শিউলিমালা একাডেমি

সংকটকালীন পরিস্থিতিতে নারীদের ভিশন; প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ

বাংলাদেশের নারীদের সংকট নিয়ে ভাবতে ভাবতে ফাহমিদাকে জিজ্ঞেস করলাম, জীবনের লক্ষ্য কী?

ফাহমিদা সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। জীবনের লক্ষ্য তার কাছে বয়ে যাওয়া স্রোতের মতো। কোনো লক্ষ্য বা পরিকল্পনা নেই, বা এটা থাকা যে গুরুত্বপূর্ণ, তাও যেন জানা নেই।

জীবনকে নিয়ে এমন উপলব্ধি কি শুধু ফাহমিদার সাথেই ঘটছে?

নারীদের সার্বিক অবস্থা চিন্তা করলে করলে দেখা যায়, নারীরা সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাক্ষেত্রসহ সব দিক থেকেই পিছিয়ে আছে। নারীরা নিজেদের আত্মপরিচয় অর্জন করতেও আজ ব্যর্থ। এই পিছিয়ে পড়া জীবনের সূচনা কিন্তু বর্তমানে এসে হয়নি। পূর্বের সভ্যতাগুলোর দিকে যদি লক্ষ্য  করি, তাহলে দেখবো, যেসব সভ্যতা বা যে গোষ্ঠী নারীদের বাদ দিয়ে এগিয়ে যেতে চেয়েছে, তারা বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি।

প্রাচীন একটি প্রবাদ আছে, “কোনো সভ্যতার দিকে যদি তুমি তাকিয়ে দেখতে চাও যে, ঐ সভ্যতার সামগ্রিক অবস্থা কী, তবে ওই সভ্যতার নারীদের দিকে তাকাও। তাদের সামাজিক অবস্থান, শিক্ষা, অধিকার ও মর্যাদার দিকে তাকাও।”

এদিক বিবেচনায় সমাজ বিনির্মানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নারীদের অবস্থান কেমন?

প্রথমত, শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে উচ্চ শিক্ষার হার কম। অধিকাংশ নারী উচ্চ শিক্ষার গণ্ডি পেরোতে পারেন না।  বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে  অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থী মাত্র ৩৬ শতাংশ। অন্যদিকে, বিজ্ঞান ও গবেষণায় নারীর অংশগ্রহণ ২৮ শতাংশ হলেও গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাত্র ১৭ শতাংশ নারী। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় শতকরা ৪৯.৫০ শতাংশ ছাত্রী। মাধ্যমিকে এ হার ৫৪.৬৭ শতাংশ এবং উচ্চ মাধ্যমিকে ৫১.৮৯ শতাংশ হলেও সবচেয়ে কম উচ্চশিক্ষায়; যা শতকরা হিসেবে মাত্র ৩৬.৩০ শতাংশ। বর্তমানে দেশে মোট ২,০২,৩৪,৬৪৬ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১,০৩,০৯,৭৮৩ জন, শতকরায় যা ৫০.৯৫ শতাংশ। অন্যদিকে, উচ্চশিক্ষায়তনে মোট নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪,৪৭,৭৪৪ জন। ইউজিসির ২০২০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ব্যানবেইস বলছে, দেশে ১৬০ টি সরকারি-বেসরকারি এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষকের সংখ্যা ২৯% এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৬%।

দ্বিতীয়ত, চাকরির ক্ষেত্রে বর্তমানে সরকারি চাকরিতে নারীদের অংশগ্রহণ মাত্র ২৮ শতাংশ।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সরকারি চাকরিজীবীদের তথ্যসংক্রান্ত ‘স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফস’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশে সরকারি নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর হার সীমাবদ্ধ রয়েছে ২৭ থেকে ২৮ শতাংশের মধ্যেই। প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, বিসিএসের মাধ্যমেও চাকরিতে নারীদের হার খুব একটা বাড়ছে না এবং শীর্ষস্থানীয় ও নীতিনির্ধারণী পদে নারীর অংশগ্রহণ এখনো অনেক কম। সরকারের ৭৭ জন সচিবের মধ্যে নারী মাত্র ১০ জন। আর বর্তমানে দেশের ১৫ লাখেরও অধিক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে নারী ৪ লাখ ১৪ হাজারের মতো।

এক্ষেত্রে আলোচনায় আসে মুসলিম ঘরানার পক্ষ থেকে নারীদের বর্তমানে বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থায় পড়াশোনা এবং চাকরির ব্যাপারে অনুৎসাহিতকরণের প্রসঙ্গ। কিন্তু এ শিক্ষাব্যবস্থায় উচ্চতর পড়াশোনার সুযোগ না পাওয়া নারীরা যে মৌলিক জ্ঞানগুলোও অর্জন করার সুযোগও পাচ্ছে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, তা কিন্তু সুস্পষ্ট। বরঞ্চ দরিদ্রতা, অব্যবস্থাপনার শিকার পরিবারগুলোতে নারীদের অবস্থা শোচনীয়।

তৃতীয়ত এ আলোচনায় যদি আসি, এখনো শুধুমাত্র বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লক্ষ নারী পেটের দায়ে পতিতাবৃত্তি করছে। সরকারি হিসেব অনুযায়ী  বাংলাদেশে ১৪টি যৌন পল্লি আছে, কিন্তু ভাসমান ও অস্থায়ী যৌনপল্লীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। ২০২০ সালের গবেষনা অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ২ লক্ষ নারী যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করেন। ২০০৪ সালের United Nations Children’s Fund (UNICEF) এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ১০,০০০ অপ্রাপ্তবয়ষ্ক মেয়ে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করে। তবে আরো অন্যান্য পরিসংখ্যান অনুযায়ী এর সংখ্যা ২৯,০০০।

“সেভ দ্য চিলড্রেন”এর ২০১৫-২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকায় সড়ক, বাসস্থান ও হোটেলভিত্তিক নারী যৌনকর্মী ১৯,২৯৪ জন, যাদের মধ্যে ৮,২৩৮ জন ভাসমান যৌনকর্মী।

“দ্য ডেইলি স্টার বাংলা” তাদের ২০২২ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ২৯টি যৌনকর্মী সংগঠনের প্ল্যাটফর্ম “সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্ক” এর (এসডব্লিউএন) সাধারণ সম্পাদক আলেয়া বেগম লিলিও একই ধরনের তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমার সূত্রের খবর অনুযায়ী, নতুন অনেকেই এখন এ কাজে আসছেন। আমার মনে হয়, মহামারীর কারণেই অনেকে গ্রামে ফিরে গিয়েও কোনো কাজ পাননি, আবার এখন চাকরি পাওয়াও কষ্টসাধ্য, তাই তারা এ পেশায় আসছেন।”

যৌন কাজে থাকা এই মানুষদের মধ্যে ৭৫% যৌনকর্মীর  বয়স ১৩ থেকে ২৫ বছর। যৌনকর্মী হিসেবে তাদের পেশার জন্য তারা অন্য কোনো পেশায় চাইলেও যেতে পারেন না, এর কারন হলো সামাজিক দায়বদ্ধতা। কিন্তু লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো এ সকল যৌনকর্মীর অর্ধেকেরও বেশি এ কাজে যুক্ত হয়েছে দরিদ্রতা, অর্থনৈতিক দৈন্যদশা, কর্মসংস্থানের অভাব, শারীরিক নির্যাতন ও ধর্ষণ এবং শিশু ও নারী পাচারের কারণে।

চতুর্থত, যে নারীরা এ পথে না গিয়ে বিদেশে পরিচারিকার কাজ করছেন অন্নসংস্থানের তাগিদে, তারা কেমন আছেন?

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে রেমিট্যান্স খাত। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে রেমিট্যান্স উপার্জনে বিশ্বে ৮ম অবস্থানে বাংলাদেশ।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ২০২০ থেকে ২০২২ সালের তথ্য বলছে, এই তিন বছরে ৪০৪ জন নারী শ্রমিকের লাশ দেশে এসেছে। তাঁদের মধ্যে ২২৭ জনের ক্ষেত্রে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ লেখা ছিলো। ব্র্যাকের পরিসংখ্যান বলছে, বিদেশে গিয়ে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ হওয়া নারী শ্রমিকদের বেশির ভাগের বয়স ছিল ৪০ বছরের কম।

শ্রমিকদের বিদেশ যাওয়ার আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক। তাঁদের বড় বা জটিল কোনো রোগ থাকলে স্বাস্থ্য পরীক্ষাতেই পাওয়ার কথা। তাই মৃত্যুর সনদে থাকা ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ নিয়ে সন্দেহ করছেন মারা যাওয়া শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যরা।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক দেশে আসা নারী শ্রমিকদের লাশের তথ্য আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করে। সংস্থাটির তথ্য বলছে, ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সাত বছরে ৭১৪ নারী শ্রমিকের লাশ দেশে এসেছে। তাঁদের মধ্যে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’র সনদ লেখা লাশের সংখ্যা ২৬২। আর ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৩ বছরে ৩১৯ জন নারী শ্রমিকের লাশ দেশে আসে। তাঁদের মধ্যে ২২০ জনের ক্ষেত্রে লেখা ছিল ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’।  বাংলাদেশ থেকে অধিকাংশ নারী প্রবাসীরা কাজের জন্য মধ্যপ্রদেশের দেশ জর্ডান, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, লেবানন, যুক্তরাজ্য ও মরিশাসে যাচ্ছেন এবং এ সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এছাড়া মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইতালি, হংকং, সাইপ্রাস ইত্যাদি দেশেও নারীরা কাজ করতে যাচ্ছেন। কিন্তু নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখনো সম্ভব হচ্ছে না। এ সকল দেশে নারীরা অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, ধর্ষন, নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এদের মধ্যে অনেকে গর্ভধারন করছেন। এক সময় তাদের দেশে ফিরে আশার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়। নারীরা যারা প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে দেশের বাহিরে যাচ্ছেন, তারা দরিদ্র পরিবার থেকে যাচ্ছেন। কিন্তু নিরাপত্তার অভাবে ফিরে আসা প্রবাসীদের পরিবারগুলোতে আর্থিক ক্ষতির দায়িত্ব কি কেউ নিচ্ছে? কিংবা যারা মৃত্যুর সম্মুখীন হচ্ছে এর সমাধানে কী কাজ হচ্ছে?

পঞ্চমত, গার্মেন্টেস ক্ষেত্রে নারীদের সংকট কী?

গার্মেন্টসে নারীশ্রমিক দিনে ৮-১০ ঘণ্টা কাজ করছে। কিন্তু সে তুলনায় তাদের মজুরি থাকে খুব স্বল্প। বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নারী শ্রমিকদের হার দিন দিন কমছে। পোশাক শিল্পে নারীদের অবদান উল্লেখযোগ্য বলে তুলে ধরা হলেও নারীরা নিজেদের কর্মক্ষেত্রে নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও এক্ষেত্রে দেখা যায় না। এছাড়া অর্থনৈতিক দিক থেকেও বৈষম্য করা হয়।

ষষ্ঠত, বাংলাদেশে ধর্ষন ও নির্যাতনের হার কত?

আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০২৩ উপলক্ষে ৬ই মার্চ (সোমবার) ‘মিডিয়া অ্যাডভোকেসি’ শীর্ষক এক সভায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লাইট হাউস জানায়, ‘দেশে ২০২২ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪,৩৬০ জন নারী। এর মধ্যে ৪৫০ জনকে  ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। একইসময়ে সারা দেশে সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৯,৭৬৪ জন নারী।’

শুধু যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২,৬৭৫ জন নারী। যৌতুক না পেয়ে আবার এদের ১৫৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এ সময়ে অপহরণের শিকার হয়েছেন ১৫৫ জন।

নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো গুরুতর না হলে সেগুলো গণমাধ্যমে আসে না। তাই অনেক সময় নারী নির্যাতনের খবরগুলো চাপা পড়ে যায়।

২০২২ সালে The Daily Star এর একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে দেশে প্রায় ৮৭ শতাংশ নারী জীবনে অন্তত একবার হয়রানির শিকার হয়েছেন। ২৪টি জেলার ৫ হাজার নারীর ওপর চালানো একটি জরিপ থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়।

সপ্তমত, বাংলাদেশের ৪৫ শতাংশ নারী কেন অপুষ্টির শিকার।

২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ১ কোটি ৭০ লাখ নারী অর্থাৎ দেশের ৪৫ শতাংশ নারী অপুষ্টির শিকার।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আগে প্রকাশিত ‘অপুষ্টিতে আক্রান্ত এবং উপেক্ষিত: কিশোরী ও নারীদের মধ্যে বৈশ্বিক পুষ্টি সংকট’ (Undernourished and Overlooked: A Global Nutrition Crisis in Adolescent Girls and Women) শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ২৪ শতাংশ পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু স্টান্টিং বা খর্বাকৃতির। আর এর জন্য দায়ী বিভিন্ন বিষয়গুলোর মধ্যে মায়ের অল্প বয়সে বিয়ে ও গর্ভধারণ, তার ‍শিক্ষার অভাব এবং অপুষ্টি অন্যতম। বাংলাদেশে ১২-৪৯ বছরের নারীদের মধ্যে ১২ শতাংশেরই ওজন তাদের বয়স ও উচ্চতার তুলনায় কম। এছাড়া, বাংলাদেশে গর্ভবতী নয় এমন প্রজননক্ষম মহিলাদের মধ্যে উচ্চ মাত্রার মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের ঘাটতি রয়েছে।

বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হারও তুলনামূলক বেশি। জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক সংস্থা ইউএনএফপিএ-র সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাল্য বিয়ের ক্ষেত্রে এখন এশিয়ার দেশ গুলোর মধ্যেই শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি, ২০২৩-এ ২০০৬ থেকে ২০২২ সালের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়েছে বয়স ১৮ হওয়ার আগেই বাংলাদেশের ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ১৫ বছর বা তার কম বয়সি মেয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিয়ের হার ২৭ শতাংশ। এর অন্যতম কারন হচ্ছে দরিদ্রতা ও নিরাপত্তার অভাব। 

এ থেকে বুঝা যায়, পরিবার,সমাজ ও রাষ্ট্র নারীর নিরাপত্তা, নারীর অবস্থান তৈরির ক্ষেত্রে কতটুকু ভূমিকা রাখতে সক্ষম। বর্তমান সময়ে পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাব থেকে রক্ষা করার নামে এক পক্ষ নারীকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখতে গিয়ে মানুষ হিসেবে তাদের মৌলিক অধিকারগুলো থেকেও বঞ্চিত করছে, আরেকপক্ষ পাশ্চাত্যের আদলে নারীদের শোষন করে ভোগবাদের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে। আজ প্রতিনিয়ত নারীরা পূঁজিবাদী সভ্যতার নানা অন্যায় ও ষড়যন্ত্রে নিপতিত।

নারীর সম্মান, মর্যাদা, অধিকার আদায় শুধুমাত্র গোল টেবিলের আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকে। কেন এই অবক্ষয়?

সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের প্রসঙ্গে বর্ণবাদী আচরণ কখনো একটি আখলাকী, ইনস্যানিয়াতের সভ্যতা তৈরি করতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম ব্যতীত কোনো সভ্যতা নারীদের সম্মানজনক মর্যাদা দিতে পারেনি। ইসলামী সভ্যতা ছিলো ব্যতিক্রম। ইসলাম শুধুমাত্র কোনো জাতি কিংবা কোনো নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত নয়। বৈষম্যমূলক আচরণ  ইসলামে কখনোই স্থান পায়নি। বরং ইসলামী সভ্যতা এমন এক সভ্যতা, যে সভ্যতার সামগ্রিক অবস্থানের  সামনে অন্য কোনো সভ্যতার তুলনা সম্ভব নয়।

বিদায় হজ্বের ভাষণে রাসূল (সা:) দ্বীনকে পূর্ণতা দান করে যে ভাষন প্রদান করেন, সেখানে রাসূল (সা:) ভাষনে প্রথমত বলেন, শিরক করো না। দ্বিতীয়ত, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা নিষিদ্ধ। তৃতীয়ত, সুদ থেকে বিরত থাকো। চতুর্থত বলেন, তোমরা নারীদের সাথে সদ্ব্যবহার করো।

আজ মুসলিম ঘরাণা থেকে নারীদের সাইকোলজি নিয়ে প্রশ্ন করা হয়, নারীদের আকল কম, দূর্বল এবং নারীকে ফেতনার সাথে তুলনা করা হয়। অথচ ইসলাম কখনোই সমাজের সাথে নারীর বৈষম্যমূলক আচরণকে অনুমোদন করেনি।

ইসলামী সভ্যতায় এর নজির পাওয়া যায়। ইসলামী সভ্যতার সূচনাকালে রাসূল (সা:) কে সঙ্গ দেওয়া প্রথম ব্যক্তি হচ্ছেন হযরত খাদিজা (রা:)। ইসলামে প্রথম শহীদ নারী সুমাইয়া (রা:)। হিজরতের সময়কালে মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য অংশই ছিলো নারী। আকাবার বায়াত গ্রহন করার সময় রাসূল (সা:) নারী এবং পুরুষ উভয় থেকেই বায়াত গ্রহন করেন।

হিজরতের পর মসজিদে নববীকে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিনত করা হয়। তখন নববীতে সর্বদাই নারীদের উপস্থিতি লক্ষনীয় ছিলো। এ থেকে বুঝা যায়, সভ্যতা বিনির্মানে  নারীরা শুরু থেকে তাদের উপস্থিতি জানান দিয়েছিলো।

সভ্যতা গঠনে নারী এবং পুরুষের জাতির স্বার্থে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সে জন্য স্বর্ণালী সভ্যতাকে পুনরুজ্জীবিত করতে, নারীকে তার আত্মমর্যাদা অর্জন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, খিলাফতের দায়িত্ব শুধুমাত্র পুরুষের উপরই নয় বরং সমভাবে নারীর উপরও। তাই উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থে নারী ও পুরুষকে একই সাথে কাজ করতে হবে।

ইসলামী সভ্যতার শুরুর দিককার রাহবার হযরত আয়শা (রা:)। তিনি রাষ্ট্রীয় অঙ্গনে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি মদীনাকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপদান করছিলেন। একাধারে তিনি ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ বাগ্মী, ফকিহ, চিকিৎসাবিদ, মুফাসসির। রাসূলের পর তৎকালীন মদিনার নারীসমাজের প্রধান শিক্ষক ছিলেন হযরত আয়শা (রা:)। নারীদের ব্যাপারে তার দৃষ্টিভঙ্গি, মহিলাদের কর্মপন্থা নিয়ে প্রচুর জ্ঞানভান্ডার রেখে গিয়েছেন। আমরা এড়িয়ে গেলেও ইতিহাস তাকে আজও শ্রদ্ধার সাথে স্মরন করে। শুধুমাত্র মহিলা অঙ্গনেই তার পদচারণা ছিলে না তিনি রাষ্ট্রীয় কাজেও ছিলেন অসামান্য।

ইসলামী সভ্যতার ইতিহাস ঘেটে দেখুন। অসংখ্য ফাতিমা আল ফিহরী, মরিয়ম আল ইজলিয়াহ এর মাধ্যমে আমাদের স্বর্ণালী সভ্যতা তৈরি হয়ে আছে। অথচ অসংখ্য নাম আজ অচেনা। ইসলামী সভ্যতার কথা আসলে “নিজাম-উল-মুলক’ এবং আল বাত্তানী ইসমাঈলীর নাম যেমন উচ্চারণ করি তেমনি আমরা ফাতেমা আল ফিহরী ও জ্যোতির্বীদ আল ইজলিয়াহ-আল-আস্ট্রোলাবির নাম উচ্চারণে বাধ্য। দশম শতাব্দীতে সুতায়তা আর রাহমানি পাটিগণিতকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নিত করেন। তার সবচেয়ে বড় আবিস্কার হলো বীজগনিতের Solution To Equations এর আবিষ্কার। তিনি ইসলামী আইনে সম্পত্তির ভূমি জরিপ ও বন্টনের যে গানিতিক বিদ্যা সেক্ষেত্রে ও তিনি অসামান্য অবদান রাখেন এবং সমাধান করেন।

১২ শতাব্দীতে আব্বাসী খেলাফতের সময় ফিকাহবিদ হিসেবে যাকে সবার আগে স্থান দেওয়া হতো, তিনি হচ্ছেন ‘জয়নব আল শাহদা’। তিনি একই সাথে একজন ক্যালিগ্রাফার ছিলেন।

ইমাম আবু হানিফা (রহঃ), ইমাম বুখারীর (রহঃ) মহিলা ওস্তাদ ছিলেন।

ঘর থেকে যেসকল যোদ্ধা বের হয়ে হাজারো বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন, জ্ঞানের বিপ্লব সাধন করেছেন, তাদের ইমানী চেতনা ভিত্তির কারিগরই ছিলেন নারী।

এই মহীয়সী নারীরা কি বর্তমান সময়ের হাজারো তরুণীদের প্রেরণা হতে পারে না?

ইসলামী সভ্যতায় বাংলা অঞ্চলের নারীরা নিজেদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক, শিক্ষা ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিকশিত করে নিজেদের সমৃদ্ধির উচ্চ শিখরে নিয়ে গিয়েছিলেন।

বাংলা অঞ্চলে সুফিয়া বিবি, আজিজান বাঈ, ভূপালের বেগম ও নাজিমুন্নেসা সহ উল্লেখযোগ্য মহীয়সী নারীদের জ্ঞান ও মুক্তির আন্দোলনে অবদান ছিলো সংগ্রামমুখর। বর্তমান সময়ে নারীদের সমাজের অবস্থা বুঝতে হবে এবং ভিশনারী পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে।

সংকটকালীন পরিস্থিতে নারীদের ভিশন হওয়া উচিত –

<> বর্ণবাদী বা লিঙ্গবাদী দৃষ্টিভঙ্গী আচরণকে বিশ্লেষণ না করে মানুষ বা ইনসানের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে আলোচনা করা উচিত।

<> নিজেকে আল্লাহর প্রতিনিধি বা একজন খলিফা হিসেবে তুলে ধরা ও পৃথিবী বিনির্মাণ করা।

<> ক্বলবকে নতুন করে বিনিমার্ণ করা।

<> ইতিহাসকে ভালভাবে অধ্যয়ন করা, নতুন একটি সাহিত্য চিন্তার প্রয়োজন। যার উপর ভিত্তি করে প্রচেষ্টা চালাতে হবে।

<> জয়নব বিবি, ফতিমা জিন্নাহ, রাজিয়া খাতুনের মতো মুসলিম মহীয়সী নারীদের জানার চেষ্টা করা ও তাঁদেরকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নেওয়া, অনুসরণ করা।

<> শক্তিশালী আন্দোলন ও সার্কেলের সাথে যুক্ত থাকা।

<>ফিমেল স্কলার হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলা, তথা আন্তর্জাতিক মানের স্কলার হওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালানো।

<> তাযাক্কুর বা অতীতকে স্মরন এবং তাদাব্বুর বা ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা করার জন্য শক্তি করায়ত্ব করতে হবে।

নারীরা ভিশনারী হয়ে যদি জেগে উঠতে না পারে, তবে কখনোই এ গভীর সংকটের নাগপাশ থেকে মুক্তি পেয়ে স্বস্তির হাসি হাসা সম্ভব হবে না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *