আমরা সকলেই কমবেশি এ’কথার সাথে অভ্যস্ত যে, ইসলামী সভ্যতায় চিকিৎসাশাস্ত্রের ইতিহাসে মুসলিম নারীদের অবদান খুব একটা নেই বললেই চলে। এমনকি অনেকেই মনে করেন, এই অঙ্গনে নারীদের তেমন কোনো ভূমিকা নেই। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে ইসলামী সভ্যতার স্বর্ণালী ইতিহাসে বৈশ্বিক ও ধর্মীয় যেকোনো ক্ষেত্রে মুসলিম নারীদের যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো, তেমন-ই স্বাস্থ্যখাতেও তাদের অবদান ছিলো অপরিসীম, যা আজ আমাদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এসকল তথ্য সমৃদ্ধ নির্ভরযোগ্য কোনো গ্রন্থ আমাদের কাছে সংরক্ষিত নেই বললেই চলে, যা-ও আছে তার অধিকাংশ উৎসই আবার আরবী ভাষায় থাকায় আরবী ভাষায় অনভিজ্ঞদের পক্ষে এ সম্বন্ধে অবগত হওয়াও ঢের কঠিন। যে কারণে এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের অধ্যয়নও করা হয়ে ওঠে না। এই প্রবন্ধে আমরা এ’ধরনের দৈন্য দৃষ্টিভঙ্গির মূলে কুঠারাঘাত করে সত্য উন্মোচনের চেষ্টা করবো।
ইসলামের ইতিহাসে চিকিৎসাশাস্ত্রের আবির্ভাব
ইসলামী সভ্যতার ১২শ বছরের স্বর্ণালী ইতিহাসে চিকিৎসাশাস্ত্রের বিশেষ তাৎপর্য থেকে একথার সাক্ষ্য দিতেই হবে- ইসলাম তার স্বকীয়তার আলোকেই মানব কল্যাণের অন্যান্য সকল শাখার সাথে চিকিৎসাশাস্ত্রেও সমান গুরুত্ব প্রদান করেছে। আল্লাহর রাসূল (স.) সব সময় সাহাবীদের অসুস্থতা ও রোগের জন্য চিকিৎসা গ্রহণের নির্দেশ দিতেন এবং এর গুরুত্বের উপর প্রয়োজনীয় দারসও প্রদান করতেন। যার অসংখ্য উপমা আমরা হাদীস গ্রন্থে লক্ষ্য করি।
হযরত উসামা ইবনে শারীক (রা.) হতে বর্ণিত, একদা রাসূল (স.)-এর নিকট একজন বেদুইন এসে বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, রোগাক্রান্ত হলে আমরা কি চিকিৎসা চাইব না?” নবী (স.) বললেন, “হ্যাঁ চাইবে। হে আল্লাহর বান্দারা, চিকিৎসা গ্রহণ করো। প্রকৃতপক্ষে, আল্লাহ একটি রোগ ব্যতীত সকল রোগের চিকিৎসা বা নিরাময় রেখেছেন। তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (স.), সেটা কী? নবী (স.) বললেন, “সেটা হলো বার্ধক্য।”
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (স.) বলেছেন, “যার যে বিষয়ে জ্ঞান আছে সে সেটাই জানে এবং সে বিষয় সম্পর্কে যে জানে না সে অজ্ঞই রয়ে যায়।”
এ থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়, স্বয়ং আল্লাহর রাসূল (স.) রোগ নিরাময়ের জন্য চিকিৎসা গ্রহণ এবং সংক্রমিত রোগের প্রতিষেধকের অনুসন্ধান করার নির্দেশ দিয়েছেন।
রাসূলুল্লাহ (স.)-এর জীবদ্দশায় অনেক মুসলিম নারী চিকিৎসক ছিলেন, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে যাদের অবদান ছিলো অপরিসীম। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে যারা তৎকালীন সময়ের ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করেছিলেন তারা নারীদের কৃতিত্বসমূহকে ইতিহাসের পাতায় অন্তর্ভুক্ত করেননি কিংবা করতে পারেননি। যার ফলস্বরূপ, সে সময়ের অধিকাংশ নারীদের এমন মূল্যবান অবদানগুলোর সাথে আমরা সুপরিচিত হতে পারিনি। এর চেয়েও ভয়াবহ বিষয় হলো- এ সময়ের ব্রিটিশ একাডেমিয়ার শিক্ষাধারা তো চিকিৎসা ক্ষেত্রে মুসলিম নারীদের অবদানকে বরাবর-ই অস্বীকার করে। ফলে, এ শিক্ষাধারার আদলে বেড়ে উঠা সন্তানদের জন্যও প্রকৃত সত্যের সন্ধান পাওয়া কষ্টকর।
মূলত আরবীতে গ্রীক গ্রন্থসমূহ অনুবাদে উৎসাহিত করার মাধ্যমে এবং পরবর্তীতে উমাইয়া ও আব্বাসী যুগে এই অনুবাদসমূহের সাথে নিজস্ব অভিজ্ঞতার সংযোজনের মাধ্যমে আমাদের সভ্যতার ইতিহাসে চিকিৎসাশাস্ত্রের অগ্রযাত্রার সূচনা ঘটে। যা পরবর্তী সময়ে ক্রমেই তরান্বিত হতে থাকে এবং সর্বোচ্চ অবস্থানেও পৌঁছে যায়।
গৃহ ও চিকিৎসালয়ে মুসলিম নারীদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান
ইসলামী সভ্যতার প্রারম্ভিক সময়কাল থেকেই মুসলিম নারীদের যেসব ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যায় তার মধ্যে অন্যতম হলো- চিকিৎসাশাস্ত্র। এর অসংখ্য নজীর সেই উমাইয়া শাসনামল থেকেই লক্ষণীয়। যেমন, ধারণা করা হয়, ‘রুফায়দার তাঁবু’ ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল (আধুনিক যুগে ব্যবহৃত সামরিক মোবাইল হাসপাতালের মতো)। এ সম্পর্কে পরবর্তীতে আরও বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
জানা যায়, আন্দালুসিয়ার বিখ্যাত চিকিৎসক Father of Modern Surgery হিসেবে খ্যাত আল-জাহরাভি তার চিকিৎসা কার্যে অনেকাংশেই ধাত্রীবিদ্যা ও স্ত্রীরোগবিদ্যা বিশেষজ্ঞদের (বর্তমানে যারা ধাত্রী হিসেবে পরিচিত) উপর নির্ভরশীল ছিলেন। প্রাথমিকভাবে, গাইনি চিকিৎসার ক্ষেত্রে মুসলিম নারীদের ব্যাপক উপস্থিতি থাকলেও খুব অল্প সময়ের ব্যবধানেই চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীগণ প্রবেশ করতে থাকেন। যার অন্যতম বড় দৃষ্টান্ত ফাতেমী সালতানাতের শিহাবুদ্দিন আল-সাইয়ের কন্যা ‘আল মানসুরী’ মিশরের সর্ববৃহৎ হাসপাতালে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও চিকিৎসক হিসেবে পদ লাভ করেন।
নারী চিকিৎসকগণ হাসপাতালের পাশাপাশি, রোগীদের বাড়িতে গিয়েও চিকিৎসা সেবা প্রদান করতেন। আত-তাবারী তাঁর বই ‘তারিখুর রাসূল ওয়াল মুলক’-এ বলেন, “একবার আবুল হাসান নামক একজন পুরুষ চিকিৎসকের নিকট একজন নারী রোগী কাঁধে সংক্রমিত ক্ষত নিয়ে চিকিৎসা চাইতে আসলে তিনি তাকে বলেছিলেন, “আমি একজন কাহাল (চক্ষু চিকিৎসক)। তবে আমাদের এখানে একজন নারী চিকিৎসক আছেন, যিনি আপনার এই ব্যাধির চিকিৎসা করতে পারবেন।”
অতঃপর তিনি সেই নারী চিকিৎসকের কাছ থেকেই চিকিৎসা গ্রহণ করেছিলেন। তাবারী সেই হাসপাতালকে (বিমারিস্তানে) একটি “জনস্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্র” বলে অভিহিত করেছেন। সে সময় যে সকল ধাত্রীগণ বাড়িতে গিয়ে স্বাস্থ্যসেবা দিতেন তাদের অবদানসমূহও বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। এ নিয়ে ইবনুল হজ্জ তাঁর “আল মাদখাল”- গ্রন্থে ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীর সময় কায়রোতে বসবাসরত মুসলিম নারীদের জীবন বর্ণনা করেন। এই গ্রন্থে তৎকালীন সময়ে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের পারিবার, সন্তান প্রসব এবং নবজাতকের দেখাশুনা করার জন্য ধাত্রী মায়েদের কীভাবে বাড়িতে এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী নারীগণের বিশেষত্ব
সে সময়ে নারী চিকিৎসকদের মাঝে প্রচলিত বিশেষত্বগুলো ছিলো : যুদ্ধাহত সৈনিকদের দেখাশোনা করা, ছোটখাটো শল্য চিকিৎসা থেকে শুরু করে অঙ্গচ্ছেদের মতো জটিল কিছু অস্ত্রোপচার করা। এমনকি ‘কাই’ (পোড়ানোর মাধ্যমে শরীরের কোনো অংশের ক্ষত বন্ধ করার পদ্ধতি) এবং “হিজামা” (রোগীর রোগ প্রতিরোধ করতে বা সারাতে নিয়ন্ত্রিত রক্তপাত করানোর পদ্ধতি) করাও তাদের সেবার অন্তর্ভুক্ত ছিলো। নারী চিকিৎসকগণ ক্ষত সারানো, রক্তপাত বন্ধ করা, ড্রেসিং করা এবং নিজেদের তৈরি ভেষজ মলম দিয়ে ব্যথা প্রশমিত করার কাজও করতেন।
ঔষধ তৈরির ক্ষেত্রেও নারীদের বিশেষ অবদান ছিলো। আত-তাবারী তাঁর বইতে আরও বলেছিলেন যে, নিজেদের তৈরি এন্টিসেপটিক মলম ব্যবহার করে তারা রোগীদের শরীরের ক্ষতস্থানের চিকিৎসা করতেন। বনি আউস গোত্রের জয়নব নামের একজন নারী চক্ষু চিকিৎসক এবং প্রাথমিক চিকিৎসার ঔষধ বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন বলে জানা যায়। শিফা বিনতে আবদুল্লাহ নিজ হাতে তৈরি মলম দিয়ে ত্বকের আলসারের চিকিৎসা করতেন। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) তাকে হুসবাহের (ঔষধ তৈরিসহ বাজারের বিভিন্ন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা) প্রধান হিসেবেও নিযুক্ত করেছিলেন।
তবে ইসলামের ইতিহাসে চিকিৎসা ক্ষেত্রে মুসলিম নারীদের অবদান প্রসঙ্গে ইংরেজি সাহিত্যে খুবই কম বর্ণনা আছে আর যতটুকু আছে তাও খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য। এখানে ইসলামের ইতিহাসে চিকিৎসাক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অবদান রাখা সেই সকল মহীয়সী নারী চিকিৎসকদের মধ্য থেকে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনকে তুলে ধরা হলো-
রুফায়দা আল আসলামিয়া (রা.)
ইতিহাস থেকে জানা যায়, হিজরতের পরে রুফায়দা আল আসলামিয়া (রা.) মদিনার মসজিদে নববীতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং রাসূল (স.)-এর সাথে বেশ কয়েকটি যুদ্ধেও যোগদান করেছিলেন। বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে আহত যোদ্ধাদের দেখাশোনার পাশাপাশি তাদের ক্ষতের চিকিৎসায়ও নিয়োজিত ছিলেন এই চিকিৎসক মহিলা সাহাবী। রুফায়দা (রা.) চিকিৎসা বিষয়ক অধিকাংশ জ্ঞানই তার বাবা সাদ আল-আসলামি (রা.)-এর নিকট হতে অর্জন করেছিলেন, তিনিও ছিলেন একজন পেশাদার চিকিৎসক। খন্দকের যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর সাথে সফরকালে চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রকার সরঞ্জামসহ তার একটি চিকিৎসা তাঁবু ছিলো। সাহাবী রুফাইদা আল আসলামিয়া (রা.)-ই ছিলেন ইসলামের ইতিহাসে যুদ্ধক্ষেত্রের ভ্রাম্যমাণ সামরিক চিকিৎসা কেন্দ্রের সর্বপ্রথম ভারপ্রাপ্ত চিকিৎসক এবং এই কেন্দ্রই ছিলো তার চিকিৎসা তাঁবু।
সহীহ বুখারীর এক হাদীস সূত্রে জানা যায়, নবী (স.)-এর অনুরোধে তিনি অন্য সাহাবীদের চিকিৎসা করার পাশাপাশি সাদ ইবনে মুয়াজ (রা.)-এর চিকিৎসাও করেছিলেন। এমনকি, তিনি সেই চিকিৎসা তাঁবুতে আহত সাদ ইবনে মুয়াজ (রা.)-এর বাহু থেকে একটি তীর অপসারণের মতো কঠিন অস্ত্রোপচারও একাই করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
খাইবার যুদ্ধের প্রাক্কালে রুফায়দাকে মদিনার মসজিদে নববীতে নাগরিক চিকিৎসা তাঁবু স্থাপনের অনুমতিও দেওয়া হয়েছিলো। সেখানে পালাক্রমে কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবিকা সাদ ইবনে মুয়াজ (রা.)-এর দেখাশোনা করার কাজে তাকে সাহায্য করতেন। খাইবার যুদ্ধের পূর্বে তিনি কিছু নারী সাহাবাদের প্রাথমিক চিকিৎসা ও নার্সিং-এর উপর প্রশিক্ষণও দিয়েছিলেন। সে সকল সেবিকাগণ তাকে চিকিৎসা তাঁবু পরিচালনা এবং আহত মানুষদের দেখাশোনা করতে দিনে রাতে পালাক্রমে সাহায্য করতেন। এ ঘটনার মাধ্যমে রাসূল (স.)-এর সময় একটি মসজিদকে কীভাবে চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিলো আমরা তারও একটি জলজ্যান্ত নজীর পাই । এই নজীরই বর্তমান সময়ে কিছু মসজিদকে কোভিড-১৯ নিরাময়, পুনর্বাসন এবং ভ্যাকসিন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করেছে যা ইতোমধ্যে বিজ্ঞ ব্যক্তিদের দ্বারা ব্যাপক প্রশংসিতও হয়েছে।
যুদ্ধের সময় মহিলা সাহাবী রুফায়দা আল আসলামিয়া (রা.)-এর অবদানসমূহ পর্যবেক্ষণ করে রাসূলুল্লাহ (স.) তাকে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন যোদ্ধার সমতুল্য (গানায়েম) বলে গণ্য করেছিলেন। তিনি যেমন যুদ্ধহীন সময়ে মানুষের চিকিৎসা করেছেন তেমনি যুদ্ধকালীন সময়েও করেছেন। রুফায়দা (রা.)-কে স্নেহময়ী, সহানুভূতিশীল সেবিকা এবং একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবেও বর্ণনা করা হয়েছে। চিকিৎসাশাস্ত্রে তার দক্ষতা কাজে লাগিয়ে তিনি অন্যান্য নারীদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য প্রশিক্ষণ দিতেন। এর পাশাপাশি তিনি একজন সমাজকর্মী হিসেবেও কাজ করতেন, তিনি বিভিন্ন রোগ সংক্রান্ত নানাবিধ সামাজিক সমস্যা সমাধানে দীর্ঘ সময় ধরে বিশেষ ভূমিকা পালন করে গেছেন। এছাড়াও, দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত শিশুদের সহায়তার পাশাপাশি তিনি ছিলেন অনাথ, এতিম ও অক্ষম প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি বিশেষ যত্নশীল এক নারী।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, রুফায়দা (রা.)-এর কাছে থেকে নবী আকরাম (স.)-এর কিছু হাদীস জানা যায় যা বুখারী, আবু দাউদ ও নাসায়ী কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। প্রখ্যাত এ সাহাবীর মৃত্যুর পর তার নামে অসংখ্য রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্থানের নামকরণ করা হয়। পরবর্তীতে যা নতুন প্রজন্মের নারীদেরও এই খাতে কাজ করতে ভীষণভাবে উদ্বুদ্ধ করে। উল্লেখ্য, বর্তমানেও আয়ারল্যান্ডের রয়েল কলেজ অব সার্জন্স ও বাহরাইন বিশ্ববিদ্যালয় সম্মিলিতভাবে প্রতি বছর মেধাবী শিক্ষার্থীদের ‘রুফায়দা পদক’ নামে ব্যয়বহুল এক পদক দিয়ে থাকে।
আশ-শিফা (রা.)
আশ-শিফা বিনতে আবদুল্লাহ আল-কুরাশিয়া আল-আদাবিয়া ছিলেন সেই সময়ের অন্যতম একজন নারী সাহাবী ও জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব। ইসলামী সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই তার দৃঢ় উপস্থিতি ছিলো বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সেই নিরক্ষরতার যুগেও তিনি ছিলেন শিক্ষিত। এমনকি রাসূলুল্লাহ (স.)-এর সময়কালে তিনিই ছিলেন প্রথম নারী শিক্ষক। অর্থ্যাৎ ইসলামের ইতিহাসের তিনি প্রথম নারী শিক্ষক।
প্রখ্যাত এই মহিলা সাহাবী জনপ্রশাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার পাশাপাশি চিকিৎসাশাস্ত্রেও ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। তার আসল নাম লায়লা, তবে চিকিৎসাশাস্ত্রে তার অসাধারণ জ্ঞান এবং দক্ষতার কারণে তাকে আশ-শিফা (নিরাময়) নামে অভিহিত করা হতো। একজন স্বাস্থ্য সেবিকা ও চিকিৎসক হওয়ার কারণে বলা যায় এই নামটি আংশিকভাবে তার পেশা থেকেই উদ্ভূত হয়েছে। আশ-শিফা পিঁপড়ার কামড়ের জন্য প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। পরবর্তীতে স্বয়ং আল্লাহর রাসূল (স.) তার এই চিকিৎসা পদ্ধতিকে অনুমোদন দেন এবং আশ-শিফার প্রতি অন্যান্য মুসলিম নারীদেরকেও এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়ার অনুরোধ করেন। তিনি ভাল পড়তে ও লিখতে পারতেন এবং হাফসা বিনতে ওমর (রা.)-কে (রাসূল (স.)-এর স্ত্রী) লেখালেখির কাজ শেখানোর পাশাপাশি চর্মরোগ বিষয়ক চিকিৎসার প্রশিক্ষণও দিয়েছিলেন এই প্রখ্যাত নারী চিকিৎসক। আলসারের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন চর্মরোগ, একজিমার অনুরূপ রোগসমূহ এবং পিঁপড়ার কামড় সংক্রান্ত সমস্যা থেকে নিরাময়ের চিকিৎসার জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন। হযরত উমর (রা.) তাকে মদিনার একজন বাজার পরিদর্শক হিসেবেও নিয়োজিত করেছিলেন। এই ধরনের সরকারি পদে তিনিই ছিলেন প্রথম মুসলিম নারী, যার পদমর্যাদা ছিলো স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা কর্মকর্তার পদের অনুরূপ। আশ-শিফা নবী (স.)-এর ১২টি হাদীস বর্ণনা করেছিলেন। তিনি ৬৪১ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।
নুসায়বা (রা.)
নুসায়বা বিনতে হারিস আল-আনসারী (রা.) (উম্মে আতিয়্যা আল- আনসারিয়া) ইসলাম গ্রহণের আগে ও পরে উভয় পর্যায়েই চিকিৎসাশাস্ত্রের চর্চা করেছেন। তিনি রাসূল (স.)-এর উৎসাহে অসংখ্য খতনার কাজও করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (স.)-এর স্ত্রীদের সাথে তার সুসম্পর্ক বজায় থাকায় নিয়মিত তাদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ এবং উপহার বিনিময় করতেন নুসায়বা বিনতে হারিস। তিনি ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে আহতদের প্রতি বিশেষ যত্নশীল এক নারী। পাশাপাশি যোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ ও প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা প্রদানেও তিনি নিয়োজিত থাকতেন। প্রখ্যাত এই মহিলা সাহাবী সর্বমোট সাতটি যুদ্ধে সশরীরে রাসূল (স.)-এর নির্দেশে সক্রিয়ভাবে যোগদান করেন। এছাড়াও, নবী (স.)-এর কন্যা জয়নব (রা.)-এর মৃত্যুর পর তাঁকে গোসলের মাধ্যমে পবিত্র করা থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সকল কাজ তিনি নিজ হাতে আঞ্জাম দেন।
উল্লেখ্য, প্রখ্যাত এই মহিলা সাহাবী কর্তৃক হাদীস বর্ণিত হয়েছে প্রায় অর্ধশত। যার বড় একটি অংশের অবস্থান রয়েছে সহীহ বুখারী ও মুসলিম জুড়ে। তার বর্ণিত হাদীসসমূহের মধ্যে একটি হাদীস ছিলো নারীদের ঈদের জামায়াতে অংশগ্রহণ সম্পর্কিত যা সহীহ আল বুখারীসহ গুরুত্বপূর্ণ আরও বেশ কিছু গ্রন্থে বর্ণিত আছে। প্রসিদ্ধ এই মহিলা সাহাবী তার জীবনের শেষ সময়টি অতিবাহিত করেছিলেন ইরাকের বসরায় এবং সেখানেই তিনি ইন্তেকাল করেন।
নুসায়বা বিনতে কাব আল মাজিনিয়াত (রা.) (উম্মে উমারা)
নুসায়বা ছিলেন শুরুর দিকে ইসলাম গ্রহণকারী নারীদের মধ্যে অন্যতম। হিজরতের পূর্বে রাসূল (স.)-এর সাথে সাক্ষাতের জন্য মদিনা থেকে মক্কা
ভ্রমণের পরপর তিনি মুসয়াব ইবনে উমাইর (রা.)-এর সাথে চুক্তিতে (আকাবার শপথ) অংশ নিয়েছিলেন। রাসূল (স.) মদিনায় হিজরত করার সময় যারা তাকে পূর্ণ সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, নুসায়বা ছিলেন তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম নারী সাহাবী। উম্মে উমারা উহুদের যুদ্ধে আহত যোদ্ধাদের সহায়তাসহ পরবর্তী সকল যুদ্ধেই তিনি সেবার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। শুধু তাই নয়, যুদ্ধের সময় রাসূল (স.)-কে রক্ষার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছেন প্রখ্যাত এই সাহাবী। বর্ণিত আছে, রাসূল (স.) বলেছিলেন- যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি যখনই ডানে বা বামে তাকাতেন, দেখতেন নিজ গর্দানে আঘাত না পাওয়া পর্যন্ত তাকে রক্ষার জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন উম্মে উমারা। এমনকি যুদ্ধ শেষে নিজে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও আহত সহযোদ্ধাদের দেখাশুনা ও চিকিৎসা সেবা দেয়া অব্যাহত রাখা ছিলো তার অসাধারণ গুণাবলির মধ্যে অন্যতম। জানা যায়, তিনি একজন বলিষ্ঠ যোদ্ধা ছিলেন বিধায় মুসাইলামার বিরুদ্ধে সংগঠিত যুদ্ধে যোগদান করেছিলেন (প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.)- এর সময়), সেই যুদ্ধে তার একটি হাত গুরুতরভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলো এবং পরবর্তীতে তা কেটে ফেলতে হয়। সেসময় তিনি মদিনায় ফিরে এসে নিজেই নিজের চিকিৎসা করেছিলেন।
উম্মে সিনান আল ইসলামিয়া (রা.)
যারা রাসুল (স.)-এর নিকট যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়া, আহত সৈন্যদের সাহায্য করা এবং তৃষ্ণার্তদের পানি সরবরাহ করার জন্য অনুমতি চেয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন সাহাবী ছিলেন উম্মে সিনান। খাইবারের যুদ্ধে তিনি রাসূল (স.)-এর সাথে যোগদান করেছিলেন এবং সর্বদা আহত সাহাবীদের চিকিৎসার কাজে নিয়জিত ছিলেন।
উম্মে ওয়ারাকা বিনতে আবদুল্লাহ ইবনুল হারিস আল-আনসারিয়া (রা.)
উম্মে ওয়ারাকা আহতদের সেবা প্রদানের কাজে সহায়তা করতেন। তিনি কোরআন সংকলনের কাজেও অংশ নিয়েছিলেন এবং রাসূল (স.)-এর অনুমতিক্রমে নিজ বাড়িকে একটি ছোট মসজিদে রূপান্তর করেছিলেন। রাসূল (স.) তাকে উদ্দেশ্য করে সাহাবীদের ডেকে বলতেন, আসুন আমরা শহীদ নারীর সাথে দেখা করতে যাই। তাই তিনি জীবিত শহীদ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। রাসূল (স.) বলেছিলেন, তাকে হত্যা করা হবে এবং পরবর্তীতে এ কথাই সত্যি হয়। হযরত উমর (রা.)-এর সময়কালে তার চাকরের হাতে তিনি প্রাণ হারান।
আর-রাবি বিনতে মুয়াজ (রা.)
রাসুল (স.)-এর জীবদ্দশায় জীবিত সাহাবীগণের মধ্যে যারা অল্প সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করেছিলেন, আর-রাবি বিনতে মুয়াজ (রা.) ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। তাঁর বর্ণিত হাদীসগুলো ছিলো আল্লাহর রাসূল (স.)-এর ওজু করার পদ্ধতি নিয়ে। তিনি ছিলেন হিজরতের ষষ্ঠ বছরে বাইয়াতুর রিদওয়ানে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদের মধ্যে একজন। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি আহতদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে সহায়তা করতেন। ৬৬৫ খ্রিষ্টাব্দে হযরত মুয়াবিয়া (রা)- এর সময় আর-রাবি বিনতে মুয়াজ (রা.) ইন্তেকাল করেন।
রাসূল (স.)-এর সময় আরও অনেক নারী সাহাবী মুসলিম বাহিনীর আহত যোদ্ধাদের ক্ষত ড্রেসিং (ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে ঔষধ দিয়ে ব্যান্ডেজ করা), স্পিন্ট (ভেঙে যাওয়া কোনো অঙ্গকে সর্বদা এক অবস্থায় স্থির রাখতে শক্ত বস্তুর সাথে ব্যান্ডেজ করার পদ্ধতি) ও ব্যথা প্রশমনের জন্য প্রয়োজনীয় ভেষজ সামগ্রী সরবরাহ করে সাহায্য করতেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন :-
★ উম্মে হাকাম আল-মাখজুমিয়াহ (রা.)।
★ উম্মে মুসা ইবনে নুসাইর (রা.)।
★ সাফিয়াহ বিনতে খাত্তাব (রা.)।
★ আয়েশা (রা.) (নবী (স.)-এর স্ত্রী)।
★ উম্মে আয়মান (রা.) (বারাকা বিনতে সালাবা)।
★ উম্মে সেলিম (রা.) (আনাস ইবনে মালিকের মা)।
★ উমাইয়া বিনতে কায়স আল গাফেরিয়াহ (রা.)।
★ লায়লা আল-গাফেরিয়াহ (রা.)।
★ মুআযা আল-গাফারিয়াহ (রা.)।
★ উম্মে আল-উলা আল-আনসারিয়া (রা.)।
★ সালমা (রা.) (উম্মে রাফে):
সালমা (রা.) তার স্বামীর সাথে রাসূল (স.) ও তার ঘর-বাড়ির দেখাশোনা করতেন। মক্কায় হযরত খাদিজা (রা.)-এর সন্তান প্রসবকালেও তিনি সেবিকা হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
হামনা বিনতে জাহাশ (রা.)
হামনা বিনতে জাহাশ (রা.) (জয়নব (রা.)-এর বোন ও মহানবী (স.)-এর স্ত্রী) তৃষ্ণার্তদের পানির যোগান দিয়ে, আহতদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা প্রদানের মাধ্যমে উহুদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
জয়নব বিনতে আলী (রা.)
জয়নব (রা.) ছিলেন রাসূল (স.)-এর নাতনী। আহতদের চিকিৎসা সেবা প্রদান, যুদ্ধের ময়দানে বিপুল সাহসিকতা ও দক্ষতার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন জয়নব বিনতে আলী। ইরানে জয়নবের কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে তার অবদানসমূহের স্মরণে প্রতি বছর সেবিকা দিবস (Nurse Day) উদযাপন করা হয়। ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, জয়নব তার ভাই হোসাইন (রা.)-এর সাথে কুফায় গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে হোসাইন (র,) উমাইয়া খলিফাকে কারবালার যুদ্ধে আহবান করেন এবং ৬৮০ সালে যুদ্ধে পরাজিত হন। তিনি কারবালার যুদ্ধে ইয়াজিদ ও তাঁর পুত্র মুয়াবিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় আটক হয়েছিলেন। সেখানে তিনি এমন উদ্বেলিত ভাষণ দিয়েছিলেন যা শুনে ইয়াজিদ তাকেসহ অন্যান্য বন্দীদের মুক্তি দেয়ার আদেশ দিয়েছিলো।
উমাইয়া আমলে বিখ্যাত নারী চিকিৎসকগণ
বনী আউস গোত্রের জয়নব চোখের চিকিৎসার পাশাপাশি অস্ত্রোপচারের জন্যও বিখ্যাত ছিলেন। আবু আল-ফারাজ আল ইস্পাহানী তার বিখ্যাত গ্রন্থ “আল-আগানি”-তে তাকে উদ্দেশ্য করে চমৎকার একটি কবিতায় লিখেছিলেন,
طبيب بني أود على النأي زينبا أمخترمي ريب المنون ولم أزر
★ ফরিদা আল-কুবরা হেজাজ অঞ্চল ছেড়ে সিরিয়ায় গমন করেছিলেন।
★ খারকা আল-আমিরিয়া হেজাজ অঞ্চলে বসবাস করতেন এবং সেখানেই চিকিৎসাশাস্ত্র চর্চা করতেন।
★ সালামা আল কিসাস উমাইয়া আমলে হেজাজ অঞ্চল ছেড়ে সিরিয়ায় বসবাস করতে চলে আসেন।
★ হোবাবা ইরাকের আল-বাসরাহ শহরে বাস করতেন এবং সেখানেই চিকিৎসাশাস্ত্র চর্চা করতেন। সেখানে ৭২৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন।
আব্বাসীয় শাসনামলের কয়েকজন উল্লেখ্য নারী চিকিৎসকগণ
★ মোতায়েম আল-হামিশিয়া নবম শতাব্দীতে চিকিৎসাশাস্ত্র চর্চা করতেন এবং ৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।
★ রোহাস, তিনি বাগদাদে বসবাস করতেন এবং ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।
★ মাহবুবা, তিনি আব্বাসীয় খেলাফতকালে ৮৬১ খ্রিস্টাব্দে ইরাকে ইন্তেকাল করেন।
★ উম্মে আসিয়া (একজন ধাত্রী), টলোনিয়ার রাজত্বকালে তিনি মিশরে বসবাস করতেন।
আন্দালুসিয়ায় (বর্তমান স্পেন) মুসলিম শাসনামলে চিকিৎসা খাতে অবদান রাখা কয়েকজন নারী
আল-হাফিজ ইবনে জোহরের বোন (ইবনে জোহরের নাতি) এবং তার দুই কন্যা প্রসূতিবিদ্যা ও ধাত্রীবিদ্যা চর্চা করতেন এবং অসুস্থ শিশুদের চিকিৎসা সেবা দিতেন। তারা উভয়েই আন্দালুসের শাসক আল-মনসুরের স্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন। আন্দালুসে পাঁচ প্রজন্ম যাবৎ ইবনে জোহরের পরিবারের বেশ কয়েকজন চিকিৎসক কাজ করে গেছেন।
আজ-জাহরাবির কন্যারা তাদের পিতার সাহায্যে চিকিৎসাবিদ্যায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। চিকিৎসাশাস্ত্র চর্চার জন্য তারাও সুপরিচিত ছিলেন। আজ- জাহরাবি তার চিকিৎসা বিষয়ক জ্ঞানকোষ ‘আত-তাসরিফ’ এর ৩০ তম খণ্ডে ১০টি অধ্যায় জুড়ে দাতব্য ও প্রসূতিবিদ্যায় অস্ত্রোপচার সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন।
উম্মুল হাসান বিনতে কাজী আত-তানজালী
চতুর্দশ শতাব্দীতে তিনি আন্দালুসে বসবাস করতেন এবং চিকিৎসা চর্চার পাশাপাশি মানুষকে এ বিষয়ে শিক্ষাদানের জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন। তিনি একজন জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। মানুষকে মহাগ্রন্থ আল কুরআনের তাজবীদ শিক্ষা দেয়ার কাজেও তার ছিলো অসামান্য অবদান। তার লেখা কবিতা থেকে সহজেই বুঝা যায় যে, তিনি বই লেখার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না।
দামেস্কের (বর্তমান সিরিয়া) নারী চিকিৎসক
বিনতে দুহান আল-লুজ (দোহান আল-লুজ নামেও পরিচিত), চিকিৎসাশাস্ত্রের অত্যন্ত দক্ষ একজন নারী ছিলেন। তিনি দামেস্কের একজন প্রখ্যাত আলেমাও ছিলেন। ১২১৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন।
সপ্তদশ শতাব্দীতে মিশরের কয়েকজন নারী চিকিৎসক
বিনতে শাহাবুদ্দিন ইবনে সায়েগ ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দে তার বাবার মৃত্যুর পরপর চিকিৎসাশাস্ত্রের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে মিশরের কায়রোর আল মনসুরি বিমারস্থানে তিনি প্রধান চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করেন। তৎকালীন সময়ে দেশটির সবচেয়ে বড় হাসপাতাল পরিচালনার কার্যসমূহও ছিল তার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।
পঞ্চদশ শতকে তুরস্কের নারী শল্যচিকিৎসক
ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকেই চিকিৎসাক্ষেত্রে যে সকল নারীরা অবদান রেখেছেন তন্মধ্যে কেবলমাত্র অল্প কয়েকজনের অবদান লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। চিকিৎসাশাস্ত্রের ইতিহাস বিষয়ক নথিপত্র নিখুঁতভাবে পর্যালোচনা করলে তৎকালীন সময়ের এ সকল নারীদের জীবন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ও তথ্য পাওয়া যাবে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে, একজন তুর্কি শল্যচিকিৎসক, সেরেফেদ্দিন সাবুনকুওগলু (১৩৮৫-১৪৬৮) অস্ত্রোপচারের নির্দেশনামূলক বিখ্যাত বই ‘সেররাহিইয়েতু-হানিইয়ে’-তে ধাত্রীবিদ্যা ও স্ত্রীরোগ চিকিৎসার বিভিন্ন প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে বা নারী রোগীদের চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রক্রিয়ার চিত্র তুলে ধরতে দ্বিধাবোধ করেননি। যে সময়ে পশ্চিমে কর্মরত তার পুরুষ সহকর্মীরা নারী চিকিৎসকদের বিরোধিতা করতো, সেই সময়ে সেরেফেদ্দিন সাবুনকুওগলু অনেক নারী শল্যচিকিৎসকদের সাথে কাজ করে গেছেন।
আনাতোলিয়ায় নারী শল্যচিকিৎসকগণ সাধারণত ক্লিটোরিসে (স্ত্রী জননেন্দ্রিয়ের অংশ বিশেষ) অনিয়ন্ত্রিত মাংশের বৃদ্ধির জন্য অস্ত্রোপচার, নিশ্ছিদ্র জননেন্দ্রিয়, জননেন্দ্রিয়ে আঁচিল ও লাল ফুসকুড়ি, জরায়ুতে ছিদ্র বা জরায়ু ফেটে যাওয়া, অস্বাভাবিক প্রসব যন্ত্রণা এবং অস্বাভাবিক ভ্রুণ ও অমরা অপ্রসারণ এর মতো বেশ কিছু স্ত্রীরোগ সংক্রান্ত চিকিৎসা প্রক্রিয়া পরিচালনা করতেন। ‘সেররাহিইয়েতু-হানিইয়ে’-তে ক্ষুদ্রকায় চিত্র দ্বারা নারী শল্যচিকিৎসকদের চিত্রায়িত করা হয়েছে, যা ভ্রূণীয় হাইড্রোসেফালাস ও ম্যাক্রোসেফালাসের মতো শিশুদের নিউরোসার্জিক্যাল রোগের চিকিৎসা প্রদানকারী নারী শল্যচিকিৎসকদের প্রাথমিক স্বীকৃতিরই একটি প্রতিফলন। চিকিৎসাশাস্ত্রের ইতিহাসে নারীদের প্রতি যে সাধারণ মনোভাব ও আচরণ বিদ্যামান ছিলো তা সে সময়ের নারীদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিচ্ছবি। একটি চমৎকার বিষয় হলো, সেরেফেদ্দিন সাবুনকুওগলু তার একেবারেই আগ্রহী ছিলেন না। তিনি আরবীতে একটি কবিতা লিখেন, যাতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, “লেখকেরা লেখেন আর কাজের মানুষ কাজ করেন।” অর্থাৎ তিনি কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলেন যে লেখালেখির জন্য সময়ই পেতেন না।
অতএব এটি স্পষ্ট যে, মুসলিম নারী চিকিৎসকদের শত শত বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে, যা পাশ্চাত্যের কল্পনারও অতীত। এই নারী চিকিৎসকদের নানা অনুসন্ধান ও উদ্ভাবন থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। কিন্তু তাদের অবদানগুলোকে জেনে, উপলব্ধি করে সঠিক মূল্যায়ন করতে হলে আমাদের এই বিষয়ে প্রচুর অধ্যয়ন ও জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
অনুবাদিকা : শালিমার জোহা
তথ্যসূত্র: https://muslimheritage.com/muslim-female-physicians/