শিউলিমালা একাডেমি

ইসলামী সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য

ইসলামী সংস্কৃতির প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তাওহীদ। তাওহীদ বা একত্ববাদ বলতে বুঝায় আল্লাহ তা’আলার নিরঙ্কুশ এককত্বের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন। তাওহীদ ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিক সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা উপস্থাপন করে। ইতিবাচক ধারণা এই যে, বিশ্বজাহানে একজন এক ও একক সৃষ্টিকর্তা আছেন। আর নেতিবাচক ধারণা এই যে, তাঁর মতো কেউ নেই- কিছু নেই; কেউ হতে পারে না তাঁর সমতুল্য। গোটা বিশ্বজাহানে তিনি একক ইখতিয়ারসম্পন্ন ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী সত্তা। তিনি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন; যা ইচ্ছা তারই ফয়সালা করেন-আদেশ ও নির্দেশ দেন। ইসলামের দৃষ্টিতে তাওহীদের ধারণা পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ। ‘ইলাহ’ হিসেবেও তিনি এক ও একক। তিনি ছাড়া আর কোনো ‘ইলাহ’ নেই এবং ‘ইলাহ’ হওয়ার যাবতীয় বৈশিষ্ট্য কেবল এককভাবে তাঁরই জন্যে শোভনীয়। তাঁর সত্তায় ই নিহিত।

স্রষ্টা বা খোদাকে ‘এক’ বলে জানার ও মানার কথা অন্যান্য ধর্মে ও সংস্কৃতিতে স্বীকৃত হলেও তাতে রয়েছে অসংখ্য ভুল ও ভ্রান্তি। কেউ তাকে একটি শক্তিমাত্র মনে করেছে। কেউ মনে করেছে প্রথম কার্যকারণ (First cause of causes)। কেউ তাঁর সাথে বংশধারাকে সংযোজিত করেছে। কেউ কেউ আবার তাঁকে আকার-আকৃতি বিশিষ্ট মনে করেছে। কিন্তু ইসলামের তাওহীদী ধারণা এসব কলুষতা থেকে মুক্ত ও পরিচ্ছন্ন। ইসলামের খোদা পবিত্র ও মহান সত্তার অধিকারী। তাঁর সত্তা যাবতীয় মহৎ গুণে ভূষিত। তিনি কারোর মুখাপেক্ষী নন, সবকিছু বরং তাঁরই মুখাপেক্ষী। তিনি সর্ববিধ জ্ঞানের অধিকারী। তাঁর রহমত সর্বব্যাপক। তাঁর শক্তি ও ক্ষমতা সর্বজয়ী। তাঁর হিকমত ও সুবিচার নীতিতে কোন ত্রুটি বা বিচ্যুতি নেই। তিনি জীবনদাতা ও জীবন সামগ্রীর একমাত্র পরিবেশক। ক্ষতি ও কল্যাণের যাবতীয় শক্তি তাঁরই হাতে নিবদ্ধ।

হিসাব-নিকাশ এবং শাস্তি ও পুরস্কার তাঁরই ইখতিয়ারভুক্ত। তিনিই চিরন্তন মা’বুদ, অবিনশ্বর ইলাহ। পূর্ণত্বের সব গুণ তাঁরই সত্তায় নিহিত। তাঁর কোনো গুণ-বৈশিষ্ট্যে নেই একবিন্দু দোষ-ত্রুটি। বস্তুত খোদা সম্পর্কে এ ধারণা অত্যন্ত ইতিবাচক। এরই পাশাপাশি রয়েছে নেতিবাচক ধারণাও অর্থাৎ খোদার এ মহৎ গুণাবলী খোদা ছাড়া আর কারোর মধ্যে নেই। খোদা সম্পর্কে যা কিছু বলা হয়, তা আর কারোর সম্পর্কেই বলা যেতে পারে না। বিশ্বলোকের অন্য কোন শক্তি বা সত্তা এই গুণাবলীর অধিকারী নয়। এ কারণে অপর কেউই  ‘ইলাহ’ হতে পারে না।

ইসলামের তাওহীদী ধারণা পূর্ণতার একটি অপরিহার্য দিক হলো নবুয়‍্যাত বা রিসালাত বিশ্বাস। তাওহীদী ধারণায় আল্লাহ-ই যেহেতু সর্ব ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ফয়সালা গ্রহণকারী, একমাত্র বিধানদাতা, তাই মানুষের নিকট তাঁর বিধান পৌঁছানোর মাধ্যম হলো এই রিসালাত বা নবুয়্যত। এ জন্যে মানব সমাজের মধ্যে হতেই এক এক ব্যক্তিকে তিনি নিজ ইচ্ছানুযায়ী বাছাই করে নেন এবং এ কাজ সম্পাদনের জন্যে মনোনীত করেন। মানুষের ইতিহাসে এ ধরনের বহু মনোনীত পুরুষের আবির্ভাব ঘটেছে এ দুনিয়ায়। এদের মধ্যে সর্বশেষ ও পূর্ণ-পরিণত ব্যক্তি হচ্ছেন হযরত মুহাম্মাদ (স.)। তিনি কিয়ামত অবধি সমস্ত মানুষের জন্যে রাসূল।

বস্তুত নবুয়্যত ও রিসালাত মানুষের বিবেক, বুদ্ধি চিন্তা ও কর্মের দিক দিয়ে একটি অপরিহার্য প্রয়োজন। মানুষের জীবনে যতটা প্রয়োজন খাদ্য পোশাকের, তার চাইতেও অধিক প্রয়োজন এই রিসালাতের। মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও জাতীয় জীবনে যেসব আইন বিধানের প্রয়োজন, তা সবই এই রিসালাতের মাধ্যমে পূরণ হয়েছে। আর এসব আইন বিধানের ভিত্তিতে মানুষের জীবন যতোটা উন্নত মানে চলতে পারে, ততোটা উন্নত মান অপর কোন বিধানের সাহায্যেই অর্জিত হতে পারে না। এখন মানুষ যদি নবুয়্যত বা রিসালাতকে গ্রহণ না করে তাহলে নিজের জন্যে প্রয়োজনীয় আইন-বিধান হয় সে নিজেই রচনা করবে, নচেৎ অপর কোন মানুষকে তার রচনার অধিকার দিতে হবে কিংবা বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষকে বিভিন্ন পর্যায়ের জীবনের জন্যে প্রয়োজনীয় আইন-বিধান রচনার দায়িত্ব অর্পণ করতে হবে অথবা প্রতিটি জনসমাজ নতুন করে আইন-বিধান রচনার পরিবর্তে প্রচলিত রসম-রেওয়াজের আশ্রয়ে জীবন পরিচালিত করবে। এছাড়া মানুষের সামনে অন্য কোন উপায় আছে কি? কিন্তু বর্ণিত উপায়সমূহ গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টত দেখা যাবে, এর কোনো একটি উপায়ও মানুষকে নিশ্চিত ও সন্দেহাতীত জ্ঞানের সন্ধান দিতে সমর্থ নয়। এ কারণে মানুষ তার সীমাবদ্ধ পর্যবেক্ষণ ও জ্ঞান বুদ্ধির সাহায্যে কোন সর্বজনীন, সর্বকালীন ও সর্ব মানুষের জন্যে কল্যাণকর বিধান রচনা করতে পারে না; বরং তার (মানুষের) মানসিক যোগ্যতার সীমাবদ্ধতা ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের পার্থক্যের কারণে মানব-সমাজের বিভিন্ন অংশ চরম দুর্গতি ভোগ করে আসছে যুগ যুগ ধরে। দুনিয়ায় সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের মূলে প্রধানত এ কারণটিই নিহিত।

এদিক থেকে বিবেচনা করলে মানুষকে শেষ পর্যন্ত মহান সৃষ্টিকর্তার দেয়া বিধানের নিকটই আত্মসমর্পণ করতে হয়- এছাড়া তার আর কোনোই উপায় নেই। ইসলামের দাবী হল, মানুষের মর্যাদা রক্ষা তথা সুষ্ঠু ও সুন্দর জীবন যাপনের জন্যে প্রয়োজনীয় আইন-বিধান দানের অধিকার কেবল আল্লাহরই রয়েছে। রিসালত হচ্ছে এ বিধান দানের একমাত্র মাধ্যম। রাসূল তার বিশেষ ধরনের যোগ্যতা-প্রতিভা ও খোদায়ী নিয়ন্ত্রণ লাভের কারণে সাধারণ মানুষ থেকে স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনি আল্লাহর বিধানকে যথাযথভাবে পৌঁছানো ও তার বাস্তবায়নে পূর্ণ শক্তি নিয়োজিত করেন। তাই আল্লাহর বিধান সঠিকভাবে লাভ করতে মানুষের কোন অসুবিধা হয়নি। বস্তুত রাসূলের উপস্থাপিত বিধানে সর্বশ্রেণীর মানুষের এবং জীবনের সকল দিক ও বিভাগের জন্যে প্রয়োজনীয় আইন-কানুন বর্তমান। মানব জীবনের সমগ্র দিক ও বিভাগে সামঞ্জস্য রক্ষা করা কেবলমাত্র এই রাসূল-বিশ্বাসের সাহায্যেই সম্ভবপর।

রিসালাত বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে তাওহীদী আকীদার আরো একটি অপরিহার্য দিক হলো পরকাল বিশ্বাস। বস্তুত ইসলামী সংস্কৃতি আধ্যাত্মিক কাঠামোর তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো আল্লাহর নিকট জবাবদিহীর সন্দেহাতীত বিশ্বাস। এ বিশ্বাসই মানুষের চিন্তা ও কর্মকে পবিত্র ও নির্দোষ করে তোলে। মানুষের তাগিদেই জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ-ভীতি ও তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করতে বাধ্য হয়। এক পরিপূর্ণ চিন্তা-ব্যবস্থা ও যুক্তিধারার ওপর ভিত্তিশীল হচ্ছে এই আকীদাটি। মানুষের নৈতিক সুস্থতার জন্যে এর মতো প্রভাবশীল দৃঢ় ভিত্তি আর কিছুই হতে পারে না। এ আকীদার মূল কথা হল, মানুষ প্রতিটি বিষয়ের জন্যে নিজেকে দায়িত্বশীল মনে করবে। কোনরূপ বাহ্যিক চাপ, প্রলোভন ও লালসা ছাড়াই মনের ঐকান্তিক তাগিদে সে আল্লাহর বিধান পালন করে চলবে। এই হলো পরকাল বিশ্বাসের লক্ষ্য।

 মানবতার সম্মান

ইসলামী সংস্কৃতির দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল মানবতার সম্মান। মানুষ ‘মানুষ’ হিসেবেই সম্মানার্থী। মানবতার এই সম্মান নির্বিশেষ-পার্থক্যহীন। মানুষে মানুষে নেই কোনরূপ তারতম্য। উঁচু- নীচু ও আশরাফ-আতরাফের বিভেদ মানবতার পক্ষে চরম অপমান স্বরূপ। সমাজের সব মানুষই সমান মর্যাদা ও অধিকার পাওয়ার যোগ্য। সুতরাং আইনের দৃষ্টিতেও কোনরূপ পার্থক্য ও বৈষম্য করা চলতে পারে না। ইসলামী সংস্কৃতির দৃষ্টিতে ধনী-গরীব, শিক্ষিত- অশিক্ষিত, উচ্চ পদাধিকারী ও নিম্নপদস্থ কর্মচারী, গ্রামবাসী ও শহরবাসী, নারী আর পুরুষ- ইত্যাদির মধ্যে কোনই পার্থক্য বা বৈষম্য স্বীকৃতব্য নয়। ইসলামী সংস্কৃতি এ ধরনের কৃত্রিম বিভেদ-বৈষম্যকে নিঃশেষ ও নির্মূল করে দিয়ে সব মানুষকে একই মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। বংশ, বর্ণ, ভাষা, স্বদেশিকতা, আঞ্চলিকতা, শাসন-সংস্থা এ ধরনের কৃত্রিম ভেদ-বৈষম্যকে নিঃশেষ ও নির্মূল করে দিয়ে সব মানুষকে একই মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। এসব দিক দিয়ে মানুষের মাঝে কোনরূপ পার্থক্য সৃষ্টি করা ইসলামী সংস্কৃতির পরিপন্থী। ইসলামী সংস্কৃতিতে সব মানুষের সম্মান, মর্যাদা, অধিকার, ক্ষমতা সর্বতোভাবে সমান। এখানে পার্থক্য কেবলমাত্র একটি দিক দিয়েই করা হয়। তা হলো মানুষের চিন্তা-বিশ্বাস ও বাস্তব জীবনধারা। অন্য কথায়, কুফর ও ইসলাম এবং ইসলামী সমাজের তাকওয়ার বিভিন্ন মানগত অবস্থা হচ্ছে পার্থক্যের মাপকাঠি।

ইসলামী সংস্কৃতি উঁচু-নীচুর অন্যসব ব্যবধান নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। মানবতার ইতিহাসে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত এ সাম্যের কোনই তুলনা নেই। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের এ সাম্য দুনিয়ার অপর কোন সংস্কৃতিই কায়েম করতে পারেনি।

 বিশ্ব-ব্যাপকতা ও সর্বজনীনতা

ইসলামী সংস্কৃতি এক সর্বজনীন সংস্কৃতি। তা বিশেষ কোনো গোত্র, বর্ণ, শ্রেণী, বংশ, কাল বা অঞ্চলের উত্তরাধিকার নয়। তার সীমা-পরিধি সমগ্র বিশ্বলোক এবং গোটা মানববংশে পরিব্যাপ্ত ও বিস্তীর্ণ। তাতে বিশেষ ভাষা বা বংশের দৃষ্টিতে কোন সংকীর্ণতার অবকাশ নেই। ইসলামী সংস্কৃতির এ হলো তৃতীয় বৈশিষ্ট্য। আল্লাহর একত্ব ও হযরত মুহাম্মদ স. এর রিসালাতে বিশ্বাসী প্রত্যেক ব্যক্তিই এ সংস্কৃতির অধিকারী- সে যে ভাষায় কথা বলুক, তার গায়ের বর্ণ যা-ই হোক, সে প্রাচ্য দেশীয় হোক, কি পাশ্চাত্য দেশীয়। তার আচার- আচরণ ও জীবনযাত্রা ইসলামী ভাবধারায় পরিপুষ্ট, ইসলামী রঙে রঙীন- এটুকুই যথেষ্ট। এ কারণেই ইসলামী সংস্কৃতি ব্যাপক ও সর্বাত্মক ভূমিকার অধিকারী।

 বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ব

ইসলামী সংস্কৃতির ভিত্তি হলো দ্বীন রক্ত সম্পর্ক এর তুলনায় একেবারেই গৌণ। তাই এ দুটির কোন একটিকে অগ্রাধিকার দেয়ার প্রশ্ন উঠলে দ্বীনী সম্পর্কের দিকটিই প্রাধান্য পাওয়ার অধিকারী হবে। ইতিহাসে এ সংস্কৃতির প্রথম প্রকাশ ঘটেছে হিজরতের পরে নবী করীম রচিত সমাজ সংস্থায় বহিরাগত এবং স্থানীয় লোকদের পারস্পরিক ভ্রাতৃ-সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে। এ ভ্রাতৃত্ব রক্ত-সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল না। ভাষার, বর্ণের বা স্বাদেশিকতার ভিত্তিতেও নয়; বরং তা গঠিত হয়েছিল একমাত্র দ্বীনের ভিত্তিতে। এরা সবাই ছিলেন একই দ্বীনে বিশ্বাসী, একই জীবনাদর্শের অনুসারী, একই ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ ও একই লক্ষ্য-পথের যাত্রী। হাবশার (আবিসিনিয়া) বেলাল, রোমের সুহাইব, পারস্যের সালমান, মক্কার আবুবকর, উমর (রা) ও মদীনার আনসারগণ এ আদর্শ-ভিত্তিক ও সংস্কৃতিবান সমাজে নিঃশেষে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। এভাবে একটি মানব সমাজ তার সাংগঠনিক পর্যায়ে একই সংস্কৃতির অনুসারী একটি মহান মিল্লাতে পরিণত হয়েছিল। এ মিল্লাতটি ছিল যেন একটি পূর্ণাঙ্গ মানব-দেহ। এর যে কোন অঙ্গে ব্যথা অনুভূত হলে পূর্ণ দেহটিই সে ব্যথায় জর্জরিত হয়ে উঠতো। বস্তুত ইসলামী সংস্কৃতির এটাই হয়ে থাকে পরিণতি।

 বিশ্বশান্তির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ

ইসলামী সংস্কৃতির পঞ্চম বৈশিষ্ট্য হলো বিশ্বশান্তির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। সমাজে অকারণ রক্তপাত কিংবা বিপর্যয় সৃষ্টি হওয়া এবং প্রতিবেশী জাতি বা রাজ্যের সাথে নিত্য সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া ইসলামী সংস্কৃতির পরিপন্থী। যা কিছু ভালো-কল্যাণময়, তার সম্প্রসারণ এবং যা কিছু মন্দ ও ক্ষতিকর, তার প্রতিরোধই হলো এ সংস্কৃতির ধর্ম। অন্যায়কে প্রতিরোধ করার জন্যে শক্তি প্রয়োগ অপরিহার্য হয়ে উঠলে তাকে এড়িয়ে না যাওয়াও এর বৈশিষ্ট্য। বিশ্বশান্তি স্থাপনে ইসলামী সংস্কৃতির ভূমিকা চিরকালই সুস্পষ্ট ও বিজয়দৃপ্ত। বিশ্ব-সমাজকে যুদ্ধের দাবানল থেকে মুক্ত রাখতে হলে ইসলামী সংস্কৃতির ভাবধারাই হলো একমাত্র উপায়।

 বিশ্ব-মানের ঐক্য

মানবতার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে মানুষের পারস্পরিক ঐক্য অপরিহার্য। ঐক্য ছাড়া যেমন মানবতার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার ধারণা করা যায় না, তেমনি বিশ্বশান্তিরও বিঘ্নিত ও বিনষ্ট হওয়া অবধারিত। বিশ্ব-মানবের পরস্পরে পরিপূর্ণ ঐক্য সৃষ্টি করতে হলে চিন্তার ঐক্য বিধান সর্বপ্রথম কর্তব্য; তারপরই হলো কর্মের ঐক্য ও সামঞ্জস্য। অন্যকথায়, মানব সমাজের সার্বিক ঐক্য তাদের আভ্যন্তরীণ ঐক্যের ওপর নির্ভরশীল। বস্তুত মানুষের মনন-চিন্তা ও মানসিকতার ঐক্য ও সামঞ্জস্য হচ্ছে বিশ্ব-মানবের কাঙ্ক্ষিত ঐক্যের একমাত্র উপায়।

ইসলাম যে ‘কালেমায়ে শাহাদাত’ মানব-সাধারণের নিকট উপস্থাপন করেছে এবং তার যে বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ পেশ করেছে, চিন্তার ভারসাম্য রক্ষার জন্যে তা-ই হলো প্রধান হাতিয়ার। এর সাহায্যে চিন্তা-বিশ্বাস ও মননশীলতায় যে ঐক্য দানা বেঁধে ওঠে, তা-ই বাস্তব কর্মে নিয়ে আসে ঐক্যের ধারাবাহিকতা। বিরোধ ও বিভেদের সমস্ত প্রাচীর এর বন্যা-প্রবাহে চূর্ণবিচূর্ণ হতে বাধ্য। মানুষ এরই ভিত্তিতে সমান মর্যাদার অধিকারী হয়ে এক আল্লাহর বান্দা হয়ে ওঠতে পারে এবং মানব-সমাজের ওপর থেকে এক আল্লাহ ছাড়া অপর শক্তিগুলোর প্রভাব প্রতিপত্তি, কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্বকে উৎখাত করে মানুষ সর্বপ্রকার লাঞ্ছনা ও অবমাননা থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে। তাই তাওহীদ হচ্ছে মানবতার মুক্তি সনদ। শিরক হচ্ছে এর বিপরীত অশান্তি ও বিপর্যয়ের সর্বনাশা বীজ। তা মানুষকে নানাভাবে বিভক্ত করে। এসব থেকে মানুষ যখন মানসিক দিক দিয়ে পবিত্রতা লাভ করে, তখনই আসে মন ও মননশীলতার ঐক্য এবং তখন বাহ্যিক ঐক্যের সঙ্গে সঙ্গে আন্তরিক ঐক্যের সৃষ্টি করা আরো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই এ লক্ষ্য অর্জনের জন্যে ইসলামে বিশেষ কর্মনীতি ও সুফলদায়ক কর্মপন্থা গৃহীত হয়েছে। বাহ্যিক ঐক্য স্থাপনের জন্যে যেখানে নামায ও হজ্বের ব্যবস্থা করা হয়েছে, আন্তরিক ঐক্যবিধানের জন্যে সেখানে গৃহীত হয়েছে রোযা ও যাকাতের ব্যবস্থা। পাঁচ ওয়াক্তের নামায হোক কিংবা জুম’আ ও দুই ঈদের নামায, উভয় ক্ষেত্রেই সীমিত ধার্মিকতা ও জাতীয়তার ঊর্ধ্বে ওঠে মানুষ আন্তর্জাতিকতার উদার পরিবেশে স্থান গ্রহণ করে। আর বায়তুল্লাহর হজ্ব বিশ্ব-মানবের এক পোশাকে, এক আল্লাহর দরবারে, একই ভাষায়, একই দিকে মুখ করে একই প্রকারের আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে, পারস্পরিক সহানুভূতির সাথে, এক সমাবেশের এক অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে জোয়ার-ভাঁটা তথা উপার্জনে কম-বেশী হওয়া এক স্বাভাবিক অবস্থারই লক্ষণ। অন্যথায় বৈচিত্রহীনতা ও একঘেয়েমীতে মানব সমাজে এক চরম অচলাবস্থা সৃষ্টির পূর্ণ আশংঙ্কা দেখা দিতো। এমনকি, এর ফলে দুনিয়ার আবর্তন স্তিমিত হয়ে যেতো। এ কারণে মানব জাতির বেঁচে থাকার জন্যে ব্যক্তির অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের অবাধ সুযোগ-সুবিধে থাকা একান্তই বাঞ্ছনীয়। একদিকে প্রয়োজন, অপরদিকে উপার্জন। এ দুয়ের পারস্পরিক সহযোগিতা এবং পরস্পরের পরিপূরক হওয়া অপরিহার্য। এ কারণেই ইসলামে যাকাত ও সাদকার সুষ্ঠু মানবিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সমাজের প্রতিটি মানুষই এ কারণে পরস্পরের সাথে সম্পর্ক রেখে চলতে বাধ্য হয়। এর দরুন ব্যক্তি ও সমষ্টির সংযোজনে এক বৃহত্তর সমাজ গড়ে ওঠতে পারে। বস্তুত উম্মতে মুসলিমা এমনিভাবেই স্বীয় উন্নত মানের সংস্কৃতির ভিত্তিতে বিশ্বজনীন ঐক্যের পতাকা ঊর্ধ্বে উড্ডীন করতে পারে।

 কর্তব্য ও দায়িত্বানুভূতি

ইসলামী মিল্লাতের প্রত্যেক ব্যক্তিকেই যেমন অবহিত হতে হয় নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে, তেমনি সমষ্টির প্রতি স্বীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কেও তাকে বিস্তারিতভাবে জানতে হবে। একজন অনুগত সন্তান, স্নেহময় পিতা, সহৃদয় ভাই-বোন এবং বিশ্বাসী স্বামী ও স্ত্রীরূপে প্রত্যেকেরই অধিকার এখানে সুনির্ধারিত। কর্তব্যের অনুভূতি তাকে সমগ্র জীবনভর সক্রিয় করে রাখে। অধিকার হরণ বা লঙ্ঘন তার কাছে চিরন্তন আযাবের কারণরূপে বিবেচিত। এ জন্যে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ-ব্যবস্থায় পূর্ণ ভারসাম্য ও সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলতে সে বদ্ধপরিকর। এতে করে অর্থনৈতিক শোষণ ও লুণ্ঠন আপনা-আপনি নিঃশেষ হয়ে যেতে বাধ্য। তার ফলে এ সমাজে অর্থনৈতিক অসাম্যের কোনো প্রশ্নই ওঠতে পারে না- পারে না নৈতিক চরিত্র-বিধ্বংসী প্রবণতা জেগে উঠতে।

 পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা রক্ষা

পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করে চলাও ইসলামী সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। এ পবিত্রতা যেমন বাহ্যিক, তেমনি নৈতিক ও আধ্যাত্মিক। এ জন্যে ইসলাম যেমন শিরককে সম্পূর্ণ বর্জন করে চলার আদেশ করেছে, তেমনি হারাম ও অনৈতিক কর্ম-কাণ্ডকে সম্পূর্ণ বর্জন করে চলার নির্দেশ দিয়েছে। ‘তাকওয়া’ বা আল্লাহভীতি আধ্যাত্মিক পরিচ্ছন্নতার জন্যে অতিশয় কার্যকর হাতিয়ার। এর অনুশীলনের ফলে সমগ্র সমাজ-পরিবেশ এক পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র ভাবধারায় মূর্ত হয়ে ওঠে। এ জন্যে ইসলামী সংস্কৃতিময় জীবন ও চরিত্র নির্মল ও পবিত্র হয়ে ওঠে।

 ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের মর্যাদা

ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ইসলামী সংস্কৃতির দৃষ্টিতে সমাজের মূল ভিত্তি প্রস্তর। এছাড়া ব্যক্তির সুষ্ঠু উন্নয়ন ও বিকাশ কখনো সম্ভবপর নয়। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহে যে জীবন-ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তাতে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যকে সামষ্টিক স্বার্থের বেদীমূলে উৎসর্গ করা হয়েছে। সেখানে ‘কমিউন’ প্রথা চালু করে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ও পারিবারিক জীবনের মর্যাদাকে গুরুত্বহীন করে দেয়া হয়েছে। সে সমাজের জনগণের প্রেম-ভালোবাসা, মানসিক, শান্তি ও নিরাপত্তা সংরক্ষণের উপায় এবং জীবন-জীবিকার উৎস হচ্ছে সরকার বা রাষ্ট্র। নারী- পুরুষ, বালক-শিশু, যুবক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকল মানুষই সরকারের মালিকানা। কাজেই সরকারী নির্দেশ মেনে চলায় কোনরূপ দ্বিধা-কুণ্ঠা প্রকাশ করার একবিন্দু অবকাশ নেই সে সমাজে। জমি-জায়গা, অর্থ-সম্পদ, বিত্ত-সম্পত্তি ও ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুই সেখানে ব্যক্তির মালিকানা থেকে কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় সোপর্দ করা হয়েছে। শিল্প ও বাণিজ্য হয়েছে সরকারী অর্থ শোষণের এক প্রবল হাতিয়ার। নানা বাধা-প্রতিবন্ধকতার আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দী হয়ে সেখানকার জনগণ যেন জেলখানার কয়েদী। ব্যক্তি-স্বাধীনতার কোন নাম-গন্ধ নেই সেখানে। তার জন্যে কোন সামান্য চেষ্টা করা হলেও তা হয় বিদ্রোহের নামান্তর। পঞ্চাশ ষাটের দশকে হাঙ্গেরী ও চেকোশ্লাভাকিয়ায় সোভিয়েত আক্রমণের দৃষ্টান্ত বিশ্ববাসীর চোখ খুলে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। হাজার হাজার দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতাকামী সোভিয়েত ট্যাংক বহরের প্রতিরোধে এসে প্রাণ দিয়েছে। নব্য উপনিবেশবাদী সমাজতন্ত্রের সর্বগ্রাসী অভিযান তাদের স্বাধীনতা লাভের অধিকারকে নির্মমভাবে কেড়ে নিয়েছে। পাশ্চাত্যের তথাকথিত সভ্যতা-সংস্কৃতিও জনগণকে সত্যিকার কোনো স্বাধীনতা দিতে সক্ষম হয়নি। তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর শাসনতন্ত্রে একথা স্পষ্টাক্ষরে লেখা থাকে যে, সরকার যে কোন সময় জরুরী অবস্থা ঘোষণা কিংবা নিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স জাতীয় আইনের সাহায্যে ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণ করতে পারে। নির্দিষ্ট বা অনির্দিষ্টকালের জন্যে বিনা বিচারে বন্দী করে রাখার অধিকারও এ সরকারের জন্যে সুরক্ষিত। বিশেষ জরুরী অবস্থায় সমস্ত জনগণ সরকারেরই নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বাধীনে চলে যেতে বাধ্য হয়; তাতে ব্যক্তির ইচ্ছা- অনিচ্ছার কোন প্রশ্ন ওঠতে পারে না। অন্যদিকে নারী-পুরুষের সমতার নামে নারীর মর্যাদা সেখানে চরমভাবে ভুলণ্ঠিত। আর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সেখানে আত্মকেন্দ্রিকতার নামান্তর বৈ কিছুই নয়। সেখানে কেউ কারোর জন্যে এক বিন্দু সহানুভূতি বোধ করেনা। পারস্পরিক প্রেম-ভালোবাসা ও সহানুভূতি কর্পূরের মতো উঠে গেছে সে সমাজ থেকে। আত্মহত্যার ঘটনা সেখানে এক নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার।

কিন্তু ইসলামী সংস্কৃতি এ অমানবিক বর্ণতার প্রশ্রয় দেয়নি। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ও সমাজ-স্বার্থের মাঝে এখানে ভারসাম্যপূর্ণ এক সীমারেখা অঙ্কিত। যার ফলে এ দুটি দিকই পরস্পরের জন্যে রহমত হয়ে ওঠে। মানুষের মৌল অধিকারে কোন বৈষম্য বা তারতম্য এখানে স্বীকৃত নয়। প্রত্যেকেরই স্থান ও মর্যাদা সুনির্দিষ্ট এখানে। এতে কমবেশী করার এতটুকুর অবকাশ নেই। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য হরণ করার অধিকার এখানে কাউকেই দেয়া হয়নি। ব্যবসা- বাণিজ্যের ওপরও অকারণ সরকারী নিয়ন্ত্রণ আরোপের অধিকার কারো নেই। প্রত্যেকের জন্যেই যথোচিত কাজের ও স্বীয় প্রতিভার বিকাশ সাধনের অবাধ সুযোগ এখানে স্পষ্টভাবে স্বীকৃত। জনগণের সম্পদ পরিমাণে কম-বেশী হতে পারে; কিন্তু তাদের মৌলিক মানবীয় প্রয়োজন অপূর্ণ থাকার কোন কারণ ঘটতে পারে না এ সমাজে।

এ পর্যায়ের সর্বশেষ বৈশিষ্ট্য হলো সর্বক্ষেত্রে ও সর্বদিকে পরম ভারসাম্য রক্ষা। বাড়াবাড়ি, সীমালঙ্ঘন, উচ্ছৃঙ্খলতা- এক কথায় সর্বপ্রকার জুলুম, অত্যাচার ও কদাচার ইসলামী সংস্কৃতিতে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও ইনসাফ এ সংস্কৃতির উজ্জ্বল দ্বীপশিখা।

ইসলামী সংস্কৃতির রূপরেখা

বর্তমান কালে সংস্কৃতির কথা বললেই সাধারণভাবে প্রত্নতত্ত্ব, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, অঙ্কন বা চিত্রশিল্প, কাব্য ও সাহিত্য চর্চা বা নৃত্যকলা, সঙ্গীত, নাট্যাভিনয় এবং অন্যান্য ললিতকলার কথা আপনা থেকেই মনের পটে ভেসে ওঠে। ‘সংস্কৃতির’ কথা বললে লোকেরা এসবই মনে করে বসে। কিন্তু সংস্কৃতি বলতে সত্যিই কী বুঝায় কিংবা অধুনা যে সব জিনিসকে সংস্কৃতি বলে মনে করা হচ্ছে, সেগুলো সত্যিই ‘সংস্কৃতি’ নামে অভিহিত হওয়ার যোগ্য কিনা এবং এগুলো ছাড়া সংস্কৃতির আর কোনো অর্থ আছে কি না, তা সাধারণত কারোরই মনেই জাগে না। এর ফলে আমরা দেখতে পাই, এগুলোকেই সাংস্কৃতিক কাজ বলে ধরে নেয়া হচ্ছে এবং এ পর্যায়ের এক-একটা কাজকে ‘সাংস্কৃতি’ক অনুষ্ঠান বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে, বরং বর্তমানে তো কেবলমাত্র নৃত্য-সঙ্গীত ও নাট্যাভিনয়ই সংস্কৃতি চর্চা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বলে পরিচিতি লাভ করছে। এসবের জন্যে এ শব্দটির ব্যবহার যুক্তিসঙ্গত কিনা, তা এ কালের লোকেরা একবার ভেবে দেখবারও অবকাশ পাচ্ছে না। শুধু তা-ই নয়, সংস্কৃতির নামে প্রচিলত এসব জিনিসকে আবার ইসলামী বলে চালিয়ে দিতেও অনেকে দ্বিধাবোধ করছে না।

কিন্তু আমার মনে হয়, সংস্কৃতি সম্পর্কে আমদের গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করার প্রয়োজন রয়েছে। সংস্কৃতির নামে সমাজে যা কিছু চলছে, অবলীলাক্রমে তাকেই সংস্কৃতি বা Culture বলে মেনে নেয়া অন্তত চিন্তাশীল ও বিদগ্ধজনের পক্ষে কিছুতেই শোভন হতে পারে না। তাই এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ আবশ্যক।

সংস্কৃতি: তাৎপর্য ও সংজ্ঞা

‘সংস্কৃতি’ বাংলা শব্দ। নতুন বাংলা অভিধানে-এর অর্থ লেখা হয়েছে: সভ্যতাজনিত উৎকর্ষ, কৃষ্টি, Culture। অপর এক গ্রন্থকারের ভাষায় বলা যায় : সাধারণত সংস্কৃতি বলতে আমরা বুঝি মার্জিত রুচি বা অভ্যাসজাত উৎকর্ষ। সংস্কৃতিকে ইংরেজীতে বলা হয় Culture.  এ শব্দটি ল্যাটিন শব্দ CALTURE থেকে গৃহীত। এর অর্থ হল কৃষিকার্য বা চাষাবাদ। তার মানে- জমিতে উপযুক্তভাবে বীজ বপন ও পানি সিঞ্চন করা; বীজের রক্ষণাবেক্ষণ, লালন-পালন ও বিকাশ-বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা। বিশেষজ্ঞরা Culture শব্দের অনেকগুলো অর্থ উল্লেখ করেছেন বটে; কিন্তু এ শব্দকে সাধারণত উত্তম স্বভাব-চরিত্র এবং ভদ্রজনোচিত আচার-ব্যবহার ও আচরণ অর্থেও ব্যবহার করা হয়। ললিত-কলাকেও Culture অভিহিত করা হয়ে থাকে। অশিক্ষিত ও অমার্জিত স্বভাবের লোকদেরকে Uncultured এবং সুশিক্ষাপ্রাপ্ত, সুরুচি-সম্পন্ন ও ভদ্র আচরণবিশিষ্ট মানুষকে Cultured man বলা হয়। আবার কেউ কেউ মনে করেন Culture বা সংস্কৃতি বলতে একদিকে মানুষের জাগতিক, বৈষয়িক ও তামাদ্দুনিক উন্নতি বুঝায় আর অপরদিকে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষকেও সংস্কৃতি বলে অভিহিত করা যায়।

এ দেশের জনৈক চিন্তাবিদ কলম-নবিশের মতে: সংস্কৃতি শব্দটি ‘সংস্কার’ থেকে গঠিত। অভিধানে তার অর্থ: কোন জিনিসের দোষ-ত্রুটি বা ময়লা-আবর্জনা দূর করে তাকে ঠিকঠাক করে দেয়া। অর্থাৎ সংশোধন ও পরিশুদ্ধকরণ তথা মন-মগজ, ঝোঁক-প্রবণতা এবং চরিত্র ও কার্যকলাপকে উচ্চতর মানে উন্নীতকরণের কাজকে ‘সংস্কৃতি’ বলা হয়। খনি থেকে উত্তোলিত কাঁচা স্বর্ণকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নকরণ এবং পরে তা দিয়ে অলংকারাদি বানানোও সংস্কৃতির মূল কাজ। ইংরেজী শব্দ Culture-এর বাংলা অর্থ করা হয় সংস্কৃতি। মূলত সংস্কৃতি সংস্কৃত ভাষার শব্দ। তার সাধারণ বোধগম্য অর্থ হল, উত্তম বা উন্নত মানের চরিত্র।

অধ্যাপক Murray তার লিখিত ইংরেজী ডিশনারীতে বলেছেন: Civization বা সভ্যতা বলতে একটি জাতির উন্নত সমাজ ব্যবস্থা বুঝায়, যাতে রাষ্ট্র-সরকার, নাগরিক অধিকার, ধর্মমত, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক আইন বিধান এবং সুসংগঠিত শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমান রয়েছে। আর Culture বা সংস্কৃতি হচ্ছে সভ্যতা বা Civilization- এরই মানসিক ও রুচিগত ব্যাপার। তাতে থাকা-খাওয়ার নিয়ম-নীতি, সামাজিক-সামষ্টিক আচরণ-অনুষ্ঠান, স্বভাব-চরিত্র এবং আনন্দ স্ফূর্তি লাভের উপকরণ, আনন্দ-উৎসব, ললিতকলা, শিল্পচর্চা, সামষ্টিক আদত-অভ্যাস, পারস্পরিক আলাপ- ব্যবহার ও আচরণবিধি শামিল রয়েছে। এসবের মাধ্যমে এক একটা জাতি অপরাপর জাতি থেকে আলাদা ও বিশিষ্টরূপে পরিচিতি লাভ করে থাকে।

প্রখ্যাত মার্কিন ঐতিহাসিক Will Duran এক নিবন্ধে Culture বা সংস্কৃতির সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে: ‘সংস্কৃতি সভ্যতার অভ্যন্তর ও অন্তঃস্থল থেকে আপনা থেকেই উপচে ওঠে, যেমন ফুলবনের ফুল আপনা থেকেই ফুটে বের হয়ে আসে।’ তাঁর মতে সংস্কৃতিতে Regimentation বা কঠোর বিধিবদ্ধতা চলে না।

জাতীয় সভ্যতার প্রভাবে যেসব আদত-অভ্যাস ও স্বভাব-চরিত্র আপনা থেকে গোটা জাতির মধ্যে ছড়িয়ে থাকে, তা-ই সংস্কৃতি। জাতীয় সংস্কৃতি বলে কোন জিনিসকে জোর করে চালু করা যায় না। তা পয়দা করা হয় না, বরং আপনা থেকেই পয়দা হয়ে ওঠে। অবশ্য বিশেষ বিশেষ চিন্তা-বিশ্বাসের প্রভাবে তাতে পরিবর্তন আসা সম্ভব। প্রখ্যাত দার্শনিক কবি T. S. Eliot Culture বা সংস্কৃতি সম্পর্কে বলেন: ‘সংস্কৃতির দুটি বড় চিহ্ন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ-একটি ভাবগত ঐক্য আর দ্বিতীয়টি তার প্রকাশ ক্ষেত্রে সৌন্দর্যের কোন রূপ বা দিক।’ তাঁর মতে সংস্কৃতি ও ধর্ম সমার্থবোধক না হলেও ধর্ম সংস্কৃতিরই উৎস। সংস্কৃতি রাষ্ট্র-শাসন-পদ্ধতি, ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা এবং দর্শনমূলক আন্দোলন-অভিযানেও প্রভাবিত হতে পারে। Oswald Spengler-এর মতে, একটি সমাজের সংস্কৃতি প্রথমে উৎকর্ষ লাভ করে। তারই ব্যাপকতা ও উৎকর্ষের ফলে গড়ে ওঠে সভ্যতা, যা তার প্রাথমিক ক্ষেত্র পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে না, তা ছড়িয়ে পড়ে ও সম্প্রসারিত হয়ে অপরাপর দেশগুলোর ওপরও প্রভাব বিস্তার করে বসে। কিন্তু ডুরান্টের মতে, প্রথমে রাজ্য ও রাষ্ট্র এবং পরে সভ্যতা গড়ে ওঠে আর এরই দৃঢ় ব্যবস্থাধীনে সংস্কৃতি আপনা থেকে ফুটে ওঠে। আর রুচিগত, মানসিক ও সৃজনশীল প্রকাশনার অবাধ বিকাশের মাধ্যমে সৌন্দর্যের একটা রূপ গড়ে ওঠে। তাতে গোটা জাতির ওপর প্রভাবশালী ধারণা-বিশ্বাস ও মূল্যমানের একটা প্রতিচ্ছবি প্রতিবিম্বিত হয়। এ পর্যায়ে আরবী শব্দ সাক্বাফাতের ব্যাখ্যাও আমাদের সামনে রাখতে হবে। তাতে সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের ধারণা অধিকতর সুস্পষ্ট হয়ে ওঠবে।

বাংলা ভাষায় সংস্কৃতি বলতে যা বুঝায়, ইংরেজীতে তা-ই কালচার এবং আরবীতে তাই হল সাক্বাফাত। আরবী তাহযীব শব্দটিও এ অর্থেই ব্যবহৃত হয়। সাক্বাফাত এর শাব্দিক বা আভিধানিক অর্থ হল: চতুর, তীব্র সচেতন, তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন ও সতেজ-সক্রিয় মেধাশীল হওয়া। আরবী ‘সাক্বাফ’ অর্থ সোজা করা, সুসভ্য করা ও শিক্ষা দেয়া। আর আস-সাক্কাফ বলতে বুঝায় তাকে ‘যে বল্লম সোজাভাবে ধারণ করে’। আরবী হায্যাবা শব্দের আভিধানিক অর্থ হল ‘গাছের শাখা-প্রশাখা কেটে ঠিকঠাক করা, পবিত্র-পরিচ্ছন্ন করে তোলা, পরিশুদ্ধ ও সংশোধন করা।’ আর ইংরেজী Culture মানে কৃষিকাজ করা, ভূমি কর্ষণ করা ও লালন-পালন করা (Oxford Dictionary)। এর আর একটি অর্থ লেখা হয়েছে: Intellectual Development. Improvement by (mental or pysical) Training: অর্থাৎ (মানসিক বা দৈহিক) ট্রেনিং-এর সাহায্যে মানসিক উন্নয়ন ও উৎকর্ষ সাধন।

এ তিনটি শব্দেই ঠিকঠাক করা ও সংশোধন করার অর্থ নিহিত রয়েছে। এর পারিভাষিক সংজ্ঞাতেও এই অর্থটি পুরাপুরি রক্ষিত হয়েছে।

রাগেব আলী বৈরুতী তাঁর আস-সাক্বাফাহ নামক গ্রন্থে লিখেছেন: ‘সাক্বাফাহ’ মানে মানসিকতার সঠিক ও পূর্ণ সংশোধন এমনভাবে যে, সংস্কৃতিবান ব্যক্তির সত্তা পরিপূর্ণতা ও অধিক গুণ-বৈশিষ্ট্যের দর্পণ হবে। খারাবীর সংশোধন এবং বক্রতাকে সোজা করাই হল ‘সাক্বাফাত’ বা সংস্কৃতি।

ইংরেজী ‘কালচার’ শব্দের অর্থ ও তাৎপর্য পুরোপুরি সুনির্ধারিত হতে পারেনি। বিশেজ্ঞরা নিজ নিজ রুচি অনুযায়ী এর সংজ্ঞা দিয়েছেন। সে সংজ্ঞাগুলো পরস্পরের সাথে সামঞ্জস্যশীল যেমন, তেমনি পরস্পর-বিরোধীও।

Philip Banghy তাঁর Culture and History নামক গ্রন্থে Concept of culture শীর্ষক এক নিবন্ধে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন: সর্বপ্রথম ফরাসী লেখক ভলতেয়ার ও ভ্যানডেনার্গাস (Voltair and Van venargues) শব্দটির ব্যবহার করেছেন। এদের মতে, মানসিক লালন ও পরিশুদ্ধকরণেরই নাম হচ্ছে কালচার। অনতিবিলম্বে উন্নত সমাজের চাল-চলন, রীতি-নীতি, শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান শিক্ষা ইত্যাদিও এ শব্দের আওতায় গণ্য হতে লাগল। অক্সফোর্ড ডিকশনারীর সংজ্ঞা মতে বলা যায়, ১৮০৫ সন পর্যন্ত ইংরেজী ভাষায় এ শব্দটির কোন ব্যবহার দেখা যায় না।

সম্ভবত ম্যাথু আর্নল্ড তাঁর Culture and Anarchy গ্রন্থে ‘কালচার’ পরিভাষাটি প্রথম ব্যবহার করেছেন। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত এ শব্দটি অস্পষ্টই রয়ে গেছে। এর অনেকগুলো সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। আলোচ্য গ্রন্থকার A. L Krochs and Kluck Halm-এর সূত্র উদ্ধৃত করে বলেছেন যে, এর একশত একষট্টিটি সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এই গ্রন্থকারের মতে এ শব্দটির এমন সংজ্ঞা হওয়া উচিত, যা মানব জীবনের সর্বদিকে পরিব্যাপ্ত হবে। ধর্ম, রাজনীতি, রাষ্ট্রক্ষমতা, শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান, প্রকৌশলবিদ্যা, ভাষা, প্রথা-প্রচলন ইত্যাদিকে এর মধ্যে শামিল মনে করতে হবে; এবং মানবীয় বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা তো মতাদর্শ, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধর্মীয় বিশ্বাস, ক্ষমতা এবং এ ধরনের অন্যান্য জিনিসকেও এর মধ্যে শামিল মনে করেছেন। টিএস ইলিয়ট কালচার শব্দটির তাৎপর্য এভাবে বর্ণনা করেছেন: চালচলন ও আদব-কায়দার পরিশুদ্ধতাকেই ‘কালচার’ বা ‘সংস্কৃতি’ বলে, একটু পরে তিনি বিষয়টির আরো বিশ্লেষণ করেছেন এ ভাষায়: ‘কালচার (সংস্কৃতি) বলতে আমি সর্বপ্রথম তা-ই বুঝি যা ভাষা-বিশেষজ্ঞরা বর্ণনা করেন; অর্থাৎ এক বিশেষ স্থানে বসবাসকারী বিশেষ লোকদের জীবনধারা ও পদ্ধতি।’ ম্যাথু আর্নল্ড তাঁর Culture and Anarchy গ্রন্থে শব্দটির অর্থ লিখেছেন এভাবে:

“কালচার হল মানুষকে পূর্ণ বানাবার নির্মল প্রচেষ্টা। অন্যকথায় কালচার হল পূর্ণত্ব অর্জন।”

কালচার শব্দের বিভিন্ন সংজ্ঞার সমালোচনা করে তিনি বলেন যে, এগুলোকে ভালো ও চমৎকার শব্দ তো বলা যায়; কিন্তু এগুলো কালচার বা সংস্কৃতির ব্যাপক অর্থ ও তাৎপর্যকে যথার্থভাবে ব্যক্ত করতে পারে না। তবে তিনি Montesqueu এবং B. Wilson-এর দেয়া সংজ্ঞাকে অতীব উত্তম বলে মনে করেন আর তা হলো: এক বুদ্ধিমান ও সচেতন মানুষকে অধিকতর বুদ্ধিমান ও সচেতন বানানো এবং সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির উৎকর্ষ ও আল্লাহর সন্তোষ লাভের জন্যে অব্যাহত চেষ্টা করা। কিন্তু তাঁর মতে কালচারের এ সংজ্ঞা সঠিক নয়। তিনি মনে করেন, কালচার ধর্ম হতেও ব্যাপক অর্থবোধক। তাঁর গ্রন্থের বিশেষ ভূমিকা লেখক মুহসিন মেহদী ‘কালচার’ শব্দের উল্লেখ করেছেন এভাবে: এ কালচার মানুষের সাধারণ জীবনধারা থেকে উচ্ছাসিত হয়ে ওঠে। কালচারের অর্থ হলো মানবীয় আত্মার সাধারণ জমিনকে পরিচ্ছন্ন করা, তাকে কর্ষণের যোগ্য করে তোলা।

মুহসিন মেহদী কালচার শব্দ সম্পর্কে আরো বলেছেনঃ সংস্কৃতি না যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতাকে বলা যায়, না মানুষের সত্তার অন্তর্নিহিত কামনা-বাসনাকে; বরং সত্যি কথা এই যে, তা হলো সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও বৈষয়িক সৃজনশীলতার অভ্যস্ত ও প্রচলিত রূপ। চিন্তাবিদ ফায়জী কালচার শব্দের দুটো সংজ্ঞা দিয়েছেন: একটি সমাজকেন্দ্রিক, অপরটি মানবিক। একটি সংজ্ঞার দৃষ্টিতে কালচার ‘তামাদ্দুন’ শব্দ থেকেও ব্যাপকতর আর অপরটির দৃষ্টিতে কালচার হচ্ছে মানবীয় আত্মার পূর্ণতা বিধান।

তিনি লিখেছেন: কালচার-এর দুটি অর্থঃ সমাজতাত্ত্বিক ও মানবিক। ১. কালচার হচ্ছে এমন একটা পূর্ণরূপ- যাতে জ্ঞান-বিশ্বাস, শিল্প-কলা, নৈতিক আইন-বিধান, রসম-রেওয়াজ এবং আরো অনেক যোগ্যতা ও অভ্যাস-যা মানুষ সমাজের একজন হিসেবে অর্জন করেছে-শামিল হয়েছে।

২. ‘মানবীয় কালচার’ হচ্ছে মানবাত্মার পরিপূর্ণ মুক্তির দিকে ক্রমাগত ও নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন।

কালচার শব্দের এ নানা সংজ্ঞাকে সামনে রেখে আমরা বলতে পারি, ফিলিপ বেগবী (Philip Bagby) প্রদত্ত সংজ্ঞা অপেক্ষাকৃত উত্তম। তিনি ‘কালচার’-এর সংজ্ঞা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন:

“আসুন আমরা এ বিষয়ে একমত হই যে, ‘কালচার’ বলতে যেমন চিন্তা ও অনুভূতির সবগুলো দিক বুঝায়, তেমনি তা কর্মনীতি-পদ্ধতি ও চরিত্রের সবগুলো দিককেও পরিব্যাপ্ত করে।”

গ্রন্থকার সমাজ জীবন, মনস্তত্ত্ব ও তামাদ্দুনকে সামনে রেখে ‘কালচার’ শব্দের খুবই ব্যাপক সংজ্ঞা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন: সমাজ সদস্যদের অভ্যন্তরীণ ও স্থায়ী কর্মনীতি ও কর্মপদ্ধতির নিয়মানুবর্তিতা ও নিরবিচ্ছিন্নতাকে বলা হয় সংস্কৃতি। সুস্পষ্ট বংশানুক্রমের ভিত্তিতে যে ধারাবাহিকতা তা-ও এর মধ্যে শামিল।

তিনি আরো বলেছেন: কোন বিশেষ কাল বা দেশের সাধারণ জ্ঞান-উপযোগী মানকেই বলা হয় কালচার বা সংস্কৃতি।

কালচার শব্দের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করায় সবচাইতে বেশী অসুবিধা দেখা দেয় এই যে, তার পূর্ণ চিত্রটা উদঘাটিত করার জন্যে মন ঐকান্তিক বাসনা বোধ করে বটে কিন্তু তার বাস্তব অস্তিত্ব প্রমাণের জন্যে বিশেষজ্ঞরা খুব বেশী ডিগবাজি খেয়েছেন। এ কারণে অনেক স্থানেই সংস্কৃতির বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতাকে নাম দেয়া হয়েছে ‘কালচার’ বা সংস্কৃতি। টি. এস. এলিয়ট যথার্থ বলেছেন: লোকেরা শিল্পকলা, সামাজিক ব্যবস্থা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিকে কালচার মনে করে, অথচ এ জিনিসগুলো কালচার নয়; বরং তা এমন জিনিস যা থেকে কালচার সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায় মাত্র।

সংস্কৃতি ও তামাদ্দুন

সংস্কৃতির অর্থ ও তাৎপর্যে কিছুটা অস্পষ্টতা রয়ে গেছে এজন্যে যে, তাকে অপর কয়েকটি শব্দের সাথে মিলিয়ে একাকার করে দেয়া হয়েছে। যেমন তামাদ্দুন, Civilization বা সভ্যতা, সমাজ সংগঠন বা সংস্থা (Social Structure) ও ধর্মমত (Religion)। এ তিনটির প্রতিটিই যেহেতু মানুষের জীবন ও সত্তার সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত, এ জন্যে অনেক সময় সংস্কৃতির স্বরূপ নির্ধারণে সভ্যতা, সমাজ সংগঠন বা ধর্মের প্রভাব, ফলাফল ও কর্মনীতির প্রভাব প্রতিফলিত হয়ে থাকে। সবচাইতে বেশী গোলক-ধাঁধাঁর সৃষ্টি করেছে ‘তামাদ্দুন’ শব্দ। কেননা সাধারণত তামাদ্দুন ও সংস্কৃতি- এ দুটি শব্দকে একই অর্থবোধক মনে করা হয়। আর একটি বলে অপরটিকে মনে করে নেয়া হয়- একটির প্রভাবকে অপরটির ফলাফল গণ্য করা হয়। এ জন্যে সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে পৃথক করে প্রতিটির স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা দান করার জন্যে প্রতিটির সীমা নির্ধারণ করা লোকদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। টি.এস. এলিয়ট এ দুঃখই প্রকাশ করেছেন। তিনি তার গ্রন্থের সূচনায় স্বীয় অক্ষমতার কথা সুস্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করেছেন।

চিন্তাবিদ ফায়জী তামাদ্দুন-এর যে-সংজ্ঞা দিয়েছেন, তাতেও সংস্কৃতি বা কালচার-এর সংজ্ঞা স্পষ্টতার হয়ে ওঠে। তিনি বলেছেন: তামাদ্দুন’ বলতে দুটির একটি বুঝাবে, একটি হল সুসভ্য হওয়ার পদ্ধতি আর দ্বিতীয়টি মানব সমাজের পূর্ণাঙ্গ উৎকর্ষপ্রাপ্ত রূপ। আন্তর্জাতিক ইসলামিক কলোকিন-এর নিবন্ধকারদের মধ্যে কেবলমাত্র এম. জেড, সিদিকী কালচার-এর সংজ্ঞাদান প্রসঙ্গে সঠিক কথা বলেছেন। তিনি কালচার-এর কেবল সংজ্ঞাই দেননি, সেই সঙ্গে তামাদ্দুন-এর সাথে তার তুলনাও করেছেন। এ তুলনা নির্ভুল এবং এতে করে উভয়েরই সত্যিকার রূপ নির্ধারিত হতে পারে। তিনি বলেছেন: ‘সাক্বাফাত’ বা সংস্কৃতি পরিভাষাটি দ্বারা চিন্তার বিকাশ ও উন্নয়ন বুঝায় আর তামাদ্দুন বা সভ্যতা সামাজিক উন্নতির উচ্চতম পর্যায়কে প্রকাশ করে। কাজেই বলা যায়, সংস্কৃতি মানসিক অবস্থাকে প্রকাশ করে আর সভ্যতা বা তামাদ্দুন তারই সমান প্রকাশ ক্ষেত্রকে তুলে ধরে। প্রথমটির সম্পর্ক চিন্তাগত কর্মের সাথে আর দ্বিতীয়টির সম্পর্ক বৈষয়িক ও বস্তুকেন্দ্রিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে। প্রথমটি একটি অভ্যন্তরীণ ভাবধারাগত অবস্থা আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে বাহ্যিক জগতে তার কার্যকারিতার নাম।

ফায়জী সংস্কৃতির যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, তা সংক্ষিপ্ত হলেও নির্ভুল। তিনি বলেছেন: ‘সংস্কৃতি অভ্যন্তরীণ ভাবধারার নাম আর তামাদ্দুন বা সভ্যতা হল বাহ্য প্রকাশ।’

এ পর্যায়ে মাওলানা মওদূদী যা কিছু লিখেছেন তার সারকথা হলো: ‘সংস্কৃতি কাকে বলে তা-ই সর্বপ্রথম বিচার্য। লোকেরা মনে করে, জাতির জ্ঞান-বিজ্ঞান, নিয়ম-নীতি, শিল্প-কলা, ভাস্কর্য ও আবিষ্কার-উদ্ভাবনী, সামাজিক রীতি-নীতি, সভ্যতার ধরণ-বৈশিষ্ট্য ও রাষ্ট্র-নীতিই হল সংস্কৃতি। কিন্তু আসলে এসব সংস্কৃতি নয়, এসব হচ্ছে সংস্কৃতির ফল ও প্রকাশ। এসব সংস্কৃতির মূল নয়, সংস্কৃতি বৃক্ষের পত্র-পল্লব মাত্র। এসব বাহ্যিক রূপ ও প্রদর্শনীমূলক পোশাক দেখে কোন সংস্কৃতির মূল্যায়ন করা যেতে পারে বটে; কিন্তু আসল জিনিস হল এসবের অন্তর্নিহিত মৌল ভাবধারা। তার ভিত্তি ও মৌলনীতির সন্ধান করাই আমাদের কর্তব্য।’

টি. এস. ইলিয়ট, এম. জেড, সিদ্দীকী এবং মাওলানা মওদূদীর পূর্বোদ্ধৃত ব্যাখ্যা থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃতি হচ্ছে চিন্তা ও মতাদর্শের পরিশুদ্ধি, পরিপক্কতা ও পারস্পরিক সংযোজন, যার কারণে মানুষের বাস্তব জীবন সর্বোত্তম ভিত্তিতে গড়ে উঠতে এবং পরিচালিত হতে পারে।

সংস্কৃতি ও সভ্যতার পার্থক্য

সভ্যতা ও সংস্কৃতির মাঝে যে পার্থক্য, তা-ও এখানে সুস্পষ্ট হয়ে যাওয়া দরকার। গিস্বার্ট (Gisbert) সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে নিম্নলিখিত প্রভেদ নিরূপণ করেছেন, যথাঃ ক.দক্ষতার ভিত্তিতে সভ্যতার পরিমাণ নির্ধারণ করা যেতে পারে; কিন্তু সংস্কৃতির বিচার হয় মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানসিক উৎকর্ষের মানদণ্ডে। সভ্যতার পরিমাণ করতে গিয়ে আমরা বাইরের উন্নতি লক্ষ্য করি, যেমন- হাতেবোনা তাঁতের তুলনায় যান্ত্রিক তাঁতের ক্ষমতা অনেক বেশী। আর শিল্পকলার ক্ষেত্রে মতভেদের কারণে কোনো ভাল চিত্র কারোর দৃষ্টিতে সুন্দর, কারোর চোখে তা অসুন্দর-নিন্দনীয়।

খ. সভ্যতার অবদানগুলোকে সহজেই বোঝা যায়- উপলব্ধি করা যায়। সংস্কৃতির অবদান সাধারণ মানুষ অতো সহজে উপলব্ধি করতে পারে না। সাধারণ লোক সামান্য শিক্ষা পেলেই আধুনিক যন্ত্রপাতির কলাকৌশল ও ব্যবহার পদ্ধতি বুঝে নিতে পারে; কিন্তু কোন লোককে কবিতা বা ছবি আঁকা ভালোভাবে শেখালেই যে ঐ বিষয়ে সে দক্ষতা লাভ করবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

গ. সভ্যতার গতি যেমন দ্রুত, সংস্কৃতির গতি তেমন দ্রুত নয়। সংস্কৃতির গতি অনেক বাধাপ্রাপ্ত হয়; ফলে একটা থমথমে নিশ্চল ভাব দেখা যায়। কখনো বা সংস্কৃতি হয় পশ্চাদগামী।

ঘ. সভ্যতার ক্ষেত্রে পরিণতি বা ফলাফল হল বড় কথা। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পরিণতির বদলে কাজটা হলো বড়- সেটাই হলো লক্ষ্য। তাছাড়া সভ্যতার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা যত তীব্র, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা তত তীব্র নয়। মানুষ সৌন্দর্যকে নানাভাবে উপভোগ করতে পারে- বৃদ্ধির সাধনায় নানাভাবে আত্মনিমগ্ন হতে পারে; কিন্তু সভ্যতার ক্ষেত্রে দেখি, আধুনিকতম সভ্যতার অবদান প্রাচীন আবিষ্কারকে অনেক পিছনে ফেলে এসেছে। বস্তুত ব্যক্তির সুস্থতা, সঠিক লালন ও বর্ধন লাভের জন্যে যেমন দেহ ও প্রাণের পারস্পরিক উন্নতিশীল হওয়া আবশ্যক, ঠিক তেমনি একটি জাতির সংস্কৃতি ও সভ্যতার পুরোপুরি সংরক্ষণ একান্তই জরুরী সে জাতির সঠিক উন্নতির জন্যে। বলা যায়, সংস্কৃতি হচ্ছে জীবন বা প্রাণ আর সভ্যতা হচ্ছে তার জন্যে দেহতুল্য।

মানব জীবনের দুটি দিক। একটি বস্তুগত আর দ্বিতীয়টি আত্মিক বা প্রাণগত। এ দুটি দিকেরই নিজস্ব কিছু দাবি-দাওয়া রয়েছে- দেহেরও দাবি আছে, মনেরও দাবি আছে। মানুষ এ উভয় ধরনের দাবি-দাওয়া পূরণের কাজে সব সময়ই মশগুল হয়ে থাকে। কোথাও আর্থিক ও দৈহিক প্রয়োজন তাকে নিরন্তর টানছে; জীবিকার সন্ধানে তাকে নিরুদ্দেশ ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। কোথাও রয়েছে আত্মার দাবি- আধ্যাত্মিকতার আকুল আবেদন। সে দাবির পরিতৃপ্তির জন্যে তার মন ও মগজকে সব সময় চিন্তা-ভারাক্রান্ত ও ব্যতিব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। মানুষের বস্তুগত ও জৈবিক প্রয়োজন পূরণের জন্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থাপনার কাজ করে আর ধর্ম, শিল্প, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শন তার মনের ক্ষুধা মেটায়। বস্তুত যেসব উপায়-উপকরণ একটি জাতির ব্যক্তিদের সূক্ষ্ম অনুভূতির ও আবেগময় ভাবধারা এবং মন আত্মার দাবি পূরণ করে, তা-ই হচ্ছে সংস্কৃতি। নৃত্য ও সংগীত, কাব্য ও কবিতা, ছবি আঁকা, প্রতিকৃতি নির্মাণ, সাহিত্য চর্চা, ধর্মীয় আকীদা-বিশ্বাস এবং দার্শনিকের চিন্তা-গবেষণা একটি জাতির সংস্কৃতির বাহ্যিক প্রকাশ-মাধ্যম। মানুষ তার অন্তরের ডাকে সাড়া দিতে গিয়েই এসব কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। এগুলো থেকে তৃপ্তি- আনন্দ, স্ফূর্তি ও প্রফুল্লতা লাভ করে। দার্শনিকের চিন্তা-গবেষণা, কবিদের রচিত কাব্য ও গান, সুরকারের সংগীত- এসবই মানুষের অন্তর্নিহিত ভাবধারারই প্রকাশ করে। এসব থেকে মানুষের মন তৃপ্তি পায়, আত্মার সন্তোষ ঘটে আর এই মূল্যমান, অনুভূতি ও আবেগ উচ্ছ্বাসই জাতীয় সংস্কৃতির রূপায়ন করে।

এখানেই শেষ নয়। এই মূল্যমান, অনুভূতি-হৃদয়াবেগ এমন, যা এক-একটি জাতিকে সাংস্কৃতিক প্রকাশ মাধ্যম গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যাপক ছাঁটাই-বাছাই চালানোর কাজে উদ্বুদ্ধ করে। যা মূল্যমান ও মানদন্ডের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য প্রমাণিত হয়, তা-ই সে গ্রহণ করে আর যা তাতে উত্তীর্ণ হতে পারে না তা সর্বশক্তি দিয়ে প্রত্যাখ্যান করে- এগিয়ে চলে। একারণে দেখতে পাই, পুঁজিবাদী সমাজ সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে না। অনুরূপভাবে সমাজতন্ত্রীরা পুঁজিবাদী ও বুর্জোয়া সংস্কৃতির প্রতি ঘৃণা পোষণ করে তাকে নির্মূল করতে চায়। ইসলামী আদর্শবাদীদের নিকট একারণেই ইসলামী সংস্কৃতির প্রশ্ন অত্যন্ত প্রকট হয়ে দেখা দেয়।

সংস্কৃতি ও ধর্ম

একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারা যাবে যে, ধর্মকে যতই অস্বীকার করা হোকনা কেন, ধর্ম ও ধর্মীয় ভাবধারা মানুষের রক্ত-মাংসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে- গভীরভাবে মিলে-মিশে একাকার হয়ে আছে, থাকবেও চিরকাল। এ থেকে মানুষের মুক্তি নেই। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি, জ্ঞান-গবেষণা এবং চিন্তা ও কল্পনার চরমোৎকর্ষ সত্ত্বেও তাকে এমন সব অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়, যখন ধর্মের প্রভাব অকপটে স্বীকার না করে কোনই উপায় থাকে না। এমনকি, কট্টর নাস্তিকও এমন সব অবস্থায় ধর্ম ও ধর্মীয় ভাবধারাকেই একমাত্র আশ্রয় রূপে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। প্রসঙ্গত একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে, যা কয়েক বছর পূর্বে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। খবরটি ছিল এইরূপঃ একটি রুশ সামুদ্রিক জাহাজ আমেরিকার দূর-প্রাচ্যের সমুদ্র-বক্ষে ঝড়ের দাপটে টালমাটাল। এক্ষুণি বুঝি সব শেষ হয়ে যাবে। কোথাও আশার আলো চোখে পড়ছে না। এই দূরপ্রাচ্যের সমুদ্র উপকূলের কোথাও যে কোন উপসাগরের অস্তিত্ব আছে, তারও কোন প্রমাণ ছিল না। সহসা মাতাল ঝড়ে নাস্তানাবুদ জাহাজখানি বাত্যাতাড়িত হয়ে এক শান্ত পোতাশ্রয়ে ঢুকে পড়ল। সমুদ্র-বক্ষের দূরন্ত বাতাস ও উন্মত্ত গর্জন যেন কোন জাদুমন্ত্রবলে এখানে শান্ত হয়ে পড়ে আছে। ধরে ফিরে পাওয়া প্রাণ নাবিকেরা সোল্লাসে চীৎকার করে উঠলঃ ‘না’- খোদা (রুশ ভাষায় এ শব্দটির মানে দাঁড়ায় খোদা- প্রেরিত)। এ ঘটনাটি যেন কুরআনেরই প্রতিধ্বনি-

“উত্তাল তরঙ্গমালা যখন চারদিক থেকে তাদের পরিবেষ্টিত করে ফেলে সমাচ্ছন্ন মেঘের মত তখন তারা অতীব আন্তরিক নিষ্ঠার সাথে আল্লাহকে ডাকে, তাঁরই জন্যে আনুগত্য একান্ত করে দেয়। তার পরে যখন তারা মুক্তি পেয়ে সমুদ্র কিনারে পৌঁছায় তখন তারা ভিন্ন পথে চলতে শুরু করে।” (সূরা লুকমান: ৩২)

মানুষ সমুদ্র সফরের জন্যে বড় বড় জাহাজ নির্মাণ করে মহাসাগরে অথৈ পানিতে ভাসিয়ে দেয়। তাকে চালাবার ও থামিয়ে দেয়ার ব্যাপারে সে সম্পূর্ণ শক্তিমান। কিন্তু প্রচন্ড ঝড়-তুফানের মুখে মানুষ একেবারে অক্ষম ও অসহায়। তাকে সকল শক্তি- ক্ষমতার অপারগতা ও সীমাবদ্ধতা অনিবার্যভাবে স্বীকার করে নিতে হয়। যুদ্ধ-সংগ্রামে মানুষ পূর্ণ সজ্জিত ও সশস্ত্র হয়ে ময়দানে উপস্থিত হয়। সেখানে সে তার অতুলনীয় সাহস ও বিক্রমের ওপর নির্ভর করে শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার সঙ্গী-সাথী সৈনিকদের সংখ্যাও প্রতিপক্ষের তুলনায় হয় অনেক বেশী। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাকে শেষ পর্যন্ত পরাজয় বরণ করতে হয়। কিন্তু কেন? এর জবাব তালাশ করেও সে ব্যর্থ হয়। কোন সত্যিকার জবাবই সে খুঁজে পায় না। মানুষ ক্ষেতে-খামারে ও ফলের বাগানে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে রক্তকে পানি করে দেয়। সমস্ত ক্ষেত-খামার ও বাগ-বাগিচা সবুজ শ্যামলে ও রসটলমল ফলের গুচ্ছে একাকার হয়ে যায়। তা দেখে তার চোখ জুড়ায়, ধরায় পানি আসে সোনালী ভবিষ্যতের উজ্জ্বল আশায় বুক ভরে উঠে। কিন্তু হঠাৎ এমন ঘটনা ঘটে যায়, যার ফলে সমস্ত ক্ষেত খামার আর বাগ-বাগিচা হয় জ্বলে-পুড়ে শূন্য মাঠে পরিণত হয় কিংবা বন্যার পানিতে সব ডুবে পঁচে নষ্ট হয়ে যায়, ফলে তার সব আশা মাটি হয়ে যায়। কিন্তু কেন ঘটল এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা, এমন অভাবিতপূর্ব দুরবস্থা? মানুষ নিজ থেকে এর কোন জবাবই পেতে পারে না। বাহ্যিক কার্যকারণ যাই থাকনা কেন এ দুরবস্থার মূলে অন্তর্নিহিত আসল কারণ- মনের সেই আসল প্রশ্নের জবাব যা মানুষ ধর্মের কাছ থেকেই জানতে পারে। তাই ধর্ম মানুষের প্রকৃত আশ্রয় জীবনের তিক্ত বাস্তবতা এবং তার রঙীন স্বপ্নের মাঝে সৃষ্ট দ্বন্দ্বের কারণে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে, তখন ধর্ম এসে তাকে দেয় সান্ত্বনা, অসহায়ের সহায় হয়ে দাঁড়ায় এই ধর্মবিশ্বাস। বস্তুত জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের সব আবেগ-অনভূতি ব্যথা বেদনা ও দাবি দাওয়ার সত্যিকার জবাব হচ্ছে এই ধর্ম। জীবনের অনভূতি ব্যথা কে নৈতিকতার নিয়ম-বিধি অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত করতে মানুষ বাধ্য হয়। মানুষের সমস্ত চাল-চলনকে নিয়ন্ত্রিত ও সুষ্ঠু পথে পরিচালিত করার ব্যাপারে ধর্ম একটি সক্রিয় উদ্বোধক শক্তি হিসেবে কাজ করে। এ উদ্বোধক শক্তিই মানুষকে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত করে তোলে। আর এভাবেই সংস্কৃতির প্রশ্নে ধর্মের গুরুত্ব অনস্বীকার্য হয়ে উঠে। সমাজকে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক জীবনকে সুসংহত, সুসংবদ্ধ ও সুবিন্যস্ত করে, তার মধ্যে জাগিয়ে দেয় এক গভীর ও সূক্ষ্ম আবেগ। এ হৃদয়াবেগই হল সংস্কৃতির উৎসমূল আর এ কারণেই মানব জীবনে ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতি কিংবা সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের আলোচনা অপরিহার্য হয়ে ওঠে: বরং ধর্মের প্রেরণায় যে সংস্কৃতি পরিপুষ্ট তা যেমন হয় সুদৃঢ়ভিত্তিক, তেমনি হয় স্বচ্ছ-পরিচ্ছন্ন ও মলিনতাহীন-জঘন্যতা, অশ্লীলতা ও বীভৎসতামুক্ত। তার শিকড় হয় মানুষের মন-মগজ, স্বভাব-চরিত্র ও আচরণের গভীরে বিস্তৃত ও প্রসারিত।

ম্যাথু আর্ণল্ডের মতে, সংস্কৃতি ধর্ম হতেও ব্যাপকতর অর্থবোধক; বরং তাঁর মতে, ধর্ম সংস্কৃতিরই একটা অংশ। অধিকাংশ মনীষীর মতে, সংস্কৃতি ও ধর্ম পর্যায়ে এ-ই হল একমাত্র কথা। ফায়জী ‘ইসলামিক কালচার’ গ্রন্থে এ মতটি প্রকাশ করেছেন এ ভাষায়: ‘ধর্ম, ভাষা, বংশ, দেশ এসবের ভিত্তিতে সংস্কৃতির রকমারি আঙ্গিকতা গড়ে ওঠে’।

আর এ কথাটি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠতে পারে, যদি সংস্কৃতির সংজ্ঞার সাথে সাথে ধর্মের সংজ্ঞাও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং এ দু’য়ের প্রভাব-সীমা সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করে দেয়া হয়। কিন্তু তবু সংস্কৃতি ও ধর্মের সংজ্ঞার ক্ষেত্রে একটা অসুবিধা থেকে যাবে। কেননা সংস্কৃতির সংজ্ঞা দেয়া একটা কঠিন ব্যাপার, এ থেকে মুক্তি পাওয়া খুব সহজসাধ্য নয়। ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ান এ্যান্ড এথিক্’-এর প্রবন্ধকার ধর্মের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞদের বিবিধ উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। এখানে আমরা কয়েকটি উক্তি উল্লেখ করবো। কিন্তু তার পূর্বে উক্ত প্রবন্ধকারের একটা কথা পেশ করা আবশ্যক। সি. সি. জে. ওয়েব (C.C.J. Webb) ধর্মের সংজ্ঞাদান প্রসঙ্গে বলেছেন:

“ধর্মের কোনো সংজ্ঞা দেয়া যেতে পারে, ব্যক্তিগতভাবে আমি তা মনে করি না। তা সত্ত্বেও ধর্মের অনেক সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে”।

১. Religion is a belief in super-natural being (E.R Tylor) (ধর্ম হল অতি-প্রাকৃতিক সত্তাকে নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করা।]

২. A Religion is a unified system of belief and practices relatives to sacred things that is to say, things set apart, and forbid den-believes and practices while unite into one single moral community called a church. (Durkhem) (ধর্ম আকীদা ও আমলের এমন এক সমন্বিত ব্যবস্থা, যার সম্পর্ক হচ্ছে পবিত্র  জিনিসগুলোর সঙ্গে, যেসবকে বিশিষ্ট গণ্য করা হয়েছে আর যা নিষিদ্ধ। আকীদা ও আমল, যা নৈতিক দিক দিয়ে একটি সুসংগঠিত কেন্দ্রিকতার সৃষ্টি করতে পারে-যাকে ‘উপাসনালয়’ বলা হয়।

৩. Religion is man’s faith in a power beyond himself whereby he seeks to satisfy his emotional needs and gains stability of life and which he expresses in acts of worship and service.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *