শিউলিমালা একাডেমি

খাপলুর চাকচান মসজিদ

উত্তর পাকিস্তানের বালতিস্তান অঞ্চলের খাপলু শহরের প্রাচীনতম মসজিদ গুলোর মধ্যে “চাকচান” মসজিদ অন্যতম। উর্দুতে এর অর্থ দাঁড়ায় “অলৌকিক মসজিদ”।

মসজিদটির নির্মাণ সম্পর্কে নানা ধরনের জনশ্রুতি প্রচলিত। কথিত আছে যে, প্রায় ৭০০ বছর পূর্বে এটি বৌদ্ধদের একটি উপাসনালয় ছিল। পরে পাশ্ববর্তী এলাকা কাশ্মিরের মুসলিমদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এ অঞ্চলের অধিকাংশ জনগণ ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়। ফলশ্রুতিতে প্রাচীনতম এই স্থাপনাটি মসজিদে রূপ লাভ করে। কেউ কেউ দাবী করেন, সৈয়দ নুরবখশ নামক একজন কাশ্মিরী সুফি, যিনি ছিলেন এই অঞ্চলের সর্বপ্রথম ইসলাম প্রচারক, তিনি ১৩৭০ সালে কাশ্মীর থেকে বাল্টিস্তানে আসার পর এটি নির্মাণ করেন। কিন্তু অধিকাংশ ইতিহাস বিশেষজ্ঞ এই তথ্যের সাথে একমত নন। কেননা, তাদের মতে এই মসজিদ টি সুফি নুরবখশ এর জন্মের প্রায় বিশ বছর আগে নির্মিত হয়েছিল। আবার কারো কারো মতে, স্থানীয় রাজা ইসলাম গ্রহণ করার পর ১৩৭০ সালে মসজিদটি নির্মাণ করেন।

মসজিদটি কার দ্বারা নির্মিত হয়েছে এ সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য না মিললেও ১৩৭০ সাল বা তার সমসাময়িক সময়েই যে মসজিদটি নির্মিত হয়েছে এটি সুস্পষ্ট।

মসজিদটিতে কাশ্মীরি এবং তিব্বতি স্থাপত্যের একটি প্রাণবন্ত সংমিশ্রণ পরিলক্ষিত হয়। কাদা, পাথর এবং কাঠ দিয়ে অভ্যন্তর এবং বহির্ভাগের চারপাশে কাঠের ব্যবহার প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর একটি সূক্ষ্ম স্পর্শ এনে দেয়।

বর্গাকার কমপ্লেক্সের ন্যায় ভবনটির উপরে একটি অ্যাটিক রয়েছে যা কাঠ এবং কাদামাটি দ্বারা নির্মিত। তিব্বতীয় শৈলীর অনুরূপ অর্ধ-কাঠযুক্ত নির্মিত পেরিমেট্রাল দেওয়াগুলি কাঠের স্লাব দিয়ে তৈরী এবং এর ফাঁকা জায়গা গুলো কাদামাটি দিয়ে ভরাট করা। এই পদ্ধতিটি আবহাওয়ার প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করার একটি প্রাচীনতম নিয়ম বলে পরিচিত। মূলত
চাকচান মসজিদের নির্মাণশৈলী রোমান ওপাস ক্র্যাটিকামের সাথে অনেকাংশেই সাদৃশ্যপূর্ণ।

মসজিদটি একটি ঢালু ভূমিতে নির্মিত বিধায় নিচতলাটি পশ্চিম দিকের মাটির সাথে অনেকটা মিশে গেছে। গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে একটি সিঁড়ি প্রথম তলার পূর্ব দিকের বারান্দার সাথে ওভারহ্যাংড স্ল্যাবের মাধ্যমে সংযুক্ত যা একটি মাত্র স্তম্ভের উপর ভর করে আছে। মূল নামাজ খানার চারপাশে বারান্দাটি বিস্তৃত যা ১৩টি পিলারের উপর দাড়িয়ে আছে। মসজিদের কেন্দ্রীয় হলটি ৮ মিটার লম্বা এবং ৭ মিটার চওড়া। হলের ছাদটি অর্ধ-কাঠযুক্ত পেরিমেট্রাল প্রাচীর এবং চারটি স্তম্ভ দ্বারা নির্মিত। প্রবেশদ্বার অর্থাৎ পূর্ব এবং পশ্চিম দিকের বারান্দার প্রস্থ ৩.৮ মিটার এবং দক্ষিণে ১.৬ মিটার ও উত্তরে এক মিটার চওড়া।

তিন তলা বিশিষ্ট মসজিদটির উপরের তলা নূরবখশিয়া সম্প্রদায়ের দখলে (নূরবখশিয়া হল সুন্নি ও শিয়া মতো ইসলামের একটি সম্প্রদায়)। ঘাঁছের জেলার প্রায় ৯০% জনগণ এই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। আর মসজিদের মধ্যম তলা শিয়া সম্প্রদায়ের দখলে।

এশিয়ার প্রাচীনতম এই মসজিদটি ঘাঁচে জেলার প্রথম পর্যটন পয়েন্ট। উত্তরাঞ্চলের অর্থাৎ গিলগিট-বালতিস্তানের সবচেয়ে বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক এবং পর্যটকদের আকর্ষণের একটি প্রধান উৎস।
পরিপূর্ণ সংস্করণের কাজ শেষ করার পর এখন মসজিদটি ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান সরকার চাকচান মসজিদকে পাকিস্তানের জাতীয় ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।

পাহাড়ি শীতল সৌন্দর্যে ঘেরা এই মসজিদটিতে মুঘল ভাষার একটি নিখুঁত মিশ্রণ এবং ফার্সি স্থাপত্য শৈলীরও কিছুটা প্রতিচ্ছবি পরিলক্ষিত হয়। ব্যবহৃত কাঁদামাটি এবং কাঠের সংমিশ্রণ মসজিদটিকে করে তুলেছে মোহনীয়। নুরবখশিয়া সম্প্রদায়ের সৈয়দ মোহাম্মদ নামক একজন সাধকের আস্তানা এবং কবরের স্মৃতিস্তম্ভ মসজিদটির পাশেই অবস্থিত।

শত শত বছর ধরে সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকা এই মসজিদটি আমাদের অতীত ঐতিহ্যের অংশ। প্রাচীনতম এই স্থাপনাটি বারোশত বছরের সালতানাতকে মনে করিয়ে দেয় বার বার!

সংকলক: নাজিফা আঞ্জুম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *