শিউলিমালা একাডেমি

ভারতবর্ষের তরুণ সম্প্রদায়

[ভারতবর্ষের তরুণ সম্প্রদায়ের সকরুণ, মর্মস্পর্শী কান্না কখনই পূর্ণভাবে শোনা হয় নি। মোহাম্মদ আলী এখানে এক সাধারণ তরুণ ভারতীয়ের অন্তরতম আবেগকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।]

নতুন সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে নবীন ভারতবর্ষের কথা বর্তমানে দ্রুত উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু এখনো তা আত্মপ্রকাশের কৌশল আয়ত্ত করতে পারেনি। জীবনের যে পুরাতন নকশা পূর্বপুরুষদের বিশ্বাসের শেকড় ও উদ্দেশ্যকে পুষ্ট করেছিল, তা এখন মূলসূত্রে মিশে যাচ্ছে। নতুন ঘটনাধারা সবেমাত্র বিবর্ধিত হওয়ার পথে। উত্তরাধিকারসূত্রে নব-প্রজন্ম পেয়েছে বিশাল সামাজিক জটিলতা, অস্পষ্ট অভিলাষের জগাখিচুড়ি এবং সন্দেহ ও নৈতিকতার অনিশ্চয়তা। এর প্রেক্ষিতে, নতুন প্রজন্ম পূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চতায় পৌঁছায়নি। তারা অভাববোধ করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রার সুনিশ্চিত পদ্ধতির এবং সেই সঙ্গে আত্ম-উচ্চারণের ক্ষমতার, যা প্রতিষ্ঠিত সমাজ জীবনকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করবে। এ যেন এক স্বপ্ন দেখা, যে স্বপ্ন বড় অস্পষ্ট ও ক্ষণস্থায়ী; যেন গরাদহীন যাদুর বাতায়ন নিমেষের জন্য খুলে যায়। এ প্রজন্ম স্বপ্ন দেখে গৌরবময় সৌন্দর্যের, স্বর্গীয় আনন্দের। এ স্বপ্ন অনির্বচনীয় ইচ্ছার পাখায় ভর করে শূন্যে বায়বীয়ভাবে ভাসমান। মুহূর্তের উত্তেজনা যেন ভাষায় রূপ লাভ করে। কিন্তু এ ভাষার উচ্চারণ-ভঙ্গি অদ্ভুত, কথা অসংলগ্ন, আবেগ বিভ্রান্ত ও দ্বিধান্বিত। অসম্ভব কল্পনা যেন মনের নাগালের বাইরে চলে যায়, অপূর্ণতায় সমাধিস্থ হয়। তবু, ব্যর্থতা সত্ত্বেও তাদের অভিযাত্রা চলতে থাকে। স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষাকে জাগ্রত করে; আবার নিষ্ফলও হয়। কিন্তু আশা, সে তো থেকেই যায়। জাতির বিশাল সমস্যার বোঝার ভারে বিগত দিনের শিশুদের অপরাজেয় আশা মুখ থুবড়ে পড়েনি! অন্তর্নিহিত জীবনীশক্তিই তাদের প্রাণবন্ত প্রচেষ্টাকে বাঁচিয়ে রাখে। তাদের চিন্তাচেতনায় কোথাও না কোথাও আছে মুক্ত আনন্দময় বিশেষ অবস্থা। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, এ বিশেষ অবস্থা থেকে নবীন ভারত বেশিদিন বঞ্চিত থাকতে পারে না। তারা যদি শুধু প্রকাশ করতে পারতো তাদের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার কথা, তাদের যন্ত্রণার কথা এবং একইসঙ্গে প্রকাশকে তারা সহজ-সুন্দর ভাষায় রূপ দিতে পারত, তাহলে তাদের নিঃসঙ্গতার দুঃখের পরিসমাপ্তি ঘটতো, এবং তাদের কেউ আর কখনো বোধ করতো না যে তারা শুধু– “An infant crying in the night, An infant crying for the light. And with no language but a cry.”

সাধারণত যেমন হয়, নবীন ভারতবর্ষের শিশুকালের কান্নার বিষাদ করুণ সুর কখনো সম্পূর্ণ শোনা যায়নি। ভারতবর্ষের শত্রুরা ধীশক্তিহীন, সাধারণ মানবিক বদান্যতা বর্জিতও। তাই তারা এ কান্নাকে শক্ত ভাষায় নিন্দা জানায়। তাদের ধারণা, ভারতীয় তরুণদের এই কান্না প্রকারান্তরে ঔদ্ধত্যের মদমত্ততা ও বিদ্রোহের চেতনায় পূর্ণ। যারা নবীন ভারতের হৃদয়ের ‘নিগূঢ় আবেগ উপলব্ধি’ করেন, তারা বোঝেন এ ধারণা ঘূর্ণিত, নিষ্ঠুর মিথ্যাচার ছাড়া কিছু নয়। ভারতের ‘শিক্ষিত সম্প্রদায়’ অপেক্ষা গভীর কোন ক্ষমতা কিংবা আত্মজিজ্ঞাসা, আগ্রহ ও শ্রদ্ধা নিয়ে তরুণ প্রজন্ম কখনও সামাজিক পূণর্গঠনের বিরাট দায়িত্ব সম্পূর্ণ বহন করতে এগিয়ে আসেনি। বলা অনাবশ্যক- ওই সব গুণ মানুষের কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্যকে বাস্তব রূপ দেয়। পক্ষান্তরে বিরোধী পক্ষের এ ধরনের অত্যন্ত ক্ষতিকর বিকৃতি ও সংকীর্ণতা মানুষকে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির জটিলতা ও যন্ত্রণায় বিদ্ধ করতে পারে। তরুণরা এখন দাঁড়িয়ে আছে বিরাট পরিবর্তন ও ধ্বংস প্রক্রিয়ার মাঝখানে, বিচূর্ণকারী নতুন শক্তির সংস্পর্শে এসে প্রাচীন কৃষ্টি ও বিধি-বিধান নিঃশব্দে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়ছে। এ প্রজন্ম অতীতের দিকে পেছন ফিরে তাকায় এবং এখনো অস্তিত্ববান পূর্বপুরুষের শূন্যগর্ভ আস্ফালনে ভীত হয়। ওই সব পূর্বপুরুষ যেন অবধারিত বিচারের প্রতীক্ষায় মূক ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত, কিন্তু তবু পথ রোধ করে দণ্ডায়মান। বর্তমান যুগের তরুণ প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে অবাক বিস্ময়ে ওই সব প্রাচীনপন্থীর প্রতি দৃষ্টিপাত করে। ভবিষ্যতের দিগন্ত নতুন আশায় দীপ্তিময়, গৌরবের মেঘরাশি আকাশে-বাতাসে ভাসমান। দেশপ্রেমিক নব-প্রজন্ম পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে পৃথিবীর প্রাণবন্ত বৃহত্তর জীবনের সংস্পর্শে এসেছে। পুরনো ধ্বংস স্তূপের মধ্য থেকে নতুন জীবন সৃষ্টি করতে সে এখন পৌরুষের সঙ্গে সংগ্রাম করতে উদ্যত। ইতিহাস বলে, এ প্রজন্মের কাজ ইতিহাসের জানা কাজসমূহের মধ্যে দুরূহতম। এই প্রজন্মের বিশাল কর্মযজ্ঞের এতো সবে শুরু। তরুণদের এই চলার পথ ভীতিপ্রদ উন্মত্ততায় আকীর্ণ। বিশ্বের চিন্তা, আবেগ, ইচ্ছা এ যুগের তরুণদের চারপাশে খেলা করে। চলার পথে এখনও তারা প্রতিষ্ঠিত নয়, তারা যে সংগ্রামে লিপ্ত-সে সংগ্রামেরও কোন লক্ষ্য নেই– ঠিক যেন একটু স্থান করে নেওয়ার জন্য আমি সাঁতার কাটি তীব্র স্রোতের বিপরীতে। আমার পথ নির্দেশককে আমি এখনও চিনতে পারিনি।’

নবীন ভারতবর্ষ যদি এতটা কৌশলহীন না হয়ে সমস্ত মনপ্রাণ ঢেলে বলতে পারতো এর অন্তর্নিহিত সংগ্রামের কাহিনী, লালিত আশার কথা, যন্ত্রণাদায়ক ভীতির কথা, তা হলে সমস্ত পৃথিবীতে আলোড়নের সৃষ্টি হতো। শিক্ষিত ভারতীয় যুবক মাত্র যেন এক বেদনার প্রতীক। হৃদয়ে সে বহন করে চলেছে মহৎ অথচ অধঃপতিত এক জাতির ব্যথা-বেদনা। কোন কবি এ ব্যথার মর্মযাতনা প্রকাশ করতে তৎপর হন নি, কোন শিল্পীও সে ব্যথার অস্ফুট ধ্বনি শিল্পে ফুটিয়ে তোলেন নি। তার কামনা-বাসনার রোমান্স শুরু ও শেষ হয় নির্বাক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বৃত্তে। সে যখন জনগণের কাজে ও সামাজিক আন্দোলনে অংশ নেয়, এবং তখন সে সমস্ত উদ্দীপনাময় প্রয়াসকে সংহত করে নেয়। দেশের প্রতি আনুগত্য তাকে শামুকের খোলসের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রাখা থেকে নিবৃত্ত করেছে, এবং তার গৃহীত সমস্ত পরিকল্পনার দুঃখজনক ব্যর্থতা ভুলিয়ে দিয়েছে। এই যুবক অন্য সহযোগীদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়। সকলের মতো তার যাত্রা পথও এক হয়ে গেছে। নিজেদের ভাগ্য গড়ে নিতে পরিদৃশ্যমান শক্তির বিশ্বাস নিয়ে তারা একত্রিত হয়। যদিও তারা জানে যে, তাদের অন্তরের আগুন জ্বলে জ্বলে ছাইয়ে পরিণত হয়ে গেছে। তবুও, অতীত দিনের আশা তাদের মধ্যে জাগরুক থেকে যায়, গতানুগতিকভাবে হলেও উৎসাহের সঙ্গেই তারা এ আশার অংশীদার হয়।

দোলনা থেকে যৌবনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত নবীন শিক্ষিত ভারতীয়ের আত্ম সংগ্রামের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে হলে, অনুমানের ওপর নির্ভর না করে তার নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্দশার প্রতি আমরা ক্ষণিক দৃষ্টিপাত করতে পারি। অনেক প্রার্থনার ফলে কোনো সঙ্গতিপূর্ণ পরিবারে জন্ম নেয় এ যুবক। পরিস্থিতির নতুন ধারা অপেক্ষা মামুলি অতীতের প্রতি তার মাতা-পিতা আসক্ত। তারা আবছাভাবে দেখেন, এ নতুন ধারা বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে উদ্ভূত হচ্ছে। অত্যাসন্ন পরিবর্তনের সঙ্গে তাদের ছিল মানসিক দ্বন্দ্ব, বেদনাদায়ক যুদ্ধ। যে দ্বন্দ্ব তাদের পুরনো পৃথিবীর প্রত্যেক পরিচিত অবস্থাকে গ্রাস করছে। যা অনিবার্য, তার নিকট এখন তারা আত্মসমর্পণ করেছেন। কেউ যদি তাদের মাথার টুপি তুলে ধরতে পারতেন, তা হলে বিস্ময়াভিভূত হয়ে দেখতেন, ভ্রুণস্বরূপ প্রতিবাদের এক রাশ লাজুক অনুবর্তন হতাশ হয়ে জড়িয়ে আছে বহু নতুন চেতনার ছাপকে। প্রাচীনদের সংগ্রাম সমাপ্ত হয়েছে, কিন্তু কোন চূড়ান্ত জয় বা পরাজয় আসে নি। বলা যায়, এ এক অনির্দিষ্ট যুদ্ধের বিরতিকালীন অবস্থা, যা বৃদ্ধ-অবসন্ন মন উপস্থিত শান্তির জন্য গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে, এ বৃদ্ধরা অতীতকে ভালবাসেন বলে তা বিসর্জন দিতে পারেন না। এরা সম্পূর্ণরূপে বর্তমানকে বুঝতে অক্ষম, তাই একে সন্দেহ ও প্রচ্ছন্ন বিরূপদৃষ্টিতে দেখেন। কিন্তু বিরোধিতার আগের সেই রণধ্বনি ও চ্যালেঞ্জ এখন আর বাতাস বিদীর্ণ করতে পারে না। শিক্ষিত ভারতীয় যুবকের জন্ম এই পরিবেশে।

জায়মান চেতনা স্বতন্ত্রকরণের কাজ শুরু হলে ঝাঁকে ঝাঁকে আলগা, নিঃসম্পর্ক অনুভূতি ভ্রুণকে চারদিক থেকে আক্রান্ত করে, জর্জরিত করে। অনুরূপভাবে তরুণদের ধড়ফড় করা খুদে মনের ওপর সংগ্রহ, বাছাই ও তালিকাভুক্তির কাজ সৃষ্টি করে প্রবল চাপ। কচি মনের পরিপুষ্টির জন্য প্রাথমিক উপকরণাদি দেওয়ার মতো কোন প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষও নেই বা প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যও নেই। অস্পষ্টভাবে শোচনীয় অবস্থায় গড়ে ওঠে ঐতিহ্য এবং সন্দেহ ও সংশয়ে উবে যায় উপাদান ও উপকরণ। শুকনো রুটির টুকরোর মতো জননী তার শিশুকে দেন তার অজ্ঞতাপ্রসূত পাঁচমিশেলী ধারণা। অথচ ছেলে তখন উদ্যমের সঙ্গে বিশ্ব সম্পর্কে একটি ছক নির্মাণ করতে শুরু করে। পিতাকে প্রায়শ শুনতে হয় উৎসুক শিশুর প্রশ্নের বকবকানী। শিশুর নতুন মানসিক ভাবভঙ্গিতে তিনি ভূতি, নতুন নতুন অনুসন্ধিৎসু কথার সঠিক জবাব দিতেও তিনি মাঝে মাঝে বাকরুদ্ধ হয়ে যান। তরুণ মনের বিহ্বলিত রহস্যের গোলক-ধাঁধা সমাধানের কোন পথ তিনি খুঁজে পান না। পিতার প্রদত্ত ইতস্তত সংক্ষিপ্ত জবাব তরুণ পুত্রকে আরো বেশি বিভ্রান্ত করে। বিশ্ব রহস্য উদঘাটনে পিতার নিজের চাবি তো সেই কবে হারিয়ে গেছে, তিনি শূন্য হতাশায় ডুবে যান, যখন তার পুত্র নীরব জেদে, যন্ত্রণাদায়ক চিৎকারে অথবা আনন্দিত তীক্ষ্ণ কণ্ঠে এবং সুন্দর ছোট কথায় দাবি করে প্রতিনিয়ত তার মনে জেগে ওঠা হাজারো প্রশ্নের সমাধানের একটি চাবি। তরুণ কিশোর দ্রুত তার উৎসাহ হারাতে শুরু করে এবং তার সেই বিশুদ্ধ সতেজতা আর থাকে না। কোনো অদ্ভুত পরিকল্পনায় যখন কিছু অজ্ঞাত অসংলগ্ন কোন বিষয় জেঁকে বসে, তখন তা কারো ক্ষুধা বা যন্ত্রণা বৃদ্ধি অথবা হ্রাস করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এই অসহায় তরুণ নিজের মনোজগৎকে নিজেই সৃষ্টি করে নেয়। এটা অবশ্য ভারতীয় শিক্ষিত তরুণদের শৈশবের একটি চূড়ান্ত চিত্র। এ কিন্তু কোন অবিশ্বস্ত অথবা অসাধারণ চিত্র নয়। কোন কোন ক্ষেত্রে পিতা-মাতা তাদের প্রজ্ঞা সম্পর্কে সুনিশ্চিত হয়েই শিশুর বাড়ন্ত মন ও সংবেদনশীল মানসিকতাকে সঠিক দিক-নির্দেশনা দেওয়ার প্রয়াস পান। কিন্তু এই পর্যন্তই। কেননা তাদের অনেকেই প্রাচীনপন্থী, অর্থাৎ তারা প্রাচীন প্রতীক ও চিন্তাধারাকে প্রবল আবেগে আঁকড়ে ধরে আছেন। নবীন প্রজন্মের জন্য তারা যেন-চিন্তাধারার ক্ষেত্রে ঢালাই ইস্পাতের ছাঁচ তৈরি করে রেখেছেন। কিন্তু সে ছাঁচ কবেই ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেছে-নতুবা বক্র হয়ে গেছে। সে ছাঁচ সংশোধনাতীতভাবে তরুণ মনকে পঙ্গু করার জন্য যথেষ্ট। ফলে প্রতিক্ষেত্রে সেই তরুণ-কিশোর যখন কোন পাবলিক স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়, তখন সে তার পাঠ্য বইয়ের ভেতর এক নতুন জগৎ আবিষ্কারে প্রয়াসী হয়। এক ধরনের মানসিক পঙ্গুত্বের কারণে ইতোমধ্যে সে তার চিন্তাচেতনার অপরাপর উৎস প্রায় হারিয়ে ফেলেছে। পাঠ্য পুস্তকের প্রধান প্রধান শাখার মধ্যে সে ডুব শুরু করে নতুন কিছুর সন্ধানে। তখন তার সাথে তার পরিচিত গৃহ, রাস্তাঘাট, বিদ্যালয় ও সমাজজীবনের যেমন কোন সম্পর্ক থাকে না, তেমনি সুসংগঠিত কোন ধ্যান-ধারণার সাথে সহজ বোধগম্য পারস্পরিক সম্পর্কও সে হারিয়ে ফেলে। ফলে স্বভাবত সুস্পষ্ট ধ্যান-সংক্ষিপ্ত সময়ের রোমান্সের সূচনা হয়।

শিক্ষিত ভারতীয় তরুণটি বাল্যকালে অবাক সৃজনশীল স্বপ্নে বিভোর থাকে। ঘরের পরিবেশের অবদমিত উদ্বেগ, হতবিহ্বল শূন্যতা সত্ত্বেও পৃথিবীর চেতনার সঙ্গে তার সংশ্রব ঘটতে শুরু করে। সে ঊর্ধ্বলোকের দ্যুতিময় আলোকিত দৃশ্যাবলীর প্রতি দৃষ্টিপাত করে। জ্ঞান অন্বেষণকারী হিসেবে তার এ প্রকাশ্য উদ্যমকে পরিবারের জন্য একটি ঘটনা বলা যেতে পারে। পর্ব-উৎসব পালন নিয়ে তার নিজস্ব অনুভূতির একটি অস্পষ্ট অতিশয্য দেখা দেয় যাকে আবেগের আর্তনাদ বলা ছাড়া আর কিই-বা বলা যেতে পারে? এই অবস্থায় অনেকটা অজ্ঞাতসারে মোল্লা বা গুরুর আবির্ভাব হয় এবং বালকের নিখিল বিশ্ব হারিয়ে যায় তাদের এই ভীতিপ্রদ উপস্থিতিতে। নিষ্ঠুর শিক্ষকের বেত্রদণ্ডের ভয়ে শুরুতেই জ্ঞান সম্পর্কে তার সমগ্র ধারণা কালিমালিপ্ত হয়। মক্তব বা পাঠশালা তার নিকট পরিণত হয় জীবন্ত নরকে। জ্ঞান অর্জন ভয়ানক প্রায়শ্চিত্যের কারণ হয়ে পড়ে এবং শিক্ষক তার কল্পনার উপরে যথেচ্ছ জুলুম চালাতে থাকে। আর এই জুলুম বৎসরের পর বৎসর ধরে ছাপ ফেলে যায়। মক্তব বা পাঠশালা থেকে তরুণ-কিশোরের জীবনে স্কুলে গমন বলতে গেলে পরিবেশের সম্পূর্ণ পরিবর্তন। কিন্তু ‘গলায় একটি স্ফীতি’ নিয়ে বালকটি স্কুলে প্রবেশ করে। সে ইতোমধ্যেই জ্ঞান বৃক্ষের ফুল আস্বাদন করেছে; এবং নিজের মনোভাবও সে ইতোমধ্যে তৈরী করে নিয়েছে। এই মনোভাব নিয়েই তার পরবর্তী স্কুল জীবন নিস্পন্ন হয়। এই মনোভাব যেন তার জীবনের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে নির্বাক প্রতিবাদ। মক্তব ও পাঠশালা তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ভারাক্রান্ত করেছে; স্নায়ুকে করেছে জর্জরিত। নিরানন্দ অঙ্ক গণনা ও শিক্ষকের তর্জনী তো আছেই। কোন ভ্রুকুটি পূর্ণ মুখ তার দিকে তাকালে তার মাথার চুলের গোড়া পর্যন্ত শিউরে ওঠে। শিক্ষকের কর্কশ চিৎকার তার মনে ভীতির সঞ্চার করে। তার পাবলিক স্কুলে স্নায়ুবিক চাপ কিছুটা হ্রাস পায়। মক্তব শিক্ষকের কঠোর শিক্ষা পদ্ধতির প্রধান উদ্দেশ্য বালকটিকে সব রকম আমোদ-প্রমোদ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। পাবলিক স্কুলের শিক্ষকের ধারণা কিন্তু তা নয়। তবুও স্কুলের পরিবেশে কোনরূপ অন্তরঙ্গতা নেই, এর নিয়মও কঠোর, নৈর্ব্যক্তিক। প্রাচীন নৈতিকতা, বুদ্ধিবৃত্তিক শৃঙ্খলার অনুসারী মোল্লা ও গুরুরা অত্যাচারী হলেও, পেশায় তারা আন্তরিক। শিক্ষার্থীরা তাদের শিষ্যও বটে। ছেলেরা মোল্লা ও গুরুকে ভয় করলেও তাদের প্রতি তারা আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধাশীল এবং বহু মানবিক সম্পর্কে সম্পৃক্ত। কিন্তু বোর্ডিং স্কুলের শিক্ষক সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যক্তি বা সত্ত্বা। তিনি এমন নিয়মের মানুষ যা প্রধানত বাণিজ্যিক ধারায় চলে। তার পেশা তার কাছে রুজি-রোজগারের ফিকির মাত্র, মহৎ বৃত্তি নয়। পাবলিক স্কুলের শিক্ষক সচরাচর একটি শিক্ষারীতির মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময় সীমায় ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণাধীন রাখার দায়িত্ব পালন করেন মাত্র। তার সব কর্তব্য শেষ হয় যখন বার্ষিক পরীক্ষায় তার বিভাগে পাশের শতকরা সর্বোচ্চ হার অর্জিত হয়। খুব বেশি হলে, তিনি একটি মসৃণ যন্ত্র যা সাধারণত মনকে নির্দিষ্ট ধাঁচে গড়ে তুলতে পারে। বোর্ডিং স্কুলের দশ বৎসরের শিক্ষা জীবনে সত্যিকারের শিক্ষা খুব কমই দেয়া হয়। সেখানে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সে কিন্তু প্রয়োজনীয় যান্ত্রিক কলা-কৌশল অর্জন করে। বুদ্ধিবৃত্তি এবং শৃঙ্খলার প্রশিক্ষণ যা সে পায়, তা নাম মাত্র। নৈতিক উপদেশ সংক্রান্ত পাঠ্যবই সেখানে সে অধ্যয়ন করে বটে কিন্তু তার নৈতিক ধারণা সাধারণত অনুজ্জ্বলই থেকে যায়। ছাত্র জীবনের এই সময়টি খুবই সঙ্কটপূর্ণ। কিন্তু ওই পর্যায়ে চরিত্র গঠনের জন্য সে কোন উপদেশ বা সহায়তা পায় না। তার চরিত্র গঠনে বিবিধ দৈব বিধিবিধান ক্রিয়াশীল থাকে। জাতিগত কিছু নীতি বা ধর্মীয় কোন অনুশাসন এমনকি কুসংস্কারাচ্ছন্ন বহু ধ্যানধারণাও শিশুকালেই তার মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। প্রয়োজনে ওই সব ধারণা তার অচেতন মন থেকে উৎসারিত হয়। সে যখন কোন নৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়, তখন ওই সব ধারণার আলোকে সে পথ খুঁজে নেওয়ার প্রয়াস পায়। স্কুলের শিক্ষার সঙ্গে তার পারিবারিক জীবনের কোন সম্পর্ক নেই। রাস্তার জীবন, বাজারের জীবনের সঙ্গেও তার শিক্ষা বলতে গেলে সম্পর্কহীন। এ তরুণের মনের সুখ, আনন্দ, সামাজিক উদ্দেশ্য ও কর্তব্যজ্ঞান-সব কিছুই তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাসঞ্জাত; তার সঙ্গে এ শিক্ষার কোন মিল নেই। স্কুলের শিক্ষা শেষ করার আগেই সে অস্পষ্টভাবে সচেতন হয় তার একান্ত জীবনের দ্বৈতধারা সম্পর্কে। তার পিতা-মাতা ও তার চারপাশের মানুষেরা তাদের নিজস্ব জীবনযাপন করেন। তাদের চিন্তাভাবনা, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, তাদের আনন্দ-বেদনা, তাদের পেশা ও বৃত্তি ব্যাপকভাবে বিভিন্নমুখী।

কেউ কি এমন কোন পরিণত বয়সের মানুষের খবর জানাতে পারেন-যে মানুষ কোন না কোন সময় আবার বালক বয়সে ফিরে যাবার ইচ্ছা পোষণ করেননি? বালক বয়সের সেই অপূর্ব স্বর্গীয় অভিজ্ঞতা পরিণত বয়সে আলো ও মানবতার বাতিঘর হয়ে দাঁড়ায়। গোটা সময়টা অনুভূতির অতি মূল্যবান সঞ্চয়। মনোভাব তখন ছিল তেজস্বী; এবং কোন রকম দুশ্চিন্তা বা দুঃখের দহন জীবনকে তখন ম্লান করতে পারেনি। সবকিছু ছিল বাস্তব ত্রুটিবিহীন। মিঃ ওয়েলস ভবিষ্যতের মানুষের মোহনীয় চিত্র তুলে ধরেছেন। অসুন্দর অপূর্ণতা দূর করা হলে, মানুষ ছোট্ট পা-দানীতে দাঁড়িয়ে নক্ষত্রপুঞ্জে হাত বাড়াতে সক্ষম হবে। বাস্তবক্ষেত্রে এটাই বালকত্বের একটি নিখুঁত চিত্র। এই বয়সটা জীবনের এমন এক সময় যখন কোন অপূর্ণতার চেতনা মুক্ত আনন্দময় মনের গতি ও অনুভূতিকে জড়িয়ে থাকে না। এই বয়সটা জীবনের এমন এক সময়, যখন পৃথিবীকে রঙ্গীন পোশাকে সজ্জিত মনে হয়। যখন অর্থবহ অথবা রহস্যঘেরা সবকিছুকে মনে হয় জীবন্ত। যখন টুল, কাঠের টেবিল, এবং কলম ও দোয়াতদানী এগুলিও নিজ নিজ স্বাতন্ত্রে যেন অলৌকিক ভঙ্গিমায় পরিস্ফুট, ব্যাঙ্ময়। চমৎকার শব্দময় রঙিন এ জনাকীর্ণ পৃথিবীতে মানুষের ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র অংশগুলি যেন দেবতার মতো চিত্তবিনোদনে রত। এই সময়ে তরুণ মন সৃষ্টির গোপনীয়তার ভেতর ডুব দেয়। তরুণ মনের নিকট গোটা জগৎ যেন সৌন্দর্যের ইন্দ্রজাল, যার সৃষ্টি তরুণের অন্তর ও মস্তিষ্কের রসায়ন থেকে। এ যেন স্রষ্টার এক অনবদ্য অবদান। সৃজনশীলতা ও আত্মপূর্ণতার এই যে ক্ষমতা, এটাই তারুণ্যের অলৌকিকত্ব। মুষ্টিমেয় কয়েকজন মাত্র পরিণত বয়সে মানুষের এ ক্ষমতা অবিকৃত রাখতে পারেন। এ এক সজীব সমাজের অপরিহার্য উদ্দীপনা। এটা সেই ক্ষমতা যার উল্লেখ গ্যেটে এভাবে করেছিলেন, “মানুষ প্রতি-অর্থে ঐশ্বরিক, কারণ সে পৃথিবীকে নির্মাণ করে।”

Or “bidding them no longer be, exserts, enjoys a sense of deity.”

সমাজ জীবনে পরস্পরের প্রতি আচরণ, দৈনন্দিন জীবনে ভাব-বিনিময় মানুষকে একটি আলাদা মাত্রা ও স্বতন্ত্র পরিচিতি দান করে। বোর্ডিং স্কুলের শিক্ষা ও দুর্বোধ্য পাঠ্যপুস্তকের কারণে পাশ্চাত্যের জাগতিক নীতি তার চেতনায় মিটমিট করে জ্বলে বটে, কিন্তু তার মূল্যবোধ ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে ধারণা দেয় সম্পূর্ণ ভিন্নতর। পূর্বসূরীদের কৃষ্টি, বিশ্বাস ও সমাজবিধি তরুণদের প্রগাঢ় নিষ্ঠার দাবিদার। এসবের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য দেখিয়ে তবেই তরুণেরা পেতে পারে মুক্তির চিরন্তন আস্বাদ। পাশ্চাত্যের নতুন দেবতারা যখন পিছন হতে অদ্ভুত দৈববাণী উচ্চারণ করে, প্রতিপত্তি ও অভিনবত্বের মায়ায় মোহাবিষ্ট না হয়ে পারে না। তরুণ মন ঘৃণা করতে শুরু করে পূর্বপুরুষদের দার্শনিক সংশয় ও দুর্বোধ্য পটভূমিকে। বলিষ্ঠ সরল বিশ্বাস ছাড়া তরুণেরা পথ চলতে পারে না। সমস্যা যত কঠিন হোক, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সে সমস্যার সমাধান করতে চায়। অথচ সেসব সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব কিন্তু ভারতীয় সমাজেরই। প্রবেশিকা পরীক্ষা দেওয়া এবং কলেজে ভর্তি হওয়ার পর্যায়ে কিছু বিতর্কিত বিষয় এবং নব্য-ভারতের চিন্তাধারার গভীর দ্বন্দ্ব তরুণদের মনে রেখাপাত করে। অস্পষ্টভাবে হলেও, এই প্রথম কোন তরুণ তার জাতির বিশাল বোঝা অনুমান করতে পারে। দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অন্যান্য সমস্যা সম্পর্কে সে সজাগ হয়। সামগ্রিকভাবে জটিলতা তার মনের আয়ত্তের বাইরে হলেও সে এসব জটিলতার কিছু কিছু স্বরূপ বুঝতে শুরু করে, সে যেন স্পষ্ট শুনতে পায় এসব জটিলতা সরলীকরণে নিয়োজিত ব্যক্তিদের আহ্বান। তাকে তখন আকৃষ্ট করে সংবাদপত্র, বক্তৃতা মঞ্চের হৈচৈ এবং বহু ব্যবহৃত কথামালা। সেই সব গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কিত বিষয়ে সে পক্ষাবলম্বন করতে শুরু করে, যেসব বিষয় ভারতবর্ষের মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণে সক্রিয়।

তরুণ তার মধ্যে পরিবর্তনের স্পন্দন অনুভব করে, সে আন্দোলিত হয় নতুন চেতনায়। যা কিছু সে দেখে ও অনুভব করে তার তাৎপর্য উপলব্ধি করতে স্কুলের শিক্ষা তাকে তেমন সাহায্য করেনা। বিতর্কমূলক বিশাল সাহিত্য, সংবাদপত্র, চারপাশের আলোচনা, কথাবার্তার মধ্যে চিন্তা ও হেঁয়ালির কিছু সূত্র সে খুঁজে পায়। এগুলো তার নবীন মননশীলতায় আঘাত হানে। নতুন প্রজন্ম তখন নিজের মনে মনেই গ্রহণ করে সংকল্প; সে দীক্ষা গ্রহণ করে ধর্ম, সম্প্রদায় ও দেশ-সেবার। বুকে তার জন্ম নেয় দেশপ্রেম; এবং শৈশব অতিক্রম করে এ তরুণ প্রথমবারের মতো অনুভব করে সত্ত্বার প্রাচুর্য ও বৈভব। শ্রমের বিস্তৃতিতে সে আতঙ্কিত নয়। কারণ, এ সম্পর্কে তার ধারণা খুবই স্বচ্ছ। সরল বিশ্বাসের প্রাণ-প্রাচুর্য নিয়ে সে তৈরি হয় নতুন স্বর্গ, নতুন পৃথিবী গড়ার পরিকল্পনায়। তার দেশপ্রেম মূলত সম্প্রদায়গত। হিন্দু হলে সে তার প্রেরণার সন্ধান করে ভারতের পৌরানিক ঐতিহ্য থেকে, যা তার ধর্মপরায়ণতা ও সাহিত্যের মধ্যে প্রকাশিত। সে ঐতিহ্যের চারপাশ জড়িয়ে আছে মহৎ আদর্শের সৌরভ ও মেলবন্ধন। আর মুসলমান হলে পৃথিবীর সর্বত্র পূর্বপুরুষদের শিল্প, সাহিত্য, বাণিজ্য ও সাম্রাজ্যের গৌরবে সে গর্বিত হয়। অতীতের স্মৃতিচারণা যেন তার ভবিষ্যতের স্বপ্নকে পূর্ণ করে। দেশপ্রেমের কবিতা তার অন্তর স্পর্শ করে, সে তা মুখস্থ করে; এবং তার আত্মার গভীরে তা সুরে, সঙ্গীতে অনুরণিত হয়। আগ্রহ নিয়ে সে সমাজসংস্কারের কথা বলতে শুরু করে; এবং সমাজ জীবনে তার ভবিষ্যতের সক্রিয় দায়িত্বশীল ভূমিকার কথা সে ভাবতে থাকে। মানুষ ও সমাজের মূর্খ ও নষ্ট বিধি-নিয়মের প্রতি ইতোমধ্যে সে তার সঙ্গীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বয়োবৃদ্ধরা এ স্বপ্নবিলাসী যুবকের সবল সংস্কারমূলক আগ্রহ ও উৎসাহ দেখে মাথা নাড়েন। পরিবারের মহিলাদের মনে প্রতিদিন অন্তত ছয় বার কেলেঙ্কারীর ভয় জাগিয়ে এ তরুণ আনন্দ উপভোগ করে। পর্দাপ্রথা, নারীর বিদ্যমান মর্যাদা সম্পর্কে তার ধারণা এবং কেমন করে সে এসব বিষয়ে বিপ্লব ঘটাবে-তার বর্ণনা শুনে তারা ভীত হয়ে পড়েন। ধর্ম-সংক্রান্ত বিষয়ে সে প্রায়শ ‘সংস্কারের’ পক্ষে। সে নিজের মেধা ও ক্ষমতা পরিমাপ করে দেখে, ধর্মের প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে বিদ্যালয়ের মৌলভী বা পণ্ডিতের ক্রোধ সে কতটা জাগাতে সক্ষম। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের আরবি, ফারসি ও সংস্কৃতের ক্লাসগুলি বস্তুতপক্ষে যেন তরুণদের ক্ষুদে ধর্মীয় বিতর্ক সভা। এ সভার স্থায়ী সভাপতি মৌলভী বা পণ্ডিত। জ্ঞান ও সংস্কার প্রসারে প্রতিবন্ধকতা, অন্ধকারাচ্ছন্ন কুসংস্কার এবং গদবাঁধা উপদেশের বিরুদ্ধে নব্য ভারতের সংগ্রাম শুরু হয় বিদ্যালয় কক্ষেই, শৈশবের হৈ চৈ ও চাঞ্চল্যের মধ্যে। মৌলভী যেন নির্ধারিত বিধি ও প্রতিষ্ঠিত সমাজের প্রতীক। তরুণ বালকের মধ্যে আছে নতুন আলোর স্ফুলিঙ্গ, ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি। মৌলভী একজন সহজ-সরল ব্যক্তি এবং দয়ালু প্রশ্রয়দাতা। তিনি পছন্দ করেন কৌতুক ও রম্য উপাখ্যান। বিতর্কের দ্বন্দ্বযুদ্ধে তিনি প্রায়ই অনুভব করেন, তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। তবু বিচক্ষণতার সঙ্গে তিনি তার ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করেন। দীর্ঘ অন্তঃসারশূন্য গল্প শুনিয়ে তিনি তরুণের উদ্যামকে দাবিয়ে রাখেন। মৌলভীর মেজাজ ও খেয়ালিপনা সংস্কারপন্থী তরুণদের জোগায় শ্রদ্ধাহীন, হাস্যরসাত্মক গালগল্পের অফুরন্ত ভাণ্ডার। স্কুল থেকে তার অবসর গ্রহণ সম্পন্ন হলে নর্মাল স্কুল ও ট্রেনিং কলেজ থেকে আসেন তার নবাগত উত্তরসূরি। কিন্তু তিনিও কদাচিৎ পুরনো নিয়মের উন্নতি সাধনে সক্ষম হন। তবুও অদক্ষতা, অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও মৌলভী তার ছাত্রদের অন্তরে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রাখেন। অনেক ক্ষেত্রে তিনি জ্বালাতে সাহায্য করেন-যা শেষ পর্যন্ত প্রজ্জ্বলিত থেকে যায়। আলোকবর্তিকা প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর কলেজে প্রবেশের প্রস্তুতিকালে তরুণ মাত্রই স্বপ্নের ঘোরে বিভোর থাকে। তার এ স্বপ্ন নতুন উৎসাহে ব্যঞ্জনাময়। নিজের ক্ষমতায় সে আস্থাবান, দেশপ্রেমের শক্তিতে সে অটল। সংক্ষেপে বলা যায়, তরুণ তার আদর্শ সম্পর্কে নিশ্চিন্ত। চম্বুকের মতো কলেজ তাকে আকর্ষণ করে। সে কলেজে যায় তার অন্তরের ঐশ্বর্যময় আবেগ নিয়ে। তার আশা, সেখানে সে সকল হেঁয়ালি-ধাঁধার সমাধানের চাবিকাঠি খুঁজে পাবে, সেখানে সে অর্জন করবে নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করার মেধা ও শক্তি। নক্ষত্র তার মোহ, সে নক্ষত্রের আলোয় পথ চলে। আঁধারের ছায়া দেখলে দেখা যাবে, সে ছায়া যেন নেমেছে প্রাচীন লোকদের চলার পথে। একজন তরুণের পেশা অবলম্বনের গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ তার কলেজ জীবন। কলেজেই তার জীবনের রোমাঞ্চের শুরু। এখানে সে আত্মপ্রকাশের মাত্রা খুঁজে পায়। কিন্তু শিগগির সূচনা হয় তার মোহমুক্তির প্রক্রিয়া। ভাগ্যের ফেরে তার প্রথম দিনের স্বর্গের আলো হয় নির্বাপিত।

সরকারী, বেসরকারী অথবা সম্প্রদায়গত; যাই হোক, ভারতবর্ষের কলেজগুলি পোক্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। সেখানে নব্য ভারতের চিন্তার দ্বন্দ্ব তরুণদের সঙ্কটের সম্মুখীন করে এবং অনেক সময় এর পরিণতিও হয় বিপজ্জনক। যে তরুণ কলেজ ছেড়ে চলে যায়, সে কিন্তু তার ঐ মুহূর্তের উন্মাদনা কখনো ভুলতে পারে না। কারণ এই কলেজেই সে তার বুদ্ধিবৃত্তিক আকাঙ্ক্ষার তীর্থে প্রথম প্রবেশ করেছিল। যখনই সে তার শহর অথবা শহরতলীর বি.এ. ডিগ্রীর মোহে আবিষ্ট হয়েছিল, তখনই সে তাকে স্বীয় ইচ্ছার পূরণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। আর গোটা বিষয়টা তার রক্তে সৃষ্টি করেছিল এক তীব্র আলোড়ন। ডিগ্রীর নিষ্কলঙ্ক ধারা ও ধারণার বিমুগ্ধ প্রশংসা তাকে পরাভূত করেছিল। প্রথমে কিছু ইতস্তত করলেও তার পিতা-মাতা স্বাভাবিকভাবেই সেই তরুণের দুঃসাহসিক ঝুঁকির যাবতীয় খরচপত্র যোগানোর ব্যাপারে নিজেদের সম্পত্তির হিসেব-নিকেশ শুরু করেছিল। কিন্তু জেদের বশবর্তী হয়ে সেই তরুণ সেসব বিবেচনা বাতিল করে দিয়ে শেষ পর্যন্ত খুঁজে নিয়েছিল তার নিজস্ব পথ। ঘটনাটা ঘটেছিল এভাবে: সে তার জিনিসপত্র বাঁধাছাদা করে নেয় এবং ম্যাট্রিক সার্টিফিকেট, এবং চরিত্র ও আচরণ সম্পর্কে স্কুলের সনদপত্র সঙ্গে নিয়ে কোন এক সুন্দর সকালে সে উপস্থিত হয় নিজ পছন্দের কলেজে। সে এমন এক অনুভূতি নিয়ে সেই কলেজ প্রাঙ্গনে উপস্থিত হয় যেন এক পবিত্রস্থানে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। এই তরুণ তীর্থযাত্রী প্রথম কয়েক সপ্তাহ বেশ বড় বিভ্রান্তির শিকার হয়। ধারাবাহিক দমবন্ধকর অবস্থা তার মনে প্রথম রেখাপাত করে। কলেজ সম্বন্ধে সে তার মনে যে চিত্র এঁকেছিল, তা ছিল সমাধিস্থানের মতো মর্যাদাপূর্ণ এক আবাসস্থল। যুবক ধীরে ধীরে দেশপ্রেমের আবেগে আপ্লুত হয়। ধর্ম, সম্প্রদায় ও সমাজসংস্কার সম্পর্কে বিরামহীন বক্তৃতা দিয়ে তার দিন কাটে। প্রকৃতপক্ষে, নবাগত তরুণ হোষ্টেলের কক্ষে, বারান্দায় অলস গল্পেরত ছাত্রদের ছোট ছোট সমাবেশ দেখে। তাদের এসব গালগল্প মাঝে মাঝে বিদ্রূপাত্মক শিষ অথবা অশ্রদ্ধাপূর্ণ উচ্চ হাস্যরোল দ্বারা বাধাগ্রস্থ হয়। তরুণটির সহজাত প্রফুল্লভাব হয়তো জেগে উঠে অকৃত্রিম আনন্দে; কেননা এটাই যৌবনের ধর্ম। কিন্তু তার আগের সেই কল্পিত চিত্র চিরদিনের জন্য চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। কলেজ প্রবেশের মুহূর্তে নিজেকে সে প্রথমে অবহেলিত মনে করেছিল। কেউ তার জীবনের এই পরম ঘটনাকে পাত্তা দিয়েছিল বলে তার মনে হয়নি। ঘটনা আগের মতোই ঘটে চলছিল- যুগান্তকারী ঘটনা তো দূরের কথা, তার কলেজে আগমন যেন কোন ঘটনাই ছিল না, এটা ছিল তার জন্য লজ্জাকর। তার মনে হয়েছিল সে বহিরাগত ও অবাঞ্ছিত। যাই হোক, পক্ষকালের মধ্যেই সে যেন এসব অনুভূতি অতিক্রম করে এবং পারিপার্শ্বিকতার সূত্রগুলি খুঁজে বের করে। সে জেনে ফেলে অস্নাতকদের গুপ্ত ভ্রাতৃসংঘের সদস্যদের কথা। এমনকি, সে দ্রুত ভুলেও যায় তার মনের ক্রোধ, হুলফুটানো অপমানের জ্বালা, যখন সে তার পোশাক-পরিচ্ছদ, চেহারা ও স্বভাব সম্পর্কে নির্দয় ঠাট্টা-বিদ্রূপ ও অবজ্ঞার শিকার হয়ে জর্জরিত হচ্ছিল। সে সময়ে তার মনে হচ্ছিল, বাকি জীবনের দিনগুলি এমনি নিষ্প্রভভাবে কেটে যাবে। তাকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ নিদ্রাহীন ভীতিকর রাত্রি অতিবাহিত করতে হয়েছিল। এভাবেই ক্রমান্বয়ে প্রাক-স্নাতক পর্যায়ের পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে তার পূর্ণ পরিচয় ঘটে। কর্ম-প্রক্রিয়া শুরু হতে মোটামুটি দু’মাসের বেশি সময় লাগেনি। তার নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংবেদনশীলতা অবধারিতভাবে উদ্দীপ্ত হয়েছিল নতুন অজস্র ধারণার মধ্য দিয়ে। তার প্রতি লোমকূপে জীবন সুধার উন্মাদনা জেগেছিল। চিন্তা ও চেতনার নতুন তরঙ্গ নতুন পরিবেশে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে ছিল। শ্রেণী কক্ষে, পাঠাগারে, বিতর্ক সভায়, খেলার মাঠে, ভোজন কক্ষে এবং সঙ্গীদের সঙ্গে উন্মুক্ত যোগাযোগে তরুণটি দেখেছিল রৌদ্রোজ্জ্বল, সুন্দর চেতনার রশ্মি। প্রকৃতই বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার অনুভূতির সৃষ্টি হতে শুরু করে তার ভেতরে। বিদ্রোহের আনন্দে সে যেন ছিন্ন করে তার চেতনার দাসত্বের অসংখ্য অদৃশ্য শৃঙ্খল। কিন্তু যৌবনের মনস্তত্ত্ব ও পূর্ব-প্রশিক্ষণ সে বাদ দিতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল এই দুর্দমনীয় অভিলাসকে না ঠেকালে এই বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণা হয়তো বিপজ্জনকভাবে নৈরাজ্যে পর্যবসিত হবে। এ বিশ্বাস তার ব্যক্তিত্বের বিকাশে সৃজনশীল প্রভাব বিস্তার হয়ত করেছিল, কিন্তু তা ছিল বড় ক্ষণস্থায়ী। এই সবিরাম উদ্যম স্বাভাবিকভাবে দু’এক বৎসরের মধ্যে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে, বলা অনাবশ্যক যে, পরিপুষ্টির অভাবেই।

কলেজ জীবন শেষ করার পূর্বে সাধারণত সংগোপনে যে সমস্ত কারণে যুবকদের বুদ্ধিগত আত্মবিশ্বাসের অবনতি ঘটে, সে সম্পর্কে সতর্ক, অনুসন্ধানী বিশ্লেষণ আবশ্যক। এই বিশ্লেষণ ভারতবর্ষের সমগ্র শিক্ষা সমস্যার সংশ্লিষ্ট সকল প্রশ্নকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করার স্বার্থেই প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রে বিপর্যয় যে ঘটে না, তা নয়। এ বিপর্যয় কী ধরনের এবং বিপর্যয় বলতে কী বোঝায়, এই পর্যায়ে তার সারমর্ম উদ্‌ঘাটন করার প্রয়াস চালাব। তবে তার আগে আমরা এ বিপর্যয়ের প্রতি ভারতবর্ষের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির সকল বুদ্ধিমান ছাত্রের সর্বোচ্চ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ভারতবর্ষের এই তরুণ সম্প্রদায় পাশ্চাত্য শিক্ষার ফসল। নিঃসন্দেহে এ অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। বাহ্যত দেখা যায়, এ শিক্ষায় উদ্যমতা বা আস্থার অভাব নেই। মনে হয়, এ শিক্ষায় যারা শিক্ষিত তারা ভারতের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পূর্ণ আস্থাবান, এবং গতিকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয় শক্তি সঞ্চয় করতে এই শিক্ষা তাদের সহযোগিতা করেছে। কিন্তু আসলেই কি এই শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরা এত বলিষ্ঠ ও সাহসী যে, ভয়ে পিছিয়ে আসার লোক তারা নয়? এ শিক্ষা কি সন্দেহে ক্ষত-বিক্ষত নয়? অথবা এই শিক্ষার অবস্থা কি এই নয় যে, তা শুধু নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টার বহিঃপ্রকাশ? পথ ও গন্তব্য সম্পর্কে এ শিক্ষা কি চূড়ান্তভাবে নিশ্চিন্ত? স্পষ্ট বুঝা যায়, ভারতবর্ষের তরুণ সম্প্রদায় শুধু উদাসীন, এবং অদ্ভুত শঙ্কায় শুধু শঙ্কিতই নয়, তাদের আস্থাও নড়বড়ে। এবং এই তরুণদের আদর্শ শিক্ষা লাভের পরেও আকাশ কুসুম কল্পনা হয়েই বিরাজ করে। তারা উৎসুক হয়ে থাকে বিশ্বাস ও নিশ্চয়তার জন্য। সোজা রাস্তার ব্যাপারে তারা কিছুটা নিশ্চিত হতে আগ্রহী। তরুণ সম্প্রদায় যে আর্তনাদ করছে, তা পথ-নির্দেশে পাওয়ার জন্য, হাতে চাঁদ পাওয়ার জন্য নয়। কিন্তু তরুণ সমাজের আকাঙ্ক্ষা যথেষ্ট আবেগপ্রবন নয়; তাদের আর্ত-চিৎকারে একজন উদ্যমী ব্যক্তির বিশ্বাস ও সাহস অনুরণিত হয় না। কিছু অপ্রাচুর্য, কিছু নিষ্ক্রিয়তা ভারতবর্ষের তরুণ সম্প্রদায়ের মন-মানসিকতাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। চেতনা ও অনুভূতির সংশোধনাতীত কিছু না খুইয়ে একজন যুবক কলেজ জীবন শেষ করে না।

এই ক্ষতির মাত্রা নিরূপণ করার আগে, এটা দেখা গুরুত্বপূর্ণ যে, কেমন করে তরুণ সম্প্রদায় এ ধরনের ক্ষতির শিকার হয়। আমরা যেমন দেখেছি, নতুন উপস্নাতক নতুন পরিবেশে তাল মিলিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে তার মনের মধ্যেও সীমাহীন স্বাধীনতা অনুভব করে। প্রথা, ঐতিহ্য ও কর্তৃত্বের মাধ্যমে তার উপরে আরোপিত অভ্যাসের পুরনো সীমাবদ্ধতা ও রীতিনীতি এবং অসংখ্য বাধা-নিষেধ ক্রমশ খসে পড়ে। পাশ্চাত্যের উন্মাদক ধারণায় সে তরুণ-মন তখন পূর্ণ উদ্যমে নতুন পথে মোড় নেওয়া শুরু করে। বিশাল ইংরেজি সাহিত্য এবং অগ্রসর ভাবধারা; তার সৌন্দর্য ও প্রভাব, ইতিহাস ও আধুনিক বিজ্ঞান এবং বিশ্ব রাজনীতির মোহ ও রোমাঞ্চ; আধুনিক প্রয়াসের পরিমণ্ডল ও কলাবিদ্যার আবিষ্কার; শিল্প-বাণিজ্য, আধুনিক চিন্তা ও দর্শন সবকিছু তার নিকট মনে হয় এ যেন কোন মানুষের মনোনীত স্বপ্ন। দেশের যন্ত্রণাক্লিষ্ট সন্তানদের শোক ও সন্দেহ, বিস্ময়, সৌন্দর্য ও আনন্দ যুগ যুগ ধরে এদেশের মানুষের চেতনায় নতুন কিছু করার উৎসাহ যুগিয়েছে এবং তাকে আধুনিক জীবন-সংগ্রামের মোকাবিলার ব্যাপারে সর্বদাই যেন চাপের মধ্যে রেখেছে। কলেজের পরিবেশের নিবিড় অস্বচ্ছতার মধ্যেও এ সবকিছু যেন সহসা নতুন করে তার দৃষ্টিগোচর হয়। তরুণ তখন পরিমাপ করতে শুরু করে তার চিন্তা ও অনুভূতির হতবুদ্ধিকর মাত্রাকে। কম-বেশি এরকম উল্লাসজনক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই প্রত্যেক উপস্নাতককে অগ্রসর হতে হয়। তাদের মেজাজ ও বুদ্ধিগত চেতনার প্রভেদ অবশ্যই আছে। এবং কিছুসংখ্যক উপস্নাতকের রোমাঞ্চকাল সংক্ষিপ্ত, তাদের ভেতরের উদ্দীপনার আগুনও শিগগির নিভে যায় জীবনের বাস্তব অবস্থা ও পরিস্থিতির শৈত্য প্রবাহের প্রথম ধাক্কায়।

উপস্নাতকদের মধ্যে নানা ধরনের তরুণের যেন মিলনমেলা। তাদের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছে, যাদের মনের মুকুল কখনও প্রস্ফুটিত হয় না, যাদের আকাঙ্ক্ষা অঙ্কুরেই শুকিয়ে যায়। কঠিন-নীরস পারিবারিক পরিবেশ, অথবা ধূর্ত-চতুর ঘোর সংসারী অভিভাবকের হিসেবী প্রজ্ঞার কাঠিন্য বহু তরুণের উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রস্রবণকে রুদ্ধ করে দেয়। ফলে এই সব তরুণ সারা জীবনের জন্য কঠিন আবরণের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকে। মূল্য জানে বলেই সে শুধু বি.এ. ‘ডিগী’কে মূল্য দেয়। একঘেয়ে নিরানন্দ পরিশ্রমের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় সাফল্য অর্জন করলে তখনই শুধু সে শান্তি পায়। অতঃপর নিঃশব্দে সে সরকারী অফিসের সৎ কর্মচারী অথবা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের কঠিন পরিশমী চাকরিজীবীদের কাতারভুক্ত হয়।

আর এক শ্রেণীর তরুণ আছে, যারা ভাবনাচিন্তাহীন, অপ্রেমিক উপস্নাতক। নিজ চেহারা সম্পর্কে এরা খুঁতখুঁতে, জীবন ও জীবনের সমস্যা সম্পর্কে চিন্তা করতে এরা বিরক্তিবোধ করে। এরা ফ্যাশন দুরস্ত রীতি প্রবর্তন করে এবং কখনো কখনো পোশাকী ফুলবাবুতে অধঃপতিত হয়। এদের কেউ সক্রিয় অভ্যাসে কলেজ জীবনে অতিমাত্রায় কর্মব্যস্ত থাকে। কলেজের অনুষ্ঠান, প্রদর্শনী ইত্যাদিতে তাদের কর্মশক্তি ও নিষ্ঠার পরিচয় পাওয়া যায়। নিজ নিজ চরিত্রের অনাবিষ্কৃত সম্ভাবনায় এসব তরুণ ধারালো ও বুদ্ধিমান। কিন্তু শিক্ষার প্রাথমিক কিছু ত্রুটি তাদের প্রফুল্ল মেজাজের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের সামাজিক বৈশিষ্ট্য অর্জনের স্পৃহাকে ম্লান করে দেয়। তারা তখন খোঁজে জীবনের সেরা জিনিস, আলো ও সরসতা এবং সহজ ব্যক্তিগত বিজয়। তাদের অনেকে ইংল্যান্ড যায়। কারণ তারা বুদ্ধিগত বিষয় অর্জনের সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে তৎপর। পাশ্চাত্যের চাকচিক্যময় পলকা সংস্কৃতিকে তারা বরণ করে নেয়। গভীর অনুরাগে যে শিক্ষা তারা একদা গ্রহণ করেছিল, দেশে ফিরে সে শিক্ষার অনেকটাই তারা ইচ্ছাকৃতভাবে ভুলে যায়। যোগ্য স্বচ্ছল ব্যক্তি হিসেবে সমাজ জীবনে তাদের অনেকে পরিচিতি লাভ করে। আবার এমনও উপস্নাতক আছে, যার কর্ম ও মানসিক শক্তি ক্লান্তিহীন; অভীষ্ট লক্ষ্য সাধনে সে দৃঢ়। তার অধ্যাবসায় ও প্রয়োগ ক্ষমতা উল্লেখ করার মতো। অথচ ভাগ্য তার সব সদ্‌গুণ কেড়ে নিয়ে তার সাথে নিষ্ঠুর প্রতারণা করে। কলেজে তার উপস্থিতি ছিল নিয়মিত, সে কখনো নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছিল বলে জানা যায় নি। সে ছিল অধ্যাপকদের প্রিয়পাত্র, অলস সহপাঠীদের কাছে ঈর্ষনীয়। পাঠ্যবই ছিল তার সম্পদ, তার প্রেম, তার সবকিছু। সে ঘরের মধ্যে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় সম্মান অর্জন করেছিল। চমৎকার স্নাতক ডিগ্রী, প্রশংসা সনদপত্র এবং অধ্যাপকদের শুভেচ্ছা নিয়েই সে যেন পৃথিবীর বুকে পদার্পণ করেছিল। শেষ পর্যন্ত একটি সম্মানজনক সরকারী চাকরি সে লাভ করে। নিজ বৈষয়িক আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সাফল্য-শ্রীবৃদ্ধিও অর্জন করে। নিয়মিত করদাতাদের শ্রেণীভুক্ত হয়ে সে সম্মানিত হয়। বস্তুত সে যা করে বা যা হয়-তা সমাজগত দেশাচারের আধার, রাষ্ট্রের দাবি, এবং বিধান সভার প্রধান বিষয়।

কিন্তু আমরা যে আদর্শবাদী তরুণের ব্যাপারে আগ্রহী সে তরুণ কল্পনা ও বিশ্বাসের সন্তান। সে মূলত আদর্শবাদী। তার মন অবাঞ্ছিত বিশাল রহস্যের রাজ্যে অপার বিস্ময়ে বিচরণ করে; তার অন্তর ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত ভাবনাশূন্য; তুচ্ছ নীরস স্বার্থমুক্ত; তার হৃদয় অনিচ্ছাকৃত অন্যায়ের জন্য দুঃখ প্রকাশে অবারিত। এই তরুণ পক্ষপাতহীন সুবিচার ভালবাসে এবং সত্য ও সুন্দরের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। মুক্ত চেতনা নতুন উপস্নাতকদের কাছে আসে স্বর্গীয় জীবনের উপাদান হিসেবে এবং তা স্থায়ী হয় তাদের ব্যক্তিত্বের ক্ষমতা অনুযায়ী। এ এক বিস্ময়কর তাৎক্ষণিক উদ্দীপনা, মন ও চরিত্রের পরীক্ষা। ভারতবর্ষের চিন্তা, ধারণা, সামাজিক উদ্দেশ্য, পুনর্জীবনের আশা, সন্দেহ-শঙ্কা ইত্যাকার বিবিধ অপূর্ণ অমীমাংসিত সমস্যার এক ক্ষুদ্র জগৎ এই কলেজ। প্রথমাবস্থার মোহভঙ্গের পর কলেজের সুস্থ পরিবেশের প্রেক্ষিতে তরুণরা প্রত্যুষের প্রথম রক্তিম আভা দেখতে পায়। চিন্তা সহজ হয়, কল্পনা ও ধারণা নিঃশব্দে তার মস্তিষ্কে আনাগোনা করে, অনুভূতি পর্যবসিত হয় আকাঙ্ক্ষায়। স্কুলের ছাত্রাবস্থায় তার মনে সম্প্রদায়গত দেশপ্রেমের সঞ্চার হয়েছিল। কলেজ জীবনে সে আবিষ্কার করে সমগ্র নিখিলবিশ্ব, নববিবাহিতা বধুরূপে সে এ বিশ্বকে দাবি করে। তার আবিষ্কারের প্রক্রিয়া দ্রুততর হয়, উদীয়মান যুগের দিকে বিদ্যুৎবেগে তার মন ধাবিত হতে থাকে, পুনরুদ্ধারকৃত স্বর্গের গৌরবে বসবাস করাই যেন তার একমাত্র উদ্দেশ্য। সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি কিছুকালের জন্য হলেও বিশ্বজনীন আবেগের অভ্যন্তরে কঠিন শিলায় রূপান্তরিত হয়। তার প্রথম আবিষ্কার অবশ্য পুস্তকের সীমাহীন জগৎ। সৃষ্টির পর থেকে কী চিন্তা, কী কাজ, কী যন্ত্রণাভোগ করা হয়েছে, তার দ্রুত সংক্ষিপ্ত আভাস এই তরুণ এই সব পুস্তক থেকেই পায়। সে আবিষ্কার করে মানুষ, মানুষের অপরিহার্য ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, তার সুখ-দুঃখ ও সাফল্য। মানুষের দূরদর্শিতার কাছে সে বন্দি হয়। যেন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শান্ত, ক্লান্ত চরণে সে চলমান। দুঃখের ভারী বোঝা, অন্যায় যন্ত্রণাভোগ, নীরস বিষন্নতা, মানুষের স্বার্থপরতা, মানুষের নিষ্ঠুরতা এবং উৎকট লোভ সত্ত্বেও সে চলতে থাকে। সে চলতেই থাকে নাম না জানা লক্ষ মানুষের নির্বাক দিশা সত্ত্বেও যারা বেহিসেবে রাস্তায় মরে পড়ে থাকে, যাদের ভাষাহীন নৈশব্দ আর্তনাদ শোনেন শুধু বিধাতা। পুস্তকের পৃষ্ঠায় নিমগ্ন অন্তরে তরুণ এ সমস্তই অনুভব করে। তবুও সে সেই জাতির দূরবীক্ষণের মধ্য দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তার আস্থা ও আনন্দ ফিরে পায়, যে জাতি সকল দুর্ভাগ্য ও বিরূপ পরিস্থিতির সঙ্গে, সাহসের সঙ্গে লড়াই করে। সে জাতির আশা কখনও অবসাদগ্রস্ত হয় নি, তার অন্তর্নিহিত বিশ্বাস, তার শহীদদের সাহস ও অনুরক্তি, তার সাধু-সন্তাদের দেবদূত সদৃশ পবিত্রতা, চরম দুর্দিনেও যারা কখনো ব্যর্থ হননি, সেই প্রেরিত পুরুষদের আবেগময় আশা-সবকিছুই সতেজ রেখেছিল, জাতির উদ্যমকে তাগিদ দিয়েছিল, জাতিকে তার অভীষ্ট লক্ষে চলতে। অনন্ত রহস্য সম্পর্কে তরুণ তার অনুসন্ধান ও গবেষণা চালায়। তার প্রশ্নের সম্পূর্ণ সুনির্দিষ্ট জবাব সে পায় না বটে, তবু সে নিশ্চিত হয়, এ বিশ্ব বসবাসযোগ্য স্থান, এবং জীবনের সবকিছুই ভুল নয়। তার বিচারবোধ জাগ্রত হয় অতিপ্রাকৃতভাবে, তার স্বপ্নের যথার্থতা উজ্জ্বলতর হয়। আধুনিক জগৎকে সে নিরীক্ষণ করে। এমন নীরস ও অলস লোক সম্পর্কে সে ধৈর্যহীন, যারা মানুষ হিসেবে টিকে থাকতে অন্যায় দুর্ভোগকে সমর্থন করে। অতীত যুগের বৈশিষ্ট্যগুলি অপরিমেয়ভাবে মন্দ ছিল, কারণ তখনকার জ্ঞান-বুদ্ধি ছিল সীমাবদ্ধ। আধুনিক যুগের জ্ঞান-গরিমা এত বেশি সম্ভাবনা-সমৃদ্ধ যে, পূর্বপুরুষেরা তা স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না। তা হলে কি জরাজীর্ণ নির্বুদ্ধিতা ও প্রতিবন্ধকতা রয়ে যাবে? ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদদের আধুনিক চিন্তার আলোকে পৃথিবীর মানুষের জীবনকে পুনর্নিমাণ করতে পূর্ণ বিশ্বাস অথবা সামর্থের প্রয়োজন নেই, কোন তরুণদের পক্ষে এমনটি ভাবা অস্বাভাবিক। আধুনিক সভ্যতার অদ্ভুত অসঙ্গতি, প্রয়োগের নিষ্ফলতা, সমাজগত কল্পনা ও ধারণার উর্বরতা, জীবন-সমস্যার বিশালতা ও তা সমাধানের লক্ষ্যে অপ্রতুল ব্যবস্থা-এসব দেখে তরুণ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের বিষয়টাই ক্ষমতাবান বড় মানুষদের সর্বোচ্চ লক্ষ্য হওয়া উচিত। তাদের পক্ষে এ কাজ তেমন কঠিন নয়। তরুণের প্রশ্ন, তবে তারা কেন তা করছে না? পর্যাপ্ত সুযোগ ও ক্ষমতা থাকলে নিঃসন্দেহে সে নিজেই তা করতে পারত। যেভাবেই হোক, তার গৃহসংলগ্ন এলাকায় তার যা করণীয়, তা করার চেষ্টা সে করবে। ভারতবর্ষের জন্য যে পুনর্গঠিত সমাজের আজ প্রয়োজন, তার স্বরূপ তরুণের চোখে পরিষ্কার ভাসে। তরুণের কল্পনায় এ সমাজে দল-মতের কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে না, বর্ণ বা জাতির কারণে কল্পনাবিধা থাকবে না, থাকবে না দেশাচারের কোন নিষ্ঠুর অবিচার। সমাজ ও ধর্মীয় রীতিতে গজিয়ে ওঠা আগাছার ঝাড়কে নির্মূল করে দেওয়া হবে। প্রত্যেক মানুষ সুন্দর পরিচ্ছন জীবনযাপনের সুযোগ পাবে এ সমাজে। মানুষের নিজস্ব জীবন ও জীবনধারা হবে পূর্ণতার আদর্শ। অতঃপর তরুণ প্রিয়তমা সুন্দরী জীবনসঙ্গিনীর স্বপ্ন দেখে। সে তার আত্মার গভীরতম সঙ্গীতের প্রতি পূর্ণ সাড়া দেবে। ভারতবর্ষের নারীমুক্তির আন্দোলনে নিশ্চয়ই তরুণ সমাজকে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে। শিক্ষা সম্পর্কে তরুণ ভাবনাচিন্তা করে যতই অনিয়মিত হোক পূর্ণ আগ্রহী সে হবে। বণিকদের তার মনে হয়; এরা শুধু পুরানো এলোমেলো, শূন্যগর্ভ প্রলাপ বকে। তার ইচ্ছা, সময় এলে তার ওপর ন্যস্ত দায়িত্বে সে অধিক শক্তি ও উৎসাহ প্রয়োগ করবে।

কিন্তু, তার এই চমৎকার ইচ্ছা বাস্তবে পরিণত হওয়ার আগেই তার দিব্যদৃষ্টি ক্ষীণ হতে শুরু করে, এবং পেছনে কোন চিহ্ন না রেখে এক সময়ে তা চূড়ান্তভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়। যৌবনের স্বপ্ন শুধু প্রেরণাদায়ক অভীপ্সা ও চরিত্রের শেকড়কে লালন করে: আগাম পরিস্থিতির সঙ্গে সেসব স্বপ্নের কিছু সামঞ্জস্য থাকে। আসলে ভারতবর্ষে সমাজ জীবন হতাশাজনকভাবে ঘোলাটে। প্রকৃতপক্ষে, উপস্নাতকদের এসব স্বপ্ন কলাবিদ্যাবিশারদ অথবা বুদ্ধিমান নৈরাজ্যবাদীর উদ্ভট বিমূর্ত কল্পনার বেশি কিছু নয়। এসব স্বপ্ন অন্তর্মুখী আবেগপ্রবণতার বিচ্ছিন্ন পরিমণ্ডলেই শুধু পরিভ্রমণ করে। কঠিন বাস্তবতার প্রথম স্পর্শেই তারা বিলীন হয়ে যায় বিস্মৃতির অতলে। উপস্নাতকদের মোহমুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হয় শ্রেণিকক্ষেই। কেবল পাঠ্যবই তাদের মনের ক্ষুধা মেটাতে সক্ষম হয় না। দুর্ভাগ্যের মূল কারণ হল, কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয় প্রয়োজন অথবা জাতিগত চেতনা ও অভিজ্ঞতার ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। একজন শিক্ষকের শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে তরুণদের শিক্ষা প্রদান অপেক্ষা বেশি কাজ করে শিক্ষকদের রাজনীতি। তিনি তার রুক্ষ আচরণ, সহানুভূতিহীন শিক্ষা পদ্ধতি ও বিরক্তিকর অনুশীলনের মাধ্যমে দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্বকে খর্ব করেন। আর এভাবেই সম্পূর্ণ হয় শিক্ষার্থীর মোহমুক্তির বিষয়। বি. এ. পাশ করার আগেই শিক্ষার্থীর বুদ্ধিজাত আত্মবিশ্বাস ধ্বংস হয়ে যায়। আর এই কাজটা ঘটে বিশেষজ্ঞ শিক্ষাবিদের দ্বারা। এসব বিশেষজ্ঞকে অজ্ঞ ও ভ্রান্ত পদ্ধতির যন্ত্র হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। তরুণ তার স্নাতক সনদ নিয়ে জ্যোতির্ময় ঊর্ধ্বলোক থেকে নেমে আসে সাধারণ মানুষের জগতে,  খুব বেশি হলে ডেপুটি কালেক্টর অথবা হাইকোর্টের উকিল হিসেবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *