবই আজ কম্পমান হলেও আশা করা যায়, তরুণ-সমাজ একদিন এসবের বিরুদ্ধে দৃঢ়চিত্তে রুখে দাঁড়াবে।

লেখা: সাবিহা শুচি

গবেষণা বিভাগ প্রধান

শিউলিমালা একাডেমি

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *