[[প্রফেসর ডক্টর আব্দুল ফাত্তাহ আল-ওয়াইসি একজন প্রখ্যাত চিন্তাবিদ, গবেষক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ। তিনি একইসাথে ইসলামের ইতিহাস, ভূরাজনীতি ও বাইতুল মাকদিস বিষয়ক গবেষণায় অসামান্য অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, ‘বারাকা সার্কেল থিওরি’ এবং ‘আমান থিওরি’র মতো গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক ধারণা প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ভূরাজনীতির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাইতুল মাকদিস ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে তিনি বাংলাদেশ সফর করেন এবং ‘রোড টু বাইতুল মাকদিস’ শীর্ষক একটি বিশেষ প্রশিক্ষণ ক্যাম্প পরিচালনা করেন। বাংলাদেশে অবস্থানের শেষ মুহূর্তে তিনি শিউলিমালা একাডেমির আয়োজনে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে অংশ নেন, যেখানে তিনি তার জীবনের লক্ষ্য, গবেষণা, ফিলিস্তিনের সংগ্রাম এবং বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা তুলে ধরেন।]
শিউলিমালা একাডেমি: উস্তাদ, আমরা জানি যে ১৯৪৮ সালে যখন দ্বিতীয়বার ফিলিস্তিনে আক্রমণ চালানো হয়েছিলো, তখন আপনার পরিবারকেও নিজ গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিলো। এরপর জীবনের ১৮ বছর ধরে আপনি শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করেছিলেন। কঠিন সেই সময়টা আপনারা কীভাবে অতিবাহিত করেছিলেন এবং শরণার্থী শিবিরে বেড়ে ওঠার পরও কীভাবে নিজেকে পৃথিবীর অন্যতম সেরা স্কলার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলেন?
প্রফেসর আব্দুল ফাত্তাহ আল-ওয়াইসি: আলহামদুলিল্লাহ। ওয়াস্সালাতু ওয়াস্সালামু আ’লা রাসূলিল্লাহ। রাব্বিশ্রাহলি…
১৯৪৮ সালের ঘটনা সম্পর্কে একটু বলি। আমাদের ফিলিস্তিনি পূর্বপুরুষরা শান্তিপূর্ণভাবেই নিজেদের গ্রামে বসবাস করতো। গ্রামটির নাম ছিল জারনূকা (Zarnuqa), যা বাইতুল মাকদিস এলাকার একটি অংশ ছিলো। সেখানে ছিলো তাদের সুখী জীবন, ছিলো নিজস্ব আঙিনা এবং প্রত্যেকের আপন আপন স্বপ্ন। কিন্তু হঠাৎ করে সেই সুখের জীবন তছনছ করে দেয় জায়োনিস্ট বাহিনী। সেই গ্রামে তারা আক্রমণ করে নির্দয়ভাবে গ্রামবাসীদের হত্যা করতে শুরু করে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় এবং সবাইকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করে।
আমাদের গোটা পরিবার— আমার বাবা-মা, দাদা এবং তাঁর তিনটি সন্তান– দুই মেয়ে ও এক ছেলে গ্রাম থেকে বিতাড়িত হয়েছিলো। এই কঠিন যাত্রাপথে তাদের দুই মেয়ে ও এক ছেলে মারা গেছে। মেয়েদের নাম ছিল সোফিয়া ও আমিনা, আর ছেলের নাম ছিল আলী। তবে, আলহামদুলিল্লাহ, বাবা-মা বেঁচে গিয়েছিলেন।
এরপর জাতিসংঘের নিকট থেকে তারা কিছু তাবু পেয়েছিলেন। এভাবে তারা একটি আশ্রয়স্থল খুঁজে পান বটে, তবে সেটি ছিলো পুরোপুরি অনিরাপদ। তবুও, সেই তাঁবুই ছিলো আমাদের জন্য অস্থায়ী নতুন ঘর। দশ বছর পর, সেই জীর্ণ তাঁবুতে—যেখানে আমাদের জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার দিনগুলো কেটেছিল—আমি জন্ম নিলাম। যখন আমি ছোটো ছিলাম, চোখ খেলার পর চারপাশে কোনো আধুনিক জীবন বা উন্নতির কোনো লক্ষণ দেখতে পাইনি, দেখেছিলাম শুধুই তাঁবু, খালি মাঠ এবং শূন্যতা। তবে, সেই শূন্যতা থেকেই আমাদের সংগ্রাম শুরু হয়েছিলো।
শীতের হাড় কাঁপানো ঠান্ডা ও গ্রীষ্মের অস্বস্তিকর গরম—প্রকৃতপক্ষে, দুই ঋতুতে জীবনের সংগ্রাম ছিলো অবিশ্বাস্য। সত্যি বলতে, আমাদের প্রতিটি মুহূর্তই ছিলো সংগ্রামের, যেখানে ৫০০ জন মানুষের জন্য একটিমাত্র টয়লেটের বাস্তবতা ছিলো আমাদের অকপট জীবনচর্চার একটি অংশ। আমাদের পরিবার ছিলো একটি কৃষক পরিবার। বাবা এবং দাদা ছিলেন কৃষি কাজের সাথে জড়িত। তাঁদের জীবনের সব ছিলো জমি, যদিও তাঁরা কখনো ধনী হতে পারেননি। ‘কৃষি-জমি’ ছিলো তাদের সকল স্বপ্ন ও আস্থার কেন্দ্র, ঠিক অভিভাবকের মতো, যা হারানোর পর তাঁদের কাছে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার মতো আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট ছিলো না। বাবা প্রতিদিন এক গ্রাম থেকে ডিম কিনে অন্য গ্রামে বিক্রি করতেন। সেই ডিম বিক্রির সামান্য লাভে আমরা একমাত্র খাবার, অর্থাৎ রুটি কিনতাম; আমার মা সেই রুটি নিজ হাতে তৈরি করতেন। বাংলাদেশে যেমন নিয়মিত বাজার দেখা যায়, আমাদের সেরকম ছিলো না। আমাদের কাছে বাজারের সুযোগ ছিলো সীমিত, হয়তো সপ্তাহে একদিনই কোনোমতে বাজার বসতো। আমরা জাতিসংঘের UNRWA তাঁবুতে চালু হওয়া স্কুলে যেতাম। আমার কাছে ভালো কাপড় ছিলো না; কোনো শার্ট থাকলেও তা ছেঁড়া, প্যান্টও একই অবস্থা। আর স্কুলে যেতে প্রায় ৩ কিলোমিটার পথ হাঁটতে হতো, অনেক সময় আবার আমাদের পায়ে জুতোও থাকতো না।
তবুও, আমার মা-বাবা ছিলেন অসাধারণ স্নেহশীল এবং সন্তানদের শিক্ষিত করার ব্যাপারে গভীরভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তারা আমার এবং আমার ছয় বোনের স্কুল-যাওয়া নিশ্চিত করেছিলেন। জীবনের প্রথম ১৮ বছরে আমি কখনও বিদ্যুৎ দেখিনি। আমার বয়স যখন আঠারো, একদিন প্রথমবারের মতো দেয়ালে এক সুইচ দেখতে পেলাম ও হঠাৎ আলো জ্বলে উঠল—আমি ভেবেছিলাম, এটা মনে হয় কোনো যাদু!
আমার বাবা, যিনি লিখতে-পড়তে জানতেন না, প্রায়ই আমাকে বলতেন, “আবদুল ফাত্তাহ, আমরা আমাদের বাড়ি ও ভূমি হারিয়েছি, তবে একমাত্র উপায়—শিক্ষা, যা সেই হারানো সবকিছুকে ফিরিয়ে আনতে পারে।”
আমার কাছে তিনি ছিলেন জীবনের অভিজ্ঞতায় সবচেয়ে শিক্ষিত ব্যক্তি, যদিও তাঁর হাতে কোনো আনুষ্ঠানিক সার্টিফিকেট বা ডিগ্রী ছিলো না। শেষে, বাবাই আমার পড়াশোনার জন্য বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করেন। কোনো সরকারী স্কলারশিপ বা আন্তঃসংস্থাগত সহযোগিতা ছাড়াই, তাঁর নিজস্ব ছোট ব্যবসা—ডিম বিক্রি থেকে শুরু করে ফলমূল ও শাকসবজি বিক্রির মাধ্যমে—আমাকে বিদেশে পাঠানোর সুযোগ করে দেন। নিজস্ব ছোট ব্যবসা শুরু করে তিনি ডিম, ফলমূল ও শাকসবজি বিক্রি করতেন; ঠিক যেমন আমি এখানে ঢাকায় এসে দেখতে পেয়েছি।
ওই ব্যবসার ধারাবাহিকতায়, বাবাই আমাকে বিদেশে পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ পাঠাতেন, যতদিন না আমি এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি শেষ করি। ১৯৮৬ সালে পিএইচডি সমাপ্তির পর আমি দেশে ফিরে আসি, কিন্তু প্রকাশ্যে ফিরে আসার এক বছর পর, ১৯৮৭ সালে, প্রথম ইন্তিফাদা শুরু হয়। সেই কঠিন সময়ে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ আমাকে লক্ষ্য করে। পরবর্তীতে তাঁদের গোয়েন্দারা একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসতো। ১৯৯২ সালে তাঁরা আমাকে নির্বাসিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁদের মতে, আমার লেখালেখি যেকোনো অস্ত্রের চেয়েও বেশি বিপজ্জনক। নির্বাসনের পর আমাকে যুক্তরাজ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর সেখানেই আমি নিজের একাডেমিক যাত্রা পুনরায় শুরু করি।
আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন, আমি আমার একাডেমিক ক্যারিয়ারে উন্নতি করতে থাকি এবং প্রফেসর পদে অধিষ্ঠিত হই, যা যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে উচ্চতর একাডেমিক পদ। এটি ছিল আমার সংক্ষিপ্ত জীবনের গল্প—১৯৪৮ সাল থেকে ২০০১ সালে চেয়ার পদে উপনীত হওয়া পর্যন্ত। আজ সেই মাইলফলকটি পার হওয়ার প্রায় ২৪ বছর পূর্ণ হয়েছে।
শিউলিমালা একাডেমি: উস্তাদ, যেহেতু নির্বাসনের প্রসঙ্গ এলো, আমরা শুনেছি যে নির্বাসনের সময় আপনি প্রখ্যাত মুজাহিদ ইসমাইল হানিয়ার সাথে সময় কাটিয়েছেন। আপনি কি তাঁর সঙ্গের কিছু স্মৃতি শেয়ার করবেন?
প্রফেসর আব্দুল ফাত্তাহ আল-ওয়াইসি: হ্যাঁ, আমি একা ছিলাম না। নির্বাসনের সময়, আমাদের সাথে ছিলো পবিত্র ভূমি বায়তুল মাকদিসের ৪১৫ জন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। আমার ভাই ইসমাইল হানিয়া তখন ছিল টগবগে তরুণ; গাজার যেসব লোক তাঁকে চেনে, তারা আজও তাঁর স্মৃতি ভালোবাসার সহিত হৃদয়ে ধারণ করে। সেই সময়টাতেই তার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়। নিঃসন্দেহে, তখন থেকেই তার মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী বিচ্ছুরিত হতো। যদিও শুরুর দিকে তাঁর নেতৃত্ব ততোটা স্পষ্ট ছিলো না, কারণ তিনি তখন খুবই তরুণ ছিলেন। পরবর্তীতে যখন বিভিন্ন শহরে প্রতিনিধি নির্বাচন শুরু হলো, তখন তিনি বলিষ্ঠ নেতা হিসেবে শক্তপোক্তভাবেই আবির্ভূত হলেন। আমার মনে হয়, সেই বছরগুলোতেই আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্ব আরও দৃঢ় ও গভীর হয়েছিলো, যা পরবর্তীতে ক্রমান্বয়েই বৃদ্ধি পেয়েছিলো। আলহামদুলিল্লাহ রব্বিল আলামিন।
শিউলিমালা একাডেমি: উস্তাদ,আপনি প্রায়ই আপনার সেমিনার ও বক্তৃতায় স্বাধীনতার কথা বলে থাকেন। আমার কৌতুহল হলো, আপনি ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি দ্বারা কোন বিষয়টিকে উদ্দেশ্য করেন?

প্রফেসর আব্দুল ফাত্তাহ আল-ওয়াইসি: প্রথমেই বলি, যুক্তরাজ্যে অবস্থানকালেই আমাকে ‘স্বাধীনতা’ বিষটি নিয়ে ভাবতে বাধ্য হওয়া লাগে। সেখানকার উদার চিন্তাধারায় স্বাধীনতাকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। তবে অনেকেই স্বাধীনতার নামে এমনসব কাজ করে, যা নীতিহীন এবং আইনের অপব্যবহার।
আমার কাছে স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ হলো গভীর উপলব্ধির বিষয়। যখন আমি ইসলাম শিখলাম এবং আমাদের গৌরবময় ইতিহাস অধ্যয়ন করলাম, তখনই আমি অনুভব করলাম খলীফা উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর ‘মানুষ স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করে।’ কথাটি কতটা সত্য এবং গভীর। অর্থাৎ, সুবিশাল এই দুনিয়ায় কোনো মানুষই দাস হয়ে জন্মায় না; প্রত্যেক মানুষই প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনভাবে জন্মায়।
তাই আমার মতে, স্বাধীনতার মানে হলো,
চিন্তা করার স্বাধীনতা, নিজের কাজ করার স্বাধীনতা, নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা; তবে এসবের সাথে ‘দায়িত্ব’-এর বিষয়টিও জরুরি। আমার বিশ্বাস, স্বাধীনতা মানে হলো দায়বদ্ধতার সাথে স্বাধীনতা, যেখানে থাকবে দায়িদায়িত্ববোধ ও দায়বদ্ধতা, যা আমরা কুরআন ও রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এর জীবন থেকে শিখেছি। আমি মানুষকে উৎসাহিত করি মুক্তভাবে চিন্তা করতে, যাতে করে তার মাঝে সৃজনশীলতা ফুটে উঠে এবং সে উম্মাহর কল্যাণে কাজ করে।
ইসলাম শেখায়, স্বাধীনতা মানে উচ্ছৃঙ্খল বা বিশৃঙ্খলা নয়, বরং দায়িত্বশীলভাবে স্বাধীন থাকা। আপনি মুক্ত থাকবেন, তবে আপনার কাজ এবং চিন্তার জন্য আপনাকে আল্লাহ, সমাজ ও নৈতিকতার প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হবে। একইসাথে, এই মুক্তি ও স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্বও আসতে থাকতে হবে। যদি কেউ তার স্বাধীনতার অপব্যবহার করে সমাজ, ইসলাম বা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কাজ করে, তাহলে তার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা থাকা উচিত, যেনো স্বাধীনতার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়।
অথচ, আজকের পশ্চিমা দেশে, স্বাধীনতার নামে অনেক কাজ করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, অনেকেই নিজেদের লিঙ্গ পরিবর্তন করছে এবং তা আইনের অধীনে বৈধ। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি এটাই স্বাধীনতার আসল অর্থ নয়।
শিউলিমালা একাডেমি: উস্তাদ,আপনি প্রায়ই Occupation of mind বা মনস্তাত্ত্বিক দাসত্ব এবং occupation of land বা ভূমির দখলদারিত্ব নিয়ে বলে থাকেন। অনুগ্রহ করে এই বিষয়টি আমাদের জন্য সহজ করে ব্যাখ্যা করলে আমরা এখান থেকে উপকৃত হতে পারবো।
প্রফেসর আব্দুল ফাত্তাহ আল-ওয়াইসি: হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আমি দেখেছি যে, আমাদের উপর দু’ধরণের দখলদারিত্ব আসে। প্রথমটি হলো—ভূমির দখল, যেখানে শত্রু বাহিনী সরাসরি আমাদের ভূমি, দেশ এবং ঘরবাড়ি দখল করে নেয়। দ্বিতীয়টি হলো—আকলের দখল, যেখানে কেউ আমাদের চিন্তা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করে নেয়।
এখন, এই দু’টি দখলদারিত্বের মূল উৎস হচ্ছে ঔপনিবেশিক শক্তি। তাদের প্রথম কাজ হলো, মানুষকে মানসিকভাবে দাস বানিয়ে ফেলা বা মনস্তাত্ত্বিকভাবে বন্দী করা। কারণ, আমাদের আকল থেকেই আমাদের প্রতিটা কাজের পরিকল্পনা ও চিন্তার সূচনা হয়। যদি মন ও আকল স্বাধীন না থাকে, তাহলে কোনো মানুষ কখনই তার ভূমি মুক্ত করার স্বপ্নও দেখতে পারে না। এমনকি এমন আকল ব্যবহার করে কখনও সঠিক পথ খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই, আকলের মুক্তি ছাড়া ভূমির মুক্তি কখনও সম্ভব না।
দুঃখজনকভাবে, গত শতাব্দীজুড়ে অনেক মুসলিম শুধুমাত্র তার ভূমির স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে গেছে। তবে তারা ভুলে গেছে যে, ভূমি স্বাধীন হলেও যদি আকল পরাধীন থাকে, তাহলে প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জিত হয় না। ফলস্বরূপ, আজ অনেক দেশে স্বাধীনতার দাবি থাকলেও, তাঁদের শিক্ষা, চিন্তা, সংস্কৃতি এবং স্বপ্নগুলো পশ্চিমা ঔপনিবেশিক চিন্তায় বন্দী। একে বলা যায় বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব।
সুতরাং, আমার বক্তব্য হলো, ভূমির স্বাধীনতার আগে আকলের স্বাধীনতা অত্যন্ত জরুরি। যদি আকল ও চিন্তা মুক্ত থাকে, তবে ভূমি নিজেও প্রকৃত স্বাধীন হবে এবং এভাবেই এক সত্যিকারের স্বাধীন সমাজ গড়ে উঠবে, ইনশাআল্লাহ।
শিউলিমালা একাডেমি: উস্তাদ, আপনি শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং ছোটবেলা থেকেই স্বাধীনতার স্বপ্ন লালন করেছেন, আবার আমরা এ-ও জানি যে, আপনার জীবনের প্রধান ভিশন হচ্ছে বায়তুল মাকদিসের মুক্তি। তাহলে প্রশ্ন হলো, কেন আপনি সরাসরি যুদ্ধের মাঠে না গিয়ে সারা জীবন জ্ঞান সাধনায় নিয়োজিত থাকলেন?
প্রফেসর আব্দুল ফাত্তাহ আল-ওয়াইসি: তোমার প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমার চারপাশের অনেকেই—এমনকি আমার শহীদ ভাই আবদুল্লাহ এবং অন্যান্য আত্মীয়রা—সরাসরি সামরিক অঙ্গনে লড়াই করেছেন। সামরিক সংগ্রামের গুরুত্ব নিয়ে আমার কোনো দ্বিধাই ছিলো না। কিন্তু একদিন আমার পিতা আমাকে একটি কথা বলেছিলেন, যা আমার জীবন বদলে দেয়। তিনি বলেছিলেন, “আমাদের মাতৃভূমি মুক্ত করতে হলে, প্রথম অস্ত্র হতে হবে শিক্ষা।”
আমি যখন মাত্র ১১ বছর বয়সে এই কথা শুনলাম, তখন থেকেই হৃদয়ে গেঁথে গেলো যে আমার যুদ্ধ হবে কলমের এবং জ্ঞানের; আমার যুদ্ধ হবে চিন্তার যুদ্ধ। আবার ইসলাম সম্পর্কে অধ্যয়ন করতে গিয়ে আমি বুঝতে পারলাম, ইসলামের প্রথম ওহী ছিল, “পড়ো! তোমার প্রভু আল্লাহর নামে পড়ো!” এই বাক্য থেকেই শিখলাম যে ইসলামের শক্তি জ্ঞান অর্জনের মধ্যেই নিহিত। পরে গবেষণায়ও দেখলাম, সামরিক শক্তি ও রাজনীতি যেমন প্রয়োজন, তেমনি সবকিছুর ভিত্তিই হচ্ছে জ্ঞান।
এই বিশ্বাস নিয়ে আমি আমার জীবনের ৩৫ বছরেরও বেশি সময় শিক্ষা ও জ্ঞানের আন্দোলনে নিয়োজিত থেকেছি। আমি মনে করি, এই পথেও এক ধরণের জিহাদ রয়েছে। ইবনে কাইয়্যিম (রহ.) বলেছেন, জিহাদের ২৩টি স্তর আছে; সরাসরি যুদ্ধ করা তো সহজ স্তর—অস্ত্র ধরে লড়াই করা, কিন্তু সবচেয়ে কঠিন হলো নিজের ও উম্মাহের আকল ও চিন্তাধারাকে মুক্ত করা এবং ভবিষ্যতের জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা তৈরি করা।
সুতরাং, আমার জিহাদ হলো, মুমূর্ষু মুসলিম উম্মাহর আকলকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করে তাদের চিন্তা ও জ্ঞানকে শক্তিশালী করা। এটাই আমার লড়াই, এটাই আমার যুদ্ধ। ইনশাআল্লাহ, যতদিন না বায়তুল মাকদিস ও মুসলিম উম্মাহ প্রকৃত স্বাধীনতা লাভ করে, আমি এই যুদ্ধ অব্যাহত রাখবো।
শিউলিমালা একাডেমি: আপনি বলেছিলেন, জ্ঞানচর্চার পথে আপনি বায়তুল মাকদিসকে কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তাহলে আমার প্রশ্ন হলো, কেউ যদি উম্মাহ বা মানবতার জন্য কাজ করতে চায়, তাহলে তার জন্য কি বায়তুল মাকদিসকে কেন্দ্র করে কাজ শুরু করা আবশ্যক?
প্রফেসর আব্দুল ফাত্তাহ আল-ওয়াইসি: বিষয়টা আবশ্যক, তবে একটু ব্যাখ্যা করি। আসলে আমাকে বায়তুল মাকদিসের দিকে টেনে নিয়েছিলেন আমার মা। প্রথম দিকেতো এটা আমার নিজের কোনো সিদ্ধান্ত ছিলো না। আমার মা, যিনি লিখতে-পড়তে পারতেন না, তিনি আমার ছোটবেলায় প্রায়ই আমাকে মসজিদুল আকসায় নিয়ে যেতেন। মা যখন মহিলাদের সঙ্গে ‘ডোম অব দ্য রক’-এ নামাজ পড়তেন, তখন আমি চারপাশে খেলতাম। নামাজ শেষে মা আমাকে নিয়ে এসে ডেকে বলতেন, “আবদুল ফাত্তাহ, তুমি এই পাথরটা দেখছো? এখান থেকেই রাসূলুল্লাহ (সা.) আকাশে মেরাজে গমন করেছিলেন।”
মায়ের এই কথা শুনেই আমার হৃদয়ে আল-মসজিদুল আকসার প্রতি এক গভীর ভালোবাসা জন্মে এবং সেই ভালোবাসা থেকেই পরবর্তীতে এটি আমার জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, আমার বাবার কাছ থেকে শোনা কথা—“শিক্ষা, শিক্ষা, শিক্ষা” এবং মায়ের সঙ্গে মসজিদুল আকসায় যাওয়া থেকেই বায়তুল মাকদিসের প্রতি আমার ভালোবাসার জন্ম।
পরবর্তীতে দীর্ঘ পড়াশোনা ও গবেষণার মধ্য দিয়ে আমি উপলব্ধি করি যে, ইসলামের জন্য কাজ করা মানে বায়তুল মাকদিসের জন্য সংগ্রাম করা, আর বায়তুল মাকদিসের মর্যাদা রক্ষা করা মানে ইসলামের শক্তি বহাল রাখা। এখানে একটা কথা খেয়াল রাখতে হবে, প্রতিটি মুসলিমেরই অন্তত বায়তুল মাকদিসের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত।
আজ, অনেক বছর পর, আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ যে তিনি আমাকে এই পথে পরিচালিত করেছেন। আমার দৃঢ়বিশ্বাস যে, যদি মাসজিদুল আকসা মুক্ত হয়, তাহলে পুরো উম্মাহ মুক্ত হবে। আর যদি তা দখলদারদের কাছে থাকে, তবে উম্মাহও তাদের নিয়ন্ত্রণের আওতায় থাকবে।
এটাই আমার পথচলা। যদিও আমার পথ প্রতিটি মুসলিমের জন্য বাধ্যতামূলক নয়, তবে বিষয়টা আবশ্যক। মসজিদুল আকসার গুরুত্ব অনুধাবন করে আমরা সত্যিকার স্বাধীনতার ও শক্তিশালী উম্মাহ গঠনের পথে অগ্রসর হতে পারি।
শিউলিমালা একাডেমি: আপনার বক্তব্যগুলো থেকে আমরা জানতে পেরেছি, ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই বায়তুল মাকদিস মুসলিমদের জন্য একটি অবিচ্ছেদ্য স্থান। এটি ছিলো মুসলমানদের প্রথম কিবলা এবং আমাদের আকীদার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আজকের অনেক মুসলিম এ বিষয়টিকে শুধুমাত্র ফিলিস্তিনের সমস্যা হিসেবে দেখেন। তাহলে আমরা কিভাবে আমাদের সমাজে এটিকে আকিদার বিষয় হিসেবে তুলে ধরতে পারি এবং বায়তুল মাকদিসকে আমাদের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি?
প্রফেসর আব্দুল ফাত্তাহ আল-ওয়াইসি: আজকের দিনে, আমাদের সমাজকে এই সত্যটি বুঝতে হবে যে, ইসলামের জন্য কাজ করা মানে বায়তুল মাকদিসের জন্য সংগ্রাম করা। এই জয়প্রাপ্তি শুধু ভূতাত্ত্বিক বা রাজনৈতিক নয়, এটি একান্ত আমাদের আকীদার প্রশ্ন। আমার মতে, প্রতিটি মুসলিমের উচিত, যারা মানবতা বা উম্মাহর কল্যাণ চায়, বায়তুল মাকদিসের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া।
আমি মনে করি, আমাদের প্রথম কাজ হলো শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করা। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, যাদের আমি ভবিষ্যতের নেতা বলি, তাদেরকে এই বিষয়ে সুস্পষ্ট ও কার্যকর শিক্ষা দেয়া দরকার। আমার বাবার মতো আমিও বলি, শিক্ষা, শিক্ষা এবং শিক্ষা! আমি দেখেছি আমরা এমন একটি উম্মাহ, যাদের পরিচয় লেখক হলেও আমরা নিজেই পড়ি না। আমার একটি অনুরোধ হচ্ছে, নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, আপনি কি কখনও মাসজিদুল আকসা ও বায়তুল মাকদিস নিয়ে বই বা প্রবন্ধ পড়েছেন এবং কীভাবে এই বিষয়গুলো আমাদের ইসলামের আকীদার সাথে যুক্ত?
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বায়তুল মাকদিসকে আমাদের সংস্কৃতির অংশ করা। এই সংস্কৃতি বাস্তবিকভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মডেল। তিনি বায়তুল মাকদিসকে মদিনার সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
প্রথমত, আমাদের উচিত হচ্ছে, ইসলামী ও কুরআনী পরিভাষা ব্যবহার করা, যেনো আমরা আল-আরদুল মুকাদ্দাসাহ, বায়তুল মাকদিস এবং মাসজিদুল আকসা শব্দত্রয়ের মূল্য বুঝতে পারি এবং এ-নিয়ে গর্বিত হতে পারি।
দ্বিতীয়ত, আমাদের উম্মাহকে স্পষ্ট আশা দিতে হবে যে, আল-আকসা মুক্ত হবে; বায়তুল মাকদিস মুক্ত হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) তার সমগ্র জীবনেই এ কাজটি করে গিয়েছেন, এবং এটিই আল্লাহর ওয়াদা, যা সূরা ইসরাতে বর্ণিত হয়েছে। সূরা ইসরা পড়ুন, তাহলে মুক্তির রোডম্যাপটি আপনার সামনে স্পষ্ট হবে।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশসহ আমাদের সমাজে মুসলমানদের মধ্যে বায়তুল মাকদিস ও মাসজিদুল আকসা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা ও বিতর্ক করা দরকার।
চতুর্থত, আমার ব্যক্তিগত মডেল অনুযায়ী, প্রত্যেক রাতে ঘুমানোর আগে সূরা ইসরা পাঠ করা উচিত। দুর্ভাগ্যক্রমে, আজকের উম্মাহ এমন অভ্যাস থেকে বঞ্চিত। তিরমিযির বর্ণনায় আছে, উম্মুনা আয়েশা (রা.) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সা.) ততক্ষণ পর্যন্ত ঘুমাতে যেতেন না, যতক্ষণ না তিনি সূরা বনি ইসরাইল পড়তেন।”
ভাবুন, তিনি তাঁর শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এই অভ্যাস বজায় রেখেছিলেন!
এই চারটি বিষয়ে যদি আমরা আমাদের সমাজকে সচেতন করি, তাহলে ইনশাআল্লাহ, বাংলাদেশে এবং সমগ্র উম্মাহর মধ্যে ‘বায়তুল মাকদিস সংস্কৃতি’ প্রতিষ্ঠিত হবে।
শিউলিমালা একাডেমি: তাহলে উস্তাদ, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে আপনি বায়তুল মাকদিসের মুক্তি সম্পর্কে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী।
প্রফেসর আব্দুল ফাত্তাহ আল-ওয়াইসি: আলহামদুলিল্লাহ, আমার মনে কোনো শংকা নেই। এইযে, আমি এখন তোমাকে আমার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, এটি যেমন আমার কাছে নিশ্চিত সত্য, তেমনি আমি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি—ইনশাআল্লাহ, বায়তুল মাকদিস মুক্ত হবে এবং আপনাদের প্রজন্মই তার সাক্ষী হবে।
শিউলিমালা একাডেমি: উস্তাদ, আপনি এতটা দৃঢ় আত্মবিশ্বাস কোথা থেকে পেয়েছেন?
প্রফেসর আব্দুল ফাত্তাহ আল-ওয়াইসি: আমার আত্মবিশ্বাসের মূল উৎস হলো সূরা ইসরা। সূরা ইসরা—তার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, তুমি যা পড়বে, তাই তোমার সামনে স্পষ্ট হয়ে যাবে। এরপর, আমার আত্মবিশ্বাসের দ্বিতীয় উৎস হলো রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাদীস। তৃতীয়ত, এটি শুধু ইতিহাস থেকে নয়, বরং ইতিহাসের চলমান প্রবাহ থেকেও উদ্ভূত, যা সুন্নাতুল্লাহর পথে পরিচালিত হয়। চতুর্থত, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্ব, যেখানে ব্যাখ্যা করা হয় যে, কিভাবে একটি রাষ্ট্রের উত্থান হয় এবং একপর্যায়ে গিয়ে তার পতন হয়। এই চারটি মূল উৎসই আমাকে শক্তি, সাহস ও আত্মবিশ্বাস প্রদান করে। তবে তুমি যদি একবাক্যে জানতে চাও, তাহলে আমি বলবো, সবকিছুর মূলে রয়েছে কুরআন ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাত।
শিউলিমালা একাডেমি: উস্তাদ, আমরা জানি আপনার সমগ্র জীবন জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় নিবেদিত ছিলো, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আপনার বিশেষ ব্যুৎপত্তি রয়েছে। আপনি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বের জনক। এর মাঝ থেকে বারাকাহ সার্কেল তত্ত্ব এবং আমান তত্ত্ব নিয়ে যদি সংক্ষেপে কিছু বলতেন…
প্রফেসর আব্দুল ফাত্তাহ আল-ওয়াইসি: সংক্ষেপে বলাটা একটু কঠিন, তবে চেষ্টা করি। আমার নতুন ভূরাজনৈতিক তত্ত্ব—বারাকাহ সার্কেল তত্ত্ব—কোনো পূর্বপরিকল্পিত প্রচেষ্টার ফল নয়; বরং ধারাবাহিক ও গভীর গবেষণার ফসল। ব্রিটেন, জার্মানি ও আমেরিকার মতো পশ্চিমা দেশগুলো যেখানে আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে ভূমি দখল ও সম্প্রসারণের দিকে লক্ষ্য করে, সেখানে আমার এই তত্ত্ব সম্পূর্ণ বিপরীত এবং এটি আকসা মুক্তির এক সুস্পষ্ট নকশা।
আমি গবেষণার মাধ্যমে খুঁজে পেয়েছি, বায়তুল মাকদিসকে কেন্দ্র করে মুক্তির ক্ষেত্রে চারটি দেশ—মিশর, সিরিয়া, ইরাক ও তুরস্ক—বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এই চারটি দেশের মাধ্যমে মুক্তির সামরিক প্রস্তুতি ও বাস্তবায়ন হবে ইনশাআল্লাহ। আর দূরবর্তী মুসলিম দেশগুলোকে নিজেদের জ্ঞান, চেতনা ও প্রস্তুতিতে উন্নত করতে হবে, যাতে মুক্তির সময় তারা সহযোগী হিসেবে অংশ নিতে পারে।
আর আমান তত্ত্ব মূলত মুক্তির পর বায়তুল মাকদিসের সমাজব্যবস্থা নিয়ে। মুক্তির পর সমাজে কীভাবে পারস্পরিক সম্মান ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা হবে—এটাই এই তত্ত্বের মূল বিষয়। আমি ‘আমান’ শব্দের ইংরেজি অর্থ—Mutual Respect and Peaceful Coexistence—এর সঙ্গে তুলনা করেছি। যেমন খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর শাসনে সব ধর্মের মানুষ মুসলিম শাসনের অধীনে শান্তিতে বসবাস করতেন, ঠিক তেমনি এক নতুন সমাজ সৃষ্টি হবে, ইনশাআল্লাহ।
শিউলিমালা একাডেমি: উস্তাদ, এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। প্রথম সাক্ষাতে আপনি মুসলিম পরিবার গঠনের কথা বলেছিলেন। কিন্তু আমরা তো এমনিতেই মুসলিম পরিবারে জন্মেছি, মুসলিম সংস্কৃতিতে বড় হয়েছি। তাহলে আবার মুসলিম পরিবার গড়ার প্রয়োজন কেন?
প্রফেসর আব্দুল ফাত্তাহ আল-ওয়াইসি: পরিবার গঠনের প্রথম ধাপই হলো—সঠিক জীবনসঙ্গী নির্বাচন। একজন পুরুষের উচিত যোগ্য নারীকে বেছে নেওয়া, আর নারীরও উচিত যোগ্য পুরুষকে নির্বাচন করা। শুরুতেই যদি ভুল হয়, তাহলে তা হবে আজীবনের দুর্ভোগের কারণ।
দ্বিতীয়ত, একটি মুসলিম পরিবার পরিচালিত হতে হবে কুরআন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাত অনুযায়ী। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের আদর্শ হতে হবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনাচরণ দ্বারা গঠিত; প্রেরণা নিতে হবে উম্মাহাতুল মু’মিনীন—হযরত খাদিজা (রা.), হযরত আয়িশা (রা.), হযরত মাইমুনা (রা.) এবং হযরত উম্মে সালমা (রা.)-এর জীবন থেকে।
পরবর্তী ধাপ হলো সন্তান প্রতিপালন। সন্তান জন্মের আগেই, গর্ভাবস্থায় মা যেনো নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করেন—তা নিশ্চিত করতে হবে। আমি বহু বোনের কথা জানি, যারা গর্ভাবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত করতেন, ফলে আল্লাহর কুদরতে তাদের সন্তানরা মাত্র পাঁচ-ছয় বছর বয়সেই কুরআন হিফজ করে ফেলেছে। কারণ, তাদের ইসলামী শিক্ষা শুরু হয়েছিলো গর্ভকাল থেকেই।
সন্তান জন্মের পরও বাবা-মা দুজনের ওপর সমান দায়িত্ব বর্তায়। শুধু মায়ের উপর বা শুধু বাবার ওপর ছেড়ে দিলে চলবে না। দুজনকেই ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির আলোকে সন্তানদের গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা আলোকবর্তিকা হয়ে সমাজে ভূমিকা রাখতে পারে।
একটি প্রকৃত মুসলিম পরিবার গঠনের জন্য শুরুতেই সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সন্তানের ইসলামী মূল্যবোধে পরিপূর্ণ শিক্ষা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। এটাই একটি সফল ও বরকতময় জীবনের ভিত্তি।
শিউলিমালা একাডেমি: আমরা সবাই জানি, আমাদের ফিলিস্তিনি ভাই-বোনেরা কী অবর্ণনীয় সংগ্রাম ও অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করে চলেছেন। তাদের জীবনের সীমাহীন দুঃকষ্ট সত্ত্বেও তাদের মুখে, তাদের চোখে বা তাদের চেহারায় কখনো হতাশার ছাপ দেখা যায় না, তারা হালও ছেড়ে দেয় না। প্রফেসর আব্দুল ফাত্তাহ আল-ওয়াইসি:, আপনার দৃষ্টিতে—কোন বিশেষ গুণটি তাদেরকে সবার চেয়ে আলাদা করেছে? এবং কোন বিষয়টি তাদেরকে এতটা দৃঢ়, একতাবদ্ধ ও অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে?
প্রফেসর আব্দুল ফাত্তাহ আল-ওয়াইসি: এ-সবই ইসলামী পরিবেশে লালিত-পালিত হওয়ার ফল। এটাই হলো প্রকৃত ইসলামী পরিবার গঠনের বাস্তব ফসল।
প্রথমত, তারা জীবনসঙ্গী নির্বাচনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। একজন সৎ স্বামী বা একজন ধার্মিক স্ত্রী নির্বাচন করা তাদের পারিবারিক জীবনের মূল ভিত্তি। এখান থেকেই তাদের শক্তির যাত্রা শুরু হয়।
দ্বিতীয়ত, কুরআন। অপারেশন ‘তুফান আল আকসা’ আসার আগ থেকেই সেখানে শুরু হয়েছিলো ‘তুফান আল-কুরআন’। ফিলিস্তিনের প্রতিটি মহল্লা, প্রতিটি ক্যাম্প, প্রতিটা শহর ও গ্রামেই সকল মানুষ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একত্র হয়ে সম্পূর্ণ কুরআন খতম করতো। কুরআনের এই বন্যায় তারা নিজেদের হৃদয় ভাসিয়ে দিয়েছিলো।
আজ গাজায় যারা অবিচল দাঁড়িয়ে আছে, সীমাহীন আগ্রাসনের মুখেও যারা অটল থেকেছে, তাদের ভেতরকার সেই অনন্য শক্তি এসেছে কুরআন থেকেই। কুরআনই তাদের আঁকড়ে ধরে রেখেছে। কুরআনই তাদের দিয়েছে অফুরন্ত সাহস, ঈমানি দৃঢ়তা এবং অদম্য প্রতিরোধের শক্তি। এটাই ফিলিস্তিনিদের অদম্য শক্তির রহস্য; অর্থাৎ, ইসলামী পরিবার, ইসলামী মূল্যবোধ ও কুরআনের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক।
শিউলিমালা একাডেমি: আমার শেষ প্রশ্ন—বাংলাদেশে আসার পর আপনার অনুভূতি কেমন ছিলো? আর এখন যখন বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন কেমন অনুভব করছেন?
প্রফেসর আব্দুল ফাত্তাহ আল-ওয়াইসি: সত্যি বলছি, বাংলাদেশে এসে আমি যা দেখেছি, তার জন্য আমার মন প্রস্তুত ছিলো না। আমি ইতিবাচক অর্থেই বলছি, নেতিবাচক নয়। আমি এখানে প্রায় পনেরো দিন কাটালাম, অথচ মনে হচ্ছে যেন মাত্র কয়েক ঘণ্টা!
কেন? কারণ, আমি এখানে আমার আপন ভাই-বোনদের মাঝে ছিলাম। এক মুহূর্তের জন্যও আমার নিজেকে বিদেশি বা বহিরাগত মনে হয়নি। বিমানবন্দরে নামার সেই প্রথম মুহূর্ত থেকেই, আজ অবধি মনে হয়েছে আমি যেনো নিজের ঘরেই আছি। আমি ভেবেছিলাম, হয়তো একটু অচেনা লাগবে।
কিন্তু আল্লাহর কসম, এখানে আসার পর থেকে প্রতি মুহূর্তে মনে হয়েছে—আমি বহুদিনের পরিচিত, বহুদিনের আপন এই মাটির সাথে। এটি সম্ভব হয়েছে এখানকার ভাইদের সীমাহীন ভালোবাসা, আতিথেয়তা এবং যত্নের কারণে। তারা এমন আন্তরিকতা দেখিয়েছে—যা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।
বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার অনুভূতি—সুবহানাল্লাহ! আমি যেনো এমন এক বাংলাদেশ দেখছি, যে বাংলাদেশ বহু বছরের অন্ধকার পেরিয়ে আলোর পথে যাত্রা শুরু করেছে। হ্যাঁ, এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ আছে, অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে, কিন্তু সেই প্রথম পদক্ষেপটা শুরু হয়েছে, আর এটাই সবচেয়ে বড় কথা।
আমি আমার চোখে দেখেছি, বাংলাদেশ এক অফুরন্ত সম্ভাবনার দেশ। বিশেষ করে মানুষের মাঝে যে মেধা, মননশক্তি এবং উদ্দীপনা, তা সত্যিই অবাক করার মতো। অনেক জাতি তাদের এই মূলধন হারিয়ে ফেলেছে, কিন্তু বাংলাদেশ এখনো তা ধারণ করে রেখেছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অভাব হয়তো নেতৃত্বের, কিন্তু প্রতিভা, শক্তি ও সম্পদে এদেশ বেশ সমৃদ্ধ। শুধু প্রয়োজন আল্লাহর উপর ভরসা রেখে সামনে এগিয়ে চলা। এই দেশ সত্যিই সুন্দর। আমরা একবার অল্প সময়ের জন্য গ্রামে গিয়েছিলাম, মাশাআল্লাহ! চারপাশে শুধু সবুজের সমারোহ। বিমান থেকে নিচে তাকালেও মনে হচ্ছিল—আল্লাহ তাআলা যেনো সবুজের কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছেন এই মাটিতে।
আমি মনে করি, বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ আরও ভালো জীবনের হকদার। গাড়িতে চলার পথে যখন সাধারণ মানুষদের দেখি, তাদের চোখে অদম্য স্বপ্ন দেখি, অব্যক্ত কষ্ট দেখি। তখন মনে হয়, এরা আরও ভালো কিছুর অধিকারী হওয়ার যোগ্য। আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহর ইচ্ছায়, দৃঢ় সংকল্প, মেধা ও সঠিক নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশ অবশ্যই উন্নতির চূড়ায় পৌঁছাবে এবং একদিন এই অঞ্চলের অন্যতম নেতৃত্বশীল জাতিতে পরিণত হবে, ইনশাআল্লাহ।
শিউলিমালা একাডেমি: বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য আপনার কোনো পরামর্শ আছে?
প্রফেসর আব্দুল ফাত্তাহ আল-ওয়াইসি: জ্ঞানকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে হবে। জীবনের যেখানেই থাকুন না কেনো, শেখার সাধনা কখনোই থামানো যাবে না। জ্ঞানার্জন হতে হবে তোমাদের অস্ত্র, তোমাদের আত্মিক শক্তি।
তোমরা তোমাদের স্নাতক সম্পন্ন করো। এরপর মাস্টার্স করো। কিন্তু মাস্টার্সে থেমে থাকবে না, তোমাদের লক্ষ্য হতে হবে পিএইচডি, গবেষণা এবং বিশ্বমানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। আমি দেখেছি, এখানে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সধারীরাই শিক্ষকতা করছেন। কিন্তু উন্নত বিশ্বের বাস্তবতা ভিন্ন। যুক্তরাজ্য, তুরস্কসহ বহু দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে হলে পিএইচডি বাধ্যতামূলক। আমার অন্তর থেকে আহ্বান হচ্ছে, তোমরা উচ্চশিক্ষার এই পথে এগিয়ে যাও। বিশ্বমানের শিক্ষক, গবেষক ও চিন্তাশীল নেতৃত্ব হয়ে ওঠো।
আর প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি আমার বিশেষ বার্তা হচ্ছে, আপনারা দেশে ফিরে আসুন, ফিরে আসুন, ফিরে আসুন। আমি ইচ্ছাকৃতভাবে তিনবার বলছি, কারণ এটি শুধু অনুরোধ নয়, এটি এক জরুরি আহ্বান। বাংলাদেশের তরুণরা জেগে উঠেছে। এই নবযাত্রায় আপনাদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও নেতৃত্ব অপরিহার্য। আপনারা যারা বিশ্বব্যাপী উচ্চশিক্ষায়, গবেষণায় বা ব্যবসায়ে প্রতিষ্ঠিত, আপনাদের প্রত্যাবর্তনেই বাংলাদেশ পাবে তার প্রকৃত শক্তি। দেশের পথে, জাতির সেবায়, আপনাদের এগিয়ে আসতে হবে। বিশ্বাস রাখুন, আপনাদের হাত ধরেই একদিন বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, ইনশাআল্লাহ।
শিউলিমালা একাডেমি: উস্তাদ, আমরা কিভাবে আমাদের দেশ থেকেই মাকদিসি হয়ে উঠতে পারি?
প্রফেসর আব্দুল ফাত্তাহ আল-ওয়াইসি: এটা কোনো কঠিন বিষয় নয়।
বায়তুল মাকদিসি হওয়ার একমাত্র শর্ত হচ্ছে, তুমি যদি তোমার জীবন ও তোমার অস্তিত্বের একটি অংশ বায়তুল মাকদিসের মুক্তির জন্য উৎসর্গ করো, তাহলে তুমিও মাকদিসি হতে পারবে।
তুমি যেমন তোমার দেশের জন্য, তোমার মাটি ও তোমার মানুষের জন্য সংগ্রাম করবে, ঠিক তেমনি তুমি যদি বায়তুল মাকদিসের জন্য, তার পবিত্র ভূমির মুক্তির জন্য কাজ করো, তবে তুমি নিজেও মাকদিসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠবে। তখন পৃথিবীর কোনো শক্তিই তোমাকে সেই পরিচয় থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না। তোমার প্রার্থনা, তোমার সাধনা, তোমার শক্তির উৎস হবে বায়তুল মাকদিস। এভাবেই তুমি মাকদিসি হয়ে উঠতে পারবে।
মাকদিসি নামের এই মর্যাদা অর্জন করা ভৌগলিক কোনো বিষয় নয়। এটি হৃদয়ের, আত্মার ও ভালোবাসার প্রশ্ন। তোমার অন্তরে যদি এই পবিত্র মাটি, সেই মক্কা, মদীনা, আর আল-আকসা থাকে, তবে তুমিও একজন মাকদিসি। এটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিশাল উপহার, যা কেউ কেড়ে নিতে পারে না।
শিউলিমালা একাডেমি: উস্তাদ, আপনার এই অমূল্য সময় ও ধৈর্য্যের জন্য আমরা কৃতজ্ঞ থাকবো।
আপনার এই কথাগুলো আমাদের হৃদয়ে অমলিন হয়ে থাকবে।

প্রফেসর আব্দুল ফাত্তাহ আল-ওয়াইসি: আমি-ও কৃতজ্ঞ। এই মুহূর্তগুলো আমি যতদিন বেঁচে থাকব, মনে রাখব। আল্লাহর ইচ্ছায়, তোমাদের সকল কাজ সঠিক পথে এগিয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তোমাদের সকলকে মাকদিসি হয়ে ওঠার তাওফিক দিক, আমিন।নশাআল্লাহ। আল্লাহ তোমাদের সকলকে মাকদিসি হয়ে ওঠার তাওফিক দিক, আমিন।
অনুবাদ: জান্নাত আরা তাবাসসুম