প্রাণিকুলের অধিকার রক্ষা ও তাদের কল্যাণার্থে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ৪ অক্টোবর পালিত হয় ‘বিশ্ব প্রাণী দিবস’। ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে ১৯৩১ সালে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের এক সম্মেলনে দিবসটি ঘোষণা করা হয়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ন্যাচার ওয়াচ ফাউন্ডেশন দিবসটি সারাবিশ্বে প্রাণীপ্রেমীদের নিয়ে পালন করে থাকে। যেই ইউরোপীয়রা প্রাণীদের প্রতি এতটা সহানুভূতি বিশ্বের সামনে দেখিয়ে থাকে, বাস্তবে তারা প্রাণীদের সাথে কেমন আচরণ করে এবং কেমন সহানুভূতি, মায়া-মমতা ও দয়াদ্রতা প্রকাশ করে থাকে তার একটু ছোট্ট উদাহরণ দেখে আসি।
১৯২৩ সালে আমেরিকায় সর্ব প্রথম পোল্ট্রি ধারণাটির সূত্রপাত হয়। এই পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিতে দুই ধরণের মুরগীর প্রজনন করা হয়। ডিমের জন্য লেয়ার মুরগী, আর মাংসের জন্য ব্রয়লার। ব্রয়লার মুরগী ছয়-সাত সপ্তাহের মধ্যে বিশাল বড় হয়ে যায়। মাংশ হয় প্রচুর। আর লেয়ার মুরগীর স্পেশালিটি হল সাইযে বড় না হলেও এ জাতের মুরগী অনেক বেশি ডিম দেয়। তবে ডিম তো দেয় শুধু নারী মুরগী। পুরুষদের কী হয়? মেরে ফেলা হয়।
জন্মের প্রথম দিনই ওদের মেরে ফেলা হয়। কারণ এ মুরগীগুলোর জীবন প্রফিটেবল না। পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রির কাছে এরা ‘সারপ্লাস’। পুরুষ হবার কারণে এদের কাছ থেকে ডিম পাওয়া যায় না। আর লেয়ার জাতের হবার কারণে পাওয়া যায় না ব্রয়লার মুরগীর মতো মাংসও তাই সবচেয়ে লাভজনক, সবচেয়ে ‘একোনমিক’ সমাধান হল এই বাচ্চাগুলোকে যতো দ্রুত সম্ভব মেরে ফেলা।
আর তাই প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে এক দিন বয়েসী ৭০০ কোটি পুরুষ শিশু মুরগী হত্যা করা হয়। হ্যাঁ, ৭০০ কোটি। ৭ বিলিয়ন।
এই মেরে ফেলার কাজটা কীভাবে করা হয় জানেন? বিভিন্ন পদ্ধতি আছে।
১। শ্বাসরোধ করা: বাচ্চাগুলোকে বিশাল বিশাল প্লাস্টিক ব্যাগে ভরে আটকে দেয়া হয়। বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করতে করতে দমবন্ধ হয়ে মারা যায় ওরা।
২। ইলেক্ট্রোকিউশান: ডিম ফুটে বের হওয়া বাচ্চাদের ইলেক্ট্রিক শক দিয়ে হত্যা করা হয়।
৩। সারভিকাল ডিসলোকেশান: সোজা বাংলায়, হাত দিয়ে টেনে মাথা ছিড়ে ফেলা হয় শরীর থেকে।
৪। গ্যাসিং: গ্যাস চেইম্বারে চালু করে দেয়া হয় কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস। সদ্যজাত মুরগীগুলো একসময় জ্ঞান হারায় এবং মারা যায়।
৫। ম্যাসেরেইশান: পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে পছন্দের পদ্ধতি। বাচ্চাগুলোকে প্রথমে একটা কনভেয়ার বেল্টে ছুড়ে দেয়া হয়। কনভেয়ার বেল্ট জীবন্ত বাচ্চাগুলোকে নিয়ে ফেলে প্রচন্ড গতিতে ঘুরতে থাকা ধারালো ধাতব পাতের মধ্যে। মূহুর্তের মধ্যে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ওরা।
একটা ঢাউস সাইজের ব্লেন্ডারের ভেতর একদিন বয়েসী মুরগীর বাচ্চাকে ছেড়ে দিলে কী হবে চিন্তা করুন। সেইম প্রসেস। তবে একটা না, শত শত কোটি মুরগীর বাচ্চাকে এভাবে হত্যা করা হয়। পুরো ব্যাপারটা পুঁজিবাদের ইউটিলিটারিয়ান সমীকরণ আর মডার্নিটির মনস্তত্ত্বের অসাধারণ এক দৃষ্টান্ত। আগাগোড়া পিওর মেশিন লজিক।
জার্মানিতে যে ডিমগুলো এই নিষ্ঠুরতা ব্যাতিত প্রডিউস করা হয় সেই ডিমের প্যাকেটগুলিতে লিখা থাকে “ohne kükentöten”। কিন্তু দাম অন্য ডিমের চেয়ে অনেক বেশি। যে কারনে সাধারন মানুষ কিনতে চায় না।
বাংলাদেশে লেয়ার মেলগুলো কক বাচ্চা হিসেবে সেল হয়। আমরা যে ককের রোস্ট খাই তা মূলত এই লেয়ার মেলই বেশিরভাগ। বাংলাদেশে এই সারপ্লাস মেলগুলোর মার্কেট তৈরি হয়েছে। কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশেই এই মার্কেট টা তৈরি হয়নি। এর কারন সে দেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাস। আমাদের দেশে মানুষ দেশি মুরগির মতো স্ট্রাকচারের যত মুরগি আছে যেমন কক,সোনালি,কালার বার্ড,ফাওমি সব পছন্দ করে। যা অন্যান্য দেশের মানুষ পছন্দ করেনা। তারা ব্রয়লার বা হেভি মিট টাইপের জাতগুলোকেই প্রায়োরিটি দেয়। তাই সে দেশে এই কক মুরগির আলাদা মার্কেট গড়েনি হয়তো। কারন এই ৭০০ কোটি বাচ্চা উৎপাদনে সেইম খরচটাই হয়েছে যা ফিমেল বাচ্চা উৎপাদনে হয়েছে। কোনো কম্পানিই চাইবেনা মার্কেট থাকলে শুধু শুধু এ বাচ্চাগুলোকে মেরেফেলতে।
যে বিজনেস মডেলে সারপ্লাস হিসেবে নিশ্চিতভাবে এই ধরণের হত্যাযজ্ঞ তৈরি হয়, সেটাকে মেনে নেয়ার যে ক্যাপিটালিস্ট লজিকটা সেটা বিকৃত। এটাকে স্রেফ কোম্পানির পলিসি বা কোম্পানির ‘কিছু করার নেই’ টাইপ মনে করার অর্থ আমরা নিজেরাও এই লজিকে চিন্তা করছি বা একে অনেকটা মেনে নিয়েছি।
এই ভয়ঙ্কর কাজটার একটা সুন্দর নাম আছে। Chick Culling বা Male Chick Culling। বাংলাদেশে কী হয় জানি না, কিন্তু বিশ্বের অধিকাংশ জায়গায় এটা পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রির স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস। এবং আমরা সবাই এই প্রক্রিয়ার অংশীদার।
হ্যাঁ, এই নৃশংসতা বন্ধ করতে গেলে নিশ্চিতভাবেই পোল্ট্রি প্রডাকশন কমবে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে, ফ্রাইড চিকেন হয়তো পাওয়া যাবে না। চালানো যাবে না কেএফসির মতো মাল্টিবিলিয়ন ডলার ফ্র্যাঞ্চচাইয। ফাস্ট ফুডের নেশা উপভোগ করা যাবে না যখন তখন। কিন্তু অবিশ্বাস্য মাত্রার এ নিষ্ঠুরতাকে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার বানিয়ে ফেলার চেয়ে কি তা খুব একটা খারাপ হবে?
এমনকি ডেইরি ফার্মগুলোতেও অধিক দুধ উৎপাদনের জন্য দুধেল গরুর বাছুরকে দুধ খেতে দেয়া হয় না। না খাইয়ে মেরে ফেলা হয়। দুধ দোয়ানো হয় ইলেকট্রিক শক দিয়ে।
আলহামদুলিল্লাহ, মহান আল্লাহ আমাদের অনেক নিয়ামত দিয়েছেন। প্রানীজগত থেকে আমরা উপকৃত হতে পারি, এটাও একটা নিয়ামাহ। খাদ্যের জন্য হালালভাবে পশু হত্যা জায়েজ, এবং এটা মানবজাতির জন্য প্রয়োজন। কিন্তু এমন একটা প্রসেসকে কীভাবে সমর্থন করা যায়, যেটার অবশ্যাম্ভাবী সাইড ইফেক্ট হিসেবে বছরে ৭০০ কোটি সদ্যজাত মুরগীকে এতো বীভৎসভাবে হত্যা করা হয়? কীভাবে এখানে হুকুকুল ইবাদ (বান্দার হক) রক্ষিত হয়? কীভাবে রাহমাতুল্লি আলামীনের (ﷺ) এর শিক্ষার সাথে এমন আচরণকে মেলানো যায়?
পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রি কিন্তু এই ৭০০ কোটি শিশু মুরগীকে কোন কাজে লাগাচ্ছে না। এরা স্রেফ সারপ্লাস। বিক্রিয়ার অপদ্রব্য। এর সাথে কুরবানীর অবস্থা মিলিয়ে দেখুন। কুরবানীর পশুর প্রায় প্রতিটি অংশ কাজে লাগে। শুধু একজন ব্যক্তি কিংবা পরিবার না, বরং পুরো সমাজ উপকৃত হয়। কুরবানীর পশুর মাংসের দুই-তৃতীয়াংশ বিলিয়ে দেয়া হয়। কুরবানীর সময় এমন অনেক মানুষ মাংস খেতে পায় বছরের অন্য সময় মাংস খাবার সুযোগ যাদের হয়তো হয় না। কুরবানী কেন্দ্রিক বেচাকেনাতে গ্রামাঞ্চলের মানুষ এবং খামারীরা সুযোগ পায় অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবার। এবং পুরো ব্যাপারটা করা হয় সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির জন্য।
তাই ফাস্টফুডের নির্জীব আত্মকেন্দ্রিকতা, মাল্টিবিলিয়ন ডলার কর্পোরেইশানের নির্জলা প্রফিটমুখীর চিন্তা, আর সারপ্লাস হত্যার সাথে কতো আকাশপাতাল তফাৎ। তবু বছর বছর ইসলামের বিধান কুরবানীর বিরোধিতা করে হাজার হাজার শব্দ লেখা হয়। কিন্তু পুঁজিবাদী পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ আমরা বিনা প্রশ্নে সয়ে যাই। এক বিচিত্র মনস্তত্ত্ব আধুনিকতা আর আধুনিক মানুষের।
দীর্ঘ আলোচনার পূর্বে এসব ‘সভ্য’ সমাজের উদ্ভট ও হাস্যকর কয়েকটি ঘটনার বর্ণনা দেওয়া প্রয়োজন। পাঠকের সুবিধার্থে উল্লেখযোগ্য তিনটি ঘটনা উপস্থাপন করতে চাই।
এক.
পঞ্চদশ শতকের ফ্রান্সের অকটেভ শহরের ঘটনা এটি। সে সময় শহরে ইঁদুরের খুব উপদ্রব ছিলো। মানুষের জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছিলো ইঁদুরগুলো। আদালতে মামলা দায়ের করা হলো-রাস্তার মাঝে এসে অসংখ্য ইঁদুর মানুষের কাজকে বাঁধাগ্রস্থ করে। এরপর অতিদ্রুতই এই মামলায় ইঁদুরের পক্ষে একজন উকিলও নিযুক্ত করা হলো।
প্রথম শুনানির দিনে ইঁদুরের পক্ষের উকিল বিচারককে বললেন, “আদালতের নিয়ম অনুযায়ী দোষীকে আদালতে উপস্থিত থাকতে হবে। কিন্তু, শহরের এতোগুলো ইঁদুরকে একসাথে একত্রে আদালতে হাজির করানো সম্ভব নয়। কেননা, তাদের মাঝে অনেকে অসুস্থ, দুর্বল এবং বয়স্ক হয়ে গিয়েছে। আদালতে তাদের উপস্থিত হওয়াটা খুবই দুঃসাধ্য একটি বিষয়। অতএব, আদালতের উচিত এই বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া।”
প্রথম শুনানি এভাবেই স্থগিত হয়ে যায়।
দ্বিতীয় শুনানির দিনেও ইঁদুররা হাজির না হওয়ার কারণে উকিল বলেন- “ইঁদুররা আসতে চাইলেও পথে অবস্থানকারী কুকুর ও বিড়ালের জন্য তারা আসতে পারেনি। কেননা, কুকুর বিড়ালের নিকট থেকে তাদের মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে। আসামী-পক্ষ যেহেতু নিরাপত্তাজনিত কারণে অনেকেই মনে করেন, হাল সময়েই কেবল পশু-প্রাণীর অধিকারের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। বিষয়টি তেমন নয়। আদালতে উপস্থিত হতে পারছে না, অতএব আদালতের উচিত, তাদের নিরাপত্তার নিশ্চায়ন করা।”
আদালতের পক্ষ থেকে তখন ঘোষণা এলো, ইঁদুরের নিরাপত্তার নিশ্চায়নের জন্য কিছুদিন কুকুর বিড়ালকে রাস্তায় বের করা নিষিদ্ধ। বলার অপেক্ষা রাখে না, এমন ঘোষণায় সাধারণ জনগণ বিরোধিতা করে বসে। মামলাটি তখন দোদুল্যমান অবস্থায় থাকে। একপর্যায়ে গিয়ে আদালত ইঁদুরগুলোকে নির্দোষ রায় দিতে বাধ্য হয়। কেননা, তাদের মতে, ন্যায়বিচারের দাবি হলো, প্রত্যেকেরই অধিকার রয়েছে তার অবস্থান বর্ণনা করার। আর এই সুযোগটা সে না পেলে তাকে মুক্তি দেওয়া অত্যাবশ্যক। এই প্রেক্ষিতেই সমস্ত ইঁদুরকে নির্দোষ হিসেবে রায় প্রদান করা হয়।
দুই.
এই ঘটনাটি মূলত ডিম দেওয়া একটি মুরগীকে নিয়ে। এটিও মধ্যযুগের একটি ঘটনা। ঘটনাটি ঘটেছে ১৪৭৪ সালে সুইজারল্যান্ডের বাল শহরে। সে সময় আদালতে মামলা দায়ের করা হয় যে, কোনো একটি মুরগী ডিম দিয়েছে। যে ডিমের সাহায্য নিয়ে কয়েকজন জাদুকর নিষিদ্ধ রীতিনীতি পালন করেছে।
এরপর, মুরগীটিকে আদালতে উপস্থিত করা হয় এবং মামলাটা নিয়ে যুক্তিতর্ক হয়। মোরগের উকিল বলেন, “মুরগীটি এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নির্দোষ। কেননা, জাদুকরদের চাপে পড়ে তাকে ডিম দিতে হয়েছে। অতএব, আদালতের উচিত না এমন একটি প্রাণীকে শাস্তির রায় শুনিয়ে দেওয়া।”
উকিলের এসব কথা আদালতে ধর্তব্য হয়নি। যুক্তিতর্ক শেষে মুরগীটিই দোষী হিসেবে প্রমাণিত হয়। তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। রায় শুনানোর সময় বিচারক এই ঘটনাটিকে অন্য মুরগীদের জন্য দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা বলে অভিহিত করেন।
তিন.
তৃতীয় ঘটনাটি ঘটে ফ্রান্সে, ১৪৯৪ সালে। ফ্রান্সের সান জুলিয়ান শহরে একটি আঙুর বাগানের মালিক আদালতে মামলা দায়ের করে যে, তার বাগানের আঙুরগুলো পোকা খেয়ে নষ্ট করে ফেলছে। যার কারণে লোকটির প্রচুর অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। পরবর্তীতে এই মামলাটির জন্য অভিজ্ঞ দুইজন উকিলকে নিযুক্ত করা হয়।
একদিন দুইদিন করতে করতে এই মামলাটি চল্লিশ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। একপর্যায়ে এসে উভয়েই বিরক্ত হয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসে যে, বাগানটির একটা অংশ পোকাদের জন্য বরাদ্দ রাখা হবে, যেন তারা বাগানের মূল অংশে এসে ফসলের ক্ষতি করতে না পারে এবং তারা তাদের নির্ধারিত অংশে যা খুশি করতে পারে।
আপনারা হয়তো এখন ভাবতে পারেন, এসব আইনকানুন ও বিচার- ব্যবস্থা ছিলো শুধুই বিনোদনের উদ্দেশ্যে। বরং, তাদের এসব কার্যক্রম, মূলনীতি, আইন, বিচার ব্যবস্থা এবং শাস্তি কার্যকরের পদ্ধতি এটার দিকেই ইঙ্গিত করে যে, তারা এসব বিষয়কে খুবই গুরুত্বের সাথে দেখতো। এমনকি বিচারকগণ তাদের রায় এভাবে লেখতেন যে, “এই প্রাণীটির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে যেন সমাজে শান্তি স্থিতিশীল থাকে।”
অথবা এভাবেও লেখা হতো, “এই প্রাণীটির বর্বরোচিত ও জঘন্যতম অপরাধের কারণে তাকে ক্রুশবিদ্ধ করা হবে।”
শুধু এতটুকুই নয়, তারা প্রাণীদেরকে জাদুকরের শাস্তির সমপর্যায়ের শাস্তি দিতো। জাদুকরের অপরাধের একমাত্র শাস্তি হলো, তাকে পুড়িয়ে মেরে ফেলা। প্রাণীদেরকেও এ পর্যায়ের শাস্তি দেওয়া হতো।
প্রাণীদের শাস্তি কার্যকরের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেই নির্দিষ্ট স্থান বরাদ্দ করে দেওয়া হতো। শাস্তি প্রয়োগের পূর্বে বদ্ধ খাঁচায় করে দোষী প্রাণীটিকে উপস্থিত করা হতো। প্রাণীর সাথে কয়েকজন ধর্মীয় গুরুও উপস্থিত হতেন, যারা সেখানে এসে তাদের ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে শোনাতেন। বিশাল এলাকার ঠিক মাঝখানে একটু উঁচুস্থানে শাস্তি প্রয়োগের বেঁদি তৈরি করা হতো। ধীরলয়ে প্রাণীকে সেখানে উপস্থিত করা হতো। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত ঘোষণা এলে তখন প্রাণীটির শাস্তি কার্যকর করা হতো।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এসব সভ্যতার ‘সভ্য’ মানুষেরা ধারণা করে, প্রকৃতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় মানুষের মতো প্রাণীদেরকেও এসব আইনের আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। এবং সেজন্য বিভিন্ন সভ্যতা বিভিন্ন সময়ে নানারকম উদ্ভট আইনের উদ্ভব ঘটায় ও তার প্রয়োগ করে। আমি কয়েকটা আইনের কথা বলবো।
ইহুদী আইন
ইহুদী আইনে বলা হয়েছে, যদি কোনো ষাঁড় তার শিং দিয়ে কোনো মানুষকে আঘাত করে, আঘাতের কারণে যদি মানুষটা মারা যায়, তাহলে সেই ষাঁড়কে পাথর মেরে হত্যা করতে হবে।
যদি কোনো পশুর এমন আচরণ অভ্যাসগত না হয়, আর হঠাৎ যদি এমন করে বসে এবং এর আঘাতে ব্যক্তিটি আহত হয় বা মৃত্যুবরণ করে, তাহলে এক্ষেত্রে পশুর মালিককে এর জন্য কোনো প্রকার জবাবদিহিতা করতে হবে না। তবে, প্রাণীর এমন আচরণ যদি অভ্যাসগত হয়, প্রতিনিয়তই করে থাকে এবং মালিককেও এই বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে, তাহলে এক্ষেত্রে প্রাণীর পাশাপাশি মালিককেও হত্যা করা হবে।
প্রাচীন গ্রিস
প্রাচীন গ্রিসে রাষ্ট্রের তরফ থেকে স্বতন্ত্র একটি বিভাগই ছিলো, যার কাজ ছিলো প্রাণীদের ‘অপরাধ’-এর জন্য তাদের উপর শাস্তি প্রয়োগ করা। এই বিভাগকে Berteoneon বলা হতো। এটি এমন একটি স্থান ছিলো, যেখানে মানব সমাজের মতোই প্রাণীদের নিয়ে আদালত-এর কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো।
প্লেটো তার LAWS বইয়ে লেখেন-
“যদি কোনো প্রাণী কোনো মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়, তাহলে মৃতব্যক্তির পরিবারের অধিকার রয়েছে যে, সে প্রাণীটিকে ধরে আদালতের নিকট হস্তান্তর করবে এবং নিজেদের পছন্দমতো বিচারক নিযুক্ত করবে।
তবে, যেসব প্রাণীকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মানুষের সাথে সম্মুখ লড়াই বা খেলাধুলার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে, সেসব প্রাণীদের আঘাতের ফলে যদি কোনো ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে, তাহলে সেসব প্রাণীদের কোনো প্রকার সাজা দেওয়া হবে না।
প্রাণীদের শাস্তির বিষয়টি শুধু মানুষ মৃত্যুবরণ করলেই নয়, বরং আহত করার ক্ষেত্রেও তার শাস্তির বিষয়টি প্রযোজ্য। উদাহরণস্বরূপ, কোনো কুকুর কাউকে কামড় দিলে কুকুরটির মালিক কুকুরকে আহত ব্যক্তির নিকট হস্তান্তর করবে। এখন, এই আহত ব্যক্তিটির স্বাধীনতা রয়েছে যে, হত্যা করা থেকে শুরু করে সে যেভাবে ইচ্ছে সেভাবেই প্রাণীটিকে শাস্তি দিতে পারে।
শুধু জীবের ক্ষেত্রেই নয়, বরং জড়বস্তুর ক্ষেত্রেও গ্রিসে আইন প্রচলিত ছিলো। যেমন, কোনো ব্যক্তির উপর কোনো জড়বস্তু পড়ার কারণে মৃত্যুবরণ করলে তার নিকটবর্তী প্রতিবেশি বিচারকের দায়িত্ব পালন করবে। আর এই বিচারকের অধিকার রয়েছে যে, সে ঐ বস্তুটিকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিতে পারবে।
গ্রিসের আরেকটি আশ্চর্যজনক নিয়ম হলো-কোনো ব্যক্তির উপর শাস্তিস্বরূপ মৃত্যুর নির্দেশ এলে শুধু ব্যক্তিকেই নয়, বরং তার সকল সম্পদকে বাজেয়াপ্ত করা হবে, পুড়িয়ে ফেলা হবে। এমনকি, ব্যক্তিটির কোনো পশুসম্পদ থাকলে, সেটাকেও হত্যা করা হবে।
রোমান মূলনীতি
রোমান আইনের একটিতে উল্লেখ রয়েছে যে, জমিতে চাষ করার সময় কোনো চাষীর প্রাণী যদি অপর জমির ক্ষতি করে বসে, তাহলে প্রাণী ও প্রাণীর মালিক উভয়কেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। একটি কুকুরের কামড় দেওয়ার সর্বনিম্ন শাস্তি হলো, আহত ব্যক্তির নিকট প্রাণীটিকে হস্তান্তর করা হবে। এরপর ব্যক্তিটি তার স্বাধীনতা অনুযায়ী তাকে শাস্তি দিতে পারবে। আবার কোনো প্রাণী যদি কোনো ব্যক্তির জমি ও চারণভূমি নষ্ট করে, তাহলে সে প্রাণীকে জমি বা চারণভূমির মালিকের নিকট হস্তান্তর করা হবে।
উল্লেখ্য যে, রোম এবং গ্রিসের এসব উদ্ভট মূলনীতি জার্মানিতেও ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিলো।
প্রাচীন পারস্যের মূলনীতি
প্রাচীন পারস্যের মূলনীতির মধ্যে প্রাণীদের সাথে সম্পর্কিত মূলনীতিগুলো আরো বিস্ময়কর। প্রাচীন পারস্যের মূলনীতির একটি হলো,
যদি কোনো ক্ষিপ্ত কুকুর কাউকে কামড় দেয়, তাহলে তার ডান কান কেটে ফেলে দেওয়া হবে। এরপরেও তার এমন কাজ করার ক্ষমতা থাকলে তার বাম কান কেটে নেওয়া হবে। তৃতীয়বার এমন করলে তার ডান পা এবং চতুর্থবার এমন করলে তার বাম পা কেটে নেওয়া হবে। এরপর পঞ্চমবার তার লেজের সম্পূর্ণ অংশটুকুই কেটে ফেলা হবে।
ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহের ধ্যান-ধারণা
মধ্যযুগে ফ্রান্সকে সবচেয়ে উন্নত দেশ বলে পরিগণিত করা হতো। তেরো শতকে এই দেশই সর্বপ্রথম প্রাণীদের অধিকার নিয়ে স্বতন্ত্র আইন চালু করে। তা প্রয়োগ করার ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করে এবং আদালতও গঠন করে। পুরো ব্যবস্থাটাই হয় মানব অপরাধের বিচারের আদলে সাজানো। এমনকি, মানুষের জন্য যেসব আইন প্রয়োগ করা হতো, প্রাণীদের ক্ষেত্রেও হুবহু সেই আইনই প্রয়োগ করা হতো। চতুর্দশ শতকেও এসব বিষয়ই প্রচলিত ছিলো। পঞ্চদশ শতকের শেষভাগে বেলজিয়াম এবং ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে নেদারল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি ও সুইডেন এসব আইন প্রয়োগ করতে শুরু করে। সিসিলির কিছু অংশে প্রায় ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত এসব আইন জারি ছিলো।
এই সম্পূর্ণ সময়টা জুড়েই প্রাণীদের বিরুদ্ধে আরোপিত যেকোনো মামলা দুইভাবে লিখিত হতো। হয় আহত ব্যক্তি সরাসরি আদালতে এসে বিচার দিতো অথবা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেই মামলা লিখিত হতো। এরপর দোষী প্রাণীটির জন্য কোনো উকিল নিযুক্ত করা হতো, যে আদালতে প্রাণীটির পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতো। এসময় বদ্ধ খাঁচায় করে দোষী প্রাণীটি আদালতে উপস্থিত থাকতো। পরবর্তীতে প্রাণীটি দোষী সাব্যস্ত হলে মানুষের মতোই তার রায় শুনিয়ে দেওয়া হতো। বলি দেওয়া, পুড়িয়ে ফেলা, পাথর মেরে হত্যা বা হত্যার পূর্বে অঙ্গচ্ছেদ করা ইত্যাদি শাস্তিসমূহ নির্দিষ্ট স্থানে জনসাধারণের মাঝে বিশাল আয়োজনরে সাথেই কার্যকর করা হতো।
এমনকি, বর্তমান সময়েও ইউরোপ-আমেরিকায় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন আয়োজন, অনুষ্ঠান এবং বিনোদনের জন্য খেলাচ্ছলে প্রাণীদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। কিন্তু, আজ থেকে চৌদ্দোশত বছর আগে ইসলামী সভ্যতা প্রাণীদের ক্ষেত্রে যে মূলনীতি প্রদান করেছে, তা আজও প্রশংসনীয় হয়ে আসছে। প্রাণীদের ক্ষেত্রে প্রদত্ত এসব মূলনীতি আজ অব্দি কোথাও উপেক্ষিত হয়নি। প্রাণীর প্রতি দয়া, সহানুভূতি, মমত্ববোধ এবং তাদের অধিকার-পূরণ আমাদের সুমহান ইসলামী সভ্যতার অত্যাশ্চর্যজনক একটি বিষয়। আমাদের সভ্যতাকে আরো নূতনত্ব ও অভিনবত্ব দান করেছে দয়া ও ন্যায়ের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাণীদের প্রতি কৃত আমাদের কার্যক্রমসমূহ। তাছাড়া এমন একটি সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাণীদের অধিকার নিয়ে আর কোনো সভ্যতাই সর্বজনীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি, কেবলমাত্র ইসলামী সভ্যতাই এই অঙ্গনে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে।
প্রাণীদের ক্ষেত্রে ইসলামী সভ্যতা প্রদত্ত এসব মূলনীতি সাক্ষ্য দেয় যে, মানবসভ্যতা ও মানবসমাজের মতো প্রাণীদেরও স্বতন্ত্র একটি জগৎ বিদ্যমান, যেখানে তাদের দৃষ্টিকোণ থেকেই তাদের কার্যক্রমসমূহকে বিশ্লেষণ করতে হবে। ইসলামী সভ্যতার মূলনীতির আলোকে প্রাণীজগতের রয়েছে নিজস্ব ধরন, স্বভাব, বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কোরআনের ভাষায়- ভূপৃষ্ঠে যত জীব বিচরণ করে, যত পাখি তাদের ডানার সাহায্যে উড়ে, তারা সকলে তোমাদেরই মতো সৃষ্টির বিভিন্ন প্রকার। আমি কিতাব (লাওহে মাহফুজ)-এ ন্যূনতম ত্রুটিও রাখিনি। অতঃপর তাদের সকলকে তাদের প্রতিপালকের কাছে একত্র করা হবে।”
(সূরা আল-আন’আম : ৩৮)
প্রাণীরাও দয়া ও সহানুভূতির অধিকারী
মানবসমাজ ও মানবসভ্যতার মতো প্রাণীজগতের প্রতিটি প্রাণীই দয়া ও সহানুভূতির অধিকারী। রাসূল (স.) বলেন-
“যে ব্যক্তি অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনও তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়। যে ব্যক্তি প্রকৃতির প্রতি দয়ার্দ্র হয়, দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহ তার প্রতি দয়ার্দ্র হবেন।”
(মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ, তিরমিজী, মুসতাদরাকে হাকীম)
প্রাণীদের প্রতি দয়ার্দ্র ও সহানুভূতিশীল হলে প্রতিদানস্বরূপ সে ব্যক্তি জান্নাতের অধিকারী হবেন। এ মর্মে রাসূল (স.) একটি ঘটনা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন-
“একদা এক ব্যক্তি তৃষ্ণার্ত হয়ে তার তৃষ্ণা নিবারণের জন্য ঘোরাঘুরি করছিলো। অনেকক্ষণ পর সে একটি কূপের দেখা পেয়ে কূপের নিকট এসে উপস্থিত হয়। স্বাভাবিকভাবেই কূপে নেমে সে তার তৃষ্ণা নিবারণ করে। ফেরার পথে সে একটি কুকুরকে তৃষ্ণার্ত হয়ে জিহ্বা বের করে হাঁপাতে দেখে। এমনকি কুকুরটি মরিয়া হয়ে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য ভেজা একটি দেয়াল জিহ্বা দিয়ে পানি পানের চেষ্টা করছিলো। লোকটি তখন কিছুক্ষণ পূর্বের নিজের অবস্থার সাথে কুকুরটির বর্তমান অবস্থার তুলনা করতে পারে। তাৎক্ষণিক সে কূপের নিকট আবারো ফিরে আসে এবং পায়ের মোজায় করে কুকুরটির জন্য পানি নিয়ে আসে। কুকুরটি তৃষ্ণা নিবারণের পর সে-ও আত্মতৃপ্তি পায়। মহান আল্লাহর নিকট তার এই কাজটি খুব পছন্দ হয়। প্রতিদানস্বরূপ তিনি সেই লোকটির সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন।”
সাহাবীরা তখন জিজ্ঞেস করলেন, “প্রাণীদের প্রতি দয়ার্দ্র ও সহানুভূতিশীল হলে আমরাও কি আল্লাহর অনুগ্রহের অধীনস্থ হবো?” রাসূলের (স.) জবাব দিলেন, “পৃথিবীতে বিচরণকারী ও খাবার গ্রহণকারী জীবিত সকল প্রাণীদের প্রতি যে ব্যক্তিই দয়ার্দ্র ও সহানুভূতিশীল হবে, আল্লাহ তাকেই পুরস্কৃত করবেন।”
(বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ, মুয়াত্তা মালেক)
প্রাণীদের প্রতি দয়ার্দ্র ও সহানুভূতিশীল হলে যেমন পুরস্কার রয়েছে, তাদের প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রদর্শনেও তেমনি শাস্তি রয়েছে। রাসূল (স.) এর আরেকটি বর্ণনায় পাওয়া যায়-
“একজন মহিলা শুধুমাত্র একটি স্বভাবের কারণে জাহান্নামের অধিবাসী হবার শাস্তি পেয়েছিলো। তার অপরাধ ছিলো, সে একটি বিড়ালকে কোনো কারণ ব্যতীতই বেঁধে রাখতো, মুক্ত করতো না, খাবার দিতো না, এমনকি বিড়ালটি যেন নিজের খাবার খুঁজে নেয়, সেজন্যও তাকে ছেড়ে দিতো না।”
(সহীহ বুখারী)
প্রাণীদের ক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতি
এসব থেকেই বুঝা যায় মানুষ এবং প্রাণীর মাঝে ইসলাম অবিচ্ছেদ্য একটি বন্ধন তৈরি করে দিয়েছে। এ বিষয়টি থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, কোনো প্রাণীর উপরে তার সাধ্যাতীত বোঝা চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। এমনকি, তার পিঠে বোঝা চাপিয়ে দিয়ে মালিকের গল্পও করা যাবে না। রাসূল (স.)-এর ভাষায়-
“তোমরা তোমাদের প্রাণীদেরকে মালবহনকারী বাহন এবং বসার কেদারা বানিয়ো না।”
(মুসনাদে আহমদ, মুসতাদরাকে হাকীম)
একইভাবে, প্রাণীদেরকে অভুক্ত, অসুস্থ ও দুর্বল করে রাখাও তার মালিকের জন্য নিষিদ্ধ। তাদের জন্য পরিমাণমতো খাবার এবং থাকার জন্য উপযুক্ত পরিবেশের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। একবার রাসূল (স.) হাড্ডিসার একটি উটের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন, যার পেট পিঠের সাথে লেগেছিলো। রাসূল (স.) উটের এমন অবস্থা দেখে বললেন ঠি সাচ্ছে বাকশক্তিহীন অবলা প্রাণীদের সাথে করা তোমাদের আচরণ নিয়ে আল্লাহকে ভয় করো। শুধুমাত্র উপযুক্ত হলেই তবে তাকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করো। এরপর তার শক্তি ফেরত পেতে তাকে বিশ্রামের জন্য। ছেড়ে দেও।”
অনুরূপভাবে, প্রাণীদের থেকে তাদের সাধ্যাতীত কাজ করে নেওয়া তার মালিকের জন্য কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। একবার রাসূল (স.) এক আনসার সাহাবীর বাগানে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি একটি উটকে দেখলেন। উটটি রাসূল (স.)-কে দেখে করুণ স্বরে আর্তনাদ করতে লাগলো এবং তার চোখ বেয়ে পানি পড়তে শুরু করলো। এসব দেখে রাসূল (স.) জিজ্ঞেস করলেন, “এই উটের মালিক কে?”
উটের মালিক রাসূলের নিকট এসে বললো, “আমি, হে আল্লাহর রাসূল।”
রাসূল (স.) তাকে তাৎক্ষণিক জবাব দিলেন, “প্রাণীদের সাথে মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ তোমাকে যে সম্পদ দান করেছে, সে সম্পদ আমার কাছে নালিশ দেয় যে, তুমি তার থেকে কাজ করে নাও বটে, তবে বিনিময়ে তাকে পর্যাপ্ত খাবার দেও না।”
(মুসনাদে আহমাদ)
একইভাবে, খেল-তামাশা ও মজার ছলে বিনোদনের জন্য প্রাণী হত্যাও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। রাসূল (স.) বলেন-
“যদি কেউ খেল-তামাশা ও মজার ছলে বিনোদনের জন্য সামান্য একটি পাখিও হত্যা করে, তাহলে সে পাখিটি বিচার দিবসে আল্লাহর কাছে বিচার দেবে, হে সৃষ্টিকর্তা, এই ব্যক্তিটি খেলার ছলে কোনো কারণ ছাড়াই আমাকে হত্যা করেছিলো।”
(নাসায়ী, ইবনে হিব্বান)
এমনকি, প্রাণীদেরকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে অনুশীলন করার ক্ষেত্রেও কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। রাসূল (স.) বলেছেন- “।যে ব্যক্তি কোনো প্রাণীকে অনুশীলনীর জন্য লক্ষ্যবস্তু বানায়, তার প্রতি আল্লাহর রাসূলের অভিশাপ বর্ষিত হবে।”
এছাড়াও, এনিমেল-ফাইটিং বা বিনোদনের জন্য পশুদের ভেতরের যুদ্ধ লাগিয়ে শক্তিমত্তা বিচার করার যে বিষয়টি মানবসমাজে খুব বেশি প্রচলিত, এই বিষয়টিও ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আবার প্রাণীদের শরীরে স্থায়ীভাবে কোনো কিছু অঙ্কিত করে বিজ্ঞাপন দেওয়াটাকেও ইসলাম অভিশাপ দিয়েছে। যেমন, মুখে নির্দিষ্ট একটি চিহ্ন অঙ্কিত করিয়ে বিজ্ঞাপনের জন্য উপস্থাপন করা। একবার একটি বানরের পাশ দিয়ে রাসূল (স.) হেঁটে যাচ্ছিলেন। বানরটিকে দেখে তিনি বলে উঠলেন- “যে ব্যক্তি বানরটির এই অবস্থা করেছে, আল্লাহর অভিশাপ পড়ুক তার উপর।”
কোনো প্রাণীকে কুরবানী করা বা জবাই করার ক্ষেত্রেও ইসলাম মূলনীতি আরোপ করেছে। জবাই করার ক্ষেত্রে প্রাণীকে কোনো প্রকার কষ্ট দেওয়া যাবে না। তীক্ষ্ণ ও ধারালো ছুরি ব্যবহার করতে হবে। জবাইয়ের পূর্বে প্রাণীকে প্রয়োজনে পানির ব্যবস্থা করে দিতে হবে। জবাইয়ের পর স্থির হবার পূর্বে তার চামড়া ছিলে ফেলা যাবে না। মৃতদেহের অপ্রয়োজনীয় অংশ বা অঙ্গগুলো সর্বোৎকৃষ্টভাবে পরিষ্কার করতে হবে। পরিবেশ দূষিত করা ইসলাম কখনোই সমর্থন করে না। রাসূল (স.) বলেন-
“মানুষের ভেতরে আল্লাহ ফিতরাতগতভাবেই জীবের প্রতি দয়ার্দ্র ও সহানুভূতিশীল হবার বিষয়টি প্রতিস্থাপন করে দিয়েছেন। কোনো প্রাণীকে যদি কুরবানী ও জবাই করতে হয়, তাহলে তা হতে হবে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থায়। যে ব্যক্তি জবাই করবে, তাকে খুবই তীক্ষ্ণ ও ধারালো ছুরি ব্যবহার করতে হবে। জবাইয়ের পর বাকী কাজ সম্পাদনার আগে প্রাণীকে শান্ত হবার জন্য পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে।”
(সহীহ মুসলিম)
প্রাণীদের ক্ষেত্রে ইসলাম এতটা গুরুত্ব দিয়েছে যে, প্রাণীকে কুরবানী বা জবাইয়ের জন্য ফেলে রেখে ছুরি ধার দিতে নিষেধ করেছে। কেননা, এর দ্বারা প্রাণীটি মারাত্মক কষ্ট পেয়ে থাকে। একবার রাসূল (স.) কয়েকজন ব্যক্তিকে জবাইয়ের জন্য ছাগলকে ফেলে দিয়ে ছুরিতে ধার দিতে দেখলেন। তখন রাসূল (স.) বললেন- তোমরা কি চাও ছাগল এভাবে পড়ে থাক এবং এরপর গোশতগুলো নষ্ট হয়ে যাক? তাহলে কেন তোমরা ছরিকে আগে ধারালো করে নাওনি?”
এমন আরেকটি ঘটনায় প্রাণীদের সাথে ইসলামের দয়ার্দ্র ও সহানুভূতিশীল হওয়ার বিষয়টি অসাধারণভাবে ফুটে উঠেছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন-
রাসূল (স.) এর সাথে আমরা একবার সফরে বেরিয়েছিলাম। একটি স্থানে গিয়ে আমরা হামরা নামক পাখি দেখতে পেলাম। সাথে সদ্য জন্ম দেওয়া তার দুটি বাচ্চা ছিলো। আমরা বাচ্চা দুটোকে নিলাম। খানিক পর মা পাখিটিকে আমাদের মাথার উপরে চক্কর কাটতে দেখলাম। বিষয়টি রাসূল (স.) এর দৃষ্টিগোচরে এলে তিনি তৎক্ষণাৎ বললেন, এই মা পাখিটির বাচ্চা নিয়ে কে তাকে এমন চিন্তিত করে দিয়েছে? তোমাদের ভেতরে থেকে যে তার বাচ্চা নিয়েছো, অতিদ্রুত তা ফেরত দিয়ে দেও।
এরপর, একই সফরে রাসূল (স.) জ্বলন্ত আগুনে পিঁপড়ার বাসা ধ্বংস হতে দেখলেন। রাসূল (স.) বললেন, ‘কে এটিকে পুড়িয়েছে?’
আমি বললাম, ‘আমরা করেছি।’
রাসূল (স.) তখন বললেন, ‘একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ কোনো জীবকে আগুন দিয়ে কষ্ট বা শাস্তি দেবার ক্ষমতা রাখে না।”
(আবু দাউদ)
এসব শিক্ষা ও মূলনীতির আলোকেই মানুষ এবং প্রাণীর মাঝে ইসলাম সহানুভূতিশীল ও মমতাবোধসম্পন্ন একটি সম্পর্ক তৈরি করে দিয়েছে, যা ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছে। যেমন, ইসলামের মূলনীতি হলো, প্রাণীদের সকল চাহিদা পূরণ করা একজন মালিকের দায়িত্ব। আর সে যদি তা করতে সক্ষম না হয়, তাহলে সে প্রাণীকে বন্যভূমিতে ছেড়ে দিতে মালিক বাধ্য। আর যদি কোনো প্রাণীকে কুরবানী বা জবাইয়ের জন্য নির্ধারিত করা হয়, তাহলে তা হতে হবে সর্বোত্তম পন্থায়।
ইসলামের মূলনীতিতে এটাও বলা হয়েছে যে, যদি কোনো অন্ধ বিড়াল খাবারের জন্য কোনো বাড়িতে প্রবেশ করে, এরপর সে যদি খাবার খুঁজে না পায়, তাহলে সে বাড়ির মালিকের উচিত হলো সে বিড়ালের খাবারের ব্যবস্থা করে দেওয়া।
প্রাণীদের ক্ষেত্রে আরেকটা মূলনীতি হচ্ছে, কোনো প্রাণীকে তার সাধ্যাতীত বোঝা বহন করানো তার মালিকের জন্য নিষিদ্ধ। বিষয়টা এসেছে সাধারণ একটি বিষয় থেকে। অর্থাৎ, বাজার থেকে কোনো ব্যক্তি বোঝা বহনের জন্য কোনো প্রাণীকে ভাড়া নিলে তাহলে তার পিঠে কতটুকু বোঝা দেওয়া যুক্তিযুক্ত। এ বিষয়টি নিয়ে মুসলিম আইনজ্ঞ ও ফকীহগণের কয়েকটি মতামত রয়েছে। একজন ফকীহ প্রাণীদের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে গাধা ও খচ্চরের ক্ষেত্রে, বোঝা বহনের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দিতে চাইলে অন্য আরেকজন বিরোধিতা করেন। তার বিরোধিতার যুক্তি ছিলো-প্রাণীদের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে গাধা ও খচ্চরের ক্ষেত্রে, বোঝা বহনের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেওয়া উচিত না। কেননা, গাধা ও খচ্চরের শারীরিক গঠন অনুযায়ী প্রাণী দুটি সমপরিমাণ বোঝা বহন করতে সক্ষম নয়।
যেহেতু মানবসভ্যতা ও মানবসমাজের মতো প্রাণীদের ক্ষেত্রেও স্বতন্ত্র একটি জগত বিদ্যমান এবং তাদের রয়েছে নিজস্ব ধরন, স্বভাব, বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্য, সেহেতু সেখানে তাদের দৃষ্টিকোণ থেকেই তাদের কার্যক্রমসমূহকে বিশ্লেষণ করা হবে। অতএব, এটা সম্পূর্ণ অনর্থক যে প্রাণীদের অভ্যন্তরীণ মারামারি-কে মানব সমাজের আলোকে বিশ্লেষণ করা এবং শক্তিশালীকে দুর্বলের উপর ‘অত্যাচার’ করার জন্য শাস্তি প্রয়োগ করা। এরচেয়ে বরং মালিকের উচিত প্রাণীদের সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা। আর এতে যদি তার সক্ষমতা না থাকে, তাহলে তার উচিত প্রাণীদের এসকল কাজের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখা।
প্রাণীদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব
শুধুমাত্র ব্যক্তিগত পর্যায়েই নয়, বরং রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও প্রাণীদের অধিকার নিয়ে ইসলামী সভ্যতায় বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। রাষ্ট্র এবং একজন খলীফার দায়িত্ব হচ্ছে প্রাণীদের অধিকার নিয়ে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করা এবং সে আইন যথাযথভাবে প্রয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। প্রাণীদের প্রতি মালিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য, তাদেরকে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার প্রদান এবং প্রাণীদের ক্ষেত্রে বোঝা বহনের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্র সর্বদা সতর্ক থাকবে।
পঞ্চম খলীফা হিসেবে পরিচিত হযরত উমর বিন আব্দুল আজিজ তাঁর এক চিঠিতে একটি প্রদেশের গভর্নরকে তিনি প্রাণীদের অধিকার সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপদেশ দেন। প্রাণীদের উপর অহেতুক চাবুক মারা, মাত্রাতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেওয়া এবং তাদেরকে উত্তেজিত করার বিষয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিতেন তিনি গভর্নরকে। এসব বিষয় প্রতিহতকরণে প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকেও উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলেন মহান এই খলীফা।
তিনি ট্রাফিক পুলিশ এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের অফিসার-ইন- চার্জকে (সে সময় এই পেশাটি মুহতাসিব নামে পরিচিত ছিলো) নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, সে যেন মানুষের প্রতি সর্বদা সতর্ক থাকে যে, মানুষেরা যেন তাদের প্রাণীদেরকে লাগাম পরানোর ক্ষেত্রেও সাবধানতা অবলম্বন করে, অযথা যেন প্রহার না করে এবং প্রাণীর সাধ্যাতীত বোঝা তার উপর চাপিয়ে না দেয়। এসবের ব্যত্যয় ঘটলে প্রাণীর সাথে বিরূপ আচরণকারীকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার অধিকার রয়েছে অফিসার- ইন-চার্জের।
হযরত উমর বিন আব্দুল আজিজ বলেন-
“অফিসার-ইন-চার্জের অধিকার ও সক্ষমতা রয়েছে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করার। আইন ভঙ্গকারী অর্থাৎ প্রাণীদের অধিকার ক্ষুণ্ণকারীকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার অধিকারও তার রয়েছে। এমনকি, প্রাণীদের অধিকার রক্ষায় এসব আইন মানুষকে বাধ্য করার ক্ষমতাও রয়েছে একজন অফিসার-ইন-চার্জের। মানুষকে ভেতরে কোনো ব্যক্তিকে এই অধিকার দেওয়া হবে না যে, সে তার প্রাণীদের সাথে যাচ্ছে-তাই ব্যবহার করবে, পর্যাপ্ত খাবার পরিবেশন করবে না এবং প্রাণীর উপর তার সাধ্যাতীত ওজনের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হবে।”
“প্রতিটি মালিকেরই উচিত তার প্রাণীদের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করা। তাদের দায়িত্ব এটাই যে, সে তার প্রাণীদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবারের ব্যবস্থা করবে, যেন প্রাণীটির ক্ষুধা পরিপূর্ণভাবে নিবারণ হয়ে যায়। এমনকি, প্রতিটি মালিকের দায়িত্ব হচ্ছে, সে তার প্রাণীদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করবে।”
“জনসাধারণকে এদিকেও সতর্ক থাকতে হবে যে, তারা যেন যত্রতত্র। প্রাণীকে বেঁধে না রাখে। বিশেষ করে যেখানে মানুষের যাতায়াত বেশি। এসবই হলো প্রাণীদের ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিধান।”
প্রাণীদের রক্ষণাবেক্ষণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান
ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও প্রাণীদের অধিকার নিয়ে সর্বদা সচেষ্ট থেকেছে। ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসে আমরা এর প্রমাণ পাই। এমনকি, সে সময়ের সেসব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন নথিপত্র আজও বিভিন্ন স্থানে খুঁজে পাওয়া যায়।
নথিপত্রের আলোকে জানা যায়, ইসলামী সভ্যতায় শুধুমাত্র প্রাণীদের জন্যই, বিশেষ করে তাদের অধিকার পূরণ এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়েছিলো। এসব প্রতিষ্ঠানের অধীনে অসংখ্য পশুচারণ এলাকা ছিলো। মারাজ-এ-আযহার এমনই একটি সুপ্রসিদ্ধ পশুচারণ এলাকা, যেটির তত্ত্বাবধানে ছিলো এলাকাটির স্থানীয় পৌরসভা।
এসব চারণভূমি মূলত সেসব প্রাণীদের জন্যই নির্দিষ্ট ছিলো, যেসব প্রাণী দুর্বল বলে তাদের মালিক তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছিলো। এসব চারণভূমিতে
প্রাণীগুলো তাদের মৃত্যু পর্যন্তই অবস্থান করতে পারতো।
ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসে দামেস্কে অবস্থিত এমন একটি চারণভূমির ঘটনা পাওয়া যায়, যে চারণভূমিটি কেবলমাত্র বিড়ালের জন্যই নির্ধারিত ছিলো। এই চারণভূমিতে প্রায় ১০০টির মতো বিড়াল তাদের খাদ্য ও বাসস্থান পেয়েছিলো। চারণভূমিটিতে বিড়ালগুলো সবকিছু যেমন- খাবার গ্রহণ, ঘুমানো, দৌড়াদৌড়ি, আমোদপ্রমোদ বা বংশ বিস্তার করতে পারলেও তারা অবশ্য সেখান থেকে বেরোতে পারতো না।
ইসলামী সভ্যতার এসব মূলনীতি এবং অসাধারণ ঘটনাসমূহকে এভাবে আলোচনা করলে এটা একপ্রকার একপাক্ষিক হয়ে যায়। পাশাপাশি, অন্যান্য সভ্যতায় প্রাণীদের প্রতি আচরণের বিষয়টি আলোচনা করে তুলনামূলকভাবে বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা না করলে ইসলামী সভ্যতার এসব মূলনীতির শ্রেষ্ঠত্ব পরিপূর্ণভাবে উপলদ্ধি করা যাবে না। অতএব, প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে মধ্যযুগ পর্যন্ত প্রাণীদের প্রতি অন্যান্য সভ্যতার আচরণ এবং প্রাণীদের প্রতি তাদের মনোভাবের দিকে নজর দেওয়া যাক।
ইসলামী সভ্যতা এবং অন্যান্য সভ্যতার মৌলিক পার্থক্যটা হলো, ইসলাম ব্যতীত আর কোনো সভ্যতা প্রাণীদেরকে দয়া ও সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখেনি, প্রাণীদের অধিকার নিয়েও সচেষ্ট হয়নি। যার ফলে ইসলামী সভ্যতা ব্যতীত আর কোনো সভ্যতায় প্রাণীকেন্দ্রিক কোনো প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থাপনার নজির পাওয়া যায় না।
ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, পশু-পাখি ও জীব-জন্তু আল্লাহতায়ালার অনন্য দান ও নিয়ামত। মানুষ হলো আশরাফুল মাখলুকাত আর মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন তামাম সৃষ্টি। যার মধ্যে রয়েছে পশু-প্রাণীও। আল্লাহতায়ালা মানুষের উপকার ও সুবিধার জন্য এসব সৃষ্টি করেছেন। তাই এসবের কোনো ক্ষতি করা চলবে না। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় আমি আদম-সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদের উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদের অনেক সৃষ্ট বস্তুর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। ’ – (সূরা বনি ইসরাইল: ৭০)
হযরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত : রাসুল (সা.) বলেছেন : তোমরা জমির লুক্কায়িত ভা-ারে খাদ্যের অনুসন্ধান কর।’ রাসুল (সা.) কৃষিকাজ ও ফল-ফলাদির গাছ রোপণকে একটি পূণ্যের কাজ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন : কোন মুসলমান যদি গাছ রোপণ করে অথবা কোন ফসল আবাদ করে এবং তা থেকে কোন পাখি বা মানুষ অথবা চতুষ্পদ জন্তু ভক্ষণ করে তবে তা তার জন্য সাদকা বা দানরূপে পরিগণিত হবে।’ (বুখারী-মুসলিম)। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সে যুগে মুসলিম সেনাবাহিনী যুদ্ধে রওনা হওয়ার সময় হযরত আবু বকর ও উমর (রা.) কঠোর নির্দেশ দিতেন যেন তারা বিজিতদের কোন শস্য ক্ষেত নষ্ট না করে। কিতাবুল খারাজে উল্লেখ করা হয়েছে : একবার এক ব্যক্তি উমর (রা.)-এর নিকট অভিযোগ করে যে, মুসলিম সেনাবাহিনী তার একটি শস্য ক্ষেত পদদলিত করেছে। খলিফা ঐ ক্ষেতের ক্ষতিপূরণস্বরূপ বায়তুল মাল হতে দশ হাজার দিরহাম প্রদান করেন।
পশু পালনের উপকারিতা বর্ণনা করতে গিয়ে আল-কোরআনে বলা হয়েছে : ‘আল্লাহতায়ালা সৃষ্টি করেছেন চতুষ্পদ জন্তুকে। এতে (চামড়ায়) তোমাদের জন্য শীত বস্ত্রের উপকরণ আছে। আরও আছে অনেক উপকার এবং কিছু সংখ্যক পশুকে তোমরা আহারে পরিণত কর।’ (সুরা নাহল-৫)। পবিত্র সূরা ইয়াসিনে মহান আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের অসম্ভব রকমের দরদ মাখা ও আবেগময় ভাষায় বলেছেন : তারা কি দেখে না, আমি তাদের জন্য আমার নিজ হাতের তৈরি বস্তু দ্বারা চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছি। অতঃপর তারাই এগুলোর মালিক। আমি এগুলোকে তাদের হাতে অসহায় করে দিয়েছি। ফলে এদের কিছু তাদের বাহন (হিসেবে ব্যবহৃত হয়) এবং কতক তারা ভক্ষণ করে।
হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর পাশ দিয়ে কোনো বিড়াল হেঁটে গেলে তিনি তাকে পানির পাত্র এগিয়ে দিতেন এবং বিড়াল তা থেকে পান করত। ’
কোনো পশু রোগাক্রান্ত হলে তাকে দ্রুত চিকিৎসার বিষয়েও জোর দেওয়া হয়েছে। রোগাক্রান্ত পশুকে সুস্থ পশু থেকে পৃথক রাখতে বলা হয়েছে। যাতে করে অন্য পশু রোগাক্রান্ত না হয়।
পবিত্র কোরআনে বিক্ষিপ্তভাবে প্রায় ২০০ আয়াতে প্রাণিজগতের প্রসঙ্গ এসেছে। এমনকি পৃথকভাবে বিভিন্ন প্রাণীর নামে ছয়টি সুরার নামকরণ করা হয়েছে। যেমন—সুরা বাকারা (গাভি), সুরা আনআম (উট, গরু, বকরি), সুরা নাহল (মৌমাছি), সুরা নামল (পিপীলিকা), সুরা আনকাবুত (মাকড়সা), সুরা ফিল (হাতি) ইত্যাদি। এসব নামকরণ থেকে প্রাণিজগতের প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্ট ফুটে ওঠে।
পশুপাখি মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত। কুদরতিভাবে আল্লাহ এগুলো মানুষের করায়ত্ত করেছেন। এরা করুণার পাত্র। ইসলাম ধর্ম মতে, যথাসম্ভব পশুপাখির সঙ্গে দয়াশীল আচরণ করতে হবে। হাদিস শরিফে এসেছে : ‘যেকোনো প্রাণীর ওপর দয়া করার মধ্যেও সওয়াব আছে।’ (বুখারি, হাদিস : ৬০০৯)
বর্তমানে পশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতা :
মানবজাতি পশু-পাখি লালন-পালন ও মোটা-তাজা করতে গিয়ে তাদের প্রতি অমানবিক আচরণ করে থাকে। অনিরাপদ বাসস্থান, অপর্যাপ্ত ও ভারসাম্যহীন খাদ্য প্রদান, সু-চিকিৎসার অভাবসহ নানাভাবে তারা নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে থাকে। আল্লাহ তাআলা পশু-পাখিকে স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার দিয়েছেন। ইসলামী বিধানে পশু-পাখি লালন-পালন করতে হলে তাদের সার্বিক নিরাপত্তার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং তাদের অধিকার লংঘন ও অমানবিক আচরণে জন্য শাস্তির হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে।
ঢাকা কলেজের ভেতরে একটি কুকুরকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে শিক্ষার্থী ও স্থানীয় দোকানদারদের বিরুদ্ধে। কলেজের শিক্ষার্থী ও কর্মচারীকে কামড় দেওয়ার অভিযোগ এনে কুকুরটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় বলে জানা গেছে। পরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি গাড়ি ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসে গিয়ে মৃত কুকুরটিকে নিয়ে যায়। ওই সময় আরও কয়েকটি জীবিত কুকুরকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এই খবর দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনে প্রকাশিত হওয়ার পর অনেকে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, কুকুরটিকে পিটিয়ে না মেরে সিটি করপোরেশনকে খবর দিলে তারা এসে নিয়ে যেতো বা পশু সংরক্ষক কোনো গ্রুপকে খবর দিলেও তারা একটা ব্যবস্থা নিতে পারতো। তবে, অধিকাংশ মানুষই মনে করেন, শিক্ষার্থী-দোকানদাররা কুকুরটিকে পিটিয়ে মেরে বেশ করেছে। অনেকে বলেছেন, যেমন কর্ম তেমন ফল। কুকুর কামড়ালে কি আদর করবে তাকে? অধিকাংশ মানুষই কুকুর হত্যার পক্ষে।
একটি সমাজের জন্য পিটিয়ে মারার প্রচলনটা খুব খারাপ। আজ আমরা কুকুর ক্ষতি করেছে বলে তাকে পিটিয়ে মারছি, কাল যে একজন মানুষ ক্ষতি করলে তাকে পিটিয়ে বা গলাটিপে মারব না, তাতো নয়। ‘পিটিয়ে হত্যা’ এক ধরনের ভয়াবহ প্রবণতা।
কিছুদিন আগে ঢাকা কলেজের সামনেই শিক্ষার্থীদের একাংশের সঙ্গে দোকানদারদের সংঘর্ষে একজন কুরিয়ার কর্মীকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। কুকুর হত্যার সংবাদের নিচে আমি এই প্রসঙ্গ আনায় অনেককে দেখলাম কুরিয়ারে কর্মরত ওই ছেলেটিকে পিটিয়ে মারার ব্যাপারটিকেও সমর্থন করছেন। বলছেন, ছেলেটির দোষ ছিল বলেই তাকে মরতে হয়েছে।
যাইহোক, প্রসঙ্গত আরও একটি বিষয় বলতে চাই। গত বছর পাকিস্তানে যে ৫ জন মানুষ একটি অন্তঃসত্ত্বা ছাগলকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলেছিল, এটাকে আমরা কী বলবো? এখানেও কি আমরা ছাগলটিকেই অপরাধী করবো এবং বলবো এইভাবে হত্যা করাটা ঠিক হয়েছে? এ থেকেই বোঝা যায় মানুষ পশুর চেয়ে অনেক বেশি হিংস্র হয়ে উঠতে পারে।
জীবের প্রতি দয়ার কথা আমাদের সেভাবে শেখানো হয় না বলেই অসংখ্য নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটছে মানব সমাজে এবং প্রকৃতিতে। শ্রীমঙ্গলে ধান খেত থেকে আহত অবস্থায় একটি মেছোবাঘ উদ্ধার করা হয়েছিল। যার কোমরে কেউ লাঠি দিয়ে আঘাত করেছে। এরমধ্যে সীমান্ত ঘেঁষা নাগর নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল ছোট্ট একটি নীলগাই। স্থানীয়রা নীলগাইটি দেখে এমনভাবে ধাওয়া করে যে সেই ধাওয়ায় পালাতে গিয়ে সেটি মারা যায়। ফেনীর সোনাগাজীতে গভীর রাতে কৃষকের একটি অন্তঃসত্ত্বা গাভী চুরি করে চামড়াসহ গাভীর মাথাটি গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে যায় দুর্বৃত্তরা। এরকম আরও অনেক ঘটনার কথা খবর হয়ে আসে। যেখানে পশুপাখিগুলো কোনো কারণ ছাড়াই মানুষের বর্বরতার শিকার হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ কেন কোনো কারণ ছাড়াই পশুপাখি হত্যা করে? যে তরুণরা টিলার ওপরে আশ্রয় নেওয়া শিয়াল, বাগডাসকে মারলো, যারা বন্যার সময় ঘরে আশ্রয় নেওয়া হরিণটিকে খেয়ে ফেললো, যারা গন্ধগোকুলকে মেরে ফেলল, যারা কুকুরের হাত-পা ভেঙে দিলো, বিড়ালকে দড়িতে ঝুলিয়ে ফাঁসি দিলো, আহত শামুকখোল পাখিদের রান্না করে খেয়ে ফেললো, বিষ খাইয়ে মাছ, বানর ও পাখি মেরে ফেললো—এরা আসলে খুনি। আজ এরা বিনা প্রয়োজনে পশুপাখি খুন করছে, কাল মানুষ খুন করবে। যেমনভাবে খুন করেছে আবরারকে।
পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা এক ধরনের মানসিক বিকৃতি বা অসুস্থতা। স্কুলে থাকতে একটা বইয়ে পড়েছিলাম, মানুষই এই জীবজগতে সবচেয়ে বেশি নৃশংস। কারণ একমাত্র মানুষই পারে অপ্রয়োজনে বা তুচ্ছ কারণে ভয়ংকরভাবে মানুষ ও পশুপাখিকে হত্যা করতে। আর কোনো জীব তা পারে না। এমনকি খুব বিষধর সাপও হঠাৎ মানুষকে আক্রমণ করে না।
রাজবাড়ীতে একটি ঘোড়ার ৪ পা বেঁধে পায়ুপথে ও মূত্রনালিতে বাঁশের লাঠি ঢুকিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। শত্রুতা ছিল ঘোড়ার মালিকের সঙ্গে, কিন্তু মরতে হলো ঘোড়াটিকে। একইভাবে হত্যা করা হয়েছিল বগুড়ার কাহালু এবিসি টাইলস কারখানায় রাসেলকে ও রুবেলকে। খুলনায় শিশু রাকিব ও নারায়ণগঞ্জে শিশু সাগর বর্মণকে একইভাবে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।
মানুষের প্রতি মানুষের ‘ভায়োলেন্স’ বা সহিংসতার সূত্রপাত হয় পশুপাখির প্রতি ‘ভায়োলেন্স’ থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই একটা প্রতিবেদনে বলেছিল, তাদের দেশে অধিকাংশ সিরিয়াল কিলারদের ‘অ্যানিমেল অ্যাবিউজ’ করার ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ আছে। যদি ছোটবেলা থেকে প্রাণীদের ওপর নির্যাতন করার প্রবণতা কারো থাকে এবং কেউ যদি এ নিয়ে শিশুকে সাবধান না করে, তাহলে তারা বড় হয়ে মানুষের প্রতিও অমানবিক আচরণ করে থাকে।
বাংলাদেশে যখন পশুপাখির ওপর নির্দয় আচরণ করা হয়, তখন কখনো দেখিনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়, ব্যবসায়ী মহল, রাজনীতিবিদ, আমলা, তারকা বা অন্য পেশাজীবী এ নিয়ে উদ্বেগ বা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং অপরাধীর বিচার দাবী করেছেন। পশুপাখি সংরক্ষণে ১৯২০ সালে প্রণীত একটি আইন থাকলেও এর তেমন কোনো কার্যকারিতা চোখে পড়ে না। এই আইনটিকে আধুনিক করা প্রয়োজন। সেইসঙ্গে প্রয়োজন জনসচেতনতা সৃষ্টি করা।
পশুপাখি, গাছপালা মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িত। পশুপাখি কখনো বুদ্ধি খাটিয়ে কারো ক্ষতি করে না বা কাউকে হত্যা করে না। মাঝেমধ্যে যা করে, সেটা তাদের সহজাত প্রবৃত্তির বশেই করে। অন্য কোনো প্রাণী আক্রান্ত না হলে সাধারণত অন্যকে আঘাত করে না, কিন্তু মানুষ করে। আমরা অনেকেই জীবজগতকে ভালবাসতে শিখিনি। এই একই কারণে মানুষকেও ঠিকমতো ভালবাসতে পারিনি। পশুপাখির পাপ-পুণ্যের হিসাব হয় না, কিন্তু মানুষের হয়। কুকুর পাগল হয়ে মানুষকে কামড়াতে পারে, মানুষ কুকুরকে বা অন্য প্রাণীকে এভাবে কামড়াতে পারে না।
আমাদের সমাজে ছোটবেলা থেকে সাধারণত পশুপাখির প্রতি দয়া দেখানোর কথা শেখানো হয় না। অবশ্য মানুষের প্রতিও দয়া বা ভালবাসা দেখানোর উদাহরণও খুব কম। পরিবারে, স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের শেখাতে হবে মানুষ, বৃক্ষ ও জীবকে সমানভাবে দয়া করার কথা।
লোকেরা বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! জীবজন্তুর প্রতি দয়া প্রদর্শনেও কি আমাদের সওয়াব আছে?’ তিনি বললেন, ‘প্রত্যেক প্রাণবিশিষ্ট জীবের (প্রতি দয়া প্রদর্শনে) সওয়াব বিদ্যমান।’ তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগা ছাড়া অন্য কারো (হৃদয়) থেকে দয়া ছিনিয়ে নেওয়া হয় না।’
কিছু সত্যিকারার্থেই মানুষ এতটা নিষ্ঠুর এবং দুর্ভাগা, একবার খাবার খুঁজতে খুঁজতে একটি মেছো বাঘ খালের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। গ্রামের সবাই একজোট হয়ে ধাওয়া করে তাকে পিটিয়ে মেরেই ক্ষান্ত হয়নি, নিরীহ মেছোবাঘটির মরদেহ ঝুলিয়ে রেখেছিল গাছের ডালে। এরপর কাঁধে তুলে পুরো গ্রাম চক্কর দিয়ে উল্লাস করেছে গ্রামের কিছু তরুণ। ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে প্রচার করেছে বাঘটা মেরে তাদের বীরত্বের গল্প। দু’বছর আগে ফেনীর সোনাগাজীতে গভীর রাতে কৃষকের একটি অন্তঃসত্ত্বা গাভী চুরি করে চামড়াযুক্ত গাভীর মাথা গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে যায় দুর্বৃত্তরা। চট্টগ্রামে একজন প্রবাসী এক হরিণ শাবককে খাবার দিয়ে ভুলিয়ে কাছে এনে গুলি করে হত্যা করল এবং পরে মৃত হরিণের পাশে দাঁড়িয়ে সদলবলে ফটোসেশন করল। পুরো দৃশ্যটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভিডিও চিত্র শেয়ারও করেছিল সেই প্রবাসী বাঙালি। লালমনিরহাটে কৃষকের ধান খেয়েছে বলে প্রাণ দিতে হয়েছে শতাধিক পাখিকে। এগুলো সব নিউজ হয়ে এসেছে। রাজধানীতে দুই মা কুকুরসহ ১৪টি বাচ্চাকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হয়েছিল। মনিপুরি পাড়ায় বাথরুমে বন্দি করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় আরেক কুকুরকে। হত্যার ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল করা হয়।
আজকে যে প্রকৃতি বিরূপ হয়ে উঠেছে আমাদের প্রতি, তা মানুষের অপকর্মেরই ফল। একটা প্রবাদ আমরা সবসময় শুনে এসেছি, ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’।
বাংলাদেশে পশুপাখি ও গরিব মানুষের মৃত্যুর মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য তো দেখছি না। সেই যে নারায়ণগঞ্জে আগুনে পোড়া ৫২টি শিশুর মরদেহ আর এই চারশ পশুপাখির মধ্যে কি কোন ফারাক খুঁজে পাওয়া যায়? যায় না। ঢাকার সাভারে তীব্র জ্যামে আটকা পড়ে প্রচণ্ড গরমে মারা গেছে ২৭ মণের একটি গরু। অসুস্থ হয়ে পড়েছে আরও পাঁচটি। পাবনা থেকে এসব গরু আনা হচ্ছিল কোরবানির জন্য। সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দামের এই গরুটিকে নিশ্চয় বিশেষ আদর-যত্ন করেই কোরবানির জন্য তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু, কোরবানির ময়দানে পৌঁছানোর আগেই গরুটির জান কোরবান হয়ে গেল। অনেক জায়গায় গরু অসুস্থ হওয়ার খবরও আসছে। পশুবাহী গাড়ির ক্ষেত্রে আমাদের আলাদা কোনো নির্দেশনা নেই। তীব্র যানজটের সঙ্গে প্রচণ্ড গরমে ছটফট করতে করতে শরীয়তপুর-চাঁদপুর ফেরিঘাটে এ পর্যন্ত ২০টি গরু মারা গেছে। নিরুপায় ব্যবসায়ীরা ক্ষতির কথা ভেবে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। একজন পশুপ্রেমী হিসেবে আমিতো কষ্ট পাচ্ছি।
কেন ঈদের সময় আমরা পশু পারাপার ও রাজধানীতে আনার সময় ন্যনতম মানবিকতা দেখায় না, কেন ভাবি না ওরা কীভাবে আরাম করে আসতে পারে? কেন আমরা এমন কোনো সিস্টেম চালু করি না- যাতে মৃত্যুর আগে প্রাণীটির যাত্রা নিরাপদ ও সুখের হয়।
কোরবানির মতো একটি পবিত্র কাজে যার জীবনকে উৎসর্গ করা হচ্ছে, সে বা তারা আমাদের কাছে এতটা মূল্যহীন ও অনাদরের হয় কীভাবে? এদের মূল্য তো নিজের সন্তানের মতোই প্রিয় হওয়া উচিত। পশু ব্যবসায়ীরা নিজেদের সম্বল ও পুঁজি বাঁচাতে ফেরির সংখ্যা বাড়ানো ও দ্রুত পারাপারের দাবি জানাচ্ছেন- আর আমরা মানবিকতার স্বার্থেই চাইছি এদের জন্য একটু ভালবাসা, একটু সুবিধা। অধিকাংশ মানুষের মনে পশুপাখির প্রতি ভালবাসা প্রায় নেই বললেই চলে। এদের আমরা শুধু পশু হিসেবেই বিবেচনা করি। কাজেই এরা কষ্ট পেলে আমাদের কারো কিছু এসে যায় না। সে কোরবানির পশুই হোক, অথবা অন্য পশুই হোক।
প্রায়শ:ই না জেনে এটি বলা হয়ে থাকে মুসলমানেরা গো হত্যায় সবচাইতে এগিয়ে। অথচ পরিসংখ্যানে দেখা যায় পার কেপিটা মিট কনজাম্পসনের তালিকার প্রথম ৫০ টি দেশের ৩টি কি ৪টি মুসলিম দেশ। কাজাখাস্তান, সৌদি আরব, তুরস্ক।
অথচ প্রথম সারির দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে (১০) চেক প্রজাতন্ত্র, ইউরোপের সবচাইতে নাস্তিকদের বাস যে দেশটিতে। আজ সবচাইতে বেশি শুয়োর খায় যে ডেনমার্ক সেখানে নাস্তিকেরা আনুপাতিক হারে পৃথিবীর ৩য় স্থান দখল করে আছে।২য় স্থানে আছে চেকরা। ১৯ নাম্বারে আছে চীন। পৃথিবীতে মাংস গ্রহনের (মাথাপিছু কেজি) তালিকা : {কেজি/প্রতিজন (২০০৯)}
- অস্ট্রেলিয়া ১১১.৫
- যুক্তরাজ্য ৮৪.২
- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১২০.২
- ভারত ৪.৪ হিন্দু ধর্ম
- থাইল্যান্ড ২৫.৮ বৌদ্ধ ধর্ম ৯৩.২০% (বৌদ্ধ ধর্মে প্রানী হত্যা মহাপাপ)
- জাপান ৪৫.৯ শিনতো ধর্ম ৬৭%
- শ্রীলঙ্কা ৬.৩ বৌদ্ধ ধর্ম ৭০.২%
থ্যাংকস গিভিং ডের প্রধান মেনু হল টারকি। থ্যাংকস গিভিং ডে, যা কানাডাতে ঘটা করে পালন করা হয়, শ্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য, ভালো ফসলের জন্য। তাহলে এটাও কি উৎসব করে একটি প্রাণী হত্যা নয়কি! প্রায় সাড়ে চার কোটি টারকি খাওয়া হয় শুধু এই দিনটিতে!
মিয়ানমারে মুসলিম নিধন, ইরাক আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনী কর্তৃক মুসলিম নিধন, ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্থিনি নিধন, ভারত কর্তৃক কাশ্মিরী নিধন – মানব সভ্যতা বিকারহীন।
মুসলমান কর্তৃক গরু নিধন – মানব সভ্যতা সোচ্চার।
শেষ কথা
হিটলার নিরামিষভোজী ছিলেন। পশুপাখিকে খুবই ভালবাসতেন। তার সাথে অতিথিরা যখন ভোজসভায় অংশগ্রহন করতেন তখন তিনি তাদেরকে শুনাতেন কি নৃশংসভাবে পশুগুলোকে জবাই করা হয় কসাইখানাতে। ফলে অভ্যাগতরা লজ্জায় মাংস খাওয়া থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখতেন। হিটলার সৈন্যদের জন্য খাদ্য হিসাবে ফলমূল আর শাকসব্জিকে প্রাধান্য দিতেন। পশুপ্রেমি হিটলারের পশু মারতে গিয়ে কলজে কেপে উঠলেও লক্ষ কোটি মানুষ মারতে তার মন একটু কাপেনি।
তাই সম্পূর্ণ পর্যালোচনা থেকে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে-
১. প্রাচীনকাল হোক আর মধ্যযুগেই হোক, ইসলামী সভ্যতাই সর্বপ্রথম প্রাণীদের জন্য সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে অধিকার পূরণের ব্যবস্থা করে। ইসলামী সভ্যতা ব্যতীত আর কোনো সভ্যতাতে প্রাণীদের নিয়ে এতো বিস্তৃত আকারে গবেষণা ও কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়নি।
২. আজকের এই তথাকথিত আধুনিক সভ্যতা প্রাণী-অধিকারের যেসব বুলি আওড়িয়ে থাকে, যেসব সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করে থাকে, তা মূলত ইসলামী সভ্যতার ঘটনাগুলোকে চুরি করে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে উপস্থাপন করা। অথচ, এসব অবলা ও বোবা প্রাণীদের সাথে ইসলামী সভ্যতায় কেমন আচরণ করা হয়েছে, তার প্রমাণ আমাদের নিকট সুস্পষ্ট।
মূলত, প্রাণীদের উপর আরোপিত অন্যায় থেকে ইসলামী সভ্যতাই তাদেরকে মুক্ত করে দিয়েছে, তাদের অধিকার প্রদান করেছে। ইসলামী সভ্যতাই প্রাণীদের নিয়ে খেল-তামাশার বিষয়টি বন্ধ করেছে। এই সভ্যতাই এনিমেল ফাইটিং হারাম ঘোষণা করেছে। অথচ, এই বিষয়টিই গ্রিক ও রোমান সভ্যতা এবং স্পেনে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে প্রচলিত ছিলো। এমনকি, স্পেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন অংশে এখনো এই খেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, মধ্যযুগে ইউরোপ যখন মূর্খ, বর্বর ও নিষ্ঠুর ছিলো, ইসলামী সভ্যতা তখন তার উন্নতির সর্বোচ্চ চূড়ায় অবস্থান করছিলো। অতএব, মানবতা বিবর্জিত এবং হাস্যকর এসব ইউরোপীয় সংস্কৃতি থেকে ইসলাম সর্বদাই মুক্ত।
তথ্যসূত্র :
ইসলামী সভ্যতার গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস – ড. মুস্তফা সিবাই