শিউলিমালা একাডেমি

‘সমকালীন সংকট, বিশ্বব্যবস্থা ও বাংলাদেশ; আমাদের মুক্তির ভাবনা’

 দক্ষিণ এশিয়ার পলল ভূমি খ্যাত- ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ক্ষুদ্র একটি দেশ, সুজলা, সুফলা, শস্য, শ্যামলা দেশটির নাম- বাংলাদেশ। ছোট্ট অথচ প্রাকৃতিক প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ এ ভূখণ্ডে জনসংখ্যা প্রায় বিশ কোটি! বিগত কয়েক দশক ধরে অঘোষিতভাবে এদেশের অপর নাম যেনো হয়ে গিয়েছে সংকট! সংকট নিয়ে চিন্তা করতে গেলে মানুষের মাথায় যে সকল সাধারণ প্রশ্ন ঘুরপাক খায় সেগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলাপ করা হলে প্রথম যে প্রশ্ন আমাদের সামনে হাজির হয় তা হলো-

সংকট কী? আমরা কি সংকট অনুধাবনে সক্ষম?

একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা যখন আমাদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টিপাত করি, তখন ভুরি ভুরি সংকট দেখতে পাই যার কোনো সমাধানের পদক্ষেপও লক্ষ্য করি না। আজ সমগ্র বিশ্ব যেখানে একত্রে একই সময়ে করোনার মতো বিধ্বংসী মহামারীর ‘মোকাবেলা’ করছে, ঠিক সে সময়ে প্রকাশ পাচ্ছে তামাম দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময় অঞ্চলটির ‘চরম মানবিক ও ব্যবস্থাগত অসহায়ত্ব’।

সংক্ষেপে আমরা যদি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমানের সংকটকালীন ইস্যুগুলোকে সামনে নিয়ে আসি তবে দেখা যায়, আমাদের ঘিরে ধরেছে নানাবিধ মৌলিক সংকট, অর্থাৎ একেবারে জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়গুলোয় যেগুলো ছাড়া মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারা অচল হয়ে যায়, সে সকল সেক্টরেও আমাদের কোনো নিশ্চয়তা প্রদানকারী ব্যবস্থার অস্তিত্ব নেই। যেমন-

মানুষের জীবনের নিরাপত্তা, খাদ্য, শিক্ষা, চাকরি, চিকিৎসা ইত্যাদি।

• BBS-এর মতে, করোনাকালীন সময়েই কর্মক্ষম মানুষ বেকার হয়েছে ৪ কোটি ৮২ লক্ষ! সরকারপন্থী গবেষক দলের মতেও, প্রথম দিকেই ৩ কোটি ৬৬ লক্ষ নতুন বেকার হয়েছে। আর CPD-এর মতে, ৫ কোটি। কিন্তু আসল হিসাব হলো এখন ৮ কোটি বেকার!

• খাদ্য সংকটে নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে ৬ কোটি ৯৯ লক্ষ মানুষ।

• বিআইডিএসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জনসংখ্যার ৫১ দশমিক ৩ শতাংশ স্থায়ী কর্মসংস্থানহীন। বিশ্বব্যাংক গত অর্থবছরে ২% এবং চলতি অর্থবছরে মাত্র ১ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করেছে। কোটিপতি ধনী বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ সমগ্র পৃথিবীর শীর্ষে অবস্থান করছে অথচ সানেম গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, মহামারিতে দারিদ্র্য দ্বিগুণ হয়ে ৪২ শতাংশে পৌঁছেছে।

• দরিদ্র ও অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যাও ৪ কোটি ৭৫ লক্ষ থেকে বেড়ে দ্বিগুণ, অর্থাৎ সাড়ে আট কোটিতে পৌঁছাচ্ছে, যাদের দৈনিক আয় ১৫৭ টাকারও কম।

মানুষের আয় কমছে, ব্যক্তি-সঞ্চয় ফুরিয়ে যাচ্ছে, চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে। সামষ্টিক বা পারিবারিক সঞ্চয় কমছে বলে ব্যক্তিগত ধার/ঋণের সুযোগ কমছে। বেকারত্বজনিত কর্মহীনতায় পড়ে শিক্ষা খাতে ঝরে পড়ার সংখ্যা বাড়ছে, কৃষি ও ভাসমান কাজে শিশুশ্রম বাড়ছে। একই সাথে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার সংখ্যাবৃদ্ধি এবং পাশের হারও কমে আসার আশঙ্কা রয়েছে।

রেমিটেন্স আমাদের আয়ের অন্যতম খাত, অথচ প্রবাস থেকে শ্রমিকরা ফিরে আসছে প্রতিনিয়ত! এখন পর্যন্ত খালি হাতে দেশে ফিরেছেন প্রায় ২০ লক্ষ শ্রমিক! এবং খুব শীঘ্রই আরও কয়েক লক্ষ শ্রমিকের ফিরে আসার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

অথচ আমাদের রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ভিত্তি ও আয়ের অন্যতম উৎস বিদেশে থাকা রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের পাঠানো আয়। কোটি কোটি যোদ্ধাদের দুর্দশা বুঝার ক্ষেত্রে একটি উদাহরণই যথেষ্ট, তা হলো- গত এক বছরে প্রায় ২০ লক্ষ শ্রমিক বিদেশ থেকে ফিরে এসেছে খালি হাতে!

• বাংলার গ্রামগুলোতে ব্যাপকভাবে করছিলো, যেখানে ছোট ছোট উদ্যোক্ত কষিভূমিকা রাখছিলেন, কিন্তু গত ক্ষুদ্র শিল্প বিস্তার লাভ কয়েক দশকে কৃষিতে নেমে এসেছে ভয়াবহ বিপর্যয়! যতটুকু বর্তমান আছে তাও কায়িক শ্রম নির্ভর, আবার তাতেও নেই ন্যায্যতা। সবমিলিয়ে গাণিতিক হারে বেড়েছে নারী বেকারত্ব, নারী অসহায়ত্ব। আর ঘুণেধরা রাষ্ট্র এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে লক্ষ লক্ষ নারীকে পাচার করেছে। বর্তমান সরকার ব্যাপকহারে তাদের বিদেশেও পাঠানোর ব্যবস্থা করছেন। বিগত এক বছরের ব্যবধানেই, তৈরি পোশাক শিল্পে প্রায় ৯০ হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। এদিকে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকগণ নির্যাতন, বেকারত্বের সমস্যা জিইয়ে রেখে, কেবল নারী পাচারের ক্ষেত্র পরিচর্যা করছেন। শুধু মধ্যপ্রাচ্য থেকেই দিনে গড়ে ১১টি কফিন আসছে। এক বছরে এসেছে ৪ হাজার ৮৮১টি। এর মধ্যে নারীদের সংখ্যাও কম নয়। সাড়ে তিন বছরে শুধু সৌদি আরব থেকে নারী শ্রমিকের লাশ এসেছে প্রায় সাড়ে তিনশত। তাদের মধ্যে ৫৩ জনই আত্মহত্যা করেছেন বলে জানিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। আত্মহত্যার এই হার তিন বছরের ব্যবধানে ১৭ গুণ বেড়েছে। তার মানে এই সময়ে তাদের ওপর নির্যাতনও বেড়েছে ১৭ গুণ!

• অর্থনীতির অন্যতম আরেক ভিত্তি হলো- আমাদের সমুদ্র বন্দর। যে বন্দর নানাবিধ অবকাঠামোজনিত সমস্যা, দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় অবহেলা ও সামগ্রিক সংকটের মধ্য দিয়ে অপচয় ও অপব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে, প্রতিনিয়ত কোটি কোটি টাকার লোকসান হচ্ছে! কিন্তু এ সকল সঙ্কট কাটিয়ে উঠার বদলে পুরো বন্দরকেই দিয়ে দেওয়া হলো ভারতের হাতে! চিন্তা করা যায়? একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের বন্দর নিয়ন্ত্রণ করবে ভিন্ন একটি দেশ!

• ৫০ এর উপরে খনিজ সম্পদ, যার সবগুলো বিদেশিদের হাতে ইজারা দেওয়া। ইউরেনিয়ামের মত দামী সম্পদ, যার জন্য এত যুদ্ধ, তা কিনা আমরা সাম্রাজ্যবাদীদের বিনা পয়সায় দিয়ে দিচ্ছি! এসব আলাপ বাদ দিলেও, গ্যাস যে আমাদের কত মূল্যবান সম্পদ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্যাস ক্ষেত্র আমাদের, সেটাও সাম্রাজ্যবাদীদের অনকূলে! সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হলো, আমাদের সরকার বিদেশ থেকে আন্তর্জাতিক মূল্যের তিনগুণ দামে গ্যাস আমদানি করছেন!

• এদিকে কৃষির ক্ষেত্রে বণিক বার্তায় প্রকাশিত সবচেয়ে ভয়াবহ যে রিপোর্ট আমরা দেখেছি তা হলো ধান ব্যতীত সকল প্রকার কৃষিদ্রব্য বাইরে থেকে আমদানি করতে হচ্ছে আমাদের! সারা দেশব্যাপী যে বেকারত্বের ভয়াবহ কালো ছায়া বিরাজমান। তাহলে কোথায় যাচ্ছে এই বেকার, চাকুরিহীন মানুষগুলো? তাদের সন্তান, পরিবার সব কিছুই তো গ্রাম কেন্দ্রিক, তাই তারা মাতাবিকভাবেই গ্রামমুখী হচ্ছে। কিন্তু গ্রামের যে সার্বিক অবস্থা তা দ্বারা তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাও সম্ভবপর নয়। এমনকি সরকার থেকেও তারা কোনো সহযোগিতা বা ভর্তুকি পাচ্ছে না। অথচ সরকার থেকে কৃষি খাতে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে বাৎসরিক ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা! এই বড় অঙ্কের অর্থ আসলে কোথায় যাচ্ছে? যেখানে ৭০% মানুষই ভূমিহীন চাষী! তারা তো সরকারের তালিকার বাইরে, সরকার থেকে কোনো ঋণ পাচ্ছে না। আবার প্রত্যেকবারই ঘাটতি দেওয়া হচ্ছে। এই ঘাটতির টাকাগুলো কোথায় যাচ্ছে যেখানে ধান ছাড়া সব ফসলই আমাদেরকে বাইরে থেকে আমদানি করতে হচ্ছে? এটা সহজেই অনুমেয় এ জায়গাতেও বড় ধরণের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, অযোগ্য নেতৃত্ব কাজ করছে।

LLRD এর মতে, বর্তমানে ৫০% পুরুষ এবং ৬০% নারী কৃষক পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। বিভিন্ন ক্ষুদ্র ঋণ, অন্যান্য চাহিদার কারণে তারা নিজেদের উৎপাদিত ফসল, শাক-সবজি, নিজেদের চাষ করা মাছ নিজেরাই গ্রহণ করতে পারছে না। তারা স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে না, বঞ্চিত হচ্ছে তাদের সন্তানরাও। এমনকি অনেক বছর আগেও তাদের অবস্থা এরকমই ছিলো। আর তারা যতটুকুও গ্রহণ করার সুযোগ পাচ্ছে, তাও কীটনাশক, সার আর ভেজাল মিশ্রিত। তাহলে চিন্তা করে দেখুন, এই চাষী, হাওড়-নদীর জেলে, প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষক, নারী কৃষক, কুটির-শিল্পীদের নিয়ে, তাদের উৎপাদন বৃদ্ধি নিয়ে কারো কোনো ভাবনা আছে?

• করোনাকালীন সময়ে শহরাঞ্চলের ২ কোটি পুরুষ কর্মসংস্থানহীন হয়ে পড়েছে তারা সবাই গ্রামে ফিরে যাচ্ছে। ফলে পরিবারের অর্থনৈতিক দায়িত্বটা অনেকাংশে তাদের স্ত্রী অর্থাৎ নারীদের উপর চলে যাচ্ছে। গ্রামের নারীরা হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন করে কিছু টাকা আয় করে। এই আয়ের পরিমাণ-ই বা কতটুকু? তারা আদৌ ন্যায্যমূল্যটা পাচ্ছে? তাদের স্বাস্থ্যের কী অবস্থা, চিকিৎসার কী অবস্থা? আর যতটুকুই বা পাচ্ছে তা দিয়ে কি সংসার, একটি পরিবার চালানো সম্ভব?

• দেশে প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে রোগীর সংখ্যা, কিন্তু চিকিৎসা ব্যবস্থার কী হাল? গুরুত্বহীন, অপরিচ্ছন্ন ও ভয়াবহ নোংরা পরিবেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার কী বেহাল দশা, সে কথা নাহয় আপাতত বাদই রাখা হলো! প্রতিদিন যে হারে মানুষ মারা যাচ্ছে, যার উত্তরণে যেখানে কোনো কর্মসূচিই নেই!

যদিও উপরোল্লিখিত তথ্যাবলী প্রকৃত অবস্থার তুলনায় নিতান্ত নগণ্য তবুও ন্যূনতম চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রই এসকল আশঙ্কাজনক সমীক্ষার পর্যবেক্ষণ করে তটস্থ হবেন। অথচ আমরা যদি একটু দৃষ্টি প্রসারিত করে আমাদের জাতীয় অবস্থান ও সাধারণ জনগণের দিকে নিবদ্ধ করি তবে যা দেখি, তা নিতান্তই হতাশাজনক। আমাদের যেনো এসকল ভয়ানক সংকট নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই নেই। যে বিষয়টি আমাদেরকে এসকল গভীর সমস্যা ও তার সমাধান নিয়ে ভাবতে বাধাগ্রস্ত করে তা হচ্ছে- ধারাবাহিকভাবে জনসম্মুখে প্রকাশিত বিভিন্ন ভুঁইফোঁড় ইস্যু!

• স্বাস্থ্যসেবার বেহাল দশা নিয়ে আমাদের কখনো ইস্যু তৈরি হয়নি; হয়েছে কোন হুজুর দুই বিয়ে করেছেন, সেটা নিয়ে।

• কারখানায় লাগা আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া শ্রমিকদের নিয়ে আমাদের কোনো ইস্যু হয়নি; হয়েছে কোন নায়িকার ঘরে মদের বোতল পাওয়া গেছে সেটা নিয়ে।

• শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর বন্ধ রয়েছে, ছাত্রদের ভবিষ্যৎ রসাতলে যাচ্ছে, আগামীর জীবন অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে আমাদের কখনো ইস্যু তৈরি হয়নি; হয়েছে কোন ক্রিকেটার বিয়ে করছেন না সেটা নিয়ে।

সার্বিকভাবে বলতে গেলে এগুলো হচ্ছে দৃশ্যমান সংকট, যেগুলো আমরা দৃষ্টি মেলে চাইলেই দেখতে পারি। যাকে বলা যায় প্রাথমিক স্তরের সংকট। কিন্তু আফসোস! ইস্যু পাগল জনতা দৃষ্টি মেলেও চাইবে না! কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে জাতীয় ও আঞ্চলিক পরিসরে ঘটমান বিভিন্ন ঘটনা- প্রতি ঘটনাই (গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় ধামাচাপা বা মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য জন্য সৃষ্ট ইস্যু) কি সব? এর পিছনে কি অন্য কোনো বিষয় ফাংশন করছে না?

এবারে আমাদের আলাপের দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো-

কেন এমন সংকট? এগুলো কি সহজাত সমস্যা, নাকি পূর্ব পরিকল্পিত?

‘ইস্যুই আমাদের রাজনৈতিক হতে দেয় না’ চিরসত্য এ কথাটির মুদ্রার অপরপিঠ উল্টিয়ে যে লাইনটি আমরা পেতে পারি তা হলো- ‘রাজনীতিবিদরাই আমাদের ইস্যু দিয়ে মাতিয়ে রাখে’।

এখানে দুই ধরনের রাজনীতি আছে-

১. আন্তর্জাতিক রাজনীতি; যা নিয়ন্ত্রণ করে বিশ্বব্যবস্থা।

২. দেশীয় রাজনীতি: যা ব্যবস্থার আলোকে নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের জীবন প্রবাহকে অর্থাৎ, রাষ্ট্রব্যবস্থা।

১. বিশ্বব্যবস্থা:

অল্প কথায় বলতে গেলে- বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা চালায় পাশ্চাত্য যায়নবাদী সভ্যতা। যারা মানুষকে মনে করে ‘পণ্য’, তাই তাদের মুখের বুলিতে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সাম্য, মৈত্রী যতকিছুই থাকুক না কেন, মানুষকে নিয়ে তারা ব্যবসা করতেই পারঙ্গম। আর এভাবেই তাদের বিশ্বদর্শন দাঁড়িয়েছে চার্লস ডারউইনের “Survival of the fittest.” মূলনীতির উপরে। যার মানে হলো, যার ক্ষমতা বেশি, শক্তি বেশি, সে-ই দুনিয়াতে টিকে থাকার যোগ্য।

এভাবে করে তারা একটি সমঝোতা বা সহযোগিতামূলক নয়, বরং প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলক একটি বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে। যেখানে প্রকৃতপক্ষে সবাই সবার প্রতিপক্ষ। আপাতদৃষ্টিতে তাদের মাঝে মৈত্রী বিদ্যমান থাকলেও তারা একে অপরের শত্রু।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- আমেরিকা ও রাশিয়া এক দশক আগেও নিজেরা একে অন্যের শত্রু ছিলো। আজ তারা চীনের বিপক্ষে জোট বেঁধে একে অপরের মিত্র। চীন যদি এই দ্বন্দ্বে হেরে যায়, তখন আবার আমেরিকা আর রাশিয়া একে অপরের সাথে শত্রুতা বৃদ্ধি করে দেবে। এখন কথা হচ্ছে, এই বিশ্বব্যবস্থা যারা নিয়ন্ত্রণ করছে, মানুষ হয়ে মানুষের ‘খোদা’ সেজে বসেছে- তারা তাদের শাসন ব্যবস্থাকে আরও সুসংহত, আরও নিচ্ছিদ্র করতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ফর্মুলার প্রয়োগ ঘটিয়ে চলেছে।

এতদিন দুনিয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গন পরিচালিত হতো গণতন্ত্রের ধোঁয়া তুলে, তার আগে ছিলো সমাজতন্ত্রের সয়লাব। সমাজতন্ত্রের পতনের পরে বৈশ্বিক অর্থনীতির মূল মন্ত্র হলো- পুঁজিবাদ। এই পুঁজিবাদ যখন সমাজতন্ত্রের উপর বিজয় লাভ করল, বিশ্বব্যবস্থার একচেটিয়া কর্তৃত্ব চলে গেল পাশ্চাত্যের হাতে। তখন-

• অর্থনীতি চলতো- ডলারে; চালাত বিশ্বব্যাংক, IMF, ফেডারেল ব্যাংক অব আমেরিকা।

• রাজনীতি চলতো- গণতন্ত্রে; আমেরিকার মত রিপাব্লিকান- ডেমোক্র্যাট, আবার এদের মধ্যে লিবারেল, অর্থোডক্স,কনজার্ভেটিভ এমন বিভাজনের আলোকেই প্রতিটি দেশের রাজনৈতিক পরিসর সেজে উঠেছিলো।

• সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রিত হতো- হলিউডের ধারায়; এর আবার আঞ্চলিক শাখা হলো, যেমন উপমহাদেশে বলিউড।

• জ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য নিয়ন্ত্রিত হতো- পাশ্চাত্যের মানদণ্ডে। যেমন: আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি, শিক্ষাব্যবস্থার ধরণ অক্সফোর্ডের আদলে।

• অন্যান্য জনগোষ্ঠীকে তাদের প্রভাবাধীন রাখার মূলনীতি ছিলো- গ্লোবালাইজেশন; যার হেড কোয়ার্টার ছিলো জাতিসংঘ এবং তার অঙ্গ সংস্থাসমূহ ছিলো তারই পাইক পেয়াদা।

এভাবে করেই তারা সমগ্র দুনিয়াব্যাপী ক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যের একটি ‘Complete Mesh’ বা অন্তর্জাল প্রতিষ্ঠা করেছিলো। দুনিয়াতে দুটি ব্লকের উপস্থিতি সেই ১৯০০ সালের আগ থেকেই:

► ওয়েস্ট ব্লক।

► ইস্ট ব্লক।

ওয়েস্ট ব্লকে রয়েছে- আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপ ও তাদের অনুসারীরা। তাদের মূলমন্ত্র- পুঁজিবাদ। ইস্ট ব্লকে রয়েছে রাশিয়া-চীন ও তাদের দোসররা। মূলমন্ত্র সমাজতন্ত্র। এরা যদিও একই মায়ের দুটি সন্তানতুল্য। তথাপি পূর্বোল্লিখিত বিশ্বদর্শনের আলোকে এদের মাঝে আধিপত্যবাদ নিয়ে রেষারেষি চলমান থাকবেই। তারই ধারাবাহিকতায় ওয়েস্টের কাছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়ে যাওয়ার পর দুনিয়াকে প্রায় একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ওয়েস্ট ব্লক।

এখন আবার বিশ্বশক্তি কিংবা পরাশক্তি হিসেবে উত্থান হচ্ছে চীনের, যা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা বর্তমান রাশিয়ারই আরেকটা অংশস্বরূপ। তাদের উত্থানের গল্পটা বেশ চমৎকার- আজ থেকে চল্লিশ বছর আগেও চীন ছিলো অর্থনীতিতে অন্যান্য প্রতিবেশীদের তুলনায় বেশ পশ্চাৎপদ। কারণ ছিলো বহুদিনের যুদ্ধের ঘানি টেনে চলা। এক পর্যায়ে তারা বেশ কয়েক বছরের জন্য সকল ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দ্বার রুদ্ধ করে দিয়ে শুধু টেকনিক্যাল বিষয়াদির উপরে গুরুত্ব দিতে লাগল। যত ধরনের কারিগরি বিষয়ের সেক্টর ছিলো আস্তে আস্তে সমগ্র দেশ জুড়ে ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে সেগুলোকে বাস্তবায়ন করা শুরু করলো। মূলত সোভিয়েতদের পতন থেকেই শিক্ষা নিয়ে তারা আজ শুধুমাত্র চেতনায় সমাজতান্ত্রিক। কিন্তু কর্মে পুঁজিবাদী হিসেবে দুনিয়ার বুকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সবই আধিপত্যের খাতিরে। মানুষকে গোলাম বানানোর প্রয়াসে।

যাইহোক, শিক্ষা-দীক্ষা বন্ধ করে দিয়ে তারা যে এধরণের কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে বসল, এ নজির কিন্তু ইতিহাসে প্রথম নয়। হযরত মূসা (আ.)-এর ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, তিনি যে শাসকের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিলেন সে ফেরাউন নিজেকে খোদা দাবী করেছিলো- তার যুক্তি ছিলো, “আমি মানুষকে খাওয়াই। ইচ্ছে করলে আমি মৃত্যু দিতে পারি, ইচ্ছে করলে আমিই আবার মুক্তি দিতে পারি। সুতরাং, আমিই তোমাদের খোদা।”

আর জনগণও তাকে খোদা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলো। কারণ টানা কয়েক প্রজন্ম শিক্ষা-দীক্ষা, চিন্তা বিমুখ হওয়ার ফলে তাদের ‘আকল’ আর কর্মক্ষম ছিলো না। কারণ তারা যুগ যুগ ধরে প্রকৃতিকে পড়তে পারেনি, সৃষ্টিকে অবলোকন করে প্রকৃত স্রষ্টাকে খুঁজে দেখতে পারেনি। পক্ষান্তরে পেটের চাহিদা মেটানোর খাতিরে কায়িক পরিশ্রমের দিকে চলে গেছে, ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক!

এভাবেই আমরা মিসরীয় সভ্যতায় এতখানি উৎকর্ষ দেখতে পাই। যেখানে মানবিক কোনো উৎকর্ষ নেই, আছে সব জাগতিক! মানুষের প্রশান্তি ও অগ্রগতির কোনো নজির নেই, আছে শুধু শাসকের মহিমা কীর্তন। পিরামিডগুলো গড়ে উঠেছিলো হাজার হাজার মানুষের রক্ত আর হাড়ের ওপর দিয়ে। রাজারা মারা গেলে তাদের সাথে জ্যান্ত মানুষগুলোকেও পুঁতে ফেলা হতো। এজন্যই জ্ঞানসম্রাট আলীয়া ইজ্জেতবেগভিচ বলেছিলেন, “পাশ্চাত্যের চাকচিক্যপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার ভিত্তি হচ্ছে মানুষের উপর জুলুম।”

এমন একটি ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে হতভাগা মানুষগুলো ‘সত্য’ খুঁজে পাওয়ার মতো ফুরসত না পেয়ে নিজেদের মতোই অপর একটি মানুষ (মানুষের তৈরি সিস্টেম)-কে খোদা মানতে বাধ্য হয়েছিলো। আজকের প্রচলিত বিশ্বব্যবস্থা কিন্তু সেই ফেরাউনী ধারারই উত্তরসূরি। ঠিক তাদেরই দোসর। একমাত্র ইসলাম ভিন্ন যত মতবাদই আছে সবই মূলত ‘মানুষকে মানুষের দাস বানানোর পন্থা’ ছাড়া অন্য কিছু নয়।

যাইহোক। সেই ব্যবস্থারই আন্তর্জাতিক রূপ আজকে আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে নতুন কাঠামোয়। গোটা দুনিয়াকে নতুনভাবে ডিজাইন করছে মানুষের খোদা সেজে বসা এই বিশ্বশক্তিগুলো। তারই সরাসরি উপসর্গ আজকের বিশ্ব সংকট, করোনা ভাইরাস, অর্থনৈতিক মন্দা, যুদ্ধ, শরণার্থী সমস্যা, সমগ্র দুনিয়াকে স্থবির করে ফেলা ইত্যাদি।

২. রাষ্ট্রব্যবস্থা:

বিশ্বায়নের এই যুগে আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্র হচ্ছে সোজা কথায় বিশ্ব সাম্রাজ্যের আজ্ঞাবহ আঞ্চলিক কেন্দ্র। অর্থাৎ, বিশ্বদর্শনের যা রুলস, সেই আলোকেই রোল প্লে করে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠীর শাসক হিসেবে। অন্যভাবে বললে, মানতে বাধ্য হয়। কিছু সিস্টেম আছে, যার কারণে বিশ্বশক্তির এজেন্ডাসমূহ বাস্তবায়নে তারা সহায়তা করতে বাধ্য থাকে। যেমন -আমাদের দেশে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন কে? সরকার! আবার এই সরকার গঠন করে কারা? রাজনৈতিক দলগুলো। এদের কিন্তু অবশ্যই বৈদেশিক শক্তি বা প্রভাবশালী প্রতিবেশী কিংবা দুনিয়ার পরাশক্তির প্রত্যক্ষ মদদ লাভ করতে হয়। যদি তারা আধিপত্যবাদীদের এসকল শর্ত এবং স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হয় বা না করতে চায়, তখনই তাদের বিভিন্ন কায়দায় দাবিয়ে দেয়া হয়।

সেটা হতে পারে সরাসরি মিলিটারি অ্যাকশনের মাধ্যমে। যেমন: ইরাকে সাদ্দাম হুসেইন শুরুতে আমেরিকার আজ্ঞাবহ এবং তাদের মিত্র ছিলো, পরবর্তীতে তিনি স্বাধীনভাবে আঞ্চলিক পরাশক্তি হয়ে উঠতে চাইলে তা আমেরিকার স্বার্থবিরুদ্ধ হওয়ায় পাশ্চাত্য সোজা গণতন্ত্র রক্ষার নাম করে ইরাকে আগ্রাসন চালায় এবং তাদের এক কালের মিত্র সাদ্দাম হুসেইনকে ফাঁসিতে ঝুলায়।

সেটা হতে পারে সরাসরি হত্যা বা রাজনৈতিক ভাবে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি এবং অন্যান্য দেশীয় দালাল শ্রেণিকে সচল করার মাধ্যমে। যেমন- তুরস্কে প্রফেসর এরবাকানের বিরুদ্ধে করা মিলিটারি ক্যু। মিশরে ড. মুরসির বিরুদ্ধে সিসির অভ্যুত্থান। এখানে কিন্তু এটা পরিষ্কার যে, যতই স্বকীয়তা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বুলি ছুটিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলা হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে আমাদের শাসক শ্রেণির হাতে প্রকৃত ক্ষমতা খুবই সীমাবদ্ধ এবং তারা শুধুমাত্র সাম্রাজ্যবাদীদের জুলুমের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যদি কোনো পুতুল সরকারের প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যায়, তখন ময়দানে আধিপত্যবাদীরা তাদের বিকল্প দোসর এবং দালাল শ্রেণির উদ্ভব ঘটায়।

উক্ত আলোচনার ভিত্তিতে যদি আমরা সাম্প্রতিক বাংলাদেশের খণ্ডিত চিত্রসমূহ জোড়া দিতে থাকি, এবং আঞ্চলিক এবং বিশ্বরাজনীতির ক্যানভাসে যুক্ত করি তবে যা দেখি তা হলো-

★ বাংলাদেশে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং একমুখী স্বৈরশাসন বিদ্যমান। এখান থেকেই জাতীয় সংহতি বাধাগ্রস্ত, অর্থাৎ, এর মাধ্যমের সত্যিকার প্রগতির সকল সম্ভাবনার দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায়। সুতরাং, উন্নয়ন এবং যতসব অর্থনৈতিক বরাদ্দ দেখি তার সিংহভাগই যায় অবকাঠামোগত লুটপাটে।

* রাজনীতির যখন এ অবস্থা তখন প্রশাসন ভঙ্গুর ও অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় পরিপূর্ণ থাকবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আরও পরিষ্কারভাবে বললে মানুষের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত সকল ব্যবস্থাপনাই আজ দুর্দশাগ্রস্ত। এর মধ্যে কৃষি, বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামাজিক নিরাপত্তাসহ সকল কিছুই অন্তর্ভুক্ত। এভাবে করে তোষামোদপূর্ণ এবং খেয়ানতপূর্ণ একটি শাসনব্যবস্থা আজ আমাদের উপরে জেঁকে বসেছে। আরও আশংকার বিষয় হলো- এ ধরণের অসামঞ্জস্যতা আজ আমাদের কালচারে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ, এসকল ঘৃণ্য ভয়াবহ বিষয়কে আমরা সহজাত বিষয় হিসেবে দিব্যি চালিয়ে দিচ্ছি!

• শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কিছু কথা না বললেই নয়-

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থান আজ কোথায়? একদম প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করলে যা দেখতে পাই তা হলো,

* লক্ষ লক্ষ শিশু আছে, কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার হার এখন পর্যন্ত ৮০% অতিক্রম করতে পারেনি। যার দরুন বিশ্বায়নের এ যুগে আজও এ দেশকে নিরক্ষরতা মুক্ত ঘোষণা করা যায়নি।

* মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা এত পরিমাণ একাডেমিক চাপে থাকে যে, প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার বাইরে সারাদিন কোচিং করে তাদের ওই একই বিষয় নিয়ে পড়ে থাকতে হয়। ফলে ৯৫ শতাংশ কিশোর কিশোরীর মাঝে তোতা পাখির মত শেখানো মুখস্থ বিদ্যা ছাড়া প্রকৃত জ্ঞানের বা শিল্পের (Art) উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়না।

* দেশের উচ্চ মাধ্যমিকের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের মোটামুটি সকল অঙ্গনে আজ মাদক, সন্ত্রাস, বেহায়াপনার সয়লাব। যার সরাসরি ফলাফল হচ্ছে মানহীন শিক্ষা, অশিক্ষা, কুশিক্ষার মহামারী।

* ভুরি ভুরি ডিগ্রি আছে, চাকরি নেই। পর্যাপ্ত পদ খালি নেই, সব যায়গায় ঘুষ ছাড়া ‘নো এন্ট্রি’। যার ফলে টানা ২০-২৫ বছর পড়ালেখা করা একজন মাস্টার্স পাশ যুবকের জন্য হতাশা, নিরাশা ছাড়া ভিন্ন কিছুই দিতে পারছে না এ জাতি।

সবকিছুকে ছাপিয়ে যে বিষয়টি আমাদের চোখের আড়ালে থেকে যায়, তা হলো- আমাদের পাঠ্যক্রম। আমরা আপাতদৃষ্টিতে কীভাবে পাড়ায় তার অসঙ্গতি নিয়ে আলাপ তুলতে তুলতেই সময় পেরিয়ে যায়, অথচ আমরা কখনোই এটা নিয়ে মাথা ঘামাইনি যে, আমাদের কী পড়ানো হয়? সোজা কথায় এর উত্তর দিতে গেলে বলা যায়, বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে যুগোপযোগী কোনো জ্ঞান আমাদের শিক্ষা দেয়া হয় না। তবে কী করা হয়? মাত্র দুটি উদাহরণ যথেষ্ট-

১. আমাদের এমন জ্ঞান পড়ানো হয়, যা আমাদের মানবিক উৎকর্ষে কোনো ভূমিকা রাখতে সক্ষম নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমাদের যে সাহিত্য পড়ানো হয়, বিশেষত বাংলা সাহিত্য। তা পুরোপুরি হিন্দুত্ববাদীদের তৈরি এবং তা দ্বারা আমাদের ছাত্র সমাজের মুসলিম মানস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়া আর কিছু হয় না। এখান থেকে ক্রমান্বয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকারগ্রস্ততা চলে আসে। যার প্রভাব প্রতিফলিত হয় পরবর্তী জীবনজুড়ে।

২. আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রথম স্বপ্ন এবং সিংহভাগ বাবা মায়ের প্রথম স্বপ্ন থাকে, সন্তান ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে। কিন্তু আমরা কি কোনো দিন চিন্তা করে দেখেছি যে, এত এত স্বপ্নগুলো ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি এবং মেডিকেল কলেজ পাশ করে বের হচ্ছে, তারা কেন ঝানু ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে না? যারা হচ্ছে সেই সকল মানুষের তালিকা কেন বাইরের বিভিন্ন দেশে ‘মেধাপাচার’ এর তালিকায় উঠছে?

কেন আমাদের একটু উন্নত চিকিৎসা পাওয়ার আশায় বিদেশে পাড়ি জমাতে হয়? আমাদের কি শুধুই বস্তুগত সংকট? ডাক্তাররা কি ব্যাপকহারে অনভিজ্ঞ এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন নয়? কেন বাইরে থেকে ইঞ্জিনিয়ার এনে দেশীয় অবকাঠামোর ডিজাইন থেকে শুরু করে একদম বাস্তবায়ন হয়ে তা রক্ষণাবেক্ষণ পর্যন্ত তাদের ওপর নির্ভর করতে হয়। দেশে প্রতি বছর যে হাজার হাজার ইঞ্জিনিয়ার তৈরি হচ্ছে, তারা কোথায় যাচ্ছে?

এখানে সবটাই কি শিক্ষার্থীর দোষ! না, বরং আমাদের দেশে যে সকল জ্ঞান এখনো শিক্ষা দেয়া হয়, তা বহির্বিশ্ব বা আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রচলিত শিক্ষাক্রমের তুলনায় একেবারেই মান্ধাতার আমলের। উদাহরণস্বরূপ ধরা যায় বুয়েটে পড়া একজন ইঞ্জিনিয়ার যখন আমেরিকার মাটিতে একটি অত্যাধুনিক মেশিন এসেম্বল করতে যায়, তখন দেখে তার অর্জিত অভিজ্ঞতার সাথে সেই মেশিনারিজের খুঁটিনাটি মিলছে না। অর্থাৎ, তার অভিজ্ঞতা ব্যাকডেটেড কিন্তু কর্মক্ষেত্রের সব সিস্টেম আপডেটেড। তখনই সে তার ব্যাকডেট শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে একজন আপডেট ভারতীয়

কিংবা জাপানিজ ইঞ্জিনিয়ারের কাছে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় হেরে যায়। এভাবেই তৈরি হচ্ছে অনগ্রসরতার মহীসোপান।

মোট কথা প্রায় সর্বস্তরেই দেদারসে সময় নষ্ট করে পড়িয়ে পড়িয়ে একটি মেধাকে মূর্খ বানানো হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অপরিপক্ব এবং সময়ের আলোকে অনুপযোগী শিক্ষাদান করা কি মূর্খতা ছড়ানোর অপর নাম নয়? এই যদি হয় একটি জাতীয় শিক্ষাক্রমের অবস্থা, সেখান থেকে কীভাবে ভালো ফলাফল আশা করা যায়? কীভাবে জাতীয় অগ্রগতি ও মানবসূচকে প্রকৃত উন্নয়ন নিয়ে আসবে এমন একটি দক্ষ শ্রেণি আশা করা যায়? কীভাবে চলমান সকল সংকটকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে একটি সমাধানমূলক পন্থা বা ফর্মুলায় জাতিকে দিগদর্শন করবে এমন যোগ্য লোকবল আশা করা সম্ভব?

• শিক্ষা ব্যবস্থার এই ধরণের ভয়াবহ অবস্থার কারণে কী প্রভাব পড়ছে?

★ শিক্ষা কারিকুলাম বলতে যে জিনিস আছে, তা থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বিভিন্ন কো কারিকুলাম, বা প্র্যাক্টিক্যাল সেক্টরে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে।

* গ্রেডিং সিস্টেম এবং মেরিট যাচাইয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অসঙ্গতি এবং তার মাধ্যমে পাওয়া সার্টিফিকেট, অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কর্ম জীবনে যা কাজে আসছে না। তখন তার একটি কাগজ ছাড়া অন্য কোন মূল্য থাকে না।

* ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’, দুর্দশাগ্রস্ত এ শিক্ষাব্যবস্থার ফলাফল যে প্রজন্ম আজ আমাদের সামনে, তারা সকল দিক থেকে দুর্বল; ভঙ্গুর শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে আটক করে তাদেরকেও দুর্বল এবং নতজানু করে দেয়া হচ্ছে। ফলে দক্ষ লোকবল তো আসছেই না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তল্পীবাহী মানসিকতা নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বের হয়ে আসছে শিক্ষার্থীরা।

* সামগ্রিকভাবে মানুষ আত্মশক্তি প্রবুদ্ধ নয়, বরং গোলামীর মানসিকতা ও ‘কেরানি’ হবার যোগ্যতা নিয়ে বড় হচ্ছে। এজন্যই আজ দেশে নতুন কোনো উদ্ভাবন নেই, উদ্ভাবন হলেও তার কদর নেই। সার্বিক সংকট নিরসনে কেউ

কোনো বিকল্প প্রস্তাবনা পেশ করতে পারছেনা। শিক্ষাই মানবতার উৎকর্ষ সাধনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার, সেখানে সাড়ে ১৮ কোটি মুসলিমের দেশে কেন শিক্ষা ব্যবস্থা এতই নাজুক যে, একে সংস্কার বা শক্তিশালী করণের চিন্তাও কেউ করতে পারছে না! কেন?

আমার বক্ষ্যমাণ লেখায় ফেরাউনের মূলনীতির ব্যাপারে আলোচনা এনেছিলাম, সেখানে দেখানে হয়েছে কীভাবে মানুষকে ‘হাকীকত সন্ধানী শিক্ষা’ থেকে নিবৃত করে গোলামী চাপিয়ে দিয়ে ফেরাউন নিজেকে অন্যান্য মানুষের খোদা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলো। পরবর্তীতে, আঞ্চলিক ও বিশ্ব পরিমণ্ডলে পরাশক্তি হয়ে উঠতে থাকা চীনকে আলোচনা করা হয়েছিলো। এখন আমরা দেখব, আমাদের রাষ্ট্রীয় সিস্টেম কীভাবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এজেন্ডাগুলোর আলোকে পরিচালিত হচ্ছে।

চীনের বর্তমান ভূ-রাজনীতি ও বৈদেশিক নীতির দিকে যদি তাকাই, তবে দেখবো যে- তারা ৪ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে সারা বিশ্বব্যাপী ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্প চালু করেছে এবং এর রোড ম্যাপের মাঝে বাংলাদেশ এক মহা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দখল করেছে। ইতোমধ্যে, বাংলাদেশের সাথে চীনের দহরম-মহরম ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে।

এই ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে বাংলাদেশে ছয়টি ‘সিস্টার সিটি’ গড়ে তুলবে চীন, যার মধ্যে রাজধানী ঢাকার অর্ধেক, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনও অন্তর্ভুক্ত।

• সিস্টার সিটি কী?

কোনো দেশের শহরগুলোকে দূরের কোনো দেশের নির্দিষ্ট শহরগুলির আলোকে সাজিয়ে তোলা। অর্থাৎ, বাংলাদেশে অবস্থিত চীনের সিস্টার সিটিগুলো চলবে চীনের কায়দা কানুনে, তাদের ভ্যালু অনুসরণ করে। আবার সেই সকল শহরের উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশে ঋণ হিসেবে ২৪ বিলিয়ন ডলার খরচ করবে চীন। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে- সে সকল শহরে এদেশের মানুষের প্রবেশাধিকার কেমন হবে? স্বাধীনতা থাকবে নাকি গোলামের মত ঢুকে কাজ করে চোখ বুঝে পারিশ্রমিক নিয়ে নতমস্তকে বেরিয়ে আসবে? অবশ্যই তাদের বিনিয়োগ, তাদের নীতিমালা অর্থাৎ পুরোটাই তাদের শাসনে, এখানে এদেশের মানুষের প্রবেশাধিকার থাকবে একমাত্র একটি পরিচয়ে- তা হলো গোলাম! (আধুনিক দাস- ফেরাউনী ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য)

এ তো গেলো এক চীনের হিসাব। বাকি বাংলাদেশে ইতোমধ্যে ৫৫টি সরকারি এবং বেসরকারি ১১টি ইকোনোমিক জোন আছে। ২০২৮ সালের মধ্যে তা ২০০ তে উন্নীত হবে। এই ইকোনোমিক জোনের মূল উদ্দেশ্য কী?

বিদেশি বিনিয়োগ এনে এইসকল অর্থনৈতিক অঞ্চলে ওইসকল বিনিয়োগকারীদের চাহিদা মোতাবেক পণ্য উৎপাদন করা এবং সে সকল সেক্টরে প্রচুর পরিমাণে শ্রমিক নিযুক্ত করা। এটাকে যদিও অর্থনীতির চাকাসচল রাখার হাতিয়ার বলা হচ্ছে তবে কিছু বিষয় চিন্তা করলেই আমাদের সামনে মূল বিষয়টি উন্মোচিত হয়ে যায়।

আমাদের দেশকে বলা হয়- সস্তা শ্রমের দেশ। এতদিন আমাদের দেশের সস্তা শ্রমিক বিদেশে পাঠিয়ে প্রচুর রেমিটেন্স আয় করেছি আমরা, আজ সে পথও রুদ্ধ হয়ে আসছে ক্রমশ। আগে দেশের জনগণ বাইরে গিয়ে গোলামী করত, এখন দেশের মাটিতেই বিদেশীদের গোলামী করবে।

আমাদের দেশের পোশাক শিল্প খাতসহ যা কিছু টুকটাক রপ্তানি হতো- তার সবচেয়ে বড় বাজার ছিলো ইউরোপের মার্কেট এবং আমেরিকা। কারণ আমাদের দেশের সস্তা শ্রমে উৎপাদিত পণ্য সেইসব উন্নত দেশের বাজারে বিক্রি করে ব্যাপক মুনাফার সুযোগ রয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, সে সকল দেশই এখন বাংলাদেশের ইকোনমিক জোনগুলোতে বিনিয়োগ করতে আসছে। এখন পর্যন্ত যে সকল দেশ বিনিয়োগ করবে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে বা যাদের জন্য ইকোনমিক জোন বরাদ্দ হয়েছে-

১. ইউ এস এ।

২. চীন।

৩. সিঙ্গাপুর।

৪. সৌদি আরব।

৫. ডেনমার্ক।

৬. ভারত।

ক্রমান্বয়ে এখানে বিনিয়োগের পরিমাণ এবং বিনিয়োগকারী শক্তির উপস্থিতি বাড়বে বৈ কমবে না।

এখন আমরা যদি বিশ্বের সাতটি অঞ্চল থেকে সাতটি দেশ এবং তার সাথে

বাংলাদেশের ‘ঘণ্টা প্রতি শ্রমিক খরচ’ এর একটি তুলনা করি তবে দেখি যে,

উত্তর আমেরিকা থেকে ইউ এস এ-৭.২৫৮

দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আর্জেন্টিনা- ৩.০৪৮

ইউরোপ থেকে বেলজিয়াম- ১১.০৬৮

আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা- ১.৩৮৮

এশিয়া থেকে চীন- ০.৯৪৮

প্রতিবেশী ভারত- ০.২৮৮

বাংলাদেশ- ০.০৯৮

পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সকল অঞ্চলের তুলনায় আমাদের শ্রমিক মজুরী সবচেয়ে সস্তা। এবার যদি মুদ্রার ওপিঠ একটু উল্টিয়ে দেখি, তবে দেখা যায় যে-

* আমাদের দেশ সমগ্র দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি আবাদ যোগ্য ভূমি নিয়ে শীর্ষে অবস্থান করছে, শতকরার হিসেবে যা ৮৮ পার্সেন্ট। আয়তনের তুলনায় এতখানি আবাদযোগ্য ভূমি আর কোনো দেশেরই নেই। সেই আমরাই কিনা কৃষিতে পিছিয়ে রয়েছি, ধান ছাড়া আমাদের সকল কিছু আমদানি করতে হচ্ছে!

* সোনালী আঁশ পাট শিল্পকে ধ্বংস করে দিয়েছি, সারা দেশে আর একটি পাটকলও চালু নেই। যে দেশ আখের স্বর্গরাজ্য, সে দেশে চিনির কারখানা নেই বললেই চলে, সব বাইরে থেকে আমদানি করা লাগছে।

* চা শিল্পে ন্যায্য মূল্য না পেয়ে তা আজ চরম হুমকির সম্মুখীন, আবার যাও উৎপাদন হয়, তার মধ্য হতে নিকৃষ্টমানের চা পাতা দেশে রেখে উন্নতগুলো বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে।

* যে দেশ বস্ত্র বুননের জন্য হাজার বছর সমগ্র দুনিয়াব্যাপী খ্যাতি কুড়িয়েছিলো, আজ তারাই বাইরে থেকে তুলা আমদানি করে নিজেদের চাহিদা মেটাচ্ছে!

সার্বিকভাবে আই.এম.এফ.-এর ঋণ প্রদানের শর্ত হিসেবে ১০ শতাংশের অধিক জনবল কৃষি খাতে রাখা যাবে না মর্মে যে চুক্তি হয়েছে, তারই বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া হচ্ছে- দেশের মৌলিক সত্তা কৃষিকে ধ্বংস করে দিয়ে শিল্প কারখানামুখী করে দেয়া।

এর ফলে যা হবে, তা হলো মানুষের স্বকীয়তা হারিয়ে অসহায়ত্ব বাড়বে, পরনির্ভরশীলতা এবং বিদেশি প্রভুদের প্রতি মুখাপেক্ষিতা বাড়বে।

শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আমরা মোটামোটি বড়সড় আলোচনা করেছি, এখন আশাকরি-

কেন শিক্ষাব্যবস্থার এই বেহাল দশা? কেন এই শিক্ষাব্যবস্থা কেরানি-কামলা

তৈরি করে? কেন ইচ্ছাকৃত অব্যবস্থাপনা ও খামখেয়ালির কারণে লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত যুবককে বেকার রাখা হয়েছে?

এ সমস্ত প্রশ্ন সামনে চলে আসে। এসবের উদ্দেশ্যই বা কী?

এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সস্তা শ্রমিক তৈরি করা। যাতে এভাবে মানুষকে চাপের মধ্যে রেখে নামমাত্র মজুরিতে পানির দামে পণ্য উৎপাদন করে অত্যধিক মুনাফা হাসিল করা যায় এবং মানুষের খোদা সেজে বসা যায়। সার্বিকভাবে এটাই আধিপত্যবাদী ফেরাউনী সভ্যতার এজেন্ডা। এই কাজ শুধু তারা আমাদের দেশেই করছে এমন না! আফ্রিকা মহাদেশকে গত দুইশ বছরে একেবারে কয়লা বানিয়ে দিয়েছিলো ঠিক এই পন্থা অবলম্বন করেই। শোষণের এই ধারাবাহিকতা এখনো চলমান।

অতীতেও ব্রিটিশরা এভাবে জোর করে আমাদের দিয়ে নীলচাষ করিয়েছিলো। দেশের সহজাত কৃষিকে ধ্বংস করার স্বার্থে কৃষক শ্রেণির উপরে বর্ণনাতীত অত্যাচার চালিয়েছিলো। এদেশের তাতিদের ব্যবসায় আগুন দিয়ে, মসলিন শিল্পকে ধ্বংস করে তাদের দেশের ড্যান্ডির কাপড় ব্যবহারে অভ্যস্ত করে তুলেছিলো। এভাবে করেই বিশ্বব্যবস্থায় ‘মানুষকে মানুষের গোলাম বানানোর’ ফর্মুলা বাস্তবায়ন করে চলেছে এই পুতুল রাষ্ট্রব্যবস্থা। অথচ আজ ইতিহাস থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারছি না।

ছোট্ট একটি প্রশ্ন আমাদের ভাবনার দুয়ারকে আরও ভালভাবে নাড়া দিতে পারে। সেটি হলো-

বাংলাদেশের গৃহ অর্থনীতির একাল-সেকাল।

আগে দেখা যেত, গ্রাম বাংলার পরিবারগুলাতে অন্যান্য কাজ কর্মের পাশাপাশি নারীরা কুটির শিল্প ও বুনন শিল্পের সাথে জড়িত ছিলেন। সেখান থেকে বাংলাদেশ কীভাবে সস্তা শ্রমিকের দেশে পরিণত হলো? কীভাবে গার্মেন্টসের ৭৫ ভাগ কর্মী নারী হয়ে গেল! নারী তো সেই একই আছে, জনসংখ্যার অনুপাত ও ঠিক আছে। তবে তারা ঘর ছেড়ে বাইরে কেন? তাও গার্মেন্টসের মত অমানুষিক পরিশ্রমের জায়গায়, এই যুগেও বেতন মাসে মাত্র ৭০০০ টাকা! কীভাবে বহুমুখী আয় থেকে অধিকাংশ পরিবার একমুখী আয়ে চলে আসল? এর উত্তরণ কীভাবে সম্ভব? কাজের মধ্যে শিল্প নাই কেন? কারুকাজ নাই কেন? নিজস্ব স্বকীয়তা নাই কেন? এরকম সংকটাপন্ন প্রতিটি সেক্টরকেই আমরা যদি ধরে ধরে বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হই, তবেই উদ্ভূত সকল মুসিবতের মূল কেন্দ্রবিন্দু ও তার অন্তর্জাল সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল হওয়া এবং তা মোকাবেলায় যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হবে।

দেখুন, এক্ষেত্রে আমাদের প্রথম সমস্যা হলো- মূল সংকট কোনগুলো, তাই আমরা জানি না। কারণ আমরা ইস্যুকেন্দ্রিক।

দ্বিতীয় সমস্যা হলো- উক্ত সংকটগুলোর হাকীকত বা প্রকৃত সত্তা উদ্ভাবন করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি এবং তা সম্পাদন করার জন্য মেধার প্রচুর ঘাটতি রয়েছে।

সার্বিক বিবেচনায়, ভাসমান কোনো সংকট বা সাময়িক কোনো সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে পুরো সময়টা নষ্ট করে দেয়া কোনো যৌক্তিক কারণ হতে পারে না। কেননা, মহামারীকালীন যে সকল চরম সংকট আমাদের সামনে প্রকাশ পেয়েছে, তা হুট করে উদিত হওয়া কোনো বিষয় নয়। এর পিছনে বিদ্যমান ধারাবাহিক অথচ শক্তিশালী কিছু মৌলিক সংকট। অর্থাৎ, এখন আমরা যে সকল অসঙ্গতি দেখতে পাচ্ছি, এর বীজ প্রোথিত হয়েছে বহু পূর্বকাল থেকেই। সুতরাং এখানে প্রয়োজন সামগ্রিক সংকটের পর্যালোচনা এবং সামগ্রিকভাবে সমাধানের প্রস্তাবনা।

সার্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে- জাতিগতভাবে আমাদের মাঝে উদ্যম, প্রেষণা, স্বকীয়তা ও আত্মনির্ভশীলতা বলে কিছু নেই। চতুর্মুখী চাপ ও কৃত্রিম সংকটের ভারে ন্যুজ হয়ে আছে আমাদের দেশের প্রতিটি নাগরিক। অথচ ব্রিটিশ পূর্ব বাংলা অঞ্চলের ইতিহাস কিন্তু এর চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সমগ্র দুনিয়া ২২ ভাগ জিডিপি নিয়ন্ত্রণ করত এই বাংলা অঞ্চল। সেই ঐশ্বর্যময় অবস্থান থেকে কীভাবে আজ এই হীনমন্য দাসত্বের মনোভাবসম্পন্ন একটি জাতি তৈরি হলো? সেই প্রশ্নটি এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক।

আমরা একটি স্বাধীন অঞ্চলের সার্বভৌম জাতি হিসেবে যদি নিজেদের বিবেচনা করি তবে দেখবো-

আমাদের রয়েছে-

দীর্ঘকালব্যাপী রাজনৈতিক সংকট।

> অর্থনৈতিক ভঙ্গুর দশা।

> বাস্তবতা বিবর্জিত শিক্ষাব্যবস্থা।

» অসঙ্গতিপূর্ণ সাংস্কৃতিক বয়ান সংক্রান্ত সংকট।

> জাতীয় মানসে চটুলতা ও গোলামির মানসিকতার ছড়াছড়ি।

যার সরাসরি ফলাফল আজকে আমাদের চোখের সামনে। সত্যিকার সমাধান নিয়ে চিন্তা করা, কিংবা কথা বলার মতো কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী আমরা দেখতে পাই না। অর্থাৎ কোনো শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি আমাদের সামনে বিদ্যমান নেই। রাজনীতি এখানে কেন গুরুত্বপূর্ণ? কারণ একটি সার্বজনীন সূত্র হলো জনগণ+ রাজনীতি অর্থনীতি = সিস্টেম।

অর্থাৎ, কোনো সিস্টেম বা ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের সার্বিক জীবনকে অর্থচিালনা করতে হলে, তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে হলে এই তিনটী পরিচা বিদ্যমান থাকা অপরিহার্য। এখানে একটি অপরটির পরিপূরক। অধ্য বিমরা যদি আমাদের রাজনৈতিক পরিসরে লক্ষ্য করি তবে দেখতে পারো, প্রকৃতপক্ষে মানুষের অধিকার আদায় করবে এমন মানসিকতার রাজনৈতিক দর্শনের অনুপস্থিতি প্রথম পর্যবেক্ষণেই ধরা পরে। তবে এর বাইরে যে সকল ধারা বিদ্যমান, তাকে আমরা অনায়াসে সন্ত্রাসবাদী, লুটপাটপন্থি ও গলাবাজি কেন্দ্রিক তথাকথিত রাজনৈতিক ধারা বিবেচনা করতে পারি।

খেয়াল করুন, এত গুরুত্বপূর্ণ একটি অবস্থানে এরকম ভয়াবহ অসঙ্গতির কারণ কী? কারণ আমাদের ভূখণ্ড আজ শক্তিশালী মানুষ তৈরিতে ব্যর্থ। আমরা যদি সেই ব্রিটিশ আগমনের সময় থেকে আমাদের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করি তাহলে সংক্ষেপে যা দেখতে পাই-

* টানা দুইশ বছর ব্রিটিশ শোষণের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত এ জাতিটি নুন্যতম নাগরিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিলো। পরিকল্পিতভাবে এ অঞ্চলের মুসলিমদের দাপ্তরিক ভাষা কেড়ে নিয়ে, শিক্ষা-দীক্ষা ও অর্থনৈতিক শক্তিশালী অবস্থান থেকে হটিয়ে একটি হতভাগ্য গোলাম জাতিতে পরিণত করা হয়েছিলো। এখান থেকে এই জাতিটি আস্তে আস্তে আত্মবিশ্বাস ও হিম্মত হারিয়ে ফেলতে থাকে, স্বপ্ন দেখার সাহস হারিয়ে ফেলে।

* এ অঞ্চলে মুসলিমদের দাবিয়ে ব্রিটিশরা হিন্দুত্ববাদের উত্থান ঘটায়, তারই ধারাবাহিকতায় এ অঞ্চলে ক্রমশ প্রকাশ পেতে থাকে জাতীয়তার বিভাজন। মুসলিমগণ এমনিতেই পিছিয়ে ছিলো সর্বক্ষেত্রে, তদুপরি হিন্দুত্ববাদ এ অঞ্চলে শক্তিশালী হলে তারা ভাষা, শিক্ষা ও পর্যায়ক্রমে রাজনৈতিক চাপের মাধ্যমে এ অঞ্চলের মুসলিম মানসে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। যার সরাসরি উদাহরণ বঙ্গভঙ্গ রদ। এখান থেকে শুরু আমাদের সাংস্কৃতিক গোলামীর।

* ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশ ছেড়ে যাবার সময় ভারতের হাতে অত্র অঞ্চলের মোড়লের দায়িত্ব অনেকটা প্রকাশ্য অঘোষিতভাবে তুলে দিয়ে যায়। যার সরাসরি ফলাফল প্রতিবেশী দেশগুলোর জাতীয় রাজনৈতিক পরিসরে ভারতের আধিপত্যবাদী হস্তক্ষেপ। যার দরুন, পাকিস্তান রাষ্ট্রের ধারণা সফল হতে হতে ব্যর্থ হয়। সেই তখন থেকেই ভারত বিশেষত বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরকে কখনোই স্থিতিশীল হতে দেয়নি। এখান থেকেই উৎপত্তি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার।

* ৭১ এর স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এদেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদ কখনো সরাসরি, কখনো এদেশীয় দালাল শ্রেণির মাধ্যমে, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষাব্যবস্থা, খনিজ থেকে শুরু করে সকল কিছুর নিয়ন্ত্রণ কব্জা করতে থাকে। ঠিক এ কারণে আজকে শিক্ষাব্যবস্থা ও সংস্কৃতির মাধ্যমে সত্যিকার মুক্তিকামী আদর্শ মানুষ উঠে আসে না।

ঠিক এসকল কারণেই এ অঞ্চলের মানুষের হৃদয় প্রসারিত হতে পারেনি, চিন্তার গণ্ডি চার দেয়াল পার হতে পারেনি, সত্যিকার মানবতার মুক্তিকামী কোনো রাজনৈতিক দর্শন গড়ে ওঠেনি। জাতীয় সংহতি ও প্রগতির লক্ষ্যে তাই কেউ আর স্বপ্ন দেখারও ‘দুঃসাহস’ করে না।

এজন্যই আজ আমাদের কাছে-

▶ বাটপারি জাতীয় মর্যাদা।

► উশৃঙ্খলতার নাম স্বাধীনতা।

► মানুষের হক নষ্ট করে দেয়াটা স্মার্টনেস।

► মিথ্যা ওয়াদা করাই রাজনৈতিক পরিপক্বতা।

▶ আইন অমান্য করা বা জুলুম করে স্বার্থোদ্ধার করা চতুরতা।

এভাবে করে যত ঘৃণ্য বিষয় রয়েছে সব আমাদের কাছে মহত্তম গুণাবলি। পক্ষান্তরে- অকৃতজ্ঞতা, বিশ্বাসঘাতকতা, নির্মমতা, পাশবিকতা আমাদের জাতীয় গুণে পরিণত হয়েছে।

ছোট থেকে ছোট, বড় থেকে বড় সকল সংকটের কথা আমলে নিয়ে আমরা দেখি যে, আজ আমাদের মূল চারটি সংকট রয়েছে-

১. বুদ্ধিবৃত্তিক সংকট,

২. রাজনৈতিক সংকট,

৩. দক্ষ লোকবল সংকট,

৪. আইডিয়াল কম্যুনিটি সংকট।

সর্বশেষ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে-

• এমন সংকটের ব্ল‍্যাকহোল থেকে আমাদের পরিত্রাণ কীভাবে সম্ভব? মহান দার্শনিক ড. আল্লামা মুহাম্মদ ইকবালের ভাষায় বলতে চাই-

“সমাজের অধঃপতন রোধের একমাত্র কার্যকরী পন্থা হচ্ছে সেই সমাজে

আত্মশক্তি প্রবুদ্ধ মানুষ গড়ে তোলা, কেবল তারাই পারেন জীবনের গভীরতার উদ্দেশ্য দিতে।”

আজ আমাদের যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হলো- ‘মুক্তি’, মানুষের দাসত্ব থেকে মানুষের মুক্তি। সে মুক্তি হবে চিন্তার, সে মুক্তি হবে বাকস্বাধীনতার, সে মুক্তি হবে রাজনৈতিক স্বাধীনতার, সে মুক্তি হবে সাংস্কৃতিক স্বকীয়তার।

মহান আলেম ও প্রখ্যাত সভ্যতা বিশারদ মালেক বিন নবীর একটি সূত্র আছে- মাটি+ মানুষ + সময় = সভ্যতা।

ব্যক্তির গঠনই হচ্ছে সভ্যতা গঠনের মূল স্তম্ভ। সে আলোকে আজ যদি আমরা আমাদের মাটির নির্যাস ও স্বকীয়তার আলোকে শক্তিশালী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ তৈরি করতে পারি তবে সময়ের সাথে সাথে আমরা তামাম সংকট মোকাবেলা করতে সক্ষম হবো।

* আমাদের জনসংখ্যার শতকরা ৮০ ভাগ যুবক রয়েছে। সমাজ ও সভ্যতাকে পরিবর্তনকারী শক্তি হিসেবে আমাদের উচিত তাদের জাগিয়ে দেয়া। আমাদেরই জীবন ঘনিষ্ঠ সকল সংকট তাদের সামনে তুলে ধরা। তাদের বন্ধ চিন্তার দুয়ারে করাঘাত করে তাদের মাঝে পরিবর্তন আনয়নের উজ্জীবনী শক্তি জাগ্রত করে দেয়া।

* কেরানি মার্কা শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে এসে একটি চিন্তাশীল যুব সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, তাদের দেশ, জাতি, মানবতা তথা সমগ্র দুনিয়ার উৎকর্ষ ও ভারসাম্য রক্ষার চিন্তার দিকে ধাবিত করা। এভাবে করে শুধুমাত্র গতর নয়, সেই সাথে আকল খাটিয়ে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান নিয়ে আসতে পারার উপযোগী প্রজন্ম তৈরি করা।

* আমাদের জাতি বিভিন্ন কারণে আজ চরম হীনমন্য, তাদের মাঝে আগামীর সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন জাগ্রত করে দিয়ে হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা। সার্বিকভাবে জীবনী শক্তি ও আকলকে কাজে লাগিয়ে মানবতার সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ ও মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা।

মানবতার কল্যাণের লক্ষ্যে রাজনীতি, এই স্লোগানকে সামনে রেখে রাজনীতি সচেতন যুবসমাজ গড়ে তোলা। সকল ধরনের অসঙ্গতি ও সংকটের দিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে একটি সমাধানমূলক দৃষ্টিভঙ্গি লালনে সহায়তা করা।

যুবসমাজের মাঝে আখলাক ও আধ্যাত্মিকতার চর্চা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি করা, যাতে তারা এই দুনিয়াকে আল্লাহর আমানত এবং গোটা মানবজাতির অগ্রগতি ও নিরাপত্তাবিধানকে নিজের কাজ মনে করে আগামীতে একটি সুন্দর বসবাসযোগ্য দুনিয়া গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতে পারে।

নতুন বিশ্বব্যবস্থার প্রস্তাবক ও মহান মুজাহিদ প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান বলেন, “আমরা সবাই একটি উন্মুক্ত কারাগারে বন্দী, কিন্তু আমরা গুটিকয়েক সেই কারাগারের অবাধ্য কয়েদি।”

আজ আমাদের সর্বাঙ্গীণ মুক্তির প্রশ্ন নির্ভর করে আমাদের লক্ষ্যমাত্রার উপরে। আজ আমরা যদি ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে সংকট নিরসন ও মুক্তির চিন্তা করি, তবে রাষ্ট্রের গোলামীর কাছে সে আশা ভেস্তে যাবে।

যদি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মুক্তির স্বপ্ন দেখি, তবে বিশ্বশক্তির চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে হবে। কিন্তু আমরা যদি এই গোটা জুলুমপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থা থেকেই মুক্তি পেতে চাই তবে অবশ্যই আমাদের পক্ষে চূড়ান্ত মুক্তি লাভ করা সম্ভব।

এরবাকান হোজার মতই আজ আমাদের উন্মুক্ত জেলখানার অবাধ্য কয়েদিতে পরিণত হতে হবে। জুলুমবাজ এই পাশ্চাত্য যায়নবাদী বিশ্বব্যবস্থা ও চিন্তাবৃত্তির গণ্ডি থেকে নিজেদের সত্ত্বাকে এবং সেই সাথে সমগ্র মানবতাকে মুক্তির ব্যাপারে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে ইসলামী সভ্যতার পুণর্জাগরণের চিন্তাকে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। এবং সে আলোকে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ বাস্তবায়নে দৃঢ়পদে এগিয়ে যেতে হবে (যেমন ডি-৮)। তেরো কোটি যুবসমাজের হৃদয়ে মুক্তির নেশা জাগিয়ে দিতে হবে এবং বসবাসযোগ্য একটি দুনিয়া প্রতিষ্ঠার চিন্তাকে গণহারে ছড়িয়ে দিতে হবে।

মনে রাখা প্রয়োজন, একটি ফুল দিয়ে কখনো বসন্ত হয় না, তবে প্রতিটি বসন্তের শুরু একটি ফুল দিয়েই হয়। সুতরাং, আমরা যেনো প্রত্যেকেই বসন্তের সেই প্রথম ফুলটি হতে পারি। আজ যদি আমরা নিজেরা মুক্তির চিন্তায় উজ্জীবিত হতে পারি, তবে ক্রমান্বয়ে গোটা জাতি এবং মুসলিম উম্মাহ উজ্জীবিত হবে। এভাবে করেই আজকে হৃদয়ের ছোট্ট কুটিরে ধারণ করা মুক্তির দীপশিখা সমগ্র মানবতাকে আলোকিত করবে। তামাম জুলুম থেকে বিশ্বাবাসীকে পরিত্রাণ দিয়ে নতুন একটি দুনিয়া প্রতিষ্ঠা করা আমাদের দ্বারাই সম্ভব হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *