শিউলিমালা একাডেমি

বাংলার বস্ত্রশিল্পের শুরু যেখান থেকে…

ভূমিকা :

সুদূর অতীতকাল থেকে বাংলা ভূ-খন্ড যে কারণে পৃথিবীব্যাপী সুপরিচিত ছিল, আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছিল, তার অন্যতম প্রধান কারণ হলো বয়নশিল্প বা বুননশিল্প। সেই সূত্রে বাংলার মসলিনের কিংবদন্তী আজও সবার মুখে মুখে ফেরে।

শত শত বছর ধরে অতি সাধারণ স্থানীয় কিছু যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে বাংলাদেশের তাঁতিরা দক্ষ হাতে  চরম নিপুণতার সহিত যেসব উৎকৃষ্ট ছড়িয়ে পড়ত সারা পৃথিবীতে। এ কথা অনস্বীকার্য, আঠারো-উনিশ শতক পর্যন্ত বাংলা ছিল ‘পৃথিবীর তাঁতঘর’।

পরিব্রাজক টাভারনিয়ার লিখেছেন, ইরানের রাষ্ট্রদূত মোহম্মদ আলী ভারতবর্ষ থেকে দেশে ফেরার সময় সম্রাটের জন্য অনেকটা উটপাখির ডিমের মতো একটি নারকেলের খোল নিয়ে গিয়েছিলেন। সেটা খোলার পর দেখা গেল, এর ভেতর রয়েছে ৬০ হাত দীর্ঘ ঢাকাই মসলিন। সে সময় একটি সরু আংটির ছিদ্রের ভেতর দিয়ে ৩ গজ প্রস্থ ও ২০ গজ দৈর্ঘ্যের কাপড় টেনে নেওয়া যেত— এমন গল্প প্রচলিত আছে। এসব কিংবদন্তির সত্য-মিথ্যা নিরূপণ করা দুরূহ হলেও একটা বিষয় কিন্তু বেশ স্পষ্ট—বাংলার মসলিন এমন এক উৎকর্ষে পৌঁছেছিল, যা প্রায় অবিশ্বাস্য!

বিশ্বজুড়ে বয়নশিল্পের ঐতিহ্য এবং এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের জামদানি বয়নশিল্প আজও আভিজাত্য ও নান্দনিক সুষমায় উদ্ভাসিত। পৃথিবীজুড়ে ঢাকাই জামদানি, মসলিনের কদর-সুনাম বিস্তৃত। এই জামদানি ডিজাইনের নমুনা ইরানি শিল্প থেকে প্রাপ্ত– রঙের বিন্যাস ছিল রুচিসম্মত ও বাহুল্যবর্জিত। সে সময়ের জামদানি তাঁতিদেরও অনুমান ইরানের কিংখাব বয়ন নকশা জামদানিকে প্রভাবিত করেছে। জামদানির মূল ও আদি নকশার আলংকারিক সূক্ষ্মতা এর নান্দনিক সৌন্দর্যই একে পৃথিবীখ্যাত করে তুলেছে। আর বংশপরম্পরায় বয়নশিল্পীদের ভালোবাসা ও নিষ্ঠা এই শিল্পকে এখনও পর্যন্ত হারিয়ে যেতে দেয়নি।

আমাদের দেশের প্রায় সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর আছে নিজস্ব নকশা ও মোটিফ। তাদের মধ্যে তাঁতি হিসেবে নারীদের আধিপত্য একচেটিয়া। পার্বত্য এলাকায় পুরুষেরা সাধারণত তাঁতের কাজ করেন না। তবে সাম্প্রতিক কালে নরসিংদী অঞ্চলের কিছু দেশান্তরি পুরুষ বয়নশিল্পী পার্বত্য এলাকায় কাজ করছেন।

সিলেটের মণিপুরিদের তাঁতের সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে এবং তারা সেটা কিছু মাত্রায় এখনও চর্চা করে। এছাড়াও কুমিল্লার খাদি; কুষ্টিয়ার গামছা, লুঙ্গি, চাদর ইত্যাদি এখনও বিখ্যাত। তবে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ঘটেছে প্রায় সবখানেই। ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা অঞ্চলের মান্দিদের তাঁতযন্ত্রটি কিছুটা ভিন্ন। মান্দিরা ব্যবহার করে ভূমিতে সমান্তরাল তাঁত। তবে বর্তমানে এই তাঁতের প্রচলন প্রায় নেই বললেই চলে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষেরা একসময় নিজেরাই নিজেদের জন্য প্রয়োজনীয় সব বস্ত্র তৈরি করত ‘কোমর’ তাঁতে– যা এখন বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে।

প্রধানত বিভিন্ন হাটের মাধ্যমে এসব তাঁতপণ্য বিক্রয় ও বিপণন হয়ে থাকে। ঢাকার ডেমরা ও তারাব, নরসিংদীর বাবুর হাট, টাঙ্গাইলের বাজিতপুর ও করটিয়া, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ও বেলকুচি, কুষ্টিয়ার কুমারখালী ও পোড়াদহ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ তাঁতের হাট।

তাঁতশিল্পের সূত্রপাত :

অবিভক্ত বাংলায় ঠিক কবে তাঁতশিল্পের সূত্রপাত হয়েছে, তা অবশ্য নির্দিষ্ট করে জানা যায় না। তবে বিভিন্ন প্রত্ন-প্রমাণ, সাহিত্যিক সূত্র ইত্যাদি পর্যালোচনা করে মনে হয়, অন্তত আড়াই হাজার বছর আগে এই ভূখণ্ডে তাঁতশিল্প বেশ ভালোভাবেই বিকশিত হয়েছিল। অবিভক্ত বাংলায় সবচেয়ে প্রাচীন তাম্র-প্রস্তর যুগের মানব বসতির প্রমাণ পাওয়া গেছে পশ্চিম বাংলার অজয় নদীর তীরবর্তী বর্ধমান জেলার পান্ডুরাজার ঢিবি থেকে। যার আদি স্তরটির কাল– আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১২৫০-১২০০ অব্দ। এই স্তরে বাংলার তাঁতশিল্পের নিদর্শন অনুপস্থিত। তবে এই প্রত্নস্থলের দ্বিতীয় স্তর থেকে একটি মৃৎখণ্ডের গায়ে রেশম-সুতি বস্ত্রের ছাপ পাওয়া গেছে বলে কোনো কোনো গবেষক উল্লেখ করেছেন। তা যদি সত্যি হয়, তাহলে খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দ (কিংবা তার আগেই) অবিভক্ত বাংলায় তাঁতশিল্পের প্রচলন হয়ে থাকতে পারে বলে অনুমান করা যায়।

খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের গুরুত্বপূর্ণ মানব বসতির যে চিহ্ন পাওয়া গেছে নরসিংদী জেলার উয়ারী-বটেশ্বরে, তা থেকে এখনও এমন কোনো নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়নি, যার ওপর ভিত্তি করে বলা যেতে পারে যে এখানে তাঁতশিল্পের প্রচলন ঘটেছিল। তবে গবেষকেরা দাবি করছেন, এটি ছিল একটি বন্দরনগরী এবং সুদূর ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে উয়ারী-বটেশ্বরের একটি সমৃদ্ধিশালী বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। শুধু তা-ই নয়, তারা এই প্রত্নস্থানকে মিসরীয় ও গ্রিক সূত্রে বর্ণিত সৌনাগড়া বা গঙ্গাঋদ্ধি হতে পারে বলে প্রস্তাব করেছেন। সে হিসেবে তৎকালীন উয়ারী-বটেশ্বরেও তাঁতশিল্পের কেন্দ্র গড়ে উঠতে পারে বলে দূর-অনুমান করা সম্ভব। কেননা, ভিনদেশি সাহিত্যিক সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, সৌনাগড়া বা গঙ্গাঋদ্ধি থেকে প্রচুর উন্নত শ্রেণির সূক্ষ্ম তাঁতবস্ত্র বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হতো।

তাঁতশিল্পের প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উপাদান পাওয়া গেছে বগুড়ার মহাস্থানগড় (খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক), পশ্চিম বাংলার চন্দ্রকেতুগড় (খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয়-প্রথম শতক) ইত্যাদি প্রত্নস্থান থেকে। এসব স্থানে মৌর্য-সুঙ্গ কালপর্বের (খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয়-দ্বিতীয় শতক) কিছু পোড়ামাটির ফলক পাওয়া গেছে, যেগুলোয় সে সময়ের বস্ত্র বা পোশাকের নিদর্শন দেখা যায়। এ ছাড়া বিহারের দিদারপুর থেকে প্রাপ্ত খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের যক্ষী মূর্তিটির কথা উল্লেখ করা যায়। এই মূর্তির পোশাকের ধরনের সঙ্গে শাড়ি পরার সাদৃশ্য দৃষ্টিগোচর হয়।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে শুরু করে পরবর্তীকালের যেসব পুরাতাত্ত্বিক বাস্তব প্রমাণ (পোড়ামাটির ফলক, ভাস্কর্য ইত্যাদি) পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোয় লক্ষ করলে সে সময় সূক্ষ্ম ও স্বচ্ছ বস্ত্রের ব্যবহার ছিল বলে সহজেই অনুমান করা যায়। পোড়ামাটির ফলক বা ভাস্কর্যগুলোতে যে ধরনের স্বচ্ছ ও মিহি বস্ত্রের ব্যবহার দেখা যায়, তা উন্নত কৌশল ও দক্ষতার পরিচয় বহন করে। হঠাৎ করে এমনটি হতে পারে না। দীর্ঘদিনের শ্রম ও অধ্যবসায়ের ফলে তৎকালীন মানুষ বস্ত্রশিল্পে এই উৎকর্ষ অর্জন করেছিল। সে হিসেবে বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের বয়স আরও প্রাচীন হওয়া খুবই সম্ভব। কিন্তু সে বিষয়ে উল্লেখ করার মতো কোনো প্রত্ন-প্রমাণ নেই।

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের শেষার্ধে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের হাত ধরে মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় (খ্রিস্টপূর্ব ৩২১)। বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের অংশবিশেষ সেই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তা নিশ্চিত হওয়া গেছে মহাস্থানগড় থেকে প্রাপ্ত শিলালিপির মাধ্যমে। মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্তের প্রধানমন্ত্রী বলে প্রচারিত কৌটিল্য (আরেক নাম চাণক্য) রচিত অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে সুনির্দিষ্টভাবে তাঁতশিল্প, বস্ত্র উৎপাদনব্যবস্থা, তাঁতিসমাজ ইত্যাদি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ রয়েছে। অর্থশাস্ত্র-এর রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের শেষ দিক কিংবা তৃতীয় শতক হিসেবে ধরা হয়। সবচেয়ে পুরোনো কিন্তু বিস্তারিত বিবরণ হিসেবে অর্থশাস্ত্র বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

এছাড়া ভিনদেশি সূত্র হিসেবে মেগাস্থিনিস’র- ইন্ডিকা (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ-তৃতীয় শতক), অজ্ঞাত লেখকের- দ্য পেরিপ্লাস অব ইরিথ্রায়েন সি ইত্যাদি গ্রন্থে তাঁতবস্ত্র ও বাণিজ্য বিষয়ক নানা তথ্যাদি সম্পর্কে জানা যায়। এছাড়াও তাঁতযন্ত্র ও তাঁতির উল্লেখ আছে চর্যাপদে। বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যেও নানা ধরনের তাঁতবস্ত্রের কথা জানা যায়। টলেমির ভূগোল (খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতক) ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা যায়। এসব বিবরণ থেকে বুঝে নেয়া যায়, মৌর্য আমলে বাংলাদেশে তাঁতশিল্প যথেষ্ট বিকশিত হয়েছিল। ফলে এ কথা বলা বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না যে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের অনেক আগেই বাংলাদেশ ভূখণ্ডে তাঁতশিল্পের সূত্রপাত হয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক সূত্র আমাদের সে রকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিকদের বিবরণ অনুযায়ী প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে যেসব ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী অবিভক্ত বাংলা অঞ্চলে বসবাস করেছে, তাদের একটি হলো আদি-অস্ট্রোলয়েড বা অস্ট্র্রিকভাষী জনগোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠীর মাধ্যমেই বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক সভ্যতার পত্তন হয় বলে ঐতিহাসিকদের অভিমত। অস্ট্রিকভাষীদের মাধ্যমেই বাংলাদেশে তাঁতশিল্পের সূত্রপাত বলে মনে করা হয়। নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন, “তুলার কাপড়ের ব্যবহারও অস্ট্রিকভাষীদের দান। কর্পাস (কার্পাস) শব্দটিই মূলত অস্ট্রিক। পট (পট্টবস্ত্র, বাংলা পট্, পাট), কর্পপ (পট্টবস্ত্র) এই দুটি শব্দও মূলত অস্ট্রিক ভাষা হইতে গৃহীত। মেড়া বা ভেড়ার সঙ্গে ইহারা পরিচিত ছিল। ‘কম্বল’ কথাটিও কিন্তু মূলত অস্ট্রিক, এবং আমরা যে অর্থে কথাটি ব্যবহার করি, সেই অর্থেই এই ভাষাভাষী লোকেরাও করে।”

কিন্তু অস্ট্রিকভাষী জনগোষ্ঠী ঠিক কখন থেকে এই অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করে, তা নিশ্চিত করে বলার মতো তথ্য-প্রমাণ নেই। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা তাম্র-প্রস্তর যুগের প্রত্নস্থান পান্ডুরাজার ঢিবি ও সমসাময়িক অন্যান্য প্রত্নস্থানের মানুষেরা নৃতাত্ত্বিক বিচারে আদি অস্ট্রোলয়েড বা অস্ট্রিকভাষী হতে পারে বলে অনুমান করেছেন। কিন্তু নিশ্চিত করে বলার মতো তথ্য আজও উদ্ধার হয়নি। বিচ্ছিন্ন নানান বিবরণ থেকে বলা যায় যে অন্তত খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক (কিংবা তার আগেই) অস্ট্রিকভাষীদের মাধ্যমে বাংলাদেশে তাঁতশিল্পের সূত্রপাত হয়ে থাকতে পারে।

তাই, এই ভূখণ্ডে তাঁতশিল্পের সূত্রপাত অন্তত খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ বা পঞ্চম শতকে ঘটেছিল বলা হলে সম্ভবত তা ভুল হবে না। বিশেষ করে, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের বিবরণ আমাদের সে রকম ইঙ্গিত দেয়। সব মিলিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে, অন্তত খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে (কিংবা তার আগেই) বাংলাদেশে তাঁতশিল্পের সূত্রপাত হয়ে থাকতে পারে। ভবিষ্যতে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের মাধ্যমে আরও অনেক অজানা তথ্য উদ্ঘাটিত হলে এই সময়ের পরিধি আরও বাড়তে পারে- সেই সম্ভাবনা এখনও রয়েছে।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও রাজনীতি, যুদ্ধবিগ্রহ, নতুন বাণিজ্যিক পথ চালু হওয়া, প্রযুক্তির বিকাশ, বিভিন্ন সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন- সবকিছু বিভিন্ন মাত্রায় বাংলাদেশের তাঁতশিল্পকে প্রভাবিত করেছে। যেমন- গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ (খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দ) ভারতের সঙ্গে বাইরের দেশগুলোর যোগাযোগ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অনুমান করা যেতে পারে, বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও এর প্রভাব পড়েছে। আবার মৌর্য সম্রাট অশোকের আমলে (খ্রিস্টপূর্ব ২৭২-২৩২ অব্দ) যে বিশাল সাম্রাজ্যের পত্তন ঘটেছিল, নিশ্চিতভাবেই বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের কিছু অংশ ছিল তার সেই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। ফলে সেই সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের তাঁতপণ্য দেশে এবং দেশের বাইরে বিপণন হতে পারে। অন্তত কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রর বিবরণে বঙ্গের বিভিন্ন ধরনের তাঁতবস্ত্রের প্রশংসা এবং সে সময়কার রপ্তানি-বাণিজ্যের যে চিত্র পাওয়া যায়, তা আমাদের এমনটা ভাবতে সাহায্য করে। স্থল ও জলপথে সে সময় এসব রপ্তানি বাণিজ্য হতো বলে মনে করা হয়। অন্তত খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক পর্যন্ত এই ধারা বজায় ছিল। এবং সে সময় বাংলাদেশের তাঁতশিল্পজাত বিভিন্ন পণ্যও যে তাতে অন্তর্ভুক্ত ছিল, সেটা অনুমান করা যায় সহজেই।

তবে গবেষকেরা মনে করেন, খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের পর বাংলার সমৃদ্ধ সমুদ্রবাণিজ্য হীনবল হয়ে পড়েছিল বা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে বারো শতক পর্যন্ত আর তেমন কোনো বাণিজ্যের তথ্য মেলে না। তবে তেরো-চৌদ্দ শতকের দিকে আবার তা বিকশিত হয়ে ওঠে। সোনারগাঁ, সাতগাঁও, চট্টগ্রামের উত্থান ঘটে এই সময় থেকেই। কয়েক শতক পর আবার বাংলার সমুদ্র বাণিজ্য শুরু হবার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো মোঙ্গলদের আক্রমণ, ক্রসেড ইত্যাদি কারণে এশিয়া ও ইউরোপের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথ পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের ওপরেও যে এই পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছিল, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

তবে পনেরো শতকের শেষে ভাস্কো-দা-গামা নামক একজন পর্তুগিজ নাবিক আফ্রিকা ঘুরে ভারতের কালিকট বন্দরে এসে নামেন (১৪৯৮)। এই ঘটনার প্রায় ১১০ বছর পর পূর্ব বাংলা মুঘলদের অধীনস্থ হয় এবং ঢাকা হয় নতুন প্রাদেশিক রাজধানী। বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের নিরিখে এই দুটি অন্তত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

ইউরোপের সঙ্গে ভারতের সরাসরি বাণিজ্যপথ আবিষ্কৃত হওয়ার পর বিভিন্ন ইউরোপীয় বণিকগোষ্ঠী দলে দলে ভারতে এসেছিল। তারা যেসব পণ্যের ব্যবসায় নিজেদের নিযুক্ত করেছিল, তার একটি ছিল বিভিন্ন ধরনের তাঁতপণ্য। তবে বিদেশি বণিকদের কথা বলার আগে সুলতানি ও মুঘল আমলের শাসকশ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতার কথা বলে নেয়া যাক।

সুলতানি ও মুঘল আমলে তাঁতশিল্প :

সুলতানি আমলের (তেরো থেকে ষোলো শতক) বিভিন্ন শাসক বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। বিদেশি পর্যটক বা বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির নথিপত্রে আমরা যেসব বিবরণ পাই, তাতে নির্দ্বিধায় বলা যায়, সুলতানি আমলে বাংলাদেশ তাঁতপণ্যের একটি সমৃদ্ধ উৎপাদন কেন্দ্র ছিল। তবে বাংলাদেশ মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলে এবং ঢাকা নতুন প্রদেশের রাজধানী হওয়ার পরে এখানকার তাঁতশিল্প বিশেষ গতি লাভ করেছিল। মুঘল সম্রাট এবং সভাসদেরা বাংলার তাঁতপণ্যের অত্যন্ত গুণগ্রাহী ছিলেন এবং তাঁরা অকুণ্ঠভাবে এই শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। ফলে মুঘল আমলকেই বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল পর্ব বলা যেতে পারে।

তবে সুলতানি আমলেই বিভিন্ন বিদেশি বণিক বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের রপ্তানি বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছিল। মুঘল আমলে এই বাণিজ্যের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায়। ফলে মুঘল পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি এই বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধিও বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সে ক্ষেত্রে বিদেশি বণিকদের ভূমিকাও অস্বীকার করা যাবে না।

তবে মুঘল আমল শেষে বাংলাদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপন (১৭৫৭) বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসে যেমন, তেমনি তাঁতশিল্পের ইতিহাসেও গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। যদিও প্রাথমিকভাবে ব্রিটিশ উপনিবেশ হবার পর বাংলাদেশের তাঁতশিল্পে এর তেমন কোনো বিরূপ প্রভাব পড়েনি। উল্লেখ্য, মুঘল আমলেও বাংলাদেশের তাঁতিরা যে খুব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটাত, তা নয়। কিন্তু ব্যাপক কোনো অনিয়ম-অত্যাচার না হওয়ায় তারা সহজ-সরলভাবে জীবনযাপন করতে পারতো। কিন্তু ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজনৈতিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়ীদের হটিয়ে দিয়ে তাঁতের ব্যবসায় তারা অনেকাংশে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করেছিল। এ ছাড়া বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের জন্য বৈরী রাজস্ব নীতি তৈরি করে নিজেদের দেশের তাঁতশিল্পের উন্নতি করলেও এ দেশের তাঁতশিল্পের রক্ষা ও উন্নতিতে কোনো অবদান রাখেনি। আঠারো শতকের শেষার্ধে এই অবক্ষয় শুরু হয়েছিল এবং উনিশ শতকের মধ্যে বা বিশ শতকের আগেই বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের সোনালি দিন শেষ হয়ে গিয়েছিল।

বিশ শতকের শুরুতেই স্বদেশি আন্দোলনের ফলে দেশে আবার চরকায় সুতা কাটা ও দেশি কাপড় ব্যবহারের জোয়ার বয়ে যায়। এমনকি বিদেশি পণ্য- বিশেষ করে বিদেশি বস্ত্র পোড়ানোর কথাও জানা যায়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, ভদ্রলোক শ্রেণির ভেতর তাঁত সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হয়। যদিও সেটা অচিরেই বিনষ্টও হয়। তা ছাড়া এ সময় দেশি উদ্যোক্তারা কলের সুতা ও বিদেশি প্রযুক্তি আমদানি করে মোটা কাপড় তৈরি করতে শুরু করেছিল, সেটাও স্বদেশি আন্দোলনেরই ফসল।

স্বদেশি আন্দোলনের পাশাপাশি আমরা লক্ষ করি যে বিশ শতকের শুরু থেকেই বাংলাদেশের তাঁতশিল্পকে বাঁচানোর কিংবা পুনরুদ্ধারের জন্য নানা রকম সরকারি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এর ফলে ঘটেছে করণকৌশলগত পরিবর্তন। বিশ শতকের শুরুতে, প্রথম ৩০ বছরের মধ্যেই, বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পের সনাতনী পদ্ধতিগুলোর বদলে নতুন নতুন কৌশলের সূত্রপাত ঘটে। ফলে শত শত বছর ধরে বাংলাদেশের তাঁতিরা যে পদ্ধতি ও কৌশল অবলম্বন করে বস্ত্র বয়ন করত, তার পরিবর্তন ঘটে। এই ঘটনার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের তাঁতশিল্পে। তৎকালীন বঙ্গীয় কৃষি ও শিল্প বিভাগ এগ্রিকালচার অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ ডিপার্টমেন্ট, গভর্নমেন্ট অব বেঙ্গল এবং কারিগরি শিক্ষাসংক্রান্ত সরকারি নথিপত্র দেখলে এই পরিবর্তনের কারণ ও উপলক্ষ সম্পর্কে জানা যায়। সেখানে দেখা যাচ্ছে, বিশ শতকের প্রথম দশকেই এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল এবং ১৯০৮ সালে সেই উদ্যোগের ফলস্বরূপ শ্রীরামপুরে একটি বয়ন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আরও অনেক স্থায়ী ও ভ্রাম্যমাণ বয়ন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এগুলোর মাধ্যমে তাঁতশিল্পের বেশ কিছু গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। তা ঘটেছিল ১৯২০ থেকে ১৯৩০-এর মধ্যেই। প্রথমত সনাতন গর্ত তাঁতে হাতে ছোড়া মাকুর বিকল্প হিসেবে ফ্লাই সাটল লুম বা ঠকঠকি তাঁতের প্রচলন ঘটে। এর ফলে বস্ত্র উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয়ত, ডবি ও জ্যাকার্ড মেশিনেরও অল্পবিস্তর প্রচলন ঘটে। এর ফলে তাঁতের কাপড়ে বিভিন্ন ধরনের নকশা করা সহজ হয়ে যায়। তৃতীয়ত, কৃত্রিম রঞ্জন পদ্ধতির সূচনা ঘটে। এর ফলে সুতা ও কাপড়ে নানা ধরনের রঙ করা সহজ হয়ে ওঠে। রঙে বৈচিত্র্য আসে।। পাশাপাশি সনাতনী প্রাকৃতিক রঞ্জনশিল্প ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যেতে থাকে। এভাবে, বিশ শতকের প্রথমার্ধেই, বাংলাদেশের তাঁতশিল্প ব্যাপক কৃৎকৌশলগত পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল, যার প্রভাব এখনো বিদ্যমান।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের মধ্য দিয়ে দেশভাগের ফলে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের তাঁতশিল্পে প্রাথমিক যে প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, তা হলো তাঁতিদের দেশান্তরের গল্প। এ দেশের তাঁতিদের একটা বড় অংশ ছিল হিন্দুধর্মাবলম্বী। যেমন- বসাক তাঁতি, বঙ্গ তাঁতি, যোগী, কাপালী ইত্যাদি। তা ছাড়া আর্থিক লাভজনক এই বিবেচনায় কিংবা স্বদেশি আন্দোলনের কালে অনেক নমঃশূদ্র ও অন্যান্য জাতের লোক তাঁতের কাজ বেছে নিয়েছিল পেশা হিসেবে। তাঁতবস্ত্রের ব্যবসার সঙ্গেও যুক্ত ছিল অনেক হিন্দু ব্যবসায়ী। দেশভাগের পর তাঁতের সঙ্গে যুক্ত এই হিন্দুধর্মাবলম্বীদের একটা বড় অংশ নিজেদের ব্যবসা, বসতবাড়ি ও মাতৃভূমি ত্যাগ করে ভারতের পশ্চিম বাংলাসহ অন্যান্য প্রদেশে চলে যায়। স্বাভাবিক কারণেই এ দেশের তাঁতশিল্পের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

পক্ষান্তরে, দেশভাগের কারণে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে অনেক ইসলাম ধর্মাবলম্বী বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) চলে আসে নতুন জীবনের খোঁজে। এদের মধ্যে তাঁতের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল অনেকেই। অবাঙালি মুসলমান তাঁতিদের মধ্যে বেনারস থেকে আসা বেনারসি তাঁতিদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কেননা, এদের মাধ্যমে বাংলাদেশে, প্রধানত ঢাকায়, বেনারসি শাড়ির একটা নতুন ঘরানা চালু হয়। এ ছাড়া পশ্চিম বাংলা বা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাঙালি মুসলমান তাঁতিদের অনেকে বাংলাদেশে এসেছিল। তবে তারা এ দেশের মূল তাঁতশিল্পের ধারার সঙ্গে মিশে গেছে। বেনারসি তাঁতিদের মতো তাদের এখন আলাদা করে চিহ্নিত করা মুশকিল। তা ছাড়া বিশেষ কোনো ঘরানাও তারা তৈরি করতে পারেনি।

পাকিস্তানপর্বে (১৯৪৭-১৯৭১) বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের ইতিহাসে আরও যে পরিবর্তন ঘটে সেগুলো হলো, এই কালপর্বে বাংলাদেশে অনেক কটন মিল তৈরি হয়। কেননা, দেশভাগের পর এ দেশের তাঁতশিল্পের চাহিদা মেটানোর মতো সুতার কারখানা বা কটন মিল ছিল না। সুতার অভাব দূর করার জন্য মূলত এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তারপরও সুতার চাহিদা সে সময় পুরোপুরি মেটেনি। তৎকালীন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে এ ধারণা পাওয়া যায়। আর পাকিস্তানপর্বে বাংলাদেশে তুলা চাষের তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। পাকিস্তানের দুই অংশের তুলায় মূল উৎপাদনকেন্দ্র ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। এর প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল দেশ স্বাধীন হবার পর, সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে। আসলে পাকিস্তান সরকারের অনাগ্রহ ও বিরুদ্ধনীতির কারণে এ দেশের তাঁতশিল্প সেভাবে বিকশিত হয়নি।

স্বাধীনতাত্তর বাংলাদেশে তাঁতশিল্প :

বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলে আরও অনেক ক্ষেত্রের মতো তাঁতশিল্পেরও নানা সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল। তবে প্রাথমিকভাবে সবচেয়ে বড় যে সংকটের সম্মুখীন হতে হয়েছিল, তা হলো তুলার অভাব। পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের তাঁতশিল্প তুলার জন্য পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর সেখান থেকে তুলা আসার পথ বন্ধ হয়ে যায়। প্রাথমিকভাবে এই সংকট মোকাবিলার জন্য সত্তরের দশকে সরকারি ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু তা নানা কারণে অচিরেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এরপর থেকে বাংলাদেশে তুলা চাষের লক্ষণীয় কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। স্বাধীনতার পর তুলার কল বা কটন মিলের সংখ্যা বাড়লেও তুলার জন্য বাংলাদেশ আশির দশক থেকে এখন পর্যন্ত (২০১৮) প্রায় পুরোপুরি আমদানির ওপর নির্ভরশীল।

আশির দশক থেকে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রঞ্জন পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা চলছে। খুব সীমিত পরিসরে হলেও নাগরিক মহলে এ বিষয়ে সচেতনতা বেড়েছে। তবে এখনো তা একটি গন্ডির ভেতর আবদ্ধ হয়ে আছে।

বাংলাদেশে পাওয়ার লুমের সংখ্যা আরও বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে হস্তচালিত তাঁতশিল্পের ওপর। সত্তর ও আশির দশকেও মিলের কাপড় ও হস্তচালিত তাঁতের কাপড়- উভয়েরই বাজার ছিল। কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে পাওয়ার লুমের প্রভাবে এবং পাওয়ার লুমে উৎপাদিত তাঁতপণ্যের সঙ্গে টিকতে না পেরে হস্তচালিত তাঁতশিল্প ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু। এই সময় থেকেই ব্যাপক পরিমাণ হস্তচালিত তাঁতে কাপড় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় এবং ব্যাপকসংখ্যক তাঁতি কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় যুক্ত হয়।

তবে সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তনটি ঘটেছে, সেটা হলো বাঙালি-সংস্কৃতি ও চেতনার ওপর ভিত্তি করে হস্তচালিত তাঁতশিল্পের নতুন বাজার তৈরি হয়েছে শহরে। প্রধানত মধ্যবিত্ত ও দেশি এলিট শ্রেণি এবং কিছু বিদেশি এই বাজারের মূল ক্রেতা। সত্তরের দশকে এই বাজার তৈরি শুরু হলেও আশি ও নব্বইয়ের দশকে তা বিকশিত হয়। বর্তমানে নগরের এই নতুন বাজার দেশের হস্তচালিত তাঁতশিল্পের জন্য অনেকাংশে সহায়ক হয়েছে। অনেক তাঁত কারখানায় আবার কাজ শুরু হয়েছে শহরের নতুন বাজারকে কেন্দ্র করে। নগরের এই বাজার তৈরিতে শহরের বিভিন্ন ফ্যাশন হাউজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

উপসংহার :

কিংবদন্তিময় মসলিন বিলুপ্ত হয়ে গেছে বহু আগে। তাঁতশিল্পের সোনালি দিন, পৃথিবীজুড়ে রপ্তানি বাণিজ্য- তা-ও অতীতের গল্প। শেষ হয়েছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন, পাকিস্তানি শাসনেরও অবসান হয়েছে- সেটিও বছর চল্লিশেক আগের কথা। স্বাধীন বাংলাদেশে কেটে গেছে অনেক সময়। শেষ হয়েছে বিংশ শতাব্দী। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে দাঁড়িয়ে যদি বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি কিংবা ভবিষ্যতের দিকে তাকাই, তাহলে কি খুব বেশি আশ্বস্ত হওয়া যায়?

গত ১০০ বছরের ইতিহাস যদি আমরা খেয়াল করি, তাহলে দেখতে পাবো, খুব বেশি আশাহত হওয়ারও কিছু নেই। এত চড়াই-উতরাইয়ের পরও এই শিল্প যে টিকে আছে, তার কারণটি কী? আগেই বলা হয়েছে, যে তুলা এখন আমরা ব্যবহার করি, তা উৎপাদন করি না, যে সুতা ব্যবহার করি, তার একটা বড় অংশ আসে দেশের বাইরে থেকে আর যে সুতা আমরা তৈরি করি, তার প্রযুক্তি আমরা আমদানি করেছি অন্য দেশ থেকে। কখনো কখনো সুতাও আনি বিদেশ থেকে। যে রঙ দিয়ে আমরা সুতা বা কাপড়গুলো বিচিত্র বর্ণে রঙিন করি, তা অন্য দেশ থেকে আমাদের আনতে হয়। জ্যাকার্ড, ডবিসহ যেসব তাঁতযন্ত্র আমরা এখন ব্যবহার করি, তার বেশির ভাগ দেশি প্রযুক্তি নয়; যদিও তা এখন দেশেই তৈরি হচ্ছে (পাওয়ার লুমের কথা এখানে বলা হচ্ছে না)। তাহলে কী আছে আমাদের নিজেদের, যা নিয়ে আমরা গর্ব বোধ করতে পারি, আশাবাদী হয়ে উঠতে পারি? হ্যাঁ, আছে- তা হলো এ দেশের তাঁতি সমাজ।

সময়ের বাঁকে নানা অনুঘটকের প্রভাবে এই বয়নশিল্পের নান্দনিকতা ও বিষয়বস্তুর শুদ্ধতা আজ বিপর্যস্ত প্রায়। স্বকীয়তা বিবর্জিত, ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সুতার মান সম্পর্কে অজ্ঞতা ও মোটা সুতার ব্যবহার, গুণগত মান সম্পর্কে উদাসীনতা, পৃষ্ঠপোষকদের ব্যক্তিগত ভাবনার অগ্রাধিকার, ক্রেতার আগ্রহকে গুরুত্ব দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোক্তাদের অধিকতর বিপণনমুখী করার ভ্রান্তির সঙ্গে যোগ হয়েছে বয়নশিল্পীদের মেধা নিয়ে সমঝোতা— মূলত এসবই একসঙ্গে জামদানি তথা বয়নশিল্পের শ্রেষ্ঠত্বকে বিপন্নতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

নানা রকম পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েও বাংলাদেশের তাঁতশিল্প, বিশেষত হস্তচালিত তাঁতশিল্প এখনো যে টিকে আছে, এর প্রধান কৃতিত্ব দিতে হবে এদেরকেই। তাঁতিরাই বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের সবচেয়ে বড় ভরসা। নানা রকম পরিবর্তনের সঙ্গে তারা বারবার নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে, নতুন প্রযুক্তি ও কৌশল আত্মস্থ করেছে এবং এভাবেই টিকিয়ে রেখেছে বাংলাদেশের হস্তচালিত তাঁতশিল্প।

জামদানি বয়নশিল্প অদূর ভবিষ্যতে ব্যাপক পরিচয়ের সংকটে নিমজ্জিত হতে পারে। আর সেই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে আমাদের। তাই এ শিল্পকে বাঁচাতে পারি শুধুমাত্র আমরাই। এজন্য সচেতন পৃষ্ঠপোষণই হতে পারে একমাত্র সমাধান। আগামীতে এই ঐতিহ্যমণ্ডিত ও কিংবদন্তিতুল্য বয়নশিল্পকে বাংলাদেশে গৌরবোজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে টিকিয়ে রাখার দায় সবার। প্রয়োজন আন্তরিকতা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি ভালোবাসা আর বিশুদ্ধতার প্রতি শ্রদ্ধা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *