শিউলিমালা একাডেমি

পাশ্চাত্যের তথাকথিত নারী স্বাধীনতা বনাম ইসলামে নারীর মর্যাদা ও অধিকার

১. বিগত তিনশো বছর থেকে পাশ্চাত্য সভ্যতা সারা বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করে আছে। এখন বলতে গেলে সর্বত্র প্রায় তার একচ্ছত্র আধিপত্য। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি মুসলিম দেশগুলোতেও কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। পাশ্চাত্যবাদ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাপনায় বিরাট পরিবর্তন সাধন করেছে। পাশ্চাত্য সমাজে নারী ছিল গৃহকোণে আবদ্ধ, পুরুষের সেবাদাসী, সব রকমের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার থেকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত এবং দেশের ও রাষ্ট্রের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। সবচেয়ে শোষিত, বঞ্চিত ও নিগৃহীত শ্রেণী হিসেবেই তাকে দেখা হতো। কিন্তু শিল্পবিপ্লব ও ইউরোপের দেশগুলোর বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক প্রাধান্য বিস্তারের ফলে পাশ্চাত্য সমাজে বহুকাল ধরে নিগৃজূত নারী গৃহ অংগনের বাইরে চলে আসে। নারীরা পুরুষের সমান অধিকারের দাবীতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। পুরুষের আরোপিত বাধা-নিষেধের সমস্ত বেড়াজাল ছিন্নভিন্ন করে তারা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে পুরোপুরি অংশগ্রহণ করতে থাকে। নিজেদের অর্থনৈতিক দায়িত্বের বোঝা পুরোপুরি নিজেদের কাঁধে তুলে নেবার ফলে তাদের সামাজিক ও সাংসারিক দায়িত্ব পালন বাধাগ্রস্ত হতে থাকে। অর্থনৈতিক দায়িত্ব গ্রহণ করার সাথে সাথে সামাজিক ও সাংসারিক দায়িত্বও তারা পুরুষদেরকে সমান ভাগে ভাগ করে দিতে চায়। কিন্তু এই অস্বাভাবিক কর্মকান্ডে সমঅধিকার ও সমদায়িত্বের ধ্বজাধারী পুরুষরা পিছিয়ে পড়ে। ফলে সংসার জীবনে ভাঙন ধরে।

তাছাড়া মেয়েরা স্বাধীন অর্থোপার্জনের ক্ষমতা লাভ করার সাথে সাথে নিজেদেরকে সামাজিক ও সাংসারিক উভয়ক্ষেত্রে কর্তৃত্বশালী হিসাবে দেখতে শুরু করে। এক্ষেত্রে পুরুষের কোনো প্রকার প্রাধান্য স্বীকার করতে তারা প্রস্তুত হয় না। কিন্তু পাশ্চাত্য পুরুষ তাদের হাজার হাজার বছরের প্রধান্য এক নিমেষে ধুলিস্মাত করে দিতে রাজী হয় না। ফলে সংসার জীবনের ভাঙনটা দ্রুত প্রসারিত হয়। ইতিপূর্বে পুরুষ ছিল অবিমৃশ্যকারী ও নিপীড়ক। এখন নারীও হয়ে ওঠেছে অবিমৃশ্যকারী ও নিপীড়ক। এভাবে সাংসারিক ভাঙনের ষোলকলা পূর্ণ হয় এবং সাংসারিক সুখ দুলর্ভ বস্তু হয়ে যায়।

পাশ্চাত্য সমাজের এই ধ্বংস আজ আমাদের সমাজেও প্রসারিত হয়েছে। প্রথমত, পাশ্চাত্যের দীর্ঘদিনের গোলামী, মুসলিম বিশ্বের সর্বব্যাপী দারিদ্র্য এবং পাশ্চাত্যের বুদ্ধিবৃত্তিক ঐন্দ্রজালিক নেতৃত্ব আমাদের সমাজ অংগনকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। আমাদের সমাজেও চলছে পাশ্চাত্য ধারার সয়লাব। চোখ বন্ধ করে অন্ধের মতো আমরা তাদের পেছনে চলছি। দ্বিতীয়ত, ইসলামের সামাজিক বিধান থেকে আমাদের সমাজ বহু দূরে সরে এসেছে। এ সরে আসার কাজটা একদিনে সাধিত হয়নি। এজন্য আমাদের হাজার বছরের ভূমিকা দায়ী। কুরআন ও সুন্নাহ আমাদের যে সামাজিক বিধান নির্দেশ করেছে, রহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ইসলামী সমাজ গঠন করেছিলেন এবং সাহাবা, তাবেঈ, তাবে-তাবেঈ ও তৎপরবর্তীকালের দু’তিনশো বছরের মুসলিম মনীষী ও চিন্তাবিদগণ যে স্বাভাবিক গতিসম্পন্ন ইসলামী সমাজ গঠন করেছিলেন পরবর্তীকালে বিভিন্ন মুশরিক জাতির সংস্পর্শে এসে তা থেকে ধীরে ধীরে আমরা দূরে সরে আসতে থাকি। বিশেষ করে আমাদের শাহী আমীর-উমরাহ ও উচ্চ মহলে মুশরিকী রাজন্য ও উচ্চ বর্ণ প্রভাবিত একটি সমাজ কাঠামো গড়ে ওঠে। “আননাসু আলা দীনি মুলুকিহিম” জনতা হয় তাদের রাজার আচরণের অনুসারী- এই প্রবাদকে সত্য প্রমাণ করে সাধারণ মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজেও এ ধারা প্রসারিত হয়। পাশ্চাত্য সমাজের মতো আমাদের সমাজের মেয়েরাও এক অন্ধকূপে আটকে পড়ে। তেরশো-চৌদ্দশো বছর পরে আমাদের সমাজের মেয়েরা পার্শ্ববর্তী মুশরিকী ও পাশ্চাত্যের জড়বাদী সমাজের মেয়েদের সাথে নিজেদের কোনো ফারাক দেখতে পায়না। তারা দেখে তারা তাদের মতো শোষিত, নিগৃহীত, পশ্চাৎপদ, অধিকারহারা ও বঞ্চিত।

কাজেই তাদের মতো এরাও আজ বিদ্রোহের ঝান্ডা উঁচু করে ময়দানে নামতে শুরু করেছে। এইতো মাত্র চল্লিশ বছরের মধ্যে মুসলিম মেয়েদের একটি বিরাট অংশ প্রকাশ্য রাজপথে নেমে পড়েছে। আসলে এরা ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চায় না। এরা চায় এদের অধিকার। কিন্তু ইসলামে এদের কী অধিকার দেয়া হয়েছে সে সম্পর্কে এরা সজাগ নয়। এ সজাগ হওয়াটাও এদের পক্ষে অতোটা সহজ নয়, যেখানে সজাগকারীরা নিজেরাই এ ব্যাপারে যথেষ্ট অসচেতন। এই অসচেতনতা গত হাজার বছরের আগ্রাসনের ফসল। একদিনে নয়, ধীরে ধীরে আমাদের সমাজ অনৈসলামী সমাজের রীতি-রেওয়াজে প্রভাবিত হয়েছে। ইসলামী সমাজ যে ধারায় অগ্রসর হয়েছিল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সরল-স্বাভাবিক সামাজিক ধারার প্রবর্তন করেছিলেন তা কালক্রমে ব্যাহত হয়েছে।

মুসলিম পুরুষ ও নারীর পাস্পরিক সহযোগিতায় গড়ে ওঠে ইসলামী সমাজ। এখানে নারীকে পুরুষের বা পুরুষকে নারীর গোলামে পরিণত করা হয়নি। দুটি সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সত্তা। দুনিয়াতেও স্বাধীন-স্বতন্ত্র এবং কিয়ামতেও আল্লাহর সামনে সম্পূর্ণ স্বাধীন-স্বতন্ত্র সত্তা ও ব্যক্তিত্ব হিসাবে জবাবদিহি করার দায়িত্ব লাভ করবে। তাই কুরআনে তাদেরকে “মুমিনা ওয়াল মুমিনাত”, “কানিতীনা ওয়াল কানিতাত”, “সাবিরীনা ওয়াস সাবিরাত” ইত্যাদি পৃথক সত্তা সম্বলিত শব্দে চিহ্নিত করা হয়েছে। একজনকে অন্যজনের লেজুড় হিসাবে উপস্থাপন করা হয়নি। ইসলামী সমাজও ঠিক সেভাবেই গঠিত হয়। পুরুষ ও নারীর স্বাধীন-স্বতন্ত্র সত্তাকে কোনো ক্ষেত্রেও আহত করা হয়নি।

পাশ্চাত্য সামাজিকতা ও ইসলামী সামাজিকতার ফারাকটা এখানেই সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। পাশ্চাত্য সমাজে শিল্পবিপ্লবের পূর্বে নারী ছিল পুরুষের গোলাম এবং পরবর্তীতে উভয়ে স্বাধীন সত্তা ও সমান কর্তৃত্বের অধিকারী হয়। কিন্তু ইসলামী সমাজে নারী কখনো পুরুষের গোলাম ছিল না। উভয়ই ছিল স্বাধীন সত্তার অধিকারী। তবে উভয়ে সমান কর্তৃত্বের অধিকারী ছিল না। উভয়ে ছিলো একে অন্যকে পূর্ণতাদানকারী। “আর রিজালু কাউওয়ামূনা আলান নিসা।” নারী পুরুষের অধীনস্থ হলেও তার স্বাধীন সত্তাকে আহত করা হয়নি। পাশ্চাত্য সংস্থায় প্রথমে কর্তৃত্ব একজনের হাতে ছিল এবং অন্যজনকে তার গোলামে পরিণত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে কর্তৃত্ব উভয়কে দেয়া হয়। ফলে সামাজিক বিশৃংখলা ও নৈরাজ্য দেখা দেয়। সমাজ ও গৃহ সংস্থাটি অচল হয়ে পড়ে। এর মোকাবিলায় ইসলামী সংস্থায় পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে সমাজ গঠন করায় এবং উভয়ের স্বাধীন সত্তা অক্ষুণ্ণ থাকায় সমাজ সংস্থায় ও গৃহে শান্তি ও শৃংখলা অটুট থাকে। এভাবে পাশ্চাত্য যেখানে এক চরম পন্থা থেকে এগিয়ে গেছে আর এক চরম পন্থার দিকে সেখানে ইসলাম প্রথম থেকেই মধ্যম, ভারসাম্যপূর্ণ ও প্রকৃতিসম্মত পন্থা অবলম্বন করেছে।

কিন্তু বিগত কয়েকশো বছরে মুসলিম সমাজে পুরুষের কর্তৃত্বের অধীনে মুসলিম নারীর স্বাধীন সত্তা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তারা নামাযের জামাতে পুরুষদের সাথে মসজিদে শামিল হতে পারছে না। ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষালাভ করতে পারছে না। নিজেদের একান্ত প্রয়োজনে অর্থোপার্জন করতে পারছে না। মেয়েদের মধ্যে জ্ঞানের বিস্তার ও জ্ঞানালোচনার জন্য বাইরে বের হতে পারছে না। অথচ শরীয়তের সীমার মধ্যে থেকে ইসলামের প্রাথমিক যুগে তারা স্বচ্ছন্দে এসব কাজ করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে মুসলিম মেয়েরা এতে অক্ষম হবার কারণে তাদের একটি আত্মসচেতন গোষ্ঠী ইসলামী বিধানকেই অকার্যকর ভাবতে শুরু করেছে। তারা পাশ্চাত্যবাদের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। সারা দুনিয়ার সমস্ত মুসলিম দেশে এ প্রবণতা লক্ষণীয়। এ প্রবণতা প্রতিদিন বেড়ে যাচ্ছে। এখন মুসলিম মেয়েরা ইসলামকে তাদের পথের বাধা মনে করতে শুরু করছে। তাদের ওপর আরোপিত ইসলামী বিধানের সমস্ত সীমারেখা ছিন্ন করে তারা বাইরে বের হতে শুরু করেছে। ইসলামের মোকাবিলায় পাশ্চাত্যবাদকে তারা প্রগতি, অগ্রগতি ও নিজেদের স্বাধীন সত্তা বিকাশের সহায়ক মনে করতে শুরু করেছে। অথচ আত্মসচেতন মুসলিম মেয়েরা যদি একথা জানতো যে, ইসলাম তার নিজস্ব সীমারেখার মধ্যে মেয়েদের স্বাধীন সত্তা বিকাশের এবং তাদের জীবনকে সুন্দর ও পূরিপূর্ণ করার সমস্ত সুযোগ ও সুবিধা দান করেছে তাহলে তারা আর পাশ্চাত্যবাদকে এভাবে বুকে জড়িয়ে ধরতে অগ্রসর হতো না। মানুষের সমাজে সব সময় একদল মেরুদন্ডহীন থাকে। তারা পরানুকরণেই পরিতৃপ্ত। তাদের কথা বাদ দিলেও বিশাল আত্মসচেতন মুসলিম মহিলা গোষ্ঠীটি ইসলামী বিধানের প্রতি একান্তভাবেই ঝুঁকে পড়তো।

তবে মুসলিম আলেম সমাজ এ ব্যাপারে একেবারে অসচেতন নন। তাঁদের একটি অংশ সমস্যাটিকে বাস্তবতার নিরীখে বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হয়েছেন। বিগত কয়েকশো বছরে রাজতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র এবং বিজাতির গোলামী আমাদের সমাজ কাঠামো ও সমাজ মানসের যে বিকৃতি সাধন করেছে তার প্রেক্ষিতে তাঁরা ইসলামী সমাজ পুনর্গঠনের জন্য সরাসরি কুরআন ও সুন্নাহর প্রতি দৃষ্টিপাত করা সবচেয়ে বেশী প্রয়োজনীয় বলে মনে করেছেন।

২. নারী ও পুরুষ নিয়ে মানুষের সমাজ গঠিত। সভ্যতার বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে নারীকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মুল্যায়ন করা হয়েছে। নারীর ভূমিকাও ছিল বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন রূপ। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে নারীকে দেখা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টি দিয়ে। সাম্প্রতিককালে নারী অধিকার ও নারীর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা হচ্ছে ব্যাপকভাবে। বিশ্বসংস্থা ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব পাচ্ছে। পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণ থেকেই নারী আন্দোলনের বিষয়টিকে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। এর ফলশ্রুতিতে পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্যান্য দিকের মতোই এক্ষেত্রেও অগ্রগতির ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো হচ্ছে পরিস্ফূট।

ইসলামে ব্যক্তি ও সমাজের পৃথক অস্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র‍্য স্বীকৃত। কিন্তু এই অস্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র্য  ব্যক্তিকে সমাজ থেকে আলাদা করে দেয়নি। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র‍্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি ব্যক্তির সাথে সমাজের সম্পৃক্ততাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। নামায ব্যক্তির ওপর ফরয করা হয়েছে কিন্তু জামায়াতবদ্ধভাবে নামায পড়াকে জরুরী গণ্য করা হয়েছে। এভাবে বিভিন্নক্ষেত্রে ইসলামে ব্যক্তির সামাজিক দায়বদ্ধতা একটি সর্বসম্মত বিষয়। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে ব্যক্তিকে সমাজের বুকে বিলীন হয়ে যেতে হবে। বরং ব্যক্তির নিজস্ব ক্ষেত্র নির্ধারিত আছে। সেখানে তাকে তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। আবার সামাজিক ক্ষেত্রেও তার দায়িত্ব নির্ধারিত আছে। সেগুলোও তাকে পালন করতে হবে। অর্থাৎ দায়িত্ব ব্যক্তির, ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে ও সমাজিক ক্ষেত্রে। এজন্য ব্যক্তির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও ব্যক্তি স্বাধীনতা ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এজন্য কিয়ামতে আল্লাহর সামনে ব্যক্তিকে ব্যক্তি হিসাবে হাজির হতে এবং জবাবদিহি করতে হবে। পুরুষ ও নারী দুটি পৃথক সত্তা এবং দুটি পৃথক অস্তিত্ব। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন দুজনকে পরস্পরের পরিপূরক করে তৈরি করেছেন। এখানে কেবল একজনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যজনের গুরুত্বহীন তা নয়। বরং উভয়ের ভূমিকা সমান গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য উভয়কেই আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে সমানভাবে। যদি একজনের ভূমিকা কম গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যজনের অধীনস্থ হতো তাহলে তার জবাবদিহির পাল্লা কিছুটা হালকা হতো। কিন্তু কুরআন ও হাদীসের কোথাও এ ধরনের কোনো ইংগিত দেয়া হয়নি। তবে তারা তাদের প্রত্যেকের সামর্থ অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করে যাবে। ‘লা-ইউকাল্লিফুল্লাহু নাফসান ইল্লা উহা’ অর্থাৎ ব্যক্তির সামর্থের বাইরে কোনো কিছু আল্লাহ তার ওপর চাপিয়ে দেবেন না।’ নারী তার সামর্থ অনুযায়ী এবং পুরুষ তার সামর্থ অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করে যাবে। একদিকে তাদেরকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে আবার অন্যদিকে তারা পরস্পরের পরিপূরক। এভাবে তাদের পরস্পরের সাথে যোগাযোগ ও পারস্পরিক বন্ধনের একটি সিলসিলা গড়ে উঠেছে। বিবাহ বন্ধন এ সিলসিলার একটি প্রধান ও মূল অংশ। কিন্তু কেবলমাত্র এরি মধ্যে তাদের দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্যপালন সীমাবদ্ধ থাকেনি। ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিভিন্ন ইতিবাচক ও নেতিবাচক দায়িত্ব, যেগুলো অনেক ক্ষেত্রে এই বন্ধনের বাইরেও হতে পারে, তাদের পালন করতে হবে। যেমন জ্ঞান অন্বেষণ, ভালো কাজ, ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজে বাধা দান, আল্লাহর দ্বীনের প্রতি আহ্বান জানানো, আল্লাহর পথে জিহাদ, পেশাগত কাজ, রাজনৈতিক তৎপরতা, অর্থনৈতিক কার্যক্রম, নিষ্কলুষ বিনোদন, ভালো সমাবেশ ও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। নারী ও পুরুষ উভয়কেই এসব কাজে অংশ নিতে হবে।

এভাবে সমাজে নারী ও পুরুষ প্রত্যেকে তাদের ওপর আরোপিত নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে সমাজের সুষ্ঠু পরিগঠনে ভূমিকা রাখতে পারবে এবং এজন্য আল্লাহর সামনে তাদের জবাবদিহি করাও সহজ হবে।

৩. বিশ্ব মানবতার জন্য রহমত স্বরূপ আল্লাহর শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর নবুওয়াতী জীবনের তেইশ বছর ধরে নিজ হাতে ইসলামী সমাজের পূর্ণাঙ্গ কাঠামো তৈরী করে যান।

সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণ সেই কাঠামোর মধ্যে তাকে বিকশিত ও পরিপুষ্ট করেন। আজও দুনিয়ার যে কোন দেশে যে কোন পরিবেশে সেই কাঠামোই মুসলমানদের আদর্শ। হাজার-দেড় হাজার বছর আগে পারসিক বা রোমান সমাজ অথবা আজকের পাশ্চাত্য সমাজ কোনটাই মুসলমানদের আদর্শ নয়। হাজার দেড় হাজার বছর আগে সেই সব অমুসলিম সমাজে যেমন অন্যায়, জুলুম ও মানব প্রকৃতি বিরোধী মূল্যবোধের প্রসার ঘটেছিল আজও ঠিক তেমনি সেই ধারাই পাশ্চাত্য সমাজে অব্যাহত আছে।

নারী স্বাধীনতার জিগির সেই সমাজ থেকেই উঠেছে। কারণ সেই সমাজে নারী স্বাধীন ছিল না। নারী ছিল পুরুষের দাসী। অতীতেতো সেই সমাজে নারীর আত্মা আছে কিনা, সেবব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করা হতো। নারীকে বলা হতো শয়তানের সহচরী। নারীর মৌলিক মানবিক অধিকার হরণ করাই ছিল সেই সমাজের বৈশিষ্ট্য। মূলত নবুওয়াতী ধারার বাইরে নবুওয়াতী ধারা বিচ্যুত প্রত্যেকটি সমাজে এ অন্যায় ও জুলুমের প্রসার ঘটেছে। আজকের পাশ্চাত্য সমাজ সেই অন্যায় ও জুলুমের অবসান ঘটাতে পারেনি। নারী স্বাধীনতার জিগির সেখানে তোলা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু নারী তার অধিকার লাভ করতে পারেনি। নারী তার পৃথক স্বাধীন সত্তা নিয়ে সে সমাজে নারী হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি। পুরুষের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে সে আজ কক্ষচ্যুত। সংসারের বাধন ছিঁড়ে পথে বাসা বেধেছে। তার নারীত্বের সম্পদ লুন্ঠিত দ্রব্য, নিলাম ঘরেও ডাক উঠেনা।

প্রাচ্যের মুসলমান সমাজেও এর ঢেউ লেগেছে। পাশ্চাত্যের শত বছরের ঔপনিবেশিক শাসন ও শিক্ষা ব্যবস্থা প্রাচ্যের মুসলিম সমাজের মূল্যবোধ পাল্টে দিয়েছে। তাদের ঈমান আকিদায়ও আশংকাজনক ধ্বস নেমেছে। মুসলিম সমাজের মেয়েরাও সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে নিজেদের অসহায় ভাবছে। তারাও পাশ্চাত্য নারীর কায়দায় সামাজিক বন্ধন কেটে বাইরে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে। পাশ্চাত্য জাহিলিয়াতের কাছে তাদের একটি অংশ পরোপুরি আত্মসমর্পণ করেছে।

অন্য দিকে গত দেড় হাজার বছরে মুসলিম সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে বিপুল ভাবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈগণ কুরআন সুন্নাহের যে মূলনীতির ভিত্তিতে ইসলামী সমাজ গঠন করেছিলেন হাজার বছরে বিভিন্ন

দেশের মুসলিম সমাজ তা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে। যার ফলে আমাদের দেশের মুসলিম মেয়েরা সামাজিক অনিরাপত্তা, নির্যাতন ও অন্যায় এবং অর্থনৈতিক অবিচারের ক্ষেত্রে নিজেদেরকে অমুসলিম মেয়েদের সমপর্যায়ভূক্ত দেখতে পাচ্ছে। এর কারণে রসূল (স:) ও সাহাবাদের যুগে মুসলিম মেয়েরা যে সামাজিক, ধর্মীয় ও অর্থনেতিক স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক অধিকার ভোগ করেছিল পরবর্তীকালে তা অনেক ক্ষেত্রে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম প্রবর্তিত এ অধিকারগুলো যদি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা যায় তাহলে মুসলিম নারী পূর্ণ মানবিক ও সামাজিক মর্যাদা লাভে সক্ষম হবে এবং তাদের মধ্যে বঞ্চনা ও অধিকারহীনতার অনুভূতির বিলুপ্তি ঘটবে। ফলে তারা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য পাশ্চাত্যের প্রতি ঝুঁকে পড়বেনা।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময় মুসলিম মেয়েরা নিম্নোক্ত অধিকারগুলো লাভ করেছিলেন:

  • তারা জামায়াতের সাথে নামায পড়ার জন্য মসজিদে নববীতে যেতো এবং বিশেষ করে এশার ও ফজরের নামাযে হাজির হতো। তারা জুময়ার নামাযে উপস্থিত হতো। তারা রসুলের সাথে দীর্ঘ সময় কুসুফের নামাযে হাজির হতো।
  • মুসলিম মেয়েরা রমযানের শেষ দশ দিন মদীনার মসজিদে ইতেকাফ করতেন।
  • রসূল (স) যখন মসজিদে ইতেকাফ করতেন তখন তাঁর স্ত্রীগণ তাঁর সাথে দেখা করতে আসতেন।
  • রসূলের মুয়াযযিন মসজিদে সাধারণ সভা আহবান করলে মুসলিম মেয়েরাও সে সভায় যোগ দিত।
  • মুসলিম মেয়েরা বিশেষ ফতোয়া জিজ্ঞেস করার জন্য নিজেরাই রসূলের কাছে যেতো।
  • মুসলিম মেয়েরা পুরুষদেরকে সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ করার দায়িত্ব পালন করতো।
  • মুসলিম মেয়েরা মেহমানদের অভ্যর্থনা জানাতো। সে অভ্যর্থনা লাভকারীদের মধ্যে রসূল (স:) নিজেও ছিলেন। মেয়েরা মেহমানদের খাদ্যও পরিবেশন করতো।
  • মুসলিম মেয়েরা প্রথম হিজরতকারী মেহমানদের জন্য তাদের দ্বার উন্মুক্ত রাখতো।
  • মুসলিম নারী তার স্বামীর সাথে মিলে রাতের খাওয়ায় মেহমানদের সাথে অংশ গ্রহণ করতো।
  • মুসলিম নারী বিয়ের ওলিমায় মেহমানদের খেদমত করতো এবং উত্তম পানীয় পরিবেশন করতো।
  • মুসলিম মেয়েরা রসূলের সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতো, তৃষ্ণার্তদের পানি পান করাতো। আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতো এবং আহত ও নিহতদের মদীনায় নিয়ে আসতো।
  • মুসলিম নারী রসূলের কাছে নৌযুদ্ধে শহীদ হওয়ার প্রার্থনা করতো এবং রসূল (স) তার দোয়া কবুল করার জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন করেন।
  • মুসলিম মেয়েরা রসূলের সাথে ঈদের জামায়াতে শামিল হতো এবং খুৎবার পর রসূল (স) তাদের জন্য বিশেষ ওয়াজ-নসীহতের সময় নির্ধারণ করতেন। মুসলিম কিশোরী ও উঠতি যুবতীদেরকে রসূল (স) ঈদের নামাযে শামিল হওয়ার জন্য ও মুমিনদের সমাবেশে অংশ গ্রহণ করার আদেশ দিতেন।
  • হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের (রা) স্ত্রী নিজ হাতে উপার্জন করতেন এবং তার স্বামী ও ইয়াতীম ছেলেমেয়েদের ভরণ-পোষণ করতেন।
  • হযরত আসমা (রা) মদীনা থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে তার স্বামীর খেজুর বাগান থেকে খেজুরের ছড়া বহন করে আনতেন।

রসূলের হাতে গড়া প্রথম মুসলিম সমাজে ইবাদত-বন্দেগী, জ্ঞান চর্চা, অর্থনৈতিক কার্যক্রম, সমাজকল্যণমূলক কাজ এবং আমর বিল মারূফ ও নাহী আনীল মুনকারের ক্ষেত্রে পুরুষদের সাথে মেয়েরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। এর ফলেই সে দিনের ইসলামী সমাজে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরবর্তী কালে জামানার ফিতনার আশংকায় মুসলিম নারীকে এমনভাবে গৃহকোণে আটকে দেয়া হয় যার ফলে তারা নিজেদের ইসলামী জীবন গঠন ও ইসলামী সমাজে নিজেদের প্রয়োজনীয় দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়। এটি ছিল রসূল (স) ও সাহাবায়ে কেরামের নীতির পরিপন্থী।

এর ফলে এই পরিবর্তিত মুসলিম সমাজের সাথে সেদিনকার মুশরিকী সমাজের পার্থক্যও অনেক কমে গিয়েছিল। আবার আজকের মুশরিকী তথা পাশ্চাত্য সমাজে যে পরিবর্তন, প্রান্তিকতা ও গোমরাহীর ধারা প্রবাহিত হয়েছে একদল মুসলমান মুসলিম সমাজকে সেদিকে পরিচালিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। মুসলিম মেয়েদেরকে তারা ঘরের বাইরে বের করে এনে একেবারে ঘরের চৌমাথায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এবং পাশ্চাত্যবাদের প্রত্যেকটি ধারারই অনুশীলন ও অনুকরণ করতে চাচ্ছে। এই দুই প্রান্তিকতা থেকে বের করে মুসলিম মেয়েদের আবারও রাসুলের যুগের ন্যায় সম্মানজনক জিন্দেগী দিতে হবে। তবেই আমরা একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ আশা করতে পারবো। 

(আবদুল মান্নান তালিব)

(বর্তমান আরব জাহানের শ্রেষ্ঠ আলেম এবং হাদীস ও ফিকহ শাস্ত্রের অন্যতম গবেষক আল্লামা আবদুল হালীম শুক্কাহ’র “তাহরীরুল মারআ ফী আসরির রিসালাহ” (রসূলের যুগে নারী স্বাধীনতা) নামক গ্রন্থের মুখবদ্ধ থেকে)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *