শিউলিমালা একাডেমি

বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরের ইতিহাস ও ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে শত শত বছর ধরে চলে আশা সমুদ্র বাণিজ্য একটি দেশের প্রাণস্বরুপ। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সমুদ্র বন্দর সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ, দক্ষিণ এশিয়ার একটি উপকূলীয় দেশ, যার রয়েছে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূল রেখা। এই ভৌগোলিক অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য ও যোগাযোগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ তিনটি প্রধান সমুদ্র বন্দর- চট্টগ্রাম, মংলা ও পায়রা এবং নির্মাণাধীন মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। চট্টগ্রাম, মোংলা, পায়রা, এবং নির্মাণাধীন মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্রে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে সহায়ক। নিম্নে বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর সমূহ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এদের অবস্থান ও গুরুত্ব, সম্মুখীন বিভিন্ন জটিলতা ও চ্যালেঞ্জসমূহ এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এই বন্দরকেন্দ্রিক সম্ভাবনাসমূহ তুলে ধরা হলো।

চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর

চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম শহরে অবস্থিত বাংলাদেশের প্রধান সামুদ্রিক বন্দর এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন বন্দর। বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি প্রাচীন এই বন্দর বাণিজ্য, সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের নানা অধ্যায়কে ধারণ করে আছে। এটি কর্ণফুলী নদীর মোহনায় অবস্থিত।

চট্টগ্রাম বন্দর প্রাচীনকাল থেকেই বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে আরব বণিকদের জাহাজ চলাচল ও সামুদ্রিক বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল ছিল এই বন্দর। অষ্টম-নবম শতাব্দী থেকে চট্টগ্রাম বন্দর আরব ব্যবসায়ীদের উপনিবেশে পরিণত হয়। গঙ্গার বদ্বীপে অবস্থিতির কারণে আরব বণিকরা একে “শাত-উল-গঙ্গ” নামে ডাকতেন, যার অর্থ গঙ্গার বদ্বীপ। ১৫১৭ সালে পর্তুগিজরা চট্টগ্রামে আগমন করে এবং বন্দরটির সমৃদ্ধি ঘটে। তারা একে “পোর্টো গ্র্যান্ডে” বা বিশাল বন্দর নামে পরিচিত করে তোলে। ১৬৬৬ সালে মুঘল সেনাপতি শায়েস্তা খাঁ চট্টগ্রাম দখল করেন, যা মুঘল সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে ওঠে। ইংরেজ শাসনের প্রথম দিকে ইংরেজ ও দেশীয় ব্যবসায়ীরা বার্ষিক এক টাকা সেলামির বিনিময়ে নিজ ব্যয়ে কর্ণফুলি নদীতে কাঠের জেটি নির্মাণ করেন। পরে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম দুটি অস্থায়ী জেটি নির্মিত হয়। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনার গঠিত হয়। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বন্দরে দুটি মুরিং জেটি নির্মিত হয়। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনার কার্যকর হয়। ১৮৯৯-১৯১০ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনার ও আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে যুক্তভাবে চারটি স্থায়ী জেটি নির্মাণ করে । ১৯১০ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে রেলওয়ে সংযোগ সাধিত হয়। ১৯২৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দরকে মেজর পোর্ট ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তান আমলে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনারকে চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্ট-এ পরিণত করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্ট-কে চট্টগ্রাম পোর্ট অথরিটিতে পরিণত করা হয়। এটি একটি স্বায়ত্তশাসিত সরকারি সংস্থা।

বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর হিসেবে দেশের প্রায় ৯০% বাণিজ্য পরিচালনা করছে। বন্দরটি দেশের রাজস্ব আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস।চট্টগ্রাম বন্দরের মোট রাজস্ব আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ হয় জাহাজ সেবা ও মালপত্র হ্যান্ডল খাত থেকে। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময় রাজস্ব আয় ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, রাজস্ব ব্যয় প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে এবং রাজস্ব উদ্বৃত্ত প্রায় ২২ শতাংশ বেড়েছে।

২০২২ সালে এ বন্দর দিয়ে ৩১ লাখ ৪০ হাজার টিইইউ কন্টেইনার পরিচালনা করা হয়।

বর্তমানে বন্দরটি আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে কার্যক্রমের দক্ষতা বাড়ানোর প্রচেষ্টায় রয়েছে। বন্দরটির কার্যক্রমে আরও গতি আনতে এবং আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত আধুনিকায়ন এবং দক্ষ জনবল বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া, বন্দর এলাকার যানজট নিরসন ও লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে এটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ব্যস্ততম বন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চলতি বছরের (২০২৪) জানুয়ারিতে বন্দরটি প্রথমবারের মতো বড় জাহাজ ভিড়িয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে, যা বন্দরটির ক্রমবর্ধমান সক্ষমতার প্রমাণ। এছাড়াও রপ্তানি পণ্য পরীক্ষার জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের দুই প্রবেশ পথে দুটি ফিক্সড স্ক্যানার চালু করা হয়েছে, যা প্রথমবারের মতো রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার পরীক্ষা করতে সক্ষম। বন্দরটি বছরে প্রায় ৩০ থেকে ৩২ লাখ টিইইউ (TEU) কনটেইনার হ্যান্ডলিং করে থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্যান্ট্রি ক্রেনের সংখ্যা বাড়িয়ে ১৮টি করা হয়েছে, যা পণ্য উঠানামার গতি বাড়িয়েছে। এছাড়াও এতে বে টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক, দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ড এবং সিঙ্গাপুর পোর্ট অথরিটি পিএসএ-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ৮ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

চলমান বৈশ্বিক প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব দক্ষতার মাধ্যমে কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। এতে শুধু গতিবৃদ্ধিই নয়, অর্থও সাশ্রয় হয়েছে। কর্মকর্তাদের মতে, দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের বেশির ভাগই সামাল দিচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর।দেশের মোট আমদানি ও রপ্তানি পণ্যের ৯২ শতাংশই পরিবাহিত হয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। দেশের মোট জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার (জিডিপি) যেখানে ৭ থেকে ৮ শতাংশ, সেখানে চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের প্রবৃদ্ধির হার ২১ শতাংশ।

দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত বিভিন্ন জাতি সত্ত্বার অসমসত্ব উপস্থিতি আর বর্তমান বিশ্বের দুই উদীয়মান পরাশক্তি চীন ও ভারতের বিশেষ কাছাকাছি অবস্থান এবং এখান থেকে অনায়াসে বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগরের উন্মুক্ত নীল জলভাগে প্রবেশের সুবিধার সম্ভাব্যতা চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের ভৌগোলিক অবস্থানকে ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে আরও গুরুত্ববহ করে তুলেছে। ভারতের সেভেন সিস্টারস প্রদেশগুলির উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর ভারতের জন্য খুবই প্রয়োজন। কেননা এই সকল প্রদেশগুলি দূরে হওয়ায় কলকাতা বন্দরের সাথে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা খুবই কঠিন। এক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্য রক্ষার মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসিত এই প্রতিষ্ঠান দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর ও বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে বাংলাদেশকে কৌশলগত নিরাপত্তা (Strategic Security) বা ভূ-রাজনৈতিক আড়াল (Strategic Defence) দান করেছে। তাই বলাই যায়, চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর দেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।

মোংলা বন্দর

মোংলা সমুদ্র বন্দর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর হিসেবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বাগেরহাট জেলায় অবস্থিত। এটি খুলনা শহর থেকে প্রায় ৪৮ কিলোমিটার দক্ষিণে, পশুর ও মোংলা নদীর মোহনায় অবস্থিত।

১৯৫০ সালে ১১ ডিসেম্বর বৃটিশ বাণিজ্যিক জাহাজ “The City of Lyons”  সুন্দরবনের মধ্যে পশুর নদীর জয়মনিগোল নামক স্থানে নোঙ্গর করে। এটাই ছিল মোংলা বন্দর প্রতিষ্ঠার শুভ সুচনা। এর পর ১৯৫১ সালের ৭ই মার্চ  জয়মনির গোল থেকে ১৪ মাইল উজানে চালনা নামক স্থানে এ বন্দর স্থানান্তরিত হয়ে  ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত এ বন্দরের কার্যক্রম চলে। পরে স্যার ক্লাইভ এংনিস পশুর ও শিবসা নদী জরিপের জন্য আসেন দীর্ঘ  বিস্তত জরিপের পর তিনি তার রিপোর্টে  বন্দরকে চালনা থেকে সরিয়ে মোংলায় প্রস্তাব করে। চালনা থেকে ৯/১০ মাইল ভাটিতে মোংলা নদী এবং পশুর নদীর মিলন স্থলের ছিলো ‘‘মোংলা’’ । এখানে নদীর নাব্যতাও ছিল বেশি । সুবিস্তত স্থলভাগ ও বন্দর নির্মানের জন্য ছিল উপযোগী উপরোক্ত প্রস্তাব অনুযায়ী ১৯৫৪ সালের ২০শে জুন এ বন্দরকে সরিয়ে মোংলা নামক স্থানে নিয়ে আসা হয়। মোংলা নদীর তীরে স্থাপন হওয়ায় এ বন্দরের নাম হয় মোংলা। ১৯৭৬ সালে, চালনা বন্দর কর্তৃপক্ষ নামক একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি পরিচিতি লাভ করে এবং পুনঃরায় ১৯৮৭ সালের মার্চ মাসে এটি নাম পরিবর্তনপূর্বক “মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ” হিসেবে যাত্রা শুরু করে। মোংলা বন্দর বাংলাদেশের দ্বিতীয় আন্তর্জাাতিক সমুদ্র বন্দর। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক “ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ” হিসেবে ঘোষিত পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট “সুন্দরবন” দ্বারা মোংলা বন্দর সুরক্ষিত।

এই বন্দরটি সুন্দরবনের নিকটবর্তী হওয়ার কারণে ভৌগোলিক এবং অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মোংলা বন্দর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। হাতে গোনা কয়েকটি পণ্য আমদানির উপর ভিত্তি করে যে একটি বন্দর কর্মচাঞ্চল্যে মুখরিত হতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো মোংলা বন্দর। গত কয়েক বছরে এলপিজি গ্যাস ও গাড়ি আমদানির উপর ভিত্তি করে বন্দরটি দেশের মোট আমদানির ১০% হিস্যা দখল করতে সক্ষম হয়েছে। মোংলা বন্দর এলাকায় পশুর নদের তীরে দুই কি. মি. এলাকা জুড়ে এলপিজি গ্যাস প্ল্যান্টের অবস্থান।গত ৭–৮ বছরে মোংলা বন্দর এলাকায় এ খাতে প্রচুর বিনিয়োগ হয়েছে।

পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর মোংলা বন্দরের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকা থেকে মোংলা বন্দরের দূরত্ব ১৩০ কি.মি. কমে যাওয়ায় এটি রাজধানীর সবচেয়ে কাছের সমুদ্রবন্দর হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এবং সড়ক যোগাযোগ উন্নত হওয়ায় পোশাক রপ্তানিকারকদের মধ্যে মোংলা বন্দরের ব্যাপারে আগ্রহ বেড়েছে। ফলে বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান তাদের মনোনীত শিপিং এজেন্ট নিয়োগ শুরু করেছে এই বন্দরে। দেশের বৃহৎ শিপিং কোম্পানিগুলো ইতিমধ্যে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে আগ্রহ দেখিয়ে লজিস্টিক সাপোর্ট চেয়েছে। ২০২২–২৩ অর্থ বছরে মোংলা বন্দরে ভিড়া জাহাজে মূলত সরকারি সার, গম, এলপিজি, কয়লা ও সিমেন্টশিল্পের কাঁচামাল আমদানি করা হয়। ঐদিকে দেশের অর্ধেকেরও বেশি (৫৫%) গাড়ি মোংলা বন্দর দিয়ে আমদানি করা হয়। আগে শুধু মোংলা দিয়ে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের পণ্য রপ্তানি হলেও এখন ঢাকা থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানি করা হচ্ছে। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে মোংলা বন্দরে নানা ধরনের হ্যান্ডেলিং যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে। আবার সরকারি বেসরকারি অংশীদারত্বে যে দুটি জেটি নির্মাণের কাজ চলছে, তা আগামী বছর শেষ হবে। ফলে মোংলায় আগামী দিনে পণ্য পরিবহন আরো বাড়বে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সামুদ্রিক বন্দর চট্টগ্রামের উপর চাপ বেড়ে যাওয়ায়, অনেক আন্তর্জাতিক জাহাজ কোম্পানি বিকল্প রুট হিসেবে মোংলা বন্দরকে বেঁছে নিয়েছে। এছাড়া প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটানের সরকার মোংলা বন্দরকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে ব্যবহার করছে আঞ্চলিক বাণিজ্যিক পণ্য আদান প্রদানের ক্ষেত্রে। মোংলা বন্দর ব্যবহারে নেপাল ও ভুটানের আগ্রহ দীর্ঘদিনের। কারণ নেপাল ও ভুটানের সবচেয়ে কাছের সমুদ্রবন্দর মোংলা। পদ্মা সেতুর পর মোংলা খুলনা রেললাইনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ এই রেললাইন চালু হলে মোংলা থেকে যশোর, কুষ্টিয়া, ঈশ্বরদী ও দিনাজপুর হয়ে ভারত ভূখণ্ড দিয়ে নেপাল পর্যন্ত সহজেই পণ্য পরিবহন করা যাবে।

এছাড়া মোংলার কাছেই “খান জাহান আলী বিমানবন্দর” এবং “রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র”, বিভাগীয় নগরী খুলনা, বাগেরহাট, বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল, স্থলবন্দর ভোমরা এবং “মোংলা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল” (মংলা ইপিজেড) এর অবস্থান। ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এগুলো মোংলা বন্দরকে গুরুত্ববহ করে তুলেছে।

তবে মোংলা বন্দরের কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে যেগুলো নিরসনের মাধ্যমে এর সম্ভাবনা বহুগুণ বৃদ্ধি পেতে পারে। পশুর নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে নিয়মিত ড্রেজিং না হওয়ায় বড় আকারের জাহাজ পরিচালনা ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে পড়তে পারে। এছাড়াও এর অবকাঠামোগত দুর্বলতা এবং সুন্দরবন সংলগ্ন হওয়াতে পরিবেশগত ঝুঁকি রয়েছে।

মোংলা বন্দরের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা গেলে এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরও বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। এর ভৌগোলিক অবস্থান, আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যের সুযোগ এবং শিল্প ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা মোংলা বন্দরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে।

পায়রা সমুদ্র বন্দর

বাংলাদেশের ৩য় সমুদ্র বন্দর ‘পায়রা বন্দর’ পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া, বালিয়াতলী, ধূলাসার, ধানখালী ও টিয়াখালী ইউনিয়নের অন্তর্গত রাবনাবাদ চ্যানেলের পশ্চিম তীরে পোতাশ্রয় মুখ থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার অভ্যন্তরে অবস্থিত। ২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর এ বন্দরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় এবং ২০১৬ সালের ১৩ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে এর কার্যক্রম চালু হয়।

বঙ্গোপসাগরের তীরে রাবনাবাদ চ্যানেলের তীর বরাবর অবস্থিত হওয়াতে এই বন্দর আন্তর্জাতিক শিপিং রুটের সাথে সংযোগ স্থাপন করে। এর অবস্থান দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে, যা মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য নতুন দ্বার উন্মোচন করে।

জাহাজ থেকে জাহাজে পণ্য নেওয়ার পদ্ধতিতে চালু হওয়া পায়রা বন্দরের এখনো কিছু কাজ বাকি থাকলেও বর্তমানে দেশের তৃতীয় বন্দর পায়রা সমুদ্র বন্দরের কাজে গতি বাড়ছে। বন্দরটি রাজস্ব আয়ের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। গভীরতা বেশি থাকায় এ রুটে ২৪ ঘণ্টা জাহাজ চলাচলের সুযোগ রয়েছে। এ কারণে এ বন্দরের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১০ জাহাজ আসে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আসা জাহাজের সংখ্যা ছিল এক হাজার ৪০টি।

চলতি বছরের ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ৪৮৪ বিদেশি জাহাজসহ তিন হাজার ১৬০ জাহাজ বন্দরে সফলভাবে পণ্য উঠানামা করেছে। রাজস্ব আয় হয়েছে প্রায় এক হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা।

দেশের আমদানির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এই বন্দরে আমদানির সুবিধার্থে টার্মিনাল, পরিবহন পথ এবং জাহাজ প্রবেশের সুবিধাসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ বন্দরের মাধ্যমে বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের মধ্যে আছে চুনা পাথর, স্পুন পাইল, সিমেন্ট ক্লিংকার, স্টোন চিপস, প্ল্যান্ট মেশিনারি, মোটা পাথর, ড্রেজিং সরঞ্জাম, চূর্ণ পাথর, পিএইচপি পাইপ পাইল, ওপিসি ক্লিংকার ও এলপিজি। আর এগুলোর জন্য প্রায় ৬ হাজার একর জায়গার ওপর গড়ে ওঠা সমগ্র পায়রা সমুদ্র বন্দরে কন্টেইনার, বাল্ক, সাধারণ কার্গো, এলএনজি, পেট্রোলিয়াম ও যাত্রী টার্মিনাল আছে।

পায়রা সমুদ্র বন্দরের আউটার অ্যাংকরেজ থেকে রাবনাবাদ চ্যানেলে ঢোকার পথে পানির সর্বনিম্ন গভীরতা প্রায় ৫ মিটার। চ্যানেলের ভেতর এই গভীরতা ১৬ থেকে ২১ মিটার। চ্যানেলের ৩৫ কিলোমিটার এলাকায় ড্রেজিং করা হলে জোয়ারের সময় ১৬ মিটার গভীর (চট্টগ্রামে সর্বোচচ ৯.২ মিটার) এবং ৩০০ মিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট জাহাজ (চট্টগ্রামে সর্বোচচ ১৮৬ মিটার) প্রবেশের সুবিধাসহ সামুদ্রিক বন্দর অবকাঠামো তৈরি হবে। বাবনাবাদ নদীর তীরে লালুয়ায় বন্দরের টার্মিনালের কাজ এগিয়ে চলছে। প্রথম টার্মিনালের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে (৯৭ শতাংশ)। এখানে জাহাজ থেকে আমদানি করা পণ্য সরাসরি খালাস করে সড়ক পথে পরিবহনের জন্য আন্ধারমানিক নদীর ওপর সেতু করা হচ্ছে। গত মার্চে (২০২৪) শুরু হওয়া ৯৫০ কোটি টাকার সেতুর কাজ চুক্তি মোতাবেক চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ব্রিজ কনস্ট্রাকশন গ্রুপ (সিআরবিজি) ও চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্টিটিউশন কর্পোরেশন (সিসিইসিসি) ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে শেষ করবে। আন্ধারমানিক নদীতে ফেরি দিয়ে আপাতত বন্দরের পণ্য সড়ক পথে পরিবহনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরেই সড়ক পথে পণ্য পরিবহন শুরু হবে। এতে বন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রমে আরও গতি আসবে।

তবে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করা এই পায়রা বন্দরের বড় সমস্যা হচ্ছে নব্যতা সংকট। বর্তমানে ছয় বা সাত ফুট ড্রাফট জাহাজ এখানে আসতে পারে। আবার বহির্নোঙ্গর থেকে লাইটার জাহাজে পণ্য খালাস করলে খরচ বেড়ে যায়। উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ পূর্বক  এই নব্যতা সংকট কাটাতে পারলে আমদানিকারকরা দেশের এই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক করিডোর ব্যবহারে লাভবান হবেন, যা বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে আগামীতে আরও সুসংহত করবে।

মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর

মাতারবাড়ি বন্দর হলো বঙ্গোপসাগরের তীরস্থিত একটি নির্মাণাধীন সমুদ্র-বন্দর, যেটি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত কক্সবাজার জেলার মাতারবাড়ি এলাকার অবস্থিত। বন্দরটির নির্মাণ কাজ ২০১০-এর দশকের শেষের দিকে মাতারবাড়ি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য একটি ক্যাপটিক জেটি নির্মাণের মধ্যমে শুরু হয়েছিল, এবং পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক বন্দর গড়ার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিলো। বন্দর নির্মাণের পর, এটি হবে বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্র-বন্দর।

বন্দরটি ১৬ মিটার গভীরতার নৌ-চ্যানেলসহ একটি কৃত্রিম পোতাশ্রয় নিয়ে গঠিত, যা প্যানাম্যাক্স ও ক্যাপসাইজ জাহাজগুলিকে মিটমাট করতে সক্ষম হবে। এটি ১০০,০০০ ডেডওয়েট টন বা ৮,০০০-এর বেশি কন্টেইনারবাহী জাহাজগুলিকে প্রবেশের অনুমতি দেবে। বর্তমানে, ৯ মিটারের চেয়ে কম ড্রাফটের জাহাজ দেশের দুটি সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম এবং মোংলাতে প্রবেশ করতে পারে। ২০২৩ সালের ২৫ এপ্রিল, মাতারবাড়ী বন্দরে প্রথমবারের মতো ২৩০ মিটার দীর্ঘ ও ১৪ মিটার ড্রাফট সম্পন্ন “অউসু মারো” নামের একটি জাহাজ ৮০,০০০ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে নোঙর করে, যা বাংলাদেশের কোনো বন্দরের জেটিতে নোঙর করা সবচেয়ে বড় পণ্যবাহী জাহাজ।

কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ি লবণ চাষের জন্য বিখ্যাত। এই এলাকায় এখন সমুদ্রবন্দর ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে। যা শুধু মহেশখালী নয় পুরো কক্সবাজারবাসীর জন্য গর্বের বিষয়। আগে মহেশখালীতে যাতায়াতের জন্য ভালো রাস্তা ছিল না। এখন বন্দর ও বিদু্যুৎ কেন্দ্রের জন্য চকরিয়া থেকে ধলঘাট পর্যন্ত চারলেনের রাস্তা করা হচ্ছে। যা মহেশখালীবাসী কখনো কল্পনা করতে পারেনি। ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজে প্রায় ২-৩ হাজার স্থানীয় লোকের কর্মসংস্থান করা হয়েছে। এছাড়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ১ হাজার ৩১ একর জায়গার অধিগ্রহণ করা হয়েছে।

প্রকল্প সূত্রের মাধ্যমে জানা যায়, মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ হলে অন্যান্য বন্দর থেকে এর দূরত্ব বেশি হবে না। চট্টগ্রাম থেকে সমুদ্রপথে মাতারবাড়ির দূরত্ব ৩৪ নটিক্যাল মাইল, পায়রা বন্দর থেকে মাতারবাড়ির দূরত্ব ১৯০ নটিক্যাল মাইল ও মোংলাবন্দর থেকে গভীর সমুদ্রবন্দরের দূরত্ব ২৪০ নটিক্যাল মাইল। তাই মাতারবাড়িতে মাদার ভেসেল (বৃহদাকার কন্টেনার জাহাজ) থেকে পণ্য খালাস করে অল্প সময়ের মধ্যে সড়ক ও সমুদ্রপথে অন্যান্য বন্দরে পরিবহন করা যাবে। পুরোদমে কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ি ধলঘাট এলাকায় নির্মণাধীন মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর চালু হলে দেশের অর্থনীতিতে দুই থেকে তিন বিলিয়ন ডলার যুক্ত হবে যা তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তাছাড়া সিঙ্গাপুর ও কলম্বো বন্দর থেকে পণ্য পরিবহন খরচ ১০ থেকে ২০ ভাগ কমে আসবে। পরিসংখ্যান বলছে গভীর সমুদ্রবন্দর জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে ২-৩ শতাংশ অবদান রাখবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

বাংলাদেশের একমাত্র নীল পানির বন্দর মাতারবাড়ি। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সমুদ্রপথে মাতারবাড়ির দূরত্ব ৩৪ নটিক্যাল মাইল। জাহাজে যেতে সময় লাগে ২-৩ ঘণ্টা। সড়কপথে এর দূরত্ব প্রায় ১১২ কিলোমিটার। সময় লাগে ২ থেকে আড়াই ঘণ্টা। কক্সবাজারের চকরিয়া থেকে মাতারবাড়ি ধলঘাট পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সড়ক ও বন্দর নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে। সড়ক নির্মাণের জন্য বিভিন্ন স্থানে পাথর ও মাটি ভরাট করা হচ্ছে।

এছাড়া এ বন্দরের অনেক কাজ এগিয়ে নিয়েছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পটি (মাতারবাড়ি)। বন্দরের জন্য যে চ্যানেল তৈরি হয়েছে সেটি ২৫০ মিটার চওড়া, ১৮ দশমিক ৫ মিটার গভীর এবং ১৪ দশমিক ৩ মিটার দীর্ঘ। সাগর থেকে উপকূল পর্যন্ত পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বাঁধ। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর এলাকায় চ্যানেলের পানি পুরো নীল। দেশের আর কোনো বন্দরে এমন নীল পানি নেই। নীল পানি থাকা মানে নৌপথের বড় অংশে পলি জমার আশঙ্কা কম বলে প্রকল্পটির সাথে সংশ্লিষ্টরা জানান।

প্রকল্প সূত্রের মাধ্যমে জানা যায়, ইতোমধ্যে বন্দরের নিরাপত্তায় উত্তর ও দক্ষিণ দিকে নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্রের ঢেউ প্রতিরোধ বাঁধ। প্রকল্পের বিশদ নকশা তৈরি কাজ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া জেটি নির্মাণ, জাহাজ হ্যান্ডেলিং সরঞ্জাম সংগ্রহ ও টাগ বোট ক্রয়সহ তিনটি প্যাকেজে ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সকল প্রস্তুতি শেষে গত বছর (২০২৩) এর মাঝামাঝি সময় প্রকল্পের নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করার কথা থাকলেও বিভিন্ন জটিলতার কারণে তা সম্ভব হয়নি।

২০২০ সালে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে বাস্তবায়নে অগ্রগতি হয়নি। অন্যদিকে ডলারের মূল্য বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে নির্মাণব্যয় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি বেড়ে যায়, ফলে প্রায় অনেকটা সময় এই প্রকল্পের কাজ স্থগিত রাখা হয়েছিলো।

তবে দীর্ঘদিন স্থগিত থাকা মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। চীন বা ভারত নয়, সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণের কাজ পাচ্ছে জাপান।

গত ৭ অক্টোবর ২০২৪, জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে একনেকের এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই বন্দরটি চীন করবে না ভারত করবে, এটা নিয়ে টানাপোড়েন চলছিল। এটা ভূরাজনৈতিক তাৎপযপূর্ণ প্রকল্প। পরে কৌশলে সরকার নিরাপদ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা হিসাবে পরিচিত জাপানের মাধ্যমে এই বন্দর নির্মাণের কৌশল নিয়েছে।’

একনেক সভায় মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়নের ব্যয় ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৪ হাজার ৩৮১ কোটি টাকায় উন্নীত করার একটি সংশোধিত প্রস্তাবও অনুমোদন হয়েছে।

মাতারবাড়ী বন্দরের গভীরতা ১৮ মিটার হওয়ায় ১ লাখ টন ধারণক্ষমতার মাদার ভেসেল (বড় জাহাজ) সহজেই এখানে নোঙর করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ৩০–৩৫ হাজার টন ধারণক্ষমতার জাহাজ নোঙর করছে, কিন্তু মাতারবাড়ী বন্দরে তিনগুণ বেশি ধারণক্ষমতার জাহাজ ভিড়তে পারবে। ফলে পরিবহন খরচ ও শিপিং সময় কমে আসবে। 

দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে গভীর সমুদ্র বন্দরের ভূরাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কারণ গভীর সমুদ্রবন্দরে বড় জাহাজে করে একসঙ্গে বিপুল পরিমাণ পণ্য পরিবহন করা যায়। তাতে পণ্য পরিবহন খরচ কমে। আবার বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান এবং এর একমাত্র গভীর সমুদ্র বন্দর হিসেবে নির্মাণাধীন এই মাতারবাড়ী বন্দরকে কেন্দ্র করে ভারত, চীন ও জাপানের মধ্যে ভূরাজনৈতিক কৌশল ও প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জাপানের অর্থায়নে নির্মিত এই বন্দর দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তি ভারসাম্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বৈশ্বিক পণ্য বাণিজ্যে এখন সংকট চলছে। রপ্তানি পণ্য পরিবহনের জন্য জাহাজে বুকিং সহজে মিলছে না। কনটেইনার ডিপোগুলোতে রপ্তানি পণ্যের স্মরণকালের জট। ঠিক এ সময়ে যদি দেশে গভীর সমুদ্রবন্দর থাকে, তাহলে সমস্যা সমাধানের বিকল্প হাতে থাকবে। ইউরোপ-আমেরিকায় সরাসরি পণ্য পরিবহন সেবা থাকলে যেমন অগ্রাধিকার পেত এ দেশের রপ্তানিকারকেরা, তেমনি বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে বড় আকারের এক-দুই জাহাজেই জমে থাকা সব রপ্তানি পণ্যের কনটেইনার ইউরোপ – আমেরিকায় নেওয়া যেত।

মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বন্দর, যা দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য ও পরিবহন ব্যবস্থায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার এই প্রকল্পটি বাংলাদেশের সামুদ্রিক বাণিজ্যের পাশাপাশি আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। জাপানের অর্থায়নে নির্মিত এই বন্দর শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নেই ভূমিকা রাখবে না, বরং দক্ষিণ এশিয়া ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এছাড়াও এর কৌশলগত অবস্থান এবং কার্যকারিতা দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে। এই মেগা প্রজেক্ট আন্তর্জাতিক পরিসরে দেশের প্রভাব বাড়ানোর একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। সঠিক বাস্তবায়ন এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর বাংলাদেশের উন্নয়নের মাইলফলক হিসেবে পরিচিত হবে।

বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরসমূহ; চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার-দ্বার

বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরগুলো সম্মিলিত ভাবে দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য হাব হিসেবে কাজ করছে। চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা বন্দর এ অঞ্চলে বাণিজ্যের প্রবাহ নিশ্চিত করছে। বর্তমানে বন্দরগুলো শিল্প, কর্মসংস্থান এবং রাজস্ব আয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। এছাড়াও নির্মাণাধীন মাতারবাড়ি বন্দরের মাধ্যমে গভীর সমুদ্র বন্দর এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

তবে সমুদ্র বন্দরগুলোর বিভিন্ন ভাবে অবকাঠামোগত এবং পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে যার কার্যকরী মোকাবেলা বর্তমানে সময়ের দাবী। মোংলা ও পায়রা বন্দরে পণ্য খালাসে ধীরগতি, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এই দুই বন্দরের কার্যক্রমকে ধীরগতিসম্পন্ন করে তুলছে। এছাড়াও সুন্দরবনের নিকটবর্তী হওয়াতে এই দুই বন্দরের কার্যক্রম সুন্দরবনকে এবং এর সংলগ্ন আশেপাশের বসতিগুলোকে পরিবেশগত ঝুঁকিতে রেখেছে। এছাড়াও প্রধান এবং কেন্দ্রীয় সমুদ্র বন্দর হিসেবে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের উপর অতিরিক্ত চাপ, প্রায়ই বিভিন্ন অপারেশনে বিলম্ব ঘটায়। যা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এই বন্দরগুলোর কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

অথচ সামুদ্রিকভাবে বিশ্ব পরিসরে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত করার সুবর্ণ সুযোগ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনাকারী এই সমুদ্র বন্দরগুলোর হাতেই। তাই সম্মুখীন এই চ্যালেঞ্জ গুলো কর্তৃপক্ষ শক্ত ভাবে আমলে নিয়ে এগুলোর যথাযথ মোকাবিলা অতিদ্রুতই কার্যকর করা উচিত। কারণ সমুদ্র বন্দরগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং প্রযুক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে বন্দরগুলোর কার্যক্রম আরও দ্রুততর ও কার্যকরী করা সম্ভব। আবার দ্রুততম সময়ে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের নির্মাণ কাজ শেষ করে প্রস্তাবিত পরিকল্পনা অনুযায়ী এর কার্যক্রম শুরু করলে এই সমুদ্র বন্দর দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে। এছাড়াও বন্দরগুলোতে ট্রানজিট সুবিধা বাড়ানো হলে ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা তৃতীয় বিশ্বের একটি সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে খুব দ্রুতই বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হবে।

তাই দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র এবং দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য ও যোগাযোগের মূল চালিকাশক্তি এই সমুদ্র বন্দরগুলোর যথাযথ ব্যবস্থাপনা, আধুনিকীকরণ এবং পরিবেশ সুরক্ষার মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিকভাবে বন্দরগুলোর কার্যকারিতা আরও বাড়ানো এখন সময়ের দাবী।

তথ্যসূত্র

1.[ https://cpa.gov.bd/ ]

2.[ https://mpa.gov.bd/ ]

3.[ https://ppa.gov.bd/ ]

4.[https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%9A%E0%A6%9F%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AE_%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A6%B0 ]

5.[https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AE%E0%A7%8B%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE_%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A6%B0 ]

6.[https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%B0%E0%A6%BE_%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A6%B0 ]

7.[https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A1%E0%A6%BC%E0%A6%BF_%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A6%B0 ]

8.[https://bn.banglapedia.org/index.php?title=%E0%A6%9A%E0%A6%9F%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AE_%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A6%B0&utm_source=chatgpt.com ]

9.[https://bangla.thedailystar.net/economy/industry/port/news-569681 ]

10.[https://bangla.thedailystar.net/economy/industry/port/news-628656 ]

11.[https://www.bonikbarta.com/editorial/D8pEeQUXNAp9H8CY/ ]

12.[https://www.deshrupantor.com/367558 ]

13.[https://bn.banglapedia.org/index.php/%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%B0%E0%A6%BE_%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0_%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A6%B0 ]

14.[https://www.google.com/search?client=ms-android-xiaomi-rvo3&sca_esv=f895f188e1fdba49&sxsrf=ADLYWIJqYIvy17N_R3Qba_87RT0qjzomMA%3A1735215944216&kgmid=%2Fg%2F11hynqk8nr&q=Matarbari%20Deep%20Sea%20Port&shndl=30&source=sh%2Fx%2Floc%2Fact%2Fm4%2F2 ]

15.[https://www.dailyjanakantha.com/national/news/679330 ]

                   ————-

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *