এক.
একটা সময় ছিল যখন মানবজীবনের সমস্যাগুলো শুধুমাত্র পরিবার, গোত্র বা সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, অথবা এভাবেও বলতে পারি, অতীতে মানবজীবনে যে সব সমস্যা উদ্ভুত হতো সেগুলো শুধুমাত্র ব্যক্তি, পরিবার, গোত্র কিংবা সমাজের সাথে সম্পর্কিত ছিল। আর সে সকল সমস্যা সমাধান করার জন্য তাদেরকে এসব (ব্যক্তি, পরিবার, গোত্র বা সমাজ) ক্ষেত্রের বাইরে চিন্তা করতে হতো না, কিংবা প্রয়োজনও পড়েনি। কিন্তু বর্তমান একুশ শতাব্দীর সময়টা পুরোপুরি ভিন্ন।
বর্তমান সময়ে একজন মানুষের জীবন; তাঁর অর্থনৈতিক অবস্থা, তাঁর জীবনাচার, তাঁর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা, তাঁর সামাজিক আচার-আচরণ, তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং তাঁর জীবনদর্শন কেমন হবে সেটা শুধু তাঁর ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না। মানুষের এসকল বিষয়সমূহ অতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে বর্তমান দুনিয়ার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, শিক্ষাব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে।
আমরা সবাই কম-বেশি অবগত বিগত সাড়ে তিনশ-চারশ বছরের বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে বর্তমান দুনিয়া এমন একটি পর্যায়ে উপনীত হয়েছে, যেখানে পুরো বিশ্বের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে নির্দিষ্ট একটা গোষ্ঠি। অধিকাংশ দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার কলকাঠি পরিবর্তন হয় তাদের হাত দিয়ে। তথাকথিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পুরো দুনিয়ার শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে তারাই। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে যাচ্ছে তাদের মতো করে দুনিয়াকে সাজানোর জন্য, তাদের চিন্তা ও দর্শনের আলোকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তৈরি করার জন্য।
এমন একটি দুনিয়াকে ভালোভাবে না জেনে, এ সভ্যতার কারিগর ও এর নিয়ন্ত্রকদের না বুঝে বিদ্যমান সমস্যাগুলোকে যতই পর্যালোচনা করা হোক না কেন, এগুলোর পিছনের সত্যিকারের কারণ উদ্ঘাটন করা সম্ভব নয়। আর যে কোনো সমস্যার মূল কারণ বের না করে যতই সমাধান পেশ করা হোক না কেন, তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। সত্যি কথা বলতে গেলে, আজকের দুনিয়ায় এমনটাই চলছে। সবাই মুক্তির আওয়াজ তুলছে, নিত্য- নতুন সমাধানও পেশ করছে, কিন্তু মূল সমস্যা কোথায় সেটা কেউ বুঝে উঠতে পারছে না। কেউ কেউ কিছুটা আঁচ করতে পারলেও সত্যিকারের সমাধান কী হবে সেটা ভাবতে গিয়ে কুল-কিনারা হারিয়ে ফেলছে।
তাই এমন একটি পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী, সে বিষয়ে বিস্তর আলাপ করা যেতে পারে। তবে অল্প কথায় বললে, সর্বাগ্রে আমাদের দায়িত্ব হলো, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা এবং এ বিশ্বব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত জ্ঞান দর্শনের উপর সামগ্রিক ধারণা লাভ করা। জ্ঞান ও চিন্তার মধ্যে প্রবাহমান সকল বিকৃতি, অসঙ্গতি ও বিক্ষিপ্ততা দূর করে জ্ঞানকে হাকীকতের উপর প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
দুই.
পুঁজিবাদী গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্র (National Socialism) এবং কমিউনিজমের যে শক্তিগুলো আজ পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত, তারা আসলে আলাদা আলাদা সভ্যতার ধারক নয়। তাই তাদের মধ্য থেকে বাছাই করে ভালোটিকে রাখার প্রশ্নই ওঠে না। আসলে এরা একই সভ্যতার তিনটে শাখা। বিশ্ব প্রকৃতি ও মানুষ সম্পর্কে এদের সকলের দৃষ্টিভঙ্গি অভিন্ন। একই জীবন দর্শন ও একই নৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে এদের কাঠামো তৈরী হয়েছে।
মানুষকে পশু মনে করা,* বিশ্বজগতকে স্রষ্টা বিহীন ঠাওরানো, প্রকৃতি-বিজ্ঞান থেকে মানব জীবন পরিচালনার জন্য আইন আহরণ করা এবং অভিজ্ঞতা, স্বার্থপরতা ও প্রকৃতির লালসাকে নৈতিকতার ভিত্তি রূপে গণ্য করা-এ সবই হলো এ তিনটি সংঘর্ষশীল আদর্শের সাধারণ উপাদান। এদের মধ্যে পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, এ জাহেলী সভ্যতা সর্বপ্রথমে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও জাতীয় স্বাতন্ত্রের বীজ বপন করেছিল। তার ফলে জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র ও পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে এবং দীর্ঘকাল ব্যাপী মানব জাতি এর হাতে নিষ্পেষিত ও নির্যাতি হতে থাকে। এর যুলুম ও নিষ্পেষণ যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে শুরু করে তখন ঐ একই সভ্যতা সমাজতন্ত্রকে তার প্রতিকারের উপায় হিসেবে পেশ করে। কিন্তু এ প্রতিকার যে মূল রোগের চেয়েও মারাত্মক তা অল্প দিনেই প্রকাশ হয়ে পড়ে। অবশেষে সেই একই সভ্যতার পক্ষ থেকে ফ্যাসিবাদ অথবা জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্র নামে প্রতিকারের দ্বিতীয় উপায় উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়েছে যে, ‘জাহেলিয়াত জননীর এ সর্বশেষ সন্তানটি নাশকতা ও বিপর্যয় সৃষ্টিতে আগের দুই সন্তানকেও হার মানিয়েছে।’
এভাবে যে সভ্যতা মানুষকে লাগামহীনভাবে বিচরণশীল পশু মনে করে দুনিয়ার বুকে আপন দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেছে। এবং মানুষকে পররাজ্য গ্রাস থেকে শুরু করে জঘন্যতম নৃশংসতা পর্যন্ত কোনো মানবতা বিধ্বংসী ব্যাধি উপহার দিতে বাদ রাখেনি,
-তাকে পরীক্ষা করে দেখার আর কোনো অবকাশ নেই। এ সভ্যতা বাস্তবিক পক্ষে তার সকল শাখা-প্রশাখা সমেত স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির শেষ প্রান্তে উপনীত হয়েছে। তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তার কাছে এখন আর এমন কোনো দাওয়াই অবশিষ্ট নেই, যা সে মানব জাতির সমস্যা সমাধানের জন্য দিতে পারে। তবুও যদি ধরে নেয়া যায় যে, নিজের আয়ুষ্কাল আরো কিছুটা বাড়িয়ে নেয়ার জন্য সে আরো একটা ‘ইজম’ বা মতবাদ হাজির করবে, তাহলেও আল্লাহ নিজের গড়া পৃথিবীটাকে নৈরাজ্য দিয়ে ভরে তোলার আরো সুযোগ তাকে দেবেন, তা মনে হয় না। হতে পারে, বর্তমান সংঘর্ষের পর এর শাখা-প্রশাখাগুলোর মধ্যে কোনোটা অবশিষ্ট থেকে যাবে। তবে তা যে খুবই ক্ষণস্থায়ী হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই শাখার মধ্য থেকে শিল্পীরই আগুনের শিখা বের হবে এবং সেই আগুনেই সে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।
আজ মানবজাতি এক অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। মানুষ মানুষের সাথে বন্য পশুর চেয়েও হিংস্র আচরণ করছে। আদিম ও অসভ্য যুগেও মানুষ এ ধরনের নির্মমতা ও নৃশংসতার আশ্রয় নেয়নি। মানুষের আজকের নিষ্ঠুরতা ও হৃদয়হীনতার নজীর বন্য পশুদের মধ্যেও পাওয়া যাবে না। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরমোৎকর্ষের ফল দাঁড়িয়েছে বোমা মেরে দেশের পর দেশ জ্বালিয়ে দেয়া এবং ট্যাংক চালিয়ে নিরীহ জনগণকে পিষ্ট করা। মানুষের সাংগঠনিক যোগ্যতাকে আজ সভ্যতা বিধ্বংসী আগ্রাসী সেনাবাহিনী সংগঠনের কাজে লাগানো হচ্ছে। ভয়াবহ মারণাস্ত্র তৈরী আজকের শিল্পোন্নতির অন্যতম ফসলে পরিগণিত হয়েছে। প্রচার যন্ত্রগুলো পৃথিবী ব্যাপি মিথ্যা রটনা ও জাতিতে জাতিতে রেষারেষী, হিংসা ও বিদ্বেষ সৃষ্টির চরম পরাকাষ্ঠা দেখাচ্ছে। এসব কিছু মিলে আজ যে বিভীষিকাময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তা কোনো মানুষকে হতাশার গবীর আবর্তে তলিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। এ অবস্থা মানুষকে ভগ্নহৃদয় করার এবং নিজের সমস্ত যোগ্যতা ও প্রতিভা সম্পর্কে তাকে চরম নৈরাশ্যে নিমজ্জিত করার ক্ষমতা রাখে। আর এ নৈরাশ্যের অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে মানবজাতি চরম বিতৃষ্ণায় বহু শতাব্দীকালের জন্য তন্দ্রাচ্ছন্ন ও অচেতন হয়ে যাবে।
নিরেট জাহেলিয়াতের (যা আদৌ কোনো আধ্যাত্মিকতা ও অতি প্রাকৃতিক সত্তায় বিশ্বাস করে না এবং জীবনকে সম্পূর্ণরূপে বস্তু নির্ভর মনে করে) পর্যালোচনায় গেলে এ সিদ্ধান্তেই উপনীত হতে হয় যে, এ সম্পর্কে বিশ্ববাসীর এতবেশী তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, তারা অচিরেই এ থেকে চূড়ান্তভাবে নিরাশ হয়ে যাবে। নিরেট জাহেলিয়াতের দরুনই মানুষ নিজেকে পশু ভাবতে শিখেছে আর সে জন্য পশুদের জীবন থেকেই আহরণ করেছে সে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম, প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং যোগ্যতমের বাঁচার অধিকার ইত্যাকার মতবাদ। নিজেকে পশু ভাবার কারণেই বস্তুগত স্বার্থ উদ্ধার ও জৈবিক লালসা চরিতার্থ করাকে সে জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য হিসেবেই নির্ধারণ করেছে, অভিজ্ঞতা ও স্বার্থ সিদ্ধিকে গ্রহণ করেছে নৈতিকতার উৎস ও ভিত্তি হিসেবে, আর মানুষের চেয়ে উচ্চতর কোনো সার্বভৌম শক্তির কর্তৃত্ব না মানাই হয়েছে তার নীতি। এর ফল যা হবার তাই হয়েছে এবং তা অত্যন্ত বিষময় হয়েই দেখা দিয়েছে। এসব মতবাদের দরুন মানুষের মধ্যে জাতীয় ও বর্ণগত আভিজাত্যবোধ ও একদেশদর্শিতার প্রসার ঘটেছে। জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জন্ম হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ ও অর্থনৈতিক শোষণের মত মারাত্মক আপদ মাথা তুলেছে। নিজস্ব ব্যাপারে ব্যক্তি থেকে শুরু করে বড় বড় জাতি ও সাম্রাজ্য পর্যন্ত নৈতিকতার কোনো তোয়াক্কা করে না। সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যাপার এই যে, মানুষ সত্যি সত্যি পশুর মত কাজ করা শুরু করেছে এবং অন্যান্য মানুষের সাথে পাশবিক ও যান্ত্রিক আচরণে প্রবৃত্ত হয়েছে। এসব মতবাদ সমাজে হয় গণতন্ত্রের নামে একজনের ওপর আর একজনের অত্যাচারের, অবৈধ আয়ের এবং অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা করার অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছে, নয়তো সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমের নামে মানুষকে ছাগল ভেড়ার পালের মত একটি স্বৈরাচারী দলের হাতে সঁপে দিয়েছে, যেন তাদেরকে যেদিক খুশি তাড়িয়ে নেয়া যায় অথবা তাদের সাহায্যে যেমন খুশী স্বার্থ উদ্ধার করা যায়। এ মতবাদগুলোর এই যে পরিণতি দেখা দিয়েছে তা কোনো আকস্মিক ভুল-ভ্রান্তির ফল নয় বরং ঐ বিষ বৃক্ষেরই স্বাভাবিক বিষফল। সুতরাং মানুষ যেমন এ যাবত এগুলো থেকে কোনো কল্যাণ লাভ করতে পারেনি, তেমনি ভবিষ্যতেও পারবে না। বস্তুত মানুষ সম্পর্কে এরূপ পশুসুলভ ধারণা, জীবন ও জগত সম্পর্কে এমন জড়বাদী দৃষ্টিভঙ্গী এবং এহেন অভিজ্ঞতা ও স্বার্থপরতা ভিত্তিক নৈতিকতার ভিত্তিতে এমন কোনো সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠা সম্ভবই নয়-যা মানুষের জন্য যথার্থ কল্যাণ বয়ে আনতে পারে।
এসব মতবাদ ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর মানবজাতি একমাত্র এমন একটি মতবাদ থেকে সার্বিক কল্যাণ আশা করতে পারে যার বৈশিষ্ট্য হবে নিম্নরূপঃ
– সে মতবাদ মানুষকে মানুষই মনে করবে, পশু নয়। মানুষকে নিজের সম্পর্কে ভালো জ্ঞান পোষণে উদ্বুদ্ধ করবে। পাশ্চাত্যের জড়বাদী দর্শন যেমন মানুষকে নিছক পশুরূপে গণ্য করে, খৃষ্টবাদ যেমন তাকে ‘জন্মগত পাপী’ বলে মনে করে এবং হিন্দু দর্শন যেমন তাকে ‘পুনর্জন্মবাদের শৃংখলাবদ্ধ’ মনে করে, -এ মতবাদ তেমন মনে করবে না বরং তাকে এ সবের অনেক ঊর্ধে মনে করবে।
-সে মতবাদ মানুষকে চরম স্বেচ্ছাচারী ও লাগামহীন জীব মনে করবে না, বরং তাকে বিশ্ব সম্রাটের ক্ষমতার অধীন ও তাঁর কাছে দায়ী বলে ঘোষণা করবে’।
-সে মতবাদ মানুষকে এক বাস্তব ও কার্যোপযোগী নৈতিক বিধানের আওতাধীন করবে এবং তাকে সেই নৈতিক বিধানে আপন প্রকৃতির খেয়াল-খুশীমত রদবদল করতে দেবে না।
-সে মতবাদ বস্তুগত ভিত্তিতে মানবজাতিকে বিভক্ত করবে না বরং তার পরিবর্তে মানবজাতির ঐক্যের জন্য এমন একটা নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ভিত্তি গড়ে তুলবে, যার ওপর মানবজাতি সত্যিই ঐক্যবদ্ধ হতে সক্ষম।
-সমাজ জীবনের জন্য সে মতবাদ যেসব মূলনীতি দেবে তার আলোকে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে ও জাতিতে জাতিতে সুষ্ঠু ও ভারসাম্যপূর্ণ সুবিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।
– সে মতবাদ মানুষকে আত্মতুষ্টি ও আত্মপূজার চেয়ে উচ্চতর জীবন লক্ষ্য এবং জীবনের জড়বাদী ও বস্তুবাদী মূল্যবোধের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর মূল্যবোধ শিক্ষা দেবে।
-সর্বোপরি সে মতবাদ মানুষকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তামাদ্দুনিক উন্নতিতে শুধু সাহায্যই করবে না, বরং সুষ্ঠু ও নির্ভুল পথনির্দেশও দেবে। মানবজাতিকে নৈতিক ও বস্তুগত উভয় দিক দিয়ে উন্নতি ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
তিন.
মানবতাকে দীর্ঘ বারোশো বছর আদালত ও মারহামাতের সুশীতল ছায়া দানকারী এবং জ্ঞান ও মূল্যবোধের সর্বোচ্চ বিকাশ সাধনকারী ইসলামী সভ্যতার পতনের পরে মানবতাকে জাহেলিয়াত ও জুলুমের নিগূঢ় আধাঁরে নিপতিতকারী বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতার যে আধুনিক শোষণ চলছে, এ শোষণকে বুঝার জন্য লিবারেলিজম কী, লিবারলিস্টদের ওয়াদা কী, তারা বিশ্বকে মূলত কী দিতে চায়, তাদের তাকলীফ কী- এ বিষয়গুলো ভালোভাবে বুঝা জরুরী। লিবারেলিজম দুই-আড়াইশো বছর ধরে প্রভাবশালী ও বিজয়ী একটি চিন্তা। আমরা বর্তমানে কেমন দুনিয়ায় বসবাস করছি, এ দুনিয়ায় কোন কোন চিন্তাধারা প্রভাবশালী, তা যদি আমরা বুঝতে না পারি, তাহলে আমাদের পক্ষে ইসলামের আহ্বান, ইসলামের আদালত, ইসলাম কর্তৃক মানুষকে দেওয়া মর্যাদার বিষয়গুলোকে অন্য কোনো চিন্তার উপর প্রভাবশালী রাখা সম্ভব হবে না। লিবারেলিজমের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তাই এ মুহূর্তে আমাদের সর্বপ্রথম দায়িত্ব হলো বর্তমানের এ জাহেলিয়াতকে ভালোভাবে জানা ও বুঝা। হযরত উমর (রা.) এর ভাষায়-
“যে জাহেলিয়াতকে ভালোভাবে চিনতে পারেনি, জানতে পারেনি, বুঝতে পারেনি, তার পক্ষে ইসলামকে খুব ভালোভাবে জানা সম্ভব নয়।”
বর্তমান দুনিয়ার সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত স্লোগান হচ্ছে “শোষণ মুক্ত দুনিয়া চাই”। শোষণ মুক্ত দুনিয়া এই স্লোগানের প্রথম শব্দ ‘শোষণ’-এর সংজ্ঞা কী হবে, তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে যে দুনিয়া থেকে শোষণ মুক্তির স্লোগান উঠছে সেই দুনিয়া কীভাবে শোষিত হয়?
বর্তমান দুনিয়াকে বুঝতে হলে সমগ্র মানব সভ্যতার ইতিহাসকালব্যাপী যে শোষক শক্তিটি কাজ করছে এবং জুলুম জিইয়ে রাখছে, তাকে চেনার কোনো বিকল্প নেই। নতুন বিশ্বব্যবস্থার প্রস্তাবক প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানের ভাষায়-“পৃথিবীর কর্তৃত্ব হস্তগত করা, সব মানুষকে গোলাম বানানো এবং পরিপূর্ণ আনুগত্য করিয়ে শোষণ করার জন্য যে একটি ‘শক্তি’ আছে, তা আমাদেরকে ভালোভাবে বুঝতে হবে। এ শক্তির লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, পদ্ধতি (Method) কীভাবে কাজ করে, সারা বিশ্বকে তারা কীভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে চায় এবং এর জন্য শত শত বছর ধরে শক্তি অর্জন করে তারা আজ কীভাবে একটি শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত হয়েছে সে সম্পর্কে জানা অত্যন্ত জরুরী। এ শক্তিটি কীভাবে শত শত বছর ধরে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য তার পরিকল্পনাসমূহ বাস্তবায়ন করে চলেছে-এ সম্পর্কে অবগত হওয়া সময়ের দাবি। এগুলো দেখার জন্য বর্তমান দুনিয়ার অ্যানাটমিকেও ভালোভাবে চেনা-জানা আবশ্যক। আর এর অভিপ্রায় হলো নির্যাতিত- নিপীড়িত মানুষকে মুক্ত করার জন্য মানুষের সমস্যা নির্ণয় করা।”
চার.
দুনিয়া এক নতুন সময়ে প্রবেশ করেছে। ঔপনিবেশিক যুগের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে আমরা আধুনিক সময়ে বসবাস করছি। দৃশ্যত কোনো দেশ বর্তমানে অন্য কোনো দেশকে সরাসরি শাসন করে না। কিন্তু ঔপনিবেশকদের চরিত্র কি এত সহজে পালটে যেতে পারে? শোষণ যাদের উৎকর্ষতার প্রথম শর্ত তারা তাদের স্বভাব-প্রকৃতিকে কখনো পরিবর্তন করতে পারে না।
সময়ের শ্রেষ্ঠ চিন্তক ও মুতাফাক্কিরগণ বর্তমান সভ্যতাকে আখ্যায়িত করছেন ‘শোষণমূলক ও পুঁজিবাদী সভ্যতা’ হিসেবে। এ সভ্যতাকে ভালোভাবে না চিনে, এ দুনিয়ার গতিধারাকে ভালোভাবে অনুধাবন না করে আমাদের পক্ষে কখনোই এর বিপরীতে ন্যায়ভিত্তিক একটি দুনিয়া প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
শোষণ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সর্বপ্রথম যে প্রশ্নটি আমাদের সামনে হাজির হয়, তা হলো শোষণ কী? বা শোষণের ক্ষেত্রে শোষকদের ভিত্তি কী? পর্যালোচনার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি আমাদের জন্য সর্বাধিক গুরুত্ববহ। তাত্ত্বিকভাবে শোষণ বলতে বুঝায় কোনো দেশ বা অঞ্চলের উপর অপর অন্য কোনো দেশের আধিপত্য বিস্তার বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। পরিভাষাগত অবস্থান থেকে সে আধিপত্যবাদী শোষণকে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বা ‘উপনিবেশবাদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। যদিও ঐতিহাসিক বিচারে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদকে একটি নির্দিষ্ট সময়কাল হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়।
পাঁচ.
বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় চিন্তক ও তাত্ত্বিকরা শোষণকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেন। পুঁজিবাদী তাত্ত্বিকরা কমিউনিজমকে সাম্রাজ্যবাদ হিসেবে দেখান। আবার সমাজতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী বা লেখকরা পুঁজিবাদকেই সাম্রাজ্যবাদ ও নব্য উপনিবেশবাদ হিসেবে চিহ্নিত করেন। ভ্লাদিমির লেনিন তার সুবিখ্যাত গ্রন্থ Imperialism: The Higher Stage of Capitalism-এ শক্তিশালীভাবে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, পুঁজিবাদই হলো সাম্রাজ্যবাদের সূতিকাগার। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ইসলামী সভ্যতার পতন পরবর্তী সময়ে যে সকল চিন্তা ও দর্শন ক্ষমতা বলয়ে প্রবেশ করেছে বা রাজনৈতিক, জ্ঞানগত, সাংস্কৃতিক যেকোনো নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হয়েছে, কারো পক্ষেই আদালত প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। ফ্যাসিবাদ, নাজিবাদ, তৎপরবর্তী পুঁজিবাদ থেকে যতগুলো চিন্তাই মানবতার সামনে হাজির হয়েছে, সবগুলোই বিভিন্ন পন্থায় জুলুম ও শোষণের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। যেমন- পুঁজিবাদ পরবর্তী সময়ে মুক্তির স্লোগান নিয়ে উঠে আসা সাম্যবাদ পরবর্তীতে রাষ্ট্রযন্ত্রে অধিষ্ঠিত হয়ে ব্যক্তি- কেন্দ্রিক শোষণের বদলে ভিন্ন পন্থায় শোষণ শুরু করে।
অতএব, আমাদের জ্ঞান ও চিন্তাচর্চার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো জাহেলিয়াতকে চেনা, জাহেলিয়াতের প্রতিটি পন্থা এবং পদ্ধতি সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিবহাল হওয়া। একে খুব ভালোভাবে বোঝার মাধ্যমে ইসলামের আলোকে সমাধান পেশ করা, যা কিনা এ জাহেলী ব্যবস্থার বিপরীতে নতুন প্রস্তাবনা হিসেবে হাজির হবে।
মানুষ সম্পর্কে পাশ্চাত্যর মত :
মানুষ মানুষের শত্রু। তাদের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হলো তারা একে অপরের সাথে সংঘাতে লিপ্ত থাকবে, যার অন্যতম পরিণতি হলো যুদ্ধ। মানুষ এসব নিজস্ব স্বার্থের জন্যই করে থাকে। ইউরোপের বড় বড় দার্শনিকরাও মানুষকে স্বার্থপর হিসেবে মত দিয়েছেন। এডাম স্মিথের অর্থনীতির তত্ত্ব, কিংবা মার্কসের কমিউনিজম প্রথমেই দেখিয়েছে মানুষ স্বার্থপর, সে কখনোই স্বার্থবিহীন কোনো কাজ করে না।
ইউরোপীয়রা অ-ইউরোপীয়দের মানুষ মনে করে না। উপনিবেশ স্থাপনের পেছনে তাদের অন্যতম একটি মূল ধারণা ছিলো যে, পৃথিবীতে তারাই একমাত্র সভ্য জাতি, তারাই শ্রেষ্ঠ, আর বাকিরা Inferior তথা নিকৃষ্ট। আর এজন্য অন্য জাতিকে সভ্য করার দায়িত্ব তাদেরই। ঔপনিবেশিক যুগ থেকে শুরু করে আজ অবধি পাশ্চাত্যের নিকৃষ্ট শোষণ ও নির্মম জুলুমের পেছনে মূল কারণ এটিই।
ইউরোপীয়দের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিশ্বাস হলো ‘ইউরোপীয়দের ন্যায় যোগ্যতাসম্পন্ন অন্য কোনো জাতির অস্তিত্ব নেই’। এ বিষয়টি James M. Blaut তার সুবিখ্যাত গ্রন্থ The Colonizers Model of the World-এ চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। ব্লটের লেখা পাঠান্তে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে, এটি শুধুমাত্র কোনো চিন্তকের ধারণা কিংবা দার্শনিকের তত্ত্ব নয়। পশ্চিমাদের জন্য এটি একটি বিশ্বাস এবং মূর্ত বাস্তবতা। তারা অপশ্চিমাদের চেয়ে জন্মগতভাবেই শ্রেষ্ঠ-এটি তাদের বিশ্বাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
একচ্ছত্র আধিপত্য: পরিবেশের ব্যাপারে পাশ্চাত্যের ধারণা হলো মুতলাক আধিপত্য তথা একচ্ছত্র আধিপত্য। অর্থাৎ তারা যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে দুনিয়াকে ব্যবহার করতে পারবে, এ ব্যাপারে তাদেরকে বাধা দেওয়ার কেউ নেই। যেমন-বর্তমান সময়ে তারা পরিবেশের কথা বলে, সবুজ বিপ্লবের কথা বলে, অথচ গত শতাব্দী থেকে এখন পর্যন্ত তারা যে পারমাণবিক বোমার পরীক্ষামূলক ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকৃতি ধ্বংস করেছে এবং অজস্র কলকারখানা, মানববিধ্বংসী অগণিত প্রকল্পের মাধ্যমে এখনো ধ্বংস করে যাচ্ছে তার হিসাব তারা কখনো দেয় না।
ছয়.
সাম্রাজ্যবাদী ধারণায় অর্থনীতির শেষ কথা হলো লাভ। এ অর্থনীতি মূলত প্রফিটবেইজড বা লাভভিত্তিক। এ অর্থনীতির প্রয়োগযোগ্যতা ভিত্তি করে কতটুকু লভ্যাংশ উঠে আসছে তার উপর। পরিবেশের উপর পাশ্চাত্যের এ ধ্বংসযজ্ঞ দেখে বর্তমান সময়কার মুতাফাক্কিরগণ একে আখ্যায়িত করছেন ‘জীবাশ্মভিত্তিক শিল্পসভ্যতা’ হিসেবে। কারণ পাশ্চাত্যের ধারণা অনুযায়ী, পরিবেশ থেকে কতটুকু লাভ আসছে এটিই মুখ্য বিষয়, পরিবেশের স্থিতিশীলতা মুখ্য নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গোটা পৃথিবীতে মোট শিল্পবর্জ্য উৎপাদন হয় ৪০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একাই ২৫০ মিলিয়ন মেট্রিক টন উৎপাদন করে! এ ধারণা যে অবাধ ভোগবাদকে উস্কে দিয়েছে, দুনিয়াব্যাপী পরিবেশগত সাম্রাজ্যবাদ তারই ফল।
• শোষণ ও দখল: পরিবেশের ব্যাপারে ইহুদী ও খ্রিষ্টান সভ্যতার ধারণা হলো মানুষ প্রকৃতির উপর শর্তহীন আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে এবং ইচ্ছামতো পরিবেশকে ব্যবহার করতে পারবে। শোষণ ও দখল এ চিন্তারই একটি ফসল। যেকোনো ধরনের অমানবিক কাজের জন্য এরা বিন্দুমাত্র অনুশোচনা বোধ করে না। এক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের মূলকথা হলো প্রকৃতিকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে ব্যবহার করা যাবে। যার কারণে আজ পারমাণবিক বোমার ব্যবহার থেকে শুরু করে অস্ত্রের যে প্রতিযোগিতা চলছে, তার দ্বারা সমগ্র পৃথিবী কয়েকবার ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পরেও পুঁজিবাদী সভ্যতা পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা তো কমায়নি; বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করেই চলেছে। তাদের উদ্দেশ্য একটিই, পারমাণবিক অস্ত্র নিজেদের একচ্ছত্র অধিকারে রেখে পৃথিবীব্যাপী একাধিপত্য বিস্তার এবং নির্বিচারে সম্পদ লুণ্ঠন।
শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে পাশ্চাত্যের ধারণা হলো ‘আমি সাদা, তাই আমি তোমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আমি ইউরোপীয়, তাই আমি তোমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আমার জন্ম আমেরিকায়, তাই আমি তোমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ’। এটি কখনোই শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড হতে পারে না, অথচ এটিই হলো পাশ্চাত্যের হকের ধারণা। শ্রেষ্ঠত্বের উপরে হক নির্ভর করে-এটিই পাশ্চাত্যের অঘোষিত মূলনীতি।
তাদের মূলকথা হলো স্বার্থ। স্বার্থের প্রশ্নে তারা রক্তপাত-শোষণ-জুলুম কোনো কিছুকেই ধর্তব্যে নেয় না। স্বার্থের কারণে তারা যাচ্ছেতাই করতে পারে, যেখানে ইচ্ছা সেখানে হামলা করতে পারে।
‘আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, আমরা যা বলবো তাই হবে’-এটিই পাশ্চাত্যের মূলনীতি। তাদের প্রয়োজন হলে তারা কথিত গণভোটের আয়োজন করে। তারা সংখ্যায় বেশি, তাই তাদের আধিপত্যই মূল বিষয়; তাদের স্বার্থ, লভ্যাংশ, প্রাপ্যই সর্বাগ্রে। আমরা সকলেই জায়নবাদ সর্ম্পকে কম-বেশি জানি, কারণ বর্তমান পৃথিবী জায়নবাদীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। জায়নবাদী ইহুদীদের অন্যতম নাথান রথচাইল্ড একবার বলেছিলেন “সাম্রাজ্য পরিচালনা করার জন্য কে রাজা হলো তা আমার দেখার বিষয় নয়, আমার দেখার বিষয় হলো টাকা বা অর্থ। সত্যিকারের শাসক মূলত সে-ই, যার অর্থ আছে”।
বর্তমানের যুগের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক, মহান আলেম ও মুতাফাক্কির আল্লামা তুহা আবদুর রহমানের মতে, ‘আইডিওলজিক্যাল মডার্নিটি’ দ্বীনকে কোথাও গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। তাই জীবনের সকল ক্ষেত্রেই দ্বীনকে বিযুক্ত করে একটি নতুন বয়ান তৈরি করা হয়েছে। এজন্য সাম্রাজ্যবাদীদের পাঁচটি প্রজেক্ট আছে-
ক. দ্বীনকে রাজনীতি থেকে আলাদা করা।
খ. দ্বীনকে বিজ্ঞান থেকে পৃথক করা।
গ. দ্বীনকে আখলাক থেকে পৃথক করা।
ঘ. দ্বীনকে আকল থেকে আলাদা করা।
ঙ. দ্বীনকে আইন থেকে আলাদা করা।
ফলশ্রুতিতে মুসলমানদের মধ্যেই এ সকল বিষয় নিয়ে ব্যাপক ধোঁয়াশা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। পাশ্চাত্য সভ্যতা এমনি এমনিই শক্তিশালী হয়নি, বরং আমরা ধীরে ধীরে, পর্যায়ক্রমে দুর্বল হয়েছি এবং সমান্তরালে পাশ্চাত্য সভ্যতা শক্তিশালী হয়েছে। এখন পাশ্চাত্য সভ্যতা দুনিয়ার কেন্দ্রে অবস্থান করছে। পরিবর্তনশীল এ বিশ্বব্যবস্থায় নতুন যে বিশ্বকাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা পুরোদস্তুর সাম্রাজ্যবাদী ও জায়নবাদী কাঠামো। এ পর্যায়ে এসে আমাদের বিবেচনার বিষয় হলো আজকের দুনিয়া এ অবস্থায় কীভাবে উপনীত হলো, আমাদের চিন্তা কে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং এ সময় এসে সাম্রাজ্যবাদীদের অভীষ্ট লক্ষ্য কী?-এ প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা আমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এসবের জবাবের উপরই নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা, চিন্তা ও জ্ঞানচর্চা।
সাত.
ইসলামী সভ্যতার পতন পরবর্তী সময়ে আধুনিকতা, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বহুমুখী প্রতিঘাতে মুসলিম উম্মাহর মাঝে এক প্রবল টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। ইসলামী সভ্যতার পতন ও পাশ্চাত্যের ক্ষমতায়ন-ইতিহাসের এ পালাবদল সমান্তরালভাবে ঘটার কারণে মুসলিম মানসে এক স্থায়ী আত্মবিশ্বাসহীনতা ও হীনমন্যতাবোধ জন্ম নেয়, যা পরবর্তীতে আত্মপরিচয় সঙ্কটের রূপ ধারণ করে। আর বর্তমান দুনিয়ার এ শোষণব্যবস্থা এবং পশ্চিমা ক্ষমতার সূত্রে এক নতুন জুলুমতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়। এর কারণ অবশ্যই সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতায়নের ধারাবাহিকতায় পুঁজিবাদী আধুনিকতার সম্প্রসারণ ও প্রতিক্রিয়া। এ সময়কালের নানাবিধ পরিবর্তন, ঘটনা প্রবাহ ও কথিত আধুনিকতা মুসলিম উম্মাহর মাঝে যে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে, তা ইতিহাসের অন্য কোনো পর্যায়েই পরিলক্ষিত হয়নি। এক্ষেত্রে বর্তমান দুনিয়াকে বুঝার প্রেক্ষিতে যে সঙ্কটগুলো তৈরি হয়, সেগুলো হলো-
• বর্তমান সময়ে উপনীত হওয়ার নেপথ্যের কার্যকারণগুলো নিয়ে পর্যালোচনা না করা।
• ধর্মতাত্ত্বিকভাবে কিংবা ধর্মীয় টেক্সটের মাধ্যমে সকল সমস্যাকে ব্যাখ্যা করা।
• ইতিহাসকে সামগ্রিক ও ধারাবাহিকভাবে পর্যালোচনা না করা।
• বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সময়কে পর্যালোচনা না করা।
তৈরিকৃত চিন্তার আলোকেই দুনিয়াকে বুঝা এবং বিকল্প বয়ানের প্রস্তাবনা না দেওয়া।
এ সকল বিষয়ের আলোকে সামগ্রিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে আমাদের পক্ষ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে বিকল্প প্রস্তাবনা দেওয়া সম্ভব হয়নি।
গত শতকের মহান মুজতাহিদ আল্লামা ইকবালের ভাষায়, “হে ভাই, যদি সত্যিকার ইবরাহীম হতে চাও, যুগের নমরুদকে চিনে নাও”। কথাটি মূলনীতি। এর ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না। বর্তমান দুনিয়াকে ভালোভাবে বুঝতে হলে ঔপনিবেশিক ক্ষমতার সূত্রে আমাদের সমাজ ও মানসে প্রভাবশালী হওয়া আধুনিকতা, ইসলামী সভ্যতার পতন পরবর্তী দুনিয়ার গতিধারা, পাশ্চাত্যের উত্থান ও ক্ষমতায়ন, দুনিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস এবং ক্ষমতার পালাবদল খুব ভালোভাবে অনুধাবন করা আবশ্যক। পর্যালোচনা করে পাওয়া যায় যে, ইসলামী সভ্যতার পতনের নেপথ্যে প্রধান ছয়টি কারণ ছিলো-
১. জ্ঞানের মৃত্যুবরণ।
২. অনৈক্যের ফলে সৃষ্ট বিভেদ ও বিশৃঙ্খলা।
৩. আখলাকী পতন।
৪. নেতৃত্ব সঙ্কট। (অনেকে এ ক্ষেত্রটিকে ইসলামী সভ্যতার পতনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ কার্যকারণ হিসেবে অভিহিত করেন।) ৫. পাশ্চাত্যের ক্ষমতায়ন, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদী প্রভাব।
৬. সভ্যতা বিনির্মাণের মূল পথ থেকে দূরে সরে আসা, বিভিন্ন প্রান্তিক ও
এককেন্দ্রিক চিন্তায় আবদ্ধ হয়ে পড়া।
এ সকল কারণে ইসলামী সভ্যতার যখন পতন ঘটে তখন সমান্তরালভাবেই
পাশ্চাত্য সভ্যতা দুনিয়ার ক্ষমতায় আসীন হয়। পাশ্চাত্যের এ উত্থান
প্রক্রিয়া তিনটি ধাপে সংঘটিত হয়-
১. জ্ঞানার্জন।
২. নিজস্ব ভিত্তি তৈরি।
৩. ক্ষমতায়ন।
জ্ঞানার্জন : ইতিহাস ভালোভাবে অধ্যয়ন করলে আমরা দেখবো, তমসাচ্ছন্ন ইউরোপ মূলত ইসলামী সভ্যতার জ্ঞানকেন্দ্রগুলো তথা কর্ডোভা, ইসফাহান, দিল্লি, বাংলা, ইস্তাম্বুল, কায়রো, দামেশক, বাগদাদ, মাওয়ারা-উন-নাহার থেকে জ্ঞান আহরণ করার মাধ্যমেই আলোকিত হয়। ইসলামের জ্ঞানকেন্দ্রগুলো থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে জ্ঞানের ক্ষেত্রে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে। বড় বড় আবিষ্কার এবং শহশ্রাধিক ব্যাক্তিত্ব গড়ে তোলে। তবে রেনেসাঁর ক্ষেত্রে তারা জ্ঞান আহরণ করেছে ইসলামী সভ্যতা থেকে, এটি যেমন সত্য, সেই সাথে রেনেসাঁ যে একান্তই ইউরোপের প্রেক্ষিতে সংঘটিত একটি ঘটনা এবং রেনেসাঁ পরবর্তী পর্যায়কালগুলো পশ্চিমা সমাজ থেকেই উৎসারিত, তা-ও একইভাবে সত্য।
২. নিজস্ব ভিত্তি তৈরি: নিজেরা শক্তিশালী হওয়া, অর্থাৎ পাশ্চাত্য এ সময় নিজেদের অভ্যন্তরীণ শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
এবং ইসলামকে কীভাবে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ও মুসলমানরা বুঝবে সে জ্ঞানভাণ্ডার তৈরি করা (ওরিয়েন্টালিস্ট তৈরির মাধ্যমে গবেষণা, চিন্তাসহ সার্বিক বিষয়ে ইসলামের নতুন ভাষ্য তৈরি করা)। এ পর্যায়কালটি খুবই ক্রিটিক্যাল! কারণ এ সময়েই তারা বিশ্বের কেন্দ্রীয় দৃষ্টি ইসলাম থেকে ভিন্ন দিকে তথা পাশ্চাত্যের দিকে ঘুরিয়ে দেয়, যুগ ভাগ করার পাশাপাশি তারা নিজেদের জন্য স্বতন্ত্র বয়ান তৈরি করে। ইতিহাসের ক্ষেত্রে প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ আর আধুনিক যুগের বিভাজন এবং জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রতিটি বিষয়ের প্রেক্ষিতে নতুন বয়ান দাঁড় করায়।
যেমন- এ সময়েই ওরিয়েন্টালিস্টরা ইসলাম বিষয়ক প্রায় ৬০,০০০ বই
লেখে, যা ইসলাম বিষয়ক মূল গ্রন্থের স্থান দখল করে। ফলে ইসলামী সভ্যতার মৌলিক গ্রন্থগুলো ও মহান দার্শনিকদের চিন্তাধারার বদলে আমরা ওরিয়েন্টালিস্টদের ভাষ্যে ইসলামকে অধ্যয়ন করতে শুরু করি এবং পাশ্চাত্যের চিন্তার আলোকে মুসলিম উম্মাহর একটি শ্রেণি গড়ে ওঠে।
৩. ক্ষমতায়ন: উপনিবেশ ও গণহত্যা, বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সার্বিকভাবে শক্তি অর্জন মূলত পাশ্চাত্য সভ্যতার জ্ঞানগত, প্রযুক্তিগত ও সামরিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার মাধ্যমে শুরু হয়। শিল্পবিপ্লব পরবর্তী সময়ে পশ্চিমারা অর্থনৈতিক স্বার্থে বিভিন্ন অঞ্চলের উপর দখলদারিত্ব ও শোষণ কায়েম করে। এ দখলদারিত্বের সবচেয়ে বড় শিকার উপমহাদেশ এবং বাংলা অঞ্চল। পাশাপাশি মিশর, উত্তর আফ্রিকার দেশগুলো, মধ্যপ্রাচ্য, মাওয়ারাউন নাহার অঞ্চলগুলোতেও শোষণ ও সামরিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে পশ্চিমারা। ওয়াল্টার রডনি- এর How Europe Underdeveloped Africa, শশী থারুর-এর An era of Darkness: The British Empire in India, Inglorious Empire: What British did to India, Frie Williams Gi Capitaslim & Slavery গ্রন্থগুলো পড়লে ঔপনিবেশিক শোষণের ভয়াবহ মাত্রা সম্বন্ধে কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যায়। এ শোষণের মাধ্যমেই মূলত পাশ্চাত্যের ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। শোষিত অঞ্চলগুলো থেকে সম্পদ আহরণ করেই মূলত ইউরোপীয় দেশগুলো অর্থনৈতিক দিক থেকে ফুলেফেঁপে ওঠে। ইউরোপের শিল্প বিপ্লবে শোষিত দেশগুলোর ভূমিকা ছিলো জোগানদাতার মতো। শোষণ পরবর্তী সময়ে এসে এ সকল সমৃদ্ধ অঞ্চলের অবস্থা এতটাই ভঙ্গুর হয়ে যায়, যা ছিলো কল্পনারও বাহিরে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এমন এক নির্মম দখল ও লুটপাট চালায়, যার ফলে এ সকল অঞ্চল দরিদ্র হয়ে পড়ে। আর তাদের থেকে আহরিত সম্পদে পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনী দেশে পরিণত হয়। উপনিবেশ ও গণহত্যার মাধ্যমেই শুরু হয় পাশ্চাত্যের ক্ষমতায়ন। আর উপনিবেশায়নের সূচনা হয় মুসলমানদের পতন ঘনিয়ে আসার মধ্য দিয়ে। বিভিন্ন অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন শুরু করে দখলদার ব্রিটিশ, ফরাসি, ইতালীয়, স্পেনীয় ও পর্তুগীজরা। ব্রিটিশ ও ফরাসিরা মুসলিম অঞ্চলগুলোতে ভয়াবহ গণহত্যা পরিচালনা করে। স্পেনীয়রা আমেরিকাতে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। আমেরিকাতে পাশ্চাত্যের গণহত্যা প্রমাণ করে-পাশ্চাত্যের চিন্তাদর্শন গণহত্যার রক্তের প্লাবনের উপর প্রতিষ্ঠিত। জ্ঞানসম্রাট আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচের ভাষায়-“পাশ্চাত্য কখনোই সভ্য ছিলো না, আজও তারা সভ্য হয়নি। আজকে পাশ্চাত্যের চোখধাঁধানো উন্নতি ও অগ্রসরতা শোষিত মানুষের রক্ত, তাদের চোখের পানি ও দুঃখ-কষ্টের উপর ভিত্তিশীল শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানোর পাশাপাশি তারা সবচেয়ে বেশি ধ্বংসযজ্ঞ চালায় অর্থনীতিতে। অর্থনৈতিক লুণ্ঠনের কারণে আজও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না উপনিবেশের শিকার অঞ্চলগুলো, যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ভারতীয় উপমহাদেশ।
আট.
উপনিবেশায়ন এখনো থেমে নেই। আজও প্রতিটি অঞ্চলে তারা সরাসরি আগ্রাসন না চালালেও নানা কৌশলে, পরোক্ষভাবে নানাবিধ ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। যেমন- আফ্রিকার দেশগুলোতে গণহত্যার ষড়যন্ত্র চলমান। সর্বোপরি, দুইশো বছরের মহাজুলুম, শোষণের কারণে প্রতিটি মুসলিম জনপদ আজও অধিকার ও মর্যাদাহীনভাবে পরিচালিত হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে গুটিকয়েক তথাকথিত সভ্য দেশের সুনির্দিষ্ট কিছু নাগরিক গোষ্ঠী ব্যতীত গোটা মানবতা আজ মজলুম অবস্থায় উপনীত হয়েছে এবং বঞ্চিত হচ্ছে ন্যায়ভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা থেকে। আজ সমগ্র মানবতা এহেন পরিস্থিতে নিপতিত হয়েছে। আদালতের পরিবর্তে জুলুম, সালামতের পরিবর্তে ফাসাদ, মারহামাতের পরিবর্তে দ্বন্দ্ব এবং ওয়াহদাতের পরিবর্তে তাফরিকা আমাদেরকে ক্রমাগত বিধ্বস্ত করে দিচ্ছে ও সমগ্র মানবতার ভাগ্যকে এক অন্ধকার গহ্বরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ তার আত্মজীবনী Inescapable Questions-এ সে সময়কার অবস্থার বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, “চল্লিশের দশকের প্রথমভাগেও মুসলিম বিশ্বের অবস্থা ছিলো খুবই দুর্দশাপূর্ণ। গুটিকয়েক মুসলিম রাষ্ট্র স্বাধীন হিসেবে টিকে ছিলো। আমাদের কাছে মনে হয়েছিলো এটি একটি হতাশাজনক অবস্থা। বিদেশী সামরিক বাহিনী কিংবা পুঁজির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের অবস্থাদৃষ্টে আমরা মোটেই খুশি হতে পারিনি”।
আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচের মূল্যায়নে উনিশ শতকে মুসলিম উম্মাহর সামগ্রিক অবস্থা দৃশ্যমান হয়েছে। বিশ শতকে এসেও সে অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি! বরং মুসলিম উম্মাহর ক্রমাবনতি ঘটছেই। এক্ষেত্রে আমাদের রেনেসাঁ, ফরাসি বিপ্লব, শিল্প বিপ্লবের ইতিহাসকে জানা ও পর্যালোচনা করা জরুরি।
নয়.
যারা শোষণ বিরোধী চিন্তা ও কাজ তুলে ধরেন এবং করেন, শোষকগোষ্ঠী সর্বদাই তাদের অস্তিত্ব ধ্বংস করার প্রচেষ্টা চালায়, তা যেকোনো দিক থেকেই হোক না কেন। কিন্তু বর্তমানে আমরা যে চিন্তা লালন করি বা যে ধরনের বই পড়ি অথবা যে পদ্ধতিতে জ্ঞানচর্চা করি, তা প্রতিষ্ঠিত বাতিল শক্তি অর্থাৎ প্রকৃত শোষক শ্রেণির মনে কোনো আতঙ্কই সৃষ্টি করে না, সমাধানের চিন্তা তো বহুদূর।
যেমন-কাজী নজরুল ইসলামকে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করার
অপরাধে রাজদ্রোহী আসামী হিসেবে কারাগারে বন্দী হতে হয়েছিলো। বিপরীতপক্ষে, ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের তোষণ করার কারণে রবীন্দ্রনাথ নির্ঝঞ্ঝাট জীবন অতিবাহিত করে গেছেন, বঙ্কিম তো সরাসরি ব্রিটিশ রাজ কর্মচারীই ছিলেন। ফররুখ আহমেদের মতো একজন কবির উপর ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হলো, কিন্তু একই সময়ে অন্য অনেক কবি- সাহিত্যিককে পুরস্কৃত করা হলো। এভাবে যুগে যুগে যারা শোষণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং একটি সুনির্দিষ্ট আদর্শের উপর ভিত্তি করে কথা বলেছেন, তাদেরকেই নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ কমিউনিস্ট বিপ্লবের কথা বলা যায়। এ বিপ্লবের সূচনাই হয়েছিলো শোষণ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্লোগান দিয়ে। কিন্তু ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর কমিউনিস্ট শাসকরাই সবচেয়ে বড় শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। বিরোধিতাকারী সাধারণ জনতার উপর তো বটেই, এমনকি যারা কমিউনিস্ট আন্দোলনের পক্ষাবলম্বনকারী ছিলো, তারাও যখন এক পর্যায়ে বিরোধিতা করে, তাদেরকেও হত্যা করা হয়। যেমন-ম্যাক্সিম গোর্কী। তার ‘মা’ উপন্যাস কমিউনিস্ট আন্দোলনের গণসমর্থন আদায়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী সাহিত্যে রূপ লাভ করেছিলো। কিন্তু গোর্কীকে পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় নির্দেশে হত্যা করা হয়। একইভাবে অন্যতম প্রভাবশালী কমিউনিস্ট তাত্ত্বিক লিও ট্রটস্কিকেও হত্যা করা হয়। গোর্কী এবং ট্রটস্কিকে হত্যার কারণ-তারা দু’জনেই শেষ দিকে স্তালিনের শোষণের বিরোধিতা করেছিলেন।
এভাবে ব্যক্তি পর্যায় থেকে বড় বড় আন্দোলন সবক্ষেত্রেই একই কথা প্রযোজ্য। শোষণ বিরোধী চিন্তা বা কাজ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়।
দশ.
A Confession of an Economic Hitman-গ্রন্থের লেখক জন পার্কিন্সের ভাষ্যানুযায়ী, এ শোষণব্যবস্থা এবং পদ্ধতিকে খুব ভালোভাবে বুঝতে হলে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার প্রতিটি পর্যায় নিয়ে সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করতে হবে এবং প্রশ্ন করতে হবে।
এরই ধারাবাহিকতায় যদি আমরা দেখি,
• আজকের বিশ্বব্যবস্থা কারা নিয়ন্ত্রণ করছে?
বর্তমানে জায়নবাদীরা সমগ্র অর্থব্যবস্থাকে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে, সেভাবে মিডিয়া, খেলাধুলা, থিয়েটার, কৃষি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, অস্ত্র, খনিজ সম্পদ, বাণিজ্যপথও নিয়ন্ত্রণ করছে।
• যে চিন্তা দ্বারা আজকের বিশ্বব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে, সে চিন্তা কারা গঠন করেছে?
• বিশ্বব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে তাদের গৃহীত পদ্ধতি ও মূলনীতিগুলো কী?
• আজকের দুনিয়ার দার্শনিক ভিত্তি কী?
• মুসলমানদের দ্বারা আবাদকৃত দুনিয়ায় বর্তমানের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে আমাদের অবস্থান কোথায়?
এ প্রশ্নগুলোর যৌক্তিক জবাব পাওয়ার মাধ্যমে বিশ্বব্যবস্থার স্বরূপ উপলব্ধির ক্ষেত্রে নিজেদের স্বচ্ছতায় আবৃত করার কোনো বিকল্প নেই।
আলোচ্য প্রশ্নগুলোর জবাব পাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের এ বিষয়টি খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে যে, আজকের বিশ্বব্যবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ‘এ দুনিয়ার জ্ঞান ও চিন্তা ব্রিটিশ একাডেমিয়া এবং অক্সফোর্ড ধারার আলোকে পরিচালিত’। ব্রিটিশ একাডেমিয়া এবং অক্সফোর্ড ধারা মূলত শোষণ ও সাম্রাজ্যবাদকে একটি চিন্তাগত ও দার্শনিক ভিত্তি দেয় এবং শোষণকে তাত্ত্বিকভাবে বৈধতা দেয়।
প্রখ্যাত গ্রিক দার্শনিক প্লেটো বলেছিলেন, “যারা গল্প বলে, তারাই সমাজ শাসন করে”। প্লেটো ছিলেন গ্রিক দর্শনের অন্যতম স্তম্ভ খ্যাত এরিস্টটলের শিক্ষক। সুবিখ্যাত এ কথাটি তিনি উল্লেখ করেছিলেন গ্রিক ঐতিহ্যের আলোকে। তৎকালে গ্রিসে তারাই সবচেয়ে বেশি প্রভাব রাখতো, যারা সমাজ, ইতিহাস, অর্থ ও রাষ্ট্রের বয়ান কিংবা গল্প বলতো। নিজস্ব চিন্তার আলোকে গল্প তৈরি করতো। একই বিষয় আমরা রাসূল (স.)-এর মক্কী জীবনেও দেখতে পাই। রাসূল (স.)-এর দাওয়াতকে বাধাগ্রস্থ করতে কোরাইশ নেতারা পারস্য থেকে গল্পকারদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মক্কায় সমৃদ্ধ ফারসি সাহিত্যের শিক্ষাসমৃদ্ধ ভিশনারী গল্পের আসর বসাতো। যাতে যুবকরা রাসূলের দাওয়াত থেকে বিমুখ হয়ে এ সকল আসরে হাজির হয়।
আলোচনার সূত্র ধরে পর্যালোচনা করতে গেলে আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো-বর্তমান দুনিয়ায় কারা সবচেয়ে বেশি গল্প লিখে বা বলে? আমরা কার কাছ থেকে ইতিহাস পড়ি?
যেমন আমরা সবচেয়ে বেশি ইতিহাস পড়ি জর্জ লুইসের লেখনীতে। পিকে হিট্টি, জোসেফ হেল, উইলিয়াম ম্যুর, নিয়াল ফার্গুসেন, ম্যাকনেইল, থমাস নোবল, কার্ল হাগ, ফ্রেডরিক লুইস-সহ অসংখ্য ইতিহাসবিদ ও ওরিয়েন্টালিস্টদের জবানিতেও আমরা ইতিহাস পড়ি। তাদের লেখনীতে ইতিহাসের বয়ান ও দর্শনই পাল্টে যায়। অর্থনীতিতে জন স্টুয়ার্ট মিল, ফ্রেডরিখ লিস্ট, হেনরি জর্জ; ফিজিক্সে উইলিয়াম হ্যামিল্টন, জোসেফ ফোরিয়ার; কেমিস্ট্রিতে হ্যান্স ফিশার, চ্যাইম ওয়াজম্যান, হারমান স্ট্যডিঙ্গারদের মাধ্যমে জ্ঞানের প্রতিটি শাখায়ই স্বতন্ত্র বয়ান, চিন্তা ও মেথডোলজি তৈরি হয়। সমাজবিজ্ঞানে অগাস্ট কোঁত, দুর্খায়েম, দ্যু বয়েস, স্পেন্সারদের মাধ্যমে পর্যালোচনার ধারা ও জ্ঞানের পন্থাই পরিবর্তিত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে পশ্চিমারা ইসলামী সভ্যতার ফিকহের জায়গায় তাদের তৈরিকৃত সমাজবিজ্ঞানকে নিয়ে আসে। এভাবে ইসলামী সভ্যতার সকল জ্ঞানশাস্ত্রের বিপরীতে স্বতন্ত্র ধারা, মেথডোলজি, বয়ান ও পন্থা তৈরি হয়। এখন প্রশ্ন হলো জ্ঞানের প্রতিটি শাখায় পশ্চিমা মেথডোলজি অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণ করে, গবেষণ্য করে কীভাবে বিকল্প জ্ঞানের ধারা বিনির্মাণ সম্ভব? কীভাবেই-বা চিন্তার ক্ষেত্রে নতুন মেথডোলজি ও বড় মাপের চিন্তাবিদ উঠিয়ে আনা সম্ভব?
এক্ষেত্রে বিখ্যাত পণ্ডিত ওয়ায়েল হাল্লাকের এ কথাও প্রাসঙ্গিক যে, মুসলমানরা তাদের গল্প লিখতে পারেনি, ঘটনা তথা ইতিহাস মুসলমানদের হলেও তাদের গল্প এবং ইতিহাসের মেথড, আবেগ ও কৌশলপন্থা পাশ্চাত্যের লেখকদের হাতে।
শেষ কথা
বুদ্ধিবৃত্তিক বা চিন্তাঙ্গনে একটা পরিভাষা – থিংক গ্লোবালি, অ্যাক্ট লোকালি বেশ সুপরিচিত। অর্থাৎ, সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বজনীন প্রেক্ষিতে চিন্তা করে নিজস্ব অঞ্চল বিনির্মান করা বা নিজের অঞ্চল নিয়ে কাজ করা। আর এই পরিভাষাটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয় পাশ্চাত্যকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করে, পাশ্চাত্যের দর্শনকে বুঝে তার বিপরীতে ইসলামের সামগ্রিকতা কীভাবে সকলের নিকট উপস্থাপন করা যায়, সেক্ষেত্রে একজন ভালো দক্ষ ডাক্তার হওয়ার জন্য এনাটমি বা মানব শরীরের গঠন সম্পর্কে জানাটা যেমন জরুরি, ঠিক তেমনি বিশ্বায়নের এই যুগে ইসলামের বিশ্বজনীনতাকে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করার জন্য বর্তমান দুনিয়ার এনাটমি জানাটা তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। আর এর পাশাপাশি আমাদেরকে এটাও জানতে হবে যে, বর্তমান দুনিয়ায় রাজনীতি, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, সমরনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, মিডিয়া বা হলিউডি সংস্কৃতির মাধ্যমে কীভাবে আমাদেরকে আমাদের অজান্তেই নিষ্ঠুরভাবে শোষণ করা হচ্ছে।
এখন তাহলে প্রশ্ন আসে, প্রতিটি সেক্টরেই পাশ্চাত্যের এমন জুলুমপূর্ণ শোষণের উৎপত্তি ও মূলনীতি কোত্থেকে এলো? অথবা প্রশ্ন করা যেতে পারে, তারা কীসের উপর ভিত্তি করে এমন শোষণ করার আত্মবিশ্বাস পায়? এছাড়াও পশ্চিমাদের দার্শনিক ভিত্তিই বা কী এবং তাদের এমন পর্যায়ে এসে উপনীত হবার প্রক্রিয়া, ঘটনাক্রম বা ঘটনা-ধারাবাহিকতা কী?
এর পাশাপাশি আরো কয়েকটা প্রশ্ন আসবে। যেমন,
আপনি আমি এই পৃথিবীতে কতটুকু স্বাধীন বা নিরাপদ, এর যথার্থ উত্তর দেওয়ার মতো সক্ষমতা কি আমাদের রয়েছে? আমরা কি আমাদের আকল, বিবেক বা বুদ্ধি খাটিয়ে নিজস্ব চিন্তা করতে পারি, নাকি অন্যের চিন্তা ধার করেই চিন্তা করি? এছাড়াও, আমরা কি সত্যই রাজনৈতিকভাবে দলমত নির্বিশেষে জাতি বা দেশের জন্য কথা বলার সামর্থ রাখি? সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কি আমরা নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রাখতে পেরেছি? আবার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, আমরা কি শোষণমূলক বৈশ্বিক অর্থনীতির অদৃশ্য এক বেড়াজালে বন্দি নয়?
আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে,
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেহেতু আমাদেরকে বাংলা অঞ্চলে পাঠিয়েছেন, এবং বাংলাতেই যেহেতু আমাদের জন্ম। অতএব, স্রষ্টার একজন খলিফা হিসেবে বিশ্বকে বুঝে বাংলা অঞ্চল নিয়ে কাজ করাটাই তো আমাদের দায়িত্ব।
আবার, আমাদের এই বাংলা অঞ্চলের রয়েছে সুমহান ও শ্রেষ্ঠত্বের সোনালী এক ইতিহাস।
আমরা সেই বাংলা অঞ্চলের সন্তান, যে বাংলা অঞ্চল একটা সময় পুরো বিশ্বের ২৫-২৮% জিডিপি নিয়ন্ত্রণ করতো, সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় আজকের এই ইউরোপীয়দেরকেই স্কলারশিপ দিতো, আবার আমরা মুসলিমরাই তো বাঙ্গালী জাতিসত্তা তৈরি করেছি।
এছাড়াও, আমাদের আছে মুসলিম সভ্যতার জ্ঞানের মারকায দারসবাড়ি, রয়েছে সুলতান গিয়াস উদ্দীন আজম শাহের সেই সোনারগাঁ, আবার এই সোনারগাঁতেই অবস্থিত ছিলো শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার প্রতিষ্ঠিত আমাদের এই সমগ্র উপমহাদেশের সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়।
ভাষার দিক থেকেও বাংলা ভাষা অনন্য উচ্চতায় সুবিশাল এক শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখে। কেননা, বাংলা ভাষা ইংরেজির চেয়েও প্রাচীন ও শক্তিশালী ভাষা। আবার বাংলা ভাষা মুসলিম বিশ্বের ২য় সর্ববৃহৎ ভাষা।
অথচ, এতোসব শ্রেষ্ঠত্ব থাকার পরেও বাংলা অঞ্চল কেনো যেনো আজ অবহেলিত, নিষ্পেষিত। বাংলার মুসলমানরাও আজ নিগৃহীত ও অত্যাচারিত। মুসলিম হয়েও আমরা আজ আত্মপরিচয় সংকটে ভুগতে শুরু করেছি। আমাদের বাংলা অঞ্চলের কোনো ভিশন, ডেক্লারেশন বা ইশতেহার নেই। অথচ এসব বিষয় ব্যতিত কোনো অঞ্চলের ভবিষ্যত নির্ধারণ কখনই করা সম্ভব না। অতএব, বাংলা অঞ্চলকে নিয়ে কাজ করতে হলে সর্বপ্রথম আমাদের প্রয়োজন, এই বাংলা অঞ্চলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সুগঠিত একটি ভিশন, ডেক্লারেশন বা ইশতেহার।
তথ্যসূত্র :
আন্তর্জাতিক শোষণ ও মুক্তির পন্থা – হাসান আল ফিরদাউস