আলীগড়ের মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর অসন্তুষ্ট মোহাম্মদ আলী ১৯২১ সালে জা’মিয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়া নামে একটি জাতীয় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৬ সালের ২৩ জানুয়ারি এবং ১ ফেব্রুয়ারিতে কমরেড পত্রিকায় প্রকাশিত এ দু’টি প্রবন্ধে তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোকপাত করেন।
জাতীয় মুসলিম শিক্ষা
সূচনালগ্ন থেকেই কমরেড পত্রিকা মুসলমানদের শিক্ষা সম্পর্কে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিল এবং বস্তুত, সাধারণ ভারতীয়দের, বিশেষ করে মুসলমান সমাজের অগ্রগতির আলোচনায় ব্যাপৃত ছিল। পত্রিকাটির সেই দৃষ্টিভঙ্গি আজও অপরিবর্তিত রয়েছে। জাতির জন্য চরকার সার্বজনীন প্রয়োজনীয়তা সত্ত্বেও মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য চূড়ান্ত প্রয়োজন হচ্ছে জাতীয় শিক্ষার। বিষয়টিকে আজ আর কমরেড পত্রিকা উপেক্ষা করতে পারছে না। সর্বভারতীয় সম্প্রদায়গুলি দুঃখজনকভাবে অবহেলা করেছে মুসলমানদের জাতীয় শিক্ষাকে। বেলগাউম অধিবেশনের আলোচনায় এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিল। কিন্তু যেহেতু পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে স্যার সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে মুসলমানরাই সর্বপ্রথম শিক্ষায় সরকারী নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে অসহযোগিতার পতাকা উড্ডয়ন করেছিলেন, সে কারণে জাতীয় শিক্ষা সংক্রান্ত বর্তমান পরিস্থিতি পুনঃপরীক্ষা করে দেখাও তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব।
সে যাই হোক, একটি বিষয় পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার। ভারতবর্ষের সব সম্প্রদায় শিক্ষা সম্পর্কে তাদের যুবসমাজকে সমভাবে এরূপ দিকনির্দেশনা দেবে- যেন এ শিক্ষাকে জাতীয় বলে অভিহিত করা যায়। এরূপ শিক্ষা সরকারী অথবা বে-সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত শিক্ষালয়ে প্রদত্ত শিক্ষা থেকে ভিন্নতর হতে হবে। প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজ যুবশ্রেণীকে পৃথক পৃথকভাবে শিক্ষাদান করবে। অবশ্যই ধর্মীয় মূল ভাষা বলে তুলে না ধরে অথবা ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকদের বর্জন না করে কিংবা বাধ্যতামূলক ধর্মীয় শিক্ষা অন্য ধর্মীদের ওপর আরোপিত না করে। কারণ প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিজস্ব আদর্শ ও ঐতিহ্য রয়েছে। সুতরাং সাম্প্রদায়িক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে অনিবার্য বলে ধরে নিলে, আমরা আমাদের পাঠকদের নিকট আশা করব, তারা যেন মুসলমান সম্প্রদায়ের বিশেষ চাহিদাগুলির প্রতি দৃষ্টি প্রদান করেন। আমাদের ধারণা, মুসলমানদের সর্বোচ্চ চাহিদা, তারা যেন প্রকৃত অর্থে মুসলমান হতে পারেন। এ উদ্দেশ্যে যা প্রয়োজনীয় তা হচ্ছে, ইহজাগতিক এবং আধ্যাত্মিক বিষয়ে বিচ্ছিন্নতা সহ্য করা হবে না। এবং আমরা উৎসাহিত করব না যে, মুসলমানদের বর্ণগত এবং ধর্মগুরু বা অন্য ধরনের সাধারণ মানুষের পৃথকীকরণকে যে সব কারণে এ দেশের মুসলমান সমাজ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তা পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করতে হবে এবং তার প্রতিবিধানের উপায় খুঁজে বের করতে হবে। শিক্ষা পরিকল্পনায় বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সর্বদা যা ছিল অভীষ্ট লক্ষ্য তা হচ্ছে আধুনিক কৃষ্টিসম্পন্ন যুব সম্প্রদায়কে শুধু নয়, ইসলামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ প্রত্যেক প্রকৃত মুসলমানকেও সব ধরনের অকল্যাণকর দোষারোপ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। প্রত্যেককে নিজ ধর্ম সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানী হতে হবে এবং ইসলামী মিশনের সেনা ইউনিট হিসেবে স্বাধীনভাবে নিজ পায়ে দাঁড়াতেও সক্ষম হতে হবে। দেখা গিয়েছে যে, নিজ ধর্ম সম্পর্কে শিক্ষিত মুসলমানদেরও জ্ঞান এত কম যে, ধর্মীয় বিষয়গুলি সামগ্রিকভাবে স্বল্পসংখ্যক আলেমদের নিকট ন্যস্ত করে, তারা নিশ্চিন্ত থাকেন। তারা নিজেরা ধর্মকে জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা না করে একে অবহেলা করে চলেন অথবা অন্ধ হয়ে থাকেন এবং ধর্ম সম্পর্কে উলামা সমাজের এক বা একাধিক বিশেষজ্ঞের ওপর অযৌক্তিকভাবে নির্ভর করেন। এটা তাদের নিজেদের বা আলেমদের অথবা এমনকি ইসলামের জন্যও কল্যাণকর নয়।
কিছুসংখ্যক মানুষের নিকট স্যার সৈয়দ আহমদ খান উগ্র আনুগত্যশীল এবং বিরুদ্ধ মতাবলম্বী মানুষ ছিলেন। অথচ এই চরম অনুগত ব্যক্তিটিই সরকারী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঝাণ্ডা উড়িয়েছিলেন, এবং এই প্রধান বিরুদ্ধ মতাবলম্বী ব্যক্তিটিই মতভিন্নতার ভিত্তি নির্মাণ করেছিলেন তার নিজস্ব মুসলিম ধর্মানুরাগের ওপরেই। খ্রিষ্টান মিশনারি স্কুল-কলেজগুলোতে অখ্রিষ্টানদেরও বাইবেল ক্লাসে যোগ দিতে বাধ্য করা হত। এই সব শিক্ষার্থীদের অবশ্য মুসলমান সমাজে একঘরে করে রাখা হত। এ সব সরকারী স্কুল-কলেজগুলির প্রতিও সৈয়দ আহমদ খানের কম বিরূপতা ছিল না। তিনি মুসলমানদের শিক্ষার পশ্চাৎপদতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তাদের অতীতের সুস্থ প্রবৃত্তি এবং লালিত ঐতিহ্যের প্রতি বিরূপতাকে এবং পাশ্চাত্যের ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার বিচ্যুতিকে। সৈয়দ আহমদের এই নীতিই সরকার স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল। সংক্ষেপে বলতে গেলে, এ নীতিই মুসলমানদের এ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। মুসলমানদের নিকট তিনি যে শুধু তার এরূপ দৃষ্টিভঙ্গির সঠিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা নয়, এর অনুকূলে প্রবল যুক্তিও দিয়েছিলেন। তিনি একজন অতি বাস্তববাদী সংস্কারক ছিলেন। একই সঙ্গে ভালো কিছু প্রবর্তন না করে ক্ষতিকর বস্তুর চারদিকে বেড়া দিয়েই শুধু তুষ্ট থাকেন নি। তিনি মুসলমান যুবকদের একই সঙ্গে ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা দানের উদ্দেশ্যে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন। সর্বোপরি, মুসলিম তরুণদের জন্য খাঁটি ইসলামী পরিবেশ সৃষ্টির জন্য একটি কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগও তার ছিল। উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীরা যেন শুধু শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান মানুষ না হয়ে শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান মুসলমান হয়ে গড়ে উঠতে পারে। তার বহুমুখী ধর্মীয় মতাদর্শ আমাদের প্রাসঙ্গিক বিষয় নয়। এ কথা অনস্বীকার্য যে, বিজ্ঞানের যাদুর সংস্পর্শে আসার পর একই সময়ে ইউরোপ ডারউইনের অরিজিন অব স্পেসিসের মধ্যে পেয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতার এক নতুন সমাচার। এটা ছিল বিবর্তনবাদের বিপ্লবী তত্ত্বে। ইউরোপের অগ্রগামিতায় অভিভূত হয়ে স্যার সৈয়দ আহমদ তার নব জাগ্রত উদ্দীপনার সাথে যুক্ত করে নিয়েছিলেন এক সর্বদলীয় মতবাদের অভিনব উন্নয়নের আলোক। এখন অবশ্য আমাদের স্বীকার করতে বাধা নেই যে, বিষয়টি অতিরঞ্জিত করা হয়েছিল। বৈষম্য সত্ত্বেও তিনি ইউরোপকে বিশ্বাস করেছিলেন তার সৎ গুণাবলীর জন্য, যার অভাব তিনি নিজ সমাজের মানুষদের ভেতর প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এসব সত্ত্বেও ইসলামের চিরন্তন সত্যের প্রতি ছিল তার অটল বিশ্বাস, এবং মহত্বের শীর্ষতম দেশে পৌঁছুতে মুসলমানরা যে সক্ষম, সে সম্পর্কে তার কোন দ্বিধা ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন একটি সেতু নির্মাণ করতে যা যোগাযোগ রক্ষা করবে পাশ্চাত্যের নতুন বিজ্ঞানের সঙ্গে তার শাশ্বত ধর্মবিশ্বাসের। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন পরিকল্পনায় যে আদর্শ তিনি গ্রহণ করেছিলেন তার নিজ ভাষায় তা সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে: “বিজ্ঞান থাকবে আমাদের দক্ষিণ হস্তে, দর্শন বাম হস্তে এবং মাথার মুকুটে খচিত থাকবে এক আল্লাহ্ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই এবং মুহাম্মদ তার প্রেরিত দূত।” আলীগড় অনেক বিষয়ে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সুন্দর মিলন ঘটিয়েছে এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও সাহিত্যে অগ্রসরমানতা সত্ত্বেও সম্প্রদায়গত অহমিকা বজায় রেখেছিল আলীগড়। আর তা প্রায়শ প্রাক্তন ছাত্রদের সদাচরণের সঠিক মনোবৃত্তিরূপে কার্যকর ভূমিকা রেখে চলেছে। তবে এ কথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে, ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে মূল্যবান উপকরণ আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় কমই যুগিয়েছে। ছাত্ররা যথেষ্ট প্রগতিশীল ছিল, ধর্মের ব্যাপারেও ছিল যথেষ্ট গর্বিত। দুঃখের বিষয়, তাদের অজ্ঞতাও ছিল যথেষ্ট, তাদের পিতা-মাতার অরুচিকর সান্নিধ্য থেকে দূরে সরে থাকতে তাদের অহমিকাবোধও তেমন সাহায্য করেনি। স্যার সৈয়দের চিন্তা ও কাজ এরূপ পিতা-মাতার গোঁড়ামিকে প্রবল ধাক্কা দিয়েছিল। তাদের সন্তানদের আকৃষ্ট করতে স্যার সৈয়দ এক নিঃস্বার্থ নির্দেশ জারি করে বলেছিলেন, তার কলেজে ধর্মপুস্তক শিক্ষা দেওয়া হবে না, এবং ধর্ম নিয়ামক কোন আলেমও কলেজ কমিটির সদস্য হতে পারবেন না। ফলে সাধিত হয়েছিল এমন বর্ণহীন মৃতকল্প এক কমিটি, যা কিছু প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তক নির্ধারণ করা ছাড়া কখনও কোনো কাজই করেনি, ওই সব পাঠ্যপুস্তককে মৃদুভাষায় বলা হয়েছিল ‘ধর্মতত্ত্ব’। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, এতে অজু, গোসল, নামায পড়ার রীতি এবং সিনিয়র ছাত্রদের জন্য বিয়ে-শাদী, দেনমোহর, তালাক সম্পর্কে ইসলামের কিছু প্রধান বিধান ইত্যাদি বর্ণিত ছিল। বাস্তব ক্ষেত্রে, কুরআন ছাত্রদের কাছে ছিল এক পরিত্যাক্ত গ্রন্থ। ব্যতিক্রম ছিল শুধু মাওলানা শিবলীর বক্তৃতা, তাও পরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কেবল নামে মাত্র ছিল রাসূলের হাদিস। যদিও স্বল্পকালের জন্য মাওলানা শিবলী রচিত রাসূলের জীবন কাহিনী পড়ানো হয়েছিল। একে “শিশু শিক্ষা” বলা যেতে পারে, তাও সে শিক্ষা ছিল মাত্র কয়েকটি পৃষ্ঠায় সীমাবদ্ধ। কলেজের পাঠ্যপুস্তকের ধর্মতত্ত্বে ধর্মবিজ্ঞান বা তর্কবিদ্যার লেশমাত্র উল্লেখ ছিল না। সাধারণত আরবি ও ফারসি ভাষা শেখাবার জন্য স্কুল-কলেজগুলোতে অবহেলিত ও নিষ্কর্মা ব্যক্তিদের স্বল্পবেতনে নিয়োগ করা হত। আরবি ও ফারসি ভাষারও আবার অবনতি ঘটেছিল ‘দ্বিতীয় ভাষা’ হিসেবে। এসব স্থূলবুদ্ধি নিষ্কর্মাদের আলীগড়ে আটকে রাখা হয়েছিল ‘ধর্মতত্ত্ব অনুষদে’ মুসলিম ছাত্রদের সপ্তাহে একবার ধর্মশিক্ষা দেবার জন্য-‘দ্বিতীয় ভাষা’র জন্য নির্দ্ধারিত দিনে। এর ফলে, ‘ধর্মতত্ত্বের সময়কাল’ বিনোদনের সময় অপেক্ষাও বেশি উপভোগ্য হয়। পাঠ্যপুস্তক থেকে যে সামান্য তথ্য পাওয়া যেত, তা সারা রাত্রি অর্থ না বুঝে মুখস্থ করে পরদিন সকালে পরীক্ষা কক্ষে ‘উত্তরপত্রে’ উদগীরণ করা হত। এ রকম পরীক্ষা বৎসরে দু’একবার অনুষ্ঠিত হত। ছাত্রদের মধ্যে নিঃসন্দেহে একটি সম্প্রদায়গত চেতনা ছিল। কিন্তু তা ধর্মের পরিবর্তে বেশি ধর্মনিরপেক্ষ ছিল। তারা ইসলাম ধর্মকে মানবজাতির প্রতি চূড়ান্ত বার্তা, একমাত্র পূর্ণাঙ্গ সত্যধর্ম হিসেবে গণ্য করত। তারা অবিরাম অথচ যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তা সহকারে বিতর্ক চালিয়ে যেতে পারত ইসলামের প্রধান নীতিগুলির সর্বোচ্চ উৎকর্ষ সম্পর্কে। অথচ ন্যাক্কারজনকভাবে তারা ইসলামের শিক্ষা এবং এর সারা পৃথিবীব্যাপী শত শত বৎসরের ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল।
বিরাজমান এ অবস্থার প্রেক্ষাপটে আলীগড়ে জা’মিয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়া বা জাতীয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠকেরা সংস্কার সাধনে মাঠে নামলেন। এ কাজের ভিত্তি স্থাপনের জন্য অপরিহার্য ছিল পবিত্র কুরআনের গভীর জ্ঞান। সুতরাং প্রতিটি স্তরে আল্লাহর বাণী বুদ্ধিমত্তা সহকারে অধ্যয়ন করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। যে মুসলমান অর্থনৈতিক ও অন্যান্য কারণে প্রাথমিক পর্যায়ের বাইরে অধ্যয়ন চালিয়ে যেতে অসমর্থ ছিলেন, তাদের জন্য ব্যবস্থা রাখা হয় যাতে তারা পবিত্র কুরআন পাঠ করতে পারেন, শুধু মূল আরবি ভাষাতেই নয়, লিখিত উর্দু অথবা অন্যান্য দেশীয় ভাষার অনুবাদেও। শুধু তাই নয়, প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে কিছু আরবি ভাষার জ্ঞান অর্জনের প্রতিও শিক্ষার্থীরা ঔৎসুক্য দেখিয়েছিল। সে কারণে মৌলিক কিছু পরিবর্তনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। প্রচলিত পদ্ধতিতে ব্যাকরণ বিষয়টি শিক্ষানবিশদের মনোযোগে বিঘ্ন ঘটায়। তাই ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি সম্পূর্ণ পরিহার করা হয়। যে রীতি এর পরিবর্তে সেই রীতি গ্রহণ করা হয় যা প্রত্যক্ষ ও স্বাভাবিক। এর ফলে, আরবি ভাষায় তরুণ শিক্ষার্থীদের অর্জিত জ্ঞান পবিত্র কুরআন হৃদয়ঙ্গম করতে তাদের বাস্তব উপকারে আসবে বলে আশা করা যায়।
আরবি ও উর্দু ভাষার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পরিচিত হবার অব্যবহিত পরেই পবিত্র কুরআনের শেষ অংশের কিছু সংক্ষিপ্ত অধ্যায় শিক্ষার্থীদের শেখাতে হবে। আরবি ভাষাতেই শুধু নয়, উর্দুসহ অন্যান্য ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমেও। নামায আদায়েও অনুরূপ শিক্ষা দিতে হবে, যাতে সাত বৎসরের শিশুও অর্থ বুঝে নামায পড়তে পারে। এমনই ছিল প্রস্তাবিত পরিকল্পনা। অনুরূপভাবে, এও প্রস্তাব করা হয়েছিল যে, সাধারণত আনুমানিক বার-তের বৎসর বয়সে যে শিশু প্রাথমিক শিক্ষা ও আরবি ভাষায় কুরআন শরীফ খতম করে, তাকে তখন দুই পঙ্ক্তির মধ্যে লিখিত উর্দু ও অন্যান্য দেশী ভাষায় অনূদিত শিক্ষাও সমাপ্ত করতে হবে। অর্থাৎ সে বয়সে সে শুধু পবিত্র কুরআন খতম করবে না, বৃহদাকারের উর্দু নাজিরা পাঠও শেষ করবে। ঘটনাক্রমে তা হবে পবিত্র কুরআনের অনুবাদ। কিন্তু এখানেই এ যথেষ্ট নয়। সুতরাং প্রস্তাব রাখা হয়েছিল, প্রাথমিক পর্যায়ের শেষ তিন বৎসর একজন শিক্ষার্থীকে ইংরেজির সাথে সাথে আরবিও শেখানো হবে। তবে এ কথা সত্য যে, উন্নতমানের শিক্ষাদান পদ্ধতি সত্ত্বেও দশ বৎসর বয়সী বালকের পক্ষে তিন বৎসরে বিদেশী ভাষার সামান্য প্রাথমিক জ্ঞান ছাড়া বেশি কিছু শেখা সম্ভব নয়। তবু আশা করা হয়েছিল, আরবি ভাষায় তার মৌলিক জ্ঞানের অতিরিক্ত, কুরআন অধ্যয়ন এবং এর পাশাপাশি পাঁচ বা ততধিক বৎসরের মধ্যে আল-কুরআনের অনুবাদ তাকে অন্তত আরবি ভাষার জ্ঞান অর্জনে ততটুকু সামর্থ্য দান করবে, যা অনুবাদের সাহায্যে ধর্মশাস্ত্র পাঠ করতে তাকে আগ্রহান্বিত ও উৎসাহ প্রদান করবে। এবং এটাই ছিল উদ্দেশ্য, যা ছাড়া অন্য কোন উপায়ও ছিল না।
আজকাল মাধ্যমিক পর্যায়ে কলেজে সাধারণত যতদূর শিক্ষা দেওয়া দরকার নতুন ব্যবস্থায় তা-ই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আরবি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। প্রস্তাব ছিল সতের বৎসর বয়স পূর্ণ হলে এই পাঁচ বৎসর ছাত্রদের একমাত্র আরবি পাঠ্যবই হিসেবে সম্পূর্ণ কুরআন শিক্ষা দিতে হবে, নির্দিষ্ট কিছু হাদিসসহ। আরো প্রস্তাব ছিল, একই সঙ্গে তারা প্রাণবন্ত আরবি ভাষায় কথা বলা ও লেখা শিখবে, মাধ্যমিক ক্লাসের ছাত্ররা যেভাবে ইংরেজিতে কথা বলতে ও লিখতে পারে। কেবল যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু আরবি ব্যাকরণ তাদের শেখানো হবে এবং সঠিকভাবে আরবি ভাষা ব্যবহার ও বাক্যগঠনের নিমিত্ত শিক্ষা পদ্ধতিরও আমূল পরিবর্তন করতে হবে। এ পর্যায়ে অন্যান্য আরবি গদ্য শেখাবার প্রস্তাব ছিল। প্রথমত উদ্দেশ্য ছিল যে, আরবি ভাষা শিক্ষা দেওয়া হবে কুরআন শরীফের গভীর জ্ঞান অর্জনের জন্য, পরবর্তীতে আরবি ভাষার জ্ঞান অর্জনের জন্য কুরআন অধ্যয়ন যথেষ্ট মনে হয়েছিল। তৎসত্ত্বেও আরবি কবিতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য ছাত্রদের কয়েকশত নির্বাচিত কবিতা পড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছিল।
আশা ছিল, এরূপভাবে কুরআন অধ্যয়ন করে যুবকেরা খাঁটি মুসলমানে পরিণত হয়ে আরো নিবিড়ভাবে নিজ ধর্মের সঙ্গে পরিচিত হবে। শুধু পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে এতটা অর্জন হয়তো সম্ভব ছিল না-কিন্তু তাই বলে ইসলামী ধর্মতত্ত্বের অন্যান্য শিক্ষাও যে বর্জন করতে হবে, সেটাও অভিপ্রেত ছিল না।
প্রাথমিক পর্যায়ে অবশ্য এমন প্রস্তাব ছিল যে, মৌখিকভাবে শিক্ষকরা ইসলামী রীতি-আচার সম্পর্কে ছাত্রদের বাস্তব শিক্ষা দেবেন এবং অতঃপর উপদেশের মাধ্যমে শিক্ষা দেবেন ইসলামী বিশ্বাস ও বিধি-নিষেধ সম্পর্কে। মাতৃভাষার ‘রিডার্সের’ অন্তর্ভুক্ত হবে এ বিষয়গুলি। আরো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে ইসলামের ইতিহাসের বিভিন্ন শিক্ষামূলক বিষয়, মৌলিক বিজ্ঞান সংক্রান্ত তথ্য, ইত্যাদি।
এভাবে ইবাদত, আখলাক ও সীরাত সংক্রান্ত আকায়েদ, ফিকাহ শিক্ষাদানের প্রস্তাবও করা হয়েছিল, যা প্রথম থেকে বাড়ন্ত শিশুদের মনে গেঁথে যেতে পারে। আজকাল সচরাচর যে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়, তা ইবাদত সংক্রান্ত মূল ফিকাহ-এর শিক্ষার বেশি নয়। এ শিক্ষাও এমনভাবে দেওয়া হয় যা ছাত্রদের সব উৎসাহ নিভিয়ে দেয়। ফলে এ শিক্ষা ছাত্রদের মধ্যে নীরস একঘেয়ে পরিশ্রমে পরিণতি লাভ করে। সেজন্য প্রস্তাব করা হয়, নিপুণভাবে প্রণয়ন করতে হবে উর্দু ‘রিডার্সের’ পাঠ্যক্রম। উদ্দেশ্য সাহিত্যের মাধুর্যের সঙ্গে মুসলিম শিশুরা ইসলামের প্রকৃত বিশ্বাস এবং তার প্রধান আদেশগুলির প্রতিও সহজে নিজেদের অজ্ঞাতসারে গভীরভাবে আকৃষ্ট হতে পারে। ক্রমবিকাশের ধারায় এ আদেশগুলির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ব্যাখ্যা করে এর প্রয়োজনীয়তার প্রতি তাদের আকৃষ্ট করতে পারলে আরো ভালো হয়। রাসূলের (সা) জীবনের প্রধান ঘটনাবলী এবং তার খলিফাদের ঘটনাবলীসহ ইসলামের ইতিহাসও এ শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শুধু এ সম্পর্কে সঠিক ও প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়াই নয়, শিশু মনে যাতে সে সব বিষয় রেখাপাত করে-তারও ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় গণ্ডিবহির্ভূত মুসলমানরা শিগগিরই ভিন্ন সম্প্রদায়ের যাজক, পুরোহিত ও সাধারণ মানুষের নিকট-সান্নিধ্যে চলে যাবে। প্রথম যুগের প্রচারিত ও অনুশীলিত ইসলাম থেকে এই বিচ্যুতিই আমাদের অধঃপতনের প্রধান কারণ। ইসলামের পরবর্তীকালের পরিবৃদ্ধিও আমাদের অধঃপতনের অন্যতম কারণ।
১৯২০ সালের অক্টোবর মাসে স্যার সৈয়দ আহমদের আলীগড় কলেজের ছাত্রবৃন্দ অসহযোগ আন্দোলনের আহবানে সাড়া দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। কর্তৃপক্ষ কলেজকে কোন যৌক্তিকতা এখনও আছে কি না। আমাদের এ প্রশ্ন শুধু প্রশ্নের খাতিরে নয়। আমাদের দাবি, ভারতবর্ষের মুসলমানদের নিকট এ শিক্ষা পরিকল্পনার যদি এতটুকু মূল্যও থাকে, তাদের শুধু এ কথা বললেই চলবে না যে, তারা এ পরিকল্পনা পছন্দ করেন। জামিয়াকে উপযুক্ত সাহায্য প্রদান করে তাদের তা প্রমাণ করতে হবে। আর একমাত্র এভাবেই জা’মিয়ার স্বতন্ত্র স্থায়িত্ব সুনিশ্চিত হবে। এটা খিলাফত ফান্ডের অর্থ সাহায্যের বাইরে থাকবে। প্রচলিত অন্যান্য পদ্ধতি অপেক্ষা এরূপ শিক্ষা পদ্ধতির প্রাধান্য পাওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। বর্তমান পদ্ধতির পরিবর্তে মুসলমানরা ভিন্নতর পদ্ধতি গ্রহণ করতে সম্মত না হলে আমাদের একটি প্রশ্ন থাকবে। সাত কোটি মুসলমান নিয়ে গঠিত সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে মাত্র সাত শত জন ছাত্রকেও আমাদের প্রবর্তিত ধারায় শিক্ষা প্রদানের মতো অর্থ আমাদের আছে কি না। তাই মুসলিম জনগণের নিকট জিজ্ঞাস্য, তারা এ পরিকল্পনা অনুমোদন করেন কি না। ইতিবাচক জবাব হলে আরো ছাত্র, আরো ছাত্রবৃত্তি এবং লাইব্রেরির জন্য আরো বই চাই। শুধু মুখের প্রশংসায় চলবে না।
এ কথা ঠিক যে, ধর্মীয় বিষয়কে পূর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এখন আর একটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। তা হচ্ছে, বিদেশী ভাষার দাস মনোবৃত্তি সুলভ নিরর্থক শিক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করতে হবে। মাধ্যমিক পর্যায়ে শুধু ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে ইংরেজি শিক্ষা বজায় রাখা যেতে পারে এবং আগামী কয়েক বৎসরের জন্য মাত্র অধিকসংখ্যক স্কুল ছাত্রকে তের বৎসর বয়স থেকে ইংরেজি শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে। এটা অভিপ্রেত। তবে প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি ভাষা সম্পূর্ণ বর্জন করতে হবে। কোনক্রমেই শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি হতে পারবে না। সাময়িকভাবে শুধু কোন কোন বিজ্ঞান শাখায় ইউরোপীয় শব্দ বজায় রাখা যাবে।
সে যাই হোক, মাধ্যমিক স্তরের স্কুল ছাত্রদের যে কোন ইউরোপীয় ভাষা শেখার অনুমতি দেওয়া হবে। এই মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে ইংরেজির পাশাপাশি ফরাসি ও জার্মান ভাষা শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে। তবে এশীয় ভাষা শিক্ষার বিষয়টিকেও উপেক্ষা করা যাবে না। প্রথমত, দেশী ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে, উর্দু যেখানে স্থানীয় ভাষা, সেখানে হিন্দি; উর্দু যেখানে স্থানীয় ভাষা নয়, সেখানে উর্দু শেখাতে হবে। প্রচলিত দেশী ভাষাগুলির গুরুত্ব এবং আমাদের বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী আগামী বৎসরগুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ডিগ্রী প্রদান করা উচিত। এই পদক্ষেপ শিক্ষা ক্ষেত্রে চাহিদামতো নতুন নতুন গ্রন্থ রচনাকে উৎসাহিত করবে।
দেশী ভাষায় বাধ্যতামূলক শিক্ষা এবং প্রত্যেক স্তরে এ ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া সত্ত্বেও অতিরিক্ত একটি এশীয় ভাষা ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ও ফারসি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রী প্রদানের ব্যবস্থাও থাকতে হবে। আরবি, ফারসি ও নিজস্ব স্থানীয় ভাষা যে কোন দু’টি এশীয় ভাষায় কৃতিত্বের জন্য পুরস্কার দানের ব্যবস্থা রাখা উচিত।
যেহেতু শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বিদেশী ভাষা বর্জন করা হবে। আশা করা যায়, নির্ধারিত সময়েই ছাত্ররা বৃহত্তর পরিমণ্ডলে বর্তমান স্কুল-কলেজের প্রদত্ত শিক্ষা ছাড়াও গভীরতর জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হবে। এভাবে যে ছাত্রটি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষা সমাপ্ত করেছে, মুসলিম ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কেও তার জ্ঞান যথেষ্ট পোক্ত হয়েছে বলে মনে করা হবে (প্রস্তাবিত শিক্ষা পদ্ধতিতে পৃথিবীতে তা বাস্তবমুখী ও যথেষ্ট সাংস্কৃতিক মূল্যমান সমৃদ্ধ হবে)। তৃপ্তি ও আগ্রহ সহকারে পবিত্র কুরআন পাঠের জন্য শিক্ষার্থী প্রয়োজনীয় অল্প আরবি ভাষা শিখতে সক্ষম হবে। অঙ্কশাস্ত্র, মৌলিক জ্যামিতি, ভূমি বিজ্ঞান এবং সে সঙ্গে প্রাথমিক হিসাব বিদ্যা শিখতেও সে সক্ষম হবে, যা এক গ্রাম্য বালককে সাধারণ জীবনযাপনে সাহায্য করবে। সে সক্ষম হবে প্রাথমিক হলেও, বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা সম্পর্কে সঠিক ও সম্প্রসারিত তথ্য পেতে; ইসলামের ইতিহাসের খসড়া-চিত্র পেতে; বিশ্ব আন্দোলনে ভারতবর্ষের সম্পৃক্ততা জানতে; ভারতবর্ষের পূর্ণ ভৌগোলিক বিবরণ পেতে; মুসলিম বিশ্বের সাথে অবশিষ্ট পৃথিবীর ভৌগোলিক বিষয় অবগত হতে; দেশের সংবিধানের চিত্র পেতে; নিজ জেলার প্রশাসন সম্পর্কে অবগত হতে এবং সাধারণ নাগরিক হিসেবে তার অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত হতে। অতঃপর তার উচিত হবে নিজ দেশী ভাষায় পড়তে ও লিখতে সক্ষম হওয়া। দরখাস্ত লিখতে ও বুঝতে পেশাদার লিপিকারের শরণাপন্ন হওয়া তার মোটেও উচিৎ হবে না।
যুবকটিকে প্রথম পর্যায়ে ধর্মশিক্ষার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আরবি ভাষায় কুরআন সম্পর্কে প্রগাঢ় জ্ঞান অর্জন করতে হবে। তাকে তার দেশীয় ভাষায় সাহিত্য অধ্যয়ন ও মূল্যায়ন করতে এবং সাহিত্যের স্বচ্ছতা ও মাধুর্যসহ দেশীয় ভাষা লিখতে পারার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। উর্দু মাতৃভাষা হলে তাকে সহজ ফারসি ও হিন্দি ভাষা পাঠ এবং মাতৃভাষা উর্দু না হলে স্বচ্ছন্দে উর্দু পাঠ করতে ও লিখতে সক্ষম হতে হবে। অন্তত নিম্নোক্ত তিন বিষয়ে মাধ্যমিক মানের জ্ঞান তার থাকতে হবে:
মাতৃভাষা ব্যতীত যে কোন ইউরোপীয় অথবা আরবি ভাষা; ইতিহাস (ভারতবর্ষ ও ইসলামের এবং অন্য কোন ঐতিহাসিক বিষয়); ভূগোল; পৌরনীতি; রাষ্ট্রবিজ্ঞান; অর্থনীতি; প্রকৃতিবিজ্ঞান (যে কোন তিন শাখা); গণিতশাস্ত্র; তর্কশাস্ত্র; প্রাথমিক মনোবিজ্ঞান এবং অঙ্কন বিদ্যা। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও ধর্মতত্ত্বে অধিকতর জ্ঞান অর্জন এবং এ বিষয়ে শ্রেষ্ঠ রচনাবলীর সঙ্গে পরিচিত হওয়া ছাড়াও তাকে ইতিহাস, সমাজ বিজ্ঞান, দর্শনশাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র, বিজ্ঞান, সাহিত্য অথবা আইনশাস্ত্র এবং এর যে কোন শাখায় অধ্যয়ন করতে হবে। এবং তাকে ইউরোপীয় অথবা বিদ্যমান ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্নাতকোত্তর মানের ব্যুৎপত্তি দেখাতে হবে। বলা বাহুল্য, বিভিন্ন স্তরের শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধন করতে হবে। বার বৎসর বয়সের পর গ্রাম্য অথবা শহরের দরিদ্র শিক্ষার্থীরা আরো শিক্ষা গ্রহণ করবে, আমরা এতটা আশা করতে পারি না। আগামী দিনগুলিতে শতকরা পঁচাত্তর শতাংশ ব্যক্তি, যতটা শিক্ষা প্রাপ্ত হোক না কেন, নিজেরা একটি পূর্ণাঙ্গ ইউনিট বা সমবায় গড়ে তুলবে। এর অতিরিক্ত শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহীদের জন্য আমরা কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারি না। যেহেতু এ বয়সটা স্বাভাবিক পরিবর্তনের, শৈশব থেকে কৈশোর এবং যৌবনে উত্তীর্ণ হওয়ার, শিক্ষা ক্ষেত্রেও এরূপ অবস্থান্তর হওয়া স্বাভাবিক। সে কারণে প্রচলিত শিক্ষা দান পদ্ধতি থেকে পরবর্তী পদ্ধতি ভিন্নতর হবে, তাতে সন্দেহ নেই। কোন বিষয় থেকে অন্য বিষয়ের জ্ঞানের মধ্যে কোন তারতম্য এখানে করা হবে না। অঙ্ক ছাড়া অন্যান্য বিষয় পাঠ করে শেখানো হবে। পাঠ সংকলনে যা অন্তর্ভুক্ত, মৌখিকভাবে তাই শিক্ষা দিতে হবে। এভাবে শিক্ষার্থীর জ্ঞান ও নৈতিক শিক্ষা সহজতর হবে বলে আশা করা যায়।
শিশু মনস্তত্ত্বে সুগভীর জ্ঞানসম্পন্ন উপযুক্ত শিক্ষাবিদদের সম্পাদনায় সাহিত্য চেতনা সমৃদ্ধ বেশ কিছুসংখ্যক যোগ্য লেখক এ পাঠ সংকলন প্রণয়নে নিয়োজিত থাকবেন বলে প্রস্তাব করা হচ্ছে। মুসলিম সমাজের সামগ্রিক পৃষ্ঠপোষকতায় এ আরদ্ধ কাজ সম্পন্ন করা প্রয়োজন। সংকলকদের মধ্যে থাকবেন বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ, ধর্ম শিক্ষক, ইসলাম তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসবিদ এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ। সংকলনের বিষয়বস্তু বিভিন্ন শ্রেণীতে বিন্যস্ত হবে। লেখকদের পরামর্শক্রমে প্রধান সম্পাদক এর পাঠ্যক্রম, আয়তন এবং বিষয়াদি নির্ধারণ করবেন। বিভিন্ন গ্রুপভুক্ত লেখকরা এভাবে ক্রমানুযায়ী পাঠ্যপুস্তক রচনা করে ছাত্রদের জ্ঞানের ভিত্তি গড়ে দেবেন। কিন্তু পাঠ সংকলন শুধুমাত্র মাতৃভাষায় শিক্ষা দানের জন্য নয়। এ সংকলনে থাকবে বিস্তারিত সঠিক তথ্য, যা একজন মানুষের ন্যূনতম চাহিদা। এবং তা এমনভাবে রচিত হতে হবে, যা বার বৎসর বয়সী কোন বালকের পক্ষেও আয়ত্ত করা সহজ হবে। কেবল মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক পড়তে পারলে চলবে না, শিক্ষার্থী এর বিষয়বস্তু যথা, ধর্ম, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, পৌরনীতি ইত্যাদি হৃদয়ঙ্গম করতে পারে কিনা তার পরীক্ষা নিতে হবে।
পরবর্তী পর্যায় হবে মাধ্যমিক শিক্ষার, যা বিদ্যমান উচ্চ বিদ্যালয়ের অনুরূপ না হয়ে কলেজ স্তরের হবে। এই পর্যায় প্রাথমিক স্তরের মতো পাঁচ বৎসর মেয়াদী হবে। ছাত্রটির মোটামুটি বয়স তখন সতের বৎসর হবে। এ পর্যায়ের শিক্ষাধারা হবে শুধু মাতৃভাষা এবং এই পর্যায়ে শিক্ষার্থীকে মাতৃভাষায় সাহিত্য সম্পর্কিত যাবতীয় শিক্ষা প্রদান করা হবে। পাশাপাশি বিশেষ বিশেষ বিষয়গুলির সাথে অন্যান্য বিষয়েও শিক্ষা দান করা হবে। সাধারণ শিক্ষার পাঠ সংকলন পদ্ধতি এখানেই পরিত্যক্ত হবে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রচলিত প্রবেশিকা মানের অনুরূপ একজন যুবক যাতে মাতৃভাষা, আরবি ভাষা ও ধর্মতত্ত্বের অতিরিক্ত যে কোন তিনটি বিষয় তিন বৎসরে বেছে নিতে পারে। কিন্তু শেষ দুই বৎসরে মাধ্যমিক মানের অনুরূপ মাত্র দু’টি ঐচ্ছিক বিষয় তাকে বেছে নিতে হবে। প্রচলিত নিয়মের মতো তার পছন্দ সীমাবদ্ধ রাখার কোন প্রয়োজন নেই। সুতরাং আকর্ষণীয় বিষয় পছন্দ করার অধিকার তাকে দিতে হবে। তবে এ স্তরে নিজ পছন্দ মতো বিষয় বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে না পৌঁছা পর্যন্ত তার বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়াস চালানো উচিত হবে না।
প্রথম পর্যায়ের হলেও, এ পর্যায়েই তাকে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। মাধ্যমিক পর্যায়ে তাকে বিষয় পছন্দের যে বৃহত্তর সুযোগ দেওয়া হবে তার কারণ এই নয় যে, সে বিষয় সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ অজ্ঞ থাকবে, বরং যেসব বিষয়ের প্রতি তার স্বভাবগত আকর্ষণ রয়েছে সে সম্পর্কে তার জ্ঞান আরো বৃদ্ধি করা।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গ্রুপ পদ্ধতি সম্পূর্ণ বাতিল করা হবে এবং বিভিন্ন বিষয়ে (যেমন: ইতিহাস, দর্শন, গণিতশাস্ত্র, বিজ্ঞান, সাহিত্য, আইনশাস্ত্র, সমাজবিজ্ঞান এবং অবশ্যই ইসলামিক স্ট্রাডিজ) গ্রুপভুক্তি ও বিভিন্ন বিভাগে জ্ঞানচর্চার অনুশীলনী কেন্দ্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। ক্ষেত্রবিশেষে, একজন ছাত্রকে বিভিন্ন কেন্দ্রে ক্লাশ ও বক্তৃতায় যোগ দিতে অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। স্পেশাল কোর্স সম্পূর্ণ হলে অধ্যাপক ও পরীক্ষকদের সন্তুষ্টি সাপেক্ষে শিক্ষার্থীকে ডিপ্লোমা ডিগ্রী প্রদান করা যেতে পারে। মোট কথা, গ্রুপ পদ্ধতি নিরুৎসাহিত করাই অভিপ্রেত এবং পাস কোর্সে স্নাতক ডিগ্রীর ব্যবস্থা ভারতবর্ষের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রচলিত নিয়মে না হয়ে আলাদা হওয়াই উচিত। অধ্যাপক বক্তৃতা দেন, শিক্ষার্থী তা নোট করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এরূপ শিক্ষা দান পদ্ধতির পরিবর্তে টিউটোরিয়াল পদ্ধতির প্রচলন হওয়া উচিত। যেখানে অধ্যাপক অস্নাতকদের ব্যক্তিগত পর্যায়ে দিকনির্দেশনা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করবেন। তিনি ছাত্রদের পাঠ্যপুস্তক হাতে নিয়ে বসে না থেকে পুস্তকের মূল পড়তে ও ব্যাখ্যা করতে পরামর্শ দেবেন। সেজন্য শিক্ষা প্রণালীতে মাধ্যমিক স্তর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে- যার সঙ্গে এর যথেষ্ট সামঞ্জস্য রয়েছে।
ইতঃপূর্বেই বলা হয়েছে, আগামী কিছুকাল পর্যন্ত জনসংখ্যার প্রায় পঁচাত্তর শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডীর বাইরে থাকতে পারবে না এবং পঞ্চাশ শতাংশ মাধ্যমিক পর্যায় অতিক্রম করতে পারবে। সুতরাং কোন কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতা ছাড়া ছাত্ররা প্রাথমিক শিক্ষার এক বিশেষ সুনির্দিষ্ট ইউনিট হিসেবে গড়ে উঠবে। সতের বৎসর বয়স হওয়ার পর যে কোন তরুন যুবক স্কুলের শিক্ষা জীবন শেষ করবে, যা হবে প্রচলিত মাধ্যমিক মানের সমতুল্য। আরো অধিক শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী না হলেও তাকে শিক্ষিত হিসেবে গণ্য করা যাবে। যাদের সাহিত্য সম্পর্কে উচ্চাশা ও সেই সঙ্গে অবসর সময় আছে, অথবা যারা সাহিত্যকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে উৎসুক, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা নিতে হবে। এতে শিক্ষার্থীর জীবন থেকে আরো তিন বৎসর সময় ব্যয় হলেও প্রায় বিশ বৎসর বয়সে স্নাতক ডিগ্রী লাভে সে সক্ষম হবে। এ ডিগ্রী ইংরেজি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স মানের ডিগ্রী, প্রচলিত মানের নয়। উচ্চতর শিক্ষা, গবেষণা ও গ্রন্থকার পেশার জন্য যা কিছু অপরিহার্য আগ্রহী শিক্ষার্থীর পক্ষে বাইশ-তেইশ বৎসর বয়সে তা অর্জন করা সম্ভব হবে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, শুধু স্নাতক ডিগ্রী নিতে এখন যে সময় লাগছে তার চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্পূর্ণ করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রীর জন্য অনেক বেশি সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া হবে। মাতৃভাষায় শিক্ষা এবং উন্নততর শিক্ষা পদ্ধতি গ্রহণ করার দরুন উচ্চতর শিক্ষা লাভ সহজ হবে।
বিজ্ঞানে মুসলমানদের অধিকতর আগ্রহী করে তোলার উদ্দেশ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। উদ্দেশ্য, শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ শিক্ষাব্যবস্থা যেন সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। মাধ্যমিক স্তরেও বিজ্ঞান শিক্ষায় বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এর ফলে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে মুসলিম ছাত্ররা বর্তমানের তুলনায় বেশি সংখ্যায় বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য প্রয়োজন ব্যয়বহুল ল্যাবরেটরি। ধর্মশিক্ষার পর অত্যধিক প্রয়োজন বিজ্ঞান শিক্ষার। এ বিষয়ে যা কিছু করণীয় সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হবে মুসলমান সম্প্রদায়কেই।
ইতিহাস শিক্ষাদান সম্পর্কে বলতে হয়, ইসলাম তথা ভারতবর্ষের ইতিহাস পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের শেষ দু’বৎসর ইতিহাসের আরো একটি বিষয় বেছে নিতে হবে। এর মধ্যে থাকবে রোম, ভারতবর্ষ অথবা সেমেটিক জাতিগুলির প্রাচীন ইতিহাস। ইউরোপ বা এশীয় ইতিহাসের একযুগ অথবা ইংল্যান্ডের সাংবিধানিক ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বর্ণনাও থাকবে। এবং স্নাতক শ্রেণীতেও অনুরূপভাবে ইসলামের ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ইতিহাস সংক্রান্ত প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতি যে সন্তোষজনক নয়, তা বলাই বাহুল্য। বহু দেশের ইতিহাস এ শিক্ষা থেকে সম্পূর্ণ বাদ পড়েছে। এ এক ভ্রান্ত বিপথগামী পদ্ধতি, যার ফলে সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং আন্তর্জাতিক ঈর্ষার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। নিখুঁত ঐতিহাসিক পরিমিতি ও পরিপ্রেক্ষণা বজায় রেখে ইতিহাসের যে কোন বিষয় সম্পর্কে শিক্ষা দান করতে হবে। এজন্যে প্রাথমিক স্তরেই পৃথিবীর বৃহত্তর ঘটনার স্রোতধারা সম্পর্কে ছাত্রদের স্বল্প হলেও প্রয়োজনীয় ধারণা দিতে হবে। উদ্দেশ্য নিজ দেশ ও দেশের মানুষের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের যে কোন বিচ্ছিন্নতা না ঘটে। পরবর্তী বিভিন্ন পর্যায়ে ছাত্রদের শিক্ষাদান করতে হবে পৃথিবীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস অথবা মানবজাতির ইতিহাস সম্পর্কে। এ শিক্ষা কিন্তু বিভিন্ন জাতি ও দেশের মানুষের এবং বিশেষ করে বিভিন্ন রাজবংশের ইতিহাস থেকে স্বতন্ত্র হবে। এই স্বতন্ত্রীকরণ বিশদ বিবরণ প্রয়োজনও নেই অথবা কার্যত তা করাও যাবে না। বিরাজমান দেশপ্রেমের ব্যাপকতায় এবং উদার দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে ইতিহাস শিক্ষার আরো অবনতি ঘটার আশঙ্কা আছে। এইচ. জি. ওয়েলসের নতুন ইতিহাস মোটেও সন্তোষজনক নয়, এবং ইসলাম সম্পর্কে তার বিবরণ অমার্জিত ও ত্রুটিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও তিনি ইতিহাস রচনার পথিকৃৎ। যারা ইতিহাস সম্পর্কে সঠিকতর ও বিশদ জ্ঞানের অধিকারী, তারাও নিশ্চয় তার গৃহীত পদ্ধতি অনুসরণ করবেন বলে মনে হয়।
প্রাথমিক স্তরেই জটিল গণিতশাস্ত্র দ্বারা শিশুদের কচি মন ও মস্তিষ্ককে যেভাবে ভারাক্রান্ত করা হয়, একজন পরিণত বয়স্ক মানুষের বাস্তব জীবনেও তেমন হয় না। সুতরাং সামান্য ভগ্নাংশ সরলীকরণের নামে এই জটিল ও ক্লান্তিকর নিয়মের তীব্র নিন্দা জানাতেই হয়। এ শ্রম ও ধৈর্যের এক ভালো পরীক্ষা হতে পারে, কিন্তু কচি শিশু অপেক্ষা বাড়ন্ত যুবকদের জন্য এ নিয়ম বেশি উপযোগী। এ নিয়মকে বাতিল করেও কাঙ্ক্ষিত দ্রুততায় অগ্রসর হয়ে একজন বার বৎসর বয়েসী বালককেও প্রয়োজনীয় অঙ্কশাস্ত্র শেখানো অসম্ভব নয়। এর ফলে বালকটি ত্রৈরাশি, সুদকষা, ক্ষেত্রফল মাপা সংক্রান্ত সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হবে। গ্রাম ও শহরের বালকদের দৈনন্দিন জীবনে এসব বিষয় নিয়েই চর্চা করতে হয়। মাত্র কয়েকটি বিষয়ে শিশুর দক্ষতায় তুষ্ট না হয়ে স্বল্পতর সময়ে অনেক বিষয় পাঠ্যক্রমের অন্তর্গত করা শ্রেয়। নতুবা উত্তর জীবনে সেসব বিষয়ে সে অজ্ঞ থেকে যাবে এবং মানুষের সঙ্গে আদান-প্রদানে অসুবিধার সম্মুখীন হবে।
শুধু অঙ্ক ও প্রাথমিক ক্ষেত্রতত্ত্ব বাধ্যতামূলক বিষয় রেখে গোটা গণিতশাস্ত্র অধ্যয়ন বর্জন করা উচিত। বীজগণিত ও জ্যামিতির শিক্ষাগত মূল্য স্বীকার করে নিয়েও বলতে হয়-ওই দু’টো বিষয় বাধ্যতামূলক করা হলে কোন শিক্ষার্থীর সব বিষয় শেখানো প্রয়োজন পড়বে না।
শিশুর হস্ত ও চক্ষুর প্রাথমিক প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে তার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য ও পরিমিতিবোধ জাগ্রত করার জন্য প্রাথমিক অঙ্কন বিদ্যাও শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তবে মাধ্যমিক স্তরে তা হবে ঐচ্ছিক বিষয়। ভবিষ্যতে যারা অঙ্কন শিল্পী হতে চায়, অভিজ্ঞতা লাভের জন্য তারা অঙ্কন শিল্পকে অন্যতম ঐচ্ছিক বিষয়রূপে নিতে পারে।
আমাদের এই শিক্ষা পদ্ধতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে: ধর্মীয় শিক্ষায় অত্যধিক গুরুত্বারোপ এবং শিক্ষার মাধ্যমের পরিবর্তন, হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলককরণ এবং পেশাগত বৃত্তি অবলম্বন। প্রাথমিক স্তরে হস্তশিল্প হবে শিশুকে উপযোগী বিনোদন দেওয়া ছাড়াও তার হস্ত ও চক্ষুর প্রশিক্ষণ।
কিন্তু যেহেতু অধিকাংশ ছাত্র কৃষিজীবী হওয়া ছাড়াও এ কাজ করবে, তাদের এ বিষয়ের মূলতত্ত্বে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। অধিকন্তু স্বাস্থ্য, পুষ্প ও সবজি বাগান সংক্রান্ত বিষয়গুলিও সহজে কৃষি পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। শহরের স্কুলগুলিতে এর পরিবর্তে অন্য কোন বৃত্তিমূলক বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া যায়। ভারতবর্ষের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ছেলেদের জন্য বুনন শিল্পকেও বাধ্যতামূলক করতে হবে। মাধ্যমিক স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বৃত্তিমূলক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। তবে সব স্কুল-কলেজে সব রকম বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেওয়া যাবে না-অথবা এর প্রয়োজনও হবে না। পছন্দের বিশাল ক্ষেত্র থেকে স্কুল- কলেজগুলি স্থানীয়ভাবে বৃত্তি নির্বাচন করতে পারবে। উদাহরণত, মোরাদাবাদে ‘ভরত’ বা গীলাৎ-এর কাজ অথবা আলীগড়ে তালা প্রস্তুতের কাজ শিক্ষা দেওয়া স্কুলগুলির পক্ষে তেমন কঠিন নয়। তবে বৃত্তি বেছে নিতে হলে নিচের যে কোন একটি বেছে নিলেই হবে। যেমন ছুতোরের, রান্না-বান্নার, রাজমিস্ত্রীর, রঙের, ধোপাখানার, হিসাব রক্ষকের, স্টেনোগ্রাফির, কামারশালার, দরজির, তাঁতের, চর্ম সংস্কারের, বই বাঁধানোর, চামড়াজাত দ্রব্য তৈরির কাজ ইত্যাদি। ছেলেরা ছাত্র জীবনেই এক বা একাধিক পেশা খুঁজে নিতে চেষ্টা করবে। এর ফলে কয়েক বৎসরের মধ্যে ভারতবর্ষের ছাত্রসমাজ বর্তমান অর্থনৈতিক অসহায়তা এবং সরকারী অফিসের কেরানি অথবা নিম্নবেতনের চাকরির ওপর নির্ভর করা থেকে অব্যাহতি পেতে পারে। তখন কোন শিক্ষিত তরুণ দাসত্ব সুলভ সরকারী চাকরির পক্ষে সাফাই গাইতে পারবে না। অথচ এখন তারা তাই করে। কারণ কেরানির চাকরি ছাড়া অন্য কোন যোগ্যতা তার নেই। স্কুল-কলেজের পেশাগত শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই যে শিক্ষার্থীকে পেশা খুঁজে নিতে হবে, তা নয়। জীবিকার প্রয়োজনে পেশাগত জ্ঞান তো তার আছেই। তারপরও স্কুল-কলেজের কলাবিদ্যায় শিক্ষা সমাপনান্তে বৃহদাকারের সরবরাহ অথবা দরজি, লন্ড্রী বা কামারশালার ব্যবসায় শুরু করার মধ্যে লজ্জার কোন কারণ থাকতে পারে না। বাস্তব পেশাগত জ্ঞানসম্পন্ন যে কোন শিক্ষিত ব্যক্তি সামান্য মূলধন নিয়ে অথবা কোন মূলধন ছাড়াই মেধা ও শ্রম দিয়ে ব্যবসায় গড়ে তুলতে পারে। এবং কালক্রমে তা একটি সুন্দর ব্যবসায়ে পরিণত হতে পারে। এ ছাড়াও শিক্ষিত যুবসমাজকে বৃত্তিমূলক শিক্ষা শ্রমের মর্যাদা ও গুরুত্ব সম্পর্কে অনুপ্রাণিত করে তাদের ও শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে বিরাজমান বিরোধ দূর করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। উপরন্তু উত্তর জীবনে এ শিক্ষা ছাত্রদের জন্য সুযোগ বৃদ্ধি করা ছাড়াও পেশাগুলির অগ্রগতি সুনিশ্চিত করবে। কারণ কোন সংস্কৃতিমনা শিক্ষিত ব্যক্তি সামান্য অনুকরণ নিয়ে তুষ্ট থাকতে পারেন না। তিনি শিগগিরই উন্নয়ন ও আবিষ্কারের মনোভাব নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হবেন। কিন্তু বৃত্তিমূলক শিক্ষা যে কারিগরী শিক্ষার বিকল্প, তা মনে করা যাবে না। যে পদক্ষেপ গ্রহণের ইঙ্গিত এখানে দেওয়া হচ্ছে, তা কলাবিদ্যা (Arts) সংক্রান্ত শিক্ষাকে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের সঙ্গে সম্পূরক করা। এজন্য ছাত্রদের প্রতি সপ্তাহে মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময় বেশি ব্যয় করতে হবে। তবে অতিরিক্ত এই কয়েক ঘণ্টা তাদের ক্লান্ত মস্তিষ্কে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে না। বরং কিছুটা জরুরী বৈচিত্র্য এনে দেবে। এ পদ্ধতি শিক্ষিত কোন যুবককে তার এগার থেকে চৌদ্দ বৎসরের শিক্ষা জীবনে দক্ষ কারিগর হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করবে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও সে তার জীবিকা অর্জন করতে সক্ষম হবে।
শিক্ষা পরিকল্পনার যে রূপরেখা এখানে দেওয়া হয়েছে, জা’মিয়া তার আংশিক অনুসরণ করছে। সম্পূর্ণ অনুসরণ না করার কারণ অর্থাভাব। তবে মনে হয়, বেশি দিন এ অবস্থা থাকবে না। মুসলিম সম্প্রদায় জা’মিয়াকে পর্যাপ্ত অর্থের যোগান দেবে এবং দেশে ও দেশের বাইরে অধ্যাপকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে। তারা নিজ নিজ ভাষায় বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করবে। যার ভাষা যা-তার জন্য তাই হবে শিক্ষার মাধ্যম। এমনিতেই ইংরেজির যোগ্য অধ্যাপক পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু আমাদের দাসত্ব সুলভ মনোভাব ইংরেজিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। নিয়মের ব্যতিক্রম হলেও ভারতীয়রা নিজ নিজ মাতৃভাষায় যে কোন বিষয়ে শিক্ষা দান করতে পারত। কিন্তু মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভেচ্ছুদের সংখ্যা বলতে গেলে অপ্রতুল। জা’মিয়ার আদর্শ ইতোমধ্যেই কয়েকজন দক্ষ শিক্ষককে আকৃষ্ট করেছে। তারা অন্যত্র সহজেই বেশি বেতনের চাকরি নিতে পারতেন। আশা করি, ভবিষ্যতে এরূপ আরো অনেক দেশপ্রেমিক আকৃষ্ট হয়ে জা’মিয়াতে যোগ দেবেন। তবে এ কথা স্বীকার্য যে, আগামী কিছুদিনের জন্য জা’মিয়াকে প্রচলিত বেতনেই শিক্ষক সংগ্রহ করতে হবে। এ ব্যবস্থা প্রচলনের জন্য ভারতবর্ষের শিক্ষা বিভাগ ধন্যবাদার্থ। ইংল্যান্ডের শিক্ষকদের বেতন এখনো (অত্যন্ত) অপরিমিত। এই সেদিনও অক্সফোর্ডের মেধাবী শিক্ষকদের বেতন খুব বেশি হলেও বাৎসরিক তিনশত পাউন্ডের অধিক ছিল না। কিন্তু ভারতবর্ষের সরকারী কলেজ শিক্ষকদের ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা। তাদের অবশ্যই থাকতে হবে মোটর গাড়ি এবং কখনো কখনো পোলো খেলার ঘোড়াও। গ্রীষ্মকালে যে করেই হোক, ইংল্যান্ডে না হলেও অবকাশ যাপন করতে পরিবার-পরিজনদের কোন শৈল-শিখরে প্রেরণ করতে হবেই। এদের আরো দাবি, ন্যূনতম পক্ষে এদের বেতন জুনিয়র ডেপুটি কালেক্টরের বেতনের সমতুল্য হতে হবে। সুতরাং এসব দুর্লভ ব্যক্তিদের কথা বাদ দিলেও, উর্দু ভাষাতে শিক্ষাদানে দক্ষ ভারতীয় শিক্ষক নিয়োগ করার জন্য দেশের মুসলিম সম্প্রদায়কে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ দান করতে হবে। তবে আগামী পাঁচ-ছয় বৎসরের মধ্যে প্রাক্তন ছাত্ররাই শিক্ষকতা কাজে নিয়োজিত হবার জন্য তৈরি হবে। ইতোমধ্যে এদের কেউ কেউ ইউরোপে শিক্ষকতার পেশা গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে আমরা তাদের কাছ থেকে কিছুটা স্বার্থত্যাগের আশা তথা দাবি করতে পারি। এর ফলে জা’মিয়া মিল্লিয়ার খরচপত্র অযথা বৃদ্ধি পাবে না। প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের প্রত্যক্ষ পদ্ধতিতে আরবি, ফারসি, তুর্কি ও পশতু ভাষা শিক্ষা দেবার জন্য প্রতিটি ভাষার জন্য আরবি, ইরানি, তুর্কি ও আফগান শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। এসব ভাষাজ্ঞানসম্পন্ন ভারতীয় শিক্ষক পাওয়া একেবারে অসম্ভব না হলেও কষ্টসাধ্য হবে। কেননা শুরুতেই নীরস ব্যাকরণ শিক্ষা দানের কুঅভ্যাস তাদের পরিহার করতে হবে। সুতরাং এ অসুবিধার একমাত্র প্রতিকার হচ্ছে এমন আহলে জুবান ব্যক্তিদের সন্ধান লাভ-যারা ভারতীয় ভাষার একটি শব্দও জানেন না এবং ছাত্রদের সঙ্গে দৈনন্দিন সংসর্গে তাদের ভাষা শিখতে বাধ্য হবেন-যেভাবে শিশুরা নিজেদের মাতৃভাষা শেখে। সৌভাগ্যবশত ভারতীয় সরকারী অধ্যাপকদের মতো আরব ও ইরানি শিক্ষকগণ এত বেশি বেতনের প্রত্যাশী নন। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে জা’মিয়াকে যদি দিনের আয় দিয়ে দিনেই চলতে হয়, তা হলে আরব, ইরানি, তুর্কি ও আফগান শিক্ষক নিয়োগ বিলাসিতা ভিন্ন আর কিছু হবে না। সে বিলাসিতা আজ কল্পনা করাও উচিত হবে না।
সর্বোপরি, অন্যান্য মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অপেক্ষা জা’মিয়ার পরিবেশ এখনো অনেক বেশি ধর্মীয় ও জাতীয় ভাবাপন্ন। সে কারণে এ প্রতিষ্ঠানটি ভারতের মুসলমানদের নিকট থেকে প্রচুর অর্থ সাহায্যের দাবি রাখে। মুসলিম ছাত্রসমাজ সম্পর্কে আজ আমরা কোন তিক্ত কথা বলতে চাই না। তবে এ কথা আমাদের চেয়ে আর কেউ বেশি জানে না যে, জা’মিয়াতে ভর্তি না হওয়ার জন্য ছাত্ররাই শুধু দায়ী নয়। ত্রুটি যাদেরই হোক না কেন, তাদের অনেকেই আমাদের মতো বেশ বুঝতে পারেন, তারা তাদের সযত্নে লালিত আদর্শ থেকে বিচ্যুত হচ্ছেন, জা’মিয়ার ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ও এর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে। কোন এক রেলওয়ে স্টেশনে তুর্কি ফেজ টুপি পরিহিত উজ্জ্বল চেহারার কয়েকজন সপ্রতিভ যুবকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলে তারা নিজেদের পরিচয় দেয় এবং আলীগড়ে ভাইসরয়কে সংবর্ধনা দিয়ে সদ্য জয়ন্তী উৎসব পালন করেছে বলে জানায়। কেন তারা ফেজ টুপি পরেছে, এ প্রশ্ন না করে আমি পারলাম না। প্রশ্নটি তাদের নিকট সহজে বোধগম্য হয়নি এবং ব্যাখ্যা না করলে পাঠকের কাছেও হবে না। ফেজ টুপি ইসলাম ধর্ম, সারা বিশ্বের মুসলমান এবং বিশেষ করে খিলাফত ও তুর্কিদের প্রতি মুসলমানদের সহানুভূতির প্রতীক। মুসলমানরা ঘটনাবহুল দীর্ঘ চার শত বৎসর যাবৎ খ্রিষ্টান ও ইউরোপীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রামে লিপ্ত থেকেও এই টুপি ব্যবহার করে আসছে। অথচ ইসলাম, খিলাফত এবং তুরস্কের অত্যন্ত দুঃসময়েও এসব ছাত্র, তাদের শিক্ষক ও তত্ত্বাবধায়করা (অছি) প্রতিষ্ঠানটিকে অতিমাত্রায় নিরপেক্ষ রেখে ইসলাম, খিলাফত ও তুরস্কের শত্রুদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে অস্বীকার করেছে। তুর্কি ফেজ টুপি মস্তকে ধারণ করে তারা তুর্কিদের প্রতি কী ইঙ্গিত দিতে চায়, এ প্রশ্ন ঐ ছাত্রদের করা হয়েছিল। তারা কি এ বার্তাই পৌঁছে দিতে চায় যে, ইসলাম বা খিলাফত অথবা তুরস্ক আবার বিপদাপন্ন হলে তাদের সাহায্যার্থে তারা এগিয়ে আসবে? যুদ্ধবিরতির পর যে সঙ্কট দেখা দিয়েছিল, তখন অবশ্যই তারা সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি এবং প্রকৃত অর্থে সে সঙ্কট এখনো কাটেনি। ভবিষ্যতে এদের কাছ থেকে কী আর আশা করা যায়? ক্রোধের পরিবর্তে বরং অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে এ প্রশ্ন করা হয়েছিল এবং ছাত্ররাও তা বুঝতে ভুল করেনি। তারা স্বীকার করেছিল, এ প্রশ্নের জবাব দিতে তারা অপারগ। ঘটনাটি দেড় বৎসর পূর্বের এবং এর পরে আলীগড়ে ও অন্যত্র অনেক মুসলিম ছাত্রের সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছিল। তারা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছিল, তাদের আর কোন লালিত আদর্শ নেই। তারা ইসলাম তথা ভারতবর্ষকে হতাশ করেছে। সরল প্রকৃতির এসব যুবকের বয়স ও অভিজ্ঞতা এখনো পরিপক্কতা লাভ করেনি। তারা এখনো শেখেনি কী করে তাদের ব্যর্থতাকে এই কঠিন ফর্মূলা দিয়ে ঢাকতে হবে যে, অসহযোগিতাই ব্যর্থ হয়েছে। জা’মিয়াতে এখনো প্রায় একশত যুবক আছে। তারা ইসলাম ও ভারতবর্ষকে এখনো নিরাশ করেনি, তারা এখনো ইসলাম ও ভারতবর্ষের উচ্চ আদর্শ হৃদয়ে লালন করে। মাত্র কিছুদিন আগেও এ প্রতিষ্ঠানে এরূপ যুবকের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুযোগ-সুবিধার প্রলোভনে তারা জা’মিয়া ছেড়ে চলে গেছে। অবশিষ্ট যারা এখনো রয়ে গেছে তাদের মনেও প্রলোভনের দোদুল্যমানতা। যে কোন দিন তারাও হয়তো চলে যাবে। কারো বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ নেই। অন্যত্র অধ্যয়নরত ছাত্রদের নিশ্চয়ই আমরা অবজ্ঞা করি না। জা’মিয়াতে এখনো যারা পড়াশোনা করছে, ব্যতিক্রমী বলে তাদেরও আমরা অতি উচ্চাসনে বসাই না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটা কম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলেও উপেক্ষণীয় নয়। আমরা মুসলমানরা শুধু এই চূড়ান্ত কথাটাই শুনতে চাই। শিক্ষাক্ষেত্রে এই মাত্রার পার্থক্য বজায় রাখতে তারা আগ্রহী কিনা এবং যারা তাদের লালিত ইসলামী ও জাতীয় আদর্শে অবিচল ছিল, তা ত্যাগ করে তারা শুধু ‘পেশা’ অন্বেষণ করতে চায় কিনা! এসব আদর্শের যদি কোন মূল্য থেকে থাকে, তা হলে জা’মিয়াতে ইসলামী ও জাতীয়তার পরিবেশ অবশ্যই বজায় রাখতে হবে এবং এ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সর্বপ্রকার উপকরণ থাকতে হবে। দেশের এক অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানরূপেও জা’মিয়া মিল্লিয়াকে রক্ষা করতে সাত কোটি মুসলমান প্রথম কিস্তিতে দশ লক্ষ টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারেনা? আমাদের নিকট এই প্রতিষ্ঠানের আদর্শই একমাত্র আদর্শ এ কথা স্বীকার না করলে আমরা আদর্শচ্যুত হব। অথচ আমরা ‘ব্যবহারিক রাজনীতির অত্যাবশ্যকতার নিকট নতি স্বীকার করে শুধু মুসলমানদের কাছ থেকে জানতে চাই, তারা অন্য সবকিছুর সঙ্গে এই একমাত্র আদর্শকে টিকিয়ে রাখতে রাজি কিনা। আমরাতো আর একথা বলতে পারি না যে, ভবিষ্যতে কোন ‘টিকে থাকার সংগ্রাম’ হবে না। এবং এ কথা এভাবেও বলতে পারি না যে, ‘যোগ্যতমের ঊর্ধ্বতনে’ আমাদের কোন আশা নেই। কিন্তু আজ আমাদের আবেদন যথেষ্ট পরিমিত এবং জা’মিয়া মিল্লিয়া সন্তুষ্ট নিজে বাঁচতে এবং অন্যকেও বাঁচতে দিতে। তা হলে মুসলিম সমাজের জবাব কী? আমরা ইতোমধ্যে বলেছি, ‘আহ, আমরা চাই যেভাবে হোক জা’মিয়া বেঁচে থাকুক’। অবশ্যই জবাব তা নয়। মুসলমানদের আজ যা করণীয় তা হল, তারা প্রমাণ করুক যে জা’মিয়ার অস্তিত্ব বজায় রাখতে তারা আগ্রহী এবং এজন্য জা’মিয়াকে বাঁচাতে উদারহস্তে তাদের এগিয়ে আসতে হবে।
অনুবাদ: আজিজুর রহমান