শিউলিমালা একাডেমি

চকবাজার শাহী মসজিদ

মসজিদের শহর ঢাকা৷ ঢাকার বড় বড় শহর থেকে শুরু করে অলিতে-গলিতে রয়েছে অসংখ্য মসজিদ৷ ঢাকায় ঠিক কতটি মসজিদ আছে তা হিসাব করা বেশ কঠিন৷ অসংখ্য মসজিদ থাকার কারনে এটিকে মসজিদের শহর বলা হয়৷

মূলত মোঘল আমল থেকেই ঢাকায় মসজিদ তৈরির সূচনা৷ ধীরে ধীরে এটি মসজিদের শহরে পরিণত হয়৷ প্রাচীন আমলের অনেক মসজিদ বর্তমানের মসজিদের চেয়েও বেশি আকর্ষণীয়৷ ভ্রমণপিপাসু সাধারণ মানুষদের তালিকাতেও রয়েছে এসব মসজিদের নাম৷ চোখ ধাঁধানো এসব মসজিদ বর্তমানের অনেক মসজিদকে হার মানায়৷ এসব মসজিদের মধ্যে অন্যতম একটি হলো চকবাজার শাহী মসজিদ, যা এখন ‘চক মসজিদ’ নামেই বেশি পরিচিত।

চকবাজার শাহী মসজিদ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের পুরান ঢাকার চকবাজারে অবস্থিত৷ মসজিদের শিলালিপি থেকে ধারণা করা হয় মোঘল সুবেদার শায়েস্তা খান ১৬৭৬ খ্রিষ্টাব্দে এ মসজিদ নির্মাণ করেন৷ আশেপাশের আধুনিকতার দেখে বুঝার উপায় নেই যে এ মসজিদটি চারশ বছরের পুরানো৷ বলা হয়ে থাকে মসজিদটি বাংলার উঁচু প্লাটফর্মের উপর নির্মিত প্রাচীনমতম ইমারত-স্থাপনা৷ প্লাটফর্মটির নিচে ভল্ট ঢাকা কতগুলো বর্গাকৃতি ও আয়তাকৃতি কক্ষ আছে৷ ধারণা করা হয়, প্লাটফর্মের নিচের কক্ষগুলোতে মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের আবাসন ছিল। এই ধরনের ভবনগুলীকে বলা হয় “আবাসিক-মাদ্রাসা- মসজিদ”৷

বহুকাল ধরে ঐতিহ্য বহন করা এই মসজিদের দেয়াল, গম্বুজ, মিহরাব ইত্যাদি অনেকবার সংস্কার করা হয়েছে৷ সংস্কারের কারণে মসজিদের অবকাঠামোতে নানা ধরনের পরিবর্তন এসেছে৷ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মসজিদের এতো এতো সংস্কারের ভিড়ে এটির পূর্বের চেহার অনেকটাই বিলিন হয়ে গিয়েছে৷

চকবাজার শাহী মসজিদের মূল অবকাঠামো ছিল মাটি থেকে ১০ ফুট উপরে৷ এর দৈর্ঘ্য ছিল ৫০ ফুট আর প্রস্থ ছিল ২৬ ফুট৷ মসজিদের উপরে তিনটি গম্বুজ ছিল। এগুলো ভেঙে আরেকটি তলা নির্মান করা হয়েছে, নতুন করে দ্বিতলার উপর তিনটি গম্বুজ নির্মাণ করা হয়েছে৷ উত্তর-পূর্ব কোণে ছিল সুউচ্চ মিনার। তবে বর্তমানের এটির উচ্চতাও বৃদ্ধি করা হয়েছে৷ মিনারের নিচে ছিল মসজিদের প্রধান প্রবেশেদার। তবে দক্ষিণ দিক থেকেও প্রবেশ করা যেতো৷ মসজিদে প্রবেশের জন্য রয়েছে তিনটি প্রবেশ পথ৷ এই প্রবেশপথ গুলো মসজিদের পূর্ব দিকে অবস্থিত৷ এগুলোর সমান্তরালে পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে তিনটি মিহরাব৷ আগের মিহরাবগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে বর্তমানে নতুন করা মিহরাব নির্মান করা হয়েছে৷ তবে এর কেন্দ্রীয় মিহরাবটি আদি বৈশিষ্ট্য রেখেই অষ্টকোণাকৃতি করা হয়েছে, বাকি দুইটি আয়তকার৷

চকবাজার শাহী মসজিদের ভেতর একটি শিলালিপি আছে যা ফার্সি ভাষায় লেখা৷ হরিনাথ দে এই লেখাটির অনুবাদ করেছেন –
“The Ameer of Ameers who cleaves to the right
masjid Shaista did built in God’s right,
I said to the seeker enquiring its date
Accomlished We know Was God’s bidding”

চকবাজারের শাহী মসজিদকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে বিখ্যাত চকবাজার৷ মোঘল আমলে ‘চক মসজিদ’ ছিল কেন্দ্রীয় মসজিদ৷ এই মসজিদের আজান শুনে বাকি মসজিদগুলোতে আজান দেয়া হতো৷ তখনকার সময়ে মাইক না থাকায় মসজিদের মিনারে আজান দেয়া হতো৷ মোঘল রীতিতে চাঁদ দেখা হলে এই মসজিদ থেকে তোপধ্বনি দেয়া হতো৷ রমজান মাসে তারাবির সময় বা অন্যান্য ধর্মীয় আয়োজনে ঝাড়বাতির আলোয় আলোকস্বজ্জা করা হতো এ মসজিদ৷ বিভিন্ন বাসা, দোকান থেকে ইফতার দেয়া পাঠানো হতো মসজিদে৷ ঢাকার নায়েবে নাজিমরা চকবাজার জামে মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তেন। ‘তাওয়ারিখে ঢাকা’ গ্রন্থে এই বিবরণ দিয়েছেন মুন্শী রহমান আলী তায়েশ। আরেকটি সামাজিক রীতি ছিল চক মসজিদ ঘিরে। প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাজের দিন চারপাশের বাড়ি থেকে মিষ্টান্ন পাঠানো হতো। বিতরণ করা হতো নামাজ শেষে।

এক সময় চক মসজিদের সামনে একটি খোলা আঙিনা ছিল। সেই আঙিনাকে বাড়িয়ে এখন মসজিদের আয়তন আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। কেন্দ্রীয় প্রবেশ পথের সামনে চমৎকার নকশা শোভিত একটি অর্ধগম্বুজ ভল্ট রয়েছে। বর্তমানে, প্রতি বছর মাহে রমজানে নগরীর এই ঐতিহাসিক চক মসজিদে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের ঢল নামে। মসজিদ ছাড়িয়ে ছাদ, বারান্দা এমনকি সড়কেও ছড়িয়ে যায় মুসল্লিদের কাতার। শুক্রবার প্রবিত্র জুম্মার দিনে মসজিদের সামনের অলি-গলিতে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। জুম্মার আজানের আগে থেকেই মসজিদে যাওয়া শুরু হয় সব বয়সী মুসল্লিদের। খুতবা শুরুর অনেক আগেই ভরে যায় চক মসজিদের ভেতরের অংশ। ফলে বাইরে অতিরিক্ত বিছানা বিছিয়ে দিতে হয়। জায়নামাজ ছাড়াও পলিথিন, পত্রিকা বিছিয়েও চকবাজারের রাস্তায় জামায়াতে শরীক হন মুসল্লিরা।

মোঘল আমলের যেসব স্থাপনাশৈলী মানুষকে এখনো মুগ্ধ করে তার মধ্যে এই মসজিদটি অন্যতম৷ গায়ে ঢাকার ইতিহাস নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে সগৌরবে আজো দাঁড়িয়ে আছে শায়েস্তা খানের এই ঐতিহ্যবাহী ‘চকবাজার শাহী মসজিদ’৷


সংকলক: সুমাইয়া সুলতানা বুশরা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *