একাদশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় হাজার। একসময় সেসব নদীকে ঘিরে কত গল্প-কল্পকাহিনী শোনা যেত দাদি-নানীদের মুখে! কী ছিল তার রূপ, কী ছিল তার স্রোত—কোনো এক অতীতে–বর্ষাকালে। এখন বর্ষাকালে পানি থাকলেও শীতকালে প্রায় পুরোটাই যেন ধানক্ষেত। নদীর পেটের মধ্যে সামান্য এক ধার ঘেঁষে মৃদুস্রোত বয়, নৌকা চলে— যেখানে বাংলার চিরাচরিত রূপ ছিল নদীময়, জলময়, আর বনময়। বাংলার সেই আদিরূপ, নদীর সেই কলকল ধ্বনি– এখন শুধুই বিস্মৃত অতীত। বাংলার অতীতের যত সব খরস্রোতা নদ-নদী, খাল-বিল তাদের বেশিরভাগই এখন মৃতপ্রায়। সেখানে বৈশাখে নয়, বর্ষায় হাঁটুজল থাকে। বৈশাখে তারা একেবারেই মৃত।
ভাটির এই অঞ্চলে বর্তমানে ৭০০’র মতো নদী, উপনদী ও শাখা-নদী আছে। তন্মধ্যে ২৩০টির মতো জীবিত। এই নদীগুলো সারাদেশে রক্তের শিরা-উপশিরার মতো বহমান। বাংলাদেশের ভূখন্ডকে চারটি নদী অববাহিকা তথা : গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা ও দক্ষিণ-পূর্ব নদীসমূহের অববাহিকায় ভাগ করা হয়। গঙ্গা-পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, সুরমা-মেঘনা এবং এদের অসংখ্য উপনদী ও শাখা-নদী বাংলাদেশে নিষ্কাশন প্রণালীর ধমনীর মতো কাজ করেছে। বাংলাদেশের বাইরে ভারত থেকে দেশের ভেতরে প্রবেশ করা গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র দুটি বড় নদী। এছাড়াও প্রায় ১৫০টির অধিক নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশে বাহির থেকে যেসব নদী প্রবেশ করেছে তাদের প্রবাহ উৎস ও প্রবাহপথ তথা অববাহিকা ভারত, চীন, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার জুড়ে বিস্তৃত। বাংলাদেশসহ এর মোট এলাকা ১৭,৪৯,০০০ বর্গ কিলোমিটার। বাংলাদেশ ১,৫০,০০০ বর্গ কিলোমিটার যা মোট এলাকার ৮.৫৭ শতাংশ মাত্র। হিমালয়ের চূড়া থেকে শুরু করে আমাদের উজানে থাকা পর্বতমালা থেকে নিঃসৃত জলধারা নদী হয়ে এদেশের বুক চিরে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। ফলে বাংলাদেশকে বলা হয়ে থাকে বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ অঞ্চল। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা এবং মেঘনা এই নদীসমূহের মিলিত নিষ্কাশন অববাহিকার আয়তনই প্রায় ১ কোটি ৬০ লক্ষ বর্গকিলোমিটার। নদীগুলো বঙ্গোসাগরে বয়ে নিয়ে আসে প্রচুর পরিমাণ পলি। ব্রহ্মপুত্র-যমুনাই শুধু প্রতিদিন ১,২০০,০০০ টন পলি বহন করে আনে। প্রতিবছর গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদী প্রণালীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে বয়ে আনা পলির পরিমাণ প্রায় ২.৪ বিলিয়ন টন।
অতএব, নদীর পানি প্রবাহের ওপরেই যে দেশের জন্ম, নদী বিপন্ন হলে সে দেশের অস্তিত্বও কতটা হুমকির সম্মুখীন হতে পারে– তা বলা বাহুল্য। নদী হারানোর সর্বনাশ এক-দুই বছরে, এক-দুই দশকে বোঝা দায়। বর্তমানে শুষ্ক মৌশুম আসলে দেখা যায় শতকরা ৯৭ ভাগ নদীর পানির প্রবাহ ও পরিমাণ হ্রাস পায়। অতএব, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের প্রাণ- এই নদীমালার কতটা জীবনহানি ও জীবনক্ষয় হয়েছে, তার ক্ষতির কোনো পরিসংখ্যানগত হিসাব আমাদের কাছে নেই।
বাংলাদেশের নদীগুলো যেভাবে “খুন” হচ্ছে; কারণ হিসেবে ভাগ করলে এর পেছনে তিনটি উৎস শনাক্ত করা যায়। এগুলো হলো– প্রথমত, ভারতের অন্যায় একতরফা আগ্রাসী তৎপরতা। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের নদীবিদ্বেষী উন্নয়ন কৌশল। এবং তৃতীয়ত, দেশের নদী দখলদারদের সঙ্গে পুলিশ প্রশাসনসহ রাজনৈতিক ক্ষমতার যোগসাজশ।
ভারত ও বাংলাদেশের অভিন্ন নদী ৫৪টি। বাংলাদেশের অবস্থান ভাটি অঞ্চলে হওয়ায় উজানে যে কোন ধরনের পানি নিয়ন্ত্রণের প্রত্যক্ষ প্রভাব বাংলাদেশই ভোগ করবে। কিন্তু সেদিকে দৃষ্টিপাত না করে কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধির অজুহাতে ভারত পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার রাজমহল ও ভগবানগোলার মাঝে ফারাক্কা নামক স্থানে এক মরণবাঁধ নির্মাণ করে। এই বাঁধের অবস্থান চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার পশ্চিম সীমানা থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার (১১ মাইল) উজানে গঙ্গা নদীর ওপর। ১৯৬১ সালে এর মূল নির্মাণ কাজ হাতে নেয়া হয় যা ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে শেষ হয়। ১৯৭৫ সালে ২১ এপ্রিল থেকে ২১ মে এই ৪১ দিনের জন্য অস্থায়ী ও পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা বাঁধটির সকল ফিডার ক্যানেল চালু করে। কিন্তু প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে নির্দিষ্ট সময়ের পর থেকে এটা ভারত আজ পর্যন্ত বন্ধ করেনি। ১৯৭৭ সালের চুক্তিতে কিছুটা সফলতা থাকলেও ১৯৯৬ সালের ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তির সফলতা কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে। কারণ এর গ্যারান্টি ক্লজ বা অঙ্গিকার অনুচ্ছেদ না থাকায় বাস্তবে ফলাফল প্রায় শূন্য। এই শত্রুভাবাপন্ন মনোভাবের কারণে আমাদের মত একটি ঘনবসতিপূর্ণ কৃষিনির্ভর দেশ আজ বিপন্ন। বিপন্ন এদেশের নদী, মাটি, কৃষি, বনজ সম্পদ, বন্যপ্রাণী, পাখি, মৎস্য ও পরিবেশ। এই জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ ধ্বংসের প্রধান কারণ ফারাক্কা বাঁধ। এই বাঁধের প্রভাবে দেশের মানচিত্র থেকে প্রায় ২০টি নদী মুছে গেছে এবং প্রায় ১০০টি নদীর মরণদশা (পত্রপত্রিকার তথ্য অনুযায়ী)। আর বাকিগুলোর বুকে চর জেগে ইতোমধ্যে জনবসতি শুরু হয়েছে এবং একই নদী একাধিক ক্ষুদ্র ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। স্রোত না থাকায় এদেশের নদীগুলোর তলদেশে পলি জমে এর উচ্চতা বেড়ে যাওয়া ও নদীসংখ্যা কমে যাওয়ায় প্রতি বছর অত্যধিক নদীভাঙনের কারণে শত শত কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে। এর ওপর আবার ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদী আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প! ভারতীয় আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প সম্পূর্ণরূপে চালু হলে আমাদের নদীগুলোতে প্রায় ৪০% ভাগ পানি প্রবাহ হ্রাস পাবে। কংক্রিটকেন্দ্রিক তথাকথিত ‘উন্নয়ন’, তার বড় শিকার আজ বাংলাদেশের নদীমালা– ফলস্বরূপ, দুই শতাধিক নদী কোনোভাবে বেঁচে আছে।
আমরা শুনে আসছি, প্রতিবেশী দেশ ভারত আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু। কথিত বন্ধু ভারত ফারাক্কাসহ অভিন্ন ৫৪টি নদীতে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের বিশাল এলাকা মরুভূমিতে পরিণত করেছে।
ভারত শুকনা মৌসুমে পানি আটকিয়ে রাখে, আর বর্ষায় মৌসুমে রাতের আঁধারে একসঙ্গে সব গেট খুলে দেয়। গ্রীষ্মে যখন আমাদের পানির প্রয়োজন হয়, তখন তারা আমাদের পানি না দিয়ে শুকিয়ে মারে। পানির অভাবে হাজার হাজার একর জমির ফসল নষ্ট হয়। আবার বর্ষার মৌসুমে যখন পানির প্রয়োজন নেই, তখন পানি ছেড়ে দিয়ে আমাদের বন্যায় ভাসায়। ভারত সরকারের এমন অমানবিক কর্মকাণ্ডে আমরা হতবাক।
স্বভাবতই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, ভারত আমাদের কেমন বন্ধু!’
একতরফা এই আক্রমণে বাংলাদেশের অসংখ্য ছোট নদী যেন এখন একেকটি মৃতখাল। কার্যত বাংলাদেশের বৃহৎ চার নদী– পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, তিস্তা এখন বিপর্যস্ত এবং আরও আক্রমণের মুখে। ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে ভারতের যে নদীবিধ্বংসী উন্নয়ন যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা গত চার দশকে বাংলাদেশের বৃহৎ নদী পদ্মা ও তৎসম্পর্কিত অসংখ্য ছোট নদী, খাল-বিলকে ভয়াবহভাবে বিপর্যস্ত করেছে। ফলাফল, অনেক নদ-নদী পরিণতি হয়েছে ময়লার ভাগাড়ে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা নদীর উল্লেখযোগ্য অংশ এখন শুকিয়ে গেছে; চর পড়ে গেছে। ভারসাম্যহীন পানিপ্রবাহে ক্ষতিগ্রস্ত উত্তরবঙ্গের বিশাল অঞ্চলের কৃষি। সেচের জন্য চাপ বাড়ছে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর, যা দীর্ঘমেয়াদে আরও জটিল প্রতিবেশগত সংকট তৈরি করছে। শুধু তাই নয়, পদ্মা নদীর এই ক্ষয় তার সঙ্গে সংযুক্ত নদীগুলোকেও দুর্বল করেছে। এই প্রভাব গিয়ে পড়ছে সুন্দরবন পর্যন্ত। সুন্দরবনের কাছে নদীপ্রবাহ দুর্বল হয়ে যাওয়ায় লবণাক্ততা বেড়েছে। একদিকে ফারাক্কার কারণে বাংলাদেশের জন্য অমূল্য সম্পদ সুন্দরবন অবিরাম আঘাতের সম্মুখীন হচ্ছে; অন্যদিকে তার সমাধান না করে ভারতীয় কোম্পানির কর্তৃত্বে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে এই সুন্দরবনের ওপর মরণ আঘাত করা হচ্ছে। বাংলাদেশ নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. ইনামুল হক বলেন, “ফারাক্কা বাঁধ দেয়ার আগে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ ছিল ৬০ থেকে ৮০ হাজার কিউসেক। ফারাক্কায় ওদের যে ডাইভারশন ক্যানেল, ব্যারেজের মাধ্যমে তারা ৪০ হাজার কিউসেক পানি সরিয়ে নিতে পারে। তো সেটি সরিয়ে নেয়ার পরে যেটি থাকে সেটি পায় বাংলাদেশ।” গঙ্গা চুক্তিতে অন্তত ২৭ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার কথা রয়েছে। তবে চুক্তির আগে অনেক সময় ১০ হাজার কিউসেকেরও কম পানি এসেছে বলে জানান মিস্টার হক।
“বিশেষ করে ইলিশ মাছ এবং চিংড়ি মাছের বিরাট ক্ষতি হয়েছে, তাদের প্রজণনে মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে,সংখ্যা কমে গেছে। এছাড়া অন্যান্য মাছেরও ক্ষতি হচ্ছে। আর উপকূল এলাকায় একটা মিষ্টি পানির ওপর নির্ভরশীল যাদের জীবন, সেটা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে,” বলছিলেন মিস্টার হক। ফারাক্কার বিষক্রিয়া শুধু বাংলাদেশ নয়; পশ্চিমবঙ্গ ও তার আশপাশেও পড়ছে। একদিকে পানিশূন্যতা; অন্যদিকে অসময়ের বন্যা ও অতিরিক্ত পলি। এমনকি বিহারের মানুষ শাবল নিয়ে মিছিল করেছে ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দেয়ার দাবিতে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রীও এই বাঁধ ভেঙে ফেলার দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু এসব অভিজ্ঞতাও ভারতের বাঁধকেন্দ্রিক উন্নয়ন চিন্তা ও বাঁধ ব্যবসায়ীদের থামাতে পারেনি। তাছাড়া ভারতের শাসকদের চিন্তা-পদ্ধতিতে ভাটির দেশ বাংলাদেশের স্বার্থ ও অধিকার বিষয় একেবারেই অনুপস্থিত। মণিপুরে টিপাইমুখ বাঁধের প্রস্তুতি পুরোটাই চলেছে একতরফা। এই বাঁধ বাংলাদেশের আরেক বৃহৎ নদী– মেঘনার জন্য যে বড় হুমকি হবে, তা বাংলাদেশ ও ভারতের স্বাধীন বিশেষজ্ঞরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন। ম্যাপ দেখলে দেখা যায়, ভারত থেকে বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত নদীগুলোর ওপর বিভিন্ন স্থানে কাঁটার মতো সব বাঁধ। তিস্তা নদীর ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। গজলডোবা বাঁধ দিয়ে যেভাবে একতরফা পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে, তা স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। গ্রীষ্মকালে তাই বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বিশাল অঞ্চল পানির অভাবে খাঁ-খাঁ করে। তিস্তার প্রবাহ এখন শতকরা ১০ ভাগেরও নিচে নেমে এসেছে। ফারাক্কা ও গজলডোবা ছাড়াও মনু নদীতে নলকাথা বাঁধ, যশোরে কোদলা নদীর ওপর বাঁধ, খোয়াই নদীর ওপর চাকমা ঘাট বাঁধ, ফুলবাড়ীতে মহানন্দা নদীর ওপর বাঁধ, গোমতী নদীর ওপর মহারানী বাঁধ, মুহুরি নদীর ওপর কলসী বাঁধসহ আরও ১৫-২০টি অস্থায়ী কাঁচা বাঁধ কার্যকর রয়েছে। এখানেই শেষ নয়। ভারত পৃথিবীর বৃহত্তম নদী সংযোগ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্প অনুযায়ী ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গার পানি ১৪টি নতুন খননকৃত খালের মাধ্যমে পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের দিকে প্রবাহিত করা হবে। এটি কার্যকর হলে অন্যান্য নদীর সঙ্গে বাংলাদেশের আরেকটি বৃহৎ নদী, যমুনা আক্রান্ত হবে। শুকিয়ে যাবে অধিকাংশ নদী-উপনদী। যুক্তরাষ্ট্রের পর ভারত ও চীনই সর্বোচ্চ সংখ্যক বাঁধ তৈরির দেশ। এ দুই দেশের মোট বাঁধ পৃথিবীর সর্বমোট বাঁধের ৫৫% ভাগ। বাংলাদেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে বাঁধ (রাবার ড্যামসহ) তৈরির মাধ্যমে যেসব নদীকে ক্ষতিগস্থ করা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে– বড়াল, ধনগোদা, ফেনী, গড়াই, হালদা, কপোতাক্ষ, মনু, মেঘনা, মহুরী, তিস্তা ও গোপলা।
ভারত ১৯৬৬ সালের নদী সনদ The Helsinki Rules on the Uses of the Waters of International River ও ১৯৯৭ সালের UN Watercourses Convention বা জলপ্রবাহ সনদে ১টি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত সাপেক্ষে স্বাক্ষর করে। শর্তটি হলো, ভারতের বিরুদ্ধে নদী প্রবাহ সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ আন্তর্জাতিক আদালতে উত্থাপন করা যাবে না৷
ভারত এ যাবৎকালে বাংলাদেশে প্রবেশকারী নদীগুলোতে সেচ প্রকল্প, ক্যানেল খনন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প, গ্রোয়েন ও ব্যারাজ নির্মাণের নামে ৩০০০+ বাঁধ দিয়েছে। এর মধ্যে বিশ্বের ৯ম বৃহত্তর ও ১৫তম দীর্ঘতম নদী ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার নদীতে দিয়েছে ১২টি বাঁধ। কিন্তু আমরা কেবল ফারাক্কা, গজলডোবা, ডম্বুলা ও টিপাইমুখ নিয়ে সিরিয়াস।
ভারত যেভাবে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ নদীগুলোর জীবন সংশয় ঘটাচ্ছে, তা শুধু বাংলাদেশের নয়, ভারতের জনগণ; সর্বোপরি সমগ্র মানব সমাজের বড় ক্ষতি। দেশ চালনাকারীরা জনগণের স্বার্থ কেন্দ্রে রেখে উন্নয়ন নীতি সাজালে এই নদী ও খাল-বিলের জীবনও সচল করতেন এবং ভারতের এসব আগ্রাসী তৎপরতার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভূমিকা গ্রহণ করতেন। আন্তর্জাতিক পানি কনভেনশন অবলম্বন করে সরব হতেন। না; সেসব ভূমিকা নেই। উল্টো তারা নদ-নদী, সুন্দরবন সবই ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। ভারতের পণ্য-যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য তিতাস নদীর ওপর আড়াআড়ি বাঁধ দেওয়ার মতো অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটেছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল জুড়ে পৃথিবীর একমাত্র বৃহত্তর প্রাকৃতিক এই ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনটি দিন দিন বিনাশ হচ্ছে। উজানে ভারত গঙ্গার ওপর ফারাক্কা বাঁধ ও অন্যান্য নদীতে বাঁধের কারণে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এই অমূল্য সম্পদ আজ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বনটি বেঁচে থাকার জন্য যে পরিমাণ স্বাদু পানির প্রয়োজন, তা পাচ্ছে না। উজান থেকে পানিপ্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় সাগর থেকে জোয়ারের সময় মাত্রাতিরিক্ত লোনাপানি বিভিন্ন নদী, খাল ও ছড়া দিয়ে বনের ভেতরে প্রবেশ করে। এই লোনাপানি বনের ভেতর প্রবেশের কারণে সুন্দরবনের পানি ও মাটির লবণাক্ততা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষের পাকা ফল মাটিতে পড়ে বীজ থেকে অঙ্কুর এবং অঙ্কুর থেকে চারাবৃক্ষ জন্মাতে পারছে না। কেননা ছোট ছোট চারাগাছের বেঁচে থাকার জন্য যে পরিমাণ স্বাদু পানির প্রয়োজন, তা না পাওয়াতে অর্থাৎ প্রয়োজনীয় পানির অভাবে বৃক্ষশূন্য অঞ্চলে বাষ্পীভবন বেশি হওয়ায় পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যায়। অন্য দিকে এই বৈরী পরিবেশের কারণে বনে পাখির সংখ্যাও হ্রাস পাচ্ছে। ফলে যে সব পাখি ফল খেয়ে বীজ অন্যত্র নিয়ে ফেলে, সেখানেই চারা গজায়। আর সেই চারাগাছই একদিন বিশাল বৃক্ষে পরিণত হয়।
প্রয়োজনীয় পানির অভাবে সুন্দরবনের সুন্দরী বৃক্ষরাজি আজ বিপন্ন। ইতোমধ্যে অত্যধিক লোনাপানি বনে প্রবেশের কারণে সুন্দরী আগা মরা রোগের (টপ ডাইং) বিস্তার অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এই রোগ। দেশের ভেতরে রাজনৈতিক হানাহানি, মানুষের ভেতর দেশপ্রেমের অভাব ও জন-সচেতনার কারণে দেশের অমূল্য সম্পদ সুন্দরবন আজ ক্রমশ ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে, সুন্দরবনের প্রায় ৪০ ভাগ সুন্দরী গাছ আগা মরা রোগে আক্রান্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে, লোনা ও স্বাদুপানির মিশ্রণের অনুপাত সঠিক না থাকা অর্থাৎ সুন্দরবনের মিঠাপানির প্রবাহ কমে যাওয়ার ফলে দেখা দিয়েছে লোনাপানির আধিক্য। ফলে গাছের ডগায় এবং শেকড়ে পোকার আক্রমণ বেড়েছে। বনের ভেতরে নদী ও খালে পলি পড়ে নাব্যতা হ্রাস হেতু পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে মৃত্তিকার বিশেষ উপাদানের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তবে মিঠাপানি প্রবাহ হ্রাস পেয়ে লবণাক্ততা বৃদ্ধিই সুন্দরবন বিনাশের প্রধান কারণ বলে সর্বজনমহলে স্বীকৃত।
সুন্দরবনের মাটি ও পানিতে মৃদু লবণাক্ততা উদ্ভিদের জন্য সহায়ক হলেও অতিরিক্ত লবনাক্ততার কারণে সুন্দরবন ও এর আশপাশের বৃক্ষশোভিত সকল বেষ্টনী বিপন্ন হতে চলেছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, মাটিতে ১ হাজার থেকে ২ হাজার মাইক্রোমস ও পানিতে ৩ হাজার মিলিমস পর্যন্ত লবণের পরিমাণ সহনীয়। সুন্দরবনের আশেপাশে ইছামতি, পশুর, রায়মঙ্গল, মালঞ্চ প্রভৃতি নদীতে বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে লবণ ছিল ১৯ হাজার মিলিমস। এর পরিমাণ বেড়ে বর্তমানে ৬০ হাজার মিলিমসে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে ১৯৮৬ সালে সুন্দরবনের মাটিতে লবণ ছিল ৩২ হাজার মাইক্রোমস, যা বর্তমানে প্রায় ৪০ হাজার মাইক্রোমস এ দাঁড়িয়েছে। জোয়ারের সময় লোনাপানি সাগর থেকে সুন্দরবনের নদ-নদীতে প্রবেশ করে। নদীতে স্বাদু পানির স্বাভাবিক প্রবাহ থাকলে সেই প্রবাহ সাগরের লোনাপানিকে ঠেলে পুনরায় সাগরে নিয়ে যায়। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে বাংলাদেশের নদীগুলোতে শুকনো মৌসুমে পানি শূন্যতা দেখা দিয়েছে, যার অনিবার্য পরিণতি লবণাক্ততা। এই লোনায় আক্রান্ত সুন্দরবনের সবুজ বন ও গাছপালা দিন দিন বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। সাগরের লোনাপানির আঘাতে বেশ কয়েক প্রজাতির ধান ও মাছ বিলুপ্ত হয়েছে। এমনকি লোনা পানির আধিক্যের কারণে বনের বিভিন্ন এলাকা “ব্লাস্ট ও টপ ডাইং” রোগে আক্রান্ত হয়ে লক্ষ লক্ষ গাছ মারা গেছে এবং যাচ্ছে।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট অনুযায়ী খুলনা অঞ্চলের প্রধান কয়েকটি নদীতে গত কয়েক বছর ধরে লবণাক্ততা বৃদ্ধির হার ৫০ শতাংশেরও বেশি। খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার বেশির ভাগ নদ-নদীতেই এখন স্বাভাবিকের চেয়ে বহুগুণ লবণাক্ততা বিরাজ করছে। খুলনা জেলার রূপসা, শিবসা, কাজীবাছা ও পশুর নদীতে ২০০২ সালের মার্চ মাসের তুলনায় ২০০৩ সালের মার্চে লবণাক্ততা গড়ে প্রায় ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। রূপসা নদীতে গত এক বছরে লবণাক্ততা বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৮৫ শতাংশ, শিবসায় ৫৬ শতাংশ, কাজীবাছায় ২৫ শতাংশ এবং পশুর নদীতে এ হার ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ভারত কর্তৃক গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ এবং অন্যান্য বাঁধ দেয়ার কারণে দেশের বৃহত্তম বন সুন্দরবন বিনাশের পথে। কারণ ফারাক্কা বাঁধ চালুর আগে এরকম কোন সমস্যার সৃষ্টি হয়নি। শত শত বছর ধরে সুন্দরবন প্রাকৃতিকভাবে তার আপন সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য এবং এর জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করে চলছিল। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধের কারণে বনটি এখন মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করছে। বনটি বিনাশের সাথে সাথে ধ্বংস হচ্ছে দেশের জীববৈচিত্র্য এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এর সাথে সংশ্লিষ্ট লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকার পথ। এভাবে চলতে থাকলে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসবে দেশের পরিবেশ ও অর্থনৈতিক খাতে। এরপর যদি ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয় তাহলে কী হবে আমাদের দেশের অবস্থা! কী হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পরিণতি!
দ্বিতীয়ত, নদী বিনাশের সঙ্গে যোগ হয়েছে দেশের ভেতরের তৎপরতা। বাংলাদেশের নদ-নদী ও খাল-বিল অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে পানিপ্রবাহের ওপর ৫০ দশক থেকে ধারাবাহিক আক্রমণ এসেছে ‘উন্নয়ন’ নামক বিভিন্ন প্রকল্পের সুবাদে। এসব প্রকল্প করা হয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ সুবিধা সম্প্রসারণে বাঁধসহ নির্মাণমুখী কর্মসূচি হিসেবে। কিন্তু বন্যা তো নিয়ন্ত্রণ হয়নি, সেচ সুবিধাও কাজ করেনি; সর্বোপরি মূল লক্ষ্য খাদ্য উৎপাদনেও ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছে। এর অনেক দৃষ্টান্ত আছে। এখানে শুধু একটি দৃষ্টান্তই যথেষ্ট, যার ফলে বড়াল নামের একসময়ের উত্তাল নদী এখন মৃতপ্রায়।
বড়াল নদী বাংলাদেশের দুই প্রধান নদী, পদ্মা-যমুনার সংযোগ স্থাপনকারী নদী। দৈর্ঘ্যে প্রায় ২০৪ কিলোমিটার, ১২০ মিটার প্রস্থ। এর অববাহিকা ৭৭২ বর্গকিলোমিটার। এর সঙ্গেই আছে চলনবিল। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এই নদীর মুখে সুইচ গেট, ক্রস ড্যাম, বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। অন্য প্রকল্পগুলোর মতো এটিরও সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন ও পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি, নৌপথ সম্প্রসারণ লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করা হয়েছিল। প্রথম তিন বছর উৎপাদন ভালোই দেখা গেলেও এর পরে শুরু হয় বিপর্যয়। ফারাক্কার কারণে এমনিতেই পদ্মা নদীর প্রবাহ কম ছিল; উপরন্তু বড়াল নদীর মুখে সুইচ গেট বসানোতে পদ্মা থেকে আসা পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। স্রোত কমে যায়, বহু জায়গায় জলাবদ্ধতা দেখা যায়। যমুনায় যেখানে বড়াল গিয়ে মেশে, সেখানে পানিপ্রবাহ খুবই নিম্নস্তরে নেমে যাওয়ায় যমুনা নদীও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ভাঙন বিস্তৃত হয়। অববাহিকার প্রায় এক কোটি লোকের জীবন-জীবিকা এখন হুমকির মুখে। বড়াল শুকিয়ে যে জমি উঠেছে, তা এখন নানাজনের দখলে। তৃতীয়ত, বিভিন্ন নদীর এই পরিস্থিতি সৃষ্টির সুবিধাভোগীও আছে। এদের প্রধান অংশ– সম্পদ ও ক্ষমতায় শক্তিশালী, সমাজের অভিজাত শ্রেণী। নদী দুর্বল হয়ে গেলে নদী ক্রমাগত জমিতে রূপান্তরিত হয়। তখন তা দখল করা অনেক লাভজনক। নদী বাঁচলে তার মূল্য টাকার অঙ্কে পরিমাপ করা যায় না; কিন্তু মরলে তার দাম শত বা হাজার কোটি টাকা হয়ে যায়। সে জন্যই যারা এর ভাগীদার তারা নদীবিধ্বংসী উন্নয়ন ধারা বহাল রাখতে অনেকেই আগ্রহী। তাছাড়া এসব বাঁধ বা নির্মাণ কাজ প্রধানত বিদেশি ঋণের টাকায় হয়। ফলাফল যাই হোক, ঋণদাতা, কনসালট্যান্ট, ঠিকাদার, আমলা ও ভূমিদস্যুদের লাভ অনেক। দখলজনিত কারণে এভাবেই ১৫৮ টি প্রশস্ত নদী আজ ক্ষীণকায়, যার মধ্যে রয়েছে- বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ, বংশী (টঙ্গী), কালিগঙ্গা (মানিকগঞ্জ), ভৈরব, চিত্রা, কপোতাক্ষ ও নবগঙ্গা (যশোর), নরসুন্দা ও কলাগাছিয়া (কিশোরগঞ্জ), সুরমা (সিলেট) ও কর্ণফুলী (চট্টগ্রাম)। কয়েক বছর পূর্বে আশুগঞ্জে জনৈক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তির ঘনিষ্ট এক আত্মীয় একটি প্লাস্টিক কারখানা নির্মাণের জন্য বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী মেঘনার অভ্যন্তরে প্রায় চারশত ফুট স্থানে মাটি ভরাট করেছিল। বাপা’র আন্দোলন ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি নির্দেশের ফলে তা শেষ পর্যন্ত অপসারিত হয়। বর্তমানে হবিগঞ্জের সোনাই নদীর মধ্যখানে নিজস্ব জমিতে নির্মিত হয়েছে একজন রাজনৈতিক দখলদারের বহুতল বিশিষ্ট ভবন। নদীর ভিতরে জাজ্বল্যমান এই ভবনের মাথা উঁচু হচ্ছে প্রতিদিন, কিন্তু সরকারি প্রশাসন এমনকি শেষ পর্যন্ত জাতীয় নদী রক্ষা টাস্কফোর্স এই ভবনটিকে ‘নদীর বাইরে’ বলে প্রত্যায়ন করেছিল। জাতীয় নদী কমিশন গঠিত হওয়ার পর প্রথমে এই ভবনটিকে নদীর বাইরে বলে সত্যায়িত করলেও, কমিশনের বর্তমান প্রধান এটিকে নদীর দখলদার হিসেবে ঘোষণা করেছেন। কিন্তু তাতে ভবন তৈরির কাজ বন্ধ হয়নি। নদীর জমি চিহ্নিতকরণ ও নদীর পাড় সংরক্ষণে বিদ্যমান পরিষ্কার আইনি বিধানকে না মানা, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও দুর্ণীতি, প্রভাবশালী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বেআইনি ভোগ-দখল-সংস্কৃতি, ভূমি মন্ত্রণালয়ের আইন বহির্ভূত নদীর জমি লিজ প্রদান চর্চা প্রভৃতি নদী দখল ও বিনষ্টের প্রধান কারণ।
এরকম আরও অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন এক সময়ের পদ্মার প্রধান শাখানদী প্রমত্তা গড়াই এখন শুকনো মৌসুমে থাকে প্রায় পানি শূন্য। কেবল বর্ষা মৌসুমে কিছুটা প্রবাহ লক্ষ্য করা যায়। রাজবাড়ি জেলার ওপর থেকে বয়ে যাওয়া সেরাজপুর হাওড় ও চন্দনা এখন মৃত নদী। ফরিদপুরের কুমার নদী দিয়ে কয়েক দশক আগেও বড় বড় স্টিমার চলাচল করত। কিন্তু সেদিনের সে কুমার এখন কঙ্কাল নদী। বৃহত্তর কুষ্টিয়া এবং যশোর অঞ্চলের প্রায় সকল নদীর মাতা-নদী ছিল মাথাভাঙ্গা। এখন শুকনো তো দূরের কথা, বর্ষা মৌসুমেও এককালের প্রমত্তা মাথাভাঙ্গা থাকে নীরব, নিথর ও প্রাণহীন।
আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারের আইনগত ভিত্তি :
আন্তর্জাতিক নদী আইন অনুযায়ী একটি নদী যদি দুই বা ততোধিক রাষ্ট্রের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় তবে ঐ নদীর পানি সম্পদের ব্যবহার আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পরিচালিত হবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে এমনভাবে আন্তর্জাতিক নদীকে ব্যবহার করবে তাতে যেন অপরাপর রাষ্ট্রসমূহের সহজাত অধিকার ও স্বার্থ ক্ষুণ্ণ না হয়। যে দেশের ওপর দিয়ে নদী প্রবাহিত, নদীর সে অংশের পানি সে দেশের পক্ষে ইচ্ছেমত ব্যবহারের একচেটিয়া অধিকার আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত নয়। এ সম্পর্কে প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ওপেনহেইম বলেন ‘‘কোন রাষ্ট্রকে নিজ ভূখন্ডের প্রাকৃতিক অবস্থা এমন করে পরিবর্তন করতে দেয়া যাবে না যার ফলে প্রতিবেশি কোন রাষ্ট্রের ভূখন্ডের প্রকৃত অবস্থায় কোন অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে।’’ আন্তর্জাতিক নদীর ব্যবহার সংক্রান্ত অনুরূপ মতামত ব্যক্ত করেছেন আন্তর্জাতিক আইন ইনস্টিটিউটও।
পৃথিবীতে প্রায় ২১৪টি আন্তর্জাতিক নদী রয়েছে। এই নদীসমূহ একাধিক স্বাধীন দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত। এসব নদীর মধ্যে আমাজন, জায়ার, জাম্বেসী, দানিয়ুব, নাইজার, নীল, রাইন, মেকং, লেকচাঁদ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যে কোন আন্তর্জাতিক নদীর ওপর তীরবর্তী রাষ্ট্রের অধিকার সমঅংশীদারিত্বের নীতির ওপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক নদী সম্পদের তীরবর্তী রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সুষম বণ্টনের নীতি আজ স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক নদীর ব্যবহার সম্পর্কে ১৮১৫ সালে ভিয়েনা সম্মেলনে এবং ১৯২১ সালে আন্তর্জাতিক দানিয়ুব নদী কমিশন কর্তৃক প্রণীত আইনে এই নীতির উল্লেখ রয়েছে।
১৯৬৬ সালে আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি সম্মেলনে গৃহীত নীতিমালার ১৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি রাষ্ট্র তার সীমানায় আন্তর্জাতিক পানি সম্পদের ব্যবহার অধিকার ভোগ করবে যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। পানি সম্পদের সুষম বণ্টনের নীতি ১৯৭২ সালে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত মানব পরিবেশ সংক্রান্ত জাতিসংঘের কনফারেন্স ঘোষণাপত্রের ৫১ অনুচ্ছেদে স্থান লাভ করে।
যে নদী একবার একাধিক দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, তার ব্যবহার সম্পর্কে স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে। সেখানে নিজ দেশের আইন দ্বারা কখনোই তা নির্ধারিত হয় না। কিংবা নিজ দেশ এককভাবে সেই পানি ব্যবহার করে পার্শ্ববর্তী দেশকে পানির ব্যবহার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। কিন্তু প্রতিবেশি দেশ ভারত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোন আইন মানছে না। শক্তির জোরে একের পর এক বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ৫৪টি নদীর প্রায় সকল প্রবাহ পথে বাঁদ দিয়ে বাধার সৃষ্টি করে এর বিশাল পানিপ্রবাহ কৃত্রিম খালের সাহায্যে উঁচু অঞ্চলে প্রবাহিত করে কৃষিক্ষেত্রসহ ইচ্ছেমতো সকল ক্ষেত্রে পানি ব্যবহার করছে। আর এই প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯৭৫ সাল থেকে। প্রথম ১৯৭৫ সালে ৪১ দিনের (২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে) অজুহাতে বাংলাদেশ সরকারকে আই ওয়াশ বা প্রতারণার ফাঁদে ফেলে বহু বিতর্কিত ফারাক্কা বাঁধটি চালু করে। ওয়াদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও বাঁধটি আর বন্ধ করেনি এবং পর্যায়ক্রমে অন্যান্য সকল আন্তর্জাতিক নদীসহ ভারতের ওপর দিয়ে বয়ে আসা সকল নদীর মুখে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের সকল প্রবাহপথ বন্ধ করে দিয়েছে। এদের মধ্যে গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধ, ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপর বাঁধ, মুহুরী নদীতে বেলুনিয়া বাঁধ, পিয়াই নদীর ওপর পিয়াই বাঁধ, খোয়াই নদীর ওপর শহর প্রতিরক্ষা বাঁধ। এই সকল নদীতে বাঁধ, গ্রোয়েন নির্মাণ কিংবা সুইচ গেট নির্মাণসহ আরও অসংখ্য ছড়ানদীতে বাঁধ বা সুইচগেট নির্মাণ করে পানির স্বাভাবিক প্রবাহপথে বাধার সৃষ্টি করছে। এই বেআইনী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ বার বার প্রতিবাদ জানালেও তাতে তারা কোন কর্ণপাত করেনি। ফলে ফারাক্কাসহ ঐ সকল বিপদজনক বাঁধের প্রভাবে সারা বাংলাদেশ ক্রমশ মারাত্মক বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। নদীমাতৃক, সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা এ অপরূপ বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় পানির অভাবে আজ দিন দিন বিরাণ ভূমিতে পরিণত হচ্ছে। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বিশাল জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত দরিদ্র এই দেশটির উন্নয়নের সকল ক্ষেত্র। গুরুত্বপুর্ণ এই সেক্টরের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার দেশের অর্থনৈতিক খাত। পানির সাথে সংশ্লিষ্ট দেশের শিল্পকারখানা, নৌ-পরিবহন, নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা, মৎস্যসম্পদ, বনজসম্পদ, জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ বিপর্যয়, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসসহ মৃত্তিকার জলীয়তা ও লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে দেশ এক মারাত্মক সংকটের দিকে এগুচ্ছে। প্রয়োজনীয় পানিপ্রবাহের অভাবে প্রায় সকল নদীর নাব্যতা ভীষণভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে প্রতিবছর অকাল বন্যা ও প্রকট নদীভাঙনের শিকার হচ্ছে নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের অধিবাসীরা। তারা সড়ক, মহাসড়ক ও রেললাইনের পাশে আশ্রয় নিচ্ছে এবং ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
ফারাক্কা বাঁধের পর তিস্তা বাঁধ, টিপাই বাঁধ প্রকল্প এবং আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প ইত্যাদির প্রতিক্রিয়ায় দেশ নিশ্চিত মরুকরণের পথে এগুচ্ছে। ফারাক্কা বাঁধ ও আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প ভারতের একটি সূদুর প্রসারী চক্রান্ত; বাংলাদেশ নামের এ ভূ-ভাগকে চিরতরে মরুভূমির দিকে ঠেলে দেয়ার প্রয়াসমাত্র।
এছাড়াও, ভারতীয় অ্যাক্টিভিস্টদের দাবি, এভাবে বাঁধ দেওয়ার কারণে নদী সরে যাচ্ছে এবং বিপুল এলাকায় দেখা দিচ্ছে খরা ও বন্যা। ভারতের বিখ্যাত অ্যাক্টিভিস্ট মেধা পাটকার সম্প্রতি বিবিসিকে বলেন, ‘ভারতেও ফারাক্কা এখন সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি ঘটাচ্ছে। দেশটির জন্যও ফারাক্কা এখন যত না উপযোগী, তার চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংস ডেকে আনছে।’
বাংলাদেশের প্রতিবাদ:
১৯৬১ সালে পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কা নামক জায়গায় বাঁধ নির্মাণ শুরু করে ভারত। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার শুরু থেকেই প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারপর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে নানা আলোচনার আড়ালে ফারাক্কা বাঁধ চালু করে ভারত। কিন্তু ভারতের প্রতিশ্রুত পানি বাংলাদেশ কখনোই পায়নি।
সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানও ফারাক্কা বাঁধের বিরোধিতা করেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে জাতিসংঘেও সোচ্চার ছিলেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি করেন। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ কখনোই পানি পায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের প্রতিবাদের মুখে ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ১০০ কিলোমিটার উজানে ভারতের বরাক নদীর ওপর ২০০৯ সালে এটি নির্মিত হয়। এই বাঁধ টিপাইমুখ নামের গ্রামে বরাক ও তুইভাই নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত। অভিন্ন নদীর উজানে এই বাঁধ ভাটির বাংলাদেশের পরিবেশ আর অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে এমন আশঙ্কা সত্ত্বেও ভারত কর্ণপাত করেনি।
সম্প্রতি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে। উজানের পানি ত্রিপুরার বিভিন্ন জনপদ ভাসিয়ে হু হু করে ঢুকছে বাংলাদেশে। ভারী বর্ষণের সঙ্গে উজান থেকে বানের পানি ঢুকতে থাকায় ফেনী জেলায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। ঘরে-ঘরে পানি-বন্দি হয়ে আছে অসহায় মানুষ, গবাদি-পশুসহ অন্যান্য প্রাণী, বানের জলে ভেসে যাচ্ছে কত কত প্রাণ! স্মরণকালের ভয়াবহ এই বন্যা, চারদিকে অসহায় মানুষের হাহাকার। বন্যা আক্রান্ত ১১ জেলার মধ্যে সবেচয়ে নাজুক পরিস্থিতি ফেনীতে। অধিকাংশ এলাকায় ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। উদ্ধার কাজ করা যাচ্ছে না। স্রোতের তীব্রতা অনেক। অনেক জায়গায় হেলিকপ্টার ছাড়া উদ্ধার কাজ সম্ভব নয়। স্থানীয়রা বলছেন, বানের পানি কমতে শুরু করলেও ত্রাণ বিতরণের চেয়ে মানুষকে উদ্ধার করা বেশি জরুরি। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় এবং পানির প্রবল স্রোতের কারণে উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে বানভাসি মানুষের বাঁচার আকুতি প্রবল হয়ে উঠেছে। মুহুরী নদীর বানে ফেনী জেলা যে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে, ইতিহাসে তার নজির নেই। সম্পদ যা গেছে, তা গেছে; এ জেলার চার উপজেলার চার লাখ মানুষ এখন প্রাণ বাঁচানো নিয়েই শঙ্কায়। ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে। বন্ধ রয়েছে সড়ক যোগাযোগ, নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। বেশিরভাগ এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্কও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। এখন একটু একটু করে মোবাইল সংযোগ স্থাপিত হচ্ছে। তবে এখনও ফোনেও যোগাযোগ করতে না পেরে উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষায় আছেন অন্য জেলায় থাকা স্বজনরা। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় এবং পানির প্রবল স্রোতের কারণে উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে বানভাসি মানুষের বাঁচার আকুতি প্রবল হয়ে উঠেছে। বন্যা আক্রান্ত সব জেলায় রাতদিন আতঙ্ক, মানুষের আর্তি আর বন্যার প্রবল বিধ্বংসী রূপ, প্রাণ বাঁচাতে ভিটেমাটি ছেড়ে সামান্য কয়েকটি কাপড়চোপড় সম্বল করে বাড়ি থেকে বের হতে বাধ্য হচ্ছেন অসহায় মানুষ। বন্যা ও বৃষ্টির মধ্যে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে, মাথায় গাছ পড়ে এবং পানিতে তলিয়ে মানুষ মারা গেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ফেনী অংশের কিছু স্থানে প্রায় কোমড় সমান পানি উঠে গেছে। মৌলভীবাজারের মনু, কুশিয়ারা, জুড়ি ও ধলাইসহ সবকটি নদনদীর পানি বেড়ে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
তাই সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন সময় এসেছে এই ব্যাপারে বাঁধগুলোর ব্যাপারে সোচ্চার হওয়ার। অভিন্ন নদীতে ভারত যেসব বাঁধ দিয়েছে সেগুলো নিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা করা এখন সময়ের দাবি। কেননা অভিন্ন নদীতে কোনো একটি দেশের একক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নেই।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য করণীয় :
১. দেশের ভেতরে এবং বাইরে এ বিষয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টি করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করতে হবে।
২. শুষ্ক মৌসুমে ভারত ফারাক্কা ব্যারেজের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ন্যায্য পানির হিস্যা দিচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে দু’দেশের চুক্তির প্রতি খেয়াল বা নজরদারী রাখতে হবে। দু’দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে এ বিষয়টির গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে।
৩. প্রয়োজন হলে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগী সংস্থা’র অন্য সদস্য দেশসমূহের সাহায্য নিতে হবে। আমাদের নদীর নাব্যতা বাড়াতে প্রয়োজনে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বৃহৎ নদী ও হাওড় এবং বরেন্দ্র এলাকার নদী সমূহে পরিকল্পিতভাবে জলাধার তৈরি করতে হবে, যাতে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা যায় এবং শুষ্ক মৌসুমে কৃষি ও সেচ কাজে প্রয়োজন মত ব্যবহার করা যায়।
৪. ভারতের আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিরোধ করতে হবে।
৫. বিষয়টি বিশ্ববাসীকে জানানোর জন্য আন্তর্জাতিক ফোরামে উপস্থাপন করতে হবে।
৬. কুটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। সরকারের পাশাপাশি প্রবাসীদের বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে।
যে তথাকথিত ‘উন্নয়ন’ নদীকে বিপন্ন করে, নদীর সাড়ে-সর্বনাশ করে ছাড়ে; তাতে জিডিপি বৃদ্ধি পেলেও তা প্রাণিজগৎকে করে বিপন্ন। তাই এধরণের কার্যক্রম প্রতিরোধে জনগণ ও সিভিল সোসাইটি সমুহকে সক্রিয় হতে হবে।
এই নদী ও বন বাংলাদেশের মানুষের বর্তমান ও ভবিষ্যতের অস্তিত্বের অবলম্বন। এগুলো কেবল নদী নয়; আমাদের দেশ ও মানুষের প্রাণ। তাই নদী বাঁচানোর জন্য জনমত সৃষ্টি আমাদের সবার দায়িত্ব।