বাংলার হাজার বছরের অগ্রযাত্রায় সঙ্গী হয়েছে তার নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও শিল্পসাহিত্য। পুঁথিসাহিত্যও তার ব্যতিক্রম নয়। সাহিত্যের প্রাচীন ও সমৃদ্ধ শাখা ‘পুঁথি’– আমাদের লোকজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক অনবদ্য অংশবিশেষ।
বলছিলাম এমন এক সময়ের কথা যখন ঝিঁঝি ডাকা সন্ধ্যায় কূপির নিভু নিভু আলোয় বাড়ির কোনো এক আঙিনায় শীতলপাটি বিছিয়ে গ্রামের সব বয়সী ও সব শ্রেণী-পেশার মানুষ আসরে বসে বিমুগ্ধ হয়ে শায়েরের শ্রতিমধুর কণ্ঠে পুঁথিপাঠ শুনত। বাংলার গ্রামে-গঞ্জে প্রতিটি ঘরে ঘরে পাঠ করা হতো পুঁথিকাব্য। সেকালে পুঁথি ছিলো সার্বজনীন। পুঁথিপাঠের আসরে দেখা যেত সব বয়সের মানুষের আনাগোনা। শিশু-কিশোর-বয়স্ক নির্বিশেষে সকলের কাছেই পুঁথিসাহিত্যের অনুপম কাহিনিগুলো ছিল অমৃততুল্য। সুর-তাল-লয় আর ছন্দের সুক্ষ্ম গাঁথুনীতে রচিত পুঁথিগুলো মানুষের মনকে করত বিমোহিত। পুঁথির প্রতিটি পাতায়-পাতায় লিখা থাকত ঐতিহাসিক দিনের কথা; মানুষের কথা– তাদের সুখ-দুঃখ-বেদনার কথা, সংগ্রাম-ইতিহাসের কথা। সে’সময় গ্রামের মানুষের বিনোদন ও শিক্ষার মাধ্যমও ছিল এই- পুঁথিপাঠ।
পুঁথি কী? পুঁথি হলো অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে রচিত আরবী, ফারসি, উর্দু, তুর্কি ও হিন্দি ভাষার সংমিশ্রণে রচিত ইসলামী চেতনা সমৃদ্ধ এক বিশেষ শ্রেণীর বাংলা সাহিত্য। আরবী-ফারসি শব্দের প্রাচুর্যের কারণে অনেকে একে ‘দোভাষী-পুঁথি’ও বলে থাকে। ‘পুঁথি’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘পুস্তিকা‘ থেকে। কাল-বিচারে গবেষকরা বাংলা সাহিত্যকে তিন পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন– প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ ও আধুনিক যুগ। প্রাচীন ও মধ্যযুগে সাহিত্য রচিত হতো পদ্যে। এইসব পদ্য বা কবিতার সবই মলাটবদ্ধ ছিল প্রাচীন পুঁথির খোলসে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের সঙ্গে আধুনিক যুগের সেতুবন্ধন হচ্ছে এই পুঁথি। পু্ঁথিই ছিল বাংলা সাহিত্যের আদি নিয়ামক।
যুগসন্ধিকালে গ্রামবাংলায় পুঁথি ছিল ব্যাপক জনপ্রিয়। ভেলুয়া সুন্দরী, পদ্মাবতী, কাজলরেখা— ইতিহাসেরই উজ্জ্বল অংশ।
ছাপাখানা অপ্রতুল হওয়ায় প্রায় সব পুঁথিই হাতে লিখে রাখা হতো। এমনকি প্রথমদিকের পুঁথি সংস্করণের ব্যাপারটিও হাতে লিখেই হয়েছিল। মুসলমানদের ধর্মীয় ঐতিহ্যভিত্তিক বিভিন্ন পুঁথি সাধারণত লিখিত হতো তালপাতায়। তেরেট নামের তালজাতীয় এক প্রকার বৃক্ষের পাতায়ও তখন পুঁথি লেখা হতো।
পুঁথি সাহিত্যের শব্দসম্ভার, ঘটনাশৈলী ও ভাষারীতি লক্ষ্য করে বিভিন্ন ঐতিহাসিক এর বিভিন্ন নামকরণ করেছেন। রেভারেন্ড জেমস লং এ’ভাষাকে বলেছেন ‘মুসলমানী বাংলা’। আর এ’ভাষায় রচিত সাহিত্যকে ‘মুসলমানী বাংলা সাহিত্য’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এছাড়া বাক্যরীতির দিকে থেকে বিচার করে প্রথমে এগুলোকে দোভাষী এবং পরবর্তীতে মিশ্রভাষা রীতির কাব্য বলে অভিহিত করেন।
বিষয় ও রস বিচারে পুঁথিসাহিত্যকে মোট ছয়টি ভাগে ভাগ করা যায়:
১. রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য
২. জঙ্গনামা বা যুদ্ধকাব্য
৩. নবী-আউলিয়ার জীবনীকাব্য
৪. লৌকিক পীর-পাঁচালি
৫. ইসলামের ইতিহাস, ধর্ম বিষয়ক শাস্ত্রকাব্য
৬. সমকালের ঘটনাশ্রিত কাব্য
পুঁথি বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে চর্যাপদ, লাইলী-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, কারবালার মতো অমর সাহিত্যের কথা। ইউসুফ-জুলেখা,লায়লী-মজনু, গুলে বকাওলী, বেনজির-বদরে মুনীর প্রভৃতি কাব্য প্রথম শ্রেণীর রচনা। আমীর হামজা, সোনাভান, জৈগুনের পুঁথি, হাতেম তাই প্রভৃতি দ্বিতীয় শ্রেণীর কাব্য– যেখানে আরব-ইরানের ইসলামপূর্ব ও ইসলামউত্তর যুগের বীরপুরুষদের যুদ্ধবিগ্রহ, রাজ্যজয় ও ইসলাম প্রচারের বর্ণাঢ্য বিবরণ পাওয়া যায়। নবী, পীর-আউলিয়ার জীবনকথা, চরিত্র-মাহাত্ম্য ও ধর্ম-প্রচার নিয়ে তৃতীয় শ্রেণীর কাব্য রচিত হয়েছে। যুদ্ধ-বিগ্রহ, প্রেম-কাহিনি, নবী-আওলিয়ার জীবনকাহিনি ইসলামের ইতিহাস, শাস্ত্রকাব্য, কল্পকাহিনিই ছিল পুঁথিসাহিত্যের মূল উপজীব্য।
পুঁথিসাহিত্যের অধিকাংশ রচয়িতা এবং পাঠক ছিল মুসলমান সম্প্রদায়। মুসলিম কবিরাই প্রথম পুঁথিসাহিত্যের মাধ্যমে সাহিত্যকে নামিয়ে আনেন একদম মানুষের কাছে; মানুষের হৃদয়ে; অন্তরের অন্তঃস্থলে। হয়তো মানুষের এত কাছে নিয়ে আসার কারণেই মুসলমানদের ঘরে ঘরে পুঁথিসাহিত্য এতটা জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। ‘ইউসুফ-জুলেখা’ লিখে রোমান্টিক প্রণয়কাব্যের সূচনা করেন কবি মুহাম্মদ সগীর। পরে অন্য মুসলিম কবিরা একই ধারায় লিখতে শুরু করেন।
১২৭১ সালে মুন্সী মুহাম্মদ লিখেন ‘লায়লী-মজনু’। ১৩১৭ সালে মুনশী কমরুদ্দিন রচনা করেন বেনজির-বদরে মুনীর। ১৩২৬ সালে মৌলভী আতাউল্লাহ লিখেন ‘হায়রাতুল ফেকা’। এটি ফিকহের বিভিন্ন প্রশ্নোত্তরে সাজানো। ১৩২৮ সালে শেখ ওমরুদ্দিন লিখেন ‘খয়রল হাসর’। মুসলিম জাহানের বিশেষ কাহিনিগুলো একত্রিত করে এ পুঁথি লিখেন তিনি। ১৩৩৬ সালে মুন্সী মাজহার আলী লিখেন ‘শাহাদতনামা’। ১৩৬০ সালে মুন্সী জোনাব আলী রচনা করেন ‘জঙ্গে খয়বর’। এতে খায়বার বিজয়ের ঘটনা বিবৃত হয়েছে। এ শ্রেণির কাব্যের মধ্যে রয়েছে আমীর হামজা, জৈগুনের পুঁথি, হাতেম তাই প্রভৃতি গ্রন্থ। ১৩৬৮ সালে ইমাম হোসেনের শাহাদাত নিয়ে মোক্তার হোসেন রচনা করেন ‘ছহি বড় জঙ্গনামা’। (তথ্যসুত্রঃদৈনিক যুগান্তর)
মুসলিম কবিরা ভাষা, বিষয়বস্তু এবং গঠনরীতির দিক দিয়েই শুধুমাত্র নতুনত্ব আনেননি, বরং আঙ্গিকের দিক দিয়েও প্রবর্তন করেছিলেন নতুন রীতি-নীতি। মুসলিম কবিদের হাত ধরেই তাই সে’সময় বাংলা সাহিত্য হয়ে ওঠে গতিশীল।
পুঁথি সংগ্রহ ও সংরক্ষনের সাথে যার নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত তিনি হলেন “আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ”। বাঙালি সমাজে তিনি মূলত পুথিচর্চার জন্যই পরিচিত ও খ্যাতিমান। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর পুঁথি-সম্পাদনার নৈপুণ্যকে ‘জার্মান এডিটর’র তুল্য জ্ঞান করেছিলেন। পুঁথি ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান,পুঁথিই তাঁর ‘জীবনসর্বস্ব। তিনি হিন্দু-মুসলিম অভেদে পুঁথিসংগ্রহ করেছেন। তাঁর আগে এমন অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে কেউ পুঁথি সংগ্রহ করেননি। পুঁথিই ছিল তাঁর মনোযোগের মূল কেন্দ্র। তিনি আড়াই হাজারের মতো পুঁথি সংগ্রহ করেন এবং বৈজ্ঞানিক উপায়ে তা সংরক্ষণ করেন। তাই তার উদ্ধারকৃত পান্ডুলিপি এবং গবেষণামূলক রচনাসমূহ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অনন্য দুর্লভ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ প্রথম পুঁথি সংগ্রহ করেন ডুমুরিয়া গ্রামের এক কৃষকের ঘর থেকে। পুঁথিটি ছিল– আলাওলের পদ্মাবতী কাব্য। এই পুঁথি আবিষ্কারের আনন্দের কথা তিনি ড. মুহাম্মদ এনামুল হক-কে যেভাবে বলেছিলেন তা বলতে গিয়ে এনামুক হক বলেন, “আনোয়ারায় (চট্টগ্রাম) আবদুল করিমের দিন খোঁজাখুঁজিতেই কাটে। একদিন হঠাৎ এক চাষির বাড়িতে একখানা পুঁথি পাওয়া গেল। ইউরেকা! ইউরেকা! পেয়েছি, পেয়েছি। সে কি যে সে আনন্দ! হাজার টাকার তোড়া বা গুপ্তধন পেয়েও কেউ তেমন আনন্দ উপভোগ করেছেন কিনা, জানিনে। আবদুল করিম যখন বৃদ্ধ বয়সে এ কাহিনী বলতেন, তখন তার দন্তহীন মুখে যে হাসি ফুটে উঠতো, তা দেঁতো হাসিকেও মাত করে দিতে দেখেছি। তখনও প্রাচীন হস্তাক্ষর পড়ার ক্ষমতা তাঁর হয়নি। পুঁথিখানি যে কী বই, তা কিছুতেই ঠিক করা গেল না। নানা স্তোক–বাক্যে চাষিটিকে ভুলিয়ে তিনি হস্তগত করলেন—সাত রাজার ধন এক মানিক। আহার নেই, নিদ্রা নেই; পাঠোদ্ধারের প্রচেষ্টা অবিরাম গতিতেই চললো। এক সপ্তাহের অদম্য প্রচেষ্টায় জানা গেল, পুঁথিটি কবি আলাওলের পদ্মাবতী।” (সাহিত্যবিশারদ স্মারকগ্রন্থ)
বাংলা একাডেমির তৎকালীন সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এক বক্তৃতায় বলেন, দীর্ঘ ছয় দশকের সাধনায় আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ আড়াই হাজারের মতো পুঁথি সংগ্রহ করেন। এর মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম উভয় কবির বিরল সৃষ্টি আমাদের সামনে উপস্থাপিত হয় এবং বিশেষভাবে বাংলা সাহিত্যে মুসলিম অবদানের বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
পুঁথি সংরক্ষনে এদেশে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রথম পুঁথি সংগ্রহে হাত দেন কয়েকজন ব্রিটিশ নাগরিক। তাঁদের মধ্যে বাংলা ব্যাকরণের আদি রচয়িতা নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড অন্যতম। তিনি ১৭৭২ থেকে ১৭৮৩ সালে বাংলাদেশে অবস্থানকালে ১২টি বাংলা পুঁথি সংগ্রহ করেন, যা পরে তিনি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে অর্থের বিনিময়ে প্রদান করেন। হ্যালহেডের ব্যাকরণের বাংলা হরফ নির্মাতা চার্লস উইলকিন্স ১৭৮৬ সালের দিকে ‘চন্ডীমঙ্গল’ ও ‘বিদ্যাসুন্দর’ নামে দুটি পুঁথি সংগ্রহ করেন। ১৮০৭ সালে এদেশ থেকে সংগৃহীত ১৪টি বাংলা পুঁথি ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে প্রদান করা হয়। এতে প্রতীয়মান হয় বেশখানেক পুঁথি এদেশ থেকে পাড়ি জমিয়েছে ভিন্ন দেশে। ১৯৬৮ সালে সরকারি প্রচেষ্টায় এদেশে প্রথমবারের মতো পুঁথি সংগ্রহের উদ্যোগ নেয় এশিয়াটিক সোসাইটি। ১৯৪৭ সালের জুলাইয়ের এক হিসাবে দেখা যায়, বিশ্বভারতীতে ১৪৩৯টি বাংলা পুঁথি ছিল যা সংগ্রহ করেন চট্টগ্রামের আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। তাঁর সংগৃহীত ৫৮৫টি মুসলিম বাংলা পুঁথি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করেছেন। তার সংগৃহীত ৩৩৮টি পুঁথি রাজশাহী বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।
আজ আমরা যে আধুনিক যন্ত্র সভ্যতায় এসে উপনীত হয়েছি সে প্রজন্মের অনেকেই জানে না পুঁথি কি! এখন আর সন্ধ্যে হলেই পরিবারের সবাই মিলে জড়ো হয়ে পুঁথি নিয়ে বসা হয় না। স্ক্রিনসভ্যতার দাপুটে বাস্তবতায় প্রাচীন পুঁথিকাব্য-পুঁথিকাহিনী আজ বিলুপ্তপ্রায়। সংরক্ষনের অভাবে অনেক পুঁথি আজও আমাদের অজানাতেই রয়ে গেছে।
বাংলা সাহিত্যের ঊষালগ্ন জানতে হলে আমাদের প্রাচীন পুঁথির কাছে ফিরে যেতেই হবে। ইতিহাসের ধূলিমলিন আস্তরণ থেকে এসব খু্ঁজে বের করা আমাদেরই দায়িত্ব। বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য-সাহিত্যের ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে পুঁথির সংরক্ষণ, পুঁথি সংগ্রহ এবং জনমন ও বাংলা সংস্কৃতি থেকে অবলুপ্ত ‘পুঁথি’ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা আজ অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। নইলে হয়তো বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য বিলীন হয়ে যাবে চিরতরে।
লেখাঃ জান্নাতুল ফেরদৌস মিম
শিক্ষার্থী,