শিউলিমালা একাডেমি

সভ্যতার প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী

আসসালামু আলাইকুম

আজ আমি আপনাদের সাথে এখানে একত্রিত হতে পেরে সত্যিই আনন্দিত। আপনাদেরকে পবিত্র জুমার শুভেচ্ছা জানাচ্ছি এবং বরকতময় জুমার দিন কামনা করছি। পাশাপাশি শুভেচ্ছা জানাচ্ছি রমজানের। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের রমজান মাস এবং ঈদে বরকত দান করুন।

আজ আমি এখানে আমন্ত্রিত হয়েছি ‘সভ্যতার প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী’ নিয়ে কথা বলার জন্য। আমি এমন একটি বিষয় দিয়ে আলোচনা শুরু করতে চাই, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বেশি প্রয়োজনীয়। সাধারণত ইতিহাস, সামাজিক বিজ্ঞান, দর্শন, উপনিবেশবাদ, স্বাধীনতা আন্দোলন, আধুনিক চ্যালেঞ্জের নিরিখে সভ্যতার সংজ্ঞায়ন করা হয়। কিন্তু আমি এ আলোচনায় ইসলামী ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সভ্যতার সংজ্ঞায়ন করতে চাই। এক্ষেত্রে আমার আলোচনার বিষয়সমূহ হলো–

১) আল ইরফান

২) আল আকওয়ান

৩) আল মীজান

৪) আল ইনসান

৫) আল আবদান

৬) আল লিসান

৭) আল মাকান

৮) আয যামান

৯) আল উমরান

বিষয়সমূহের প্রতিটির শেষে আরবি ا ও ن রয়েছে, তাই আশা করছি আপনারা খুব সহজেই মনে রাখতে পারবেন। প্রথমে যে বিষয় দিয়ে আলোচনা শুরু করতে চাই, তা হলো ‘আল ইরফান’ তথা জ্ঞান বা প্রজ্ঞা। জ্ঞান কী, জ্ঞানের প্রকৃতি কেমন হওয়া উচিত, অতীন্দ্রিয় এবং ঐশ্বরিক বিষয়সমূহের প্রতি আমাদের অবস্থান কেমন হবে ইত্যাদি এখানে আলোচ্য।

সভ্যতা এমন কোনো বিষয় নয় যাকে আমরা মোটা দাগে ভালো কিংবা খারাপ– এ দুই ছকে বেঁধে দিতে পারি। সভ্যতা মূলত একটি বর্ণনা বা বিবরণ। সভ্যতার বিভিন্ন ধরন রয়েছে। আমরা সভ্যতার উত্থান পতন নিয়ে আলোচনা করি, বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যকার পার্থক্য নিয়ে কথা বলি; আর বিচারের ক্ষেত্রে আমাদের চিন্তা ও বিশ্বাসের সাথে যে সভ্যতাকে সবচেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ হিসেবে দেখতে পাই, তাকে প্রাধান্য দিই। আপনারা জানেন, প্রতিটি সভ্যতায়ই অতীন্দ্রিয় কিছু বিষয় আছে যা মানুষের স্বাভাবিক জ্ঞানের বাইরে। এটি কোনো মতাদর্শও হতে পারে। এক্ষেত্রে আপনি যদি বস্তুবাদে বিশ্বাসী হন যা ম্যাটাফিজিক্স এবং ঐশ্বরিক শক্তিকে অস্বীকার করে, তাহলে আপনি সম্ভবত মুসলিম সভ্যতা, খ্রিস্টান সভ্যতা ইত্যাদিকে পিছিয়ে পড়া সভ্যতা হিসেবে বিবেচনা করবেন। বর্তমানের তথাকথিত আধুনিক সভ্যতাও আমাদেরকে এটিই বোঝানোর চেষ্টা করছে।

এক্ষেত্রে আমাদেরকে আল ইরফান তথা জ্ঞান সম্পর্কে জানতে হবে। জ্ঞান কী, জ্ঞানের প্রকৃতি কেমন হওয়া উচিত, অতীন্দ্রিয় এবং ঐশ্বরিক বিষয়সমূহের প্রতি আমাদের অবস্থান কেমন হবে,  পৃথিবীতে তুলনা করার মতো এমন কোনো সভ্যতা আসলেই আছে বা ছিলো কিনা– এ প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার মাধ্যমেই মূলত আমরা বুঝতে পারবো একেকটি সভ্যতা গড়ে ওঠার পেছনে কোন কোন উপাদান ভূমিকা পালন করেছিলো। এর মাধ্যমে আমরা অতীত ও বর্তমানের বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে তুলনাও করতে পারবো।

দ্বিতীয় বিষয় হলো ‘আল আকওয়ান’, অর্থাৎ সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণা। মানুষ আসলে কী, মানুষ কোথা থেকে এসেছে,  পৃথিবীতে মানুষের দায়িত্ব কী, পৃথিবী সম্পর্কিত জ্ঞান, পৃথিবী কীভাবে সৃষ্টি হলো, পৃথিবীতে আমাদের অবস্থান ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর এখানে আলোচ্য।

মূলত এ প্রশ্নগুলো পূর্ববর্তী প্রশ্নের সাথেই সম্পৃক্ত। স্রষ্টা বা ঐশ্বরিক বিষয়সমূহের প্রতি বিশ্বাস বা অবিশ্বাস আপনাকে প্রশ্নগুলো সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন উত্তর দিবে। আপনি যখন স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন, তখন আপনি ধরে নেন বিগ ব্যাং সত্য। আপনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন ডারউইনের থিউরি সত্য যা কিনা বাস্তবে একটি পৌরাণিক কাহিনী মাত্র।

সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কিত প্রশ্নসমূহের উত্তর জানার মাধ্যমেই আমরা জানতে পারবো পৃথিবী, প্রকৃতি ও মানুষ সৃষ্টির রহস্য। আর এ প্রশ্নগুলোর উত্তর, অর্থাৎ এ বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই সভ্যতাসমূহের পার্থক্য সূচীত হয়। কেউ যদি একটি সভ্যতা বিনির্মাণ করতে চায়, তবে এ প্রশ্নগুলোর উত্তরে তার কাছে ব্যাখ্যা থাকতে হবে।

আমাদের সভ্যতার ক্ষেত্রে আমরা আদম (আঃ) এর ঘটনায় বিশ্বাসী। আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহ, পৃথিবী, মানুষ এবং সৃষ্টি জগতের সকল কিছুর মধ্যে একটি দৃঢ় সংযোগ রয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে এ পৃথিবীতে ‘ইমারাতুল আরদ’ বা পৃথিবী শাসনের আমানত দিয়ে প্রেরণ করেছেন। আমরা পৃথিবীর সকল কিছুর ব্যাপারে দায়িত্বশীল। এ পৃথিবী সৃষ্টির পেছনে পরিষ্কার ও যুক্তিযুক্ত কারণ রয়েছে। সভ্যতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এ কারণসহ মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের সামনে আছে এবং এর মাধ্যমেই ইরফান (জ্ঞান) ও জাহেলিয়াত (মূর্খতা) এর মধ্যে পার্থক্য করা যায়। আমরা মুসলিমরা আল্লাহ, তাওহীদ, শিরক এবং কুফরের অস্তিত্বকে বিশ্বাস করি এবং এর উপর ভিত্তি করেই আমাদের সভ্যতার মূল কাঠামো ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে। এখন আমরা যদি অন্যান্য সভ্যতাকে বিশ্লেষণ করি, তবে দেখবো, সেসব সভ্যতা গড়ে উঠেছে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন অথবা কিছু রীতিনীতির উপর ভিত্তি করে। যেমন– আমরা ভারতীয় সভ্যতার ক্ষেত্রে দেখি এটি একটি পৌত্তলিক ইতিহাস ও কিছু রীতিনীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে ইসলাম আমাদের সামনে সবচেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসে। ইসলাম একইসাথে অতীন্দ্রিয় বিষয় এবং মেটাফিজিক্সে বিশ্বাসী। ইসলাম আমাদেরকে ঐশ্বরিক বিষয় সম্পর্কে একটি সুনির্দিষ্ট ধারণা দেয় এবং মানুষ আসলে কী, মানুষ কোথা থেকে এসেছে, এ পৃথিবীতে মানুষের দায়িত্ব কী– এ প্রশ্নসমূহের সুনির্দিষ্ট উত্তর দেয় যা অন্যান্য সভ্যতার সাথে আমাদের পার্থক্য গড়ে দেয়। মূলত এ বিষয়টিই আল আকওয়ান।

তৃতীয় বিষয় হলো ‘আল মীজান’ তথা সেই প্রজ্ঞা যা দ্বারা মানুষ কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ তা আবিষ্কার করতে পারে।

গ্রীকদের ধারণা ছিলো সৃষ্টিকর্তা প্রথমে ঝোঁকের বশে কিছু জিনিস সৃষ্টি করেছেন; অর্থাৎ একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন, তিনি এ বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড, প্রাণিকুল ও মানুষকে হুট করে হেঁয়ালের বশে সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টি শেষে তিনি বিশ্রামে চলে যান। অনেক মুসলমানের মধ্যেও এমন কিছু কাল্পনিক ধারণা বিদ্যমান। আবার অনেক সভ্যতায় বিশ্বাস করা হয় সৃষ্টিকর্তা এ বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন ঠিকই, কিন্তু এখন আর তিনি বিশ্ব পরিচালনার কাজে সংশ্লিষ্ট নন। এ বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড যেন একটি ঘড়ির মতো। সৃষ্টিকর্তা ঘড়িটি সৃষ্টি করে চালু করে দিয়েছেন, তারপর থেকে এ ঘড়ি আপনাতেই চলছে, সৃষ্টিকর্তার যেন এখন এটি চালানোর ব্যাপারে আর কিছু করার নেই; আর তাই বিশ্ব পরিচালনার দায়িত্ব মানুষেরাই বুঝে নিয়েছে।

এখন প্রশ্ন আসে বিশ্ব, প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণকারী নিয়ম বা আইনগুলো কী কী? এগুলো কি শুধুই সমন্বয়, যেমনটা কিছু সভ্যতায় বিশ্বাস করা হয়? নাকি এগুলো শুধুই মানুষের ইচ্ছাবৃত্তি এবং এটিই সবকিছুকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করছে? নাকি এটি কদর  আমাদের নিজেদের ইচ্ছাবৃত্তির সংমিশ্রণ?

এক্ষেত্রে আমরা ইসলামে দেখতে পাই, এ মহাজগৎ, মানুষ সৃষ্টির পেছনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি সময় সম্পর্কে পরিপূর্ণ ওয়াকিবহাল। আল্লাহ জানেন কখন কী হবে। তিনি জানেন আমরা কখন, কীভাবে, কেমন কাজ করবো। কিন্তু তিনি আমাদেরকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন, ভালো-খারাপ নির্ণয়ের শক্তি দিয়েছেন।

আর ‘আল মীজান’ হলো সেই প্রজ্ঞা যা দ্বারা মানুষ আবিষ্কার করতে পারে কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ। এর মাধ্যমে আমরা মানুষ হিসেবে আমাদের নিজস্ব কাজগুলো, দায়িত্বগুলো নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করতে পারি, ইজতিহাদ করতে পারি, ‘সুন্নাতুল্লাহি ফী খালকিহী’ বা সৃষ্টির ব্যাপারে আল্লাহর বিধান বা সুন্নত এবং ‘সুন্নাতুল্লাহি ফিল আরদ’ বা জমিনের ব্যাপারে আল্লাহর বিধান বা সুন্নতসমূহ বুঝে তার আলোকে নিজেদের পরিচালনা করতে পারি। ইসলামী সভ্যতায় বিশ্বাস করা হয় মহাবিশ্ব পরিচালনার একটি পদ্ধতি রয়েছে। এটি এমন একটি ব্যবস্থাপনা যা আমরা প্রকৃতির মধ্যে এবং নিজেদের ভেতর খুঁজে বেড়াই। এ ব্যবস্থাপনাকে আমরা অনেকে ‘নিজামুল আ’লাম’ (মহাবিশ্ব পরিচালনা পদ্ধতি) বলে থাকি। মানুষকে পৃথিবী পরিচালনা করার যোগ্যতা দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। মানুষের দায়িত্ব ওহীর জ্ঞানের দ্বারা সত্য-মিথ্যা, হালাল-হারাম, গ্রহণীয়-বর্জনীয়, শিষ্টাচার, নৈতিকতা জানার মাধ্যমে  পৃথিবীকে পরিচালনা করা।

কিছু কিছু সভ্যতায় মানুষ নিজেই আইন তৈরি করে, নিজস্ব ধারণা অনুযায়ী নীতি প্রণয়ন করে। তারা দাবি করে নীতি-নৈতিকতা নির্ধারণের জন্য ওহীর জ্ঞান আবশ্যক নয়, মানুষ নিজেই এটি তৈরি করতে পারে, আর এর মাধ্যমেই তারা বিশ্ব পরিচালনা করতে পারে। আবার কিছু কিছু সভ্যতা ওহীর জ্ঞানের আলোকে আইন, নীতি-নৈতিকতা প্রণয়ন করে এবং সে আলোকে বিশ্ব পরিচালনা করে। আপনারা জানেন, আমাদের ইসলামী সভ্যতায় রয়েছে ওহীর জ্ঞানের আলোকে সৃষ্ট নিজস্ব নীতি-নৈতিকতা। আমরা আমাদের ভিশন এবং সুচিন্তিত কার্যপ্রণালীর উপর ভিত্তি করে একটি স্বতন্ত্র সংবিধান তৈরি করি। আমাদের সভ্যতায় রয়েছে অসাধারণ সামাজিক ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা এবং সার্বজনীন নীতি। ওহীর জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে মিজান এর মাধ্যমে আমরা আমাদের নিজাম নির্ধারণ করি, মদীনার সভ্যতা যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

নিজামুল আ’লাম এর আলোচনায় আরেকটি বিষয় চলে আসে, তা হলো ‘আল হুদুদ’। ‘হুদুদ’ মানে শুধু শাস্তি সংক্রান্ত বিষয়াবলী নয়, বরং এটি আমাদেরকে জানিয়ে দেয় এ পৃথিবীতে আমাদের সীমাবদ্ধতাগুলো কী, আমাদেরকে কোথায় থামতে হবে, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক জীবনে আমাদের কোন কোন বিষয় থেকে দূরে থাকতে হবে।

তাই আপনারা যখন বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে তুলনা করবেন, তখন এ বিষয়সমূহকেও তুলনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করবেন।

আমরা আল ইরফান, আল আকওয়ান, আল মীজান সম্পর্কে জানলাম। এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক, তা হলো মানুষ এবং ঐশ্বরিক বিষয়াবলীর মধ্যে আদৌ কি কোনো সংযোগ আছে? থাকলে সেটি কী? ইসলাম আমাদেরকে এ সংযোগ সম্পর্কে জানায়, আর তা হলো ‘আন নবুওয়াত’। বর্তমান আধুনিক সময়ে এ প্রশ্নের উত্তর জানা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে ইসলামী আন্দোলনগুলোর ক্ষেত্রে। এ আন্দোলনগুলো সাধারণত সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। এক্ষেত্রে নবুয়াতের ধারণা, মানব প্রকৃতির উপর ‘আন নবুওয়াত’ কী ধরনের ভূমিকা রাখে এ সম্পর্কে পরিষ্কার জ্ঞান রাখা দরকার। নবুওয়াত হলো মানুষ এবং স্রষ্টার মধ্যে সংযোগ। কোরআনেও এ সম্পর্কে বলা হয়েছে। কোরআনে নবীগণের (যারা নবুওয়াতের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন) আসল পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। তারা স্রষ্টা নন কিংবা স্রষ্টার পুত্র নন। ইহুদী ধর্মে আমরা দেখি, ইহুদীরা হযরত উযাইর (আঃ)-কে আল্লাহর পুত্র মনে করে। খ্রিস্টানরা হযরত ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহর পুত্র বলে থাকে। কিন্তু কোরআন আমাদের জানিয়েছে নবীগণ মানুষ বৈ অন্য কিছু নন।

নবীগণের ন্যায় স্রষ্টা সম্পর্কেও বিভিন্ন সভ্যতায় বিভিন্ন ধারণা চিত্রায়িত হয়েছে। ভারতীয় সভ্যতায় আমরা একাধিক দেবতার পৌরাণিক কাহিনী সম্পর্কে জানতে পারি। তারা বিশ্বাস করে বিভিন্ন কাজের জন্য আলাদা আলাদা দেবতা রয়েছে। কেউ সৌন্দর্যের দেবতা, কেউ যুদ্ধের দেবতা, কেউ বুদ্ধির দেবতা। কখনো কখনো তাদের স্রষ্টারা গ্রীক সভ্যতার স্রষ্টাদের মতো নিজেদের মধ্যে বিয়ে করে, যুদ্ধ করে, আবার কখনো মানুষের রূপ ধারণ করে পৃথিবীতে আসে। আমি একজন মিশরীয়। প্রাচীণ মিশরের ইতিহাসেও এমন বহু ইশ্বরের ধারণায় বিশ্বাস ছিলো। ইরাকের পুরাণ কাহিনীতেও ইশতারসহ বহু ঈশ্বরের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ মনুষ্য সভ্যতায় মানুষ সাধারণত যে আঙ্গিকেই হোক স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলো, তবে কখনো তা নিজস্ব কল্পনার প্রেক্ষিতে, কখনো ঐশী জ্ঞান বা ওহীর জ্ঞানের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে ইসলামী সভ্যতায় স্রষ্টা সম্পর্কে স্বতন্ত্র, সর্বোচ্চ যৌক্তিক এবং পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়।

আমাদের সভ্যতায় স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করার সাথে সাথে মৃত্যু পরবর্তী জীবন, ফেরেশতা, রাসূলগণের উপরও বিশ্বাস স্থাপন করা হয়। আমরা আমাদের রাসূলগণের মধ্যে কোনো পার্থক্য করি না। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে আল্লাহ শুধুমাত্র তাঁর নিজের পরিচয়ই দেননি, তিনি ‘আস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ’, অর্থাৎ আসমান ও জমীন সম্পর্কে বলেছেন, প্রকৃতি, নারী-পুরুষ, বিভিন্ন সৃষ্টি, প্রাণী সম্পর্কে আমাদেরকে জানিয়েছেন যেন আমরা নিজেদেরকে এই ইসলামী সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে আবিষ্কার করতে পারি। ইসলামী সভ্যতায় মানুষ এ পৃথিবীর মালিক নয়, কিন্তু পৃথিবী পরিচালনার মালিকানা মানুষকে দেওয়া হয়েছে (Humans are not the master of the world but they are the master in the world)। আর এ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আমাদের মিজান হলো কোরআন এবং সুন্নত। এ পৃথিবীতে কল্যাণ প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদেরকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। একটি উদাহরণ দিই। ধরে নিলাম আপনি একজন প্রকৌশলী। এক্ষেত্রে আপনার দায়িত্ব কেবল কিছু বিল্ডিং নির্মাণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, আপনাকে একইসাথে পরিবেশ বান্ধব শহর, পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি নিয়েও কাজ করতে হবে এবং তা প্রতিষ্ঠা করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে।

তাই অন্যান্য সভ্যতার মতো সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে ইসলামী সভ্যতার দৃষ্টিভঙ্গি এত হালকা নয়, এটি গভীর অনুধাবনের বিষয়। আপনার কাছে রয়েছে কোরআন, সুন্নত, মিজান, যার আলোকে আপনি ইমারাতুল আরদ বা পৃথিবী শাসন ও পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবেন।

আপনি যদি রাসূল (সাঃ) এর সুন্নতের দিকে তাকান, তবে দেখতে পাবেন, প্রকৃতি, সৃষ্টিজগতের প্রতি তাঁর আচরণ কেমন ছিলো এবং সে আলোকে কীভাবে তিনি ইমারাতুল আরদ এর দায়িত্ব পালন করেছেন। আমাদের রাসূলের (সাঃ) উহুদ পর্বতের প্রতি বিশেষ ভালোবাসা ছিলো এবং তিনি তাঁর ভালোবাসাকে প্রকাশ করেছেন। তিনি মক্কা, মদীনাকে ভালোবাসতেন। মক্কা বিজয়ের পর রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটিই অধিক যুক্তিযুক্ত ছিলো যে তিনি মক্কায় ফিরে আসবেন এবং বসতি স্থাপন করবেন, কারণ মক্কা ছিলো তাঁর জন্মভূমি। তিনি মদীনার আনসার সাহাবীদেরকে বলতে পারতেন, “আমাকে সমর্থন করার জন্য, সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য, মুহাজিরদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য তোমাদেরকে ধন্যবাদ। এখন আমি আমার জন্মভূমিতে ফিরে এসেছি এবং এখানেই থাকবো।”

কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি মদীনার বাসিন্দাদের কাছে ওয়াদা করেছিলেন যে তাদের কখনো ছেড়ে যাবেন না এবং তাই করেছেন। হজ্জ্বের পর তিনি মদীনায় ফিরে আসেন, সেখানেই ইন্তেকাল করেন এবং সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। এ ঘটনা আমাদের সামনে ইসলামী সভ্যতায় নিজের দেশ, জন্মস্থান, শহর, বসবাসের স্থানের গুরুত্ব কেমন সে চিত্র তুলে ধরে। এবং একইসাথে নগরকে কেন্দ্র করে আমাদের পরিচয়, প্রকৃতি সাধারণত কেমন হয় তার বর্ণনাও তুলে ধরে। আমরা যদি রাসূলের (সাঃ) সুন্নত এবং সীরাতের দিকে লক্ষ্য করি, তাহলে দেখতে পাবো, কীভাবে ইসলামী সভ্যতার উত্থান হয়েছে এবং কীসের উপর ভিত্তি করে এ সভ্যতা শত শত বছর দাঁড়িয়ে ছিলো। প্রতিটি শহরেই ঘোড়া থাকতে হবে, এমন কোনো কথা নেই; তবে প্রতিটি শহরেই সামাজিক এবং রাজনৈতিক নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে, আলাদত থাকতে হবে; যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ইসলামী সভ্যতা।

এবার আমরা সভ্যতার যে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সম্পর্কে জানবো, তা হলো ‘আল ইনসান’ বা মানুষ।

মানুষ সভ্যতার সবচেয়ে জটিল উপাদান। প্রতিটি সভ্যতা মানুষ ও তার প্রকৃতিকে ভিন্নভাবে কল্পনা করে। সামাজিক বিজ্ঞান, বিশেষ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান (যা আমার পড়াশোনার ক্ষেত্র) প্রধান বিষয় মানুষ এবং মানুষের প্রকৃতি তথা মানবপ্রকৃতি, কারণ মানবপ্রকৃতির উপর ভিত্তি করেই আমরা সামাজিক, রাজনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রণয়ন করি। উদাহরণস্বরূপ এমন একটি রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করুন, যেখানকার নাগরিকগণ প্রকৃতিগতভাবেই ভালো, তখন সে রাষ্ট্রের কী হবে? রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য ন্যূনতম ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন হবে, শাসক বা কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো প্রয়োজনই হবে না। কেবল সীমান্ত দেখাশোনার জন্য, পৌরসভাগুলোকে সংগঠিত করার জন্য, অর্থনৈতিক এবং আইনী বিষয়গুলো দেখার জন্য যৎসামান্য কিছু মানুষ প্রয়োজন হবে। রাষ্ট্রের জনগণ ভালো হওয়ার দরুণ সে রাষ্ট্রের সামাজিক যোগাযোগ ও সামাজিক কাঠামো সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ইসলামী সভ্যতায় এটির সুন্দর উদাহরণ হলো ওয়াকফ, যাকাত, সাদকা। যাকাত ও সাদকার মাধ্যমে সমাজের ধনীক শ্রেণি সমাজের উন্নয়ন এবং মানবতার মুক্তির জন্য নিজের অর্থ, সম্পদ ব্যয় করতে দায়বদ্ধ। জনগণ কেবলমাত্র খেয়ে-পরে কোনো রকমে বেঁচে থাকবে না, বরং বাইতুল মালের মাধ্যমে উন্নত শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি, চিকিৎসার সুবিধা পাবে এবং বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা থেকে অর্থ পেতে তারা বাধ্য, আর ধনীরা এ অর্থ প্রদান করতে দায়বদ্ধ। ইসলামী সভ্যতায় জনগণ নিজেদের সকল কাজ শরীয়তের আলোকে সম্পন্ন করতো। বিচার বিভাগ ছিলো মূলত উলামাদের তত্ত্বাবধানে, মুফতি, কাজীরা তা পরিচালনা করতেন। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের নামে রাষ্ট্র পরিচালকরা কখনো জুলুম করতো না, কেউ কারো উপর অনধিকার চর্চা করতো না। সর্বত্রই একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থাপনার ছোঁয়া ছিলো।

এখন আমরা যদি ইনসান/মনুষ্য প্রজাতির দিকে তাকাই, তাহলে আমাদের মনে মানুষের বিভিন্ন বিষয় ও স্তর নিয়ে, মানুষ কীভাবে নিজের দৃষ্টিভঙ্গিকে উপস্থাপন করছে বা সমাজ গড়ার সর্বোত্তম পন্থা কী হতে পারে এবং বিভিন্ন ধরনের সভ্যতা নিয়ে প্রশ্ন জাগতে পারে। আমরা যদি বিভিন্ন কারণ ও চলক বিবেচনায় মানুষ হওয়া বলতে কী বোঝায় সে অনুযায়ী মানব প্রকৃতিকে ভাগ করতে চাই, তবে আমাদেরকে ‘আল আযহান’ দিয়ে শুরু করতে হবে। আল আযহান (زهن) হলো মানুষের যুক্তির মাত্রা এবং যুক্তির সীমাবদ্ধতা। এক্ষেত্রে দুটি ব্যাপার সামনে আসে– প্রকৃতি থেকে যুক্তি শেখা এবং ঐশী বাণী থেকে যুক্তি শেখা। এ থেকেই আসে ‘আর রুসদান’ (emotional dimension of human being) বা মানুষের আবেগ-অনুভূতির আলোচনা, অর্থাৎ কোন পর্যায় পর্যন্ত মানুষ তার আবেগ-অনুভূতিকে লালন করতে পারবে, মানবতার প্রতি মানুষের দায়িত্বপরায়ণতা, মানুষের আত্মসচেতনতা সৃষ্টি ইত্যাদি এ বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। আর এটির ধরনের প্রেক্ষিতে, অর্থাৎ মানব প্রকৃতির ভিন্নতার প্রেক্ষিতে সভ্যতার পার্থক্য সূচিত হয় সুচারুভাবে।

এবার আলোচনা করবো ‘আল আবদান’ নিয়ে। এটি বদন বা শরীর শব্দের বহু বচন। সভ্যতার আলোচনায় শারীরিক মাত্রার (Bodily Dimension) বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। 

আপনি যদি আয়নায় নিজের দিকে তাকান, দেখতে পাবেন, সভ্যতার এমন অনেক উপাদান রয়েছে যা আপনার দেহে বিদ্যমান। অর্থাৎ সভ্যতার অনেক বিষয়ই মানব দেহের সাথে সম্পৃক্ত। শারীরিক বিষয়গুলো শুধু মানব দেহের আকার-আকৃতির সাথেই জড়িত নয়, এর সাথে লিঙ্গ, যৌনতা, সন্তান উৎপাদন, মানব সমাজের অস্তিত্বের মতো বিষয়গুলোও জড়িত।

শরীর যদি কোনো ব্যবস্থার জুলুমের শিকার হয়, যেমন– অর্থনৈতিক জুলুম, তবে মানুষ রাজপথে নেমে এসে বিপ্লব সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে তাহরীর স্কয়ার, আরব বসন্ত ইত্যাদির প্রসঙ্গ নিয়ে আসা যায়। এটি একটি রাজনৈতিক পন্থা।

আবার শরীরের চাহিদার উপরেই নৈতিকতার বিষয়গুলো আবর্তিত হয়। মানব অস্তিত্বের ভিত্তিও শরীরিক বিষয়াদির উপর নির্ভরশীল।এসবের উপর ভিত্তি করে কিছু সভ্যতা যুক্তি থেকে শরীরকে বেশি প্রাধান্য দেয়, আবার কিছু সভ্যতা শরীর থেকে যুক্তিকে বেশি প্রাধান্য দেয়। কোনো কোনো ধর্মে শরীরকে অবমাননা বা নিচু করা হয়, আবার কোনো কোনো ধর্মে শরীর, মন ও আবেগের মাত্রার ভারসাম্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।

আমাদের ইন্দ্রিয় ও চেতনা রয়েছে৷ আমাদের সভ্যতার ক্ষেত্রে আমাদের চিন্তার ধরন, আমাদের দৃষ্টি ও শ্রবণের সাথে জড়িত সকল বিষয়ের প্রতি আমাদের গুরুত্ব, গুজবে কান দেওয়া অথবা ইলম অর্জন করা, সত্য বলা, শাহাদাত যা শুধু আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষ্য নয়, দুনিয়াতে তাঁর একত্ববাদের সাক্ষীতে পরিণত হওয়া ইত্যাদি উপাদান আলোচ্য, যা আমাদের চেতনা ও শারীরিক অস্তিত্ব উভয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত।

অতঃপর আসে ‘আল লিসান’, যার আলোচ্য বিষয় বিভিন্ন ভাষা।

রাজনৈতিক পর্যায়ে আইন অনুযায়ী কিছু কিছু ভাষাকে জাতীয় ভাষা করা হয়, যার ফলে অনেক সময় অন্যান্য ভাষার ক্ষতি সাধন হয়। এ কারণে সারা বিশ্বে বেশ কিছু ভাষাগত দ্বন্দ্ব দেখা যায়। যেমন– সোমালিয়ার ভাষাগত দ্বন্দ্ব।

আপনারা জানেন স্পেনে কাতালান ভাষা প্রচলিত, আবার স্পেনিশ ভাষাও প্রচলিত। উত্তর আফ্রিকায় বার্বার ভাষা আছে, আবার আরবি ভাষাও আছে। কখনো এসব ভাষাভাষী মানুষেরা মিলেমিশে থাকেন, আবার কখনো আমরা তাদের মধ্যে চরম বিরোধপূর্ণ অবস্থান দেখতে পাই। তুরস্কে কয়েক দশক ধরে ঘরের বাহিরে বা রাস্তায় বা লোকালয়ে কুর্দি ভাষায় কথা বলা নিষিদ্ধ ছিলো, কারণ তাদের কুর্দি এবং আরবি ভাষার প্রতি এক ধরনের সংবেদনশীলতা কাজ করতো। পরবর্তীতে এটি পরিবর্তিত হয়। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, কামাল আতাতুর্ক বর্ণমালা পরিবর্তন করেন। অতএব কখনো কখনো এই আল লিসান বা ভাষাগত বিষয় রাজনৈতিক বিষয়েও পরিণত হয়, যা সভ্যতার পটভূমিতে গুরুত্বপূর্ণ। আপনি কোন ভাষায় কথা বলেন, জনগনের মাঝে কোন ভাষাটি প্রচলিত বেশি এসব এর অন্তর্ভূক্ত।

এরপর আমরা যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলবো তা হলো ‘আল মাকান’ বা স্থান এর ধারণা।

কীভাবে পৃথিবীতে সভ্যতা গড়ে উঠলো সে বিষয়ে যদি আমরা জানতে চাই, তাহলে আমাদেরকে ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে৷ বিভিন্ন মতাদর্শ অনুযায়ী অভিহিত করা হয়, ইতিহাস পাঠ মূলত ইকোনমিক ফ্যাক্টরের উপর নির্ভর করে এবং ইকোনমিক ফ্যাক্টর প্রকৃতির উপর নির্ভর করে।

যে সকল সমাজ নদী কিংবা কৃষি অর্থনীতির সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত, তারা এর উপর ভিত্তি করেই একটি নির্দিষ্ট সভ্যতা বিনির্মাণ করতে পারে। এক্ষেত্রে তারা উৎপাদনব্যবস্থাকে গুরুত্ব দেয়। উৎপাদনের ক্ষেত্রে সময় প্রয়োজন। আবার সে স্থান অনুযায়ী তাদের উৎপাদন পদ্ধতি নির্দিষ্ট থাকে। তাই তারা চাইলেও সে স্থান, সে সমাজকে ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতে পারে না; বরং সেখানেই স্থায়ী হয়। তারা সমাজে থেকে সমাজের কিছু সহজ কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় অনিয়মের বিপরীতে অবস্থান নেওয়া, অন্যায়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া। এটি তুলনামূলকভাবে সরাসরি প্রতিহত করার চেয়ে সহজ। তারা যদি কোনোভাবে অযাচিত বা আপত্তিজনক কর্তৃত্বের সম্মুখীন হয়, তাহলে সাধারণভাবেই তারা সামাজিক চুক্তিকে পরিবর্তন করতে পারে অথবা একত্রে অবস্থান নিতে পারে।

আপনি যদি একটি কৃষিভিত্তিক সমাজে বসবাস করেন, আপনি সে সমাজের মূল থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন না এবং কোথাও যেতে পারবেন না।

আমি সিংগাপুরে বসবাসরত একজন প্রখ্যাত ইসলামী স্কলারের নাম বলবো, যিনি মূলত জন্মসূত্রে মালয়েশিয়ান নাগরিক। তিনি হলেন হুসেইন আল আব্বাস। তার একটি গবেষণা খেয়াল করলে দেখতে পাবেন, কলোনিয়াল সমসাময়িক বিশ্বে সমাজগুলো অচল হয়ে পড়ে। এটি নিঃসন্দেহে সংস্কৃতি, স্বদেশের ভূমির প্রতি টানের সাথে সম্পর্কিত। তারা প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করেছে কীভাবে সরাসরি পদক্ষেপ না নিয়ে, কায়িক শ্রম বাদ রেখে, অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ ছাড়াই সমাজে টিকে থাকা যায়।

সমাজবিজ্ঞানের আলোকেও আমরা একই চিত্র দেখতে পাই। আমাদের বহুল পরিচিত একটি রাষ্ট্র হলো আফগানিস্তান, যা পাহাড়ি এলাকা। এ বৈশিষ্ট্য অন্যান্য অনেক অঞ্চল থেকেই আফগানিস্তানকে পৃথক করেছে। আমরা বেশিরভাগ মানুষই বলে থাকি, “আফগানিস্তানে যেও না, সেখানকার প্রকৃতি সর্বদাই তোমার বিরুদ্ধে থাকবে, সেখানে গিয়ে তুমি কখনোই যুদ্ধে জয়ী হতে পারবে না।” অর্থাৎ প্রকৃতি মানুষের বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পর্কিত। আফগানিস্তানের মানুষেরা তুলনামূলক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। তারা ফিরতি যুদ্ধ করতে পারে। সাহসিকতা, সামর্থ্যের দিক থেকে তারা নিশ্চিতরূপে সমতলের বাসিন্দাদের থেকে ভিন্ন। তবে তাদের অবশ্যই আলোচনা সাপেক্ষে নগরায়ন, আধুনিকীকরণের ব্যাপারে সচেষ্ট হওয়া, উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।

আপনি যদি এমন কোনো রাষ্ট্রের অধিবাসী হতেন, যেখানে নদী কেন্দ্রিক গড়ে ওঠা সমতলভূমি রয়েছে, তাহলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় সে অঞ্চলের রাজনৈতিক অবস্থা ও সমীকরণও হতো ভিন্নতর।

আপনি যে সমাজে বসবাস করছেন, সে সমাজেরই অন্তর্ভুক্ত। আপনার সামাজিক শিকড় সেখানেই বিদ্যমান। আপনি চাইলেই অন্যত্র যেতে পারবেন না বা অন্যত্র গিয়ে খাপ খাওয়াতে পারবেন না।

আর এক্ষেত্রে আপনার সমাজের সামগ্রিক পরিস্থিতি প্রভাব বিস্তার করবে আপনার ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও, যা সভ্যতার মাঝে দৃশ্যত পার্থক্য সৃষ্টি করে।

আল মাকান শব্দের বিশ্লেষণে প্রকৃতি, স্থাপনাকেন্দ্রিক আমাদের উপলব্ধি কিংবা বড় বড় দার্শনিকের গবেষণা অনুযায়ী অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ফুটে উঠে। তারা চিন্তায় উৎসারিত হওয়া, সে চিন্তার আলোকে গড়ে ওঠা এবং তা উপলব্ধির মাধ্যমে জ্ঞানতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো সমাজ বা সভ্যতাকে দেখে থাকেন। জার্মান দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার স্থাপত্যের সাথে আমাদের চিন্তা-ভাবনা কীভাবে জড়িত সে সম্পর্কে একটি চমৎকার পাঠ সামনে নিয়ে আসেন, যা ‘Building Dwelling Thinking’ নামে পরিচিত। সেখানে দেখানো হয়েছে কীভাবে সভ্যতা এবং সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়ের সাথে স্থাপত্য এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো জড়িত। মূলত আমাদের চিন্তা-চেতনা আমাদের চারপাশের পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত এবং সে আলোকেই আমরা আমাদের আমাদের শহর, নগর, সভ্যতা গড়ে তুলি। আবার আমাদের স্থাপত্যশৈলী আমাদের সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলে।

ছোট ছোট শহর কিংবা গ্রাম ভিত্তিক সভ্যতায় মানুষের পারস্পরিক যোগাযোগ এবং সম্পর্ক তুলনামূলক বেশি। অপরদিকে প্রযুক্তি, অত্যাধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা, সেতুব্যবস্থা, ফ্যাক্টরি নির্ভর আধুনিক শহরভিত্তিক সভ্যতায় ব্যক্তি জীবনের উৎকর্ষ সাধন, প্রযুক্তিগত উন্নয়নই মুখ্য বিষয়। এ সভ্যতায় মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক তুলনামূলক কম।

এবারের আলোচ্য বিষয় ‘আয-যামান’, অর্থাৎ সময়।

প্রতিটি সভ্যতারই সময় নিয়ে নিজস্ব কিছু মতামত আছে। সৃষ্টির শুরু নিয়ে বিতর্ক আবহমানকাল ধরেই। বৈজ্ঞানিক উপায়ে সময়ের ব্যাখ্যা দিতে গেলে প্রথমেই আসে বিগ ব্যাং থিউরি। এছাড়া অন্যান্য ধর্মের এ সম্পর্কিত অনেক প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনিও আমরা জানি। অন্যদিকে ইসলাম আমাদেরকে বলে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এ পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন; আমরা বিশ্বাস করি আল্লাহ যখন বলেন, “কুন ফায়া কুন,” তখনি সব সৃষ্টি হয়েছে, তাদের ভাগ্য লিপিবদ্ধ হয়েছে, অতঃপর মানুষসহ সমগ্র প্রাণিকুলকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে।

ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা জানতে পারি জন্মের আগে আমরা মহান আল্লাহর কাছে তাওহীদের শপথ গ্রহণ করেছিলাম। আল্লাহ্ প্রথমে আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ)-কে পৃথিবীতে পাঠান। তাদের মাধ্যমে মানব সভ্যতার সূচনা হয় এবং বংশপরম্পরায় তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। একইসাথে আল্লাহর তরফ থেকে মানুষদের মধ্য থেকে নবী ও রাসূলগণ প্রেরিত হতে থাকেন। তারা তাদের কওমের কাছে তাওহীদের সেই শপথের কথা স্মরণ করিয়ে দেন, জীবনের আসল লক্ষ্যের শিক্ষা দেন, আখিরাত সম্পর্কে জানান। এভাবে ইসলাম আমাদেরকে সময় সম্পর্কে (সৃষ্টির শুরুতে কী ঘটেছিলো এবং শেষে কী হবে) একটি সঠিক ধারণা দেয়। একইসাথে ইসলাম আমাদেরকে মানব জাতির ইতিহাস সম্পর্কেও জানায়। কোরআনে বর্ণিত ঘটনাসমূহের মাধ্যমে আমরা শুধুমাত্র হাজার বছর আগের জাতি, সভ্যতা, শাসনব্যবস্থা সম্পর্কেই জানতে পারি তা নয়; বরং মানব জাতির এ পৃথিবীতে আগমনের পূর্বের ইতিহাস সম্পর্কেও জানতে পারি।

সময় সম্পর্কিত এ সঠিক ধারণা একটি সভ্যতার জন্য অতীব জরুরী। কোনো সভ্যতাই মানুষের উপর যথাযথ ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে না, যতক্ষণ না ওই সভ্যতার একটি শক্তিশালী নৈতিক ভিত্তি থাকবে। আর এটি তখনই পরিপূর্ণভাবে সম্ভব হবে, যখন সে সভ্যতায় পরকালীন বিশ্বাস একটি শক্তিশালী মৌলিক বিষয় হিসেবে বিদ্যমান থাকবে। এ পরকালীন বিশ্বাস মানুষকে আরো বেশি নৈতিক, আরো বেশি দায়িত্বপরায়ণ করে তোলে। এমনকি কোনো লিখিত আইন না থাকলেও, কোনো কঠোর কর্তৃপক্ষ না থাকলেও সেখানে মানুষের মাঝে আলাদত প্রতিষ্ঠা করা সম্ভবপর হয়। আর এ বিশ্বাসই একটি সমাজের সাথে আরেকটি সমাজের পার্থক্য তৈরি করে। যেমন ধরুন, কোনো একটি অঞ্চলে অমাবস্যার রাতে বিদ্যুৎ চলে গিয়েছে। চারদিকে নিকষ কালো অন্ধকার। এর মাঝে একদল লোক মানুষের বাড়ি ঢুকে লুটপাট শুরু করে দিলো। তারা নিজেদের লোভের জন্য অন্যদের সম্পদে আক্রমণ করলো। এটি কেন হবে? কারণ তাদের মধ্যে শক্তিশালী জবাবদিহিতার ভয় নেই। অন্যদিকে যে সভ্যতার মানুষ আখিরাতে বিশ্বাস করে, তারা কিন্তু এ অন্যায় কাজটি করবে না। কারণ তারা বিশ্বাস করে এ অন্যায় কাজের জন্য পরকালে তাদের কঠিন জবাবদিহি এবং শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। এভাবেই পরকালীন বিশ্বাস সভ্যতাসমূহের মাঝে পার্থক্য তৈরি করে।

এখনকার রাষ্ট্রগুলোর দিকে যদি তাকাই, দেখতে পাবো, কোথাও সঠিক বিচারব্যবস্থা নেই। সকল রাজনৈতিক দলেই রয়েছে অনিয়ম, আদালতহীনতা। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় অন্যায় কিংবা বৈষম্যপূর্ণ বিচারব্যবস্থার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ এমন ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা আমাদের কর্তব্য এবং আমাদের জন্য তা করা অবধারিত। রাষ্ট্রের অস্তিত্বের বিচারে আমরা একটি ধারণার সাথে পরিচিত হবো, তা হলো ‘জিম্মাহ’। জিম্মাহ মূলত দায়িত্ব সংক্রান্ত একটি ধারণা। আমি যখন খ্রিস্টানদের সাথে কথা বলেছি, দেখেছি তারা এ জিম্মাহ এর ধারণাকে তেমন পছন্দ করে না। তারা নিজেদেরকে নাগরিকরূপে পরিচয় দিতে পছন্দ করে, ‘আহলে জিম্মাহ’ নয়। আমরা মুসলিমরা বিশ্বাস করি, জিম্মাহর ধারণা আমাদেরকে সামাজিক এবং আদর্শিক সম্মান দিয়ে থাকে।

আমি আপনাদেরকে আমার নিজের দেখা একটি ঘটনার কথা বলতে পারি। আরব বসন্তের উত্তাল এক দিনের কথা। চারদিকে বিক্ষুব্ধ জনতা। প্রতিবাদ, মিছিল চলছে। এ সময় একদল লোক নেমে আসে, যারা বাড়ি বাড়ি লুটতরাজ শুরু করে। রাস্তার প্রধান প্রধান পয়েন্টে আর্মিরা দাঁড়িয়ে ছিলো। কিন্তু তারা এর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। আর পুলিশ? তারা যেন উধাও হয়ে গিয়েছিলো। পুরো রাস্তায় একজন পুলিশও দেখা যাচ্ছিলো না। আমার এখনো মনে আছে, সে রাতে লুটতরাজ শুরু হওয়ার পরে মানুষজন রাস্তায় ট্যাংক, অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আর্মিদের অনুরোধ করেছিলো তা থামাতে, তখন আর্মিরা বলেছিলো, “এটি আমাদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত নয়। কারণ আমরা আর্মি, পুলিশ নই। আর পুলিশ যে উপস্থিত হচ্ছে না এখানে,  ব্যাপারেও আমাদের দায়বদ্ধতা নেই।” সে সময় জনগণ বুঝে যায় নিরাপত্তা রক্ষা বাহিনী আসলে তাদের সেবক নয়। অতঃপর জনগন আত্মরক্ষার জন্য কমিটি বানানো শুরু করে এবং সবকিছু রক্ষার দায়িত্ব নেয়। তখন কায়রোর এক অঞ্চলে একটি বিখ্যাত চার্চ ছিলো যার আঞ্চলিক নাম ‘খাতামুল মুরসালিন’। হ্যাঁ, নামটি খুবই মজাদার। কারণ সাধারণত চার্চের নাম এমন হয় না। তো ওই অঞ্চলের মুসলিমরা সেই চার্চের পরিপূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয়, তারা চার্চ রক্ষার জন্যও আলাদা কমিটি করে। তারা বিশ্বাস করতো এ চার্চটি তাদের এলাকায় অবস্থিত, তাই এটি তাদের জিম্মায়। এখন এ চার্চের যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যায়, তার দায়ভার কোনো না কোনো ভাবে তাদের উপরও বর্তায়। দেখুন, তাদেরকে কিন্তু কেউ বলে দেয়নি। তারা নিজেরাই এ দায়িত্ব নিয়েছে। এটিই ইসলামে জিম্মাহ এর ধারণা। ইসলামী সভ্যতায় সরকার জনগণের দেখভাল করতে বাধ্য। একইসাথে প্রতিটি জনগণ রাষ্ট্রের স্থাপনা, নীতিমালা, আইন রক্ষার প্রতিও দায়িত্বশীল। ইসলামী রাষ্ট্রে প্রতিটি জনগণও রাষ্ট্রের একেকজন রক্ষিবাহিনী।

আর ‘আয যামান’ কেন্দ্রিক বিশ্বাসই মূলত ইসলামী সভ্যতার সাথে অন্য সভ্যতাসমূহের গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য সূচিত করে।

এখন আমরা কথা বলবো ‘আল উমরান’ ও ‘আল জাবের’ নিয়ে। বস্তুগত দিক থেকে আল ইমারা বলতে স্থাপত্য, বিল্ডিং, সিটি লাইট ইত্যাদিকে বোঝায়। অপরদিকে আল উমরান এর দাবি আল ইমারা এর চেয়ে বেশি। আল উমরান  আল ইমারা এর মতো শুধু স্থাপত্যের বিষয়সমূহ নিয়েই আলোচনা করা হয় না, বরং এর সাথে রয়েছে সৌন্দর্য, নীতি-নৈতিকতা, পরকালীন জবাবদিহিতা।

আল ইমারা সব সভ্যতায়ই বর্তমান। কিন্তু ইসলামী সভ্যতার অনন্যতা হলো আল উমরান। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে আল জাবের তথা সৌন্দর্য আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে, সামাজিক জীবনে, সভ্যতায় অতিরিক্ত কিছু নয়। সৌন্দর্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মানুষ গরীব বা ধনী যাই হোক না কেন, তার সমাজ একটি সমৃদ্ধ সমাজ অথবা সংঘাতপূর্ণ বা অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত সমাজ যাই হোক না কেন, সৌন্দর্য মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, সৌন্দর্য মানুষের মধ্যেই গেঁথে রয়েছে। সৌন্দর্য আমাদের চারপাশের প্রকৃতিতে অত্যাবশ্যকীয়। এটি মুসলিম সমাজের নিত্য দিনের নাগরিক গুণাবলীর অন্যতম। অথচ এ বিষয়টিকে অন্যান্য অনেক সভ্যতায় গুরুত্ব দেওয়া হয় না‌।

এটিই দুটি সভ্যতার মধ্যে দর্শনীয় পার্থক্য গড়ে দেয়।

সর্বশেষে আমরা আবার মীজান এর প্রসঙ্গে আসবো। মীজানের একটি অন্যতম বিষয়বস্তু হলো বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে সম্পর্কের জ্ঞান।

বৈশ্বিকভাবে শান্তি নিয়ে একটি আলোচনা চলমান। আপনারা জানেন, মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শান্তি একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু আমাদের এটিও মানতে হবে যে যুদ্ধ মানব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মহল এ পর্যন্ত বহু যুদ্ধ এবং গৃহযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছে। এখন একটি সভ্যতার যদি কোনো শক্তিশালী নৈতিক ভিত্তি না থাকে, সে সভ্যতা যখন কোনো কারণবশত যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে, তখন কী অবস্থা হবে? যুদ্ধকালীন সময়ের নির্দিষ্ট নীতি-নৈতিকতা মেনে চলা একটি সভ্যতার জন্য অত্যাবশ্যক।

এ প্রেক্ষিতে ‘ফিকহুল জিহাদ’ ইসলামী সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ। কারণ যুদ্ধ হয়ই, সভ্যতার ইতিহাসের শুরু থেকেই এটি একটি পরিচিত বিষয়। আপনার যদি যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট ফিকহ জানা না থাকে, তাহলে যুদ্ধের সময় আপনাকে কী মানতে হবে বা কোন সীমার মধ্যে চলতে হবে তা আপনি জানতে পারবেন না। ফলশ্রুতিতে নিঃসন্দেহে একটি জুলুমের পরিবেশ সৃষ্টি হবে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক হলো খ্রিস্টান সভ্যতা, যাদের যুদ্ধ সংক্রান্ত যৌক্তিক তত্ত্ব ছিলো না, দুই শতাব্দী ব্যাপী স্থায়ী ক্রুসেড যার প্রমাণ। অতঃপর খ্রিস্টানরা যুদ্ধ সংক্রান্ত তত্ত্ব প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে এবং সেন্ট থমাস তা প্রণয়ন করেন, যা মূলত ইসলামের ফিকহুল জিহাদের অনুকরণেই রচিত হয়েছিলো!

আমি যা যা এতক্ষণ উল্লেখ করলাম, তা হলো সভ্যতার মৌলিক বিষয়। সভ্যতা শব্দটা মূলত একটি ছাতার মতো। ছাতার যেমন বিভিন্ন অংশ থাকে এবং অংশসমূহ একটি আরেকটির সাথে সম্পর্কযুক্ত, তেমনি সভ্যতার সংজ্ঞায়নে অনেকগুলো ধারণা ও বিষয় চলে আসে, যা একে অন্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং পরিপূরক।

এ বিষয়সমূহই এক সভ্যতার সাথে অন্য সভ্যতার পার্থক্য সৃষ্টি করে। আপনি যদি একটি সভ্যতার সাথে আরেকটি সভ্যতার তুলনা করতে চান, তাহলে আমি এ পর্যন্ত যা যা উল্লেখ করলাম, এগুলোর সবই আপনাকে বিবেচনায় নিতে হবে।

আমার উল্লেখিত বিষয়সমূহের প্রত্যেকটিই একেকটি আলাদা লেকচারের যোগ্য। তাই আমি এখানে শেষ করছি এবং এখন আমরা প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু করতে পারি।

প্রশ্নোত্তর পর্বঃ

প্রশ্ন-১

আসসালামু আলাইকুম। সম্মানিত অধ্যাপক, আমি সমাজবিজ্ঞানের কোর্সসমূহের ক্ষেত্রে দেখেছি, সব কোর্সেই পশ্চিমা এবং ইউরোপীয় সভ্যতা সম্পর্কে শেখানো হয়। ইসলামী সভ্যতা সম্পর্কে তেমন কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না এবং এটি আমাদের ইসলামী সভ্যতা সম্পর্কে জানার প্রতি নিরুৎসাহিত করে। অথচ আমরা সবাই বুঝতে পারছি এর প্রয়োজনীয়তা কত বেশি! এক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী? আমরা কী করতে পারি?

– কাজী সালমা বিনতে সলিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

উত্তরঃ

আমি মনে করি এক্ষেত্রে আপনি একটি পড়ার তালিকা তৈরি করতে পারেন। আপনি ইসলামে পৃথিবীর ইতিহাস দিয়ে শুরু করতে পারেন। এ বিষয়ে বেশ কিছু বই রয়েছে। এ ক্ষেত্রটি অনেক বিস্তৃত, তাই জানার জন্য আপনি যে বিষয় দিয়েই শুরু করেন না কেন, সেটি আপনাকে অন্যান্য বিষয়ের দিকে নিয়ে যাবে। আপনার প্রতি আমার পরামর্শ থাকবে ইতিহাস দিয়ে শুরু করুন। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সভ্যতার ইতিহাসে কী হয়েছে, সভ্যতা কীভাবে বিকাশিত হয়েছে, বিকাশের নির্ণায়কগুলো কী এবং ইতিহাসে কী কী পরিবর্তন হয়েছে ইত্যাদি বিষয়সমূহ নিয়ে পড়তে পারেন। আমি আগে উল্লেখ করেছি, সৌন্দর্যের মাত্রাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এটি আপনাকে সমাজ সম্পর্কে ধারণা দেবে, ধারণা দেবে মানুষ ও তার প্রকৃতি সম্পর্কে। ইসলামী কর্মের উপর ফারুকীর লেখা একটি এনসাইক্লোপিডিয়া আছে। আমি মনে করি এটি পড়লে আমি যা যা আলোচনা করেছি সে বিষয় সম্পর্কে আপনি বিশদ জানতে পারবেন। আপনি যদি ইসলামের মূলে যেতে চান, তাহলে আপনার সীরাত পড়া উচিত। কারণ সীরাত আমাদেরকে মানব অস্তিত্বের নৈতিকতার সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ রাসূল (সাঃ) সম্পর্কে জানায়। তিনি কীভাবে স্থান, শরীর, আইন, সমাজ, রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন; যে সমাজে তিনি বসবাস করছিলেন (মদিনা), সে সমাজের শাসনতন্ত্র, জনসাধারণ এবং ব্যক্তিগত বিষয়াদি পরিচালনা করেছেন; নারী কেন্দ্রিক সমস্যা কীভাবে সমাধান করছেন ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা দেবে সীরাত। সীরাতেই আপনি এ সভ্যতার বীজ এবং তার পরিস্ফুটন দেখতে পাবেন।

দুর্ভাগ্যবশত আমাদের কিছু দেশের সংস্কৃতিতে ইসলামী চর্চা নামে অনেক জাহেলি চর্চা ঢুকে পড়েছে যা আদতে ইসলামী সংস্কৃতিরই অংশ নয়।

তাই সংস্কৃতির ধারণা সম্পর্কে জানা উচিত এবং সুযোগ থাকলে সংস্কৃতির প্রভাব কতটা গভীর তা জানতে সভ্যতা কেন্দ্রিক বিভিন্ন বিষয়ে কোর্স নেওয়া থেকে বিরত থাকবেন না, যদি সেটা পাশ্চাত্য সভ্যতাও হয়। এর মাধ্যমে আমরা ইসলামী সভ্যতার তুলনামূলক পরিচয়ও তুলে ধরতে পারবো। আপনাদের উপমহাদেশের মালয়েশিয়ার সাইয়্যেদ মুহাম্মদ নাকীব আল আত্তাসও এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন যা আপনি পড়তে পারেন।

প্রশ্ন-২

আসসালামু আলাইকুম, প্রিয় অধ্যাপক। আমার প্রশ্ন হলো আমাদের একজন প্রফেসর আছেন, যিনি আন্তঃসভ্যতার সংলাপ সংক্রান্ত আলোচনা ও এর উপকারিতা উপস্থাপন করতে পছন্দ করেন, একইসাথে বড় বড় ইসলামী স্কলারদেরও এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হিসেবে তুলে ধরেন। অথচ অধিকাংশ স্কলারদের লেখা ও বক্তৃতা থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, আন্তঃসভ্যতার সংলাপ বলতে কিছু নেই। এমনকি ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও এর কোনো গ্রহনযোগ্যতা নেই। আপনি কি দয়া করে এ সম্পর্কে আমাদেরকে কিছু জানাবেন? এ সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন?

– রিয়াজ আহমেদ, তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা

উত্তরঃ

আচ্ছা! রিয়াজ আহমেদকে প্রশ্নটি করার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। প্রথমত এটি বোঝা জরুরি যে, সভ্যতা কেন্দ্রিক একক কোনো সংলাপ হতে পারে না। আমাদের উন্মুক্ত সংলাপ হলো আমাদের সমাজের সাথে অবিচ্ছেদ্য বিষয়সমূহ নিয়ে।

যেমন– কোরআনে মুহাম্মদের (সাঃ) প্রতি আল্লাহর বলা ‘ক্বুল’ অথবা ‘ফা ইন জাদালুকা, ইয়াস আলু নাকা’– এগুলো সামগ্রিকতা ধারণ করে থাকে। এখন প্রশ্ন হলো যখন আপনি শোষিত হতে থাকবেন, যখন আপনার সভ্যতার অস্তিত্ব জুলুমের নিচে চাপা পড়ে যাবে, তখন অবশ্যই আন্তঃসভ্যতার সংলাপের বিন্দুমাত্র মূল্যও নেই, এটি তখন কেবলমাত্র মৌখিক বাণীতে পরিণত হবে। প্রকৃতপক্ষে এটি সম্ভবও নয়। সুতরাং এ অবস্থান থেকে আন্তঃসভ্যতার সংলাপের বাস্তবায়ন নয়, বরং নিজেদের উপর চলমান জুলুমের প্রতিরোধ গড়ে তোলার দিকেই আগে মনোযোগ দিতে হবে।

আমি এখানে দুটি পরিভাষা উল্লেখ করতে চাই, প্রথমটি হলো ‘তাআরুফ’, যেটি অন্য আরেকটি সভ্যতার সাথে পরিচিত হওয়া, সে সভ্যতার মানুষের বিশ্বাসকে বোঝা বা সম্মান দেওয়া, নতুন একটি সংস্কৃতি এবং তার মানুষদের সম্পর্কে জানা ইত্যাদির প্রতি ইঙ্গিত করে।

দ্বিতীয়টি হলো ‘তাদাফা’, যেটি শুধুমাত্র শান্তি নয়, বরং দুটি সভ্যতার পারস্পরিক সংঘর্ষকে প্রাসঙ্গিক করে তোলে। হোক সেটি শোষিত হওয়ার জন্য বা শোষণ করার জন্য।

আমাদেরকে বুঝতে হবে কোন প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে আন্তঃসভ্যতার সংলাপকে হাজির করা হচ্ছে। উপনিবেশবাদ? সেটি আমাদের অঞ্চলগুলোতে নিকৃষ্টতম শোষণ বৈ কিছু নয়। তবে আজকের শোষণের প্রেক্ষিতে সময়ের আলোকে তাদের সাথে কূটনৈতিক সংলাপও জরুরী।

আরেকটি বিষয় হলো কখনো কখনো বিভিন্ন ধর্মীয় সংলাপ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে। যেমন রবের অস্তিত্ব সম্পর্কিত বিষয়াদি। এগুলো অবশ্যই সাধারণ মানুষের সংলাপের অংশ নয়, বরং সমাজের পণ্ডিত শ্রেণির নজর দেওয়ার বিষয়। এ রকম আরো অসংখ্য সময়ের আলোকে অপ্রয়োজনীয় বিষয়াবলী নিয়ে আমরা বিতর্কে লিপ্ত থাকি।

তাই কোনো সংলাপের প্রসঙ্গে এলে তা কোন ধরনের সংলাপ, এটির প্রেক্ষাপট, পর্যায়, এটি কাদের দ্বারা পরিচালিত, এটির মূল কোন দিকে ইত্যাদি বিষয় মাথায় রাখা উচিত। অন্যথায় যা হচ্ছে, আমাদের সন্তানদের বড় একটি অংশ পাশ্চাত্যের তৈরিকৃত সংলাপ বাস্তবায়নে দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছে। এমনকি দখলদার ইজরায়েল এর সাথে মুসলিম উম্মাহর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মতো আত্মঘাতী প্রচেষ্টাও তাদের উদ্দেশ্যসমূহের অন্তর্ভুক্ত, যা কিনা শান্তি রক্ষার স্বার্থেই!

অথচ আমার ফিলিস্তিনি ভাই-বোনদের অবস্থা কারো অজানা নয়! সুতরাং আমাদের আগে নিজেদের অস্তিত্বকে শোষণ থেকে মুক্ত করতে হবে এবং শত্রু-মিত্রও শনাক্ত করতে হবে। অন্যথায় নিজেদের গৃহীত পদক্ষেপই আত্মঘাতী রূপে ফিরে আসবে।

প্রশ্ন-৩ঃ

সম্মানিত অধ্যাপক, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। আমরা জানি, ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু করে ১৯ শতক পর্যন্ত ইউরোপের যে শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, সেটিকে সামনে রেখে ইউরোপে জ্ঞানের জাগরণের সংলাপকেও ঢালাওভাবে প্রচার করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমাদের পড়ানো হয়, ইউরোপের এ জ্ঞানের বিপ্লবই আধুনিক মানব সভ্যতার প্রবক্তার ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু আমাদের কাছে এটি স্পষ্ট যে, এ বিপ্লব শুধুমাত্র ইউরোপীয় বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন ও পাশ্চাত্যের কথিত আধুনিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছাড়া আর কিছুই নয়!

উস্তাজ, আপনি যদি দয়া করে ইউরোপের এ বিপ্লব নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের জানাতেন এবং বলতেন আজকের আধুনিক সভ্যতায় এ বিপ্লবের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ প্রভাব কী?

– ফজলে এলাহী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

উত্তরঃ

আচ্ছা! আমি এখানে আগে দুটি উপাদান উল্লেখ করতে চাই। একটি হলো তাদের প্রচারকৃত এ বিপ্লবের একটি উদ্দেশ্য হলো মানুষের মননকে তাদের চার্চ কেন্দ্রিক করা। প্রকৃতপক্ষে তারা ছিলো জ্ঞান-বিজ্ঞান, উৎপাদন, উন্নয়ন বা আবিষ্কার থেকে শুরু করে মানবিক মর্যাদা প্রদান ও মানবতা কেন্দ্রিক হওয়ার ঘোর বিরোধী। সুতরাং এ বিপ্লব তাদের মুক্তির অংশ বলেও গন্য হতে পারে।

তবে বলে রাখা উচিত, তাদের এ বিপ্লবের সূচনা চার্চেরই একদল ধর্মীয় শ্রেণির লোকদের মাধ্যমে হয়েছিলো, যাদেরকে ধর্মীয় পুনর্গঠক হিসেবেও গণ্য করা হতো, কারণ বিপ্লবের সূচনার ফলে তারা ক্যাথলিকদের মন রক্ষা করে করতে পারেনি। এমনকি তাদেরকে চার্চ থেকেও বের করে দেওয়া হয়েছিলো, যার সাক্ষী ইউরোপীয় ইতিহাস। স্কটিশ বিপ্লবের প্রেক্ষাপটকে জানতে পারলে এ বিষয়গুলো আরো ভালোভাবে বোধগম্য হতে পারে, যা ছিলো সম্পূর্ণরূপে চার্চ কেন্দ্রিক।

তবে একটি সময় পরে যখন এ বিপ্লব আধুনিকতার দিকে মোড় নেওয়া শুরু করে, ধীরে ধীরে সেটি ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং মানুষ কেন্দ্রিক হওয়ার বদলে বস্তুবাদীতায় সক্রিয় হতে থাকে ও ধর্মের প্রান্তিকীকরণ করে ফেলে। ফলাফলস্বরূপ সৃষ্টি হয় প্রটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক দ্বন্দ্ব, যা আমাদের সবারই জানা।

প্রকৃতপক্ষে ইসলামের সকল যুগের প্রাসঙ্গিকতার সাথে অন্যান্য মানব রচিত বিশ্বাসগুলোর পার্থক্য এখানেই। ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বের জায়গাও এটিই। যাই হোক, পরবর্তীতে তাদের মাঝে দুটি মতাদর্শের উত্থান হয়, একটি মার্ক্সিজম অপরটি লিবারেলিজম। মার্ক্সবাদীরা রাষ্ট্র কেন্দ্রিক হয়ে উঠে ও লিবারেলরা চার্চের প্রাধান্যে অটল থাকে। তবে এক পর্যায়ে তাদের সমন্বিত সুর হয়ে দাঁড়ায় মুসলিম অঞ্চলসমূহে কলোনি স্থাপন, শোষণ; যেটি তাদের কথিত বিপ্লবের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর উপর ভর করেই তারা আধুনিকতাকে সামনে এনেছে এবং শোষণের উপর অটল থেকে পূর্ব ও উত্তর আধুনিক যুগও পার করে ফেলেছে। বর্তমান সময় হলো মানব-উত্তর যুগ, যেখানে Anthropocentrism তথা মানুষ কেন্দ্রিকতা থেকে বের হয়ে আসার কথা বলা হচ্ছে, অর্থাৎ মানুষই সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ নয় বা সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে নয়; যন্ত্র ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, প্রাণি জগৎ, বাস্তুসংস্থান এবং পরিবেশ ইত্যাদির গুরুত্ব অধিক থেকে অধিকতর। আমরা একটি নতুন যুগে প্রবেশ করেছি, যেখানে নিকৃষ্টতম পুঁজিবাদের বাস্তবায়ন অগ্রে, যেখানে ‘মানুষ’ সভ্যতার কেন্দ্রে নয়, বরং মানুষই বস্তুবাদের দ্বারা নিষ্পেষিত, অসহায়। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় হলো আমরা মুসলিমরাও আমাদের রক্তের দাবি অনুসরণ না করে তাদের সাথেই এ অপব্যবস্থায় ডুব দিয়ে যাচ্ছি।

অবশ্যই ইসলাম পরিবেশ অনুযায়ী গতিধারা পরিচালনাকে প্রাধান্য দেয়, কিন্তু আমাদের এটিও মাথায় রাখতে হবে, আমরা কথিত মানবতাবাদী নই, বরং আমাদের সভ্যতাই মানুষ কেন্দ্রিক। জ্ঞানই মূল বিষয়। সুতরাং আমাদের আগে বোঝা উচিত আমরা কারা, আমাদের রক্ত কোন ভাষায় কথা বলে, আমরা কোন পূর্বপুরুষদের উত্তরসূরী এবং গোটা মানবতা আমাদের কাছেই কেন মুক্তির প্রার্থনা করে!

প্রশ্ন-৪:

প্রিয় উস্তাজ! আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। আমরা জানি, গত শতাব্দীর শেষ কয়েক দশকে দুনিয়া বেশ কিছু বড় বড় ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে। বিশেষ করে গত শতাব্দীর শুরুর দিকে শত শত জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গোটা দুনিয়ার মানচিত্র খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গেছে। রাজনৈতিক ব্যবস্থায়ও আমূল পরিবর্তন এসেছে। একইসাথে দখলদার ইজরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে গ্রেট ইজরায়েল প্রজেক্ট এর অংশ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম অঞ্চলগুলোর সীমানা ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হচ্ছে।

এ পরিস্থিতিতে আমাদের বিকল্প রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক প্রস্তাবনা কী রকম হতে পারে? একটি রাজনৈতিক পুনর্গঠন আবার কীভাবে সম্ভব? একইসাথে একটি বসবাসযোগ্য দুনিয়া গড়ার জন্য যুবকদের ভূমিকা কেমন হতে হবে?

– সায়েম মুহাইমিন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

উত্তরঃ

ধন্যবাদ, সায়েম মুহাইমিন। উত্তরের ক্ষেত্রে এটি অবশ্য বেশ বড় আলোচনার বিষয়।

জাতিরাষ্ট্র একটি ইতিহাস, একটি শক্তি, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার চ্যালেঞ্জ সংশ্লিষ্ট বিষয়, এটি একটি প্রোপাগাণ্ডা মেশিন যা সাধারণ মানুষ ও সমাজের উপর মহাজুলুম ও বর্বরতার উদ্রেককারী। আমি এখানে ছোট আকারে এ বিষয়ে আমার চিন্তা আপনাদেরকে বলতে চাই।

প্রতিনিয়ত মানুষের জীবনধারণ পদ্ধতি পরিবর্তিত হচ্ছে। একইসাথে মানসিকতা, অনুশীলন, যোগ্যতা, কৌশল, নতুন নতুন বহু সংস্কৃতির সাথে, নতুন সমাজ ও তার অবকাঠামোর সাথে এমনকি নতুন কোনো রাজনৈতিক দর্শনের সাথে পরিচিত হওয়ার ফলে গ্রহণ করার প্রবণতা থেকেই মানুষ তা আপন করে নিচ্ছে, হোক তা তার নিজের অবকাঠামো থেকেও অনুন্নত। জাতিরাষ্ট্রের বীজ আসলে এসবের মধ্যেই লুকায়িত। তবে রাষ্ট্রের আয়তন ও একই জাতির মানুষও জাতিরাষ্ট্রের উত্থানের সূচনাকালের প্রতিনিধি, যারা সেই অঞ্চলের মানুষের চাওয়া-পাওয়ার প্রাধান্যকে সর্বাগ্রে রেখে তাদের উন্নতি ও অবনতির প্রতিনিধি হিসেবে জাতিরাষ্ট্রের উত্থানে কাজ শুরু করেছিলো।

তবে আমাদের সভ্যতার সীমানা ক্ষুণ্ণ হয়েছে যেসব জাতিরাষ্ট্রের উত্থানের মাধ্যমে, নিঃসন্দেহে সে প্রেক্ষাপট পাশ্চাত্যের আদলেই গঠিত। বিশেষ করে আমাদের খেলাফতের প্রশাসনিক পতনের অন্যতম কারণও এটি। আমরা সিরিয়া, ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, জর্ডান বা ইরাকের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি, তারা জাতিরাষ্ট্র উত্থানের মাধ্যমে এ অঞ্চলগুলোসহ সকল অঞ্চলকেই অভিভাবক শূন্য করেছে শোষণের মাত্রা বৃদ্ধি করার জন্যই। সুতরাং জাতিরাষ্ট্র উত্থানের প্রথম শ্রেণির দাবিগুলোও তেমন যৌক্তিক কোনো দাবি ছিলো না, একইসাথে জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ইউরোপের সাজানো গণতন্ত্রের যে চর্চা আমাদের অঞ্চলগুলোতেও শুরু হয়েছে, সে গণতন্ত্র শুধু অঞ্চলে অঞ্চলে জনপ্রিয় কিছু নেতৃত্বই উৎপাদন করতে পেরেছে, যারা উল্টো অতিমাত্রায় জাতীয়তাবাদের বিষ ছড়িয়ে দিয়েছে এবং মানুষের প্রকৃত মুক্তি দিতে পারেনি।

আজকের এ অবস্থানকে শক্ত হাতে প্রতিহত করার জন্য আমাদের মেধা বা চিন্তাসমূহকে কাজে লাগাতে হবে। অভ্যন্তরীণ শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি নিজস্ব রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান সুসমৃদ্ধ ও শোষণমুক্তকরণ, নিজেদের শিক্ষাব্যবস্থায় হাকীকত ফিরিয়ে এনে পাশ্চাত্যের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থানের জানান দিতে হবে।

এভাবে আমরা এ জুলুমপূর্ণ ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন করতে পারি। অন্যথায় আমাদের শাসকবর্গ বাশার আল আসাদের মতো নিজেদের জাতির কথা ভুলে গিয়ে নিজের ক্ষমতাকেই আগে বেছে নিবে, নিজের দেশের ৪০% জনগণ শোষণের রোষানলে পরবাসী হওয়া থেকে শুরু করে গণহত্যা বা হাজার হাজার স্থাপনা গুঁড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও।

এ সকল করুণ পরিস্থিতি যেন আমাদের কোনোভাবেই হতাশ না করে, বরং আমাদেরকে আমাদের দায়িত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবেই নিজেদের চিন্তাজগতকে সব সময় উর্বর রাখতে হবে। পূর্ণ ইখলাসকে সঙ্গী করে নতুন নতুন চিন্তা, প্রস্তাবনা, ইশতেহার নিয়ে জাতির সামনে ভিশনারী মানসিকতা প্রদর্শন করতে হবে। কিন্তু যখনই আমরা চিন্তার জগতের আলোকে অভিলাষে পাঠাবো, তখন হাজার সম্ভাবনা ও শক্তি থাকা সত্ত্বেও আরব ভাইদের মতো চিন্তাগত দৈন্যতা থেকে নিজেদের হাসির পাত্র হিসেবে উপস্থাপন করা ছাড়া আর কোনো রাস্তা থাকবে না। কেননা আরব বসন্ত যখন শুরু হয়, চিন্তাগত দৈন্যতা বা চিন্তার পুনঃর্নির্মাণ সাধিত না হওয়ার ফলেই আজ তারা অতি মাত্রায় আত্মঘাতীতে রূপান্তরিত হয়েছে।

সুতরাং আপনাদের প্রতি আমার উপদেশ হলো আপনারা চিন্তাকে শানিত করুন। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অবস্থানকে গোটা মানবতার মুক্তির জন্য যুগের আলোকে নতুন করে সাজিয়ে তুলুন সকল ধরনের সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে। আমরা প্রত্যেকেই নিজের জন্য দায়বদ্ধ। তাই আমাদের প্রচেষ্টা হওয়া উচিত সর্বোচ্চ। সামনের সব পথ রুদ্ধ হয়ে গেলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, আমাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা আমরা আমাদের কাজকে এগিয়ে নিতে পারি এবং নিজেদের গড়ে তুলতে পারি সেই মুহুর্তের জন্য, যখন আমাদের সামনে সুযোগের দ্বার খুলবে। সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে আরো সরব হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের চিন্তা সৃষ্টি করতে হবে, অথচ আমরা চিন্তা সৃষ্টি না করে শুধুই আমাদের ইতিহাসকে আলোকপাত করি। আর এ প্রেক্ষিতেই আমি ইতিহাস থেকে সভ্যতাসমূহের পাঠকে বিভিন্ন দৃষ্টান্তসহ বের করে আনা, এসবের মাঝে তুলনা করা এবং ভবিষ্যতের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ এর দিকে দৃষ্টিপাত করার চেষ্টা করি। শুধু আমাদের সভ্যতা নয়, গোটা মানবতাই আমাদের কাছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার আমানত। প্রতিটি মুসলমান যেন শুধু মুসলমানদের পক্ষে নয় বরং সমগ্র মানবতার পক্ষে কাজ করে। আমাদের সর্বদা এ পৃথিবী নিয়ে ভাবতে হবে, অত্যাচারের শিকার সকল জাতি ও সমাজের মুক্তি, সমতা, মর্যাদা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগিয়ে যেতে হবে। বৈশ্বিক পরিবর্তনের জন্য আমাদের সচেষ্ট হতে হবে। একটি কথা মনে রাখবেন, আমাদের হাত বাঁধা থাকলেও আমাদের অন্তর ও মস্তিষ্ক কিন্তু বাঁধা নয়!

অনুবাদ : নাফিসা নাজমী, মুশফিকুর রহমান, লামিয়া তাসনীম।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *