শিউলিমালা একাডেমি

“রক্তঝরা মসলা বাণিজ্য ও তার ইতিহাস”

আচ্ছা ভেবে দেখুন তো আপনি রান্না করছেন, কিন্তু আপনার কাছে কোনো মসলা নেই। আপনার রান্নায় কোনো মশলাই যুক্ত করতে পারছেন না। তাহলে কেমন হবে? কোনো স্বাদ পাবেন? তখন কি মনে হবে না যে এভাবে কি রান্না হয়!? খাওয়া যায় এগুলো!?

নিপাট ভদ্রলোক সেজে আপন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কত লোক কত দেশে আসে। অতঃপর দখল নেয়, দেখিয়ে দেয় নিজেদের বর্বরতা—শুধুই ধনসম্পদের জন্য। ইতিহাসে অহরহ এর প্রমাণ মেলে। তবে এবারের গল্প ধনসম্পদের নয়, মসলার। মসলা নিয়েও যুদ্ধ হয়? মসলার বাজার নিয়ন্ত্রণে নিতে বর্বরতা চালায় বহিরাগত শক্তি? হ্যা, ঠিক এমনই ঘটেছিলো ভারতবর্ষে।

ভারতবর্ষ সুপ্রাচীনকাল থেকেই ইউরোপীয়দের কাছে সম্পদের আকর হিসেবে পরিচিত ছিলো। এক ইংল্যান্ডের বিশাল সাম্রাজ্যের মধ্যে ‘সবচেয়ে সমৃদ্ধ উপনিবেশ’ তকমা তো ভারত এমনিতেই পেয়ে যায়নি। এখানকার অপরিমেয় সম্পদ শতাব্দীর পর শতাব্দী বেনিয়াদের আকর্ষণ করেছে।

ভারতবর্ষ বা এশিয়ার মসলার চাহিদা ছিলো বিশ্বজোড়া। বিশ্বের নানান প্রান্ত থেকে তেরো নদী সাত সমুদ্র পেরিয়ে বণিকরা আসতো এই এশিয়ায়, আসতো মসলার সুগন্ধে কাবু হয়ে।

আরব বণিকরা হাজার বছর আগে থেকেই এ দেশে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এসেছেন এবং এ দেশের সঙ্গে তাঁরা মিশেও গিয়েছিলেন। তখন এ আরব বণিকরাই বাণিজ্যের পাশাপাশি ইসলাম প্রচারকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। ফলে বাংলা-ভারতে ইসলামের প্রসারটা ঘটেছিলো সহজে ও সন্তর্পণে। আর এ কাজটা শুরু হয়েছিল হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশায়ই। সরাসরি সাহাবি (রা.)-দের জামাত বাংলাদেশ-ভারতে এসেছে, আবার এখানকার মানুষও মক্কা-মদিনায় গিয়ে সরাসরি মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর পরবর্তী যুগে খলিফাদের হাতে বাইয়াত হয়ে মুসলিম হয়েছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, কেরালার রাজা পেরুমাল (পরিমল) প্রজাদের নিয়ে সরাসরি মুহাম্মদ (সা.)-এর হাতে বাইয়াত হয়ে মুসলিম হয়েছিলেন।

ভারতবর্ষের দক্ষিণতম প্রান্তে বর্তমান ম্যাঙ্গালোর থেকে কুমারিকা প্রণালি পর্যন্ত আরব সাগরতীরবর্তী যেই ভূভাগ, তার নাম মালাবার বা কেরল। এই মালাবার অঞ্চল বহু প্রাচীন কাল থেকেই গোলমরিচের দেশ বলে খ্যাত। দুই হাজার বছর ধরে এখানকার বণিকরা মসলাপাতি, বস্ত্র, মণিমুক্তা, গজদন্ত প্রভৃতি পণ্যে জাহাজ বোঝাই করে নিয়ে লোহিত সাগর ও পারস্য উপসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে বাণিজ্য করতো। আরব সাগর, লোহিত সাগর, পারস্য উপসাগর, ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর আরব বণিকদের বাণিজ্য জাহাজে ছেয়ে গিয়েছিলো।

ইন্দোনেশিয়ার মলাক্কাস বা মালাকু দ্বীপপুঞ্জ ‘মসলার দ্বীপ’ নামে পরিচিত। প্রাচীনকাল থেকেই মলাক্কাসের দ্বীপগুলোতে গোলমরিচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, জায়ফল ইত্যাদি মসলার চাষ হতো। এই দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপের নাম বান্দা। ছোট-বড় ১১টি ভূখন্ড নিয়ে দ্বীপটি গঠিত। এই বান্দা দ্বীপ ছিল পৃথিবীর একমাত্র জায়গা যেখানে জায়ফল নামক মসলার চাষ হতো। ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে উৎপন্ন হওয়া মসলাগুলো একসময় ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান দ্রব্য। আরব বণিকদের কল্যাণে মসলা ইউরোপে পৌঁছানোর পর থেকে মসলার চাহিদা বেড়েছিলো আর দুষ্প্রাপ্যতার জন্য বেড়েছিলো দাম। বিভিন্ন মসলার মাঝে জায়ফলের দাম ছিলো বেশ চড়া। চৌদ্দ শতকে আধা কেজি জায়ফলের দাম ছিল একটা গরু বা তিনটা ভেড়ার সমান। এখনকার সময়ে একটা জায়ফলের দাম পড়ত ৪-৬ ডলার। দুই আউন্সের দাম পড়ত ৬২৫ ডলার। মধ্যযুগের ইউরোপে একজন নাবিক এক প্যাকেট জায়ফল বিক্রি করে সারাজীবন বসে খেতে পারতো।

জায়ফলের এত দামের পেছনে কারণ ছিলো এর বহুবিধ উপকারিতা। খাবারে স্বাদবর্ধক বা সুগন্ধিবর্ধক হিসেবে যেমন অব্যর্থ ছিল জায়ফল, তেমনই নানা রকম রোগ সারাতে কাজে আসতো এটি। প্রিজারভেটিভ হিসেবে ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাসের বিরুদ্ধে জায়ফল দিতে পারতো কার্যকর সুরক্ষা। ইউরোপে দীর্ঘ শীতকালে মাংসের পচন রোধে জায়ফল ব্যবহার করা হতো। শরীরে কোনো ক্ষত হলে তার উপর ছিটিয়ে দেয়া হতো জায়ফল। জায়ফলকে প্লেগ রোগের প্রতিষেধক বলে বিশ্বাস করতো ইউরোপীয়রা। গৃহস্থালি বা রাস্তাঘাটকে সুগন্ধময় করতেও ব্যবহৃত হতো এই মসলা। রোমান সম্রাট ষষ্ঠ হেনরি তার অভিষেকের সময় রাস্তায় জায়ফল পুড়িয়ে জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশকে সুগন্ধময় করতে চেয়েছিলেন।

মসলা বিষয়ে সমুদ্র বাণিজ্যে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, চীন ইত্যাদির সঙ্গে বাংলাদেশের নামও জড়িয়ে রয়েছে। উপমহাদেশে পর্তুগিজদের সমুদ্র বাণিজ্যের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এফনসো অ্যালবুকার্কের রিপোর্ট উদ্ধৃত করে ঐতিহাসিক লিখেছেন, “জাভা, মোলাক্কাস ও ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য দ্বীপে এমন সব মসলা জন্মাত, যা পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না। সেই সব মসলা এসে জমতো সেই মালাক্কার বন্দরে। এই মসলা নিয়ে বাণিজ্য করার আগে চীন, জাপান ও পশ্চিমে ভারতবর্ষ, আরব ও পারস্য থেকে বণিকরা এই বন্দরে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। এ সম্পর্কে অ্যালবুকার্ক নিজেই লিখে গেছেন, “প্রতিবছর মালাক্কায় ক্যাম্বে, চাওল, কালিকট, এডেন, মক্কা, জেদ্দা, করমণ্ডল, বাংলা, চীন গোর, জাভা, পেন্ড ও অন্যান্য জায়গা থেকে জাহাজ আসে।”

নানাবিধ উপকারিতার কল্যাণে ইউরোপ একটু বেশিই প্রেমে পড়েছিল জায়ফলের। এত বেশি যে এর জন্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বাধাতেও পিছপা হয়নি তারা।

ইউরোপের মসলার সাথে পরিচয় খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকের দিকে। তখন মসলার বাণিজ্যে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিলো আরব বণিকদের। তারা ভারববর্ষ থেকে মসলা কিনে সিল্ক রোড হয়ে পৌঁছে যেত কনস্টান্টিনোপলে। সেখানে ভেনেশীয় বণিকদের কাছে চড়াদামে বেচতো দুষ্প্রাপ্য মসলা। মসলার উৎস গোপন রাখতে নানা রুপকথা ফাঁদতো আরবরা। মসলা নামের এই মহামূল্যবান সম্পদ যে কতটা দুর্লভ তা বোঝাতে মসলা খুবই অল্প পরিমাণে সরবরাহ করতো  তারা। ভেনেশীয় বণিকরা মসলার দাম আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে রীতিমতো আগুনমূল্যে বিক্রি করতো ইউরোপে। দারুচিনি, লবঙ্গ, জায়ফল এভাবেই  জায়গা করে নিয়েছিলো ইউরোপীয় অভিজাতদের খাবার টেবিলে। ক্রুসেড-পরবর্তী মধ্যযুগীয় ইউরোপে মসলার জনপ্রিয়তা আরো বেড়েছিলো।

ইউরোপ মসলার প্রেমে পড়ল ঠিকই, কিন্তু মসলার আকাশছোঁয়া দাম আর দুষ্প্রাপ্যতার কারণে তা রয়ে গেলো তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এদিকে পনের শতকে কনস্টান্টিনোপলে উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধিকারে চলে গেলে ইউরোপে মসলা আসা বন্ধ হয়ে যায়। ততদিনে রেনেসাঁর হাওয়া লেগে ইউরোপ বদলাতে শুরু করেছে। নতুন দেশ আবিষ্কারের নেশায় শুরু হয়েছে এইজ অব ডিসকাভারি। তখনই মসলার প্রেম আর সম্পদের নেশা ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের জাহাজে করে নিয়ে এলো দূরপ্রাচ্যে। ভারতের যেসব পণ্য বিশ্ববাণিজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপ ও পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে রপ্তানি হতো, তার মধ্যে মসলা অন্যতম। ভারতবর্ষের মসলার গন্ধে ম-ম করতো ইউরোপীয় রান্নাঘরগুলো। খাবারকে সুস্বাদু ও ঝাঁঝালো করার ক্ষেত্রে এসব মসলার জুড়ি মেলা ভার। তাই ভারতীয় মসলার বিপুল চাহিদা তৈরি হয় বিশ্ববাজারে।

মসলার বাজার হিসেবে প্রাচীনকালে ভারতবর্ষ উন্মুক্ত ছিলো সবার জন্যই। ব্যবসায়ীরা দূরদূরান্ত থেকে আসতেন। মধ্যযুগে মুসলিমরা মিশর দখল করে নিলে ইউরোপীয়রা বেশ বিপাকে পড়ে। কারণ মিশর হয়ে ভারতবর্ষে জাহাজ নিয়ে আসতে হতো। আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ দিয়ে ভারতবর্ষে আসার জলপথ আবিষ্কার হয়নি তখনও। মুসলিমদের মিশর জয়ের ফলে আরবের মুসলমান ব্যবসায়ীরা একচেটিয়া ব্যবসার সুবিধা নিয়ে ভারতবর্ষের মসলার বাণিজ্য নিজেদের করে নেয়। আরব বণিকরা শুধু বাইরে থেকেই এখানে বাণিজ্য করতে আসতেন না। অনেক আরব বণিক এখানে বাণিজ্য করতে এসে এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছেন।

ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলোর মধ্যে পর্তুগিজরা ভারতবর্ষে প্রথম পা রাখে– এরকম তথ্য আমরা সবাই জানি। ভাস্কো দ্য গামার কথা কে না জানে! পর্তুগিজদের ভারতবর্ষে আসার মূল কারণ–মসলা। এক মসলার জন্যই তারা দু’বছর সাগর পাড়ি দিয়ে ভারতবর্ষে এসেছিলো।

ভাস্কো ডা গামা ১৪৯৭ সালে আফ্রিকা ঘুরে ভারতবর্ষে আসার নৌপথ আবিষ্কার করেন, এবং জাহাজবোঝাই প্রাচ্যের সম্পদ ও মসলা নিয়ে পর্তুগালে ফিরে যান। এভাবে ইউরোপীয়দের মাঝে পর্তুগিজরা মসলার সন্ধানে এগিয়ে যায় একধাপ।

ভারতবর্ষে আসার আগে ইউরোপে মসলার ব্যবসা করতো ইতালির ভেনিস রাজ্যে। কিন্তু একচেটিয়া ব্যবসায় ভেনিসের ব্যবসায়ীদের দাম বাড়িয়ে দেয়ার কারণে পর্তুগিজরা ক্রুদ্ধ হয়, নিজেরাই মসলার মূল উৎসে হাত দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। সমৃদ্ধ নৌ-শক্তি, নিজেদের শক্তিশালী পুঁজিপতি শ্রেণী ও রাজার সমুদ্রপথ জয়ের তাগাদা তাদের স্বপ্নের পালে হাওয়া লাগায়। সুবিধামতো দামে মসলা পেতে হলে মসলার বাজার দখলের বিকল্প ছিলো না তাদের। তাই পর্তুগিজরা যেকোনো মূল্যে ভারতবর্ষের মসলার বাজার দখল করে নেয়ার চিন্তায় বিভোর হয়ে ওঠে।

ভারতে মসলার মূল বাণিজ্য পরিচালিত হতো ভারতের সমুদ্রতীরের রাজ্য কালিকটে। তাই পর্তুগিজরা কালিকট দখলের জন্য তৎপরতা চালায়। কিন্তু কালিকটের অসাম্প্রদায়িক জনগণ সর্বোচ্চ সংগ্রাম করেছিলো তাদের কালিকটকে পর্তুগিজদের ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা করতে। কারণ কালিকট পর্তুগিজদের হাতে চলে আসলে তাদের ব্যবসারও পতন ঘটবে। শেষ পর্যন্ত কালিকটের পতন ঘটে।

ভারতবর্ষের নৌশক্তির অক্ষমতা ও কালিকটের প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর নির্লিপ্ততা চোখে পড়ে বেশ। পর্তুগিজরা যখন কামানসংযুক্ত যুদ্ধজাহাজে চড়ে সমুদ্রপথে দোর্দন্ড প্রতাপে রাজ করছে, তখন ভারতবর্ষের শাসক ও জনগণ– উভয়ের কাছেই কাছে কামান ছিলো রহস্যময় বস্তু। তাই পর্তুগিজদের সাথে উপমহাদেশীয় নৌ-শক্তি পেরে ওঠেনি কোনোভাবেই। প্রতিবেশী রাজ্যগুলো কালিকটকে দুর্দিনেও সাহায্য করেনি। বরং পর্তুগিজদের আগমনে খুশি হয়েছিলো এই ভেবে যে, পর্তুগিজদের কাছ থেকে ঘোড়া আমদানি করতে পারবে তারা।

ভারতবর্ষে প্রথম আগমনকারী শক্তি পর্তুগিজদের ইসলাম-বিদ্বেষ এমন ছিলো যে, সমুদ্রপথে নিরপরাধ হজ্জ যাত্রীদের ডুবিয়ে মেরে ছিলো তারা। আরব মুসলিম ব্যবসায়ী-বোঝাই জাহাজে আগুন ধরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে তাদের কট্টর ইসলাম-বিরোধী মনোভাবের নগ্ন দিকটি উন্মোচিত হয়ে যায়। ব্যবসার খাতিরে তারা মুসলিমদের বিরোধিতা করেছিলো, কিন্তু অন্যান্য ধর্মের সাথে তাদের কোনো বিরোধ ছিলো না। কারণ মুসলিমদের করায়ত্ব মিশর তাদের ভারতবর্ষে আগমনের প্রধান বাধা ছিলো। তাদের আগমনের পূর্বে মসলার বাজার আরব বণিকদের ভিড়ে অন্য কেউ সুযোগ পেতো না। ক্রুসেডের ফলে ইউরোপে যে মুসলিমবিরোধী জনমত গড়ে ওঠে তা পর্তুগিজদের ইসলাম-বিদ্বেষের আগুনে ঘি সংযোগ করেছিলো।

এমনকি অ্যালবুকার্ক সদম্ভে ঘোষণা করেছিলো,

“তোমাদের মধ্যে যারা মুসলমান নও, তারা কোনো ভয় কোরো না। আমরা তাদের কিছু বলব না। কিন্তু মুসলমান যারা, তাদের একটাকেও আমরা ছাড়ব না। আর এই হতভাগা মুসলমানদের যারা সাহায্য করতে বা বাঁচাতে চেষ্টা করবে, তাদেরও একই গতি হবে। তোমরা ভালো মানুষরা যে যেখানে আছো, সেখানেই চুপ করে থাকো। তোমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখো, আমাদের কাজ আমরা করি।”

অ্যালবুকার্ক পৈশাচিকভাবে বক্তৃতায় বলতে থাকে,

“এভাবে আমরা সব আরবকে এ দেশ থেকে বিতাড়িত করবো, মুহাম্মদের ধর্মের শিক্ষা চিরদিনের মতোই নিভিয়ে দেবো। যাতে এরপর তা আর কোনো দিন জ্বলে উঠতে না পারে। এভাবেই আমরা আমাদের প্রভুর পবিত্র কর্তব্য সম্পন্ন করবো।”

পর্তুগিজরা মসলার দ্বীপ আবিষ্কার করে ১৫১২ সালে। মালাক্কা প্রণালীর বান্দা দ্বীপে ভেড়ে পর্তুগিজ জাহাজ। কিন্তু তারা দ্বীপের মসলার ব্যবসার নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণে থাকা ‘ওরাং কায়া’ অভিজাতদের সাথে ঠিক সুবিধা করতে পারেনি। তারা পর্তুগিজদের সাথে ব্যবসা করতে রাজি হয়নি। পর্তুগিজরা যুদ্ধ করে ষোল শতক পর্যন্ত টিকে ছিলো। তারপর ডাচদের কাছে মার খেয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে বিদেয় হয়।

পর্তুগীজরা যখন মসলার বাণিজ্যে ইউরোপে দারুণ সাফল্য কামাচ্ছে, ঠিক তখনই ওলন্দাজ বণিকেরা বিদ্রোহ করে বসলো উচ্চ দামে মসলা কেনার বিরুদ্ধে। ১৫৯৫ সালে প্রথমবারের মতো ডাচদের নৌ-বহর ভারতবর্ষের বদলে ইন্দোনেশিয়ার মসলার দ্বীপে যাত্রা করে। সেবার তারা নিজেরা মসলা কিনে এনে ব্যাপক মুনাফা কামায়। তখন থেকেই মূলত ডাচদের বাণিজ্য জাহাজ নিয়মিত চলাচল শুরু করলো। গড়ে ওঠে ইউনাইটেড ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।

মসলার দ্বীপে ডাচরা এসেছিল ১৫৯৯ সালে। তারা শক্তিপ্রয়োগে ছিল পর্তুগিজদের থেকে কঠোর। ডাচ বণিকরা স্থানীয় রাজাদের বাধ্য করে তাদের সাথে চুক্তিতে আসতে। চুক্তিতে বলা হয়, বান্দার লোকজন শুধু ডাচদের কাছেই জায়ফল বিক্রি করতে পারবে। এই চুক্তি ভঙ্গ করার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদন্ড। ঐতিহাসিকদের মতে, স্থানীয় ব্যবসায়ীরা চুক্তি জিনিসটা বুঝত না। ডাচ নৌবহর দ্বীপ ত্যাগ করামাত্রই তারা অন্য ব্যবসায়ীদের কাছে জায়ফল বিক্রি শুরু করে। জায়ফলের বিনিময়ে প্রতিবেশী দ্বীপ থেকে খাদ্যশস্য কিনত তারা। ডাচরা তাদের এই আচরণকে চুক্তিভঙ্গ ও বিশ্বাসঘাতকতা মনে করে।

স্থানীয়দের চুক্তিভঙ্গের সাজা দিতে আর ব্রিটিশদের তাড়াতে তাই বান্দা আসেন ডাচ ইস্ট কোম্পানির নতুন আঞ্চলিক প্রধান জান পিয়েটার্জ কোয়েন। কোয়েন কাউকে ছাড় দেননি। জায়ফল ব্যবসায় ডাচ মনোপলি নিশ্চিত করতে বেশ নিষ্ঠুরতার পথ অবলম্বন করেন তিনি। কোয়েন ভেবেছিলেন,  দ্বীপের অধিবাসীদের মেরে বা তাড়িয়ে দিয়ে ভূমি দখল করে সেখানে দাসদের দিয়ে জায়ফল চাষ করাবেন। 

এই লক্ষ্যে তিনি ১৬২১ সালে  আক্রমণ করেন বান্দা দ্বীপের সবচেয়ে বড় ভূখন্ড বান্দাবেসারে। ১,৬০০ ডাচ সৈন্য, ৮০ জন জাপানি মার্সেনারি, এবং স্থানীয় কিছু দাস নিয়ে আক্রমণ করেন দ্বীপের নিরীহ মানুষদের উপর। এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় সেনা সমাবেশ ছিল এটি। স্থানীয়দের বিপুল প্রতিরোধের মুখে পড়ে ডাচরা। তবে জাপানি মার্সেনারির গেরিলা আক্রমণের মুখে রণেভঙ্গ দেয় স্থানীয়রা। দ্বীপ দখলের পর ডাচদের বিরোধিতাকারী সব রাজাকে হত্যা করে বাঁশের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়। দ্বীপের যেসব চাষী ডাচদের চোখ বাঁচিয়ে অন্য কোথাও জায়ফল বিক্রি করত, তাদের খুঁজে বের করে মারা হয়। ১৫ বছরের উপরে সব পুরুষদের মেরে ফেলা হয়। অনেককে বন্দী করে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়। অসহায় অনেক মানুষ বন্দী হওয়ার ভয়ে পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে জীবন দেয়। ডাচদের নির্যাতনের মুখে দ্বীপের জনসংখ্যা ১৫,০০০ থেকে কমে নেমে আসে ৬০০-তে।

এরই মাঝে ঘটে যায় আরেক ঘটনা। ১৬০৩ সালে দ্বীপে আসে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ডাচদের সাথে জবরদস্তি বাণিজ্য থেকে রেহাই পেতে বান্দার অধিবাসীরা ব্রিটিশদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে। ব্রিটিশদের দখলে ছিল একমাত্র দ্বীপ রান। একটি দ্বীপেই ব্রিটিশরা জায়ফল ফলিয়ে বিক্রি করতো। কোয়েন সেই দ্বীপের জমিও ব্রিটিশদের হাতে দিতে চাননি। ব্রিটিশদের সাথে রান নামের এই দ্বীপের দখল নিয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে অনেকবার। ১৬১৬ সালে ব্রিটিশদের তাড়ানোর জন্য দ্বীপে আক্রমণ করেন কোয়েন। গাছ কেটে দেন, গাছে আগুন ধরিয়ে দেন। ১৬২১ সালের বিশাল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধটা শুধু  স্থানীয়দের বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধেও। ব্রিটিশরা হারলেও ডাচদের হাড় জ্বালাতন করে গেছে পরের কয়েক দশক ধরে। কিন্তু ১৬৬৬ সালের এক যুদ্ধে ডাচদের কাছে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয় ব্রিটিশরা। তাদের দ্বীপের দখল চলে যায় ডাচদের হাতে।

ডাচদের মাথায় অদ্ভুত এক বুদ্ধি এলো। যদি কোনোমতে এই জমিন দখল করা যায়, তাহলে মুনাফা আকাশচুম্বী হওয়াও অসম্ভব কিছু নয়। ডাচ বণিকরা চাষীদের আগাম দাদন বা বায়নার টাকা দিয়ে দিলো। আর সরল মনের চাষীরাও সেই ফাঁদে পা দিলো। দাদনের সুযোগ নিয়ে নানারকম ছলচাতুরি ও প্রবঞ্চনার সাহায্যে চাষীর জমি হয়ে গেলো কোম্পানির সম্পত্তি। ক্ষেতের চাষের কাজ সেই চাষীরাই করতো। তবে আগে করতো নিজের ক্ষেতে, আর এখন করতে লাগলো কোম্পানির বাগিচায় দিনমজুর হিসেবে। কোম্পানির বাইরে যাদের জমি ছিলো, তারা তাদের ক্ষেতে লবঙ্গ গাছ লাগাতে পারতো না। এই মসলা চাষের অধিকার ছিলো কেবল কোম্পানির।

পর্তুগিজদের পতনের পর ডাচরা এভাবে তাদের স্থান দখল করে নেয়। পর্তুগিজরা মসলা চাষীদের উপর কোনোরকম বিধিনিষেধ আরোপ করেনি। কিন্তু ডাচরা ইন্দোনেশিয়ায় চাষীদের উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করে। এসবের ফলে চাষীরা সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। মসলার পর ইউরোপে কফির চাহিদা বৃদ্ধি পেলে চাষীদের জোর করে কফি চাষে বাধ্য করা হয়, দাম বেধে দেয়া হয়। ঠিক অনেকটা ভারতবর্ষের সাধারণ চাষীদের নীল চাষে বাধ্য করার মতো।

পর্তুগীজরা এ অঞ্চলে এসেছিলো মসলার বাণিজ্য করতে। এ বাণিজ্যকে মুষ্টিগত করা এবং এ জলপথের একচ্ছত্র অধিকারী হওয়াই ছিলো তাদের একমাত্র লক্ষ্য। মূলত ভারতবর্ষে কালিকট রাজ্য দখল করতে গিয়ে বারংবার ব্যর্থ হওয়াতে তাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মনোবল সম্পূর্ণরূপে ভেঙে গিয়েছিলো। অবশ্য তারা উপনিবেশ স্থাপন করেছিলো বটে। তবে সেটা ছিলো মসলার বাণিজ্য পাহারা দেবার লক্ষ্যে, সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য নয়। কিন্তু ডাচরা কেবল মসলার বাণিজ্য পর্তুগীজদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েই শান্ত হয়নি। বরং তারা শুরু থেকেই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় মনোনিবেশ করেছিলো।

সাম্রাজ্যবাদের সম্পূর্ণ রূপ ডাচরা সর্বপ্রথম দেখিয়েছিলো। পর্তুগীজরা মসলার বাণিজ্য নিজেদের করে নিতে চেয়েছিলো ঠিকই, কিন্তু মসলা উৎপাদনের বিষয়ে তারা খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি। পক্ষান্তরে ডাচরা মসলার বাণিজ্য করে মুনাফা অর্জন করেও শান্ত হতে পারেনি। বরং মসলার উৎপাদন নিয়ে তারা চিন্তিত হয়েছিলো বলেই ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলোর মানুষজনকে শোষণ করা শুরু করেছিলো। চাষীরা অবশ্য বিদ্রোহ করেছিলো ডাচ কোম্পানির বিরুদ্ধে।

যে মসলা বাণিজ্যের বদৌলতে দেশ-বিদেশে বণিকদের এত সমৃদ্ধি হয়েছিলো, সেই মসলার উৎপাদনকারীদের হয়েছিলো করুণ দশা। অবশ্য এতে অবাক হবার কিছু নেই। কারণ এটাই তো দুনিয়ার রীতি। যারা উৎপাদন করে, অভাব আর অনটন তো তাদেরই প্রাপ্য। আর এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে দমন নীতির হিংস্র আক্রমণ তো তাদের উপরই নেমে আসে। যুগ যুগ ধরেই এমনটা চলছে। ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলোর চাষীরা হয়তো সম্পদে পরিপূর্ণ ছিলো না, কিন্তু ডাচদের আগমনের পূর্বে যথেষ্ট সচ্ছল ছিলো; এমনকি পর্তুগীজদের সময়েও। কিন্তু ডাচ কোম্পানির যাঁতাকলে নিজেদের জমি হারিয়ে মজুরি পেত অতি নগণ্য। কোম্পানি তাদের কাছে চালও বিক্রি করত অতি উচ্চ মূল্যে। ফলে তাদের অবস্থা দিনকে দিন দুঃসহ হয়ে উঠতে শুরু করেছিলো।

ডাচরা কখনোই চায়নি, ইন্দোনেশিয়ার চাষীরা তাদের সচ্ছল জীবনে ফিরুক। তাদের নথিপত্র ঘাঁটলে জানা যায়, তারা সর্বদাই শঙ্কিত ছিলো, পাছে চাষীরা না অতিরিক্ত ধনী হয়ে যায়। ডাচদের মূল উদ্দেশ্য ছিলো, ইন্দোনেশিয়ার সম্পদ শোষণ করে নিজেদের ভাণ্ডার পূর্ণ করে তোলা এবং কোম্পানিকে আরো শক্তিশালী করা। এছাড়াও, চাষীদের এবং সাধারণ জনগণের সুখসমৃদ্ধির পথে যতটা সম্ভব বাধা প্রধান করা।

ডাচ বণিকরা প্রথম যখন এসেছিলো, তখন তারা পর্তুগীজদের মতোই বণিকদের কাছ থেকে মসলা কিনে নিয়ে ইউরোপে চালান করে মুনাফা অর্জন করতো। বাণিজ্যটা একচেটিয়া হলেও মানুষের জীবনযাপন নিয়ে তাদের তেমন আগ্রহ ছিলো না। কিন্তু তাদের লোভের মাত্রা ক্রমশ বাড়ছিলো। তাই এ মুনাফায় তারা সন্তুষ্ট হতে পারলো না বেশিদিন। এককালের স্বাধীন চাষী পরবর্তীকালে কোম্পানির বাগিচার কুলি বা দিনমজুরে পরিণত হলো। একটা সময় পরে পুরো ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলোই এক বিশাল বাগিচায় পরিণত করেছিল ডাচরা। কয়েকজন ছিলো সেই বাগিচার মালিক এবং বাকি সবাই কুলি। ইতিহাসে আর কোথায় এমন আছে, যেখানে পুরো একটা দেশের সমস্ত মানুষকে কুলিতে পরিণত করা হয়েছে?

প্রথমে পর্তুগীজ, তারপর ডাচ এবং সবশেষে ইংরেজরা; মসলার খোঁজে মসলার দেশ ইন্দোনেশিয়ায় এসে প্রবেশ করলো। ইউরোপে মসলার ব্যাপক চাহিদা ছিলো। পর্তুগীজদের হটিয়ে ডাচরা আয়ত্ত করে নিয়েছিলো মসলার বাণিজ্য। এরপর তারা বিস্তার করে নিজেদের সাম্রাজ্য। ডাচদের উচ্চমূল্যের মসলা কেনা থেকে নিজেকে বিরত রেখে ইংরেজরাই নৌ-বহর নিয়ে হাজির হয়েছিলো ইন্দোনেশিয়ায়। কিন্তু ডাচদের একচেটিয়ে মসলাকে করায়ত্ত করতে তারা ঠিক পেরে ওঠেনি। তাই বাধ্য হয়ে সরে আসতে হয়েছিল তাদের ভারতবর্ষে। এরপরের দু’শো বছরের ইতিহাস তো সবারই জানা।

ভাবুন তো এই মসলার জন্যই ডাচ, পর্তুগিজ ও ইংরেজরা এই ভারতীয় উপমহাদেশে এসেছে। মসলা কিন্তু কোনো সাধারন বিষয় নয়। মসলা না থাকলে হয়ত তারা এদেশে আসতোই না। হয়তো রচিত হতো না তাদের এমন নগ্ন একটা ইতিহাস।

সংকলক: সাবিহা শুচি

তথ্যসূত্র :

০১.

মসলার যুদ্ধ – সত্যেন সেন।

০২. https://archive.roar.media/bangla/main/book-movie/moslar-juddho-book-review

০৩. https://archive.roar.media/bangla/main/book-movie/mosolar-juddho-history-of-spices-business-in-asia

০৪. https://bn.m.wikipedia.org/wiki/মসলা#:~:text=মসলাকে কেন্দ্র করে যুগে যুগে,জাহাজ ভেড়ান ভারতের কেরালা উপকূলে।

০৫.

https://www.britannica.com/place/মলুসিকাস

০৬. https://archive.roar.media/bangla/main/history/dark-history-of-dutch-east-india-company-in-spice-trade

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *