শিউলিমালা একাডেমি

“হারিয়ে যাওয়া মক্তব ও তার ইতিহাস “

উপমহাদেশে মক্তব শিক্ষা শুরু যেভাবে:

আলিফ যবর- আ। বা যবর- বা। তা যবর- তা। অসংখ্য মক্তবে পাখির মতো নিষ্পাপ শিশুদের কুজন-কলরবে মুখরিত এ সবুজ শ্যামল বাংলাদেশের প্রতিটি রোদরাঙা শিশির ভেজা সকাল। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা টুপি পড়ে ওড়না জড়িয়ে ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে দল বেঁধে ছুটে চলে পাড়ার মসজিদের দিকে। মসজিদের ভেতরে বা চত্বরে ইমাম মুয়াজ্জিন যত্নের সাথে কায়দা আমপারা শেখান। বোর্ডে চক দিয়ে আরবি হরফ লিখে দেখান। আরবি ভাষার বানান-ব্যাকরণে প্রশিক্ষিত হয়ে ওঠে শিশুরা। সমস্বরে উচ্চারণ করে আল্লাহর নাম, পবিত্র কালেমা, কুরআনের আয়াত, নবিজীর হাদিস, দোয়া, মাসায়েল আরো অনেক কিছু। জপতে জপতে শেখে, লিখতে লিখতে শেখে, ধাপে ধাপে ইসলামের মৌলিক ক্রিয়াকলাপ (আমল) হাতেকলমে আয়ত্ব করে কোমলমতি শিশুরা। এটি ইসলামি শিক্ষার ভিত্তিমূল। সেই সাথে গ্রাম-বাংলার আবহমান ঐতিহ্য ও গৌরবোজ্জ্বল বাঙালি সংস্কৃতিও বটে।

উপমহাদেশে আফগান-ইরান-তুরান-আরব ও মধ্য এশীয় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুসলিম শাসক-সেনাপতি-ধর্মপ্রচারক-বণিক- ভাগ্যান্বেষীদের আগমন ও অভিবাসন শুরু হলে এ অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রচার-প্রসার ঘটে ও মুসলিম জনগোষ্ঠী সৃষ্টি হতে থাকে। একই সাথে শুরু হয় মুসলিমদের আনীত সংস্কৃতির এবং ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসার। এর সূত্রপাত হয় পশ্চিম ভারতে ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে আর পূর্ব ভারতসহ সমগ্র উপমহাদেশে মোটামুটি দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে। ইসলামের প্রথম যুগে নবী ও খলিফাদের আমল থেকেই মূলত মসজিদকে কেন্দ্র করে কোরান পাঠ, নীতি শিক্ষা, আচার-আচরণ ইত্যাদি শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিল। পরবর্তীকালে কোরান ও হাদিস পাঠ ও চর্চা, ইসলামী আদর্শ ও নীতি শিক্ষা, আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কিত জ্ঞান, নবীর জীবন ও জীবনাদর্শ শিক্ষা, জাগতিক বিষয় সম্পর্কিত নিয়ম ও ব্যাখ্যা, পারলৌকিক জীবন সম্পর্কিত ধ্যানধারণা ইত্যাদির সমন্বয়ে একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এটিই শিশু পর্যায়ে মক্তব ও সাধারণভাবে ইসলামী শিক্ষা হিসেবে চালু হয়েছে। পশ্চিম ভারত, দিল্লি আগ্রাসহ উত্তর ভারত, বঙ্গ ও পূর্ব ভারতে ইসলামের প্রসার ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিস্তৃতির ফলে ইসলামী ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা ব্যাপকতা লাভ করে।

ইসলামের আবির্ভাব এবং স্থিতিশীল অগ্রযাত্রার শুরুতে মসজিদে নববি কেন্দ্রিক ইলমে দীন বা ধর্মীয় জ্ঞানচর্চার কাজ শুরু হয়। মসজিদভিত্তিক ইসলামি শিক্ষার এ ধারা যুগে যুগে চলে আসছে হাজার বছর আগে থেকেই। মসজিদই হচ্ছে ইসলামি চিন্তা, কর্ম, জ্ঞান, বিশ্বাস, শিক্ষা ও সামাজিকতার কেন্দ্রস্থল। এ কারণে যেখানেই মসজিদ সেখানেই কুরআন ও শরিয়ত শিক্ষার ব্যবস্থা ধারাবাহিক ঐতিহ্য এবং অনিবার্য। সেই ধারাবাহিকতা থেকেই একসময় ভারতবর্ষের মসজিদে মসজিদে চালু হয় মক্তব ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে প্রতিটি মুসলমান শিশুকালেই ইসলামের মৌলিক জ্ঞানগুলো অর্জন করতে পারত। ৭১১ সালে মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের পরপরই ভারতবর্ষে মক্তব ও মাদরাসা শিক্ষার সূচনা হয়। তবে শুরুর দিকে এর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ছিল না। মুহাম্মদ ঘোরি দ্বাদশ শতকের শেষ দিকে ভারতবর্ষে তুর্কি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে ১১৯১ সালে আজমিরে একটি ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। তবে ভারতবর্ষে মক্তব ও মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার বিস্তার ঘটে মূলত মোগল আমলে। সেই শিক্ষাব্যবস্থা ব্যাপক জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ছিল সব মহলে। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসকদের শাসনামলে শিক্ষাব্যবস্থা ও ধর্ম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল।

ইতিহাসবিদ এ আর মল্লিক লিখেছেন, “বাংলার মুসলমানদের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে যখন কোনো সন্তানের বয়স চার বছর চার মাস চার দিন পূর্ণ হতো, তখন তার বিদ্যা শিক্ষার সূচনা হতো।”

একসময় বাংলার পথে-ঘাটে ভোরের পাখিদের সঙ্গে সঙ্গে মক্তবগামী কোরআনের পাখিদের দেখা মিলত। আমাদের পূর্ব পুরুষদের মাঝে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যাদের শিক্ষার হাতেখড়ি ‘মক্তবে’ নয়।

বাংলাদেশে মক্তব শিক্ষার পটভূমি :

মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্পটি ছিল খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। ১৯৯৩ সালে প্রকল্পটির যাত্রা শুরু করে। প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ৩ বছর। ১৯৯৬ সালে প্রকল্পটি ২য় পর্যায়ে ৫ বছরের জন্য অনুমোদিত হয় এবং ২০০০ সাল পর্যন্ত এর কার্যকাল স্থায়ী ছিল। ১ জানুয়ারি ২০০১ থেকে প্রকল্পটি পুনরায় সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয় এবং ৩১ ডিসেম্বর ২০০৫ তারিখে প্রকল্পটি ৩য় পর্যায় শেষ হয়েছে। প্রকল্পটির ৪র্থ পর্যায়ের জন্য পুনরায় ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পেশ করা হলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ২২ জানুয়ারি ২০০৬ তারিখে প্রকল্পটি পিইসি সভায় অনুমোদিত হয়। পিইসি সভার পর ১৮৭৬৬টি মসজিদে কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। শিক্ষা উপকরণ দেয়া হয়। ১ জানুয়ারি ২০০৬ তারিখ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইমামদের দ্বারা এই প্রকল্পের কেন্দ্রগুলো পরিচালিত হয়।

শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মসজিদের ইমামদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৫৬ হাজার ইমামকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইমামগণ মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় প্রায় ৫০ লাখ শিশুকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করেছেন।

মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমে ৪র্থ পর্যায়ে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তির হার বৃদ্ধির লক্ষ্যে সারাদেশে ১৮ হাজার শিক্ষা কেন্দ্রের মাধ্যমে ১৬ লাখ ২০ হাজার শিশু শিক্ষার্থীকে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করা (প্রতি কেন্দ্রে ৩০ জন ছাত্র)।

বয়স্কস্তরের শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সাক্ষরতা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা (প্রতি কেন্দ্রে ২৫ জন বয়স্ক শিক্ষার্থী)। সারাদেশে ১২ হাজার শিক্ষা কেন্দ্রের মাধ্যমে ১২ লাখ ৬০ হাজার জন স্কুলগামী শিক্ষার্থীকে পবিত্র কোরআন শরিফ শিক্ষাদান করা। প্রকল্প বাস্তবায়নের সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে প্রকল্প এলাকায় ১ হাজার ৪৭৪টি রিসোর্স সেন্টার স্থাপন করা।

২৮ মার্চ ২০০৬ তারিখে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদনের প্রক্রিয়াধীন উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর এক পর্যালোচনা সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, ‘মসজিদ ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম (৪র্থ) পর্যায় প্রকল্পটি সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে পরবর্তী অর্থবছরে পর্যায়ক্রমে বিবেচনা করা যেতে পারে। বিএনপি সরকার সংসদ নির্বাচনি বিভিন্ন সভায় মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্প আরো সম্প্রসারিত ও জনকল্যাণমূলক করার ওয়াদা করেছিল।

মাদ্রাসা শিক্ষার বর্তমান অবস্থা:

ব্যবস্থাপনা, উদ্দেশ্য ও পাঠক্রমের দিক থেকে দেশে চার ধরনের ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে- ১. মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে সরকারী অনুদান দ্বারা পরিচালিত মূলধারার মাদ্রাসা ২. কওমি মাদ্রাসা, যেগুলো সাধারণত সরকারী অনুদান গ্রহণ করে না, তবে দেশী বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে চাঁদা নেয় (এগুলো সাধারণভাবে ওয়াহাবী মাদ্রাসা নামে পরিচিত); ৩. মূলত আমপারা ও কোরান পাঠ শিক্ষায় নিয়োজিত মক্তব এবং ৪. সরকারী-বেসরকারীভাবে গৃহীত প্রকল্পভিত্তিক সাময়িক বিভিন্ন শিক্ষা কর্মসূচী।

কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত গোঁড়া ও সকলরকম আধুনিকতা বিরোধী। এসব মাদ্রাসায় আরবির পাশাপাশি উর্দু ও ফার্সির প্রতি যে গুরুত্ব দেওয়া হয় সে রকম গুরুত্ব মাতৃভাষা বাংলার প্রতি দেওয়া হয় না। এদের বাংলা জ্ঞান সীমিত, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইংরেজী জ্ঞান নেই, বাংলা বা কোন সাহিত্য পাঠ এবং সেই সূত্রে মানব-মনীষার উন্নত প্রকাশ সম্পর্কে কোন ধারণা নেই, শিল্প ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতনতা ও আগ্রহ নেই। প্রতিষ্ঠানেও ‘নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তক ভিত্তিক পাঠের, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমপারা, কোরান ও হাদিস পাঠে সীমাবদ্ধ, বাইরে আর কোন সুযোগ সুবিধা নেই। এ শিক্ষা ব্যবস্থার কর্তা ব্যক্তিরা মনে করেন, যেহেতু কোরান ও হাদিসের বিভিন্ন তফসির এবং ফিকাহ ও আকাইদের অধিকাংশ কিতাব উর্দু ও ফার্সি ভাষায় রচিত সেহেতু এ’ভাষাদ্বয় না জানলে কোরান হাদিস ও অন্যান্য কিতাব কিছুই বোঝা যাবে না। কিন্তু বর্তমানে আরবি, উর্দু, ফার্সি ভাষার দক্ষ শিক্ষকের অভাবে সেসব ভাষায় উচ্চতর জ্ঞানার্জন ও জ্ঞান অনুশীলনের উপযোগী মানে ভাষা আয়ত্ব করা সম্ভব হয় না। ফলে ছাত্রদের কোন ভাষাতেই ভাল দক্ষতা অর্জিত হচ্ছে না। এখান থেকে উন্নত শিক্ষা, মহৎ স্থাবিনবোধ, কোনরকম দক্ষতা, সৃজনশীলতা, ব্যক্তিত্বের সুষম বিকাশ প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এছাড়াও, প্রচলিত ও ক্রমপরিবর্তমান সমাজব্যবস্থার প্রতি এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও শিক্ষকদের বিরূপতা বিভিন্ন ওয়াজ মহফিলে তীব্র ভাষায় প্রকাশ পায়। বর্তমান সমাজব্যবস্থার অবক্ষয়ের জন্যে এরা পশ্চিমা আধুনিকতা ও নারীর অগ্রগতিকে এককাতারে রেখে ঢালাওভাবে একতরফা নিন্দা করে থাকে, উচ্চ শিক্ষিত দক্ষ নারীর প্রতি চরম অবজ্ঞা ও বিদ্বেষের মনোভাব প্রকাশ করে থাকে। এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে গোঁড়া রক্ষণশীল সামাজিক মতবাদ ও উগ্র ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার জঙ্গি রাজনীতিকে সমর্থন জোগায়।জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বইয়ের সম্পাদনা, রচনা, চিত্রায়ন, চরিত্রায়ন ইত্যাদিতেই নারী ব্যাপকভাবে উপেক্ষিত। ফলে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের বইতে তার ব্যতিক্রম ঘটার কোন কারণ নেই। “

আন্তর্জাতিক সাহায্যে গণশিক্ষা বিস্তারের প্রকল্পভিত্তিক কার্যক্রমে যেসব বাংলা বই ব্যবহৃত হয় তাতে নারীর সমমর্যাদাপূর্ণ প্রতিনিধিত্ব সম্পর্কে বাড়তি সচেতনতার প্রকাশ নেই। তদুপরি এই ধারার শিক্ষার কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকগণ নারীর ক্ষমতায়ন, কর্মক্ষেত্রে যোগ্যতানুযায়ী অংশীদারিত্ব, আইনগত ও নাগরিক সমানাধিকার সম্পর্কে সাধারণত বিরূপ মনোভাব পোষণ করে থাকেন।

মাদ্রাসা শিক্ষকগণও প্রায় একচেটিয়াভাবে পুরুষ। মহিলা মাদ্রাসার ধারণা অতি সাম্প্রতিক। বলা প্রয়োজন, এতে অত্যন্ত গোঁড়া পরিবার ও এলাকার মেয়েরা লেখাপড়া করার কিছু সুযোগ পেলেও মাদ্রাসা শিক্ষার অসম্পূর্ণতা, ভ্রান্তি ও একদেশদর্শিতার বাইরে এগুলো নয়। ফলে নারীর শিক্ষার বিস্তারের জন্যে মহিলা মাদ্রাসার সংখ্যা বাড়ানো নিশ্চয়ই কোন সদুত্তর হতে পারে না। তবে সরকারি বেসরকারি বিপুল অর্থ যে খাতে ব্যয়িত হচ্ছে তাতে নারীর কি অবস্থান ও পরিণতি সে চিত্রটি পাওয়া জরুরি। সবমিলিয়ে মহিলা শিক্ষকের হার শতকরা ১ জনেরও কম। ছাত্রীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়লেও শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশের মূল নির্মাতা শিক্ষকমণ্ডলী। শিক্ষকদের একাংশ অত্যন্ত গোঁড়া এবং নারী শিক্ষার বিরোধী। যারা অপেক্ষাকৃত উদার তারাও সহশিক্ষার বিরোধী, কঠোর পর্দা প্রথার এবং নির্ধারিত গার্হস্থ্য জ্ঞান ও ধর্মীয় মূল্যবোধ নির্ভর বিষয়েই পাঠ সীমিত রাখার পক্ষপাতী। সাধারণভাবে এদের দৃষ্টিভঙ্গি নারীর ব্যক্তিত্বের প্রকাশ, স্বাবলম্বন, ক্ষমতায়ন, স্বাধীন ভূমিকা, নেতৃত্ব, আর্থিক স্বাধীনতা, চাকুরিগত উচ্চতর অবস্থান, নির্দেশক-পরিচালকের ভূমিকার প্রতি বিরূপ। ফলে একদিকে ছাত্ররা নারীর প্রতি এই কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষালাভ করে আর অন্যদিকে ছাত্রীরা কঠোর অবরোধ ও শৃঙ্খলার চাপে নিষ্পেষিত হয়।

একচেটিয়া পুরুষ প্রাধান্য, অন্ধ সংস্কারের মাধ্যমে নারী বিদ্বেষী কুসংস্কার লালন, অন্য ধর্মের প্রতি উপেক্ষা,  আধুনিক শিক্ষা ও জীবনাচরণের প্রতি নির্বিচারে বিরূপতা,  বিজ্ঞানের প্রতি সন্দেহ ও অমনোযোগ এবং জাতীয় চেতনার প্রতি উপেক্ষার ভাব একইভাবে অনুসৃত হয়ে চলেছে। তাই মাদ্রাসার সবচেয়ে বড় সংকট এইখানেই যে, শিক্ষাঙ্গন হওয়া সত্ত্বেও এখানে তত্ত্ব তথ্যের অবাধ প্রবাহ, ও পর্যালোচনা, পরিমার্জনার পরিবেশ অনুপস্থিত। নানা সংস্কার ও পরিমার্জন ও উন্নয়ন সত্ত্বেও সম্ভবত একারণেই মাদ্রাসা শিক্ষা সমাজে ও জাতীয় জীবনে কোন বড় অবদান রাখতে পারছে না।”

কমিটির দৃঢ় পরিচালনার অভাবে অধিকাংশ মাদ্রাসায় শিক্ষকদের তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থ এবং পদোন্নতির লক্ষ্যে দলাদলিতে লিপ্ত থাকতে দেখা যায়। ছাত্রদের লেখাপড়ার ব্যাপারে আগ্রহে যথেষ্ট ঘাটতি দেখা যায়। তাছাড়া প্রায় অধিকাংশ মাদ্রাসায় যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব রয়েছে এবং ক্রমান্বয়ে এ ঘাটতি বেড়ে চলেছে। বর্তমানে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেও এই সংকট দূর হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এদিকে বর্তমানে দাখিল, আলিম পাশ করার পর সহজেই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যায় বলে নিজেদের ভবিষ্যত চিন্তা করে অধিকাংশ মেধাবী ছাত্র মাদ্রাসা শিক্ষায় আর অগ্রসর না হয়ে কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চলে আসে। দাখিল, আলিম এবং ফাজিল যথাক্রমে এস.এস.সি., এইচ.এস.সি. ও ডিগ্রির সমকক্ষ গণ্য হলেও চাকুরির ক্ষেত্রে এই মান কোন কাজে আসে না বলে ছাত্ররা ভবিষ্যত চিন্তা করে সাধারণ শিক্ষায় চলে আসছে। এভাবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মেধাবী ছাত্র মধ্যম পর্যায় থেকে মাদ্রাসা শিক্ষা ত্যাগ করে এ শিক্ষার দুর্বলতা, অসম্পূর্ণতা ও ব্যর্থতা ভালোভাবে তুলে ধরছে। মেধাবী ছাত্র না থাকায় মেধাবী আলেম-উলেমাও মাদ্রাসা থেকে বেরুচ্ছে না এবং সমগ্র শিক্ষাটির যেমন মান হ্রাস পাচ্ছে তেমনি কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কারণ ঘটছে।

মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যর্থতা :

আজ যদি আমরা সমাজ জীবনের দিকে তাকাই তাহলে বিভিন্ন ক্ষেত্রের কৃতি মানুষদের মধ্যে খুঁজলে কেবল মাদ্রাসা শিক্ষিত মানুষ একজনও পাবো কিনা সন্দেহ। একসময়, মুসলিম জনগোষ্ঠীর শিক্ষার প্রথম পর্যায়ে, সাধারণ মাদ্রাসা ও নিউ স্কিম মাদ্রাসার মধ্য দিয়ে প্রথম প্রজন্মের শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে অনেক সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সার্থক পেশাজীবীর দেখা মিলেছে। কিন্তু পরবর্তীকালে ক্রমবর্ধমান হারে ইংরেজি ও সেক্যুলার সাধারণ শিক্ষার প্রসার ঘটলে ব্যাপকহারে মুসলিম জনগণ এই শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকে এবং বহুতর সংস্কার সত্ত্বেও মাদ্রাসা শিক্ষা বিচ্ছিন্ন, সংকীর্ণ, গণ্ডীবদ্ধ এবং তামাদি শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিণত হয়।”

এই সূত্রে একথাও বলতে হবে যে, কেবল শিল্পী, সাহিত্যিক, পেশাজীবী সৃজনে ব্যর্থতা নয়, এমনকি খোদ ইসলামী জ্ঞানে পাণ্ডিত্যসম্পন্ন আলেম মাশায়েক তৈরিতেও এ শিক্ষা সার্থক হতে পারেনি। বাংলাদেশের কোন মাদ্রাসা থেকে সর্বোচ্চ শিক্ষালাভ করেও অসাধারণ বা উল্লেখযোগ্য পাণ্ডিত্যের আলেম তৈরির কথা জানা যায় না। অন্তত টানা সাতশ’ বছর ধরে বিভিন্ন পর্যায়ে ইসলামী শিক্ষা চললেও এ অঞ্চল থেকে ইসলাম সংক্রান্ত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিযোগ্য কোন মৌলিক গ্রন্থ রচিত হয় নি। দেওবন্দ, লখনৌ কিংবা পাকিস্তান বা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন শিক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে কেউ কেউ উচ্চতর জ্ঞানার্জন ও অনুশীলন করেছেন। কিন্তু এখান থেকে উচ্চমানের আলেম তৈরির কোন রেকর্ড নেই। বিপুল সংখ্যক মাদ্রাসা চালিয়ে এর পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয় করে একদিকে দেশীয় ইতিহাস কৃষ্টি ও ভাবধারার বিরোধী চেতনার প্রসার ঘটছে এবং অন্যদিকে প্রকৃত ইসলামী চিন্তা-চেতনারও বিকাশ বা চর্চার বিকাশ ঘটছে না। এমনিতেও গ্রামে-গঞ্জে ও শহরে যেসব ওয়াজ মাহফিল হয় তাতে সাধারণভাবে কোরানের ব্যাখ্যা বা পয়গম্বরের জীবন আলোচনার চাইতেও অনেক বেশি আলোচিত-সমালোচিত হয় নারী ও আধুনিক জীবনব্যবস্থা।

নারীকে কেবলমাত্র সংসারের গণ্ডিতে স্ত্রী বা জননীরূপে অসূর্যম্পস্যা থেকে গার্হস্থ্য ও যৌনজীবনে আবদ্ধ প্রাণী হিসেবেই কল্পনা করা হয়। ইদানিং ক্ষেত্র বিশেষে নারীর কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ সম্পর্কে কেউ কেউ ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও পর্দা মানার যে আবশ্যিক শর্তটি তাঁরা জুড়ে দেন তার ব্যাখ্যায় ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে যথেষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। শালীন সাধারণ পোশাকের অধিক পর্দার দাবি নিয়ে বাড়াবাড়ি অনেক সময় নারীর উচ্চশিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও চাকুরির ক্ষেত্রে বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অধিকাংশ সময় নারীকে গার্হস্থ্য কাজের বাইরে সীমিত কিছু কাজে যোগ দিতে অনুমতি দেওয়া হয়। এটা নারীর পেশাগত উন্নতি ও সামাজিক নেতৃত্ব গ্রহণের তথা তার ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশের পথে অন্তরায়। এই দারিদ্র্যলাঞ্ছিত শিক্ষাবঞ্চিত মানুষের দেশে ধর্ম বিরাট ভূমিকা পালন করে। অনেক সময় দেখা যায়, যুগোপযোগী ও কল্যাণকর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলসমূহও ধর্মীয় ভাবাবেগ বা স্পর্শকাতরতার দোহাই দিয়ে পিছিয়ে পড়েন।

শেষ পর্যন্ত এ প্রশ্ন না উঠে পারে না, যে-শিক্ষার এত সীমাবদ্ধতা ও সমস্যা তাতে কেন এত ছাত্র এখনও আসছে, ছাত্র সংখ্যাই বা বাড়ছে কেন? এর উত্তরে দুটি মূল কারণ উল্লেখ করা যায়।

প্রথমত, দারিদ্র্য- বহু মাদ্রাসায় ছাত্রদের বিনামূল্যে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে বলে দরিদ্র কৃষকমজুর শিক্ষার জন্যে মাদ্রাসার দ্বারস্থ হয়। দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় বিশ্বাস- আমাদের সমাজে সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয় যে পরিবারে একজন মৌলভী হলে অধঃস্তন সাতপুরুষ পর্যন্ত বেহেস্তে যাবে। তাই দেখা যায় অনেক পরিবারের অন্তত এক ছেলেকে মৌলভী বানানোর চেষ্টা করা হয়।

প্রায় দু’শ বছরের প্রেক্ষাপটে বিচার করলে দেখা যায় মাদ্রাসা শিক্ষা থেকে কিছু উজ্জ্বল ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব, যেমন মীর মশাররফ হোসেন, আমির আলী, মনিরুজ্জানান ইসলামাবাদী, আকরাম খান, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেন, মনসুর উদ্দিন, ড. এনামুল হক, আবুল ফজল প্রমুখ ব্যতীত ধর্মীয় জ্ঞানে প্রাজ্ঞ এবং সৃজনশীল চিন্তা ও পান্ডিত্যের অধিকারী ব্যক্তির পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত স্থবির ও সংকীর্ণ মানসিকতার ধর্মীয় ভাবাবেগপ্রবণ ব্যক্তিরই সৃষ্টি হয়েছে।

বিংশ শতাব্দীতে এসে তাই মাদ্রাসা ও মক্তব উভয় যাত্রাই স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তি ব্যাপক উৎকর্ষতার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে মক্তব ব্যবস্থা। একসময় গ্রাম অঞ্চলে মায়েরা ভোরে উঠে ফজর শেষে সুললিত ধ্বনিতে কুরআন তেলাওয়াত করত। সন্তানদের মক্তবে পাঠানোর ব্যবস্থা করত। কিন্তু প্রযুক্তি ব্যাপকতায় আজ সেই ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন গভীর রাতে ঘুমানোর কারণে ফজরের সময় অবচেতন মনে ঘুমিয়ে থাকে। ফলে মুসলিম শিশুরা হারিয়ে ফেলছে ইসলামের আবহমান কালের ঐতিহ্যের শিকড়।

শিশুদের অভিবাবকদের অবহেলার কারনে মসজিদের ইমাম সাহেবরা এখন মক্তবে কোরআন পড়ানোর আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। যার কারণে এলাকার শিশু কিশোররা কোরআন শিক্ষা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। বঞ্চিত হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশের মুসলিম শিশুরা। বাংলাদেশে কয়েকটি এলাকায় ঘুরে দেখেছি, কোথাও কোথাও মক্তবগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এমনিতেই বন্ধ হয়ে গেছে। আবার কোথাও কোথাও যা-ও চালু আছে, সেগুলোতেও আগের মতো জৌলুস নেই। শিশুদের উপস্থিতিও নেই বললেই চলে। নামে মাত্র চলে এসব কোরআন শিক্ষার পাঠশালা।

কয়েকজন ইমাম সাহেবের সাথে মক্তবের বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন, বিভিন্ন অযুহাত দেখিয়ে এখন অভিভাবকেরা শিশুদের মক্তবে পাঠাতে চান না। বেশিরভাগ শিশুরা সকালে ঘুম থেকে উঠেই স্কুলে কোচিং অথবা কিন্ডার গার্টেনে চলে যায়।  ক্লাসের সময় হয়ে যায় তাদের।

এভাবে চলতে থাকলে ইসলামী বুনিয়াদি শিক্ষার এ অবারিত ও ঐতিহ্যগত প্রতিষ্ঠান চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে। পরিণত হতে পারে অতীত ইতিহাস। তাই এখন থেকেই আমরা সোচ্চার না হলে এক সময় এই মক্তবে কোরআন শিক্ষা কেন্দ্র হারিয়ে যেতে পারে।

উপসংহার :

একেকটি জাতি ও জনগোষ্ঠীকে ঘিরেই গড়ে ওঠে পৃথিবীর নানা দেশ ও মানচিত্র। সে দেশের মানুষের সামাজিক, চারিত্রিক ও ধর্মীয় ভাব-বৈশিষ্ট্যকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠে তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিমল। ধর্মবিশ্বাসে বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষ মুসলমান হওয়ায় ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতিই এখানকার জাতীয় সংস্কৃতির মূল নিয়ামক। এদেশের শিশুরা মুসলিম প্রজন্ম, মুসলমানের সন্তান। এরা বড় হয়ে নিজ নিজ জীবন ও কর্মে যে অবস্থানই অর্জন করুক, এদের মৌলিক চিন্তাচেতনা ও জ্ঞান হতে সুমহান ইসলামের আলোকে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত ইসলামের বিশ্বাস ও কর্ম সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হওয়া এদেশের প্রায় সকল নাগরিকের জন্য বাঞ্ছনীয়। এটি নাগরিকদের মৌলিক অধিকারও। যার পৃষ্ঠপোষকতার প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র তার সকল নাগরিকের সামাজিক, নাগরিক, মানবিক, নৈতিক ও সাংবিধানিক অধিকারগুলো রক্ষা করতে যেমন বাধ্য, ঠিক তেমনি নাগরিকদের ধর্মীয় অধিকারগুলোও যথাযথ পূরণে দায়বদ্ধ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইসলামি শিক্ষার সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের হতাশাব্যঞ্জক উদাসীনতা বেশ বেদনা ও বিষ্ময়ের। উপরন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার অসার চিন্তা থেকে এদেশের নব্বই ভাগ নাগরিকের ধর্মীয় অধিকার ইসলামি শিক্ষাকে যথেষ্ট বিঘ্নিত ও বঞ্চিতই করা হয়ে আসছে। সুদীর্ঘ কূটকৌশলী প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন বিদেশি ও বিধর্মী এনজিও তাদের শিশুশিক্ষা বা প্রাথমিক শিক্ষার সময়সূচি এদেশের মক্তবগুলোর বিপরীতে দাঁড় করিয়েছে। দেশীয় কিন্ডার গার্টেন ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর সময় ও কার্যক্রমও এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে যেন জাতির সন্তানরা মক্তবমুখী হওয়ার সময়ই না মেলাতে পারে। হচ্ছেও তাই। বর্তমানের শিশুরা কাকডাকা ভোরে বিছানা ছেড়েই হাতমুখ ধুয়ে নাকে মুখে সামান্য নাশতা গুঁজেই পিঠে জ্ঞানের বস্তা নিয়ে স্কুল বা প্রাইভেটে ছুট দেয়।

একটি সন্তান যদি ভোর থেকেই স্কুল, প্রাইভেট কোচিং বা হোমওয়ার্ক নিয়ে সারাটা দিন ব্যস্ততায় কাটিয়ে ক্লান্ত হয়ে যায়, তা হলে একটু খাওয়া, ঘুম, গোসলের ফাঁকে তার বিশ্বাসের দীক্ষাটি নেবার সুযোগ সে কী করে পাবে? যে মুসলিম শিশুটিকে ইসলাম শেখার সময়ই দেওয়া হলো না, পরিবার থেকে দেখে শেখারও সুযোগ হলো না, ইসলামি জ্ঞান ও আদর্শের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো না তার মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষাকালেও, বাস্তবজীবনে সে ইসলামবিমুখ বা ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিকে পরিণত হতে পারে খুব সহজেই। এরাই পর্যায়ক্রমে হবে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষক, গবেষক, চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক, রাজনীতিক, সরকার ও রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারক।  অথচ গোড়া থেকে আগা পর্যন্তই তাদের চিন্তাচেতনা ও প্রবণতা থেকে যাবে মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও ইসলামশুন্য, তখন কী হবে এদের অবস্থা, আর কী হবে এদেশের ইসলামের! ‘হবে’ বলাটাও পুরোপুরি সঠিক নয়, কারণ ইতিমধ্যে হতে শুরু করেছে। এ অবস্থাটি আরও তীব্র ও ঘণীভূত হোক, এ চিন্তা ও ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনাও চলছে দেশি বিদেশি অনেক মস্তিষ্কেও। সতর্ক হওয়ার এবং সমুচিত পদক্ষেপ নেয়ার এখনই সময়।

সমাজের যে শিশুরা সুবিধাবঞ্চিত, অথবা যারা সাধারণ শিক্ষার পথেই এগুতে আগ্রহী, সবাই মসজিদে এসব মক্তবে জীবনের প্রথম ধাপে ঈমান ও ইসলামের মজবুত ভিত্তিটি মনমস্তিষ্কে গ্রহণ করার সুযোগ পায়। পূর্ববর্তী জীবনে সে যাই হোক, যাই করুক, যেভাবে যেখানেই থাক, শৈশবে উপার্জিত বিশুদ্ধ ধর্মীয় জ্ঞান ও আমলের অনুশলীনটি তার সঙ্গেই থাকে। নৈতিক ও আদর্শিক শিক্ষার ছাপ পড়ে তার জীবন ও কর্মের প্রতিটি ধাপে। সে যদি বাকি জীবন ইসলামি শিক্ষা সংস্কৃতির অনুকূল সুযোগ আর নাও পায়, তবুও তার সে শৈশবের পবিত্র জ্ঞানটুকুই তাকে আলোর পথটি চিনতে সাহায্য করে। মক্তব নামের এই বিস্তীর্ণ সূক্ষ্ম ও ক্ষুদে দ্বীপশিখাগুলো নিভে যাওয়ার পেছনের কারণ কি আধুনিক শিক্ষা তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তার? না, এ বাংলাদেশের তৃণমূল থেকেও ইসলামি তথা ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষাকে সংকুচিত করে আনার লক্ষ্যে ঘটছে, তা আজ সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে।

ভালো শিক্ষাদানের জন্য রয়েছে অনেকগুলো পূর্বশর্ত। এসব শর্ত পূরণ না করে ভালো শিক্ষার জন্য যতই চিৎকার করা হোক না কেন তাতে কোনো লাভ নেই। যেমন ভালো শিক্ষার জন্য চাই উন্নত শিক্ষার পরিবেশ, মানসম্পন্ন ও সুবিন্যস্ত পাঠ্যক্রম, উন্নত ও আধুনিক বইপত্রসহ প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ এবং দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষা প্রশাসন। কিন্তু আমার ধারণা এই সব কিছুর চেয়ে অনেক অনেক বেশি গুরত্বপূর্ণ উপাদান হলো আদর্শ শিক্ষক। কিন্তু যে সমাজে নানারকম তদবির করে কিংবা ঘুষ প্রদান করে একজন শিক্ষক নিয়োগ লাভ করেন তাতে কী করে আর আদর্শ শিক্ষক বলা যায়?

তবে হ্যাঁ, এ সকল সংকটের বিকল্প সমধানের পথও উন্মোচিত হতে শুরু করেছে নানাভাবে। কথায় বলে ‘অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা’ নিতে হয়। যারা এ অবস্থাটির প্রতিকার চাচ্ছেন বা করছেন তারাও চিহ্নিত ও বাধাগ্রস্থ হচ্ছেন অপশক্তির দ্বারা। দ্বীন ও ঈমানের এ ক্রান্তিক্ষণে বহুমুখী শত্রুতা ও ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা যারা করতে সচেষ্ট, জাতি বা জনগণের উচিত তাদের পাশে থেকে আদর্শ ও বিশ্বাস রক্ষার এ লড়াইয়ে শরীক হওয়া। নয়তো নামধারী মুসলিমের সংখ্যা বাড়িয়ে, প্রকৃত ঈমানদার ও দীনের পাহাড়াদার মুসলমানের সংখ্যা দিনদিন কমিয়ে ইসলামের এ পূণ্যভূমিকে ঈমান আমল ও চেতনাশূন্য করে দিতে শত্রুর বেশি সময় লাগবে না। সময় এখন তাই জেগে ওঠার। সময় এখন ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের। সময় এখন, যে করেই হোক বাংলাদেশের শিরা উপশিরায় মক্তবের দীপশিখা জ্বেলে রাখার; নতুন করে জ্বালাবার।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *