শিউলিমালা একাডেমি

আমাদের ভাষা-সমস্যা

আমরা বঙ্গদেশবাসী। আমাদের কথাবার্তার, ভয়-ভালবাসার, চিন্তা-কল্পনার ভাষা বাংলা। তাই আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। দুঃখের বিষয়, জ্যামিতির স্বতঃসিদ্ধের ন্যায় এই সোজা কথাটিকেও আমাদের মধ্যে এক সম্প্রদায়কে বুঝাইয়া দিলেও তাঁহারা জোর করিয়া বুঝিতে চাহেন না। তাই মাঝে-মধ্যে আমাদের মাতৃভাষা কী কিংবা কী হইবে, তাহার আলোচনা সাময়িক পত্রিকাদিতে দেখিতে পাওয়া যায়। হা! আমাদের সূক্ষ্ম বুদ্ধি!

মাতৃভাষা ব্যতীত আর কোন ভাষা কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিয়া পরাণ আকুল করে? মাতৃভাষা ব্যতীত আর কোন ভাষার ধ্বনির জন্য প্রবাসীর কান পিয়াসী থাকে? মাতৃভাষা ব্যতীত আর কোন ভাষায় কল্পনা-সুন্দরী তাহার মনমজান ভাবের ছবি আঁকে? কাহার হৃদয় এত পাষাণ যে মাতৃভাষার অনুরাগ তাহাতে জাগেনা? পৃথিবীর ইতিহাস আলোচনা করিয়া দেখ, মাতৃভাষার উন্নতি ব্যতীত কোনও জাতি কখনও কি বড় হইতে পারিয়াছে? আরব পারস্যকে জয় করিয়াছিল। পারস্য আরবের ধর্মের নিকট মাথা নীচু করিয়াছিল, কিন্তু আরবের ভাষা লয় নাই; শুধু লইয়াছিল তাহার ধর্মভাব আর কতকগুলি শব্দ। তাই আনোয়ারী, ফেরদৌসী, সাদী, হাফিয, নিযামী, জামী, সানাঈ, রূমী-প্রমুখ কবি ও সাধক-বুলবুলকুলের কলতানে আজ ইরানের কুঞ্জ-কানন মুখরিত। যেদিন ওয়াইক্লিফ লাটিন ছাড়িয়া ইংরাজি ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ করিলেন, সেই দিন ইংরাজের ভাগ্য-লক্ষ্মী সুপ্রসন্ন হইল। যতদিন পর্যন্ত জর্মানিতে জার্মান ভাষা অসভ্য ভাষা বলিয়া পরিগণিত ছিল, ততদিন পর্যন্ত জর্মানির জাতীয় জীবনের বিকাশ হয় নাই। বেশী দূর যাইতে হইবে না। আমাদেরই প্রতিবেশী আমাদের হিন্দুস্তানী মুসলমান ভাইগণ সংখ্যায় এত অল্প হইয়াও এত উন্নত কেন? আর আমরা সংখ্যায় এত বেশী হইয়াও এত অবনত কেন? ইহার একমাত্র কারণ তাঁহারা মাতৃভাষার প্রতি অনুরক্ত আর আমরা মাতৃভাষার প্রতি বিরক্ত। হিন্দুস্থানী আলিমগণ উর্দু ভাষায় কোরআন শরীফের অনুবাদ এবং তাফসীর, ফিকহ, হাদীস, তাসাউফ, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, ভ্রমণ-বৃত্তান্ত, কাব্য, উপন্যাস প্রভৃতি বিষয়ে বহু মৌলিক গ্রন্থ রচনা করিয়া কিংবা এতদ্বিষয়ক আরবী, ফারসী ও ইংরাজি প্রভৃতি ভাষার গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশ করিয়া উর্দু ভাষায় সর্ব্বাঙ্গ সুন্দর ইসলামী সাহিত্যের সৃষ্টি করিয়াছেন। কিন্তু দুই চারিজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ব্যতীত আমাদের মৌলভী-মৌলানাগণ বঙ্গভাষায় গ্রন্থ রচনা করা দূরে থাকুক, বঙ্গভাষা কাফেরী ভাষা, এ ভাষাতে ধর্মগ্রন্থের অনুবাদ করিলে ধর্ম-গ্রন্থের অমৰ্য্যাদা করা হয় ইত্যাদি রূপ প্রলাপ উক্তি করিতে ছাড়েননা। বিশুদ্ধরূপে বাংলা বলা বা লেখা তাঁহারা অপবাদজনকে মনে করেন। ফলে তাঁহাদের ধর্মবিষয়ক বক্তৃতা শুনিয়া সামান্য বাংলা জানা শ্রোতারা পর্যন্ত হাসিবে কি কাঁদিবে, তাহা ঠিক করিতে পারেনা। তাঁহাদের বাংলা ভাষায় যেমন দখল, উর্দুও তেমন। স্কুলের ন্যায় যে পর্যন্ত বাংলার মাদ্রাসায়ও বাংলা ভাষা অবশ্য পাঠ্য দেশীয় ভাষারূপে স্থান না পাইবে, সে পর্যন্ত আমাদের এ দুরবস্থা ঘুচিবে না। যে পর্যন্ত আরবী, ফারসী জানা মুসলমান লেখক বাংলা ভাষার সেবায় কলম না ধরিবেন, সে পর্যন্ত কিছুতেই বঙ্গীয়-মুসলমান-সাহিত্য গঠিত হইবে না।

সেদিন অতি নিকট, যেদিন বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ভাষার স্থান অধিকার করিবে। বিদেশী ভাষার সাহায্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার মতন সৃষ্টিছাড়া প্রথা কখনও টিকিতে পারেনা। যত দিন পর্যন্ত তাহা না হইতেছে, ততদিন পর্যন্ত আমাদিগকে একটি সময়োপযোগী শিক্ষা-প্রণালী অবলম্বন করিতে হইবে। স্কুলের ছাত্রদের জন্য প্রথম ও দ্বিতীয় মানে কেবলমাত্র বাংলা থাকিবে। তৃতীয় মান হইতে ইংরাজি আরম্ভ হইবে। পঞ্চম মান হইতে Classical language শুরু হইবে। মুসলমান ছাত্রের পক্ষে কোন Classical language লওয়া উচিত, ইহার উত্তরে প্রত্যেক মুসলমান একবাক্যে বলিতে বাধ্য হইবেন- আরবী। আল্লাহর শেষ প্রত্যাদেশ আরবীতে। আল্লাহর শেষ নবী আরবী। আমরা সেই নবীর উম্মত (মণ্ডলী), সেই শেষ প্রত্যাদেশের উত্তরাধিকারী। অনুবাদে মূলের ছায়া পাওয়া যায় মাত্র; মূলের প্রাণ অনুবাদে থাকিতে পারে না। যদি ইসলাম ধর্মকে তাহার প্রাথমিক যুগের অনাবিল অবস্থায় বজায় রাখা আবশ্যক বলিয়া মনে হয়, যদি শত দেশভেদ এবং সহস্র ভাষাভেদ সত্ত্বেও ইসলামের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখা কর্তব্য বলিয়া মনে হয়, তবে মুসলমানকে তাহার কোরআন হাদীস মূল ভাষায় পড়িতে হইবে, পড়িয়া, বুঝিতে হইবে, বুঝিয়া মজিতে হইবে। যদি মরুকে নগর করিবার, পশুকে মানুষ করিবার, অন্ধকে চক্ষুষ্মান করিবার, কাঙ্গালকে আমীর করিবার, ভীরুকে বীর করিবার অমোঘ মন্ত্র শিখিতে চাও, তবে আরবী কোরআন শিখ। যেমন প্রত্যেক খ্রীষ্টান বালক তাহার বাইবেল জানে, যে পর্যন্ত প্রত্যেক মুসলমান বালক তেমনই তাহার কোরআন শরীফকে না জানিবে, সে পর্যন্ত মুসলমান সমাজ জাগিবে না। সমস্ত জগতের বদলে যে মুসলমান তাহার কোরআন ছাড়িতে প্রস্তুত ছিল না, আজ দেখ, সেই মুসলমান সন্তান সংস্কৃত, ফারসী কিংবা পালী ভাষার বিনিময়ে কিরূপে তাহার কোরআনকে বর্জন করিতেছে। হা! ধিক্! আমাদের মৌখিক ধর্মগুরু এইরূপ বলিয়াছেন যে, ‘বিজ্ঞান মুসলমানের হারান ধন, যেখানে পাও তাহাকে গ্রহণ কর।’ পুনশ্চ, ‘জ্ঞান অনুসন্ধান কর, যদিও তাহা চীন দেশে হয়।’ আমি শুধু এইটুকু বলিতে চাই আগে ঘরের খবর জান, পরে পরের খবর জানিও। হে মুসলমান, তুমি বাপ-দাদার নাম ডুবাইয়া হেদে জোলার নাতি হইতে যাইও না।

স্কুলের ন্যায় মাদ্রাসায়ও দেশীয় ভাষা, প্রধান ভাষা ও দ্বিতীয় ভাষা এই তিন ভাষার চর্চ্চা হইবে। মাদ্রাসাতেও স্কুলের ন্যায় ১ম হইতে ১০ম পর্যন্ত দশ মানে জুনিয়ার বিভাগ এবং ১ম বর্ষ হইতে ৬ষ্ঠ বর্ষ পর্যন্ত ছয় বর্ষ সিনিয়ার বিভাগ রাখিতে হইবে। ১ম ও ২য় মানে কেবলমাত্র বাংলা ভাষা শিক্ষা দেওয়া হইবে। তৃতীয় মান হইতে আরবী ভাষা এবং পঞ্চম মান হইতে দ্বিতীয় ভাষা আরম্ভ হইবে। এক্ষণে জিজ্ঞাস্য, দ্বিতীয় ভাষা কী হওয়া উচিত? আমি বলি ইংরাজি। ইংরাজি ভাষার সাহায্যে আমাদের মৌলভী সাহেবগণ আধুনিক দর্শন, বিজ্ঞানের তত্ত্ব পাইবেন। যদি আমাদের আলিমকুল কুফুরী ফৎওয়ারূপ প্রচণ্ড দণ্ড দ্বারা আমাদের ইংরাজি শিক্ষিত সমাজকে ভীতচকিত ও দলিতমথিত করিয়া ইসলামের অপ্রতিহত ক্ষমতার পরিচয় দিতে না গিয়া, বাস্তবিক তাহাদের হৃদয়রাজ্যে ভক্তির আসন লাভ করিতে চান; যদি তাঁহারা ক্রমবর্ধনশীল শিক্ষিত সমাজকে ইসলামের গণ্ডী হইতে খারিজ করিয়া না দিয়া তাহাদের প্রকৃত ধর্মোপদেশক হইতে চান, তবে তাঁহাদিগকে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানে পরিপক্ক হইতেই হইবে। পৃথিবী সূর্য্যের চারিদিকে ঘুরিতেছে বলিলে যাঁহাদের মতে অতি ভাল মুসলমানও কাফের হইয়া যায়, পৃথিবী মাছের পিঠে আছে, পৃথিবীর চারিদিকে কাফ পাহাড় দিয়া ঘেরা ইত্যাদিরূপ বালকোচিত মত যাঁহারা আজও গম্ভীরভাবে প্রচার করেন, তাঁহাদিগকে তাঁহাদের সমস্ত ধার্মিকতা সত্ত্বেও শিক্ষিত সমাজ ভক্তি করিতে অক্ষম।

স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা সর্ব্বত্রই উর্দু বা ফারসী বৈকল্পিক বিষয় (optional subject) থাকিলে মুসলমান ছাত্রগণের ভাষা-সমস্যার সমাধান হয়। যাহাতে উর্দু বা ফারসী বৈকল্পিক বিষয় হইতে পারে, তজ্জন্য আমাদিগকে শিক্ষাবিভাগের কর্তৃপক্ষগণকে সম্মত করাইতে হইবে।

অনেক দিন পূর্ব্বে উর্দু বনাম বাংলা মোকদ্দমা বাংলার মুসলমান সমাজের ভিতরে উঠিয়াছিল, তাহাতে বাংলার ডিক্রী হইয়া মোকদ্দমা নিষ্পত্তি হইয়া যায়। বর্তমানে আবার সেই মোকদ্দমার ছানি বিচারের জন্য উর্দু পক্ষকে বিস্তর সওয়াল-জওয়াব করিতে শুনিতেছি। কিন্তু ন্যায়বান বিচারক দেখিবেন যে, উর্দু বাংলার দখল

উত্যক্তে কিছুতেই খাস দখল পাইতে পারে না, দখল বাংলারই থাকিবে, তবে উর্দু বাংলার অধীনে উপযুক্ত করে ইচ্ছাধীন প্রজা; এই স্বত্বে কিছু ভূমি বন্দোবস্ত পাইতে পারে মাত্র।

বাংলা ভাষা চাই-ই। মুহম্মদ-ই-বখতিয়ারের বাংলা জয়ের পরে যখন হইতে মুসলমান বুঝিল এই চির-হরিতা ফলশষ্যপুরিতা নদনদী-ভূষিতা বঙ্গভূমি শুধু জয় করিয়া ফেলিয়া যাইবার জিনিস নহে; এ দেশ কর্মের জন্য, এ দেশ ভোগের জন্য, এ দেশ জীবনের জন্য, এ দেশ মরণের জন্য, তখন হইতে মুসলমান জানিয়াছে বাংলা চাই। তাই বাংলার পাঠান বাদশাহগণ বাংলা ভাষাকে আদর করিতে লাগিলেন। যে ভাষা দেশের উচ্চশেণীর অবজ্ঞাত ছিল, তাহা বাদশাহের দরবারে ঠাঁই পাইল। নসরৎ ভায়া দেহাসেন শাহ, পরাগল খাঁ, ছুটি খাঁর নাম বাঙ্গালী ভুলিতে পারিবে না। বাদশাহের দেখাদেখি আমীর ওমরা বাংলার খাতির করিলেন। আমীর ওমরার দেখাদেখি সাধারণে বাংলার আদর করিল। গোঁড়া ব্রাহ্মণের অভিসম্পাৎ ও চোখরাঙ্গানিকে ভয় না করিয়া বাঙ্গালী নবীন উৎসাহে তাহার প্রিয় ধৰ্ম্ম পুস্তকগুলি বাংলায় অনুবাদ করিল, কত দেশে প্রচলিত ধৰ্ম্ম কথা বাংলায় প্রকাশ করিল, কত মর্ম্মগাথা বাংলায় প্রচার করিল। মুসলমানও চুপ করিয়া থাকে নাই। হিন্দুর রামায়ণ আছে; মুসলমানের ‘জঙ্গনামা’ আছে। হিন্দুর মহাভারত আছে, মুসলমানের ‘কাসাসুল আম্বিয়া’ আছে। হিন্দুর মহাজন পদাবলী আছে; মুসলমানের মারফতী গান আছে। হিন্দুর বিদ্যাসুন্দর আছে; মুসলমানের ‘পদ্মাবতী’ আছে।

এই পুঁথি সাহিত্যকে ঘৃণা করিলে চলিবে না। ইহাই বাঙ্গালী মুসলমানের খাঁটি সাহিত্য। সেই সময়ের কথিত ভাষায় পুঁথিগুলি রচিত হইয়াছিল। তখন ফারসী রাজ ভাষা মুসলমানের বাংলাদেশে নূতন ভাব ও নূতন জিনিস আনিয়াছিল। এই নূতন ভাব ও নূতন জিনিসের সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের ফারসী নাম বাংলা ভাষায় ঢুকিয়া পড়িল। রাজভাষার প্রভাব কথিত ভাষার উপর হওয়া স্বাভাবিক। এখন যেমন বাঙ্গালী চলিত ভাষায় ইংরাজির বুকনি ঝাড়েন, তখন ঝাড়িতেন ফারসীর বুকনি। মুসলমান সেই ফারসীর ‘আমেজ’ দেওয়া কথিত ভাষাতেই পুঁথি লিখিতেন। হিন্দু কিন্তু লিখিবার সময় যথাসাধ্য ফারসী বর্জন করিয়া শুদ্ধ বাংলা ব্যবহার করিতেন। এখনও বাংলা ভাষায় প্রায় এক হাজার ফারসী বা ফারসীগত আরবী শব্দ ফারসী প্রভাবের পরিচয় দিতেছে।

গুটিকতক শিক্ষিত লোককে ছাড়িয়া দিলে, এখনও এই পুথি সাহিত্যই বাংলার বিশাল মুসলমান-সমাজের আনন্দ ও শিক্ষা সম্পাদন করিতেছে। পুঁথি পাঠক যখন সুর করিয়া পুঁথি পড়িতে থাকে; তখন শ্রোতৃবর্গ কখনও কারবালার শহীদগণের দুঃখে গলিয়া যায়, কখনও আমীর হামজার বা রোস্তমের বীরত্বে মাতিয়া ওঠে, কখন বা হাতেমের দয়ায় ভিজিয়া যায়। বেচারাদের আহার নিদ্রার কথা, ঘর-সংসারের কথা, চিরদৈন্যের কথা আর মনে থাকে না। দীনেশ বাবুর ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের’ ন্যায় কে আমাদের এই পুঁথি সাহিত্যের ইতিহাস রচনা করিবে?

যদি পলাশী ক্ষেত্রে বাংলার মুসলমানের ভাগ্য-বিপর্যয় না ঘটিত, তবে হয়ত এই পুঁথির ভাষাই বাংলার হিন্দু-মুসলমানের পুস্তকের ভাষা হইত। যাক সে কথা। অতীতকে যখন আমরা বদলাইতে পারিব না, তখন সে কথা লইয়া বেশী আলোচনায় লাভ কি? এখন বর্তমানে আমরা বুঝিয়াছি পুঁথির ভাষা আর চলিবে না। তাহার সময় গিয়াছে। অতীত যুগের জীব-কঙ্কালের ন্যায় তাহাকে কেবল দেখিবার জন্য রাখিয়া দাও। এখন আমাদের শিক্ষিত সমাজের রুচি সাধু ভাষার দিকে। এখন এই ভাষাই চলিবে। ইহাতেই লেখাপড়া করিতে হইবে। ইহাতেই আমাদের ভাবী বাঙ্গালার মুসলমান সাহিত্য রচনা করিতে হইবে। ইহাই হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙ্গালী জাতির ভাষা হইবে।

হিন্দু-মুসলমান মিলিয়া বাঙ্গালী জাতি গড়িয়া তুলিতে বহু অন্তরায় আছে। কিন্তু দূর ভবিষ্যতেই হউক না কেন, তাহাত করিতেই হইবে। বাঙ্গালী হিন্দু বাঙ্গালী মুসলমান ব্যতীত চলিতে পারিবে না। চিরকাল কি একভাবেই যাইবে? জগতের ইতিহাস পৃষ্ঠে কি হিন্দু-মুসলমান-মিলিত বাঙ্গালী জাতি, ফরাসী, ইংরাজ, ইতালিয়ান, জার্মান, জাপানী প্রমুখ জাতির ন্যায় নাম রাখিতে পারিবে না? আশা কানে কানে গুঞ্জন করিয়া বলে ‘পারিবে।’ উত্থান-পতন, পতন-উত্থান ইতিহাসেরত এই ধারা। যদি আমাদের এই মহামহীয়ান আদর্শ থাকে, তবে এখন হইতেই সেই আদর্শকে চোখের সামনে রাখিয়া চলিতে হইবে। এই আদর্শের অনুরোধে বলি ভাই মুসলমান আমাদের মিলনের শত বাধার মধ্যে আর এই ভাষার বাধা আনিও না; আর ভাই হিন্দু, তোমার নাটক-নভেলে মুসলমানের, শুধু মুসলমানের কেন-হিন্দু-মুসলমানের, বাদশাহ বেগমদিগের কালিমাখা মূর্তি কালি-মাখা কল্পনা দ্বারা আঁকিয়া আর তাহার ভগ্নহৃদয়ে বেদনা দিওনা।

আর এক কথা। মুসলমানের ধর্ম দেশগত বা জাতিগত ধৰ্ম্ম নহে। তাহা সার্ব্বজনীন ধৰ্ম্ম। মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য তাহার ধর্ম তাহার প্রতিবেশীকে বুঝাইয়া দেওয়া। সাহিত্যের ভিতর দিয়া আমাদিগকে ইসলামের মহত্ব ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব, ইসলামের সৌন্দর্য প্রচার করিতে হইবে। এ কথা অস্বীকার করিবার জো নাই যে, বাঙ্গালী হিন্দু মুসলমান ধৰ্ম্ম অপেক্ষা খ্রীষ্টান ধর্মের অধিক পক্ষপাতী। সে কি খ্রীষ্টান ইংরাজি সাহিত্যের প্রভাবে নহে? প্রচারের উদ্দেশ্যে আমাদিগকে আমাদিগের প্রতিবেশীর ভাষা গ্রহণ করিতে হইবে। যে ভাষা তাহাদিগের মর্ম স্পর্শ করে, সেই ভাষা ব্যবহার করিতে হইবে। হিন্দুর ভাষায় ইসলামী ভাব ফুটাইতে হইবে। কবি কি সুন্দর বলিয়াছেন-

যবাঁ কয বহরে দী গোঈ চে ইব্রানী চে সুরিয়ানী।

মকাঁ কয বহরে হক্ জোঈ চে জাবল্কা চে জাবলসা।

‘ধর্মের তরে আছে সব বাণী,

কি বা সে হিব্রু কিবা সুরিয়ানী।

সত্যের তরে খোঁজ সব ঠাঁই

পূব-পশ্চিম কোন ভেদ নেই।’

মুসলমানি বাঙ্গালা বাংলাদেশে প্রাদেশিক বুলির ন্যায় চলিত ভাষায় থাকিতে পারে, কিন্তু তাহা সাহিত্যের ভাষা হইবে না। জলকে পথ নির্দেশ করিয়া দিতে হয় না। সে আপনার পথ আপনি চিনিয়া লয়। বাঙ্গালার মুসলমানের মন আপনিই জানিতে পারিয়াছে কোন ভাষায় তাহার সাহিত্য রচিত হইবে। এখন মৌলানা, মৌলভী, পণ্ডিত, যিনিই বঙ্গ ভাষায় স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া কিছু লিখিতেছেন, তিনিই সাধু ভাষা ব্যবহার করিতেছেন। দুই একজন যদি কেহ মুসলমানি বাংলা চালাইতে চেষ্টা করেন বা তাহাতে বই লেখেন, তাহা শুধু কলমের জোরে। ইহাদেরই সমশ্রেণীর মহাত্মারা বাঙ্গালী মুসলমানের মাতৃভাষা কলমের জোরে উর্দু করিয়া দিতে চান। কখনও কখনও আমার মনে হয় হয়ত ইহাদের কলম বনমানুষের হাড়ে তৈরী, তাহা না হইলে এত গুণ কোথা হইতে আসিল?

বনমানুষের হাড়ে কত গুণ, নুনকে বানায় চুন, চুনকে বানায় বেগুন।

এখানে এক নতুন সমস্যা উপস্থিত হইতেছে। বর্তমানে বাংলা লেখকগণের মধ্যে ভাষার রীতি (style) লইয়া তিন দলের সৃষ্টি হইয়াছে। একদল কলিকাতার বিভাষাকে সামান্য একটু মাজিয়া-ঘষিয়া চালাইতে চান। এই দলের চাঁই ‘সবুজ পত্রের’ সম্পাদক প্রমথ বাবু। আমি রবি বাবুকে এই দলের প্রধান বলিয়া মনে করি। ইহাদিগকে চরমপন্থী বলা যাইতে পারে। দ্বিতীয় দল সাবেক দল। ইহারা ভাষার কোনও পরিবর্তন সহ্য করিতে পারেন না। ‘সাহিত্য’ পত্রিকা এই দলের মুখপত্র। ইহারা প্রাচীনপন্থী। তৃতীয় দল সকলের বোধগম্য সহজ সরল বাংলা প্রচলন করিতে চান। পরলোকগত অক্ষয় কুমার সরকার ও মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রভৃতি এই মতাবলম্বী। ইহাদিগকে মধ্যপন্থী বলা যাইতে পারে। এই তিন দলের মধ্যে কোন দলে আমরা যাইব? এই প্রশ্নের একটা গা-জোরি উত্তর না দিয়া ধীরভাবে আলোচনা করিয়া দেখা যাউক কোন   দলে আমাদের যাওয়া উচিত। যেমন রাজনীতির ক্ষেত্রে অভিজাত-তন্ত্র (Aristocracy) এবং গণতন্ত্র (Democracy) আছে, ভাষার ক্ষেত্রেও তদ্রূপ অভিজাত-তন্ত্র ও গণতন্ত্র আছে। ভারতীয় ভাষা হইতে আমি ইহার উদাহরণ দিতেছি। যে সময় ঋষিগণের মধ্যে বৈদিক ভাষা প্রচলিত ছিল, সেই সময় সাধারণ আর্যগণের মধ্যে বৈদিক হইতে কিছু ভিন্ন লৌকিক ভাষা প্রচলিত ছিল। বৈদিক ছিল অভিজাত-তন্ত্রের ভাষা, লৌকিক ভাষা অগ্রাহ্য অকথ্য। না স্নোচ্ছিতবৈ। নাপভাষিতবৈ। ম্লেচ্ছ ভাষা ব্যবহার করিও না। অপভাষা ব্যবহার করিওনা। যদি কর, প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে।’ ছিল গণতন্ত্রের ভাষা। ঋষিরা বলিলেন, ‘খবরদার। ব্যঞ্জনের উচ্চারণে কিংবা স্বরের উচ্চারণে যদি এক চুল পরিমাণ এদিক ওদিক হয় আর তোমার রক্ষা নাই। দেখনা অসুরেরা ‘হে অরুয়:’ ‘হেরুয়ঃ’ স্থানে ‘হেলয়: হেলয়:’ বলিয়াছিল, তাই তাহারা ধ্বংস হইয়া গেল। দেখ না, বৃত্রের পিতা পুত্রেষ্টি যজ্ঞে ইন্দ্রশত্রু শব্দ বলিতে স্বরে অপরাধ করিয়াছিল, তাই বৃত্র ইন্দ্রের জেতা না হইয়া ইন্দ্রই বৃত্রের নিহন্তা হইল।’ ঋষিদিগের শত সহস্র দোহাইতেও কিন্তু বৈদিক ভাষা পূজা অর্চ্চনায় ছাড়া অন্যত্র লৌকিক ভাষার নিকট টিকিতে পারিল না। গণতন্ত্রের নিকট অভিজাত-তন্ত্রের পরাজয় হইল।

পরবর্তীকালে উচ্চবর্ণেরা লৌকিক ভাষাকে মার্জিত করিয়া সংস্কৃত করিয়া লইল। সাধারণে লৌকিক ভাষা পালী ব্যবহার করিতে লাগিল। ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রকারেরা বলিলেন, ‘ন ম্লেচ্ছভাষাং শিক্ষেত, ম্লেচ্ছ ভাষা শিখিও না।’ তখন ব্রাহ্মণ্য কথা শুনিল না।

বৌদ্ধ গণতন্ত্রের পক্ষ লইল। পালী ভাষা এক বিপুল সাহিত্যের ভাষা হইল, গণতন্ত্রের নিকট অভিজাত-তন্ত্রের পরাজয় হইল। আর এক যুগ আসিল। এখন রাজশক্তি বৌদ্ধ। বৌদ্ধ এখন অভিজাত-তন্ত্রের দিকে। বৌদ্ধ এখন ধর্মের দোহাই দিয়া পালীকে ধরিয়া রাখিতে চাহিল; তখন কিন্তু গণতন্ত্রের পক্ষ লইল জৈন ধর্ম। তখন লৌকিক ভাষা প্রাকৃত। পালী প্রাকৃতের নিকট তিষ্টিতে পারিল না। গণতন্ত্রের নিকট অভিজাত-তন্ত্রের পরাজয় হইল।

আর এক যুগ আসিল। এ যুগ অন্ধকারময়। এ যুগে উচ্চ শ্রেণীর প্রকৃত নিম্ন শ্রেণীর অপভ্রংশের নিকট পরাজিত হইল। এই অপভ্রংশ হইল বাংলা, ওড়িয়া আসামী, হিন্দী, গুজরাতী, মারহাটী প্রভৃতি দেশীয় ভাষাসমূহের জননী।

তারপর আধুনিক যুগ। এ যুগে পণ্ডিতেরা সাধারণের ভাষাকে মাজিয়া-ঘষিয়া সাধু ভাষা করিয়া লইলেন। বিশাল জন সাধারণের ভাষাকে ইতর ভাষা বলিয়া ফেলিয়া রাখিলেন। বর্তমানে এই ইতর ভাষা পণ্ডিতের ভাষার উপর আত্মপ্রতিষ্ঠা করিতে চাহিতেছে। পণ্ডিত তাঁহার অন্ধ সংস্কৃত ভক্তির জন্য বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতের দুর্ব্বহ শিকলে বাঁধিতে চাহিতেছেন। আর ইতর ভাষা সেই শিকলকে কাটিতে চাহিতেছে। তাহার চেষ্টা সফল হইবে কি? যদি ভারতের ভাষা ইতিহাসের শিক্ষা মিথ্যা না হয়, তবে নিশ্চয়ই একদিন এই ইতর ভাষা সাধু ভাষাকে, যেমন লৌকিক বৈদিককে, পালী সংস্কৃতকে, প্রাকৃত পালীকে, অপংভ্রশ প্রাকৃতকে ঠেলিয়া দিয়াছিল, সেইরূপ ঠেলিয়া ফেলিবে। সাধু ভাষা মৃত ভাষারূপে পুস্তকে ঠাঁই পাইবে। যেমন মিলটন, জনসন প্রভৃতির ল্যাটিনবহুল ভাষা এখন কেবল কেতাবী ভাষা হইয়া রহিয়াছে, এখনকার সাধু ভাষার অবস্থাও সেইরূপ হইবে। পরিণামে চরমপন্থীরই জয় হইবে। তবে মধ্যম পন্থা বর্তমান পরিবন হইলেওপো (Transitional পেরি) জয় উপযুক্ত ভাষা বটে। একেবারে নি হইতে সা-তে সুর নামাইতে গেলা অনেকের কানে বেখাপ্পা লাগিবে নিশ্চয়ই।

কের কামোন শিক্ষাদান করে যে বহু প্রাদেশিক বিভাষার মধ্যে যে বিভাষায় বহু সদগ্রন্থ রচিত হয় বা যাহা রাজশক্তির আশ্রয় পায়, তাহা সাহিত্যের ভাষা হইয়া সুদাই জীবজগতের ন্যায় বিভাষাগুলির মধ্যেও যোগ্যতমের পরিত্রাণ-নীতি চলিয়া আসিতেছে। সাহিত্যিক শক্তিতে নবদ্বীপের বুলি সমস্ত বাংলার সাহিত্যের ভাষা হইয়া উঠিয়াছিল। এখন পুনরায় সাহিত্যিক শক্তিতে ও রাজশক্তির আশ্রয়ে কলিকাতার বুলি বাংলা সাহিত্যের ভাষা হইয়া উঠিতেছে। এখন বাংলার বিভিন্ন জেলার ভদ্রলোক আপোসে কথা-বার্তার জন্য কলিকাতার বুলিই ব্যবহার করেন।

সাহিত্যিক ভাষা হইয়া উঠিবার ইহাই সূচনা। তারপর রবিবাবু প্রমুখ কলিকাতাবাসী

সাহিত্যিকগণের প্রভাবে কলিকাতার বিভাষা সাহিত্যের ভাষার স্থান অধিকার করিতে চলিয়াছে।

ভাষার রীতি সম্বন্ধে আর একটি কথা বলিয়া এ সম্বন্ধে আমার বক্তব্য শেষ করিতেছি। একদল অন্ধ সংস্কৃতভক্ত বাংলা ভাষার মধ্যে প্রচলিত আরবী ফারসী শব্দগুলিকে যাবনিক বলিয়া বর্জন করিতে চাহেন। আমি বলি আগে তাঁহারা বাংলাদেশ হইতে যবনকে দূর করুন, পরে ভাষা হইতে যাবনিক শব্দগুলি দূর করিবেন। যখন সংস্কৃত ভাষা হোরা, কেন্দ্র, জামিত্র, দীনার প্রভৃতি গ্রীক শব্দ এবং ইক্কবাল, ইন্দুরার, মুকাবিলা প্রভৃতি আরবী শব্দ গ্রহণ করিয়াছে, তখন বাংলা ভাষার বেলায় আপত্তি কেন? ঐ সকল আরবী-ফারসী শব্দ বাংলা ভাষার অস্থিমজ্জাগত হইয়াছে। ভাষা হইতে ইহাদিগকে তাড়ান সহজ ব্যাপার হইবে না। দোয়াত, কলম, কাগজ, জামা, কামিজ, কমর, বগল প্রভৃতি এবং আইন, আদালতে প্রচলিত সর্ব্বসাধারণের সহজবোধ্য হাজার খানিক শব্দ ত্যাগ করিয়া নূতন শব্দ গড়িলে তাহা নামের জোরে পুস্তকে চলিতে পারে বটে, কিন্তু তাহা ভাষায় চলিবে না। বাংলা ভাষায় আরবী, ফারসী, তুরকী, ইংরাজি, ফরাসী, পর্তুগীজ প্রভৃতি যে কোন ভাষার শব্দ বেমালুম খাপ খাইয়া গিয়াছে, তাহারা নিজেদের দখলী স্বত্ববলে বাংলা ভাষায় থাকিবে। তাহাদিগকে তাড়াইতে গেলে জুলুম করা হইবে।

(জন্ম ১০ জুলাই ১৮৮৫, পেয়ারা গ্রাম, ২৪ পরগনা এবং মৃত্যু ১৩ জুলাই ১৯৬৯।)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *