শিউলিমালা একাডেমি

ইসলামী সংস্কৃতি

ইসলামী সংস্কৃতি বা তমদ্দুন সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে ‘তমদ্দুন’ কাকে বলে জানা দরকার হয়ে পড়ে। তমদ্দুন কথাটি আরবী ‘মাদানুন’ থেকে এসেছে, ‘মাদানুন’ মানে শহর। বাংলা ভাষায় ‘তমদ্দুন’ কথাটি মুসলিম সমাজে গত কয়েক বছর হলো চালু হয়ে গেছে। শহরের বুকেই গড়ে উঠেছিলো প্রথম সভ্যতা, গোড়াপত্তন হয়েছিলো সংস্কৃতির। এর ভেতরই হয়তো পাওয়া যাবে তমদ্দুন কথাটির সার্থকতা। বাংলা ভাষায় সাধারণত তমদ্দুন বলতে সংস্কৃতি কথাটা ব্যবহার করা হয়- তমদ্দুন বা সংস্কৃতি দিক নির্দেশ করে এক মার্জিত উন্নত রুচির ভাবের দিকে। ইংরেজিতে একেই বলা হয় কালচার।

সমাজবিজ্ঞানে কিন্তু আমরা মার্জিত রুচি আর মার্জিত রুচিহীনতার মাঝে পরস্পর পার্থক্য দেখিয়ে তমদ্দুনের সংজ্ঞা দেবার চেষ্টা করি না। কালচার্ড আর আনকালচার্ডের পার্থক্যই আমাদের সংজ্ঞার মাপকাঠি হয় না। ব্যাপক অর্থে আমরা ব্যবহার করিই ‘তমদ্দুন’ কথাটা। এক্ষেত্রে বোয়া (Boas) ও টাইলর (Tylor)-এর সংজ্ঞাই ব্যাপক ও সুষ্ঠু। বোয়া তাঁর “জেনারাল এনথ্রোপলজী” (General Anthroplogy-p.p.4-5) তে কালচার বা তমদ্দুনের সংজ্ঞার ভেতর উল্লেখ করেছে (১) প্রাকৃতিক পরিবেশের উপরে মানুষের নিয়ন্ত্রণ, (২) অনুভূতিশীল মানুষের সামাজিক সম্পর্ক ও বিভিন্ন সমাজের পারস্পরিক সম্পর্ক, (৩) মানসিক হাবভাব- ধর্ম, নীতি, সৌন্দর্য-জ্ঞান। ‘তমদ্দুন’ বলতে আমরা বুঝি সামাজিক প্রতিষ্ঠার, যন্ত্রাদি প্রত্যয় (Ideas), ধর্ম (পাশ্চাত্য অর্থে), নীতি, আইন, আচার ব্যবহার এসবেরই সমষ্টি। টাইলর তাঁর “প্রিমিটিভ কালচার”-এ তমদ্দুনের এই ধরনেরই সংজ্ঞা দিয়েছেন: Culture is that complex which includes Knowledge. Belief. Art, Moral, Law, Custom and other capabilities and habits acquired by man as a member of society.

সভ্যতা ও তমদ্দুন

এখানে মনে রাখা দরকার যে, তমদ্দুন ও সভ্যতা বলতে  ভিন্ন ভিন্ন জিনিস বুঝায়। সভ্যতা বলতে বুঝায় মানুষের কার্যধারার বিভিন্ন দিকগুলো, সামাজিক সংগঠন, প্রকৃতির উপর নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি। বাইরের খোলস আর বাইরের কাজ এই যেন সভ্যতা। ম্যাকাইভার (Maciver) বলেন: “Our culture is what we are, our civilization is what we use”.

আমরা কি বা কি হতে পেরেছি এ’ই হল ‘তমদ্দুন’। আর আমরা কি ব্যবহার করি এ’ই হল ‘সভ্যতা’। স্পেংলারের মতে, “মানুষের সভ্যতার ব্যবহারিক দিকের উন্নতির সাথে সাথে তমদ্দুনের অবলুপ্তি হয় শুরু।” ম্যাসিগননের মতে: “Culture is a certain involution within.. civilization, characteristic educational tradition.” (Massignon: Reflections on Our Age, 1948.p.134)। আর কান্ট বলেন, “তমদ্দুনের সাথে নৈতিক মূল্যবোধ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আবার অনাবিল সুখভোগ হল ম্যাথু আরনল্ডের তমদ্দুনের সংজ্ঞার নিরিখ “The study of perfection, the disinterested search for sweetness and light.”

 ইসলামী তমদ্দুনের স্বরূপ

ইসলামী তমদ্দুনের স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তমদ্দুনের ব্যাপক সংজ্ঞাটাকেই আমাদের নিতে হবে। ইসলাম ধর্মের সংকীর্ণ সংজ্ঞা দেয় নি। ‘দ্বীন’ বলতে বোঝায় জীবন-দর্শন বা জীবনের একটি সুষ্ঠু আদর্শ। কাজেই ইসলামের তমদ্দুন যেমন একদিকে ব্যাপক হবে, তেমনি অন্যদিকে এই তমদ্দুন ইসলামের আদর্শভিত্তিক হওয়া চাই। ইসলামী তমদ্দুন বলতে মোটামুটি আমরা যা বুঝি তার মধ্যে প্রথম হলো তাওহীদবাদ, মানব জীবনে আল্লাহর একত্ববাদের প্রতিষ্ঠা- মানুষের সামাজিক জীবনে সার্বজনীন ভ্রাতৃত্ব ও সার্বজনীন নীতির প্রবর্তন। সার্বজনীন বিচার প্রতিষ্ঠা তাওহীদবাদের লক্ষ্য।

এছাড়া আছে প্রত্যয় বা চিন্তাধারা, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, আইন কানুন, ঈমান, নীতি, আচার-ব্যবহার– যা ইসলাম পজিটিভ রূপে বা অস্তিত্ববাচক হিসেবে নিজেই গড়ে তোলে। প্রত্যয় বা চিন্তাধারা, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, আইন-কানুন, নীতি, আচার-ব্যবহার যেগুলো তাওহীদবাদ ও সার্বজনীন নীতির বিরোধী নয়, তাকে ইসলামী তমদ্দুন বলা যায়। জ্ঞান- বিজ্ঞানের সাধনা, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী, সাধারণভাবে সবই ইসলামী শিক্ষা, যদি তার আরম্ভ, উদ্দেশ্য ও সামাজিক ফল ভালো হয়। হযরতের সময়ে শিক্ষার এই সংজ্ঞাই দেয়া হত। [কুরআন: ১৬:১২; ৩:১৯০-৯১; ৪৫:১৩; ৩১:২০; ১০:১০২; ২:১৬৪; ১৩:২; ৩১:২৯; ১৩০:৫৪]

বলা বাহুল্য, ‘কালেমা’ আমাদের শিক্ষা দেয়, আল্লাহ্ ছাড়া সব প্রভুত্ব নাশ করে জ্ঞানের মারফত মানব সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

আদর্শের দিক থেকে বিচার করলে তমদ্দুনকে ভাগ করা যায় দু’ভাগে- আদর্শভিত্তিক তমদ্দুন (Ideological culture), আর আদর্শ-নিরপেক্ষ তমদ্দুন (Chance culture)। এই প্রকারভেদ চরম পার্থক্য নির্দেশক নয়। আপেক্ষিক পার্থক্য নির্দেশ করা হলো কেবলমাত্র বুঝাবার সুবিধার জন্যে। কারণ পরিপূর্ণ আদর্শ-নিরপেক্ষ তমদ্দুন কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। অবশ্য আদর্শভিত্তিক তমদ্দুন হলেই যে সেটি ভাল হবে তার মানে নেই। আদর্শটা কেমন তার উপরেই এটা নির্ভর করবে। যত নিকৃষ্টই হোক, হেঁয়ালিবাদ বা ঔদাসীন্যবাদও এক ধরনের আদর্শ। আদর্শভিত্তিক তমদ্দুনের ভেতরে- ফ্যাসিবাদ, কমিউনিজম ও ইসলাম, আদর্শভিত্তিক তমদ্দুন। জাতিবিদ্বেষ, শ্রেণীবিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ ও সাম্রাজ্যবাদের উপর সভ্যতার ভিত্তি স্থাপিত হতে পারে না। হিটলারের আর্য সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব, হেগেলের সার্বজনীন প্রজা (Universal spir it), স্পেংলারের বিশ্বসংজ্ঞা (World plan-the powers of blood and race are more importent than blood and money), কমিউনিজমের শ্রেণী- সাম্রাজ্যবাদ, ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ আদর্শভিত্তিক হলেও সুষ্ঠু সামাজিক কল্যাণ আনতে পারে না। আদর্শ-নিরপেক্ষ তমদ্দুনের ঐ একই দশা। আদর্শ-নিরপেক্ষ তমদ্দুন হেঁয়ালিবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত হয় ও ব্যক্তিগত স্বৈরাচার, জাতিগত ও আঞ্চলিক নীতিবোধের ওপর গড়ে ওঠে। সেই আদর্শই মানুষের গ্রহণীয় হওয়া উচিত, যার মৌলিক ভাব ও নীতিবোধ মানবিক ও সার্বজনীন; সামাজিক ফল মঙ্গলজনক এবং যা থেকে অনাবিল আনন্দ পাওয়া যেতে পারে ও যেটা সুকুমার ও মানসিক প্রবৃত্তির বিকাশ সাধন করতে পারে।

 ইসলামী তমদ্দুন ও মুসলিম তমদ্দুন

ইসলামী তমদ্দুনের স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, ‘মুসলিম’ তমদ্দুন ও ‘ইসলামী’ তমদ্দুনে আসমান জমিন প্রভেদ। মুসলমানদের তমদ্দুন হলেই তা ইসলামী তমদ্দুন নাও হতে পারে। জাতিগত ও ভাষাগত পার্থক্য, বাদশাহী ও সামন্ততান্ত্রিক হাবভাব নানা কারণে মুসলমানদের তমদ্দুনে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু সেগুলোকে ইসলামী তমদ্দুনের অংশ বলা যায় না। আব্বাসীয়দের সময় থেকেই ইসলামী তমদ্দুনে সংকীর্ণতা ঢুকে পড়ে-একজন অত্যাচারী শাসক ‘খলীফা’ বা নামে ‘আমীরুল মুমিনীন’ হলেই যথেষ্ট, তা তিনি ইসলামের সামাজিক বিধান প্রয়োগ করুন আর না করুন। সামাজিক ঐক্য বা সংহতি নিশ্চয়ই প্রয়োজন আর এটা ইসলামেরই বিধান। কিন্তু জালিম শাসনকেও ‘আল্লাহর ছায়া’ শাহানশাহ বা বাদশাহ বলে মেনে নেওয়া কিছুতেই ইসলামের নীতি অনুগত হতে পারে না। মনে রাখা দরকার যে, তথাকথিত ধর্মীয় শাসক মুখে ইসলামের নাম করে শাসন চালালেই ইসলামী শাসন হবে না। কেবলমাত্র ধর্মীয় নেতার সঙ্গে সামাজিক ব্যাপারের যোগ থাকলেই ইসলামী সমাজ পাওয়া যাবে না। বাহ্যিক হাবভাব বা পোশাক আশাকই যথেষ্ট নয়। ইসলামের নীতির সঙ্গেই সামাজিক ব্যাপারের সংযোগ হওয়া চাই। এই হিসেবে (তথাকথিত ধর্মীয় নেতার অস্তিত্বের জন্যেই শুধু নয়) ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজ, ধর্মীয় বা আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজ। জুলুমের বিরুদ্ধে জিহাদ ইসলামী সংস্কৃতির একটা বড় কথা।

যাহোক মোগল, তুর্কী ও ইরানী সংস্কৃতির প্রভাবের ফলে মুসলিম তমদ্দুনে জাতিগত বিদ্বেষ ও সম্প্রদায়গত সংকীর্ণতা ঢুকে পড়েছে ও ইসলামের সার্বজনীন দিকগুলোকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। বাইরের পোশাকের দিকে দেওয়া হয়েছে বেশী নজর। ফলে মুসলমানদের তমদ্দুনে এমন একটা ভাব ঢুকে পড়েছে যে, যা ইরানী বা তুর্কী তাই ইসলামী আর যা ভারতীয়, ইন্দোনেশীয় বা ইওরোপীয় তাই ইসলাম বিরোধী। কিন্তু বিচার করে দেখা হয় না যে, এগুলো ইসলামী তমদ্দুনের মৌলিক দিকগুলোর বিরোধী কিনা।

কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিলে কথাটা আরও সাফ হয়ে যাবে। বাংলা ভাষায় লেখা হলেই যেমন কোন সাহিত্য ইসলামী হয় না বা ইসলাম বিরোধী হয় না, তেমনি প্রত্যেক ভাষা সম্বন্ধে ঐ একই কথা। একই ভাষাতে ইসলাম- সঙ্গত ও ইসলামবিরোধী ভাবধারা প্রচার করা যায়। ভাষা সৃষ্টির ব্যাপারে বিশ্বনিয়ন্তার কোন পক্ষপাতিত্ব ছিলো না।

আল্লাহ তা’য়ালাই কুরআনে বলেছেন, ‘বিভিন্ন ভাষা ও রঙ সৃষ্টির ভেতরে মানুষের জন্যে রয়েছে অজস্র চিন্তার খোরাক’। (সূরা রুম ৩০:২২) সব ভাষার সৃষ্টি ও বিভিন্ন রঙের মানুষের সৃষ্টি তাই তাঁর অভিপ্রেত। সাদাকালোর বিরোধ জাতিগত বিদ্বেষ বা ভাষাগত বিদ্বেষ তাই আল্লাহর সৃষ্টি উদ্দেশ্যের ঘোর বিরোধী। কুরআন শরীফ প্রথমত ছিল আরববাসীর জন্যেই। অবশ্য এর গূঢ় উদ্দেশ্য ও সম্বোধন রয়েছে তামাম জাহানের মানব জাতির জন্যেই। সেজন্যে কুরআন বলেছে: ‘আরবী ভাষায় কুরআন রয়েছে, যাতে তোমাদের বোধগম্য হয়।’ (সুরা ফুসিলাত ৪১: ৪৪) এর দ্বারা কুরআন এই নীতিরই প্রতিষ্ঠা করছে যে, শিক্ষা গ্রহণের পক্ষে মাতৃভাষাই সর্বশ্রেষ্ঠ বাহন বা মাধ্যম। জাতিগত বিদ্বেষ ধুলিস্যাৎ করে হযরত সা. বলেছেন, অনারবদের উপর আরবদের কোনও শ্রেষ্ঠত্ব নেই, সবাই আদমের সন্তান আর আদমের সৃষ্টি মাটি থেকে।

কাজেই এ-কথা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, ভাষাগত পার্থক্য, জীবিকার পার্থক্য, পার্থক্য হতে পারে, কিন্তু এগুলো কখনই আদর্শিক পার্থক্য নির্দেশ করে না। কারণ ইসলামী আদর্শ ভাষাভিত্তিক বা আঞ্চলিক নয়।

ইসলামী জীবনবোধ থেকে পাওয়া মৌলিক ভাবের উপরেই নির্ভর করে ইসলামী সংস্কৃতির ও ইসলামী সাহিত্যের মৌলিক ভিত্তি।

ধরা যাক, স্বার্থসিদ্ধির জন্যে কোন একজন লোক ‘জিহাদের’ জিগির তুললো, আর ঘোষণা করল- ‘আমি জিহাদ করছি।’ কিন্তু এটা কি সত্যি জিহাদ হবে? কখনোই না। আবার ধরুন, আরো একটি লোক স্বত:প্রবৃত্ত হয়ে একটি ভাল কাজে এগিয়ে এলো, কিন্তু সে আরবী জানে না আর জিহাদ কথাটিও কোনও দিন শোনেনি। সে হয়তো ঘোষণা করলো -‘আমি সত্যের জন্যে সংগ্রাম করছি। আল্লাহর চোখে, মানবতার চোখে, সত্য ও ন্যায়- বিচারের চোখে এই সংগ্রামই প্রকৃত ‘জিহাদ’ পদবাচ্য হবে। হাদীস বলেছে: উদ্দেশ্য দেখেই কাজের বিচার হবে। ভাষাগত আধিপত্য বা অন্য যে কোনো রকমের সংকীর্ণতা ইসলামের প্রকৃত অগ্রগতির সাথে ভিষণভাবে ক্ষতিকর। পোমাক্স (Pomaks) বা বুলগেরীয় মুসলিমদের ওপর জোর করে তুর্কীভাষা চাপিয়ে দেওয়া যে উসমানী (Ottoman) সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ ছিলো, তাও প্রায় সব ইতিহাস পাঠকেরই জানা আছে। ইতিহাসের শিক্ষা যেন আমরা গ্রহণ করি, নতুন সমাজ গঠনের ভাবপ্রবণতায় যেন আমরা নতুন করে ভুল না করে বসি।

 বাঙালি সংস্কৃতি এবং ইসলামী তমদ্দুন ও সাহিত্য

বাংলাদেশে মুসলমানদের আগমনের পূর্বে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিলো পাল ও সেন বংশের আমলে। হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদ ও বৈঞ্চববাদের সাথে সাথে বৌদ্বধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাব বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বৈরাগ্যবাদ, মায়াবাদ ও নির্মাণবাদের ভেতর দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। পালি ও প্রাকৃত ভাষার মারফতে এই ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ সংস্কৃতি বাংলা সংস্কৃতিতে আত্মপ্রকাশ করেছিলো। তারপর এলো তুর্কী বিজয়। বাংলা ভাষার ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব যুগের অভ্যুদয় হলো। বিজয়ী মুসলমানদের দরবারে বিজিতের এই বাংলা ভাষা সগৌরবে স্থান পেলো। দুর্বোধ্য সংস্কৃতের নিগড় থেকে মুক্তি পেয়ে বাংলা ভাষা বিকাশের নতুন পথ বেছে নিলো। এর ফলে যে বিরাট লোকসাহিত্য ও পুঁথি- সাহিত্য গড়ে উঠেছিলো, তা হিন্দু ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির ছাপ সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠতে না পারলেও ইসলামী ভাবধারার প্রভাব বাংলা সাহিত্যে তখন থেকেই পড়তে শুরু করে। বাদশাহী পৃষ্ঠপোষকতার চাইতেও মুসলমান ফকীর দরবেশদের প্রভাব এই ব্যাপারে কোন অংশে কম নয়। তারপর বৌদ্ধ সংস্কৃতির উদার নৈতিক ভাবধারাও এদেশে ইসলামের সার্বজনীন ভাবধারার প্রসারে কম সাহায্য করে নি। ওহাবী আন্দোলনের ভারতীয় ধারা পরবর্তীকালে এদেশীয় মুসলমানের সাংস্কৃতিক জীবন থেকে ইসলামবিরোধী ভাবধারা দূর করবার চেষ্টা করে। কোনো বিশেষ দেশের সংস্কৃতি হলেই তা ইসলাম-মুখী বা ইসলাম বিরোধী হবে তা বলা যায় না। বাংলাদেশ সম্পর্কেও একথা খাটে। প্রয়াসসাধ্য হলেও দুনিয়ার যে কোন ভাষার ভেতর দিয়ে ইসলামী সাহিত্য গড়ে তোলা যায়। (কুরআন নাজিল হবার আগে আরবী ভাষা কাফিরদের ভাষা ছিল) আরবী, ফারসী, উর্দু, বাংলা ও ইংরাজি ভাষার মারফত ইসলামী সাহিত্যের বিকাশেই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। আরবীতে কথা বললেই যে ইসলামী সমাজ থাকতে পারে না, বর্তমান আরবীয় সমাজই তার নজির। কাজেই বাংলাদেশের ইসলামী সংস্কৃতি বা ইসলামী সংস্কৃতি ইসলামী থেকেও বাংলাদেশী হতে পারে, আবার বাংলাদেশী থেকেও ইসলামী হতে পারে। তবে তার ভেতরে ইসলামী ভাবধারার প্রভাব থাকা চাই এবং ইসলামী সংস্কৃতির যেসব মাপকাঠির কথা আগে বলা হয়েছে (তাওহীদ, সার্বজনীন নীতি, ইসলামী চিন্তাধারা ও প্রতিষ্ঠান, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী, সুষ্ঠু ইসলামী সমাজের সংগঠন, পরিশেষে আল্লাহর সৃষ্টির মাহাত্ম উপলব্ধি ও অনাবিল সুখ ভোগ) সেগুলোর উপরেই বাংলাদেশেও ইসলামী সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করবে। এক সময় আরবীতে ইসলামের নামগন্ধ ছিলো না, কিন্তু পরে আরবী ভাষায় ইসলামী সাহিত্য গড়ে তুলতে কোন বাধা হয় নি। কাজেই মুসলমানের লেখা হলেই তমদ্দুনের দিক থেকে তা ইসলামী সাহিত্য নাও হতে পারে। ভাবধারার উপরেই এটা নির্ভর করবে। উর্দুতে লেখা হলেই মার্কসীয় সাহিত্য বা সিনেমা সাহিত্য ও ইসলামী সাহিত্য পদবাচ্য হতে হবে তার কোন মানে নেই। সব সাহিত্য তাওহীদের বিরোধী নয় ও মানব মনের সার্বজনীন দিকগুলো তুলে ধরে, সেগুলো ইসলামী সমাজে সাদরে গৃহীত হতে পারে। বাংলাদেশের ইসলামী সাহিত্যের তাই বর্তমানের মুসলিম সমাজের প্রতিফলন পাওয়া যাবে, এমন সাহিত্য- কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, গল্প ইত্যাদি বাঞ্ছনীয়। অন্য সমাজের চিত্র এতে থাকতে পারে, তবে সেটা মুখ্য উদ্দেশ্য হবে না। সার্বজনীন সাহিত্যের সামাজিক ফল তাওহীদ বা মনের বিরোধী না হলে ইসলামী সমাজে গৃহীত হতে পারে এবং ইসলামী সংস্কৃতি অনুযায়ী লেখকগণও তাওহীদী সংস্কৃতির বিরোধিতা না করেও এগুলো লিখতে পারেন।

 ইসলামী তমদ্দুনের সুষ্ঠু প্রচার ও ধর্মীয় সাহিত্য

বাংলাদেশের সাহিত্যে মুসলিম কৃষ্টি জীবন আলেখ্যই বেশী স্থান পাবে, কেননা এখানে লোকসংখ্যার চার ভাগের তিন ভাগই হলো তারা। কিন্তু ইসলামী সংস্কৃতির প্রধান স্বরূপগুলোই তার ভাব নিয়ন্ত্রিত করবে। প্রকৃত ইসলামী শিক্ষা ও ইসলামী সমাজ গঠনের সঙ্গে সঙ্গে এটা আরও সহজ হয়ে উঠবে।

 মোগল সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের ইসলামী সংস্কৃতি

বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ইসলামী তমদ্দুনের নাড়ির যোগ রয়েছে। অন্যান্য জায়গায় ভাবধারার চাইতে বাহ্যিক পোশাকের চটক ও জাতিগত এবং সম্প্রদায়গত সংকীর্ণতাই বেশী দেখতে পাওয়া যায়। এর পেছনে ঐতিহাসিক ও তামদ্দুনিক কারণ রয়েছে। বাংলাদেশে বখতিয়ার খিলজির আসার অনেক আগেই চট্টগ্রামে ও দক্ষিণ ভারতে আরব ব্যবসায়ীগণ আগমন করেন। এদের সঙ্গে অনেক ফকীর দরবেশ ও মুসলিম প্রচারকও আসেন। মালাবার উপকূলে মোপলা মুসলমানদের মধ্যে বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের বিশ্বজনীন ও প্রকৃত প্রগতিশীল ও মানবিক ভাবধারার হদিস মেলে। এসব জায়গা ছাড়া উপমহাদেশের অন্যান্য স্থানে ইসলামের তওহীদী ভাবধারার চাইতে পারসিক তুর্কী ও মোগল সভ্যতার জাকজমক, বাদশাহী হাবভাব ও জাতিগত সংকীর্ণতা বেশী পরিমাণে দেখতে পাওয়া যায়। উপমহাদেশের মুসলিম জাগরণে আলীগড় আন্দোলনের বিরাট দান অনস্বীকার্য। তবুও এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এই আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের ভাব ধারায় সংকীর্ণতা স্থান পেয়েছে। মুসলিম রাজা বাদশাহরা এদেশ শাসন না করলে ও ইসলামের সার্বজনীন ভাবধারায় পুষ্ট চিন্তাবিদদের হাতে রাজনৈতিক ও তামদ্দুনিক আন্দোলনের ভাব থাকলে, এদেশে ইসলামের ভবিষ্যৎ যে অনেক গৌরবজনক হতো ও ইসলামী জীবনবোধের রূপায়ণ অনেকখানি সহজ হয়ে যেত তাতে কোনই সন্দেহ নেই।

 সাহিত্য ও কবিতা, চারুকলা ও সঙ্গীত

তারপর আসে চারুকলা ও সাহিত্যের সাধারণ প্রশ্ন। সাধারণ সাহিত্য ও চারুকলা কি ইসলাম বিরোধী? চারুকলা ও সাহিত্যের উৎস খুঁজে পাওয়া যাবে মানুষের বিচার শক্তি ও বুদ্ধিমত্তার ভেতরে। আর এগুলোকে কুরআন-হাদীসে আল্লাহর নিয়ামতরূপে বা মহাদানরূপে অভিহিত করা হয়েছে। কলা ও সাহিত্যের শেষ উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজকে সুন্দর করা আর এই ধরনের পরিবেশ ও আবহ সৃষ্টি করা যাতে করে মানুষ সার্বজনীন ও অনাবিল সুখের অধিকারী হতে পারে। মূর্তি থাকলেই যে তা ইসলাম বা তাওহীদ বিরোধী নয়, কুরআন থেকেই আমরা এর প্রমাণ পাই। হযরত সুলায়মান ইসলামেরও নবী। তার জন্যে জিনেরা বড় দালান, (বাড়ী সাজানোর) মূর্তি, থালা, ঘটি, বাটি তৈরী করেছিল। কলা ও সাহিত্য ইসলামী সংস্কৃতির বিরোধী নয়। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে তার সামাজিক ফল ইসলামের তাওহীদবাদ ও নীতিবোধের বিরোধী কি না। প্রত্যেক জিনিসেরই অপব্যবহার আছে, কিন্তু এই অপব্যবহারের ভয়ে মধ্যযুগীয় ‘আলিমগণ’ চারুকলা ও সাধারণ সাহিত্য বিকাশের যে বিরোধিতা করেছেন, ইসলামের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধারণ মাপকাঠিতে তা ইসলামী সংস্কৃতির বিরোধী। হযরত সা. বলেছেন: “দুটি পয়সা পেলে এক পয়সার খাবার কিন, আর এক পয়সার কিন ফুল”। বিশ্বস্রষ্টা তার কুরআনে প্রকৃতির দিকে চেয়ে তার সৌন্দর্য উপলব্ধি করবার জন্য বারবার আহবান জানিয়েছেন। হযরতও বলেছেন “আল্লাহ চিরসুন্দর, তাই তিনি সৌন্দর্য ভালোবাসেন।” আল্লাহর প্রত্যেক নবী ফুলের খুশবু আতর ও গন্ধ দ্রব্য পছন্দ করতেন। হযরত সা. আরও বলেছেন, ‘দুনিয়াকে আমি ভালোবাসি, কারণ এখানে আছে খুশবু জিনিস ও নারী’। তাই সৌন্দর্যবোধ ও চারুকলা ইসলামবিরোধী হতে পারে না। কিন্তু প্রত্যেক জিনিসের অপব্যবহারের মত চারুকলা, সংগীত ও কবিতা যখন মানুষকে অমানবিক, অসামাজিক ও নীতিহীন কাজের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় আর তাওহীদবাদ বা আল্লাহর একত্ববাদ থেকে বিচ্যুত করে তখনই এগুলো ইসলামী সংস্কৃতির ঘোর বিরোধী হয়ে পড়ে। তাওহীদের বিরোধিতা করবে বা অতিরিক্ত বিলাসিতার দিকে নিয়ে যাবে, এই ভয়ে কোন প্রাণীর ছবি আঁকতে এবং কবরের উপর সৌধ গড়তে হযরত নিষেধ করেছিলেন। ইসলাম চায় সার্বজনীন আনন্দ। ইসলাম চায় না শিল্প গুটিকতক ধনী বা শাসকের বিলাস সামগ্রী হোক এবং এদের খেয়ালিপনা চরিতার্থ করার জন্যে জনসাধারণ শোষিত হোক কিংবা তাদের দ্বারা অবহেলিত ও উপেক্ষিত হোক। শিল্পকে ইসলাম অত্যন্ত উচ্চ স্থান দেয়, কিন্তু শিল্পকে বিলাসিতায় পর্যবসিত করে ধনিক বা শাসক গোষ্ঠী মশগুল থাকলে তারা রাষ্ট্র বা সমাজের প্রতি কর্তব্য সম্পাদন করতে পারেন না। ইসলাম এই ধরনের শিল্পকেই বাধা দেয়। সৌন্দর্যবোধ ও তার মারফত সৌন্দর্য সৃষ্টি কখনোই আল্লাহর অনভিপ্রেত হতে পারে না। কারণ সৌন্দর্যই বিশ্ব রহস্যের অন্তর্নিহিত সুর। সংগীত ও কবিতা সম্পর্কেও ঐ একই কথা। মাদকদ্রব্য ও নারী জাতির ইজ্জতহানি করে যে সংগীত পরিবেশন করা হয় তা নিশ্চয়ই ইসলাম-বিরোধী। কিন্তু সংগীত ইসলাম বিরোধী হতে পারে না। সংগীতজ্ঞরা ও ক্বারী- হাফেজেরা একথা ভালভাবেই জানেন যে, কুরআন তিলাওয়াত, মীলাদ শরীফ পাঠ ও আজানের ভেতরেও বিশেষ সুর ধ্বনিত হয়ে থাকে। বিশেষ প্রয়োজনবোধে বা কোন অনুষ্ঠানের সময় হযরত গান-বাজনার ভেতর দিয়ে আমোদ আহলাদ করতে বাধা দেন নি বরং উৎসাহই দিয়েছেন। এখানে হযরত আবুবকরের বাড়ীতে হযরত মুহম্মদ (সা:)-এর আয়েশার (রা:) সঙ্গে কুমারীদের সংগীত শোনার কথা উল্লেখ করা যায়। লড়াইয়ের মাঠেও কুরআন শরীফের আয়াত সুর করে গাওয়া হতো: (Ameer Ali – History of the Saracens: Macmilan and Co: 1251. p. 65)

খন্দকের যুদ্ধে সাহাবীদের সঙ্গে পরিখা খননের সময়ে হযরত নিজে কাজ করেছিলেন আর সুরের সাথে গেয়েছিলেন- “লা-খাইরা ইল্লা-খাইরাল আখিরা, আল্লাহুম্মা আরহামাল আনসারা ওয়াল মুহাজিরা।” আখেরাতের শুভ ছাড়া, শুভ নেই কোন আর, আনসার ও মুহাজিরে রহম করো পরওয়ারদিগার।

সৎ উদ্দেশ্যে নিয়োজিত বা চিত্তবিনোদনের জন্যে যে কবিতা ও গান লেখা হয় তা ইসলাম বিরোধী হতে পারে না। কাফিরেরা খণ্ড কবিতা লিখে হযরত সা. কে নানাভাবে কষ্ট দিতো। সেজন্যেই কুরআনে বলা হয়েছে, “কবিরা মিথ্যাবাদী”। আবার অনেক কবি ইসলামকে সমর্থন করে কবিতা লিখে ছিলেন। হাসান-বিন-সাবিতের নাম এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেযোগ্য। তাছাড়া কুরআন শরীফই তো একটা উঁচুদরের কাব্য, যাকে হযরত “আমার একমাত্র অলৌকিকতা” বলে দাবী করতেন।

 শিল্পকলা ও সাহিত্যের উৎস কি শ্রেণী – সংগ্রাম?

মার্কসবাদের সাহিত্যরূপ ব্যাখ্যাকারী লেনিনের মতে প্রগতিশীল সংস্কৃতি ও সাহিত্য সব সময়ই শ্রেণীভিত্তিক ও সংগ্রামমুখী হবে। আমাদের মতে কথাটি আংশিক সত্য। সমাজের এমন অবস্থা কল্পনা করা যায় বা সমাজের এমন অবস্থা প্রকৃতই থাকতে পারে, যখন জনগণের রুটির লড়াই, ভুখা মিছিলের ছবি সাহিত্যে বিশিষ্ট স্থান পাবে; কেননা সাহিত্য হচ্ছে সমাজেরই ছবি, “জীবনের সমালোচনা”। কিন্তু কলা ও সাহিত্যের ভিত্তি শ্রেণী সংগ্রাম নয়, মানব মনের কৌতূহল ও সৌন্দর্যপ্রীতিই এর পেছনে কাজ করছে। চলে যাই আমরা সেই আদিম সমাজে, যখন মানুষ খাদ্যের খোঁজে পাহাড়ে জঙ্গলে সংগ্রাম করে চলেছে। অস্ত্র-শস্ত্রের ছবি হয়তো সে আগে আঁকতেও পারে, কিন্তু এই আঁকার পেছনে বেঁচে থাকার প্রবৃত্তির চাইতে কৌতূহল ও সৌন্দর্যবোধই বেশী কাজ করেছিলো। হয়তো সে গুহার দেয়ালে দিল এক আঁচড়। বেশ লাগলো তার কাছে এই আঁচড়টা; আরও কয়েকটি আঁচড় হয়ত গড়ে তুললো সুন্দর ছবি- প্রথম মানবশিল্পীর এক সার্থক সৃষ্টি। লেনিন যদিও স্বীকার করেছেন যে, বুর্জোয়া সাহিত্যকে অবলম্বন করেই শ্রমিক সাহিত্য গড়ে উঠবে, তবু তিনি সাহিত্যে শ্রেণী- সংগ্রামের কথাই বেশী উল্লেখ করেছেন, কিন্তু কলা ও সাহিত্যে মূল উৎসটুকু দেখান নি। সাহিত্যের মার্কসবাদী ধারণার পাল্টা জবাব দিয়েছেন টি.এস. ইলিয়ট। তিনি বলেন যে, শ্রেণী ব্যবধানই সংস্কৃতির অগ্রগতি ও বিকাশের বড় কারণ। শ্রেণীবিভাগ না থাকলে সংস্কৃতির জন্মও হয় না, উন্নতিও হয় না।

শ্রেণীবিভাগ বলতে তিনি যদি প্রাকৃতিক শ্রেণী-বিভাগ বোঝেন তবে এ কথা মানব প্রগতিবিরোধী নয়। কিন্তু শ্রেণী-বিভাগ বলতে শ্রেণী আধিপত্য বোঝালে এ মতবাদ ঘোর প্রতিক্রিয়াশীল।

 মানব সংস্কৃতিতে সুষ্ঠু জীবনবোধের আবশ্যকতা

প্রাচীন গ্রীক দর্শন থেকে আজ অবধি দর্শনের পেছনে মানুষ ছুটেছে, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ জীবন পদ্ধতি এসব দর্শন দিতে পারেনি। কোনো দর্শন হয়তো সমাজকে দেখতে গিয়ে মানুষের মনকে অবহেলা করেছে, আবার কোনটা বা মনের উপর জোর দিতে গিয়ে সমাজিক সংগঠনের দিকে নজরই দেয়নি। এজন্যেই মানুষের সংস্কৃতি ও কলা সাহিত্যে সুষ্ঠু জীবনবোধ ও জীবনাদর্শের আবশ্যকতা রয়েছে। সে জীবন-দর্শন এক দিকে যেমন সমগ্র মানুষের প্রাথমিক প্রয়োজনগুলো মেটাবে, তেমনি মানবিক গুণের ও সুকুমার প্রবৃত্তির বিকাশ সাধন করে অনাবিল সুখ ভোগের দুয়ার খুলে দেবে। “Arts for Arts sake- “শিল্পের জন্যেই শিল্প”- সত্যি সত্যিই শেষের কথা। কিন্তু সুষ্ঠু জীবন-দর্শনের সাথে যোগাযোগ না থাকলে শিল্পভোগ ও আনন্দবোধ তো দূরের কথা, মাঝ পথেই মানুষের হয় পতন। সামাজিক বিচার ও খাদ্য ভোগ করাই তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। ইসলামী সংস্কৃতির স্বরূপ বিশ্লেষণ করলেই বুঝতে পারা যায় যে, ইসলাম মানুষের সর্বাঙ্গীন বিকাশের এক সুষ্ঠু জীবনধারা দিতে পেরেছে। সামাজিক ফল খারাপ না হলে ও তাওহীদবাদের বিরোধী না হলে শিল্প-সাহিত্যের বিকাশ ও অগ্রগতি কোনো ক্ষেত্রেই ইসলামী সংস্কৃতির বিরোধী নয়। মানব সমাজের সুষ্ঠু সংগঠনের জন্যে আল্লাহ্ ইসলাম নাজিল করেছেন, যার সাথে বিশ্বসৃষ্টির ও সৌন্দর্যের কোনো বিরোধিতা নেই, বরং একটি অপরটিরই পরিপূরক। বিজ্ঞানের অগ্রগতি ইসলামের মৌলিক ভাবধারাকে দুর্বল করা তো দূরের কথা তাকে সবল করেছে, তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে।

 ইসলামী সংস্কৃতি ও নতুন সমাজ

পরিশেষে ইসলামী সংস্কৃতিকে কিভাবে আবার সামাজিক শক্তিতে পরিণত করা যায়, সে সম্বন্ধে কয়েকটি ইঙ্গিত পেশ করে আমার আলোচনা শেষ করবো।

ইসলামী সংস্কৃতির মৌলিক ও সার্বজনীন নীতিগুলোর বিশ্লেষণ ও প্রচার এবং শিক্ষা।* তথাকথিত মুসলিম ষংস্কৃতি থেকে সংকীর্ণতা, ভাষাগত ও জাতিগত গোঁড়ামি এবং তাওহীদ ও মানবতাবিরোধী হাবভাব দূর করা। আল্লামা ইকবাল এগুলোকে “আরবীয় সাম্রাজ্যবাদের চিহ্ন” (The stamp of Arabian imperialism) বলেছিলেন।

ইসলামী সমাজ কায়েম করা- ইসলামের নীতির মারফত সামাজিক সমস্যার সমাধান- ইসলামী সমাজ-রীতির সুষ্ঠু রূপায়ণ- ইসলামের মূলনীতি থেকে সরে না গিয়ে জ্ঞানলাভ ও মঙ্গলজনক সব কিছুই গ্রহণ করার প্রবৃত্তি আমাদের ভেতর থাকা চাই।

 “বিশ্বসৃষ্টি সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা কর- আল্লাহ্ কিছুই বৃথা সৃষ্টি করেন নি।”-(কুরআন)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *