শিউলিমালা একাডেমি

জ্ঞানের আখলাক

একটি সভ্যতা কেমন? ঠিক কেন এমন? কিংবা বর্তমানে আমরা যে ব্যবস্থাপনার অধীনে জীবনযাপন করছি সেটি কেমন এবং কেন এমন?— এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব পেতে আমাদের আরও একটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করতে হবে, সেটি হলো: আমরা যেই সভ্যতা সম্পর্কে জানতে চাই সেই সভ্যতায় জ্ঞান কীভাবে ক্রিয়াশীল ছিল। একই প্রশ্ন বর্তমান জীবনধারার স্বরূপ উদঘাটনের ক্ষেত্রেও উপযোগী।

বলা চলে, জ্ঞান, মানব সভ্যতার ফুসফুস স্থানীয় একটি উপাদান। ইসলামী সভ্যতারও অন্যতম মূল ভিত্তি হলো জ্ঞান।  রাসুল সা. এর উপর নাজিলকৃত প্রথম বার্তা, ‘ইকরা’ বা পড়ুন।  মানুষ আল্লার অস্তিত্বকে উপলব্ধি করে জ্ঞানের মাধ্যমে, মানুষ নিজের অস্তিত্বকেও উপলব্ধি করে এই জ্ঞানের মাধ্যমে এমনকি একজন মানুষ তার পারিপার্শ্বিকতার সাথেও নিজেকে সম্পৃক্ত করে জ্ঞানের মাধ্যমে। এজন্য কোনো ব্যক্তি কোনো কারণে চেতনা হারালে বা বেহুশ হলে আমরা বলি মানুষটি অজ্ঞান হয়ে গেছে, অর্থাৎ সে জ্ঞান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

জ্ঞান কী? জ্ঞান ও আখলাকের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত? সেই সাথে এই বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা সঙ্গত যে, জ্ঞান যখন আখালাকের সাথে সংযুক্ত থাকে তখন জ্ঞানের তৎপরতা কেমন হয়?  আবার জ্ঞান যখন আখলাকের থেকে বিযুক্ত থাকে তখন  মানব সভ্যতায় জ্ঞান  কীভাবে সক্রিয় থাকে?

জ্ঞান কী? এই প্রশ্নের জবাব অনেকে অনেকভাবে দিয়ে থাকেন। জবাব ভিন্ন ভিন্ন হলেও জবাবটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ,  জ্ঞান কী? এই প্রশ্নের জবাব কীভাবে দেওয়া হচ্ছে,  তার উপর একটি সভ্যতার সমস্ত মানুষের ভাগ্য নির্ভর করে। শুধু মানুষ না, সমগ্র প্রকৃতির নিয়তির গতিপথ নির্ধারণ করে জ্ঞানের সংজ্ঞায়ণ প্রক্রিয়া।

ইসলামী চিন্তা ও দর্শনে, ইসলামী সভ্যতাতে জ্ঞান হলো: হাকীকতে পৌঁছানোর পদ্ধতি।  জ্ঞান হলো,  সত্যকে জানা, আল্লাহকে জানা। আমরা মুসলমানেরা এমন এক চিন্তা ধারার সন্তান,  যেখানে জ্ঞান শুধু জ্ঞান না, একই সাথে আখলাক ও দায়িত্বের অনুসন্ধান।  জ্ঞানকে আখলাক তথা, উৎকৃষ্টসব মূল্যবোধের সমানিপাতিক মনে করা হয়েছে। অর্থাৎ একজন মানুষ যতটা জ্ঞানী ততটাই আখলাক সম্পন্ন এবং ততটাই দায়িত্ববান।

আমরা পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকালে লক্ষ্য করবো, ইসলামী সভ্যতা জ্ঞানকে যতটা  প্রাধান্য দিয়েছে অন্য কোনো সভ্যতা ততটা প্রাধান্য দিতে পারেনি। ইসলামের চিন্তা ও দর্শনের অন্যতম সহায়ক হলো, ঈমান বা বিশ্বাস। মুসলমানদেরকে এমন কিছু বিষয় বিশ্বাস স্থাপন করতে হয় যা তারা প্রত্যক্ষ করে না, যেমন: পরকাল। এসব বিশ্বাস মানুষকে  চাক্ষুস বিষয়ের বাইরে চিন্তা করার দূরদর্শিতা শেখায়। একই সাথে জ্ঞান অর্জনের পদ্ধতির ক্ষেত্রে একজন জ্ঞান অর্জনকারীকে ইসলাম সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ সামনে রাখার শর্ত দেয়। সেক্ষেত্রে একজন জ্ঞানানুরাগীকে তার জ্ঞান তহবিলে  পাঁচটি বিষয়ে বুনিয়াদি জ্ঞানের মজুদ রাখতে হয়। বিষয়গুলো হলো:  সৃষ্টিতত্ত্ব, জ্ঞান, মানুষ,  সৃষ্টিজগত ও মূল্যবোধ। জ্ঞান অর্জনকারী যে বিষয়েই বিশেষজ্ঞ হতে চান না কেন, তাকে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে।  যেহেতু এই বিষয়সমূহ মানুষ ও মানুষের সাথে প্রাসঙ্গিক সমস্ত দিককে পরিবেষ্টিত  করে তাই একজন বিশেষজ্ঞ তার সেই বিশেষ ক্ষেত্র থেকে হাকিকত তথা সত্যেকে সত্যিকার অর্থেই খুঁজে আনতে পারেন। বলাবাহুল্য  গবেষণার অন্বেষণটাও  যথাযথ হয়।

উপরোক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে জ্ঞান বিষয়টা যথেষ্ট কৌতূহল উদ্দীপক কারণ স্বয়ং জ্ঞানের ক্ষেত্রে কী জ্ঞান আবশ্যক কেন, এ প্রশ্ন হাজির হওয়াটা অস্বাভাবিক না। মূলত জ্ঞানের ক্ষেত্রে জ্ঞান বিষয়টা আমাদের জ্ঞানী সনাক্তকরণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় মানদণ্ডসমূহের যোগান দেয়। মানুষ শিক্ষা গ্রহনের প্রক্রিয়াতে জ্ঞানী হয় সেক্ষেত্রে  আমরা সাধারণ জ্ঞানের উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতির ভিত্তিতে মানুষকে জ্ঞানী ও মূখ্য হিসেবে বিভক্ত করি। একজন মানুষকে শিক্ষিত তকমা দিতে, আমাদের মানসপটে কোনো শিক্ষকের অধিনে শিক্ষা গ্রহণ বা শ্রেণিকক্ষের চিত্র পটভূমিতে আবির্ভূত হয়। এছাড়া সামাজিক পরিমণ্ডলে কোন প্রতিষ্ঠানের দর কেমন, তার ওপরও  মানুষের জ্ঞানের মাত্রাগত মাপজোখ করা হয়। যিনি যত নামি-দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যায়ণ করবেন তিনি তত জ্ঞানী—এমন ধারণা আমাদের প্রায় প্রত্যেকের চেতনায় গেঁথে আছে।  বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রেক্ষিতে বললে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রোকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো কিছু প্রতিষ্ঠানকে জ্ঞানী উৎপাদনের একচ্ছত্র কারখানা মনে করা হয়। এরপর দরের দিক থেকে নিচের দিকে নামবে পণ্যের মান তত কমবে। ফলে কিছু মানুষ পর্যাপ্ত জ্ঞান না রেখেও নিজেদের মহাজ্ঞানীর অভিমানে আচ্ছন্ন করে রাখেন আবার কিছু মানুষ হীনমন্যতায় নিজেদের বানের জলে নিক্ষেপ করেন। অথচ মানুষকে শিক্ষিত বা জ্ঞানী করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই একমাত্র অবলম্বন নয়। আল্লাহ তায়া’লা মানুষকে জন্মগতভাবেই মৌলিক কিছু জ্ঞান নিয়ামত স্বরূপ দান করেছেন। এ জ্ঞানেই একজন নবজাতক জন্মের পর পরই মায়ের দুধ খোঁজে। এছাড়া প্রকৃতি-জগৎ এবং এর ক্রিয়াকলাপের উপলব্ধিও জ্ঞানের অন্যতম উৎস। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ মূলত জ্ঞানের এসব উৎস থেকেই  বিশেষ পদ্ধতিতে জ্ঞানকে বিতরণ করে থাকে।

ইসলাম যে তিনটি বিষয়ে বিপ্লব সাধন করে পৃথিবীকে আদালত পূর্ণ একটি সভ্যতা উপহার দিয়েছিলো,  তার দুটি বিষয় হলো, আখলাক ও জ্ঞান। মূলত জ্ঞান ও আখলাকের মেলবন্ধনের মাধ্যমে দায়িত্বশীল জ্ঞানী শ্রেণির হাত ধরে ইসলামী সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো। ইসলামের চমকপ্রদ দিক হচ্ছে, এটি শুধু জ্ঞানকে অধিক প্রাধান্যই দেয়নি একই সাথে জ্ঞান, আখলাক এবং দায়িত্বের তাগিদকে পরস্পরের সাথে এমনভাবে যুক্ত করেছে যে এদের হ্রাস বৃদ্ধি সমান্তরাল হবে। জ্ঞানের সাথে আখলাকের সম্পৃক্ততা, মানবজাতি এবং সমগ্র প্রকৃতি জগতের কল্যাণের জন্য কতটা আবশ্যক সে বিষয়টি আমরা ইসলামী সভ্যতার সময়ে যেমন উপলব্ধি করেছি, বর্তমান সময়ে এসে ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে তা আরো অনেক বেশি উপলব্ধি করতে পারছি। ইসলামী সভ্যতায় জ্ঞানের ধারণা এবং জ্ঞান ও আখলাকের সমন্বয় ঠিক কেমন হওয়া উচিত, তা আমরা আরো স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করছি, বর্তমান পশ্চিমা দুনিয়ায় জ্ঞানের সাথে আখলাকের সম্পর্ক বিচ্ছিন্নতার মধ্য দিয়ে।

পশ্চিমা সভ্যতায় জ্ঞানকে সংজ্ঞায়িত করা হয় ‘শক্তি’ হিসেবে। নলেজ ইজ পাওয়ার অর্থাৎ জ্ঞান হলো শক্তি— এটিই  জ্ঞান সম্পর্কে পশ্চিমা সভ্যতার মৌলিক ধারণা। একজন মানুষ যত বেশি জ্ঞানী তত বেশি শক্তিশালী। একজন মানুষ যত বেশি  জ্ঞানী তত বেশি মানুষ  ও প্রকৃতির ওপর শক্তি প্রয়োগের সামর্থ রাখে, অর্থাৎ যত বেশি জ্ঞানী তত বেশি জুলুম করার ক্ষমতা রাখে। এখানে জ্ঞান জুলুম সমান্তরাল।

দুঃখজনক বিষয় হলো, অন্যান্য বিষয়ের মতো জ্ঞানের ক্ষেত্রেও পশ্চিমা সভ্যতার অবস্থান, বস্তুবাদী। দৃশ্যমান জগতের মধ্যে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আবদ্ধ। আল্লাহর অস্তিত্ব, মানুষের রুহের অস্তিত্ব এবং  পরকালীন অস্তিত্ব— সবক্ষেত্রেই নেতিবাচক অবস্থান তাদের। আখলাক, নীতি-নৈতিকতা বিযুক্ত এ শিক্ষা পদ্ধতি মানুষকে অর্থ উপার্জনের যন্ত্র হিসেবে গঠন করে। ফলে অর্থের খাতিরে যেকোনো কাজই জায়েজ!

জ্ঞানের সাথে আখলাকের সমন্বয় না থাকায়, তাদের জ্ঞান ধ্বংসাত্বক কাণ্ডকলাপকেই জ্ঞানের কার্যকারিতা বলে বিবেচনা করে।  পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধ,  পারমানবিক বোমার বিস্ফোরণসহ বর্তমানেও ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ এর ফাঁকাবুলির তরবারিতে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির শিরশ্ছেদ চলমান।

গোটা মানব জাতির কেবল উৎকর্ষ না বরং টিকে থাকার জন্যও জ্ঞানের সাথে আখলাককে যুক্ত করা জরুরি।  অন্যথায় মানবসভ্যতাকে হুমকির মুখ থেকে ফেরানো সম্ভব নয়।

গ্রন্থসহায়িকা :

বিশ্বব্যাপী আখলাকী সংকট

  • প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *