এই প্রবন্ধে উল্লেখিত আন্দালুসি নারীদের জীবনীগুলো নেওয়া হয়েছে ইবন বাশকুয়ালের ‘কিতাব আল-সিলাহ’ (মৃত্যু: ১১৮৩ খ্রি.), ইবন আল-আব্বারের ‘তাকমিলাত কিতাব আল-সিলাহ (মৃত্যু: ১২৬০ খ্রি.) এবং ইবন আল-যুবায়রের ‘কিতাব সিলাত আল-সিলাহ (মৃত্যু: ১৪০৮ খ্রি.) থেকে। এই জীবনীসমূহে আন্দালুসের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও এমন নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যারা নবম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যে জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই জীবনীগ্রন্থ ও বিবরণসমূহ আন্দালুসের সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে এবং আধুনিক গবেষকদের জন্য মধ্যযুগে জ্ঞান-বিনিময়ে আন্দালুসি নারীদের ভূমিকা ভালোভাবে বোঝার সুযোগ করে দেয়।

১। ফাতিমা বিনতে ইয়হিয়া বিন ইউসুফ আল মাগামী
ফাতিমা ছিলেন বিখ্যাত ফকিহ ইউসুফ বিন ইয়াহইয়া আল-মাঘামীর বোন। নিঃসন্দেহে তিনি তার সময়ের সবচেয়ে জ্ঞানী, উদার ও প্রজ্ঞাশালী ব্যক্তিদের একজন ছিলেন। বসবাস করতেন কর্ডোভা শহরে এবং আনুমানিক ৩১৯ হিজরি (৯৫১ খ্রিস্টাব্দ) সালে সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। তাকে শহরের উপকণ্ঠে দাফন করা হয়। কোনো নারীর জন্য কর্ডোভা শহর এতবড় জানাজা আর কখনো দেখেনি।

২। আইশা বিনতে আহমদ বিন মুহাম্মদ বিন কাদিম
তিনি কর্ডোভার বাসিন্দা ছিলেন। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ইবন হাইয়ান বলেছিলেন, “তার যুগে পুরো আইবেরিয়ান উপদ্বীপে জ্ঞান, গুণ, সাহিত্য, কবিতা, বাগ্মীতা, চরিত্র, পবিত্রতা, উদারতা ও প্রজ্ঞায় তিনি ছিলেন অতুলনীয়।“ প্রায়ই তিনি তৎকালীন শাসকদের প্রশংসায় কবিতা লিখতেন এবং তাদের দরবারে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতেন। তিনি খুব দক্ষ ক্যালিগ্রাফার ছিলেন, বহু কোরআন শরিফ ও অন্যান্য বই নিজ হাতে নকল করেছিলেন। বই সংগ্রহে তার ছিল গভীর আগ্রহ ; তার সংগ্রহে ছিল অসংখ্য বই এবং জ্ঞান অর্জনে তিনি ছিলেন আন্তরিক। তিনি যথেষ্ট ধনীও ছিলেন বটে। চিরকুমারী মহীয়সী এই নারী ৪০০ হিজরিতে (১০০৯ খ্রিস্টাব্দে) ইন্তিকাল করেন।

৩। খাদিজা বিনতে জাফর আল-তামীমি
খাদিজা ছিলেন বিখ্যাত ফকিহ আবদুল্লাহ বিন আসাদের স্ত্রী। তিনি তার স্বামীর কাছ থেকে আল-কাআনাবি কর্তৃক বর্ণিত ইমাম মালিকের ‘মুওয়াত্তা’ হাদিস গ্রন্থ বর্ণনা করেছেন। এ বিষয়ে জ্ঞানার্জনের পরে ৩৯৪ হিজরিতে (১০০৩ খ্রি.) তিনি নিজ হাতে বইটি লিখে কপি করেন। প্রখ্যাত উস্তাদ আবুল হাসান ইবন আল-মুঘীস (রহ.) বলেছিলেন, বইটি তার নিজের সংগ্রহে ছিল।
৪। রাদিয়া
মহীয়সী রাদিয়া ছিলেন খলিফা আবদুর রহমান তৃতীয়ের দাসী, যিনি ‘নাজম’ নামেও সমধিক পরিচিত ছিলেন। খলিফা আল-হাকাম তাকে মুক্তি দেন। পরে তিনি লাবীব নামে এক ভৃত্যের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তারা দুজন মিলে ৩৫৩ হিজরিতে (৯৬৪ খ্রি.) হজ পালন করেন। রাদিয়া ও লাবীব উভয়েই লেখা-পড়ায় দক্ষ ছিলেন। আবু মুহাম্মদ ইবন খাযরাজ তার কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, তার কাছে রাদিয়ার লেখা অনেক বই ছিল। রাদিয়া প্রায় ১০০ বছর বয়সে ৪২৩ হিজরিতে (১০৩২ খ্রি.) ইন্তিকাল করেন।
৫। ফাতিমা বিনতে যাকারিয়া আশ-শিবলারি
ফাতিমা ছিলেন একজন বিশিষ্ট সচিব। তিনি ৯৪ বছরের বেশি হায়াত পেয়েছিলেন, যার বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেছিলেন দীর্ঘ চিঠিপত্র ও গ্রন্থ রচনায়। তার লেখা ছিল চমৎকার, কথাবার্তাও ছিল সাবলীল ও মার্জিত। ইবনে হাইয়ান তার কথা উল্লেখ করে বলেন, ফাতিমা বিনতে যাকারিয়া ৪২৭ হিজরিতে (১০৩৬ খ্রি.) ইন্তিকাল করেন।
৬। মারিয়াম বিনতে আবু ইয়াকুব আর শালাবি
তিনি ছিলেন একজন খ্যাতিমান কবি ও সাহিত্যিক। অনন্য ধর্মপ্রাণ ও শুদ্ধচারী এই ব্যক্তিত্ব নারীদের সাহিত্য পড়াতেন। আসবাগ ইবন আবু সাইয়্যিদ নামে এক কবি তার অনুপস্থিতিতে লেখা এক কবিতায় বলেন—“তাঁর মাঝে ছিল মারিয়াম (আ.)-এর মতো ধার্মিকতা ও সংযম, এবং কবি খানসার মতোই কাব্যিক প্রতিভা।”
৭। খাদিজা বিনতে আবু মুহাম্মদ আল-শান্তাজিয়াল
খাদিজা তার পিতার সঙ্গে সহীহ বুখারী ও অন্যান্য গ্রন্থ পড়েছিলেন বিখ্যাত আলেম আবু জর আব্দুল্লাহ বিন আহমদ আল-হারাওয়ির কাছ থেকে। তিনি মক্কায় আরও অনেক বড় আলেমের কাছ থেকেও জ্ঞান অর্জন করেন। পরে তিনি পিতার সঙ্গে আন্দালুসে সফর করেন এবং সেখানেই ইন্তিকাল করেন। আল্লাহ তার প্রতি রহম করুন।
৮। ওয়াল্লাদা বিনতে মুস্তাকফি বিল্লাহ মুহাম্মাদ
তিনি ছিলেন এক উচ্চমানের কবি ও সাহিত্যিক। তিনি খুবই প্রাঞ্জল বক্তা ছিলেন, অসাধারণ ছন্দে কবিতা লিখতেন। অন্যান্য কবি-সাহিত্যিকদের সাথেও তিনি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতেন। উস্তাজ আবু আব্দুল্লাহ ইবন মাক্কি (রহ.) বলেন, জ্ঞানে ও মর্যাদায় তার সমতুল্য কেউ ছিলেন না। ওয়াল্লাদা ৪৮৪ হিজরির ২ সফর, বুধবার (২৬ মার্চ ১০৯১ খ্রি.) মৃত্যুবরণ করেন।
৯। তাওয়িয়া বিনতে আব্দুল আজিজ ইবনে মুসা
তিনি হাবিবা নামেও সমধিক পরিচিত। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত খতিব ওঃ কারী আবু আল-কাসিম বিন মুদীরের স্ত্রী। স্বনামধন্য আলেম আবু উমর বিন আব্দুল বার (রহ.)-এর কাছ থেকে তিনি সরাসরি অনেক গ্রন্থ পড়েন ও বর্ণনা করেন। এছাড়া তিনি আব্দুল আব্বাস আহমদ বিন উমর আল-উধরীর বহু রচনাও শেখেন ও বর্ণনা করেন। মহীয়সী এই নারী ৪৩৭ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৫০৬ হিজরিতে মৃত্যুবরণ করেন।

১০। আল-শিফা
সুলতানা আল শিফা ছিলেন খলিফা আবদুর রহমান (দ্বিতীয়)-এর দাসী। পরে তিনি তাকে মুক্তি দেন এবং বিয়ে করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমতী, সুন্দরী, ধার্মিক, নম্র ও সম্মানিত নারীদের একজন। কর্ডোবার পশ্চিম উপশহরের কেন্দ্রে তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। খলিফার ছেলে মুহাম্মাদের (পরবর্তী আমীর) ছোট বেলায় তার মা তাহতাজ মারা গেলে আল-শিফাই তাঁকে লালন-পালন করেন। একটি সামরিক অভিযানের সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে খলিফা তাকে টলেডোর পাহাড়ি এলাকা আল-মানিয়্যাতে পাঠিয়ে দেন। তিনি সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন এবং সমাহিত হন। তার কবর একটি বিখ্যাত জিয়ারতের স্থানে পরিণত হয়। গ্রামের লোকজন তার কবরের যত্ন-আত্তিতে খুব মনোযোগী ছিল। ফলে বারবার তা সংস্কার করত। এই কারণে আমীর মুহাম্মাদ তাদের কর মওকুফ করে দেন।
১১। আল-বাহা
শাহজাদী বাহা ছিলেন খলিফা আবদুর রহমান (দ্বিতীয়) এর কন্যা। তিনি ছিলেন সৎ, পরহেজগার, সাধ্বী এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নারী। তিনি অনেক কোরআন শরিফ নিজ হাতে লিখে মসজিদ ও ওয়াকফে দান করতেন। রীতিমত দয়ার দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ইবনে হাইয়ান এবং আহমাদ আল-রাযি বলেন, কর্ডোবার রুসাফা এলাকায় তিনি ‘আল-বাহা’ মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। আরিব ইবন সাঈদের ‘তারীখ’ নামক গ্রন্থে লেখা আছে, তিনি ৩০৫ হিজরির রজব মাসে (৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে), আবদুর রহমান (তৃতীয়) আল-নাসিরের শাসনামলের শুরুর দিকে ইন্তিকাল করেন। তার জানাজায় সর্বস্তরের জনগণ উপস্থিত হয়েছিল।

১২। উম্মুল হাসান ছিলেন আবু লিওয়া সুলায়মান আল মাকনিসী
তার পূর্বপুরুষ ছিলেন উমাইয়া খলিফা সুলায়মান ইবন আবদুল মালিকের মাওলা (আযাদকৃত গোলাম)। তিনি বিখ্যাত মুহাদ্দিস বাকি ইবনে মাখলাদের একজন ছাত্রী ছিলেন। তার কাছেই হাদিস শিখতেন আর ‘কিতাব আদ-দুহুর’ নামে একটা বই পাঠ করতেন। তার ছেলে আবুল কাসিম সেই সময় বইটা হাতে নিয়ে বসে থাকতেন যেন ঠিকঠাক পড়া হচ্ছে কি না, সেটা দেখে নিতে পারেন।
উম্মুল হাসান শুধু জ্ঞানই অর্জন করেননি, হজও করেছেন। তিনি ছিলেন খুব ধার্মিক, বুদ্ধিমান আর সৎ একজন নারী। তাঁর কথা বলা হয়েছে ‘বাকি ইবনে মাখলাদের ফজিলত’ নামের গ্রন্থেও। আরেকজন ইতিহাসবিদ রাযী বলেছিলেন, বাকি উনার কাছ থেকে হাদিস শুনেছেন, কিন্তু অনেকে বলেন ব্যাপারটা উল্টা—উম্মুল হাসান আসলে বাকি ইবনে মাখলাদের কাছ থেকেই হাদিস শিখেছেন, বাকি উনার কাছ থেকে না।
খলিফা আবদুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান তার গ্রন্থ আল মুসকিতাহ এ বলেন, “উম্মুল হাসান প্রতি শুক্রবার বাকি ইবনে মাখলাদের হাদিসের দারসে যেতেন, সেটা হতো আবু আব্দুর রহমানের বাড়িতে। তিনি অসাধারণ একজন বিদুষী নারী ছিলেন। তার দাদা আবদুল্লাহ ছিলেন একজন সম্মানিত ও দানশীল ব্যক্তি। উম্মুল হাসান হজও করেছিলেন।“
২০২ হিজরিতে (৮১৮ খ্রি.) ‘ফিতনা দিবস’ নামে পরিচিত এক শুক্রবারে তিনি অনেক নির্যাতিত মানুষকে তার মসজিদে আশ্রয় দেন। পরে তিনি খলিফা আল-হাকামের কাছে চিঠি লিখে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অনুরোধ করেন, কারণ তারা পবিত্র আশ্রয়ে এসেছে। খলিফাও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে উত্তর পাঠান।
রাযী আরও বলেন, উম্মুল হাসানের বংশ ‘বানু ওয়ানসুস’ পরিবারটা ছিল এমন এক পরিবার যেখান থেকে অনেক জ্ঞানী-ধার্মিক নারী বের হয়েছেন। তাদের অন্তত ছয়জন নারী হজ করেছেন—তাদের মধ্যে ছিলেন উম্মুল হাসান, তাঁর আত্মীয় কুলায়বা, উম্মুর রহমান, উম্মুর রহিম, রুকাইয়া আর আয়েশা।

ইবন হাইয়ান বলেন, উম্মুল হাসান ছিলেন বিচারপতি মুনজির ইবনে সাঈদের বোন। তিনি কর্ডোবার এক মহল্লায় থাকতেন। খুব ভালো মানুষ ছিলেন, প্রায় সময় ইবাদতে মগ্ন থাকতেন নিজের মহল্লার মসজিদে। তার সঙ্গে অন্য ধার্মিক নারী আত্মীয়রাও থাকতেন। সবাই মিলে দোয়া-যিকির করতেন, সুফিদের জীবনী অধ্যয়ন করতেন আর দীন শিখতেন। নিজের দেশে তিনি ছিলেন সবার শ্রদ্ধার পাত্রী।
১৩। রুকাইয়া বিনতে তাম্মাম ইবন আমির
তিনি ছিলেন আবদুর রহমান ইবন উম্মুল হাকাম আল-সাকাফির মুক্ত দাসী। কর্ডোবার রাজপ্রাসাদে তিনি আমীর মুনযির ইবন মুহাম্মাদের মেয়ের ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে কাজ করতেন। তার দক্ষতা আর বিশ্বস্ততার জন্য তিনি প্রাসাদে সবার কাছে সম্মানিত ছিলেন।
১৪। লুবনা

ময়িয়সী লুবনা ছিলেন খলিফা আল-হাকাম আল-মুস্তানসিরের রাজপ্রাসাদের সচিব। তিনি খলিফা আবদুর রহমান আল-নাসিরের সচিব মুযনের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। লেখালেখি, ব্যাকরণ, আর কবিতায় তিনি ছিলেন অসাধারণ। গণিতে তার দক্ষতা ছিল বিস্ময়কর, আর অন্যান্য বিজ্ঞানেও তার গভীর জ্ঞান ছিল। উমাইয়া প্রাসাদে তার মতো উঁচু মর্যাদার নারী আর কেউ ছিল না। ৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন।
১৫। নিযাম
যিনি ছিলেন কর্ডোবার খলিফার প্রাসাদের একজন নারী সচিব। তিনি খলিফা হিশাম আল-মুয়াইয়াদের সময়ে (৯৭৬-১০০৯, ১০১০-১০১৩) প্রাসাদে কাজ করতেন। জ্ঞানী আর বাগ্মী এই নারী পত্রলিখনে ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী। আল-মুজাফফর আবদুল মালিকের জন্য তিনি একটি সরকারি নথি লিখেছিলেন, যেটা ছিল তার বাবা আল-মনসুরের মৃত্যুতে একটি শোকগীতি। সেই লেখায় বাবার স্মৃতি আর তার অধিষ্ঠানের কথা ফুটে ওঠে। এটি লেখা হয় ১০০২ খ্রিস্টাব্দে। ইবন হাইয়ান তার তারিখ আল-কবীর গ্রন্থে নিযামের জীবনী লিখেছেন।
১৬। ইশরাক আল-সুয়াইদা আল-আরুদিয়া
ইশরাক ছিলেন ভ্যালেন্সিয়ার বাসিন্দা। তিনি আবু আল-মুতাররিফ আবদুর রহমানের কাছে কর্ডোবায় আরবি, ব্যাকরণ, আর সাহিত্য শিখেছিলেন। শিক্ষকের কাছ থেকে শেখা শুরু করলেও, ইশরাক দ্রুতই তাকে ছাড়িয়ে যান। কবিতার তত্ত্ব আর উপস্থাপনায় তার জ্ঞান ছিল অসাধারণ। কোরআনের বিশেষজ্ঞ আবু দাউদ বলেছেন, “আমি তার কাছে কবিতা শিখেছি। তার সামনে আবু আলীর নাওয়াদির আর আল-মুবাররাদের আল-কামিল পড়েছি। তিনি এই দুটো বই মুখস্ত জানতেন আর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতেন।” তখন তিনি আল-সাইয়িদা বিনতি মুজাহিদের (যার নাম আসমা) সেবায় ছিলেন। আসমা ছিলেন আল-মনসুর আবু আল-হাসান আবদুল আজিজের স্ত্রী, যিনি ইশরাকের শিক্ষকের মৃত্যুর পর ভ্যালেন্সিয়ার শাসক ছিলেন।
১৭। ফাইজ আল-কুরতুবা
কর্ডোবার এই বিজ্ঞ নারী ছিলেন আবু আবদুল্লাহ ইবন উতাবের স্ত্রী। তার নাম ইতিহাসে সংরক্ষিত হয়নি। তিনি তার বিশাল জ্ঞান, সাহিত্যের দক্ষতা, আর অসাধারণ স্মৃতিশক্তির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। বাবার কাছ থেকে তিনি তাফসীর, ব্যাকরণ, আরবি, আর কবিতা শিখেছিলেন, আর স্বামীর কাছ থেকে ফিকহ আর সুফিবাদের জ্ঞান পেয়েছিলেন। তিনি কোরআনের বিশেষজ্ঞ আবু আমর আল-দানির কাছে পড়তে ডেনিয়ায় যান, কিন্তু পথে শুনতে পান আবু আমর অসুস্থ হয়ে মারা গিয়েছেন। ফাইজ আল কুরতুবা তার জানাজায় অংশগ্রহণ করেন, এবং আবু আমরের ছাত্রদের সন্ধান করে। তাকে আবু দাউদের কথা জানায় হলে তিনি তার কাছে গমন করেন। ১০৫২ খ্রিস্টাব্দে ভ্যালেন্সিয়াতে এসে ফাইজ আবু দাউদের কাছে কোরআনের সাত কিরাত শিখে তা মুখস্ত করেন। হজের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেও, ১০৫৪ খ্রিস্টাব্দে মিসরে তিনি ইন্তেকাল করেন।

১৮। জয়নব বিনতি আবি উমর ইউসুফ
জয়নব ছিলেন পূর্ব আন্দালুসের বাসিন্দা। তিনি বাবার কাছে পড়াশোনা করতেন। ধার্মিক আর পুণ্যবতী নারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। তিনি ছিলেন ইবন আবদুলবারের নাতি আবু মুহাম্মদ আবদুল্লাহের মা।
১৯। ফাতিমা বিনতি আবি আলী আল-হুসাইন
ফাতিমা মুরসিয়ার বাসিন্দা ছিলেন, যদিও তার পরিবার এসেছিল সারাগোজা থেকে। যখন তিনি ছোট ছিলেন, তার বাবা কুতান্দার যুদ্ধে যুদ্ধে গিয়ে মারা যান। তিনি কোরআন মুখস্ত করেছিলেন আর সেই শাশ্বত বিধান মেনেই সমগ্র জীবন কাটিয়েছেন। তিনি নিয়মিত হাদিস অধ্যয়ন করতেন, বিশেষ করে দোয়ার হাদিস। তার হাতের লেখা ছিল অপূর্ব, আর বই পড়তে তিনি ভালোবাসতেন। মুরসিয়ার ইমাম আবু মুহাম্মদ আবদুল্লাহ ইবন মুসার সাথে তার বিয়ে হয়েছিল। তাদের অনেক সন্তানের মধ্যেই একজন ছিলেন আবু বকর আবদুর রহমান। ১১৯৪ খ্রিস্টাব্দের পর ফাতিমা ইন্তেকাল করেন, তখন তার বয়স ছিল আশির ওপর।
২০। জয়নব (আলমোহাদ খলিফা আবু ইয়াকুব ইউসুফেরর কন্যা)
জয়নব ছিলেন আলমোহাদ খলিফা আবু ইয়াকুব ইউসুফের মেয়ে। তিনি আন্দালুসে জন্মেছিলেন আর তার মামাতো ভাই আবু জায়েদের সঙ্গে বিয়ে হয়। আবু আবদুল্লাহ ইবন ইব্রাহিমের কাছে তিনি ইলমুল কালাম সহ আরও অন্যান্য বিষয় পড়েছিলেন। ইবন সালিম বলেন, তিনি ছিলেন অসাধারণ পণ্ডিত, বুদ্ধিমতী, গভীর চিন্তাশীল, আর তার যুগের সবচেয়ে শিক্ষিত নারী। তার মৃত্যুর তারিখ জানা যায়নি।

২১। ফাতিমা বিনতি আবি আল-কাসিম
ফাতিমা উম্মুল ফতাহ নামে পরিচিত, তিনি ছিলেন কর্ডোবার বাসিন্দা। তিনি কোরআন মুখস্ত করেছিলেন, নাফির কিরাত শিখেছিলেন তার বাবার কাছে। বাবার তত্ত্বাবধানে তিনি অনেক বই পড়েছেন, যেমন আল মাক্কির তানবিহ, আল কুদাইয়ের আল-শিহাব, আর ইবন হিশামের সীরাত, এত তুফাইলির মুখতাসার, সহীহ মুসলিম, আল মুবাররাদের কামিল, আল বাগদাদীর নাওাদির। তার বাবা তাকে আরও অনেক বিষয়ে বিদ্বান করে তোলেন। তিনি সূফীদের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে লেখা তার বাবার কবিতাগুলোও মুখস্ত করেছিলেন। দুই মহান সূফী, আল-আন্দুজারী আর ইবন আল-মুফাদ্দালের তত্ত্বাবধানে তিনি কোরআন শিখেছিলেন। তার ছেলে আবু আল-কাসিম তার কাছ থেকে হাদিস শিখেছেন আর ওয়ারশ কিরাতে কোরআন মুখস্ত করেছেন। এভাবে পিতার কাছ থেকে পাওয়া সকল জ্ঞান তিনি তার সন্তানের মধ্যে প্রবাহিত করে দেন। ফাতিমা নিজের হাতে ছেলের জন্য একটি ইজাযা লিখেছিলেন, যা তার দক্ষতার স্বীকৃতি দেয়। ছেলে বলেন, আবু মারওয়ান ইবন মাসাররা তার মাকে এই ইজাযা দিয়েছিলেন। সেই মহান মনিষীই ফাতিমার নামকরণ করেছিলেন, আর তার জীবনে বরকতের জন্য দোয়া করেছিলেন। ১২১৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন, তাকে কর্ডোবার উম্ম সালামাহ কবরস্থানে দাফন করা হয়।
২২। জয়নব বিনতি মুহাম্মদ আল-জুহরী
তিনি আজিজা নামেও পরিচিত ছিলেন। তার বসবাস ছিল ভ্যালেন্সিয়ায়। তিনি তার মাতৃপুরুষ আবু আল-হাসান ইবন হুদাইলের কাছে পড়েছিলেন আর আবু উমর ইবন আবদুল বারের কিতাব আল-তাকাসসী মুখস্ত করেছিলেন। তার ছাত্র সংখ্যা কম ছিল, তবে অনেকে তার কাছে জ্ঞানের জন্য আসতেন। তার হাতের লেখা তেমন ভালো ছিল না। তিনি দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিলেন ; ইন্তেকাল করেন ১২৩৮ খ্রিস্টাব্দে। প্রখ্যাত কারী আবু দাউদের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। তিনি ১১৬০ খ্রিস্টাব্দে জন্মেছিলেন এবং ৮০ বছরের বেশি বেঁচেছিলেন।

২৩। সাইয়িদাহ বিনতি আবদুল ঘানি
তিনি উম্ম আল-আলা নামে পরিচিত, ছিলেন গ্রানাডার বাসিন্দা। তার বাবা মুসিয়ায় বসবাস করতেন, যদিও তার পরিবার মূলত লেইদা থেকে এসেছিল। বাবা ওরিহুয়েলার কাজী ছিলেন, কিন্তু তিনি ছোটবেলায় এতিম হন। শৈশবে মুরসিয়ায় তিনি কোরআন শিখেছিলেন। তার হাতের লেখা ছিল চমৎকার। তিনি তার পুরো জীবন রাজপ্রাসাদে শিক্ষকতা করে ব্যয় করেছেন। একটা সময় দীর্ঘ অসুস্থতায় তিনি তিন বছর ঘরবন্দী ছিলেন, সেই সময়েও তিনি তার দুই পাঠদান চালিয়ে যান। এর আগে গ্রানাডায় তার সাথে আবু জাকারিয়া আদ দিমাশকির সাথে দেখা হয়। এখান থেকেই তিনি অন্যদের কোরআন শিক্ষা দিতে শুরু করেন। অল্প কিছু সময়ের জন্য তিনি মরক্কোর ফেজে শিক্ষকতা করে গ্রানাডা ফিরে আসেন। পরে তিনি আবার তিউনিসে যান, সেখানে রাজপ্রাসাদে শিক্ষকতা করেন। নিজের হাতে তিনি গাযালীর ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন এর একটি পাণ্ডুলিপি কপি করেছিলেন। তিনি দোয়া, দান-খয়রাত, আর বন্দী মুক্তিতে নিজের সম্পদ ব্যয় করতেন। ১২৪৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি তিউনিসে ইন্তেকাল করেন। তাকে তিউনিসের উপকণ্ঠে এক মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়।
২৪। যুনাহ বিনতি আবদুল আজিজ
যুনাহ উম্ম হাবিবা নামে পরিচিত, তিনি ছিলেন আবু আল-কাসিম ইবন মুদিরের স্ত্রী। তিনি আবু উমর ইবন আবদুল বার আর আল-উযরীর কাছে পড়েছিলেন। তার স্বামীও তার সাথে পড়াশোনা করেছেন। তার হাতের লেখা ছিল মার্জিত। তিনি ছিলেন মহৎ, দয়ালু, আর ধার্মিক। ১০৪৫ খ্রিস্টাব্দে জন্ম নিয়ে ১১১২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন।
২৫। লায়লা
লায়লা ছিলেন মুরসিয়ার উজির আবু বকর ইবন আল-খাতাবের মুক্ত করা একজন নারী। কাজী আবু বকর ইবন আবি জামরা তাকে তার যুগের সবচেয়ে জ্ঞানী নারী বলেছেন। তার জ্ঞান, ধার্মিকতা, আর পুণ্যবুদ্ধির জন্য গ্রানাডার প্রধান কাজী আবু আল-কাসিম তাকে বিয়ে করেন। অনেকে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেও, তিনি শুধু আবু আল-কাসিমকে বেছে নেন। তাদের ভালোবাসা এত গভীর ছিল, যা দেখে সমালোচকেরা কটু কথা পর্যন্ত বলত। ৫২৮ হিজরি মোতাবেক তিনি ১১৩৩ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন, একই বছর মহীয়সী লায়লার গ্রানাডার বিচারকের পদে আসীন হবার কথা ছিল।
২৬। হাফসা
তিনি ছিলেন প্রখ্যাত ফকীহ ও কাজী আবু ইমরান মুসা ইবন হাম্মাদের মেয়ে। তিনি কাজী আবু বকর মুহাম্মদ ইবন আলীর স্ত্রী ছিলেন। সমগ্র কোরআন মুখস্ত করেছিলেন, তার হাতের লেখা ছিল দারুণ। ধর্মতত্ত্ব আর ফিকহে তার জ্ঞান ছিল বিশাল। তিনি বিচারকার্য সমাধানের জন্য তার বাবার ফতোয়া উদ্ধৃত করতেন। ১১২৫ খ্রিস্টাব্দে জন্ম নিয়ে তিনি গ্রানাডায় ইন্তেকাল করেন।
২৭। হাফসা বিনতি আবি আবদুল্লাহ
হাফসা, যিনি ইবন আরূস নামে পরিচিত, কোরআনের সাত কিরাত মুখস্ত করেছিলেন বাবার কাছে। তিনি অনেক হাদিসের গ্রন্থ , সাহিত্য, এবং মুয়াত্তা মুখস্থ করেছিলেন। আল-মালাহী বলেন, তিনি তার পিতার মামা আবু বকর ইয়াহিয়ার সামনে মুয়াত্তা মুখস্ত শুনিয়েছিলেন। তিনি বাগ্মী ছিলেন আর কঠিন হস্তলিপিও পড়তে পারতেন। মাত্র ২৭ বছর বয়সে, ১১৮৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন।
২৮। আয়িশা বিনতি আবু আল-খাত্তাব মুহাম্মদ
আয়িশা ছিলেন বিখ্যাত বিচারক আবু আল-খাত্তাব মুহাম্মদ ইবন আহমদ ইবন খলিলের মেয়ে। তিনি তার বাবার কাছ থেকে হাদিস শিখেছিলেন এবং তার তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা করেছিলেন (আল্লাহ তার প্রতি রহম করুন)। এছাড়া অন্যান্য উলামার কাছ থেকেও তিনি হাদিস বর্ণনার অনুমতি (ইজাযা) পেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তার লেখায় তাদের নাম উল্লেখ করতেন না। তিনি ছিলেন ধার্মিক নারীদের একজন, যিনি তার নিজের বংশ এবং অন্যান্য পরিবারের ইতিহাসের অনেক কিছু বর্ণনা করেছেন। তিনি ছিলেন সতর্ক, সজাগ এবং অসাধারণ বুদ্ধিমতী। তার ছাত্র সংখ্যা ছিল খুবই কম।