নগরায়ন একটি সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সুপরিকল্পিত নগরায়ন ছাড়া কোনো সভ্যতায়ই টিকতে পারে না। মূলত, পরিকল্পিত নগরায়নই সভ্যতাকে পরিপূর্ণতা দান করে। আমরা ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই, বহু বছর ধরে টিকে থাকা সভ্যতাসমূহ তাদের নগরায়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। তারা তাদের নগরকে পরিকল্পিতভাবে সুন্দর করে সাজিয়েছে। নগরকে নাগরিকদের জন্য বালাদিল আমিন তথা নিরাপদ নগরী হিসেবে গড়ে তুলেছে। আর এটা ছিলো প্রতিটি সভ্যতার সাধারণ ঘটনা। তাহলে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে প্রভাবশালী ন্যায়ভিত্তিক আমাদের এই ইসলামী সভ্যতায় নগরায়নের গুরুত্ব কেমন ছিলো? এটা বুঝা যায় বিখ্যাত এই উক্তির মাধ্যমে, “নগরায়ন, নন্দনতত্ত্ব (এ্যাসথেটিক) আখলাকের একটি অংশ, আর নিশ্চয়ই আখলাক হলো ঈমানের অংশ।” অর্থাৎ ইসলামী সভ্যতায় নগরায়ন সরাসরি আখলাক ও ঈমানের সাথে-ই সম্পৃক্ত।
যেকোনো সভ্যতা যখন দুনিয়ার ক্ষমতায় সাফল্যের চূড়ায় অবস্থান করে, তখন সবাই সে সভ্যতাকেই অনুকরণ করতে শুরু করে। মহান আলেম ও দার্শনিক ইবনে খালদুনের তত্ত্ব অনুযায়ী, “বিজিত সর্বদাই বিজয়ীর অনুকরণ করে”। আজ আমরা যেমন পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুকরণ করি, তাদের মতো পোশাক পরি, তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির অনুকরণ করি, তাদের নগরায়ন, শহরের ছবি দেখে কল্পনায় স্বপ্ন বুনতে শুরু করি, একদিন আমাকেও এই ‘ড্রিমল্যান্ডে’ যেতে হবে, ঠিক তেমনি এক সময় আমাদের মুসলিমদেরকে দেখে অন্য ধর্মাবলম্বীরা অনুকরণ করতো, আমাদের মতো হতে চাইতো। নগরায়নের ক্ষেত্রেও আমরাই ছিলাম অন্য সবার মডেল।
হযরত ওমর (রা.)-এর শাসনামল থেকে পরিকল্পিত, পরিচ্ছন্ন নগর তৈরি, শ্রেষ্ঠ ও সুনিপুণ স্থাপত্যের মাধ্যমে নগর সাজানোর যাত্রা শুরু হয়। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, মুসলিম শাসনামলে স্পেনের সেভিল্লা ও আন্দালুসিয়ার মতো শহরগুলো এমন এক অবস্থানে ছিলো যে, পাশ্চাত্যে বসবাসকারী ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা মুসলিমদেরকে অনুসরণ ও অনুকরণ করতো। তারা মুসলমানদের ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করতো, তাদের পোশাক পরিধান করতো, তাদের শহরের অনুকরণে নিজেদের শহর ও ঘরবাড়ি বানাতো। তারা বলতো, “মুসলিমদের নগরীগুলো হলো স্বর্গরাজ্য। এত পরিচ্ছন্ন নগর শুধু স্বর্গেই হতে পারে” (পরিচ্ছন্নতা মুসলিমদের ঈমানের অঙ্গ)।
কর্ডোভার নগরীগুলো ছিলো শহরের রাজা। হারিয়ে যাওয়া স্থাপত্যবিদ্যা ও নগরায়নের স্বাক্ষর এসব শহরে আজও কিছুটা বিদ্যমান। শুধু (তৎকালীন রাজধানী) আন্দালুসিয়াতেই ছিলো ২,০০,০০০ পরিকল্পিত বাড়ি, ৬০০ টি মাদ্রাসা ও মসজিদ, ৮০০ টি হাম্মাম (গোসলখানা), ৫০ টি শিফাখানা (হাসপাতাল), ২৫ টি কাগজের কল, শত শত লাইব্রেরি এবং হাজার স্কলারদের মিলনমেলা। ইনসাফভিত্তিক এ ইসলামী সভ্যতায় পশু-পাখিদের জন্য ছিলো স্বতন্ত্র ব্যবস্থা। পাখির বাসা সমৃদ্ধ বাড়ি ও মসজিদের স্থাপনা দেখলেই তা সহজে বুঝা যায়। এই সভ্যতায় বিল্ডিং স্ট্রাকচার এতো উন্নতমানের ছিলো যে, অন্দরমহলে পর্যন্ত রোদের অভাব হতো না। নারী ও শিশুরা অন্দরমহলে অবস্থান করেই রোদ এবং প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতো। ইসলামী সভ্যতার ঘরগুলোর গুরুত্বের কারণে এলাকাগুলোও তৈরি হতো সুপরিকল্পিতভাবে। এটি ছিলো এ সভ্যতার অন্যতম অসাধারণত্ব। এলাকাগুলো তৈরি হতো মসজিদকে কেন্দ্র করে। মসজিদ ছিলো একইসাথে লাইব্রেরি ও ইন্সটিটিউট। এলাকার মধ্যে কোনো বাজার ছিলো না। বাজার থাকতো এলাকার একেবারে শেষ প্রান্তে। কোলাহলমুক্ত, শান্ত পরিবেশের বিরাট প্রভাব পড়তো নতুন প্রজন্মের উপর। এমন পরিবেশ থেকেই উঠে আসতো যুগশ্রেষ্ঠ মুজাহিদ, মুহাদ্দিস, ফকীহ বা মুজতাহিদগণ।
ইসলামী সভ্যতা যখন দুনিয়ার সর্বোচ্চ শিখরে, তখন আজকের কথিত সভ্যতার দাবীদার পাশ্চাত্য সভ্যতা জানতোই না কীভাবে পবিত্রতা অর্জন করতে হয়, পরিচ্ছন্ন সমাজ গড়তে হয়! পরিকল্পিত নগরায়ন তো কল্পনাতীত!
নগরায়ন ও পরিবেশ; প্রেক্ষিতে ইসলামী সভ্যতা আজও বাগদাদ, কর্ডোভা, সামরকন্দ, বুখারা, ঢাকা, দিল্লির মতো শহরগুলো দুনিয়ার কাছে এক অকল্পনীয় বিস্ময়ের নাম!
বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনার আগে আমরা যদি একবার ইসলামী সভ্যতার ৭শতাব্দীব্যাপী স্বর্ণালী সালতানাতের সময়কালের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাই, উপমহাদেশ এবং বাংলা সালতানাতের শহর ও গ্রামগুলো ইসলামী সভ্যতা প্রদত্ত মূলনীতিগুলোর আলোকেই বাস্তবায়িত হয়েছিলো। প্রকৃতিগত কারণেই বাংলা অঞ্চলের মাটিতে পাথরের দ্বারা নির্মিত স্থাপত্য স্থায়ী হতো না। ফলে বাংলা অঞ্চলে ঘরগুলো নির্মিত হতো সুপারি গাছের কাঠসহ বিভিন্ন কাঠ দিয়ে। এগুলো এত অসাধারণভাবে নির্মিত হতো, যার ফলে তা হয়ে উঠতো ইসলামী সভ্যতার আদর্শ মডেল। এমনকি এগুলোর নির্মাণ খরচ পাথর-মাটি-ইটের স্থাপত্যের চেয়েও অনেক বেশি ছিলো। আবার, পাথরের স্থাপত্যও যখন বানানো হয়েছে, তখনো তা হয়েছে ‘পাথরের মাঝে হাকীকতের রূহ অঙ্কনকারী’ মহান আলেম স্থাপত্যবিদদের পন্থা ও ইসলামী সভ্যতার মূলনীতির আলোকেই। যার সাক্ষী আমাদের দারসবাড়ি, মাদরাসাতুশ শরফগুলোই।
এবার ইতিহাসের পাতা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে, দৃষ্টিকে নিবদ্ধ করি বর্তমানে। আমাদের মাতৃভূমির দিকে। ‘ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ স্বর্ণালী সভ্যতার সন্তান, ‘৯০ শতাংশ মুসলিমের দেশ’-এ বাংলাদেশে পরিবেশ ও নগরের চিত্রটা এখন কেমন? একসময়ের গ্রামভিত্তিক এ দেশে বেশ কয়েক দশক আগে থেকেই শহরের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছিলো। জীবিকার তাড়নায়, সুযোগ-সুবিধার আশায় একদিকে মানুষ দিন দিন শহরমুখী হচ্ছে, অন্যদিকে গ্রামীণ পরিবেশ পরিবর্তন করে শহর তৈরির একটা ধারা তৈরি হচ্ছে। শহরমুখী হওয়ার কারণে শহরের উপর চাপ বাড়ছে। বাড়ছে কলকারখানা, বিল্ডিং, যানবাহন। সৃষ্টি হচ্ছে নানামুখী সমস্যা। এ শহরগুলোতে নেই সুষ্ঠু নগরায়নের কোনো পরিকল্পনা। ঘরবাড়ি, রাস্তা, অফিস, আদালত, শিল্প কারখানার, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস সরবরাহ কোনো ক্ষেত্রেই নেই কার্যকর পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন তো আরও পরের বিষয়! নিয়ম না মেনে যত্রতত্র গড়ে উঠছে একেকটা বিল্ডিং, কারখানা, ফ্যাক্টরি। কোনো জমি ফাঁকা পড়ে থাকতে পারছে না। একটা জমি ফাঁকা থাকলেই দুদিনের মধ্যে সেটা কিনে কিংবা দখল করে শুরু হয়ে যায় সুউচ্চ ভবন নির্মাণের কাজ। আবার যেসব ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে সেগুলোর অবকাঠামোও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছাড়া গড়ে তোলা হচ্ছে। পর্যাপ্ত জায়গার সংকটের কারণে মানুষের প্রাইভেসি রক্ষা করা হয়ে পড়েছে মারাত্মক কঠিন। নেই রোদের দেখা, পর্যাপ্ত আলো বাতাসের নিশ্চয়তা তো রীতিমতো আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া। আকাশ-প্রকৃতির সার্বক্ষণিক সংস্পর্শ থেকে বঞ্চিত এ শহরের মানুষগুলো। টিউবলাইটের কৃত্রিম আলো আর খুপরির অন্ধকারের মধ্যেই তাদের জীবন। যার ফলে চোখে সমস্যা ও অন্ধত্বের হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে বহুগুণে।
আবার, বেশিরভাগ বিল্ডিংয়ের ফাউন্ডেশনেরও নাজেহাল দশা। সামান্য ভূমিকম্পেই অনেক বিল্ডিং হেলে যাচ্ছে। শুধু এক রানা প্লাজার ঘটনায় যেখানে অসংখ্য মানুষ খেটেও দ্রুত উদ্ধার অভিযান চালাতে পারলো না, সেখানে একটা বড়সড় ভূমিকম্প হলে এশহরের কী ভয়াবহ অবস্থা হবে তা কল্পনাতীত! বলা হয়ে থাকে, এদেশের রাজধানী ঢাকায় যদি বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে যে পরিমাণ মানুষ মারা যাবে, তার চেয়ে বেশি মানুষ মারা যাবে দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ে উদ্ধার অভিযান পালনে ব্যর্থ হওয়ার কারণে। আর কেনই বা ব্যর্থ হবে না? এমন অপরিকল্পিত বিল্ডিং, বড়সড় রাস্তা, নিজেদের পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনার অভাব, সুষ্ঠু পরিকল্পনাবিহীন নগর, সর্বক্ষেত্র দুর্নীতি; কোনটা বাদ যাবে?
আমাদের রাস্তাগুলোও সঠিক নিয়ম মেনে, ভালোভাবে গবেষণা করে বানানো হয় না। প্রায়ই দেখা যায়, কোথাও আগুন লাগলে ফায়ারসার্ভিসের গাড়ি পর্যন্ত সেখানে ঢুকতে পারছে না। কারণ, গলির রাস্তাগুলো মোটেও পর্যাপ্ত প্রশস্ত না। এছাড়া, সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে ‘অপ্রশস্ত রাস্তা’ একটা বড় কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞদের কাছে চিহ্নিত হয়ে আসছে অনেক আগ থেকেই। প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে এ সড়ক দুর্ঘটনায় অথচ এ ব্যাপারে আমরা সবাই একদম নির্লিপ্ত। যেনো এটাই হওয়ার কথা! জনগণের জীবন এখন এতটাই সস্তা হয়ে গিয়েছে! অপরিকল্পিত সব ভাঙ্গা রাস্তা, বিশাল বড় গর্ত, ঢাকনাবিহীন ড্রেন, ময়লা-আবর্জনার স্তূপ, কিছুদিন পর পর খোঁড়াখুঁড়ি, জলাবদ্ধতা; আমাদের শহরের রাস্তাগুলোর একদম সাধারণ দৃশ্য। একটু বৃষ্টিতেই ভরাডুবির মতো অবস্থা হয় শহরগুলোর প্রধান রাস্তায়। এমনকি কূটনৈতিক এলাকার রাস্তাঘাটের অবস্থাও এত বাজে যে প্রায়ই তা নিয়ে সংবাদপত্র, টিভিতে প্রতিবেদন হচ্ছে। নদী ও ড্রেনেজ সিস্টেমের সুষ্ঠু কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। যার ফলে বাড়ছে শ্বাসকষ্টের রোগীর সংখ্যা। শহরের খালগুলোতে আবর্জনা ফেলে পানি প্রবাহ আটকে দেয়া হচ্ছে। কিংবা ক্ষমতার জোরে অবৈধভাবে দখল করে ভরাট করা হচ্ছে। ঢাকনাবিহীন ড্রেন কিংবা ম্যানহোল দুর্ঘটনার কারণে প্রতিবছরই অপমৃত্যু হচ্ছে দেশের জনগণের একটা বৃহৎ অংশের। অথচ এসব নিয়ে কোনো টু শব্দও নেই!
অপরিচ্ছন্নতার দিক থেকেও বিশ্বের শীর্ষে রয়েছে আমাদের শহরের রাস্তাগুলো। রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে ময়লা-আর্বজনার স্তূপ। ডাস্টবিনের গন্ধের তীব্রতায় নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। হাঁটার সময় সারাক্ষণই নাক ধরে হাঁটতে হয়। অনেক জায়গায় তো ফুটপাতও নেই। যা আছে, তার অর্ধেক ভরে থাকে এসব ময়লা-আবর্জনা দিয়ে। তাছাড়া, রাস্তায় যে জিনিসপত্র থাকে, রেইলিং, ল্যাম্পপোস্ট, ট্রান্সফর্মার ইত্যাদি ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত করা হয় না। সড়কবাতির জন্য ঠিকই অনেক ভাল বাজেট নির্ধারণ করা হয়, কিন্তু লাগানো হয় নিম্নমানের বাতি। ফলাফল, কয়েক সপ্তাহ না যেতেই বাতি নষ্ট। আর একবার যদি কোনো বাতি নষ্ট হয়ে যায় তা আর মেরামতের কোনো বালাই থাকে না। নেই ‘তার’ ব্যবস্থাপনার কোনো নিয়ম। মাকড়সার জালের মতো সারা রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ তার। রাস্তার সৌন্দর্য যেমন নষ্ট হচ্ছে তেমনি আছে ভয়াবহ বিপদের সম্ভাবনা।
রাস্তা থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে এবার যদি তাকাই পরিবহণ ব্যবস্থার দিকে, কী দেখবো? মেয়াদোত্তীর্ণ ফিটনেসবিহীন গাড়ি, ভাঙ্গা বাস, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর যানবাহনের ছড়াছড়ি দেশের প্রধান শহরগুলোতে। রয়েছে ট্রাফিক জ্যাম। সেটা তো এখন নিত্যসঙ্গী! ট্রাফিক জ্যাম ছাড়া একটা দিন এখন আর শহরের বাসিন্দারা চিন্তাই করতে পারে না। আধা ঘণ্টার পথ যেতে লাগে চার ঘণ্টা! আর এটাই এখন শহরের জনগণের কাছে স্বাভাবিক। আবার এই জ্যামেই মানুষের জীবনের একটি বৃহদাংশ চলে যাচ্ছে! অনর্থক ও অপ্রয়োজনীয় সময় যাচ্ছে পরিবহণের বেহাল দশার দরুন! এ সমস্যা থেকে মুক্তির সমাধানমূলক পরিকল্পনা দেয়ার বদলে এখন আমাদেরকে শেখানো হচ্ছে ‘কীভাবে ট্রাফিক জ্যামের মধ্যে থেকে আমরা আমাদের সময়কে কাজে লাগাতে পারি।’ অথচ আসল যে সমস্যা, ট্রাফিক জ্যাম, তা নিরসনে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই, স্বচ্ছ পরিকল্পনা নেই, কারোর কোনো উদ্যোগ নেই। শহরের এই মারাত্মক সমস্যাটা যেনো খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। যেনো এমনটাই হওয়ার কথা! অসুস্থ রোগী নিয়ে সময় মতো হাসপাতালে পৌঁছাতে না পারা, অনেক আগে বাসা থেকে বের হয়েও পরীক্ষার হলে কিংবা কর্মক্ষেত্রে সঠিক সময়ে পৌছাতে না পারা, যানজটে বসে থাকতে থাকতে অসুস্থ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি এখন প্রতিদিনকার ঘটনা। একাত্তর টিভির ভাষ্যমতে, ২০২১ সালে (২০২১-২২ সেশনে) ট্রাফিক জ্যাম, জলাবদ্ধতার জন্য পদার্থবিজ্ঞান ২য় পত্রের পরীক্ষা দিতে পারেনি বেশ কিছু এইচএসসি পরীক্ষার্থী। শুধুমাত্র যানজটের কারণে কতগুলো শিক্ষার্থীর জীবন থেকে একটা বছর নষ্ট হয়ে গেলো! ভাবা যায়? এ দায় কি রাষ্ট্রপরিচালকদের নয়?
দৃষ্টি নিবদ্ধ করি শিল্প কারখানাগুলোর দিকে। আমরা জানি, নগরের মানুষদের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের জন্য শিল্প কারখানাগুলো প্রতিষ্ঠা করতে হয় নগর থেকে দূরে, এক প্রান্তে। কিন্তু আমাদের দেশে কী দেখতে পাই? যত্রতত্র ঘিঞ্জি এলাকায়, কোনো নিয়ম, মূলনীতি না মেনে শিল্প কারখানাগুলো স্থাপন করা হচ্ছে। এসব অপরিকল্পিত শিল্পকারখানার পাশেই গড়ে উঠছে আবাসিক এলাকা। ছোট কারখানা হলে তো অনেক সময় এক বিল্ডিংয়েই আবাসিকস্থল এবং কারখানা থাকে। এসব এলাকার বাসিন্দারা যে কী ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির স্বীকার হচ্ছে, হয়তো তারা নিজেরাও জানে না। আবর্জনা ডিস্পোজালের সঠিক নিয়ম না মেনে কারখানার বর্জ্যগুলো বলা যায় যত্রতত্রই নিষ্কাশন করা হচ্ছে। যথাযথ নিয়ম তৈরি ও প্রয়োগের বাস্তবায়নে অবহেলার দরুন এর ফল ভোগ করছে পুরো শহরের মানুষ। আবার আবাসিক বিল্ডিংয়ের মতো এ কারখানাগুলোর স্ট্রাকচারও সঠিক নিয়ম মেনে করা হয় না, যার জন্য আশেপাশের সবাই ঝুঁকিতে থাকে। প্রায়ই এসব কারখানায় আগুন লাগার ঘটনা আমাদের চোখে আসে। আগুনে পুড়ে এত এত শ্রমিক প্রতিবছর মারা যাচ্ছে, অথচ তা দেখেও আমাদের হুঁশ হয় না। আমাদের দেশে শ্রমের মূল্য এত সস্তা যে শ্রমিকদেরকে মানুষ হিসেবেই আমরা গণ্য করি না। আমরা দুই দিন মায়া কান্না করি, জাতীয় শোক প্রকাশ করি; তারপর ‘যেই লাউ, সেই কদু’-ই থেকে যায়। খুব বেশি তোলপাড় হয়ে গেলে বড়জোর আর্থিক সাহায্যের নাম করে পুরো বিষয়টা ধামাচাপা দেওয়া হয়। নতুন এক ইস্যু আসে। আমরা সব ভুলে যাই। এরপর আবার এক জায়গায় আগুন লাগে। আবার আমার মায়া কান্না জুড়ে দেই। এভাবেই চলতে থাকে। এই যে সম্প্রতি ‘হাশেম ফুডস লিমিটেড’ এর ‘সেজান জুস’ কারখানায় আগুন লাগলো, এরপর কী হলো, কেউ জানি? দোষীরা আদৌ শাস্তি পেলো? জীবন্ত যে মানুষগুলো লাশ হলো তাদের কতটা কষ্ট হয়েছে কেউ অনুভব করার চেষ্টা করেছে? তাদের পরিবারের খবর কেউ রেখেছে? নামকাওয়াস্তে যে আর্থিক সাহায্যের কথা বলা হয়েছিলো, সে আর্থিক সাহায্য কি তারা পেয়েছে? নাকি শহীদের মর্যাদার আয়াত আর আগুনে পুড়ে মরলে শহীদ এ হাদীস পড়েই দায়িত্ব শেষ। ফলশ্রুতিতে মৌলিক প্রশ্নের স্থলে অপ্রাসঙ্গিক আলাপে আমরা মূল ইস্যু ভুলে যাই। আমাদেরকে এভাবেই ভুলিয়ে দেওয়া হয়।
শিল্পকারখানাগুলোকে কেন্দ্র করে বড় বড় বস্তির সৃষ্টি হচ্ছে। এসব বস্তিতে কোনোভাবেই একজন মানুষের পক্ষে সুস্থভাবে বসবাস করা সম্ভব না। শারীরিক নানা সমস্যা তো হয়ই। তাছাড়া বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার একটা কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে এসব বস্তি। অবৈধভাবে ক্ষমতায় আসা রাজনৈতিক দলগুলো এসব বস্তি থেকে টাকার বিনিময়ে একঝাঁক কিশোর, যুবকদের ভাড়া করে। এই কিশোরেরা পুরো এলাকা জুড়ে ত্রাস সৃষ্টি করে রাখে। মানুষের জান মালের কোনো নিরাপত্তা নেই এখানে।
আমাদের প্রধান শহরগুলোতে গ্যাসের লাইন, পানির লাইনে সমস্যা। রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় দুপুর ১২টার পর থেকে আর গ্যাস-ই পাওয়া যায় না। ওদিকে, ওয়াসার পানি থেকে আসে তীব্র গন্ধ। অনেকেই এই পানি পান করতে পারে না। কিছু দিন পরপরই দেখা যায় ওয়াসার পানিতে ময়লা, পোকামাকড়, লার্ভার ছড়াছড়ি। এসব সমস্যাগুলো রেকর্ড করে, সেগুলো পর্যালোচনা, যাচাই বাছাই করে সমাধান কিংবা সমাধানের জন্য কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় না। অনেক এলাকায় তো ওয়াসার লাইন-ই নেই। সেখানকার বাসিন্দারা ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে ব্যবহার করে। এর ফলে, বাংলাদেশের ভূগর্ভস্থ পানি দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। একটু শুষ্ক মৌসুমেই আর পানি পাওয়া যায় না। অথচ নগরের মধ্যেই এমন ব্যবস্থা থাকা উচিত ছিলো যেখানে নগরের সব মানুষ পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পাবে। সব জায়গায় পানির ব্যবস্থা থাকবে এবং সেটা সহজলভ্য হবে। পানির ব্যবস্থাপনা, ব্যবহৃত পানিকেই আবার যেনো পরিশোধন করে ব্যবহার করা যায় সে সুযোগ থাকবে। কিন্তু, এদেশের মানুষের কাছে এগুলো শুধুই স্বপ্ন।
এখন লক্ষ্য করি স্থাপত্যকেন্দ্রিক সমস্যার ফলে আমাদের শারীরিক ও মানসিক কী কী সমস্যা হচ্ছে? প্রথমেই আসি আমাদের বিল্ডিং স্ট্রাকচারের কথায়। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে পর্যাপ্ত জায়গা নেই, নেই প্রাইভেসি। যার ফলে সংকীর্ণ এ জায়গায় রোদ, আলো, বাতাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সবাই। যার ফলে বড় বড় রোগে আক্রান্ত হচ্ছি আমরা! আমাদের শরীরের সুস্থতার জন্য ভিটামিন-ডি অত্যাবশ্যকীয়। আর এই ভিটামিন-ডি এর প্রধান উৎস সূর্যের আলো। ডাক্তার এবং গবেষকরা জানান, একটি সুস্থ দেহে ভিটামিন-ডি এর পরিমাণের মাত্রা:
0-20: Deficient.
21-29: Insufficient.
30-100: Sufficient.
>100: Toxic.
ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে, ধারণা করা হয়, পরীক্ষা করলে দেখা যাবে এদেশের প্রধান শহরগুলোর বিশেষ করে ঢাকার বাসিন্দাদের অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠীর ভিটামিন-ডি এর পরিমাণ ০৫-১৫। অর্থাৎ, Insufficientও না, একেবারে Deficient. অর্থাৎ, এই শহরের অধিবাসীদের অর্ধেক শারীরিক ভাবে ভয়াবহ অসুস্থতা, অক্ষমতা নিয়ে জীবন পার করছে। আর মানসিক সমস্যা! এই পুরো নগরায়ন ব্যবস্থা-ই বিষণ্ণতার সবচেয়ে বড় কারণ। ইদানীং যে একটা বিষণ্ণ প্রজন্ম গড়ে উঠছে, এটা তো এমনি এমনি হয়নি। ঢাকার বেশিরভাগ এলাকায় খেলার মাঠ নেই। বিনোদনের জন্য পর্যাপ্ত পার্ক নেই। হাঁটার জন্য খোলামেলা জায়গা নেই। শিশুরা খেলাধুলা করতে পারছে না। আকাশ-প্রকৃতির সান্নিধ্য থেকে দূরে অন্ধকার খুপরিতে ফার্মের মুরগির মতো জীবন যাপন করছে শহরের শিশু এবং নারীরা। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর জন্য যে একটু ছাদে যাবে, সে অনুমতিও নেই অসংখ্য বাসায়।
একটা সময় শহরের আকাশে দেখা মিলতো অনেক বিচিত্র পাখির। এই তো, মাত্র কয়েকবছর আগের ঘটনা! অথচ, এখন এসব পাখি কোথায় নাই হয়ে গেলো। সাধারণ পাখিরা একটা নির্দিষ্ট উচ্চতার উপরে উড়তে পারে না। আমাদের এই বিশাল বিশাল বিল্ডিংগুলো পাখিদের স্বাভাবিক উড়ায় বাধা সৃষ্টি করে। এজন্য শহর থেকে পাখি আজ বিলুপ্তির পথে। আমাদের এই শহরগুলো যেমন মানুষের জন্য অনুপযুক্ত তেমনি পশুপাখিদের জন্যও অনুপযুক্ত।
আমরা যে জামা কাপড় পরিধান করি এসব কাপড় ভালোভাবে শুকানোর জন্য প্রয়োজন সূর্যের আলোর। সূর্যের আলো এসব কাপড়ে থাকা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে। কিন্তু এসব শহরে সে সুযোগ কোথায়? যার ফলে সেই জীবাণুযুক্ত জামা-কাপড় পড়েই আমরা দিন কাটাচ্ছি।
এই যে কয়েকদিন পর পরই যত্রতত্র একেকটা বিল্ডিং তৈরি হয়, এসবের শব্দে ‘শব্দ দূষণ’ হয়। আর যেসব এলাকা শিল্পকারখানার মধ্যে সেখানে শব্দ দূষণ কী প্রকটভাবে হয় তার ইয়ত্তা নেই। গবেষণায় দেখানো হয়েছে, এসব এলাকার বাসিন্দারা অন্যদের চেয়ে তুলনামূলক কানে কম শোনে। নগরায়ন ও পরিবেশ; প্রেক্ষিতে ইসলামী সভ্যতা
কোনো এলাকায় যদি নির্মাণের কাজ চলতে থাকে আর ঠিক তার পাশের বাসায় কোনো মারাত্মক অসুখে আক্রান্ত রোগী কিংবা পরীক্ষার্থী থাকে, তখন পরিস্থিতিটা কেমন হয়? একইভাবে মানুষের মেজাজের ভারসাম্যহীনতা, মানুষের মানসিক রোগ, অন্ধত্ব, শ্বাসকষ্ট, বধিরতা, এমনকি ফ্যামিলি ক্রাইসিস-ডিভোর্সের সাথেও যে নগরায়ন জড়িত, তা আমরা কতটুকু জানি? নগর এর ব্যাপারে ইসলামের কি কোনো মূলনীতি নেই? এ নগরকেও কি আমাদের সাজাতে হবে না?
এসব কনস্ট্রাকশনের ধুলাবালি বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ। সাথে আছে ক্ষতিকর যানবাহনের ধোঁয়া। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের বায়ুমান যাচাই বিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজ্যুয়াল’-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় দ্বিতীয়তে অবস্থান করছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। আরেক তথ্য বলছে, ২০২০ সালে বিশ্বে বায়ু দূষণের শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পরিমাপকারী সংস্থা আইকিউএয়ারের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই তথ্য। বায়ুদূষণ নিয়ে গবেষণা করা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস হচ্ছে ধুলাবালি। এর মধ্য দিয়ে অন্যান্য রোগের জীবাণুর পাশাপাশি করোনাভাইরাসের জীবাণু সহজে ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশেষ করে ধূলিকণা মুখে গেলে মানুষ যত্রতত্র থুথু ও কফ ফেলে। তা ধুলার সঙ্গে মিশে হাতসহ নানা মাধ্যম দিয়ে মানুষের শরীরে ঢুকতে পারে। ফলে খুব সহজেই মানব শরীর ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। বায়ুদূষণের কারণে ঢাকা শহরে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে শিশুদের স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দিচ্ছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, বাতাসে ভারী ধাতু ও সূক্ষ্ম বস্তুকণা বেড়ে গেলে ক্যানসার, শ্বাসকষ্ট, স্নায়ুজনিত সমস্যা বেড়ে যায়, বুদ্ধিমত্তা কমে যায়। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার জাতীয় বক্ষব্যাধি ইন্সটিটিউটের তথ্য মতে, প্রতিষ্ঠানটির হাসপাতালে যত রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন তার ৩০ শতাংশ হাঁপানি রোগী এবং প্রতিবছর এ সংখ্যা বাড়ছেই। বাংলাদেশ লাং ফাউন্ডেশন প্রতি দশ বছর অন্তর শ্বাসতন্ত্রের অসুখ সম্পর্কিত জরিপ পরিচালনা করে থাকে। তাতে দেখা গিয়েছে, ১৯৯৯ সালে দেশে ৭০ লাখ হাঁপানি রোগী ছিলো। তার ১০ বছর পর রোগীর সংখ্যা আরও ২০ লাখ বেড়েছে। সম্প্রতি তথ্য অনুযায়ী অ্যাজমায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখ। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫ সাল নাগাদ সারাবিশ্বে এর সংখ্যা ৪০ কোটিতে পৌঁছাবে। এই হাঁপানির প্রধান কী? এই বায়ুদূষণ, ধুলোবালি। দেশের বায়ুদূষণের অবস্থা একদিকে দিন দিন খারাপ হচ্ছে, অন্যদিকে বায়ুদূষণের উৎস দিন দিন বাড়ছে। বায়ুদূষণ রোধের মূল দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। দূষণ ঠেকাতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করেছে বলে জানায় এসব অধিদপ্তর: কিন্তু তা দূষণ কমাতে মোটেও কার্যকরী হচ্ছে না। যানবাহনের দূষণ নিয়ন্ত্রণেও কার্যকর উদ্যোগ নেই বলে জানান পরিবেশকর্মীরা। আর দূষণের অন্যতম উৎস নির্মাণকাজের ধুলা নিয়ন্ত্রণেও কোনো উদ্যোগ নেই। এমন চরম দূষিত একটা পরিবেশে জীবন কাটাচ্ছে এ দেশের মানুষেরা।
এবার আসি ‘পানি দূষণে’। ‘নদীমাতৃক দেশ’ হিসেবে বিখ্যাত এ বাংলাদেশে বর্তমানে অর্ধেকের বেশি নদী দূষিত। ‘এশিয়ান ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট আউটলুক-২০১৬’-র তথ্য অনুযায়ী, “এশিয়া ও প্রশস্ত মহাসাগর অঞ্চলের ৪৮টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষিত বাংলাদেশের নদীর পানি। দূষণের ভয়াবহ শিকার শহরের পার্শ্ববর্তী নদীগুলোও।” বিশেষজ্ঞদের মতে, শিল্প কলকারখানার বর্জ্য, অপচনশীল দ্রব্য, প্লাস্টিক, ফোম, তেল, পোড়া মবিল, পলিথিন, ট্যানারির অপরিশোধিত তরল বর্জ্য ইত্যাদি নদী দূষণের জন্য দায়ী। নদী দূষণের ফলে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। আশপাশের লোকজন যেমন এই দূষিত পানি ব্যবহারে অসতর্কতা অবলম্বন করছে, তেমনি নদীর এই দূষণ এক জায়গায় স্থির থাকে না; প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই দূষণ আমাদের খাদ্যচক্রেও প্রবেশ করছে। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে নদ-নদী, খাল-বিল অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়ার কারণে পানিপ্রবাহের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে; নদ-নদী সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। এতে বর্ষাকালে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি অনেক স্থানে বৃষ্টির পানি জমে ফসল ও বাড়িঘর তলিয়ে যাচ্ছে। ঢাকার বিখ্যাত সব নদী- বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, চাক্তাই প্রভৃতি সবই আজ দূষিত ও মৃতপ্রায়। নদী দূষিত হওয়ার কারণে ওয়াসার লাইন থেকে যে পানি আসছে তাও দূষিত পানি। আর এই দূষিত পানি থেকে গন্ধ আসা, পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়া তো স্বাভাবিক-ই। এভাবে আজ আমাদের দেশে মিঠাপানির উৎসের পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। অথচ আমরা জানি, পৃথিবীতে যত পানি আছে তার ১ ভাগ মিঠা পানি। এই মিঠাপানির উৎস এভাবে হারিয়ে ফেললে সামনের দিনগুলো আমরা প্রকট খাবার-পানি সংকটে ভুগবো।
আবার, এই দূষিত পানি মাটিকেও দূষিত করছে। সঠিক ব্যবস্থাপনা না করেই শহর ও শিল্পকারখানার দূষিত বর্জ্যগুলো যেখানে সেখানে ফেলে দেওয়ার ফলে অনেক সময় শহরের নর্দমার নোংরা পানি যেসব জলাশয়ে পড়ে, সেই সব জলাশয়ের পানি সেচের কাজে ব্যবহারের ফলে মাটির গুণমান নষ্ট হয়ে যায়। শিল্পকারখানার বিষাক্ত পানি দ্বারাও মাটি দূষণ ঘটে থাকে। এছাড়া রাসায়নিক সারের অতিরিক্ত ব্যবহার, প্লাস্টিক, কাচ, আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলা, কয়লা, ইটভাটার ছাই, উৎপাদিত শিল্পজাত বর্জ্যকে সরাসরি ভূমিতে নিষ্কাশন, পরিকল্পিত ভূমি ব্যবহারের অভাব, অতিরিক্ত পরিমাণ বনভূমি ধ্বংস ইত্যাদিও মাটি দূষণের কারণ। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা (FAO) বনবিষয়ক এক প্রতিবেদনে (দ্য স্টেট অব গ্লোবাল ফরেস্ট-২০১৮) বলেছে, বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের সাড়ে ১৩ শতাংশ বনভূমি। অথচ আমরা জানি, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় একটি দেশের মোট আয়তনের তুলনায় বনভূমির পরিমাণ শতকরা ২৫ ভাগ হওয়া অপরিহার্য। বনভূমি পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ (GFW) ও ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইন্সটিটিউট (WRI) এক প্রতিবেদনে বলছে, গত সাত বছরে বাংলাদেশে ৩ লাখ ৩২ হাজার একর বনভূমি উজাড় হয়েছে। এর ফলে কী হচ্ছে? জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন একটি নিয়মিত প্রাকৃতিক ঘটনা। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে যে ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ নিয়ে কথা বলা হচ্ছে, তা মোটেও স্বাভাবিক, সাধারণ কোনো পরিবর্তন নয়। বরং এটি একটি অস্বাভাবিক, ভয়ংকর পরিবর্তন। এর ফলে পুরো পৃথিবী দিন দিন উষ্ণ হচ্ছে এবং গোটা পৃথিবীর, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশসমূহের আবহাওয়ার ধরন এবং ঋতু-বৈচিত্র্য পাল্টে যাচ্ছে। গ্রীষ্মকালে স্বাভাবিকের চেয়ে তীব্র গরম পড়ছে। এই গরম ‘ভাদ্র মাসের ভ্যাপসা গরম’কেও হার মানায়। আবার শীতকালে পড়ছে অতিরিক্ত শীত, যা ‘মাঘের শীত’কেও হার মানায়। এ দুটোর সাথে যুক্ত হয়েছে অস্বাভাবিক অতিবৃষ্টি। গড় বৃষ্টিপাত বৃদ্ধির ফলে ভয়াবহ বন্যার পুনরাবৃত্তি ঘটে চলছে, বঙ্গোপসাগরে বাড়ছে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা। এর ফলে সমুদ্র এবং নদীর তীরবর্তী মানুষেরা ঘরবাড়ি, জীবিকা হারিয়ে বেঁচে থাকার দায়ে শহরে পাড়ি জমাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে শহরের উপর চাপ তৈরি হচ্ছে। শহরে লোকসংখ্যা বাড়ার দরুন বাড়ছে বিল্ডিং, বস্তির সংখ্যা। সৃষ্টি হচ্ছে উপর্যুক্ত সমস্যা। এভাবে একটা দুষ্ট চক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে আমাদের এ প্রিয় মাতৃভূমি।
বলা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে কৃষি ক্ষেত্রে। কৃষি নির্ভর অর্থনীতির দেশগুলোতে পড়ছে বিরূপ প্রভাব। চাপ পড়ছে দেশের অর্থনীতির উপর। আবার, অতিরিক্ত রাসায়নিক সার, কীটনাশক ব্যবহার করার ফলে একদিকে যেমন মাটির উর্বরতা কমছে, মাটি দূষিত হচ্ছে, অন্যদিকে খাদ্যের মানও কমে গিয়েছে। শুরু হয়েছে খাদ্যে সংকট। তাছাড়া ভেজাল খাদ্যে ভরে গিয়েছে এই দেশ। এর প্রভাব পড়ছে আমাদের স্বাস্থ্যে, চিকিৎসা খাতে। অন্যান্য যে কোনো সময়ের চেয়ে মানুষ এখন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। বিভিন্ন দূষণজনিত রোগ তো আছেই, সাথে রয়েছে ভেজাল, অস্বাস্থ্যকর খাবার ও অনিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপনের প্রভাবে সৃষ্ট নতুন নতুন রোগ। অসুস্থ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে হাসপাতালে রোগীর চাপ। তাছাড়া আমাদের নগর সিস্টেম, অপরিষ্কার, অপরিচ্ছন্ন নগর, ড্রেনেজ সিস্টেমের অব্যবস্থাপনা; এসবের প্রভাবেও নানা রোগ প্রকট আকার ধারণ করেছে। নিকট অতীতেও যাওয়া লাগবে না, একদম সাম্প্রতিক ঘটনার দিকে চোখ দেই। চারিদিকে এখন ডেঙ্গুর প্রকট। প্রথম আলোর ১৫ আগস্ট, ২০২১ এর সংবাদ অনুযায়ী, দেশে ডেঙ্গু ও ডেঙ্গুর উপসর্গ নিয়ে রোগীর সংখ্যা ছয় হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে আগস্ট মাসেই এ সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার। ডেঙ্গু আর করোনার সম্মিলিত চাপে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। আক্রান্ত মৃত্যুমুখী মানুষদের একটা সিট দিতে পারছে না হাসপাতালগুলো। স্বাস্থ্য খাতের এই চাপ সরাসরি আঘাত করছে দেশের অর্থনীতির উপর। অর্থাৎ, চিকিৎসা খাত অর্থনীতি খাতকে প্রভাবিত করছে। এভাবে প্রতিটা বিষয় একটি আরেকটির সাথে সম্পর্কিত।
অর্থনীতির বেহাল দশার কারণে দারিদ্র্যতার হার বেড়েছে ব্যাপক। বর্তমানে সরকারি হিসেবেই দেশের ৪২ শতাংশ মানুষ দরিদ্র! পুঁজিবাদী সিস্টেমের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী একদিকে যেমন একটা অংশ গরীব থেকে আরও গরীব হচ্ছে, অন্যদিকে একটা অংশ হচ্ছে ধনী থেকে আরও ধনী। গরীব মানুষের পেটে খাবার নেই। ক্ষুধা তাদের চিন্তা করার সক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। তাই এসব বিষয় নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথাও নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে পৃথিবী মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে, তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, কোনো রকম দু-চারটা খেয়ে বেঁচে থাকা। আর যারা ধনী, ভয়ংকর লোভ এবং স্বার্থপরতায় আক্রান্ত তাদের চিন্তাভাবনা। তাদের মতে, অন্যান্য মানুষের, সমাজের, পৃথিবীর যা ক্ষতি হয় হোক, নিজেদের পেট তো ভরছে। ‘আরও চাই, আরও চাই’- এর প্রতিযোগিতায় তারা ভুলতে বসেছে, যে পরিবেশকে তারা ধ্বংস করে চলছে একদিন সে পরিবেশই তাদের উপর চরম আঘাত হেনে তাদেরকে ধ্বংস করে দিবে। এই দুই শ্রেণির মাঝে রয়েছে মধ্যবিত্ত ক্যারিয়ার শ্রেণি। পুঁজিবাদী সিস্টেমের জাঁতাকলে অর্থাৎ আধুনিক দাসপ্রথায় নিষ্পেষিত হয়ে অন্যান্য দিকে মন দেয়ার আগ্রহ, শক্তি, পর্যাপ্ত জ্ঞানার্জন ও কাজ করার সময় কোনোটাই তাদের থাকে না। তাই আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা করতে করতেই কেটে যায় তাদের জীবন। একটা ভালো ক্যারিয়ার, ভাল বিয়ে, আরামের জীবন-ই হয়ে উঠে তাদের জীবনের লক্ষ্য। আমানতদারিতা, পরিবেশ ও নগরায়ন নিয়ে চিন্তার ফুরসত তাদের নেই। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে ভয়ংকর, ভয়াবহ সমস্যা তৈরি হচ্ছে, সারা বিশ্বব্যাপী তা আমাদের কল্পনাতীত! এর প্রভাব শুধু জলবায়ুর উপরই পড়ছে না, মানুষ, পশুপাখি, পরিবেশ, নগরায়ন, দেশের অর্থনীতি, খাদ্য, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বেকারত্ব ইত্যাদির উপরও এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
অর্থাৎ, আজ এমন সব ভয়াবহ সংকটে আক্রান্ত আমাদের মাতৃভূমি, আমাদের শহরগুলো। নানা সমস্যায় জর্জরিত আমাদের দেশের অবস্থা এখন, ‘সর্ব অঙ্গে ব্যথা, ঔষধ দিবো কোথা’ এর মতো। অথচ এই আমাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো পুরো পৃথিবীর প্রতিটা প্রাণীর জন্য বসবাসযোগ্য দুনিয়া গড়ার! এই আমরা-ই পুরো পৃথিবীকে শিখিয়েছিলাম, শহর কাকে বলে, কীভাবে শহর সাজাতে হয়, পরিবেশকে রক্ষা করতে হয়। যেই আমাদের বিশ্বাস কিংবা ঈমানের অঙ্গ ছিলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, সেই আমরা কীভাবে এমন নোংরা, অপরিষ্কার, বসবাস অযোগ্য শহরে বসবাস করে যাচ্ছি। কেন আজ আমাদের এই অবস্থা? সুন্দর নগর তৈরি কি আমাদের খেলাফতের দায়িত্ব ছিলো না?
“তুমি যদি শহর গড়ে তোলার সময় সেখানে কেমন মানুষ জন্ম নিবে সে চিন্তা না করেই গড়ে তোলো, তাহলে এমন এক প্রজন্ম জন্ম নিবে, যারা তোমার গড়ে তোলা শহরকে ধ্বংস করে দিবে।” ‘ইসলামী সভ্যতার শহর ও স্থাপত্য’ বইয়ের লেখক, প্রখ্যাত স্থপতি উস্তাজ তুরগুত জানসেভের এ উক্তিটি যেনো একটি বড় সতর্কবাণী।
আজ তাই সময় এসেছে প্রিয় মাতৃভূমিকে নতুন করে সাজানোর। সুষ্ঠু, সুন্দর, পরিকল্পিত শহর তৈরি করে পুরো বিশ্বকে দেখিয়ে দেওয়ার। সময় এসেছে একটি সুন্দর পরিবর্তনের। আর এ পরিবর্তন এসব দুর্নীতিবাজ, ক্ষমতালোভী ব্যক্তিদের দিয়ে হবে না। এ পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন একদল আখলাকসম্পন্ন, যোগ্য কিছু যুবক, যারা জানবে, “আমরা কে, আমাদের আসল পরিচয় কী, আমরা কাদের উত্তরসূরি, এ পৃথিবীতে আমাদের দায়িত্ব- কর্তব্য কী?” তারা বিশ্বাস করবে এ পুরো পৃথিবী বিনির্মাণের জন্য তাদেরকে প্রেরণ করা হয়েছে এবং সে লক্ষ্যে তারা আমরণ কাজ করে যাবে।
আজ সেই স্বপ্নময় প্রজন্মের প্রত্যাশায় প্রিয় মাতৃভূমি…