আধুনিকতার সংজ্ঞা আসলে কী?
সত্যিকারের আধুনিকতা হলো, মানবতার কল্যাণে যুগোপযোগী জ্ঞান ও চিন্তাকে হাজির করা এবং সেগুলোকে সভ্যতার অগ্রগতিতে যথাযথভাবে কাজে লাগানো। কিন্তু আধুনিকতার ধারণাকে আজকে আমরা সম্পূর্ণ গুলিয়ে ফেলেছি। আজকে আমাদের কাছে আধুনিকতা মানে নিজেদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয় ভুলে গিয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্তঃসারশূন্য ‘কালচার’কে গ্রহণ করা; যেগুলো আমাদের মাতৃভূমির মাটি ও মানুষের সাথে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নয়। এই তথাকথিত সভ্যতার কালচার মানুষকে ধীরে ধীরে আধ্যাত্মিকতা বা স্পিরিচুয়ালিটি থেকে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে আমাদের মানসিক প্রশান্তিকে বিনষ্ট করেছে; রূহকে করেছে মৃতপ্রায়।
আল্লামা ইকবাল বলেন, “ইউরোপীয় সভ্যতায় মন ও অন্তর্দৃষ্টির বিনাশের ফলে সমাজ তার প্রাণ পবিত্র রাখতে পারেনি। রূহের পবিত্রতা না থাকলে পবিত্র মন, উচ্চ চিন্তাধারা ও সূক্ষ্ম অনুভূতিও বিদ্যমান থাকে না। ফলে মন আলোকবিহীন ও জীবন আনন্দবিহীন হয়, যা এই সভ্যতার উপর সাংঘাতিক প্রভাব বিস্তার করে এবং তাকে এক যান্ত্রিক কারিগরী রঙ দিয়ে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ হতে সংযোগ ছিন্ন করার দরুণ আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।”
আমরা কালচার এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ‘সংস্কৃতি’ ব্যবহার করি। পাশ্চাত্যের কালচার আসলে সামগ্রিক হয়ে উঠেনি। সংস্কৃতি একটি ব্যপক অর্থবহ শব্দ। সংস্কৃতির যেমন দেহ আছে, তেমনি এর একটি আত্মিক দিকও আছে। মানুষের শিক্ষা, মূল্যবোধ, বিশ্বাস এবং ধ্যান-ধারণা সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে, এর আত্মা বা রুহকে গঠন করে। স্থান-কাল, ভাষা এবং আঞ্চলিক ঐতিহ্য একে বাহ্যিক অবয়ব দিয়ে থাকে। ফলে, স্বভাবতই ধর্মের সাথে সংস্কৃতির একটা সূক্ষ্ম, কিন্তু গভীর সম্পর্ক রয়েছে। অঞ্চলভেদে, যুগভেদে এর অবয়ব পরিবর্তিত হয়। আরবের সংস্কৃতির সাথে ভারতের সংস্কৃতির একটা পার্থক্য আছে, ভারতের সাথে চীনের সংস্কৃতির একটা পার্থক্য আছে। কিন্তু একইসাথে ভারতীয় মুসলমানের সংস্কৃতির সাথে আরবের মুসলমানের সংস্কৃতির মৌলিক একটা মিলও আছে। উভয়ের প্রধান উৎসব ঈদ; কিন্তু উদযাপন রীতিতে দুই অঞ্চলের মধ্যে পার্থক্য আছে। ভারতবর্ষে বসবাসকারী একজন মুসলমান একইসাথে ভারতীয় এবং মুসলমান। তার খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-আশাক, আচার-আচরণ, উৎসব-অনুষ্ঠান সবকিছুতে সেটি ফুটে ওঠে। মূলত এভাবেই সংস্কৃতির বিনির্মাণ হয়। আবার সময়ের প্রয়োজনেও সংস্কৃতির বাহ্যিক অবয়বে পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু আজকের পাশ্চাত্য এই বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে, নিজেদের মতো করে সংস্কৃতির একটি মানদন্ড দাঁড় করিয়েছে এবং সারা দুনিয়ার মানুষের উপর সেটিকেই চাপিয়ে দিয়েছে। এটি মূলত তাদের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। দুনিয়াব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রভাব বিস্তারের অন্যতম উপকরণ তাদের এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। এর জন্য তারা আবার আমাদের দ্বীনকেই অনেকক্ষেত্রে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। ওরিয়ান্টালিস্টদের ব্যাখ্যাকৃত হাদীস এবং ফিকহের মাধ্যমে তারা আমাদের দ্বীনকে সংকীর্ণ এবং সংস্কৃতিকে হারাম হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছে। তারপর তারা আমাদের সামনে হাজির করেছে হলিউডকে। এর মাধ্যমে তারা চায়, তারা যেভাবে কথা বলে, সবাই সেভাবে কথা বলবে। তারা যেভাবে চলে, সবাই সেভাবে চলবে। তারা যতটুকু চাইবে, আমরা ততটুকুই জানবো, ততটুকুই বুঝবো; এর বেশিওনা, কমওনা।
ভয়ংকর বিষয় হলো, তাদের এই ফাঁদে পা দিয়ে আমরা সচেতন বা অবচেতনেভাবে আজ সবাই পাশ্চাত্যকে অন্ধভাবে অনুসরণ করছি। পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ আমাদের জাতিসত্ত্বার স্বকীয়তাকে বিনষ্ট করেছে। আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ভিত্তিকে বিনষ্ট করেছে। আমাদের উৎসব-অনুষ্ঠানসমূহ হারিয়ে গেছে, সেখানে জায়গা করে নিয়েছে পাশ্চাত্যের তথাকথিত বিভিন্ন দিবস ও উৎসব। আমরা আমাদের হাজার বছর ধরে লালিত মূল্যবোধকে হারিয়ে ফেলেছি। পাশ্চাত্য আমাদের শিষ্টাচার ও আদবকে গ্রহণ করেছে, অন্যদিকে আমরা আধুনিকরার নামে সেসব শিষ্টাচার ও আদবকে হারাতে বসেছি। আমাদের পরিবার এবং সামাজিক কাঠামো ভেঙ্গে গেছে। আজ আমরা আত্মপরিচয় এবং নিজেদের হাজার বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাসকে ভুলে এমন এক বিভ্রান্ত জাতিতে পরিণত হয়েছি, যে জাতি অন্ধভাবে পাশ্চাত্যের অনুসরণের মধ্যেই মর্যাদা, উন্নতি, অগ্রগতি ও সুখ খুঁজে। আমাদের অবস্থা এতটাই দূর্বিষহ যে আমরা আমাদের বিবেক-বুদ্ধি বেচে দিয়ে তার বিনিময়ে পাশ্চাত্যের দাসত্বের মধ্যেই আত্মতৃপ্তি খুঁজে নিয়েছি। কিন্তু সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষের এমন আচরণ আল্লাহ প্রদত্ত মানবিক মর্যাদার সাথে চরম সাংঘর্ষিক। একইসাথে পাশ্চাত্যের খাবারগুলোও একেকটা slow poison এর মতো কাজ করে। এগুলো হাজারও রোগের সৃষ্টি করে মানুষকে খুব দ্রূতই শারীরিক ও মানসিকভাবে দূর্বল করে দিচ্ছে এবং তাদের ঔষধ বানিজ্যের চক্রের মধ্যে বন্দী করে ফেলছে ক্রমাগত।
অপরদিকে আমরা যদি নিজেদের ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে সর্বাগ্রে হক, আদালত, আখলাক, হাকীকত এবং মানবিক মর্যাদাকে সুউচ্চে স্থাপনকারী পৃথিবীর এক সর্বাধুনিক সভ্যতার সন্তান হিসেবে নিজেদের আবিষ্কার করবো; যে সভ্যতার জ্ঞান ও সম্পদ চুরি করেই আজ পাশ্চাত্য তাদের তথাকথিত সভ্যতাকে তৈরী করেছে, সেই তথাকথিত আধুনিক সভ্যতার চূড়ায় বসে নিজেদেরকে সভ্য জাতি বলে দাবি করছে।
একইসাথে আমাদের ছিলো সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। যে সংস্কৃতি এ অঞ্চলের মাটি এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যকে ধারণ করে, যে সংস্কৃতি এখানকার মানুষের বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে ধারণ করে।
অন্ধভাবে পাশ্চাত্যকে অনুসরণ না করে আমাদের উচিত ছিল নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে হৃদয়ে ধারণ করে, সেই সর্বাধুনিক সভ্যতার উত্তরসূরী হিসেবে নিজেদের দেশ ও জাতিকে যুগের আলোকে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বাধুনিক জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করে যাওয়া।
কিন্তু আফসোস আজকের এই তথাকথিত আধুনিক সভ্যতায় আমাদের জাতির কিছু মানুষকে ময়লা পরিষ্কার করার জন্য ডাস্টবিনে নামতে হয়, ফুটপাথে খোলা আকাশের নীচে ঘুমায় অজস্র মানুষ, পেটের দায়ে ইজ্জত বিক্রি করতে বাধ্য হয় কত মা-বোন। আমাদের দেশের মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলো, যেখানে মানুষের জীবন নিয়ে কাজ করা হয়, সেখানে সর্বাধুনিক ইনস্ট্রুমেন্ট থাকা তো দূরের কথা, অপরিহার্য ইনস্ট্রুমেন্টের চরম অভাব। প্রয়োজনীয় বেড, ঔষধ আরও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা-সামগ্রীর ঘাটতি তো আছেই। প্রয়োজনীয় ইনস্ট্রুমেন্টের অভাবে প্রকৃত মেডিকেল প্রটোকল যথাযথভাবে সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না, যে কারণে রোগীদের এক প্রকার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে দিয়ে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যেখানে চারদিকে আধুনিকতার জয়-জয়কার, সেখানে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আজ গবেষণা যেন বিলাসীতা। ফলে পশ্চিমাদের মেয়াদোত্তীর্ণ প্রযুক্তিই আমাদের শেষ ভরসা হয়ে উঠছে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের আজকের সভ্যতায় আধুনিকতা নেই, আছে দাসত্ব আর অনুকরণ।
একসময় সারা পৃথিবীতে খাদ্য রপ্তানিকারী আমাদের এই বাংলা অঞ্চলের কৃষকরা আজ সবচেয়ে অসহায় ও দূর্বীষহ জীবনযাপন করছে। কিন্তু আমাদের দেশে সাতের অধিক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থাকার পরও আমরা আমাদের সবচেয়ে বড় নিয়ামত, এই উর্বর মাটিকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছি। একসময় এই মাটিতেই সোনালী ফসল ফলিয়ে বাংলা অঞ্চলকে বিশ্বদরবারে সমাদৃতকারী দেশের রত্ন, সেই সম্মানিত কৃষকদের অবস্থার পরিবর্তন করতে পারছি না।
বর্তমানে যেসব সেক্টরে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন হয়েছে সেগুলো অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু অধিকাংশ সেক্টরেই প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এখন সময়ের প্রয়োজন। এই বৈষম্য বা সমন্বয়হীনতার কারণ কি আমাদের জানা আছে বা কখনও জানার প্রয়োজন মনে করেছি? প্রচেষ্টা চালিয়েছি?
এসব ক্ষেত্রে হাজার-হাজার সমস্যার পেছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো পশ্চিমা চেতনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সবসময় জাতির সামগ্রিক কল্যাণের কথা চিন্তা না করে ব্যক্তি তথা নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা। পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী সভ্যতা আমাদের আত্মকেন্দ্রিক হতে বলে। কিন্তু আমাদের ইসলামের আখলাক এই লিবারেল আখলাকের সম্পূর্ণ বিপরীত। রাসূল (সা) বলেন,
“কোন ব্যক্তি পূর্ণাঙ্গ মুমিন হতে পারবে না, যতোক্ষণ না সে নিজের জন্য যা পছন্দ করবে তার ভাইয়ের জন্যও তাই পছন্দ করবে।”
তাই আমাদের উচিত ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে ইসলামী সভ্যতার বীজ সর্বপ্রথম যেখানে বপন করা হয়েছিল, সেই ইয়াসরিব তথা মদিনার আখলাককে বিশ্বমানবতার সামনে উপস্থাপন করতে সংগ্রাম করে যাওয়া। ইসলাম আমাদের সামগ্রিক হতে শেখায়। আমাদেরকে উম্মাহর একজন সদস্য হয়ে সমগ্র উম্মাহর কল্যাণকামী হতে শেখায়। মানবতার কল্যাণকে সর্বাগ্রে রেখে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে ইসলাম।
সর্বোপরি, আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পাটাতনের উপর দাঁড়িয়ে, আখলাক ও আধ্যাত্মিকতার সংমিশ্রণে নিজেদের ঈমানের রঙকে ধারণ করে, একইসাথে সর্বাধুনিক জ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমেই আমরা একটি আধুনিক সভ্যতা বিনির্মানের দাবী করতে পারি।