শিউলিমালা একাডেমি

‘নবাব ফয়জুন্নেসা জামে মসজিদ’

ইসলামী সভ্যতার স্থাপনাসমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মসজিদ। বিশ্বের যে প্রান্তেই মুসলমানরা গিয়েছে, সেখানেই তারা নামাজ ও সামাজিক যোগাযোগের কেন্দ্র হিসেবে মসজিদ নির্মাণ করেছে। অধিকাংশ মসজিদই তৈরি হয়েছে স্থানীয় সংস্কৃতি এবং সে সময়ের স্থাপত্যশৈলীর উপর ভিত্তি করে। পাশাপাশি ইসলামী সংস্কৃতির অনন্য বৈশিষ্ট্যসমূহও এসব স্থাপনার মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। মসজিদের মিনার, মিম্বার এগুলোর মাধ্যমে ইসলামের শা’য়ায়িরসমূহও ফুটে উঠেছে। মূলত ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির উত্তরাধিকার নিয়েও যে মানুষ ইসলামের বিশ্বাসে সমৃদ্ধ হতে পারে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের এই মসজিদগুলো তার উদাহরণ।   

মহান আল্লাহ নারী-পুরুষ উভয়কেই খলিফা হিসেবে এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। শুধুমাত্র পুরুষ নয়, বরং নারী-পুরুষ উভয়ই পৃথিবী বিনির্মাণ করার দায়িত্বপ্রাপ্ত। সেই সাথে শুধুমাত্র পৃথিবীই নয়, তারা একে অপরকেও বিনির্মাণ করবে। নারী-পুরুষ উভয়কেই ইবাদত, খেলাফত এবং ইমারত-এ তিনটি মহান দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহ সৃষ্টির সূচনাতেই এ কথা বলেছেন-

إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفة

অর্থ: “আমি পৃথিবীতে আমার খলিফা প্রেরণ করেছি।”

সেইদিক থেকে ইসলামী সভ্যতার প্রতিটি যুগে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও তাদের অতুলনীয় এবং অবর্ণনীয় সব অবদানের সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন, যা আমরা ইতিহাসের পাতা খুললেই দেখতে পাবো। তেমনই, অবদান আর অর্জনে নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণের পাশাপাশি নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অনবদ্য অবদান রেখে গেছেন তিনি।

তার নির্মিত স্থাপনাসমূহের মধ্যে ১০ গম্বুজ বিশিষ্ট অনিন্দ্য সুন্দর মসজিদটি অন্যতম, যা নওয়াব বাড়ি মসজিদ হিসেবে বেশ পরিচিত। রূপজালালখ্যাত লেখিকা নওয়াব ফয়জুন্নেসা ১৯০৩ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। স্থাপত্যকলার বিবেচনায়ও এটি মুসলিম স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন।

কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলার পশ্চিমগাঁও নামক গ্রামে ডাকাতিয়া নদীর তীরে, তার জমিদার বাড়ির পাশে দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদটি নির্মাণ করেন তিনি। তৎকালে এই মসজিদটিতে পুরুষদের সাথে-সাথে নারীদেরও নামাজ পড়ার সুব্যবস্থা রাখা হয়।

পোড়ামাটির লাল ইটের তৈরি এই মসজিদটি দশ গম্বুজ বিশিষ্ট এবং আয়তাকৃতির। এটি দেখতে অনেকটাই সুরক্ষিত প্রাসাদের মত। মসজিদটির বাইরের পিলারগুলো দেখতে অনেকটা মিনারের মতো। গম্বুজগুলোতে সবুজ রঙ দেওয়ার কারনে দূর থেকে দেখতে আরও আকর্ষনীয় লাগে।

মসজিদটির ভেতরের দেয়াল, মিম্বর আর মুয়াজ্জিনের আজান দেয়ার জায়গায় আছে দুই ধরনের টাইলসের কারুকাজ। তৎকালীন টাইলসগুলো ছিল খুব দৃষ্টিনন্দন। দেয়ালের উপরের অংশের টাইলসগুলোতে রয়েছে গোলাপী, সাদা আর নীল রঙের কারুকাজ। আর নিচের দিকের টাইলসে হালকা সবুজ রঙের ডিজাইন। মসজিদে প্রবেশের শুরুতে একটি বড় হুজরাখানা রয়েছে। হুজরাখানার দুপাশে দু’টি কক্ষ রয়েছে যেখানে মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। হুজরাখানা থেকে একটু সামনে গেলে দেখা যায় নবনির্মিত মসজিদ যেটিকে মূল মসজিদের সাথে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। অধিক মুসল্লি হওয়ার কারণে জায়গার সংকটে পড়তে হয় বলে পরর্বতীতে এটি নির্মাণ করা হয়।  মসজিদের ভিতরে পাচঁটি দরজা রয়েছে। তিনটি বড় দরজা; যেগুলো দিয়ে মুসল্লীরা প্রবেশ করে আর দু’টি ছোট দরজা রয়েছে উত্তর-দক্ষিন দিকে।  মসজিদের ছাদে রয়েছে ১০টি গম্বুজ। মাঝখান বরাবর রয়েছে বড় একটা গম্বুজ। এই গম্বুজের চার ধারে মাইকগুলো লাগানো। বড় গম্বুজের চারপাশে আছে মোট ৯টি গম্বুজ। ফয়জুন্নেছা মসজিদের ঠিক দক্ষিণ পাশে নবাব ফয়জুন্নেছা ঈদগাহ্ অবস্থিত। বর্তমান সময়েও প্রতিবছর এখানে দুই ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী মুসল্লিদের সুবিধার্থে একটি পুকুর খনন করেছিলেন। মসজিদটির পাশেই রয়েছে অজু করার জন্য খননকৃত পুকুরটি। মসজিদের দক্ষিণে রয়েছে ফয়জুন্নেছা পরিবারের পারিবারিক কবরস্থান। সেখানে শায়িত আছেন নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী ও তার পরিবারের উত্তরসূরিরা। আজও মুয়াজ্জিনের স্রুতিমধুর আজানের ধ্বনিতে মুসল্লিরা প্রাচীন এই মসজিদে একত্রিত হয়ে এক আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করে।

লাকসাম নওয়াব বাড়ি পরিদর্শনে আসা ভ্রমণপিপাসুদের অনেকেই অনিন্দ্য সুন্দর এ মসজিদে নামাজ আদায় করেন। অনেককে মসজিদটির ছবি ক্যামেরাবন্দি করতেও দেখা যায়। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক ড. মো. আতাউর রহমান বাসসকে বলেন, “মহিয়সী নারী নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী কর্তৃক নির্মিত ১০ গম্বুজ মসজিদটি খুবই সুন্দর। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর তার বাড়িটিকে  আকর্ষণীয় প্রত্নতত্ত্ব পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এজন্য ৩০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বাড়িটির পাশাপাশি মসজিদটিও আরো সৌন্দর্যমন্ডিত হবে।”

আমরা আগেই বলেছি, মসজিদটি প্রতিষ্ঠার সময় এখানে মহিলাদের নামাজের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিলো। কিন্তু সময়ের বহমান স্রোতের সাথে সাথে নারীদের মসজিদে গিয়ে ইবাদত করার সুযোগ হারিয়ে যেতে থাকে। নারীদের মসজিদে যাওয়া নিয়ে নানান যুক্তি-তর্ক শুরু হয়ে যায় এবং বর্তমানে এমন অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, মসজিদ যেন শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে।

এভাবে প্রায় প্রতিটি সমাজে বৃদ্ধা, যুবতী নির্বিশেষে সকল নারী, এমনকি মেয়ে শিশুরাও আস্তে আস্তে মসজিদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো, বনী ইসরাইলরা নারীদেরকে মসজিদে প্রবেশ করতে দিতো না, তখন নারীদের জন্য মসজিদ নিষিদ্ধ ছিলো। আল্লাহ বনী ইসরাইলের এ প্রথা পরিবর্তন করে দেন হযরত মরিয়ম (আ.)-এর মাধ্যমে। তার মা তাকে মসজিদের জন্য ওয়াকফ তথা উৎসর্গ করে দেন, এমনকি তিনি মসজিদেই লালিত-পালিত হন। হযরত মরিয়ম (আ.)-এর মাধ্যমে সূচিত নারী এবং মসজিদের মধ্যকার এ সম্পর্ক মুসলিম নারীদের জন্য রেখে যাওয়া একটি অসাধারণ উত্তরাধিকার। এ উত্তরাধিকার আমাদেরকে ধারণ করতে হবে এবং লালন করতে হবে, এমনকি আমাদের পরবর্তী বংশধরদের জন্য এ ধারাকে জারি রাখতে হবে।

ইসলামী সভ্যতার প্রাণ ফিরিয়ে আনতে হলে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধারণ করে আমাদের স্থাপনাগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব। যে মসজিদের স্থাপত্যশৈলীর সুনাম বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবাইকে মুগ্ধ করেছিল, মসজিদের আজানের সুর প্রত্যেক হৃদয়ে ইসলামের জয়গান গেঁথেছিল, সেগুলোর মাঝে আবারো সেই রূহ ফিরিয়ে আনা আমাদের দায়িত্ব। সেইসাথে আমাদের মসজিদের দরজাগুলো প্রশস্ত করে দেয়াটা আজ সময়ের দাবি।

সংকলক:  আইরিন সুলতানা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *